পথের কাঁটা (ব্যোমকেশ বক্সী) – শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়
এক
ব্যোমকেশ খবরের কাগজখানা সযত্নে পাট করিয়া টেবিলের এক পাশে রাখিয়া দিল। তারপর চেয়ারে হেলান দিয়া বসিয়া অন্যমনস্কভাবে জানালার বাহিরে তাকাইয়া রহিল।
বাহিরে কুয়াশা-বর্জিত ফাল্গুনের আকাশে সকালবেলার আলো ঝলমল করিতেছিল। বাড়ির তেতলার ঘর কয়টি লইয়া আমাদের বাসা, বসিবার ঘরটির গবাক্ষপথে শহরের ও আকাশের একাংশ বেশ দেখা যায়। নীচে নবোদ্বুদ্ধ নগরীর কর্মকোলাহল আরম্ভ হইয়া গিয়াছে। হ্যারিসন রোদের উপর গাড়ি-মোটর-ট্রামের ছুটাছুটি ও ব্যস্ততার অন্ত নাই। আকাশেও এই চাঞ্চল্য কিয়ৎপরিমাণে প্রতিফলিত হইয়াছে। চড়াই পাখিগুলো অনাবশ্যক কিচিমিচি করিতে করিতে আকাশে উড়িয়া বেড়াইতেছে; তাহাদের অনেক ঊর্ধ্বে একঝাঁক পায়রা কলিকাতা শহরটাকে নীচে ফেলিয়া যেন সূর্যলোক পরিভ্রমণ করিবার আশায় ঊর্ধ্ব হইতে আরো ঊর্ধ্বে উঠিতেছে।
বেলা প্রায় আটটা, প্রভাতী চা ও জলখাবার শেষ করিয়া আমরা দুইজন অলসভাবে সংবাদপত্রের পৃষ্ঠা হইতে বহির্জগতের বার্তা গ্রহণ করিতেছিলাম।
ব্যোমকেশ জানালার দিক্ হইতে চক্ষু ফিরাইয়া বলিল–“কিছুদিন থেকে কাগজে একটা মজার বিজ্ঞাপন বেরুচ্ছে, লক্ষ্য করেছ?”
আমি বলিলাম–“না। বিজ্ঞাপন আমি পড়ি না।”
ভ্রু তুলিয়া একটু বিস্মিতভাবে ব্যোমকেশ বলিল–“বিজ্ঞাপন পড় না? তবে পড় কি?”
“খবরের কাগজে সবাই যা পড়ে, তাই পড়ি–খবর।”
“অর্থাৎ মাঞ্চুরিয়ার কার আঙুল কেটে গিয়ে রক্তপাত হয়েছে আর ব্রেজিলে কার একসঙ্গে তিনটে ছেলে হয়েছে, এই পড়! ওসব পড়ে লাভ কী? সত্যিকারের খাঁটি খবর যদি পেতে চাও, তাহলে বিজ্ঞাপন পড়।”
ব্যোমকেশ অদ্ভুত লোক, কিন্তু সে পরিচয় ক্রমশ প্রকাশ পাইবে। বাহির হইতে তাহাকে দেখিয়া বা তাহার কথা শুনিয়া একবারও মনে হয় না যে, তাহার মধ্যে অসামান্য কিছু আছে।
কিন্তু তাহাকে খোঁচা দিয়া, প্রতিবাদ করিয়া, একটু উত্তেজিত করিয়া দিতে পারিলে ভিতরকার মানুষটি কচ্ছপের মত বাহির হইয়া আসে। সে স্বভাবত স্বল্পভাষী, কিন্তু ব্যঙ্গবিদ্রুপ করিয়া একবার তাহাকে চটাইয়া দিতে পারিলে তাহার ছুরির মত শাণিত ঝক্ঝকে বুদ্ধি সঙ্কোচ ও সংযমের পর্দা ছিঁড়িয়া বাহির হইয়া পড়ে, তখন তাহার কথাবার্তা সত্যই শুনিবার বস্তু হইয়া দাঁড়ায়।
আমি খোঁচা দিবার লোভ সামলাইতে পারিলাম না, বলিলাম–“ও, তাই না কি? কিন্তু খবরের কাগজওয়ালারা তাহলে ভারি শয়তান, সমস্ত কাগজখানা বিজ্ঞাপনে ভরে না দিয়ে কতকগুলো বাজে খবর ছাপিয়ে পাতা নষ্ট করে।”
ব্যোমকেশের দৃষ্টি প্রখর হইয়া উঠিল। সে বলিল–“তাদের দোষ নেই। তোমার মত লোকের চিত্তবিনোদন না করতে পারলে বেচারাদের কাগজ বিক্রি হয় না, তাই বাধ্য হয়ে ঐ সব খবর সৃষ্টি করতে হয়। আসল কাজের খবর থাকে কিন্তু বিজ্ঞাপনে। দেশের কোথায় কি হচ্ছে, কে কি ফিকির বার করে দিন-দুপুরে ডাকাতি করছে, কে চোরাই মাল পাচার করবার নূতন ফন্দি আঁটছে–এইসব দরকারী খবর যদি পেতে চাও তো বিজ্ঞাপন পড়তে হবে। রয়টারের টেলিগ্রামে ওসব পাওয়া যায় না।”
আমি হাসিয়া বলিলাম–“তা পাওয়া যায় না বটে, কিন্তু,–থাক–। এবার থেকে না হয় বিজ্ঞাপনই পড়ব। কিন্তু তোমার মজার বিজ্ঞাপনটা কি শুনি?”
ব্যোমকেশ কাগজখানা আমার দিকে ছুঁড়িয়া দিয়া বলিল–“পড়ে দেখ, দাগ দিয়ে রেখেছি।”
পাতা উল্টাইতে উল্টাইতে এক কোণে একটি অতি ক্ষুদ্র তিন লাইনের বিজ্ঞাপন দৃষ্টিগোচর হইল। লাল পেন্সিল দিয়া দাগ দেওয়া ছিল বলিয়াই চোখে পড়িল, নচেৎ খুঁজিয়া বাহির করিতে বিশেষ বেগ পাইতে হইত।
“পথের কাটা”
“যদি কেহ পথের কাটা দূর করিতে চান, শনিবার সন্ধ্যা সাড়া পাঁচটার সময় হোয়াইটওয়ে লেড্ল’র দোকানের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে ল্যাম্পপোস্টে হাত রাখিয়া দাঁড়াইয়া থাকিবেন।”
দুই-তিনবার পড়িয়াও বিজ্ঞাপনের মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝিতে পারিলাম না, বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম–“ল্যাম্পপোস্টে হাত রেখে মোড়ের মাথায় দাঁড়ালেই পথের কাঁটা দূর হয়ে যাবে! এ বিজ্ঞাপনের মানে কি? আর পথের কাঁটাই বা কি বস্তু?”
ব্যোমকেশ বলিল–“সেটা এখনও আবিষ্কার করতে পারিনি। বিজ্ঞাপনটা তিন মাস ধরে ফি শুক্রবার বার হচ্ছে, পুরনো কাগজ ঘাঁটলেই দেখতে পাবে।”
আমি বলিলাম–“কিন্তু এ বিজ্ঞাপনের সার্থকতা কি? কোনও একটা উদ্দেশ্য নিয়েই তো লোকে বিজ্ঞাপন দিয়ে থাকে? এর তো কোন মানেই হয় না!”
ব্যোমকেশ বলিল–“আপাতত কোনও উদ্দেশ্য দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না বটে, কিন্তু তাই বলে উদ্দেশ্য নেই বলা চলে না। অকারণে কেউ গাঁটের কড়ি খরচ করে বিজ্ঞাপন দেয় না। –লেখাটা পড়লে একটা জিনিস সর্বাগ্রে দৃষ্টি আকর্ষণ করে।”
“কি?”
“যে ব্যক্তি বিজ্ঞাপন দিয়েছে, তার আত্মগোপন করবার চেষ্টা। প্রথমত দেখ, বিজ্ঞাপনে কোনও নাম নেই। অনেক অস্ময় বিজ্ঞাপনে নাম থাকে না বটে, কিন্তু খবরের কাগজের অফিসে খোঁজ নিলে নাম-ধাম সব জানতে পারা যায়। সে রকম বিজ্ঞাপনে বক্স-নম্বর দেওয়া থাকে। এতে তা নেই। তারপর দেখ, যে লোক বিজ্ঞাপন দেয়, সে জনসাধারণের সঙ্গে কোনও একটা কারবার চালাতে চায়–এ ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। কিন্তু মজা এই যে, এ লোকটি নিজে অদৃশ্য থেকে কারবার চালাতে চায়।”
“বুঝতে পারলুম না।”
“আচ্ছা, বুঝিয়ে বলছি, শোন। যিনি এই বিজ্ঞাপন দিচ্ছেন, তিনি জনসাধারণকে ডেকে বলছেন–‘ওহে, তোমরা যদি পথের কাঁটা দূর করত চাও তো অমুক সময় অমুক স্থানে দাঁড়িয়ে থেকো–এমনভাবে দাঁড়িয়ে থেকো–যাতে আমি তোমাকে চিনতে পারি।’–পথের কাঁটা কি পদার্থ, সে তর্ক এখন দরকার নেই, কিন্তু মনে কর তুমি ঐ জিনিসটা চাও। তোমার কর্তব্য কি? নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে ল্যাম্পপোস্ট ধরে দাঁড়িয়ে থাকা। মনে কর, তুমি যথাসময় সেখানে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইলে। তারপর কি হল?”
“কি হল?”
“শনিবার বেলা পাঁচটার সময় ঐ জায়গায় কি রকম লোক-সমাগম হয় সেটা বোধ হয় তোমাকে বলে দিতে হব এনা। এদিকে হোয়াইটওয়ে নেড্ল, ওদিকে নিউ মার্কেট, চারিদিকে গোটা পাঁচ-ছয় সিনেমা হাউস। তুমি ল্যাম্পপোস্ট ধরে আধঘণ্টা দাঁড়িয়ে রইলে আর লোকের ঠেলা খেত এলাগলে, কিন্তু যে আশায় গিয়েছিলে, তা হল না–কেউ তোমার পথের কাঁটা উদ্ধার করয়াব্র মহৌষধ নিয়ে হাজির হল না। তুমি বিরক্ত হয়ে চলে এলে, ভাবলে, ব্যাপারটা আগাগোড়া ভূয়ো। তারপর হঠাৎ পকেটে হাত দিয়ে দেখলে, একখানা চিঠি কে ভিড়ের মধ্যে তোমার পকেটে ফেলে দিয়ে গেছে।”
“তারপর?”
“তারপর আর কি? চোরে-কামারে দেখা হল না অথচ সিঁধকাটি তৈরী হবার বন্দোবস্ত হয়ে গেল। বিজ্ঞাপনদাতার সঙ্গে তোমার লেনদেনের সম্বন্ধ স্থাপিত হল অথচ তিনি কে, কি রকম চেহারা, তুমি কিছুই জানতে পারলে না।”
আমি কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়ে বলিলাম–“যদি তোমার যুক্তিধারাকে সত্যি বলেই মেনে নেওয়া যায়, তাহলে কি প্রমাণ হয়?”
“এই প্রমাণ হয়ে যে, ‘পথের কাটা’র সওদাগরটি নিজেকে অত্যন্ত সঙ্গোপনে রাখতে চান এবং যিনি নিজের পরিচয় দিতে এত সঙ্কুচিত, তিনি বিনয়ী হতে পারেন, কিন্তু সাধু-লোক কখনই নন।”
আমি মাথা নাড়িয়া বলিলাম–“এ তোমার অনুমান মাত্র, একে প্রমাণ বলতে পার না।”
ব্যোমকেশ উঠিয়া ঘরে পায়চারি করিতে করিতে কহিল,–“আরে, অনুমানই তো আসল প্রমাণ। যাকে তোমরা প্রত্যক্ষ প্রমাণ বলে থাকো, তাকে বিশ্লেষণ করলে কতকগুলো অনুমান বৈয়ার কিছুই থাকে না। আইনে যে circumstantial evidence বলে একটা প্রমাণ আছে, সেটা কি? অনুমান ছাড়া আর কিছুই নয়। অথচ তারই জোরে কত লোক যাবজ্জীবন পুলিপোলাও চলে যাচ্ছে।”
আমি চুপ করিয়া রইলাম, মন হইতে সায় দিতে পারিলাম না। অনুমান যে প্রত্যক্ষ প্রমাণের সমকক্ষ হইতে পারে, এ কথা সহজে মানিয়া লওয়া যায় না। অথচ ব্যোমকেশের যুক্তি খণ্ডন করাও কঠিন কাজ। সুতরাং নীরব থাকাই শ্রেয় বিবেচনা করিলাম। জানিতাম, এই নীরবতায় সে আরও অসহিষ্ণু হইয়া উঠিবে এবং অচিরাৎ আরো জোরালো যুক্তি আনিয়া হাজির করিবে।
একটা চড়াই পাখি কুটা মুখে করিয়া খোলা জানালার উপর আসিয়া বসিল এবং ঘাড় ফিরাইয়া ফিরাইয়া উজ্জ্বল ক্ষুদ্র চক্ষু দিয়া আমাদের পর্যবেক্ষণ করিতে লাগিল। ব্যোমকেশ হঠাৎ দাঁড়াইয়া পড়িয়া অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া বলিল–“আচ্ছা, ঐ পাখিটা কি চায় বলতে পার?”
আমি চমকিত হইয়া বলিলাম–“কি চায়? ওঃ, বোধহয় বাসা তৈরি করবার একটা জায়গা খুঁজছে।”
“ঠিক জানো? কোন সন্দেহ নেই?”
“কোন সন্দেহ নেই।”
দুই হাত পশ্চাতে রাখিয়া মৃদুহাস্যে ব্যোমকেশ বলিল–“কি করে বুঝলে? প্রমাণ কি?”
“প্রমাণ আর কি! ওর মুখে কুটো–”
“কুটো থাকলেই প্রমাণ হয় যে, বাসা বাঁধতে চায়?”
দেখিলাম ব্যোমকেশের ন্যায়ের প্যাঁচে পড়িয়া গিয়াছি।
কহিলাম, “না–তবে–”
“অনুমান। পথে এস। এতক্ষণ তবে দেয়ালা করছিলে কেন?”
“দেয়ালা করিনি। কিন্তু তুমি কি বলতে চাও, চড়াই পাখি সম্বন্ধে যে অনুমান খাটে, মানুষের বেলাতেও সেই অনুমান খাটবে?”
“কেন নয়?”
“তুমি যদি কুটো মুখে করে একজনের জানলায় উঠে বসে থাক, তাহলে কি প্রমাণ হবে যে তুমি বাসা বাঁধতে চাও?”
“না। তাহলে প্রমাণ হবে যে, আমি একটা বদ্ধ পাগল।”
“সে প্রমাণের দরকার আছে কি?”
ব্যোমকেশ হাসিতে লাগিল। বলিল–“চটাতে পারবে না। কিন্তু কথাটা তোমায় মানতেই হবে–প্রত্যক্ষ প্রমাণ বরং অবিশ্বাস করা যেতে পারে, কিন্তু যুক্তিসঙ্গত অনুমান একেবারে অমোঘ। তার ভুল হবার জো নেই।”
আমারও জিদ চড়িয়া গিয়াছিল, বলিলাম–“কিন্তু ঐ বিজ্ঞাপন সম্বন্ধে তুমি যে সব উদ্ভট অনুমান করলে, তা আমি বিশ্বাস করতে পারলুম না।”
ব্যোমকেশ বলিল–“সে তোমার মনের দুর্বলতা, বিশ্বাস করবারও ক্ষমতা চাই। যা হোক, তোমার মত লোকের পক্ষে প্রত্যক্ষ প্রমাণই ভাল। কাল শনিবার, বিকেলে কোন কাজও নেই। কালই তোমার বিশ্বাস করিয়ে দেবো।”
“কি ভাবে?”
আমাদের সিঁড়িতে পায়ের শব্দ শুনা গেল। ব্যোমকেশ উৎকর্ণ হইয়া শুনিয়া বলিল,–“অপরিচিত ব্যক্তি–পৌঢ়–মোটামুটি, নাদুস-নুদুস বললেও অত্যুক্তি হবে না–হাতে লাঠি আছে–কে উনি? নিশ্চয়ই আমাদের সাক্ষাৎ চান, কারণ, তেতলায় আমরা ছাড়া আর কেউ থাকে না।” বলিয়া মুখ টিপিয়া হাসিল।
বাহিরের দরজায় কড়া নড়িয়া উঠিল। ব্যোমকেশ ডাকিয়া বলিল–“ভেতরে আসুন–দরজা খোলা আছে।”
দ্বার ঠেলিয়া একটি মধ্যবয়সী স্থুলকায় ভদ্রলোক প্রবেশ করিলেন। তাঁহার হাতে একটি মোটা মলক্কা বেতের রূপার মুঠযুক্ত লাঠি, গায়ে কালো আলপাকার গলাবন্ধ কোট, পরিধানে কোঁচানো থান। গৌরবর্ণ সুশ্রী, মুখে দাড়ি গোঁফ কামানো, মাথার সম্মুখভাগ টাক পড়িয়া পরিষ্কার হইয়া গিয়াছে। তেতলার সিঁড়ি ভাঙিয়া হাঁফাইয়া পড়িয়াছিলেন, তাই ঘরে প্রবেশ করিয়া প্রথমটা কথা কহিতে পারিলেন না। পকেট হইতে রুমাল বাহির করিয়া মুখ মুছিতে লাগিলেন।
ব্যোমকেশ মৃদুস্বরে আমাকে শুনাইয়া বলিল–“অনুমান! অনুমান!”
আমি নীরবে তাহার শ্লেষ হজম করিলাম। কারণ, এক্ষেত্রে আগন্তুকের চেহারা সম্বন্ধে তাহার অনুমান যে বর্ণে বর্ণে মিলিয়া গিয়াছে, তাহাতে সন্দেহ নাই।
ভদ্রলোকটি দম লইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন–“ডিটেক্টিভ ব্যোমকেশবাবু কার নাম?”
মাথার উপর পাখাটা খুলিয়া দিয়া একখানা চেয়ার নির্দেশ করিয়া ব্যোমকেশ বলিল–“বসুন! আমারই নাম ব্যোমকেশ বক্সী, কিন্তু ঐ ডিটেক্টিভ কথাটা আমি পছন্দ করি না; আমি একজন সত্যান্বেষী। যা হোক, আপনি বড় বিপন্ন হয়েছেন দেখছি। একটি জিরিয়ে ঠাণ্ডা হয়ে নিন্, তারপরে আপনার গ্রামোফোন পিনের রহস্য শুনবো।
ভদ্রলোকটি চেয়ারে বসিয়া পড়িয়া ফ্যালফ্যাল করিয়া ব্যোমকেশের মুখের পানে তাকাইয়া রহিলেন। আমারও বিস্ময়ের অবধি ছিল না। এই পৌঢ় ভদ্রলোকটিকে দেখিবামাত্র তাঁহাকে গ্রামোফোন-পিন রহস্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করা কিরূপে সম্ভব হইল, তাহা একেবারেই আমার মস্তিষ্কে প্রবেশ করিল না। ব্যোমকেশের অদ্ভুত ক্ষমতার অনেক দৃষ্টান্ত দেখিয়াছি, কিন্তু এটা যেন ভোজবাজির মত ঠেকল।
ভদ্রলোক অতিকষ্টে আত্মসম্বরণ করিয়া বলিলেন–“আপনি–আপনি জানলেন কি করে?”
সহাস্যে ব্যোমকেশ বলিল–“অনুমান মাত্র। প্রথমত, আপনি পৌঢ়, দ্বিতীয়ত, আপনি সঙ্গতিপন্ন, তৃতীয়ত, আপনি সম্প্রতি ভীষণ বিপদে পড়েছেন এবং শেষ কথা–আমার সাহায্য নিতে চান। সুতরাং–” কথাটা অসম্পূর্ণ রাখিয়ে ব্যোমকেশ হাত নাড়িয়া বুঝাইয়া দিল যে, ইহার পর তাঁহার আগমনের হেতু আবিষ্কার করা শিশুর পক্ষেও সহজসাধ্য।
এইখানেই বলিয়া রাখা ভাল যে, কিছুদিন হইতে এই কলিকাতা শহরে যে অদ্ভুত রহস্যময় ব্যাপার ঘটিতেছিল এবং যাহাকে ‘গ্রামোফোন পিন মিস্ট্রি’ নাম দিয়া শহরের দেশী-বিলাতি সংবাদপত্রগুলি বিরাট হুলস্থুল বাধাইয়া দিয়াছিল; তাহার ফলে কলিকাতাবাসী লোকের মনে কৌতূহল, উত্তেজনা ও আতঙ্কের অবধি ছিল না। সংবাদপত্রের রোমাঞ্চকর ও ভীতিপ্রদ বিবরণ পাঠ করিবার পর চায়ের দোকানের জল্পনা উত্তেজনায় একেবারে দড়িছেঁড়া হইয়া উঠিয়াছিল এবং গৃহ হইতে পথে বাহির হইবার পূর্বে প্রত্যেক বাঙালী গৃহস্থেরই গায়ে কাঁটা দিতে আরম্ভ করিয়াছিল।
ব্যাপারটা এই–মাস দেড়েক পূর্বে সুকীয়া স্ট্রীট নিবাসী জয়হরি সান্ন্যাল নামক জনৈক পৌঢ় ভদ্রলোক প্রাতঃকালে কর্ণওয়ালিস্ স্ট্রীট দিয়া পদব্রজে যাইতেছিলেন। রাস্তা পার হইয়া অন্য ফুটপাতে যাইবার জন্য যেমনই পথে নামিয়াছেন, অমনই হঠাৎ মুখ থুবড়িয়া পড়িয়া গেলেন। সকালবেলা রাস্তায় লোকজনের অভাব ছিল না, সকলে মিলিয়া তাঁহাকে ধরাধরি করিয়া তুলিয়া আনিবার পর দেখিল তাঁহার দেহে প্রাণ নাই। হঠাৎ কিসে মৃত্যু হইল অনুসন্ধান করিতে গিয়া চোখে পড়িল যে, তাঁহার বুকের উপর একবিন্দু রক্ত লাগিয়া আছে–আর কোথাও আঘাতের কোনও চিহ্ন নাই। পুলিস অপমৃত্যু সন্দেহ করিয়া লাস হাসপাতালে পাঠাইয়া দিল। সেখানে মরনোত্তর পরীক্ষায় ডাক্তার এক অদ্ভুত রিপোর্ট দিলেন। তিনি লিখিলেন, মৃত্যুর কারণ হৃৎপিণ্ডের মধ্যে একটি গ্রামোফোনের পিন বিঁধিয়া আছে। কেমন করিয়া এই পিন হৃৎপিণ্ডের মধ্যে প্রবেশ করিল, তাহার কৈফিয়তে বিশেষজ্ঞ অস্ত্র চিকিৎসক লিখিলেন, বন্দুক অথবা ঐ জাতীয় কোনও যন্ত্র দ্বারা নিক্ষিপ্ত এই পিন মৃতের সম্মুখ দিক্ হইতে বক্ষের চর্ম ও মাংস ভেদ করিয়া মর্মস্থানে প্রবেশ করিয়াছে এবং মৃত্যুও প্রায় সঙ্গে সঙ্গে হইয়াছে।
এই ঘটনা লইয়া সংবাদপত্রে বেশ একটু আন্দোলন হইল এবং মৃতব্যক্তির একটি সংক্ষিপ্ত জীবনচরিতও বাহির হইয়া গেল। ইহা হত্যাকাণ্ড কি না এবং যদি তাই হয়, তবে কিরূপে এইহা সঙ্ঘটিত হইল, তাহা লইয়া অনেক গবেষণা প্রকাশিত হইল। কিন্তু একটা কথা কেহই পরিষ্কার করিয়া বলিতে পারিলেন না–এই হত্যার উদ্দেশ্য কি এবং যে হত্যা করিয়াছে তাহার ইহাতে কি স্বার্থ! সরকারের পুলিস যে ইহার তদন্তভার গ্রহণ করিয়াছেন, তাহাও কাগজে প্রকাশ পাইল। চায়ের দোকানের কাজীরা ফতোয়া দিলেন, ও কিছু নয়, লোকটার হার্টফেল করিয়াছিল, কিন্তু উপস্থিত ভাল সংবাদের দুর্ভিক্ষ ঘটায় কাগজওয়ালারা এই নূতন ফন্দি বাহির কইয়া তিলকে তাল করিয়া তুলিয়াছে।
ইহার দিন আষ্টেক পরে শহরের সকল সংবাদপত্রে দেড়-ইঞ্চি টাইপে যে খবর বাহির হইল, তাহাতে কলিকাতার ভদ্র বাঙালী সম্প্রদায় উত্তেজনায় খাড়া হইয়া উঠিয়া বসিলেন। চায়ের বৈঠকের ত্রিকালজ্ঞ ঋষিদের তৃতীয় নয়ন একবারে বিস্ফোরিত হইয়া খুলিয়া গেল। এত প্রকার গুজব, আন্দাজ ও জনশ্রুতি জন্মগ্রহণ করিল যে, বর্ষাকালে ব্যাঙের ছাতাও বোধ করি এত জন্মায় না।
‘দৈনিক কালকেতু’ লিখিল–
আবার গ্রামোফোন্ পিন
অদ্ভুত রোমাঞ্চকর রহস্য
কলিকাতার পথঘাট নিরাপদ নয়
“কালকেতুর পাঠকগণ জানেন, কয়েকদিন পূর্বে জয়হরি সান্ন্যাল পথ দিয়া যাইতে যাইতে হঠাৎ পড়িয়া গিয়া মৃত্যুমুখে পতিত হন। পরীক্ষায় তাঁহার হৃৎপিণ্ড হইতে একটি গ্রামোফোন পিন বাহির হয় এবং ডাক্তার উহাই মৃত্যুর কারণ বলিয়া নির্দেশ করেন। আমরা তখনি সন্দেহ করিয়াছিলাম যে, ইহা সাধারণ ব্যাপার নয়, ইহার ভিতর একটা ভীষণ ষড়যন্ত্র লুক্কায়িত আছে। আমাদের সেই সন্দেহ সত্যে পরিণত হইয়াছে, গতকল্য অনুরূপ আর একটি লোমহর্ষণ ব্যাপার ঘটিয়াছে। কলিকাতার বিখ্যাত ধনী ব্যবসায়ী কৈলাসচন্দ্র মৌলিক কল্য অপরাহ্নে প্রায় সাড়া পাঁচ ঘটিকার সময় মোটরে চড়িয়া গড়ের মাঠের দিকে বেড়াইতে গিয়াছিলেন। রেড রোডের কাছে গিয়া তিনি মোটর থামাইয়া পদব্রজে বেড়াইবার জন্য যেই গাড়ি হইতে অবতরণ করিয়া কিছুদূর গিয়াছেন, অমনি ‘উঃ’ শব্দ করিয়া মাটিতে পড়িয়া গেলেন। তাঁহার সোফার ও রাস্তার অন্যান্য লোক মিলিয়া তাড়াতাড়ি তাঁহাকে আবার গাড়িতে তুলিল, কিন্তু তিনি আর তখন জীবিত নাই। এই আকস্মিক দুর্ঘটনায় সকলেই হতবুদ্ধি হইয়া পড়িয়াছিল, কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে অল্পকালমধ্যেই পুলিস আসিয়া পড়িল। কৈলাসবাবুর গায়ে সিল্কের পাঞ্জাবি ছিল, পুলিস তাঁহার বুকের কাছে এক বিন্দু রক্তের দাগ দেখিয়া অপঘাত-মৃত্যু সন্দেহ করিয়া তৎক্ষণাৎ লাস হাসপাতালে পাঠাইয়া দেয়। শবব্যবচ্ছেদকারী ডাক্তারের রিপোর্টে প্রকাশ যে, কৈলাসবাবুর হৃৎপিণ্ডে একটি গ্রামোফোন পিন আটকাইয়া আছে, এই পিন তাঁহার সম্মুখদিক্ হইতে নিক্ষিপ্ত হইয়া হৃৎপিণ্ডে প্রবেশ করিয়াছে।
“স্পষ্ট বুঝা যাইতেছে যে, ইহা আকস্মিক দুর্ঘটনা নহে, একদল ক্রূরকর্মা নরঘাতক কলিকাতা শহরে আবির্ভূত হইয়াছে। ইহারা কে এবং কি উদ্দেশ্যে শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তিদিগকে খুন করিতে আরম্ভ করিয়াছে, তাহা অনুমান করা কঠিন। সর্বাপেক্ষা আশ্চর্য ইহাদের হত্যা করিবার প্রণালী; কোথা হইতে কোন্ অস্ত্রের সাহায্যে ইহারা হত্যা করিতেছে, তাহা গভীর রহস্যে আবৃত।
“কৈলাসবাবুর অতিশয় হৃদয়বান্ অমায়িক প্রকৃতির লোক ছিলেন, তাঁহার সহিত কাহারও শত্রুতা থাকা সম্ভব বলিয়া মনে হয় না। মৃত্যুকালে তাঁহার বয়ঃক্রম মাত্র আটচল্লিশ বৎসর হইয়াছিল। কৈলাসবাবু বিপত্মীক ও অপুত্রক ছিলেন। তাঁহার একমাত্র কন্যাই তাঁহার সম্পত্তির উত্তরাধিকারিণী। আমরা কৈলাসবাবুর শোকসন্তপ্ত কন্যা ও জামাতাকে আমাদের আন্তরিক সহানুভূতি জানাইতেছি।
“পুলিস সজোরে তদন্ত চালাইয়াছে। প্রকাশ যে, কৈলাসবাবুর সোফার কালী সিংকে সন্দেহের উপর গ্রেপ্তার করা হইয়াছে।”
অতঃপর দুই হপ্তা ধরিয়া খবরের কাগজে খুব হৈ চৈ চলিল। পুলিস সবেগে অনুসন্ধান চালাইতে লাগিল এবং অনুসন্ধানের বেগে বোধ করি গলদ্ঘর্ম হইয়া উঠিল। কিন্তু অপরাধী ধরা পড়া দূরের কথা, গ্রামোফোন পিনের জমাট রহস্য-অন্ধকারের ভিতরে আলোকের রশ্মিটুকু পর্যন্ত দেখা গেল না।
পনের দিনের মাথায় আবার গ্রামোফোন পিন দেখা দিল। এবার তাহার শিকার সুবর্ণবণিক সম্প্রদায়ের একজন ধনাঢ্য মহাজন–নাম কৃষ্ণদয়াল লাহা। ধর্মতলা ও ওয়েলিংটন স্ট্রীটের চৌমাথা পার হইতে গিয়ে উনি ভূপতিত হইলেন, আর উঠিলেন না। সংবাদপত্রে যে বিরাট রৈ-রৈ আরম্ভ হইল, তাহা বর্ণনার অতীত। পুলিসের অক্ষমতা সম্বন্ধেও সম্পাদকীয় মন্তব্য তীব্র ও নিষ্ঠুর হইয়া উঠিল। কলিকাতার অধিবাসীদিগের বুকের উপর ভূতের ভয়ের মত একটা বিভীষিকা চাপিয়া বসিল। বৈঠকখানায়, চায়ের দোকানে, রেস্তোরাঁ ও ড্রয়িংরুমে অন্য সকল প্রকার আলোচনা একেবারে বন্ধ হইয়া গেল।
তারপর দ্রুত অনুক্রমে আরও দুইটি অনুরূপ খুন হইয়া গেল। কলিকাতা শহর বিহ্বল পক্ষাঘাতগ্রস্তের মত অসহায়ভাবে পড়িয়া রইল, এই অচিন্তনীয় বিপৎপাতে কি করিবে, কেমন করিয়া আত্মরক্ষা করিবে, কিছুই যেন ভাবিয়া পাইল না।
বলা বাহুল্য, ব্যোমকেশ এই ব্যাপারে গভীরভাবে আকৃষ্ট হইয়াছিল। চোর ধরা তাহার পেশা এবং এই কাজে সে বেশ একটু নামও করিয়াছে। ‘ডিটেক্টিভ’ শব্দটার প্রতি তাহার যতই বিরাগ থাক, বস্তুত সে যে একজন বে-সরকারী ডিটেকটিভ ভিন্ন আর কিছুই নহে, তাহা সে মনে মনে ভাল রকমই জানিত। তাই এই অভিনব হত্যাকাণ্ড তাহার সমস্ত মানসিক শক্তিকে উদ্দীপ্ত করিয়া তুলিয়াছিল। ইতিমধ্যে বিভিন্ন অকুস্থানগুলি আমরা দুইজনে মিলিয়া দেখিয়াও আসিয়াছিলাম। ইহার ফলে ব্যোমকেশ কোনও নূতন জ্ঞান লাভ করিয়াছিলন কি না জানি না; করিয়া থাকিলেও আমাকে কিছু বলে নাই। কিন্তু গ্রামোফোন পিন সম্বন্ধে যেটুক সংবাদ পাইত, তাহাই সযত্নে নোটবুকে টুকিয়া রাখিত। বোধ হয় তাহার মনে মনে ভরসা ছিল যে, একদিন এই রহস্যের একটা ছিন্নসূত্র তাহার হাতে আসিয়া পড়িবে।
তাই আজ যখন সত্যসত্যই সূত্রটি তাহার হাতে আসিয়া পৌঁছিল, তখন দেখিলাম, বাহিরে শান্ত সংযত ভাব ধারণ করিলেও ভিতরে ভিতরে সে ভয়ানক উত্তেজিত ও অধীর হইয়া উঠিয়াছে।
ভদ্রলোকটি বলিলেন–“আপনার নাম শুনে এসেছিলাম, দেখছি ঠকিনি। গোড়াতেই যে আশ্চর্য ক্ষমতার পরিচয় দিলেন, তাতে ভরসা হচ্ছে আপনিই আমাকে উদ্ধার করতে পারবেন। পুলিসের দ্বারা কিছু হবে না, তাদের কাছে আমি যাইনি, মশায়। দেখুন না, চোখের সামনে দিন-দুপুরে পাঁচ-পাঁচটা খুন হয়ে গেল, পুলিস কিছু করতে পারলে কি? আমিও তো প্রায় গিয়েছিলাম আর একটু হলেই!” তাহার কণ্ঠস্বর কাঁপিতে কাঁপিতে থামিয়া গেল, কপালে স্বেদবিন্দু দেখা দিল।
ব্যোমকেশ সান্ত্বনার স্বরে বলিল–“আপনি বিচলিত হবেন না। পুলিসে না গিয়া যে আমার কাছে এসেছেন, ভালই করেছেন। এ ব্যাপারে কিনারা যদি কেউ করতে পারে তো সে পুলিস নয়। আমাকে গোড়া থেকে সমস্ত খুলে বলুন, অ-দরকারী বলে কোনও কথা বাদ দেবেন না। আমার কাছে অ-দরকারী কিছু নেই।”
ভদ্রলোক কতকটা সামলাইয়া লইয়া বলিতে আরম্ভ করিলেন–“আমার নাম শ্রীআশুতোষ মিত্র, কাছেই নেবুতলায় আমি থাকি। আঠারো বছর বয়স থেকে সারা জীবন ব্যবসা উপলক্ষে ঘুরে ঘুরেই বেড়িয়েছি–বিয়ে থা করবার অবকাশ পাইনি। তা ছাড়া, ছেলেপিলে নেন্ডি-গেন্ডি আমি ভালবাসি না, তাই কোনওদিন বিয়ে করবার ইচ্ছাও হয়নি। আমি গোছানো লোক, একলা থাকতে ভালবাসি। বয়সও কম হয়নি–আসছে মাঘে একান্ন বছর পুরবে। প্রায় বছর দুই হল কাজকর্ম থেকে অবসর নিয়েছি, সারা জীবনের উপার্জন লাখ দেড়েক টাকা ব্যাঙ্কে জমা আছে। তারই সুদে আমার বেশ চলে যায়। বাড়িভাড়াও দিতে হয় না, বাড়িখানা নিজের। সামান্য গান-বাজনার শখ আছে, তাই নিয়ে বেশ নির্ঝঞ্ঝাটে দিনগুলো কেটে যাচ্ছিল।”
ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল–“অবশ্য পোষ্য কেউ আছে?”
আশুবাবু মাথা নাড়িয়া বলিলেন–“না। আত্মীয় বলতে বড় কেউ নেই, তাই ও হাঙ্গামা পোহাতে হয় না। শুধু লক্ষ্মীছাড়া বখাটে ভাইপো আছে, সেই মাঝে মাঝে টাকার জন্যে জ্বালাতন করতে আসত। কিন্তু সে ছোঁড়া একেবারে বেহেড মাতাল আর জুয়াড়ী, ওরকম লোক আমি বরদাস্ত করতে পারি না, মশায়, তাই তাকে আর বাড়ি ঢুকতে দিই না।”
ব্যোমকেশ প্রশ্ন করিল–“ভাইপোটি কোথায় থাকেন?”
আশুবাবু বেশ একটু পরিতৃপ্তির সহিত বলিলেন–“আপাতত শ্রীঘরে। রাস্তায় মাতলামি করার জন্য এবং পুলিসের সঙ্গে মারামারি করার অপরাধে দু’মাস জেল হয়েছে।”
“তারপর বলে যান।”
“বিনোদ ছোঁড়া–আমার গুণধর ভাইপো, জেলে যাবার পর ক’দিন বেশ আরামে ছিলাম মশায়, কোনও হাঙ্গামা ছিল না। বন্ধু-বান্ধব আমার কেউ নেই, কিন্তু জেনে শুনে কোনও দিন কারও অনিষ্ট করিনি; সুতরাং আমার যে শত্রু আছে, এ কথাও ভাবতে পারি না। কিন্তু হঠাৎ কাল বিনামেঘে বজ্রঘাত হল। এমন ব্যাপার যে ঘটতে পারে, এ আমার কল্পনার অতীত। গ্রামোফোন পিন রহস্যের কথা কাগজে পড়েছি বটে, কিন্তু ও আমার বিশ্বাস হত না, ভাবতাম সব গাঁজাখুরি। কিন্তু সে ভুল আমার ভেঙে গেছে।
“কাল সন্ধ্যাবেলা আমি অভ্যাসমত বেড়াতে বেরিয়েছিলাম। রোজই যাই। জোড়াসাঁকোর দিকে একটা গানবাজনার মজলিস আছে, সেখানে সন্ধ্যাটা কাটিয়ে ন’টা সাড়ে ন’টার সময় বাড়ি ফিরে আসি। হেঁটেই যাতায়াত করি, আমার যে বয়স, তাতে নিয়মিত হাঁটলে শোরীর ভাল থাকে। কাল রাত্রিতে আমি বাড়ি ফিরছি, আমহার্স্ট স্ট্রীট আর হ্যারিসন রোডের চৌমাথার ঘড়িতে তখন ঠিক সওয়া ন’টা। রাস্তায় তখনও গাড়ি-মোটরের খুব ভিড়। আমি কিছুক্ষণ ফুটপাতে দাঁড়িয়ে রইলাম, দুটো ট্রাম পাস করে গেল। একটু ফাঁক দেখে আমি চৌমাথা পার হতে গেলাম। রাস্তার মাঝামাঝি যখন পৌঁছেছি, তখন হঠাৎ বুকে একটা বিষম ধাক্কা লাগল, সঙ্গে সঙ্গে বুকের চামড়ার ওপর কাঁটা ফোঁটার মতন একটা ব্যথা অনুভব করলাম, মনে হল, আমার বুক-পকেটের ঘড়ির ওপর কে যেন একটা প্রকাণ্ড ঘুষি মারলে। উল্টে পড়েই যাচ্ছিলাম, কিন্তু কোনও রকমে সামনে নিয়ে গাড়ি-ঘোড়া বাঁচিয়ে সামনে ফুটপাথে উঠে পড়লাম।
“মাথাটা যেন ঘুলিয়ে গিয়েছিল, কেমন করে বুকে ধাক্কা লাগল, কিছুই ধারণা করতে পারলাম না। পকেট থেকে ঘড়িটা বার করতে গিয়ে দেখি, ঘড়ি বার হচ্ছে না, কিসে আটকে যাচ্ছে। সাবধানে পকেটের কাপড় সরিয়ে যখন ঘড়ি বার করলাম, তখন দেখি, তার কাচখানা গুঁড়ো হয়ে গেছে–আর–আর একটা গ্রামোফোনের পিন ঘড়িটাকে ফুঁড়ে মুখ বার করে আছে।”
আশুবাবু বলিলে বলিতে আবার ঘর্মাক্ত হইয়া উঠিয়াছিলেন, কপালের ঘাম মুছিয়া কম্পিত হস্তে পকেট হইতে একটি ঘড়ির বাক্স বাহির করিয়া ব্যোমকেশের হাতে দিয়ে বলিলেন–“এই দেখুন সেই ঘড়ি–”
ব্যোমকেশ বাক্স খুলিয়া একটা গান-মেটালের পকেট ঘড়ি বাহির করিল। ঘড়ির কাচ নাই, ঠিক নয়টা কুড়ি মিনিটে বন্ধ হইয়া গিয়াছে এবং তাহার মর্মস্থল ভেদ করিয়া একটি গ্রামোফোন পিনের অগ্রভাগ হিংস্রভাবে পশ্চাদ্দিকে মুখ বাহির করিয়া আছে। ব্যোমকেশ ঘড়িটা কিছুক্ষণ গভীর মনঃসংযোগে নিরীক্ষণ করিয়া আবার বাক্সে রাখিয়া দিল। বাক্সটা টেবিলের উপর রাখিয়া আশুবাবুকে বলিল–“তারপর?”
আশুবাবু বলিলেন–“তারপর কি করে যে বাড়ি ফিরে এলাম সে আমি জানি আর ভগবান জানেন। দুশ্চিন্তায় আতঙ্কে সমস্ত রাত্রি চোখের পাতা বুজতে পারিনি। ভাগ্যে পকেটে ঘড়িটা ছিল, তাই তো প্রাণ বেঁচে গেল–নইলে আমিও তো এতক্ষণে হাসপাতালে মড়ার টেবিলে শুয়ে থাকতাম–” আশুবাবু শিহরিয়া উঠিলেন–“এক রাত্রিতে আমার দশ বছর পরমায়ু ক্ষয় হয়ে গেছে। মশায়। প্রাণ নিয়ে কোথায় পালাব, কি করে আত্মরক্ষা করব। সমস্ত রাত এই শুধু ভেবেছি। শেষ রাত্রে আপনার নাম মনে পড়ল, শুনেছিলাম আপনার আশ্চর্য ক্ষমতা, তাই ভোর না হতেই ছুটে এসেছি। বন্ধ গাড়িতে চড়ে এসেছি মশায়, হেঁটে আসতে সাহস হয়নি–কি জানি যদি–”
ব্যোমকেশ উঠিয়া গিয়া আশুবাবুর স্কন্ধে হাত রাখিয়া বলিল–“আপনি নিশ্চিন্ত হোন; আমি আপনাকে আশ্বাস দিচ্ছি, আপনার আর কোন ভয় নেই। কাল আপনার একটা মস্ত ফাঁড়া গেছে সত্যি, কিন্তু ভবিষ্যতে যদি আমার কথা শুনে চলেন, তাহলে আপনার প্রাণের কোন আশঙ্কা থাকবে না।”
আশুবাবু দুই হাতে ব্যোমকেশের হাত ধরিয়া বলিলেন–“ব্যোমকেশবাবু, আমাকে এ বিপদ থেকে রক্ষা করুন, প্রাণ বাঁচান, আমি আপনাকে এক হাজার টাকা পুরস্কার দেব।”
ব্যোমকেশ নিজের চেয়ারে ফিরিয়া বসিয়া মৃদুহাস্যে বলিল–“এ তো খুব ভাল কথা। সবসুদ্ধ তাহলে তিন হাজার হল–গভর্নমেণ্টও দু’হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করছে না? কিন্তু সে পরের কথা, এখন আমার কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর দিন। কাল যে সময় আপনার বুকে ধাক্কা লাগল ঠিক সেই সময় আপনি কোনও শব্দ শুনেছিলেন?”
“কি রকম শব্দ?”
“মনে করুন, মোটরের টায়ার ফাটার মত শব্দ।”
আশুবাবু নিঃসংশয়ে বলিলেন–“না।”
ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল–“আর কোন রকম শব্দ?”
“আমি তো কিছুই মনে করতে পারছি না।”
“ভেবে দেখুন।”
কিয়ৎকাল চিন্তা করিয়া আশুবাবু বলিলেন–“রাস্তায় গাড়ি-ঘোড়া চললে যে শব্দ হয়, সেই শব্দই শুনেছিলাম। আমার মনে হচ্ছে যেন–যে সময় ধাক্কাটা লাগে, সেই সময় সাইক্লের ঘণ্টির কিড়িং কিড়িং শব্দ শুনেছিলাম।”
“কোন রকম অস্বাভাবিক শব্দ শোনেননি?”
“না?”
কিছুক্ষণ নীরব থাকিয়া ব্যোমকেশ অন্য প্রশ্ন করিল–“আপনার এমন কোনও শত্রু আছে, যে আপনাকে খুন করতে পারে?”
“না। অন্তত আমি জানি না।”
“আপনি বিবাহ করেননি, সুতরাং ছেলেপুলে নেই। ভাইপোই বোধ হয় আপনার ওয়ারিস?”
একটু ইতস্তত করিয়া আশুবাবু বলিলেন–“না।”
“উইল করেছেন?”
“হ্যাঁ।”
“কার নামে সম্পত্তি উইল করেছেন?”
আশুবাবুর গৌরবর্ণ মুখ ধীরে ধীরে রক্তাভ হইয়া উঠিতেছিল, তিনি কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া সঙ্কোচ-জড়িত স্বরে বলিলেন–“আমাকে আর সব কথা জিজ্ঞাসা করুন, শুধু ঐ প্রশ্নটি আমায় করবে না। ওটা আমার সম্পূর্ণ নিজস্ব কথা–প্রাইভেট–” বলিতে বলিতে অপ্রতিভভাবে থামিয়া গেলেন।
ব্যোমকেশ তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে আশুবাবুর মুখের দিকে চাহিয়া শেষে বলিল–“আচ্ছা থাক। কিন্তু আপনার ভাবী ওয়ারিস–তিনি যে-ই হোন–আপনার উইলের কথা জানেন কি?”
“না। আমি আর আমার উকিল ছাড়া আর কেউ জানে না।”
“আপনার ওয়ারিসের সঙ্গে আপনার দেখা হয়?”
চক্ষু অন্য দিকে ফিরাইয়া আশুবাবু বলিলেন–“হয়।”
“আপনার ভাইপো কতদিন হল জেলে গেছে?”
আশুবাবু মনে মনে হিসাব করিয়া বলিলেন–“তা প্রায় তিন হপ্তা হবে।”
ব্যোমকেশ কিয়ৎকাল ভ্রু কুঞ্চিত করিয়া বসিয়া রহিল। অবশেষে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল–“আজ তাহলে আপনি আসুন। আপনার ঠিকানা আর ঘড়িটা রেখে যান; যদি কিছু জানবার দরকার হয়, আপনাকে খরব দেব।”
আশুবাবু শঙ্কিতভাবে বলিলেন–“কিন্তু আমার সম্বন্ধে তো কোন ব্যবস্থা করলেন না। ইতিমধ্যে যদি আবার–”
ব্যোমকেশ বলিল–“আপনার সম্বন্ধে ব্যবস্থা এই যে, পারতপক্ষে বাড়ি থেকে বেরুবেন না।”
আশুবাবু পাণ্ডুর মুখে বলিলেন–“বাড়িতে আমি একলা থাকি–যদি–”
ব্যোমকেশ বলিল–“না, বাড়িতে আপনার কোন আশঙ্কা নেই, সেখানে আপনি নিরাপদ। তবে ইচ্ছে হয়, একজন দারোয়ান রাখতে পারেন।”
আশুবাবু জিজ্ঞাসা করিলেন–“বাড়ি থেকে একেবারে বেরুতে পাব না?”
ব্যোমকেশ একটু চিন্তা করিয়া বলিল–“একান্তই যদি রাস্তায় বেরুনো দরকার হয়ে পড়ে, ফুটপাথ দিয়ে যাবেন। কিন্তু খবরদার, রাস্তায় নামবেন না। রাস্তায় নামলে আপনার জীবন সম্বন্ধে আমার কোন দায়িত্ব থাকবে না।”
আশুবাবু প্রস্থান করিলে ব্যোমকেশ ললাট ভ্রুকুটি-কুটিল করিয়া বসিয়া রইল। চিন্তা করিবার নূতন সূত্র সে অনেক পাইয়াছে, তাহাতে সন্দেহ নাই। তাই আমি তাহার চিন্তায় বাধা দিলাম না। প্রায় আধ ঘণ্টা নীরব থাকিবার পর সে মুখ তুলিয়া বলিল–“তুমি ভাবছ, আমি আশুবাবুকে পথে নামতে মানা করলুম কেন এবং বাড়িতে নিরাপদ, এ কথাই বা জানলুম কি করে?”
চকিত হইয়া বলিলাম–“হ্যাঁ।”
ব্যোমকেশ বলিল–গ্রামোফোন-পিন ব্যাপারে একটা জিনিস নিশ্চয় লক্ষ্য করেছ–সব হত্যাই রাস্তায় হয়েছে। ফুটপাথেও নয়। রাস্তায় মাঝখানে। এর কারণ কি হতে পারে, ভেবে দেখেছ?”
“না, কি কারণ?”
“এর দুটো কারণ হতে পারে। প্রথমত, রাস্তায় খুন করলে ধরা পড়বার সম্ভাবনা কম–যদিও আপাতদৃষ্টিতে সেটা অসম্ভব বলে মনে হয়। দ্বিতীয়ত, যে অস্ত্র দিয়ে খুন করা হয়, রাস্তায় ছাড়া অন্যত্র তাকে ব্যবহার করা চলে না।”
আমি কৌতূহলী হইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম–“এমন কি অস্ত্র হতে পারে?”
ব্যোমকেশ বলিল–“তা যখন জানতে পারব, গ্রামোফোন-পিন রহস্য তখন আর রহস্য থাকবে না।”
আমার মাথায় একটা আইডিয়া আসিয়াছিল, বলিলাম–“আচ্ছা, এমন কোন বন্দুক বা পিস্তল যদি কেউ তৈরি করে, যা দিয়ে গ্রামোফোন-পিন ছোঁড়া যায়?”
সপ্রশংস নেত্রে চাহিয়া ব্যোমকেশ বলিল–“বুদ্ধি খেলিয়েছ বটে, কিন্তু তাতে দু’ একটা বাধা আছে। যে ব্যক্তি বন্দুক কিম্বা পিস্তল দিয়ে খুন করতে চায়, সে বেছে বেছে রাস্তার মাঝখানে খুন করবে কেন? সে তো নির্জন স্থানই খুঁজবে। বন্দুকের কথা ছেড়ে দিই, পিস্তল ছুঁড়লে যে আওয়াজ হয়, রাস্তার গোলমালেও সে আওয়াজ ঢাকা পড়ে না। তা ছাড়া বারুদের গন্ধ আছে। কথায় আছে–শব্দে শব্দ ঢাকে, গন্ধ ঢাকে কিসে?”
আমি বলিলাম–“মনে কর, যদি এয়ার-গান হয়?”
ব্যোমকেশ হাসিয়া উঠিল–“এয়ার-গান ঘাড়ে করে খুন করতে যাওয়ার পরিকল্পনায় নূতনত্ব আছে বটে, কিন্তু সুবুদ্ধির পরিচয় নেই। –না হে না, অত সহজ নয়। এর মধ্যে ভাবনার বিষয় হচ্ছে, অস্ত্র যা-ই হোক ছোঁড়বার সময় তার একটা শব্দ হবেই, সে শব্দ ঢাকা পড়ে কি করে?”
আমি বলিলাম–“তুমিই তো এখনি বলছিলে–শব্দে শব্দ ঢাকে–”
ব্যোমকেশ হঠাৎ সোজা হইয়া বসিয়া বিস্ফারিত নেত্রে আমার মুখের প্রতি চাহিয়া রহিল, অস্ফুট স্বরে কহিল–“ঠিক তো–ঠিক তো–”
আমি বিস্মিত হইয়া বলিলাম–“কি হল?”
ব্যোমকেশ নিজের দেহটাকে একটা ঝাঁকানি দিয়া যেন চিন্তার মোহ ভাঙিয়া ফেলিল, বলিল–“কিছু না। এই গ্রামোফোন-পিন রহস্য নিয়ে যতই ভাবা যায়, ততই এই ধারণা মনের মধ্যে বদ্ধমূল হয় যে, সব হত্যা এক সুতোয় গাঁথা। সবগুলোর মধ্যেই একটা অদ্ভুত মিল আছে, যদিও তা হঠাৎ চোখে পড়ে না।”
“কি রকম?”
ব্যোমকেশ করাগ্রে গণনা করিতে করিতে বলিল–“প্রথমত দেখ, যাঁরা খুন হয়েছেন, তাঁরা সবাই যৌবনের সীমা অতিক্রম করেছিলেন। আশুবাবু–যিনি ঘড়ির কল্যাণে বেঁচে গেছেন–তিনিও পৌঢ়। তারপর দ্বিতীয় কথা, তাঁরা সকলেই অর্থবান লোক ছিলেন–হতে পারে কেউ বেশী ধনী কেউ কম ধনী, কিন্তু গরীব কেউ নয়। তৃতীয় কথা, সকলেই পথের মাঝখানে হাজার লোকের সামনে খুন হয়েছেন এবং শেষ কথা–এইটেই সবচেয়ে প্রণিধানযোগ্য–তাঁরা সবাই অপুত্রক–”
আমি বলিলাম–“তুমি তাহলে অনুমান কর যে–”
ব্যোমকেশ বলিল–“অনুমান এখনও আমি কিছুই করিনি। এগুলো হচ্ছে আমার অনুমানের ভিত্তি, ইংরাজিতে যাকে বলে premise.”
আমি বলিলাম–“কিন্তু এই ক’টি premise থেকে অপরাধীদের ধরা–”
আমাকে শেষ করিতে না দিয়া ব্যোমকেশ বলিল–“অপরাধীদের নয় অজিত, অপরাধীর। গৌরবে ছাড়া এখানে বহুবচন একেবারে অনাবশ্যক। খবরের কাগজওয়ালারা ‘মার্ডারস্ গ্যাং’ বলে যতই চীৎকার করুন, গ্যাং-এর মধ্যে কেবল একটি লোক আছেন। তিনিই এই নরমেধযজ্ঞের হোতা, ঋত্বিক এবং যজমান। এক কথায়, পরব্রহ্মের মত ইনি, একমেবাদ্বিতীয়ম্।”
আমি সন্দেহ প্রকাশ করিয়া বলিলাম,–“এ কথা তুমি কি করে বলতে পারো? কোন প্রমাণ আছে?”
ব্যোমকেশ বলিল–“প্রমাণ অনেক আছে, কিন্তু উপস্থিত একটা দিলেই যথেষ্ট হবে। এমন অব্যর্থ লক্ষ্যবেধ করবার শক্তি পাঁচজন লোকের কখনও সমান মাত্রায় থাকতে পারে? প্রত্যেকটি পিন অব্যর্থভাবে হৃৎপিণ্ডের মধ্যে গিয়ে ঢুকেছে–একটু উঁচু কিম্বা নীচু হয়নি। আশুবাবুর কথাই ধর, ঘড়িটি না থাকলে ঐ পিন কোথায় গিয়ে পৌঁছত বল দেখি? এমন টিপ কি পাঁচজনের হয়? এ যেন চক্রছিদ্রপথে মৎস্য-চক্ষু বিদ্ধ করার মত,–দ্রৌপদীর স্বয়ম্বর মনে আছে তো? ভেবে দেখ, সে কাজ একা অর্জুনই পেরেছিল, মহাভারতের যুগেও এমন অমোঘ নিশানা একজন বৈ দু’জনের ছিল না।” বলিয়া হাসিতে হাসিতে সে উঠিয়া পড়িল।
আমাদের এই বসিবার ঘরের পাশে আর একটা ঘর ছিল–সেটা ব্যোমকেশের নিজস্ব। এ ঘরে সে সকল সময় আমাকেও ঢুকতে দিত না। বস্তুত এ ঘরখানা ছিল একাধারে তাহার লাইব্রেরি, ল্যাবরেটরি, মিউজিয়ম ও গ্রীনরুম। আশুবাবুর ঘড়িটা তুলিয়া সেই ঘরটায় প্রবেশ করিতে করিতে ব্যোমকেশ বলিল–“খাওয়া-দাওয়ার পর নিশ্চিন্ত হয়ে এটার তত্ত্ব আহরণ করা যাবে। আপাতত স্নানের বেলা হয়ে গেছে।”
দুই
বৈকালে প্রায় সাড়ে তিনটার সময় ব্যোমকেশ বাহির হইয়া গিয়াছিল। কি কাজে গিয়াছিল, জানি না। যখন ফিরিল, তখন সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইয়া গিয়াছে; আমি তাহার জন্য প্রতীক্ষা করিতেছিলাম, চায়ের সরঞ্জামও তৈয়ার ছিল, সে আসিতেই ভৃত্য টেবিলের উপর চা-জলখাবার দিয়া গেল। আমরা নিঃশব্দে জলযোগ সমাধা করিলাম। এমন অভ্যাস হইয়া গিয়াছিল, ঐ কার্যটা একত্র না করিলে মনঃপূত হইত না।
একটা চুরুট ধরাইয়া, চেয়ারে ঠেসান দিয়া বসিয়া ব্যোমকেশ প্রথম কথা কহিল; বলিল–“আশুবাবু লোকটিকে তোমার কেমন মনে হয়?”
ইষৎ বিস্মিতভাবে বলিলাম–“কেন বল দেখি? আমার তো ভাল লোক বলেই মনে হয়–নিরীহ ভালমানুষ গোছের–”
ব্যোমকেশ বলিল–“আর নৈতিক চরিত্র?”
আমি বলিলাম–“মাতাল ভাইপোর উপর যে রকম চটা, তাতে নৈতিক চরিত্র তো ভাল বলেই মনে হয়। তার ওপর বয়স্ক লোক। বিয়ে করেননি, যৌবনে যদি কিছু উচ্ছৃঙ্খলতা করে থাকেন তো অন্য কথা; কিন্তু এখন আর ওঁর সে সব করবার বয়স নেই।”
ব্যোমকেশ মুচকি হাসিয়া বলিল–“বয়স না থাকতে পারে, কিন্তু একটি স্ত্রীলোক আছে। জোড়াসাঁকোর যে গানের মজলিসে আশুবাবু নিত্য গানবাজনা করে থাকেন, সেটি ঐ স্ত্রীলোকের বাড়ি। স্ত্রীলোকের বাড়ি বললে বোধ হয় ঠিক বলা হয় না, কারণ, বাড়ির ভাড়া আশুবাবুই দিয়ে থাকেন এবং গানের মজলিস বললেও বোধ হয় ভুল বলা হয়, যেহেতু দু’টি প্রাণীর বৈঠককে কোন মতেই মজলিস বলা চলে না।”
“বল কি হে! বুড়োর প্রাণে তো রস আছে দেখছি।”
“শুধু তাই নয়, গত বারো তের বছর ধরে আশুবাবু এই নাগরিকাটির ভরণ-পোষণ করে আসছেন, সুতরাং তাঁর একনিষ্ঠতা সম্বন্ধে কোনও সন্দেহ থাকতে পারে না। আবার অন্য পক্ষেও একনিষ্ঠতার অভাব নেই, আশুবাবু ছাড়া অন্য কোনও সঙ্গীত-পিপাসুর সেখানে প্রবেশাধিকার নেই; দরজায় কড়া পাহাড়া।”
উৎসুক হইয়া বলিলাম–“তাই না কি? সঙ্গীত-পিপাসু সেজে ঢোকবার মতলব করেছিলে বুঝি? নাগরিকাটির দর্শন পেলে? কি রকম দেখতে শুনতে?”
ব্যোমকেশ বলিল–“একবার চকিতের ন্যায় দেখা পেয়েছিলুম। কিন্তু রূপবর্ণনা করে তোমার মত কুমার-ব্রহ্মচারীর চিত্তচাঞ্চল্য ঘটাতে চাই না। এক কথায়, অপূর্ব রূপসী। বয়স ছাব্বিশ সাতাশ, কিন্তু দেখে মনে হয়, বড় জোর উনিশ কুড়ি। আশুবাবুর রুচির প্রশংসা না করে থাকা যায় না।”
আমি হাসিয়া বলিলাম–“তা তো দেখতেই পাচ্ছি। কিন্তু তুমি হঠাৎ আশুবাবুর গুপ্ত জীবন সম্বন্ধে এত কৌতূহলী হয়ে উঠলে কেন?”
ব্যোমকেশ বলিল–“অপরিমিত কৌতুহল আমার একটা দুর্বলতা। তা ছাড়া, আশুবাবুর উইলের ওয়ারিস সম্বন্ধে মনে একটা খটকা লেগেছিল–”
“ইনিই তাহলে আশুবাবুর উত্তরাধিকারিণী?”
“সেই রকমই অনুমান হচ্ছে। সেখানে একটি ভদ্রলোকের দেখা পেলুম; ফিটফাট বাবু, বয়েস পঁয়ত্রিশ ছত্রিশ, দ্রুতবেগে এসে দারোয়ানের হাতে একখানা চিঠি গুঁজে দিয়ে দ্রুতবেগে চলে গেলেন। কিন্তু ও কথা যাক্। বিষয়টা মুখরোচক বটে, কিন্তু লাভজনক নয়।”
ব্যোমকেশ উঠিয়া ঘরময় পায়চারি করিতে লাগিল।
বুঝিলাম, অবান্তর আলোচনায় আকৃষ্ট হইয়া পাছে তাহার মন প্রকৃত অনুসন্ধানের পথ হইতে বিক্ষিপ্ত হইয়া পড়ে, পাছে আশুবাবুর জীবনের গোপন ইতিহাস তাঁহার উপস্থিত বিপদ ও বিপন্মুক্তির সমস্যা অপেক্ষা বড় হইয়া উঠে, এই ভয়ে ব্যোমকেশও আলোচনাটা আর বাড়িতে দিল না। এমনিভাবেই যে মানুষে মন নিজের অজ্ঞাতসারে গৌণবস্তুকে মুখ্যবস্তু অপেক্ষা প্রধান করিয়া তুলিয়া শেষে লক্ষ্যভ্রষ্ট হইয়া পড়ে, তাহা আমারও অজ্ঞাত ছিল না। আমি তাই জিজ্ঞাসা করিলাম–“ঘড়িটা থেকে কিছু পেলে?”
ব্যোমকেশ আমার সম্মুখে দাঁড়াইয়া মৃদুহাস্যে বলিল–“ঘড়ি থেকে তিনটি তত্ত্ব লাভ করেছি। এক–গ্রামোফোন পিনটি সাধারণ এডিসন্-মার্কা পিন, দুই–তার ওজন দু’ রতি তিন–আশুবাবুর ঘড়িটা একেবারে গেছে, আর মেরামত হবে না।”
আমি বলিলাম–“তার মানে দরকারী তথ্য কিছুই পাওনি।”
ব্যোমকেশ চেয়ার টানিয়া বসিয়া বলিল–“তা বলতে পারি না। প্রথমত বুঝতে পেরেছি যে, পিন ছোঁড়বার সময় হত্যাকারী আর হত ব্যক্তির মধ্যে ব্যবধান সাত আট গজের বেশি হবে না। একটা গ্রামোফোন পিন এত হাল্কা জিনিস যে, সাত আট গজের বেশি দূর থেকে ছুঁড়লে অমন অব্যর্থ-লক্ষ্য হতে পারে না। অথচ হত্যাকারীর টিপ কি রকম অভ্রান্ত, তা তো দেখছ। প্রত্যেকবার তীর একেবারে মর্মস্থানে গিয়ে ঢুকেছে।”
আমি বিস্মিত অবিশ্বাসের সুরে বলিলাম–“সাত আট গজ দূর থেকে মেরেছে, তবু কেউ ধরতে পারলে না?”
ব্যোমকেশ বলিল–“সেইটেই হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রধান প্রহেলিকা। ভেবে দেখ, খুন করবার পর লোকটা হয়তো দর্শকদের মধ্যেই ছিল, হয়তো নিজের হাতে তুলে মৃতদেহ স্থানান্তরিত করেছে; কিন্তু তবু কেউ বুঝতে পারলে না, কি করে সে এমনভাবে আত্মগোপন করলে?”
আমি অনেকক্ষণ চিন্তা করিয়া কহিলাম–“আচ্ছা, এমন তো হতে পারে, হত্যাকারী পকেটের ভিতর এমন একটা যন্ত্র নিয়া বেড়ায়–যা থেকে গ্রামোফোন পিন ছোঁড়া যায়। তারপর তার শিকারের সামনে এসে পকেট থেকেই যন্ত্রটা ফায়ার করে। পকেটে হাত দিয়ে অনেকেই রাস্তায় চলে, সুতরাং কারু সন্দেহ হয় না।”
ব্যোমকেশ বলিল–“তা যদি হত, তাহলে ফুটপাথের ওপরেই তো কাজ সারতে পারত। রাস্তায় নামতে হয় কেন? তা ছাড়া, এমন কোন যন্ত্র আমার জানা নেই–যা নিঃশব্দে ছোঁড়া যায় অথচ তার নিক্ষিপ্ত গুলি একটা মানুষের শরীর ফুটো করে হৃৎপিণ্ডে গিয়ে পৌঁছতে পারে। তাতে কতখানি শক্তির দরকার, ভেবে দেখেছ?”
আমি নিরুত্তর হইয়া রহিলাম। ব্যোমকেশ হাঁটুর উপর কনুই রাখিয়া ও করতলে চিবুক ন্যস্ত করিয়া বহুক্ষণ চুপ করিয়া বসিয়া রহিল; শেষে বলিল–“বুঝতে পারছি, এর একটা খুব সহজ সমাধান হাতের কাছেই রয়েছে, কিন্তু কিছুতেই ধরতে পারছি না। যতবার ধরবার চেষ্টা করছি, পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে।”
রাত্রিকালে এ বিষয়ে আর কোনও কথা হইল না। নিদ্রার পূর্ব পর্যন্ত ব্যোমকেশ অন্যমনস্ক ও বিমনা হইয়া রহিল। সমস্যার যে উত্তরটা হাতের কাছে থাকিয়াও তাহার যুক্তির ফাঁদে ধরা দিতেছে না, তাহারই পশ্চাতে তাহার মন যে ব্যাধের মত ছুটিয়াছে, তাহা বুঝিয়া আমিও তাহার একাগ্র অনুধাবনে বাধা দিলাম না।
পরদিন সকালে চিন্তাক্রান্ত মুখেই সে শয্যা ছাড়িয়া উঠিল এবং তাড়াতাড়ি মুখহাত ধুইয়া এক পেয়ালা চা গলাধঃকরণ করিয়া বাহির হইয়া গেল। ঘণ্টা তিনেক পরে যখন ফিরিল, তখন জিজ্ঞাসা করিলাম–“কোথায় গিছলে?”
ব্যোমকেশ জুতার ফিতা খুলিতে খুলিতে অন্যমনে বলিল–“উকিলের বাড়ি।” তাহাকে উন্মনা দেখিয়া আমি আর প্রশ্ন করিলাম না।
অপরাহ্নের দিকে তাহাকে কিছু প্রফুল্ল দেখিলাম। সমস্ত দুপুর সে নিজের ঘরে দ্বার বন্ধ করিয়া কাজ করিতেছিল; একবার টেলিফোনে কাহার সহিত কথা কহিল, শুনিতে পাইলাম। প্রায় সাড়ে চারটের দসময় সে দরজা খুলিয়া গলা বাড়াইয়া বলিল–“ওহে, কাল কি ঠিক হয়েছিল, ভুলে গেলে? ‘পথের কাঁটা’র প্রত্যক্ষ প্রমাণ দেবার সময় যে উপস্থিত।”
সত্যই ‘পথের কাঁটা’র কথা একেবারে ভুলিয়া গিয়াছিলাম। ব্যোমকেশ হাসিয়া বলিল–“এস, এস, তোমার একটু সাজসজ্জা করে দিই। এমনি গেলে তো চলবে না।”
আমি তাহার ঘরে প্রবেশ করিয়া বলিলাম–“চলবে না কেন?”
ব্যোমকেশ একটা কাঠের কবাট-যুক্ত আলমারি খুলিয়া তাহার ভিতর হইতে একটা টিনের বাস্ক বাহির করিল। বাক্স হইতে ক্রেপ, কাঁচি, স্পিরিট-গাম ইত্যাদি বাছিয়া লইয়া বুরুশ দিয়া আমার মুখে স্পিরিট-গাম লাগাইতে লাগাইতে বলিল–“অজিত বন্দ্যো যে ব্যোমকেশ বক্সীর বন্ধু, এ খবর অনেক মহাত্মাই জানেন কিনা, তাই একটু সতর্কতা।”
মিনিট পনের পরে আমার অঙ্গসজ্জা শেষ করিয়া যখন ব্যোমকেশ ছাড়িয়া দিল, তখন আয়নার সম্মুখে দিয়া দেখি,–কি সর্বনাশ! এ তো অজিত বন্দ্যো নয়, এ যে সম্পূর্ণ আলাদা লোক। ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি ও ছুঁচো্লো গোঁফ যে অজিত বন্দ্যোর কস্মিনকালেও ছিল না। বয়সও প্রায় দশ বছর বাড়িয়া গিয়াছে। রং বেশ একটু ময়লা। আমি ভীত হইয়া বলিলাম–“এই বেশে রাস্তায় বেরুতে হবে। যদি পুলিসে ধরে?”
ব্যোমকেশ সহাস্যে বলিল–“মা ভৈঃ! পুলিসের বাবার সাধ্য নেই তোমাকে চিনতে পারে। বিশ্বাস হয় না, নীচের তলায় কোনও চেনা ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা কয়ে দেখ। জিজ্ঞাসা কর–অজিতবাবু কোথায় থাকেন?”
আমি আরও ভয় পাইয়া বলিলাম–“না, না, তার দরকার নেই, আমি এমনই যাচ্ছি।”
বাহির হইবার অস্ময় ব্যোমকেশ বলিল–“কি করতে হবে, তোমার তো জানাই আছে–শুধু ফেরবার সময় একটু সাবধানে এস, পেছু নিতে পারে।”
“সে সম্ভাবনাও আছে না কি?”
“অসম্ভব নয়। আমি বাড়িতেই রইলুম, যত শীগ্গীর পার, ফিরে এস।”
পথে বাহির হইয়া প্রথমটা ভারী অস্বস্তি বোধ হইতে লাগিল। ক্রমে যখন দেখিলাম, আমাকে ছদ্মবেশ কাহারও দৃষ্টি আকর্ষণ করিতেছে না তখন অনেকটা নিশ্চিন্ত হইলাম, একটু সাহসও হইল। মোড়ের একটা দোকানে আমি নিয়মিত পান খাইতাম, খোট্টা পানওয়ালা আমাকে দেখিলেই সেলাম করিত, সেখানে গিয়া সদর্পে পান চাহিলাম। লোকটা নির্বিকারচিত্তে পান দিয়া পয়সা কুড়াইয়া লইল, আমার পানে ভাল করিয়া দৃক্পাতও করিল না।
পাঁচটা বাজিয়া গিয়াছিল, সুতরাং আর বিলম্ব করা যুক্তিযুক্ত নয় বুঝিয়া ট্রামে চড়িলাম। এস্প্ল্যানেডে নামিয়া বেড়াইতে বেড়াইতে সঙ্কেতস্থানে উপস্থিত হইলাম। মনের অবস্থা যদিও ঠিক অভিসারিকার মত নহে, তবু বেশ একটু কৌতুক ও উত্তেজনা অনুভব করিতে লাগিলাম।
কৌতুক কিন্তু বেশিক্ষণ স্থায়ী হইল না। যে পথে জনস্রোত জলস্রোতের মতই ছুটিয়া চলিয়াছে, সেখানে স্থাণুর মত দাঁড়াইয়া থাকা সহজ ব্যাপার নহে, দুই চারিটা কনুই-এর গুঁতা নির্বিকারভাবে হজম করিলাম। অকারণে সঙ-এর মত ল্যাম্পপোস্ট ধরিয়া দাঁড়াইয়া থাকায় অন্য বিপদও আছে। চৌমাথার উপর একটা সার্জেণ্ট দাঁড়াইয়াছিল, সে সপ্রশ্নভাবে আমার দিকে দুই তিনবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করিল, এখনই হয়তো আসিয়া জিজ্ঞাসা করিবে, কেন দাঁড়াইয়া আছ? কি করি, ফুটপাথের ধারেই হোয়াইটওয়ে লেড্স’র দোকানের একটা প্রকাণ্ড কাচ-ঢাকা জানলায় নানাবিধ বিলাতি পণ্য সাজান ছিল, সেই দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকাইয়া রহিলাম। মনে ভাবিলাম পাড়াগেঁয়ে ভূত মনে করে ক্ষতি নাই, গাঁটকাটা ভাবিয়া হাতে হাতকড়া না পরায়!
ঘড়িতে দেখিলাম, পাঁচটা পঞ্চাশ। কোনক্রমে আর দশটা মিনিট কাটাইতে পারিলে বাঁচা যায়। অধীরভাবে অপেক্ষা করিতে লাগিলাম, মনটা নিজের পাঞ্জাবির পকেটের মধ্যে পড়িয়া রহিল। দুই একবার পকেটে হাত দিয়াও দেখিলাম, কিন্তু সেখানে নূতন কিছুই হাতে ঠেকিল না।
অবশেষে ছয়টা বাজিতেই একটা আরামের নিশ্বাস ফেলিয়া ল্যাম্পপোস্ট পরিত্যাগ করিলাম। পকেট দু’টা ভাল করিয়া পরীক্ষা করিলাম, চিঠিপত্র কিছুই নাই। নিরাশার সঙ্গে সঙ্গে একটা স-মৎসর আনন্দও হইতে লাগিল, যাক্, ব্যোমকেশের অনুমান যে অভ্রান্ত নহে, তাহার একটা দৃষ্টান্ত পাওয়া গিয়াছে। এইবার তাহাকে বেশ একটু খোঁচা দিতে হইবে। এইরূপ নানা কথা ভাবিতে ভাবিতে এস্প্ল্যানেডের ড্রাম-ডিপোতে আসিয়া পৌঁছিলাম।
“ছবি লিবেন, বাবু!”
কানের অত্যন্ত নিকটে শব্দ শুনিয়া চমকিয়া ফিরিয়া দেখি, লুঙ্গি-পরা নীচ শ্রেণীর একজন মুসলমান একখানা খাম আমার হাতে গুঁজিয়া দিতেছে। বিস্মিতভাবে খুলিতেই একখানা কুৎসিত ছবি বাহির হইয়া পড়িল। এরূপ ছবির ব্যবসা কলিকাতার রাস্তাঘাটে চলে জানিতাম; তাই ঘৃণাভরে সেটা ফেরত দিতে গিয়া দেখি লোকটা নাই। সম্মুখে, পশ্চাতে, চারিদিকে চক্ষু ফিরাইলাম; কিন্তু ভিড়ের মধ্যে লুঙ্গি-পরা লোকটাকে কোথাও দেখিতে পাইলাম না।
অবাক্ হইয়া কি করিব ভাবিতেছি, এমন সময় একটা ছোট্ট হাসির শব্দে চমক ভাঙিয়া দেখিলাম, একজন বৃদ্ধ গোছের ফিরিঙ্গি ভদ্রলোক আমার পাশে আসিয়া দাঁড়াইয়াছেন। আমার দিকে না তাকাইয়াই তিনি পরিষ্কার বাঙলায় একান্ত পরিচিত কণ্ঠে বলিলেন–“চিঠি তো পেয়ে গেছ, দেখছি, এবার বাড়ি যাও। একটু ঘরে যেও। এখান থেকে ট্রামে বৌবাজারের মোড় পর্যন্ত যেও, সেখান থেকে বাসে করে হাওড়ার মোড় পর্যন্ত, তারপর ট্যাক্সিতে করে বাড়ি যাবে।”
সার্কুলার রোডের ট্রাম আসিয়া সম্মুখে দাঁড়াইয়াছিল, সাহেব তাহাতে উঠিয়া বসিলেন।
আমি সমস্ত শহর মাড়াইয়া যখন বাড়ি ফিরিলাম, তখন ব্যোমকেশ আরাম-কেদারার উপর লম্বা হইয়া পড়িয়া সিগার টানিতেছে। আমি তাহার সম্মুখে চেয়ার টানিয়া বসিয়া বলিলাম–“সাহেব কখন এলে?”
ব্যোমকেশ ধূম উদ্গীরণ করিয়া বলিল–“মিনিট কুড়ি।”
আমি বলিলাম–“আমার পেছু নিয়েছিলে কেন?”
ব্যোমকেশ উঠিয়া বসিয়া বলিল–“যে কারণে নিয়েছিলুম, তা সফল হল না, এক মিনিট দেরি হয়ে গেল। –তুমি যখন ল্যাম্পপোস্ট ধরে দাঁড়িয়েছিলে, আমি তখন ঠিক তোমার পাঁচ হাত দূরে লেড্ল’র দোকানের ভিতর জানলার সামনে দাঁড়িয়ে সিল্কের মোজা পছন্দ করছিলুম। ‘পথের কাটা’র ব্যাপারী বোধ হয় কিছু সন্দেহ করে থাকবে, বিশেষত তুমি যে-রকম ছটফট করছিলে আর দু’মিনিট অন্তর পকেটে হাত দিচ্ছিলে, তাতে সন্দেহ হবারই কথা। তাই সে তখন চিঠিখানা দিলে না। তুমি চলে যাবার পর আমিও দোকান থেকে বেরিয়েছি, মিনিট দুই-তিন দেরি হয়েছিল–তারি মধ্যে লোকটা কাজ হাসিল করে বেরিয়ে গেল। আমি যখন পৌছলুম, তখন তুমি খাম হাতে করে ইয়ের মত দাঁড়িয়ে আছ। –কি করে খাম পেলে?”
কি করিয়া পাইলাম, তাহা বিবৃত করিলে পর ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল–“লোকটাকে ভাল করে দেখেছিলে? কিছু মনে আছে?”
আমি চিন্তা করিয়া বলিলাম–“না। শুধু মনে হচ্ছে, তার নাকের পাশে একটা মস্ত আঁচিল ছিল। ব্যোমকেশ হতাশভাবে মাথা নাড়িয়া বলিল–“সেটা আসল নয়–নকল। তোমার গোঁফ-দাড়ির মত। যাক, এখন চিঠিখানা দেখি, তুমি ইতিমধ্যে বাথরুমে গিয়ে তোমার দাড়ি-গোঁফ ধুয়ে এস।”
মুখের রোমবাহুল্য বর্জন করিয়া স্নান সারিয়া যখন ফিরিলাম, তখন ব্যোমকেশের মুখ দেখিয়া একেবারে অবাক্ হইয়া গেলাম। দুই হাত পিছনে দিয়া সে দ্রুতপদে ঘরে পায়চারি করিতেছে, তাহার মুখে চোখে এমন একটা প্রদীপ্ত উল্লাসের প্রতিচ্ছবি ফুটিয়া উঠিয়াছে যে, তাহা দেখিয়া আমার বুকের ভিতরটা লাফাইয়া উঠিল। আমি সাগ্রহে জিজ্ঞাসা করিলাম–“চিঠিতে কি দেখলে? কিছু পেয়েছ না কি?”
ব্যোমকেশ উচ্ছ্বসিত আনন্দবেগে আমার পিঠ চাপড়াইয়া বলিল–“শুধু একটা কথা অজিত, একটা ছোট্ট কথা। কিন্তু এখন তোমাকে কিছু বলব না। হাওড়ার ব্রিজ কখনও খোলা অবস্থায় দেখেছ? আমার মনের অবস্থা হয়েছিল ঠিক সেই রকম, দুই দিক্ থেকে পথে এসেছে, কিন্তু মাঝখানটিতে একটুখানি ফাঁক, একটা পনটুন খোলা। আজ সেই ফাঁকটুকু জোড়া লেগে গেছে।”
“কি করে জোড়া লাগল? চিঠিতে কি আছে?”
“তুমিই পড়ে দেখ।” বলিয়া ব্যোমকেশ খোলা কাগজখানা আমার হাতে দিল।
খামের মধ্যে কুৎসিত ছবিটা ছাড়া আর একখানা কাগজ ছিল, তাহা দেখিয়াছিলাম, কিন্তু পড়িবার সুযোগ হয় নাই। এখন দেখিলাম, পরিষ্কার অক্ষরে লেখা রহিয়াছে–
“আপনার পথের কাঁটা কে? তাহার নাম ও ঠিকানা কি? আপনি কি চান, পরিষ্কার করিয়া লিখুন। কোনো কথা লুকাইবেন না। নিজের নাম স্বাক্ষর করিবার দরকার নাই। লিখিত পত্র খামে ভরিয়া আগামী রবিবার ১০ই মার্চ রাত্রি বারোটার সময় খিদিরপুর রেস্কোর্সের পাশের রাস্তা দিয়া পশ্চিম দিকে যাইবেন। একটি লোক বাইসিক্ল চড়িয়া আপনার সম্মুখ দিক্ হইতে আসিবে, তাহার চোখে মোটর-গগ্ল দেখিলেই চিনিতে পারিবেন। তাহাকে দেখিবামাত্র আপনার পত্র হাতে লইয়া পাশের দিকে হাত বাড়াইয়া থাকিবেন। বাইসিক্ল আরোহী আপনার হাত হইতে চিঠি লইয়া যাইবে। অতঃপর যথাসময়ে আপনি সংবাদ পাইবেন।
“পদব্রজে একাকী আসিবেন। সঙ্গী থাকিলে দেখা পাইবেন না।”
দুই তিনবার সাবধানে পড়িলাম। খুব অসাধরণ বটে এবং যৎপরোনাস্তি রোমাণ্টিক–তাহাতে সন্দেহ নাই। কিন্তু ইহাতে ব্যোমকেশের অসম্বৃত আনন্দের কোনও হেতু খুঁজিয়া পাইলাম না। জিজ্ঞাসা করিলাম–“কি ব্যাপার বল দেখি! আমি তো এমন কিছু দেখছি না–”
“কিছু দেখতে পেলে না?”
“অবশ্য তুমি কা লযা অনুমান করেছিলে, তা বর্ণে বর্ণে মিলে গেছে, তাতে সন্দেহ নেই। লোকটার আত্মগোপন করবার চেষ্টার মধ্যে হয়তো কোন বদ মতলব থাকতে পারে। কিন্তু তা ছাড়া আর তো আমি কিছু দেখছি না।”
“হায় অন্ধ! অতবড় জিনিসটা দেখতে পেলে না?” ব্যোমকেশ হঠাৎ থামিয়া গেল, বাহিরে সিঁড়িতে পদশব্দ হইল। ব্যোমকেশ ক্ষণকাল একাগ্রমনে শুনিয়া বলিল–“আশুবাবু। এসব কথা ওঁকে বলবার দরকার নেই–” বলিয়া চিঠিখানা আমার হাত হইতে লইয়া পকেটে পুরিল। আশুবাবু ঘরে প্রবেশ করিলে তাঁহার চেহারা দেখিয়া একেবারে স্তম্ভিত হইয়া গেলাম। মাথার চুল অবিন্যস্ত, জামা-কাপড়ের পারিপাট্য নাই, গালের মাংস ঝুলিয়া গিয়াছে, চোখের কোলে কালি, যেন অক্স্মাৎ কোন মর্মান্তিক আঘাত পাইয়া একেবারে ভাঙিয়া পড়িয়াছেন। কাল সদ্য মৃত্যুর মুখ হইতে রক্ষা পাইবার পরও তাঁহাকে এত অবসন্ন ম্রিয়মাণ দেখি নাই। তিনি একখানা চেয়ারে অত্যন্ত ক্লান্তভাবে বসিয়া পড়িয়া বলিলেন–“একটা দুঃসংবাদ পেয়ে আপনাকে খবর দিতে এসেছি, ব্যোমকেশবাবু। আমার উকিল বিলাস মল্লিক পালিয়েছে।”
ব্যোমকেশ গম্ভীর অথচ সদয় কণ্ঠে কহিল,–“সে পালাবে আমি জানতুম। সেই সঙ্গে আপনার জোড়াসাঁকোর বন্ধুটিও গেছেন, বোধহয় খবর পেয়েছেন।”
আশুবাবু হতবুদ্ধির মত কিছুক্ষণ তাকাইয়া থাকিয়া বলিলেন,–“আপনি–আপনি সব জানেন?”
ব্যোমকেশ শান্ত স্বরে কহিল,–“সমস্ত। কাল আমি জোড়াসাঁকোয় গিয়েছিলুম, বিলাস মল্লিককেও দেখেছি। বিলাস মল্লিকের সঙ্গে ঐ স্ত্রীলোকটির অনেক দিন থেকে ভিতরে ভিতরে ষড়যন্ত্র চলছিল–আপনি কিছুই জানতেন না। আপনার উইল তৈরী করবার পরই বিলাস উকীল আপনার উত্তারাধিকারিণীকে দেখতে যান। প্রথমটা বোধ হয় কৌতুহলবশে গিয়েছিল, তারপর ক্রমে–যা হয়ে থাকে। ওরা এত দিন সুযোগ অভাবেই কিছু করতে পারছিল না। আশুবাবু, আপনি দুঃখিত হবেন না, এ আপনার ভালই হল,–অসৎ স্ত্রীলোক এবং কপট বন্ধুর ষড়যন্ত্র থেকে আপনি মুক্তি পেলেন। আর আপনাস্র জীবনের কোনও ভয় নেই–এখন আপনি নির্ভয়ে রাস্তার মাঝখান দিয়ে হেঁটে যেতে পারেন।”
আশুবাবু শঙ্কাব্যাকুল দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া বলিলেন,–“তার মানে?”
ব্যোমকেশ বলিল,–“তার মানে, আপনি যা মনে মনে সন্দেহ করছেন অথচ বিশ্বাস করতে পারছেন না, তাই ঠিক। ওরাই দু’জনে আপনাকে হত্যা করবার মতলব করেছিল; তবে নিজের হাতে নয়। এই কলিকাতা শহরেই একজন লোক আছে–যাকে কেউ চেনে না, কেউ চোখে দেখেনি–অথচ যার নিষ্ঠুর অস্ত্র পাঁচ জন নিরীহ নিরপরাধ লোককে পৃথিবী থেকে নিঃশব্দে সরিয়ে দিলে। আপনাকেও সরাতো, শুধু পরমায়ু ছিল বলেই আপনি বেঁচে গেলেন।”
আশুবাবু বহুক্ষণ দুই হাতে মুখে ঢাকিয়া বসিয়া রহিলেন, শেষ মর্মন্তুদ দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলিয়া ধীরে ধীরে বলিলেন,–“বুড়ো বয়সে স্বকৃত পাপের প্রায়শ্চিত্ত করছি, কাউকে দোষ দেবার নেই!–আটত্রিশ বছর বয়স পর্যন্ত আমি নিষ্কলঙ্ক জীবন যাপন করেছিলাম, তারপর হঠাৎ পদস্খলন হয়ে গেল। একদিন দেওঘরে তপোবন দেখতে গিয়েছিলাম, সেখানে একটু অপূর্ব সুন্দরী মেয়ে দেখে একেবারে আত্মহারা হয়ে গেলাম। বিবাহে আমার চিরদিন অরুচি, কিন্তু তাকে বিবাহ করবার জন্যে একেবারে পাগল হয়ে গেলাম। শেষে একদিন জানতে পারলাম, সে বেশ্যার মেয়ে। বিবাহ হল না, কিন্ত উতাকে ছাড়তেও পারলাম না। কলকাতায় এনে বাড়ী ভাড়া করে রাখলাম। সেই থেকে এই বারো তের বছর তাকে স্ত্রীর মতই দেখে এসেছি। তাকে সমস্ত সম্পত্তি লিখে দিয়েছিলুম, সে তো আপনি জানেন। ভাবতাম, সেপ আমাকে স্বামীর মত ভালবাসে–কোনও দিন সন্দেহ হয়নি। বুঝতে পারিনি যে, পাপের রক্তে যার জন্ম, সে কখনও সাধ্বী হতে পারে না!–যাক, বুড়ো বয়সে যে শিক্ষা পেলাম, হয়তো পরজন্মে কাজে লাগবে” কিছুক্ষণ নীরব থাকিয়া ভগ্নস্বরে জিজ্ঞাসা করিলেন,–“ওরা–তারা কোথায় গিয়েছে, আপনি জানেন কি?”
ব্যোমকেশ বলিল,–“না। আর সে জেনেও কোন লাভ নেই। নিয়তি তাদের যে পথে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, সে পথে আপনি যেতে পারবেন না। আশুবাবু, আপনার অপরাধ সমাজের কাছে হয়তো নিন্দিত হবে, কিন্তু আমি আপনাকে চিরকাল শ্রদ্ধ করব জানবেন। মনের দিক থেকে আপনি খাঁটি আছেন, কাদা ঘেঁটেও আপনি নির্মল থাকতে পেরেছেন, এইটেই আপনার সব চেয়ে বড় প্রশংসার কথা। এখন আপনার খুবই আঘাত লেগেছে, এ রকম বিশ্বাসঘাতকতায় কার না লাগে? কিন্তু ক্রমে বুঝবেন, এর চেয়ে ইষ্ট আপনার আর কিছু হতে পারত না।”
আশুবাবু আবেগপূর্ণ স্বরে কহিলেন,–“ব্যোমকেশবাবু, আপনি আমার চেয়ে বয়সে অনেক ছোট, কিন্তু আপনার কাছে আমি যে সান্ত্বনা পেলাম, এ আমি কোথাও প্রত্যাশা করিনি। নিজের লজ্জাকর পাপের ফল যে ভোগ করে, তাকে কেউ সহানুভূতি দেখায় না, তাই তার প্রায়শ্চিত্ত এত ভয়ঙ্কর। আপনার সহানুভূতি পেয়ে আমার অর্ধেক বোধা হাল্কা হয়ে গেছে। আর বেশী কি বল্ব, চিরদিনের জন্য আপনার কাছে ঋণী হয়ে রইলাম।”
আশুবাবু বিদায় লইবার পর তাহার অদ্ভুত ট্র্যাজেডির ছায়ায় মনটা আচ্ছন্ন হইয়া রহিল। শয়নের পূর্বে ব্যোমকেশকে একটা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিলাম,–“আশুবাবুকে খুন করবার চেষ্টার পেছনে যে বিলাশ উকীল আর ঐ স্ত্রীলোকটা আছে, এ কথা তুমি কবে জান্লে?”
ব্যোমকেশ কড়িকাঠ হইতে চক্ষু নামাইয়া বলিল,–“কাল বিকেলে।”
“তবে পালাবার আগে তাদের ধরলে না কেন?”
“ধরলে কোন লাভ হত না, তাদের অপরাধ কোনও আদালতে প্রমাণ হত না।”
“কিন্তু তাদের কাছ থেকে আসল হত্যাকারী গ্রামোফোন পিনের আসামীর সন্ধান পাওয়া যেতে পারত।”
ব্যোমকেশ মুখ টিপিয়া হাসিয়া বলিল,–“তা যদি সম্ভব হত, তাহলে আমি নিজে তাদের তাড়াবার চেষ্টা করতুম না।”
তুমি তাদের তাড়িয়েছ?”
“হ্যাঁ। আশুবাবু দৈবক্রমে বেঁচে যাওয়াতে তারা উড়ু উড়ু করছিলই, আমি জা সকালে বিলাস উকীলের বাড়ি গিয়ে ইশারা ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিলুম যে আমি অনেক কথাই জানি, যদি এই বেলা সরে না পড়েন তো হাতে দড়ি পড়বে। বিলাস উকীল বুদ্ধিমান লোক, সন্ধ্যার গাড়ীতেই বামাল সমেত নিরুদ্দেশ হলেন।”
“কিন্তু ওদের তাড়িয়ে তোমার লাভ কি হল?”
ব্যোমকেশ একটা হাই তুলে উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল,–“লাভ এমন কিছু নয়, কেবল দুষ্টের দমন করা গেল। বিলাস উকীল শুধু-হাতে নিরুদ্দেশ হবার লোক নন, মক্কেলের টাকাকড়ি যা তাঁর কাছে ছিল, সমস্তই সঙ্গে নিয়েছিলেন এবং এতক্ষণে বোধ করি, বর্ধমানের পুলিস তাঁকে হাজতে পুরেছে–আগে থাকতেই তারা খবর জানত কি না! যা হোক, বিলাসচন্দ্রের দু’বচ্ছর সাজা কেউ ঠেকাতে পারবে না। যদিও ফাঁসীই তার উচিত শাস্তি, তবু তা যখন উপস্থিত দেওয়া যাচ্ছে না, তখন দু’বচ্ছরই বা মন্দ কি?”
তিন
পরদিন প্রাতঃকালে একজন অপরিচিত আগন্তুক দেখা করিতে আসিল।
সবেমাত্র চায়ের বাটি নামাইয়া রাখিয়া খবরের কাগজখানা খুলিবার যোগাড় করিতেছি, এমন সময় দরজার কড়া নাড়িয়া উঠিল।
ব্যোমকেশ সচকিত হইয়া বলিলে,–“কে? ভেতরে আসুন।”
একটি ভদ্রবেশধারী সুশ্রী যুবক প্রবেশ করিল। দাড়িগোঁফ কামানো, একহারা ছিপছিপে গড়ন, বয়স ত্রিশের মধ্যেই–চেহারা দেখিলে মনে হয়, একজন অ্যাথ্লেট। সম্মুখে আমাদের দেখিয়া স্মিতমুখে নমস্কার করিয়া বলিল,–“কিছু মনে করবেন না, সকালবেলাই বিরক্ত করতে এলাম। আমার নাম প্রফুল্ল রায়–আমি একজন বীমা কোম্পানীর এজেণ্ট।” বলিয়া অনাহূতভাবেই একখানা চেয়ার অধিকার করিয়া বসিল।
ব্যোমকেশ বিরস স্বরে বলিল,–“আমাদের জীবনবীমা করবার মত পয়সা নেই।”
প্রফুল্ল রায় হাসিয়া উঠিল। এক একজন লোক আছে, যাহাদের মুখ দেখিতে বেশ সুশ্রী, কিন্তু হাসিলেই মুখের চেহারা বদলাইয়া যায়। দেখিলাম, প্রফুল্ল রায়েরও তাহাই হইল। লোকটী বোধ করি অতিরিক্ত পানখোর, কারণ, দাঁতগুলো পানের রসে আরক্ত হইয়া আছে। সুন্দর মুখ এত সহজে এমন বিকৃত হইতে পারে দেখিয়া আশ্চর্য বোধ হয়।
প্রফুল্ল রায় হাসিতে হাসিতে বলিল,–“আমি বীমা কোম্পানীর লোক বটে, কিন্তু ঠিক বীমার কাজে আপনাদের কাছে আসিনি। অবশ্য আজকাল আমাদের আসতে দেখলে আত্মীয়-স্বজনরাও দোরে খিল দিতে আরম্ভ করেছেন; নেহাৎ দোষ দেওয়াও যায় না। কিন্তু আপনারা নিশ্চিত হতে পারেন, উপস্থিত আমার কোনও দুরভিসন্ধি নেই।–আপনারই নাম তো ব্যোমকেশবাবু?–বিখ্যাত ডিটেক্টিভ? আপনার কাছে একটু প্রাইভেট পরামর্শ নিতে এসেছি, মশায়। যদি আপত্তি না থাকে–”
ব্যোমকেশ বেজারভাবে মুখখানা বাঁকাইয়া বলিল,–“পরামর্শ নিতে হলে অগ্রিম কিছু দর্শনী দিতে হয়।”
প্রফুল্ল রায় তৎক্ষণাৎ মানিব্যাগ হইতে একখানা দশ টাকার নোট বাহির করিয়া টেবিলের উপর রাখিয়া বলিল,–“আমার কথা অবশ্য গোপনীয় কিছু নয়, তবু–” বলিয়া অর্থপূর্ণভাবে আমার পানে চাহিল।
আমি উঠিবার উপক্রম করিতেছি দেখিয়া ব্যোমকেশ বেশ একটু কড়া সুরে বলিল,–“উনি আমার সহকারী এবং বন্ধু। যা বলবেন, ওঁর সামনেই বলুন।”
প্রফুল্ল রায় বলিল,–“বেশ তো, বেশ তো। উনি যখন আপনার সহকারী, তখন আর আপত্তি কিসের? আপনার নামটি–? মাফ করবেন অজিতবাবু, আপনি যে ব্যোমকেশবাবুর বন্ধু, তা আমি বুঝতে পারিনি। আপনি ভাগ্যবান্ লোক মশায়, সর্বদা এত বড় একজন ডিটেক্টিভের সঙ্গে সঙ্গে থাকা, কত রকম বিচিত্র crime-এর মর্মোদ্ঘাটনে সাহায্য করা কম সৌভাগ্যের কথা নয়। আপনার জীবনের একটা মুহূর্তও বোধ হয় dull নয়! আমার এক এক সময় মনে হয়, এই একঘেয়ে বীমার কাজ ছেড়ে আপনার মত জীবন যাপন করতে যদি পারতাম–” বলিয়া পকেট হইতে পানের ডিবা বাহির করিয়া একটা পান মুখে দিল।
ব্যোমকেশ ক্রমেই অধীর হইয়া উঠিতেছিল, বলিল,–“এইবার আপনার পরামর্শের বিষয়টা যদি প্রকাশ করে বলেন,–তাহলে সব দিক্ দিয়েই সুবিধে হয়।”
প্রফুল্ল রায় তাড়াতাড়ি তাহার দিকে ফিরিয়া বলিল,–“এই যে বলি।–আমি বীমা কোম্পানীর এজেণ্ট, তা তো আগেই শুনেছেন। বম্বের জুয়েল ইন্সিওররেন্স্ কোম্পানীর তরফ থেকে আমি কাজ করি। কোম্পানীর হয়ে দশ বারো লাখ টাকার কাজ আমি করেছি, তাই কোম্পানী খুশী হয়ে আমাকে কলকাতা অফিসের চার্জ দিয়ে পাঠিয়েছেন। গত আট মাস আমি স্থায়িভাবে কলকাতাতেই আছি।
“প্রথম মাস দুই বেশ কাজ চালিয়েছিলাম মশাই, কিন্তু হঠাৎ কোথা থেকে এক আপদ এসে জুটল। কারুর নাম করবার দরকার নেই, কিন্তু অন্য বীমা কোম্পানীর একটা লোক আমার পেছনে লাগল। চুনোপুঁটির কারবার আমি করি না, দু’ চার হাজারের কাজ আমার অধীনস্থ এজেণ্টরাই করে, কিন্তু বড় বড় খদ্দেরের বেলা আমি নিজে কাজ করি। এই লোকটা আমার বড় বড় খদ্দের–ভাল ভাল লাইফ–ভাঙাতে আরম্ভ করলে। আমি যেখানে যাই, আমার পেছু পেছু সে-ও সেখানে গিয়ে হাজির হয়–কোম্পানীর নামে নানারকম দুর্নাম দিয়ে খদ্দের ভড়কে দেয়। শেষে এমন অবস্থা দাঁড়ালো যে, বড় বড় লাইফগুলো আমার হাত থেকে বেরিয়ে যেতে লাগল।
“এইভাবে চার পাঁচ মাস কাটল। কোম্পানী থেকে তাগাদা আসতে লাগল, কিন্তু কি করব, কেমন করে লোকটার হাত থেকে ব্যবসা বাঁচাব, কিছুই ঠিক করতে পারলাম না। মামলা-মোকদ্দমা করাও সহজ নয়–তাতে কোম্পানীর ক্ষতি হয়। অথচ ছিলে জোঁক পেছনে লেগেই আছে। আরও মাসখানেক কেটে গেল, লোকটাকে জব্দ করবার কোনও উপায়ই ভেবে পেলাম না।”
প্রফুল্ল রায় মানিব্যাগ হইতে সযত্নে রক্ষিত দু’টি চিরকুট বাহির করিয়া, ছোট টুকরাটি ব্যোমকেশের হাতে দিয়া বলিল,–“দিন বারো চোদ্দ আগে এই বিজ্ঞাপনটি হঠাৎ চোখে পড়ল। আপনার নজরে বোধহয় পড়েনি, পড়বার কথাও নয়। কিন্তু পাঁচ লাইনের বিজ্ঞাপন হলে কি হয়, মশাই, পড়বামাত্র আমার প্রাণটা লাফিয়ে উঠল! পথের কাঁটা আর কাকে বলে? ভাবলাম, দেখি তো আমার পথের কাঁটা উদ্ধার হয় কি না! মনের তখন এমনই অবস্থা যে, স্বপ্নাদ্য মাদুলী হলেও বোধ করি আপত্তি করতাম না।”
গলা বাড়াইয়া দেখিলাম, এ সেই পথের কাঁটার বিজ্ঞাপনের কাটিং। প্রফুল্ল রায় বলিল, “পড়লেন তো? বেশ মজার নয়? যা হোক, আমি তো নির্দিষ্ট দিনে অর্থাৎ গত শনিবারের আগের শনিবার–কদমতলায় কেষ্ট ঠাকুরের মত ল্যাম্পপোস্ট ধরে গিয়ে দাঁড়ালাম। সে অস্বস্তির কথা আর কি বলব। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পায়ে ঝিঁঝি ধরে গেল, কিন্তু কা কস্য পরিবেদনা–কোথাও কেউ নেই। ডিস্টাস্টেড হয়ে ফিরে আসছি, হঠাৎ দেখি পকেটে একখানা চিঠি!”
দ্বিতীয় কাগজখানা ব্যোমকেশকে দিয়া বলিল,–“এই দেখুন সে চিঠি।”
ব্যোমকেশ চিঠিখানা খুলিয়া পড়িতে লাগিল, আমি উঠিয়া আসিয়া তাহার পিঠের উপর ঝুঁকিয়া দেখিলাম–ঠিক আমার পত্রেরই অনুরূপ, কেবল রবিবারের পরিবর্তে আগামী সোমবার ১১ই মার্চা রাত্রি বারোটার সময় সাক্ষাৎ করিবার নির্দেশ আছে।
প্রফুল্ল রায় একটু থামিয়া চিঠিখানা পড়িবার অবকাশ দিয়া বলিতে লাগিল,–“একে তো পকেটে চিঠি এক কি করে, ভেবেই পেলাম না, তার ওপর চিঠি পড়ে অজানা আতঙ্কে ভেতরটা কেঁপে উঠল। আমি মিস্ট্রি ভালবাসি না মসাই, কিন্তু এ চিঠির যেন আগাগোড়াই মিস্ট্রি। যেন কি একটা ভয়ঙ্কর অভিসন্ধি এর মধ্যে লুকানো রয়েছে। নইলে সব তাতেই এত লুকোচুরি কেন? লোকটা কে, কি রকম প্রভৃতি, কিছুই জানি না, তার চেহারাও দেখিনি, অথচ সে আমাকে রাত দুপুরে একটা নির্জন রাস্তা দিয়ে একলা যেতে বলেছে। ভয়ঙ্কর সন্দেহের কথা নয় কি? আপনিই বলুন তো?”–বলিয়া সে আমার মুখের দিকে চাহিল।
আমি উত্তর দিবার পূর্বেই ব্যোমকেশ বলিল,–“উনি কি মনে করেন সে প্রশ্ন নিষ্প্রয়োজন! আপনি কোন্ বিষয়ে পরামর্শ আন, তাই বলুন।”
প্রফুল্ল রায় একটু ক্ষণ্ণ হইয়া বলিল,–“সেই কথাই তো জিজ্ঞাসা করছি। চিঠির লেখককে চিনি না অথচ তার ভাবগতিক দেখে সন্দেহ হয়, লোক ভাল নয়। এ রকম অবস্থায় চিঠির উত্তর নিয়ে আমার যাওয়া উচিত হবে কি? আমি নিজে গত দশ বারো দিন ধরে ভেবে কিছুই ঠিক করতে পারিনি; অথচ যেতে হলে মাঝে আর একটি দিন বাকী। তাই কি করব ঠিক করতে না পেরে আপনার পরামর্শ নিতে এসেছি।”
ব্যোমকেশ একটু চিন্তা করিয়া বলিল,–“দেখুন, আজ আমি আপনাকে কোনও পরামর্শ দিতে পারলুম না। আপনি এই কাগজ দু’খানা রেখে যান, এখনও যথেষ্ট সময় আছে, কাল সকালে বিবেচনা করে আমি আপনাকে যথাকর্তব্য বলে দেব।”
প্রফুল্ল রায় বলিল,–“কিন্তু কাল সকালে তো আমি আসতে পারব না, আমাকে এক জায়গায় যেতে হবে। আজ রাত্রে সুবিধে হবে না কি? মনে করুন, আটটা কি ন’টার সময় যদি আসি?”
ব্যোমকেশ মাথা নাড়িয়া বলিল,–“না, আর রাত্রে আমি অন্য কাজে ব্যস্ত থাক্ব–আমাকেও এক জায়গায় যেতে হবে–” বলিয়া ফেলিয়াই সচকিতে প্রফুল্ল রায়ের দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া কথাটা ঘুরাইয়া লইয়া বলিল,–“কিন্তু আপনার ব্যস্ত হবার কোনও কারণ নেই, কাল বিকেলে চারটে সাড়ে চারটের সময় এলেও যথেষ্ট সময় থাকবে।”
“বেশ, তাই আসব–” পকেট হইতে আবার ডিবা বাহির করিয়া দুটা পান মুখে পুরিয়া ডিবাটা আমাদের দিকে বাড়াইয়া দিয়া বলিল,–“পান খান কি? খান না!–আমরা এক একটা বদ অভ্যাস কিছুতেই ছাড়তে পারি না; ভাত না খেলেও চলে, কিন্তু পানের অভাবে পৃথিবী অন্ধকার হয়ে যায়। আচ্ছা–আজ উঠি তাহলে, নমস্কার।”
আমরা প্রতিনমস্কার করিলাম। দ্বার পর্যন্ত গিয়া রায় ফিরিয়া দাঁড়াইয়া বলিল,–“পুলিসে এ বিষয়ে খবর দিলে কেমন হয়? আমার ত মনে হয়, পুলিস যদি তদন্ত করে লোকটার নামধাম বিবরণ বের করতে পারে।”
ব্যোমকেশ হঠাৎ মহা খাপ্পা হইয়া বলিল,–“পুলিসের সাহায্য যদি নিতে চান, তাহলে আমার কাছে কোনও সাহায্য প্রত্যাশা করবেন না। আমি আজ পর্যন্ত পুলিসের সঙ্গে কাজ করিনি, করবও না।–এই নিয়ে যান আপনার টাকা।” বলিয়া টেবিলের উপর নোটখানা অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া দেখাইয়া দিল।”
“না না, আমি আপনার মতামত জানতে চেয়েছিলাম মাত্র। তা আপনার যখন মত নেই, আচ্ছা, আসি তাহলে–” বলিতে বলিতে প্রফুল্ল রায় দ্রুতপদে বাহির হইয়া গেল।
প্রফুল্ল রায় চলিয়া গেলে ব্যোমকেশও নোটখানা তুলিয়া লইয়া নিজের লাইব্রেরী ঘরে ঢুকিল, তারপর সশব্দে দরজা বন্ধ করিয়া দিল। সে মাঝে মাঝে অকারণে খিটখিটে হইয়া উঠে বটে, কিন্তু কিছুক্ষণ একাকী থাকিবার পর সেভাব আপনিই তিরোহিত হইয়া যায়, তাহা আমি জানিতাম। তাই মনটা বহু প্রশ্ন-কণ্টকিত হইয়া থাকিলেও অপঠিত সংবাদপত্রখানা তুলিয়া লইয়া তাহাতে মনঃসংযোগের চেষ্টা করিলাম।
কয়েক মিনিট পরে শুনিতে পাইলাম, ব্যোমকেশ পাশের ঘরে কথা কহিতেছে। বুঝিলাম কাহাকেও টেলিফোন করিতেছে। দু’ একটা ইংরাজী শব্দ কানে আসিল; কিন্তু কাহাকে টেলিফোন করিতেছে, ধরিতে পারিলাম না। প্রায় এক ঘণ্টা ধরিয়া কথাবার্তা চলিল, তারপর দরজা খুলিয়া ব্যোমকেশ বাহির হইয়া আসিল। চাহিয়া দেখিলাম, তাহার স্বাভাবিক প্রফুল্লতা ফিরিয়া আসিয়াছে।
জিজ্ঞাসা করিলাম,–“কাকে ফোন করলে?”
সে-কথায় উত্তর না দিয়া ব্যোমকেশ বলিল,–“কাল এস্প্ল্যানেড থেকে ফেরবার সময় একজন তোমার পিছু নিয়েছিল জানো?”
আমি চকিত হইয়া বলিলাম,–“না! নিয়েছিল না কি?”
ব্যোমকেশ বলিল,–“নিয়েছিল, তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু লোকটার কি অসীম দুঃসাহস, আমি শুধু তাই ভাবছি।” বলিয়া নিজের মনেই মৃদু মৃদু হাসিতে লাগিল।
আমাকে অনুসরণ করার মধ্যে এতবড় দুঃসাহসিকতা কি আছে, তা বুঝিলাম না; কিন্তু ব্যোমকেশের কথা মাঝে মাঝে এমন দুরুহ হেঁয়ালির মত হইয়া দাঁড়ায় যে, তাহার অর্থবোধের চেষ্টা পণ্ডশ্রম মাত্র। অথচ এ বিষয়ে তাহাকে প্রশ্ন করাও বৃথা, সময় উপস্থিত না হইলে সে কিছুই বলিবে না। তাই আমি আর বাক্যব্যয় না করিয়া স্নানাদির জন্য উঠিয়া পড়িলাম।
দ্বিপ্রহর ও সন্ধ্যাবেলাটা ব্যোমকেশ নিষ্কর্মার মত বসিয়াই কাটাইয়া দিল। প্রফুল্ল রায় সম্বন্ধে দু’ একটা প্রশ্ন করিলাম, কিন্তু সে শুনিতেই পাইল না, চেয়ারে চক্ষু বুজিয়া পড়িয়া রহল; শেষে চমকিয়া উঠিয়া বলিল,–“প্রফুল্ল রায়? ও, আজ সকালে যিনি এসেছিলেন? না, তাঁর সম্বন্ধে এখনও কিছু ভেবে দেখিনি।”
রাত্রিকালে আহারাদির পর নীরবে বসিয়া ধূমপান চলিতেছিল; ঘড়িতে ঠং করিয়া সাড়ে দশটা বাজিতেই ব্যোমকেশ চেহার হইতে লাফাইয়া উঠিয়া বলিল,-“উঠ বীরজায়া বাঁধ কুন্তল,–এবার সাজসজ্জার আয়োজন আরম্ভ করা যাক, নইলে অভিসারিকাদের সঙ্কেতস্থলে পৌঁছতে দেরি হয়ে যাবে।”
বিস্মিত হইয়া বলিলাম,–“সে আবার কি?”
ব্যোমকেশ বলিল,–“বাঃ, ‘পথের কাটা’র নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে হবে, মনে নেই?”
আমি আশঙ্কায় উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিলাম,–“মাফ কর। এই রাত্রে একলা আমি সেখানে যেতে পারব না। যেতে হয় তুমি যাও।”
“আমি তো যাবই, তোমারও যাওয়া চাই।”
“কিন্তু না গেলেই কি নয়? ‘পথের কাঁটা’র সম্বন্ধে এত মিথ্যে কৌতূহল কেন? তার চেয়ে যদি গ্রামোফোনের পিনের ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামাতে, তাহালে যে ঢের কাজ হত”
“হয়তো হত। কিন্তু ইতিমধ্যে একটা কৌতূহল চরিতার্থ করলেই বা মন্দ কি? গ্রামোফোন পিন তো আর পালাচ্ছে না। তা ছাড়া কাল প্রফুল্ল রায় পরামর্শ নিতে আসবে, তাকে পরামর্শ দেবার মত কিছু খবর তো চাই।”
“কিন্তু দু’জনে গেলে তো হবে না চিঠিতে যে মাত্র একজনকে যেতে বলেছে।”
“তার ব্যবস্থা আমি করেছি। এখন ওঘরে চল, সময় ক্রমেই সংক্ষেপ হয়ে আসছে।”
লাইব্রেরীতে লইয়া গিয়া ব্যোমকেশ ক্ষিপ্তহস্তে আমার মুখসজ্জা করিয়া দিল। দেয়ালে লম্বিত দীর্ঘ আয়ানাটায় উঁকি মারিয়া দেখিলাম, সেই গোঁফ এবং ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি ইন্দ্রজাল প্রভাবে ফিরিয়া পাইয়াছি, কোথাও এতটুকু তফাৎ নাই। আমাকে ছাড়িয়া দিয়া ব্যোমকেশ নিজের বেশভূষা আরম্ভ করিল; মুখের কোনও পরিবর্তন করিল না, দেরাজ হইতে কালো রঙের সাহেবী পোষাক বাহির করিয়া পরিধান করিল, পায়ে কালো রবার-সোল জুতা পরিল। তারপর আমাকে আয়নার সম্মুখে পাঁচ ছয় হাত দূরে দাঁড় করাইয়া নিজে আমার পিছনে গিয়া দাঁড়াইল। জিজ্ঞাসা করিল,–“আয়নায় আমাকে দেখতে পাচ্ছ?”
“না।”
“বেশ। এখন সামনের দিকে এগিয়া যাও–এবার দেখলে পেলে?”
“না।”
“ব্যাস্–কাম ফতে। এখন শুধু একটি পোষাক পরতে বাকী আছে।”
“আবার কি?”
ঘরে ঢুকিয়াই লক্ষ্য করিয়াছিলাম, ব্যোমকেশের টেবিলের উপর দু’টি চীনামাটির প্লেট রাখা আছে–হোটেলে যেরূপ আকৃতির প্লেটে মটন্ চপ খাইতে দেয়, সেইরূপ। সেই প্লেটে একখানা ব্যোমকেশ আমার বুকের উপর উপুড় করিয়া চাপিয়া ধরিয়া চওড়া ন্যাকড়ার ফালি দিয়ে শক্তভাবে বাঁধিয়া দিল। বলিল,–“সাবধান, খসে না যায়। ওর ওপর কোট পরলেই আর কিছু দেখা যাবে না।”
আমি ঘোর বিস্ময়ে বলিলাম,–“এ সব কি হচ্ছে?”
ব্যোমকেশ হাসিয়া বলিল,–“কঞ্চুকী না পরলে চলবে কেন। ভয় নেই, আমিও পরছি।”
দ্বিতীয় প্লেটখানা ব্যোমকেশ নিজের ওয়েস্টকোটের ভিতরে পুরিয়া বোতাম লাগাইয়া দিল, বাঁধিবার প্রয়োজন হইল না।
এইরূপে বিচিত্র প্রসাধন শেষ করিয়া রাত্রি এগারটা কুড়ি মিনিটের সময় আমরা বাহির হইলাম। দেরাজ হইতে কয়েকটা জিনিস পকেটে পুরিতে পুরিতে ব্যোমকেশ বলিল,–“চিঠি নিয়েছ? কি সর্বনাশ, নাও নাও, শিগ্গির একখানা সাদা খামের মধ্যে পুরে নাও–”
শিয়ালদহের মোড়ের উপর একটা খালি ট্যাক্সি পাইয়া তাহাতে চড়িয়া বসিলাম। পথ জন-বিরল, দোকান-পাট প্রায় বন্ধ হইয়া গিয়াছে। আমাদের ট্যাক্সি নির্দেশমত হু হু করিয়া চৌরঙ্গীর দিকে ছুটিয়া চলিল।
কালীঘাট ও খিদিরপুরের ট্রাম-লাইন যেখানে বিভিন্ন হইয়া গিয়াছে, সেই স্থানে ট্যাক্সি হইতে নামিলাম। ট্যাক্সি-চালক ভাড়া লইয়া হর্ণ বাজাইয়া চলিয়া গেল। চারিদিকে দৃষ্টিপাত করিয়া দেখিলাম্ম প্রশস্ত রাজপথের উপর কোথাও একটি লোক নাই, চতুর্দিকে অসংখ্য উজ্জ্বল দীপ যেন এই প্রাণহীন নিস্তব্ধতাকে ভীতিপ্রদ করিয়া তুলিয়াছে। ঘড়িতে তখনও বারোটা বাজিতে দশ মিনিট বাকী।
কি করিতে হইবে, গাড়ীতে বসিয়া পরামর্শ করিয়া লইয়াছিলাম। সুতরাং কথা বলিবার প্রয়োজন হইল না। আমি আগে আগে চলিলাম, ব্যোমকেশ ছায়ার মত আমার পশ্চাতে অদৃশ্য হইয়া গেল। তাহার কালো পরিচ্ছদ ও শব্দহীন জুতা আমার কাছেও যেন তাহাকে কায়াহীন করিয়া তুলিল। আমার পায়ের সঙ্গে পা মিলাইয়া সে আমার ঠিক ছয় ইঞ্চি পশ্চাতে চলিয়াছে, তবু মনে হইল, যেন আমি একাকী। রাস্তার আলো অতি বিস্তৃত পথকে আলোকিত করিয়াছে বটে, কিন্তু সে আলো খুব স্পষ্ট ও তীব্র নহে। পথের দুই পাশে প্রাসাদ থাকিলে আলো প্রতিফলিত হইয়া উজ্জ্বলতর হয়, এখানে তাহা হইতেছে না। দুই দিকের শূন্যতা যেন আলোর অর্ধেক তেজ গ্রাস করিয়া লইতেছে।
এই অবস্থায় সম্মুখ হইতে আসিয়া কাহারও সাধ্য নাই যে বুঝিতে পারে, আমি এক নহি, আমার পশ্চাতে আর একটি অন্ধকার মূর্তি নিঃশব্দে চলিয়াছে।
পাশের ট্রাম-লাইনে ট্রামের যাতায়াত বহু পূর্বে বন্ধ হইয়া গিয়াছে। এ দিকে রেসকোর্সের সাদা রেলিং একটানা ভাবে চলিয়াছে। আমি রাস্তার মাঝখান ধরিয়া হাঁটিয়া চলিলাম। দূরে পশ্চাতে একটা ঘড়িতে ঢং ঢং করিয়া মধ্যরাত্রি ঘোষিত হইল। সঙ্গে সঙ্গে শহরের অন্য ঘড়িগুলোও বাজিতে আরম্ভ করিল, মধ্যরাত্রির স্তব্ধতা নানা প্রকার সুমিষ্ট শব্দে ঝঙ্কৃত হইয়া উঠিল।
ঘড়ির শব্দ মিলাইয়া যাইবার পর কানের কাছে ফিস্ফিস্ করিয়া ব্যোমকেশ বলিল,–“এইবার চিঠিখানা হাতে নাও।”
ব্যোমকেশ যে পিছনে আছে, তাহা ভুলিয়াই গিয়াছিলাম। চমকিয়া পকেট হইতে খামখানা বাহির করিয়া হাতে লইলাম।
আরও ছয় সাত মিনিট চলিলাম। খিদিরপুর পুল পৌঁছিতে তখনও প্রায় অর্ধেক পথ বাকী আছে, এমন সময় সম্মুখে বহু দূরে একটা ক্ষীণ আলোকবিন্দু দেখিয়া সচকিত হইয়া উঠিলাম। কানের কাছে শব্দ হইল,–“আসছে–তৈরী থাকো।”
আলোকবিন্দু উজ্জ্বলতর হইতে লাগিল। মিনিটখানেকের মধ্যে দেখা গেল, পিচঢালা কালো রাস্তার উপর কৃষ্ণতর একটা বস্তু দ্রুতবেগে অগ্রসর হইয়া আসিতেছে। কয়েক মুহূর্ত পরেই বাইসিক্ল-আরোহীর মূর্তি স্পষ্ট হইয়া উঠিল। আমি দাঁড়াইয়া পড়িয়া খামসমেত হাতখানা পাশের দিকে বাড়াইয়া দিলাম। সম্মুখে বাইসিক্লের গতিও মন্থর হইল।
রুদ্ধ-নিশ্বাসে অপেক্ষা করিতে লাগিলাম। বাইসিক্ল পঁচিশ গজের মধ্যে আসিল; তখন দেখিতে পাইলাম, কালো স্যুটপরিহিত আরোহী সম্মুখে ঝুঁকিয়া মোটর-গগ্লের ভিতর দিয়ে আমাকে নিষ্পলক দৃষ্টিতে দেখিতেছে।
মধ্যম-গতিতে সাইক্ল যেন আমাকে লক্ষ্য করিয়ায় অগ্রসর হইতে লাগিল। আমাদের মধ্যে যখন আর দশ গজ মাত্র ব্যবধান, তখন কড়াং কড়াং করিয়া সাইক্লের ঘণ্টি বাজিয়া উঠিল, সঙ্গে সঙ্গে বুকে দারুণ ধাক্কা খাইয়া আমি প্রায় উল্টাইয়া পড়িয়া গেলাম। আমার বুকে বাঁধা প্লেটটা শত খণ্ডে ভাঙিয়া গিয়াছে বুঝিতে পারিলাম।
তারপর নিমিষের মধ্যে একটা কাণ্ড হইয়া গেল। আমি ঢলিয়া পড়িতেই ব্যোমকেশ বিদ্যুদ্বেবেগ সম্মুখদিকে লাফাইয়া পড়িল। বাইসিক্ল-আরোহী আমার পশ্চাতে আর একটা লোকের জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিল না, তবু সে পাশ কাটাইয়া পলাইবে চেষ্টা করিল, কিন্তু পারিল না। ব্যোমকেশ তাহাকে এক ঠেলায় বাইসিক্ল সমেত ফেলিয়া দিয়া বাঘের মত তাহার ঘাড়ে লাফাইয়া পড়িল।
আমি মাটি হইতে উঠিয়া ব্যোমকেশের সাহায্যার্থে উপস্থিত হইয়া দেখিলাম, সে প্রতিপক্ষের বুকের উপর চাপিয়া বসিয়াছে এবং দুই বজ্রমুষ্টিতে তাহার দুই কব্জি ধরিয়া আছে। বাইসিক্লখানা একধারে পড়িয়া আছে।
আমি পৌঁছিতেই ব্যোমকেশ বলিল,–“অজিত, আমার পকেট থেকে সিল্কের দড়ি বার করে এর হাত দুটো বাঁধো–খুব জোরে।”
লিকলিকে সরু রেশমের দড়ি ব্যোমকেশের পকেট হইতে বাহির করিয়া ভূপতিত লোকটার হাত দুটা শক্ত করিয়া বাঁধিলাম। ব্যোমকেশ বলিল,–“ব্যস্, হয়েছে। অজিত, ভদ্রলোকটিকে চিন্তে পারছ না? ইনি আমাদের সকালবেলার বন্ধু প্রফুল্ল রায়! আরও ঘনিষ্ঠ পরিচয় যদি চাও, ইনিই গ্রামোফোনের পিন রহস্যের মেঘনাদ!” বলিয়া তাহার চোখের গগ্ল খুলিয়া লইল।
অতঃপর আমার মনের অবস্থা কিরূপ হইল, তাহা বর্ণনা করা নিষ্প্রয়োজন, কিন্তু সেই অবস্থাতে থাকিয়াও প্রফুল্ল রায় হিংস্র দন্তপংক্তি বাহির করিয়া হাসিল, বলিল,–“ব্যোমকেশবাবু, এবার আমার বুকের উপর থেকে নেমে বসতে পারেন, আমি পালাব না।”
ব্যোমকেশ বলিল,–“অজিত, এর পকেটগুলো ভাল করে দেখে নাও তো অস্ত্রশস্ত্র কিছু আছে কি না।”
এক পকেট হইতে অপেরা প্লাস ও অন্য পকেট হইতে পানের ডিবা বাহির হইল, আর কিছুই না। ডিবা খুলিয়া দেখিলাম্ম তাহার মধ্যে তখনও গোটা চারেক পান রহিয়াছে।
ব্যোমকেশ বুকের উপর হইতে নামিলে প্রফুল্ল উঠিয়া বসিল, ব্যোমকেশের মুখের দিকে কিছুক্ষণ নিষ্পলক দৃষ্টিতে চাহিয়া থাকিয়া আস্তে আস্তে বলিল,–“ব্যোমকেশবাবু, আপনি আমার চেয়ে বেশী বুদ্ধিমান। কারণ, আমি আপনার বুদ্ধিকে অবজ্ঞা করেছিলাম, কিন্তু আপনি করেননি। শত্রুর শক্তিকে তুচ্ছ করতে নেই, এ শিক্ষা একটু দেরিতে পেলাম, কাজে লাগাবার ফুরসত হবে না।” বলিয়া ক্লিষ্টভাবে হাসিল।
ব্যোমকেশ নিজের বুক-পকেট হইতে একটা পুলিস হুইস্ল বাহির কইয়া সজোরে তাহাতে ফুঁ দিল, তারপর আমাকে বলিল,–“অজিত, বাইসিক্লখানা তুলে সরিয়ে রাখো। কিন্তু সাবধান, ওর ঘণ্টিতে হাত দিও না, বড় ভয়ানক জিনিস!”
প্রফুল্ল রায় হাসিল,–“সবই জানে দেখছি, আপনি অসাধারণ লোক। আপনাকেই ভয় ছিল, তাই তো আজ এই ফাঁদ পেতেছিলাম। ভেবেছিলাম, আপনি একা আসবেন, নিভৃতে সাক্ষাৎ হবে। কিন্তু আপনি সব দিক দিয়েই দাগা দিলেন। ভাল অভিনয় করতে পারি বলে আমার অহঙ্কার ছিল; কিন্তু আপনি আরও উচ্চশ্রেণীর আর্টিস্ট। আপনি আমার ছদ্মবেশ খুলে আমার মনটাকে উলঙ্গ করে আজ সকালবেলা দেখে নিয়েছিলেন আর আমি শুধু আপনার মুখোশটাই দেখেছিলাম!–যাক, গলাটা বেজায় শুকিয়া গেছে। একটু জল পাব কি?”
ব্যোমকেশ বলিল,–“জল এখানে নেই, থানায় গিয়ে পাবেন।” প্রফুল্ল রায় ক্লিষ্ট হাসিয়া বলিল,–“তাও তো বটে, জল এখানে পাওয়া যায় কোথা!” কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া পানের ডিবাটার দিকে একটা সতৃষ্ণ দৃষ্টিপাত করিয়া বলিল,–“একটা পান পেতে পারি না কি? অবশ্য আসামীকে পান খাওয়াবার রীতি নেই সে আমি জানি, কিন্তু পেলে তৃষ্ণাটা নিবারণ হত।”
ব্যোমকেশ আমাকে ইঙ্গিত করিল, আমি ডিবা হইতে দু’টা পান তাহার মুখে পুরিয়া দিলাম। পান চিবাইতে চিবাইতে প্রফুল্ল রায় বলিল,–“ধন্যবাদ; বাকী দুটো আপনারা ইচ্ছা করিলে খেতে পারেন।”
ব্যোমকেশ উৎকর্ণভাবে পুলিসের আগমনশব্দ শুনিতেছিল, অন্যমনস্কভাবে মাথা নাড়িল। দূরে মোটর-বাইকের ফট্ ফট্ শব্দ শুনা গেল। প্রফুল্ল রায় বলিল,–“পুলিস তো এসে পড়ল। আমাকে তাহলে ছাড়বেন না?”
ব্যোমকেশ বলিল,–“ছাড়ব কি রকম?”
প্রফুল্ল রায় ঘোলাটে রকম হাসিয়া পুনশ্চ জিজ্ঞাসা করিল,–“পুলিসে দেবেবই?”
“দেব বৈকি!”
“ব্যোমকেশবাবু, বুদ্ধিমান লোকেরও ভুল হয়। আপনি আমাকে পুলিসে দিতে পারবেন না–” বলিয়া রাস্তার উপর ঢলিয়া পড়িল।
একটা মোটর-বাইক সশব্দে আসিয়া পাশে থামিল, একজন ইউনিফর্ম-পরা সাহেব তাহার উপর হইতে লাফাইয়া পড়িয়া বলিল,–“What’s up? Dead?”
প্রফুল্ল রায় নিষ্প্রভ চক্ষু খুলিয়া বলিল,–“এ যে খোদ কর্তা দেখছি! টু লেট্ সাহেব, আমায় ধরতে পারলে না। ব্যোমকেশবাবু, পানটা খেলে ভাল করতেন, একসঙ্গে যাওয়া যেত। আপনার মত লোককে ফেলে যেতে সত্যিই কষ্ট হচ্ছে!” হাসিবার নিষ্ফল চেষ্টা করিয়া প্রফুল্ল রায় চক্ষু মুদিল। তাহার মুখখানা শক্ত হইয়া গেল।
ইতিমধ্যে এক লরি পুলিস আসিয়া উপস্থিত হইয়াছিল। কমিশনার সাহেব নিজে হাতকড়ি লইয়া অগ্রসর হইতেই ব্যোমকেশ প্রফুল্ল রায়ের মাথার কাছ হইতে উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল,–“হাতকড়ার দরকার নেই। আসামী পালিয়েছে।”
চার
আমি আর ব্যোমকেশ আমাদের চিরাভ্যস্ত বসিবার ঘরটিতে মুখোমুখি চেয়ারে বসিয়াছিলাম। খোলা জানালা দিয়া সকালবেলার আলো ও বাতাস ঘরে ঢুকিতেছিল। ব্যোমকেশ একটি বাইসিক্লের বেল্ হাতে লইয়া নাড়িয়া চাড়িয়া দেখিতেছিল। টেবিলের উপর একখানা সরকারী খাম খোলা অবস্থায় পড়িয়াছিল।
ব্যোমকেশ ঘণ্টির মাথাটা খুলিয়া ভিতরের যন্ত্রপাতি সপ্রশংস নেত্রে নিরীক্ষণ করিতে করিতে বলিল,–“কি অদ্ভুত লোকটার মাথা। এ রকম একটা যন্ত্র যে তৈরী করা যায়, এ কল্পনাও বোধ করি আজ পর্যন্ত কারুর মাথায় আসেনি। এই যে পাকানো স্প্রিং দেখছ, এটি হচ্ছে বন্দুকের বারুদ,–কি নিদারুণ শক্তি এই স্প্রিংএর! কি ভয়ঙ্কর অথচ কি সহজ। এই ছোট্ট ফুটোটি হচ্ছে এর নল,–যে পথ দিয়ে গুলি বেরোয়। আর এই ঘোড়া টিপলে দু’ কাজ একসঙ্গে হয়, ঘণ্টিও বাজে, গুলিও বেরিয়ে যায়। ঘণ্টির শব্দে স্প্রিংএর আওয়াজ চাপা পড়ে। মনে আছে–সেদিন কথা হয়েছিল–শব্দে শব্দ ঢাকে গন্ধ ঢাকে কিসে? এই লোকটা যে কত বড় বুদ্ধিমান, সেইদিন তার ইঙ্গিত পেয়েছিলুম।”
আমি জিজ্ঞাসা করিলাম,–“আচ্ছা, পথের কাঁটা আর গ্রামোফোন পিন যে একই লোক, এ তুমি বুঝলে কি করে?”
ব্যোমকেশ বলিল,–“প্রথমটা বুঝতে পারিনি। কিন্তু ক্রমশঃ যেন নিজের অজ্ঞাতসারে ও দুটো মিলে এক হয়ে গেল। দেখ, পথের কাঁটা কি বলছে? সে খুব পরিষ্কার করেই বলছে যে, যদি তোমার সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের পথে কোনও প্রতিবন্ধক থাকে তো সে তা দূর করে দেবে–অবশ্য কাঞ্চন বিনিময়ে। পারিশ্রমিকের কথাটা স্পষ্ট উল্লেখ না থাকলেও, এটা যে তার অনাহারী পরহিতৈষা নয়, তা সহজেই বোঝা যায়। তারপর এ দিকে দেখ, যারা গ্রামোফোন পিনের ঘায়ে মরেছেন, তাঁরা সকলেই কারুর না কারুর সুখের পথে কাঁটা হয়ে বে’চেছিলেন। আমি মৃত ব্যক্তিদের আত্মীয়-স্বজনের ওপর কোনও ইঙ্গিত করতে চাই না, কারণ যে-কথা প্রমাণ করা যাবে না, সে কথা বলে কোনও লাভ নেই। কিন্তু এটাও লক্ষ্য না করে থাকা যায় না যে, মৃত ব্যক্তিরা সকলেই অপুত্রক ছিলেন, তাঁদের উত্তরাধিকারী কোনও ক্ষেত্রে ভাগ্নে, কোনও ক্ষেত্রে ভাইপো, কোনও ক্ষেত্রে বা জামাই। আশুবাবু এবং তাঁর রক্ষিতার উপাখ্যান থেকে এই ভাইপো-ভাগ্নে-জামাইদের মনোভাব কতক বোঝা যায় না কি?
“তবেই দেখা যাচ্ছে, পথের কাঁটা আর গ্রামোফোন পিন বাইরে পৃথক হলেও বেশ স্বচ্ছন্দে অবলীলাক্রমে জোড় লেগে যাচ্ছে–ভাঙা পাথর বাইর দুটো অংশ যেমন সহজে জোড় লেগে যায়। আর একটা জিনিস প্রথম থেকেই আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল–একটার নামের সঙ্গে অন্যটার কাজের সাদৃশ্য। এদিকে ‘পথের কাঁটা’ নাম দিয়ে বিজ্ঞাপন বেরুচ্ছে আর ওদিকে পথের ওপর কাঁটার মতই একটা পদার্থ দিয়ে মানুষকে খুন করা হচ্ছে। মিলটা সহজেই চোখে পড়ে না কি?”
আমি বলিলাম,–“হয়তো পড়ে, কিন্তু আমার পড়েনি।”
ব্যোমকেশ অধীরভাবে ঘাড় নাড়িয়া বলিল,–“এ সব তো খুব সহজ অনুমানের বিষয়। আশুবাবুর কেস হাতে আসার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে এগুলো আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। আসল সমস্যা দাঁড়িয়েছিল–লোকটা কে? এইখানেই প্রফুল্ল রায়ের অদ্ভুত প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায়। প্রফুল্ল রায়কে যারা টাকা দিয়েছে খুন করবার জন্যে, তারাও জানতে পারেনি, লোকটা কে এবং কি করে সে খুন করে। আত্মগোপন করবার অসাধারণ ক্ষমতাই ছিল তার প্রধান বর্ম। আমি তাকে কস্মিনকালেও ধরতে পারতুম কিনা জানি না, যদি না সে আমার মন বোঝবার জন্যে সেদিন নিজে এসে হাজির হত।
“কথাটা একটু বুঝিয়ে বলি। তুমি যেদিন পথের কাঁটার নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে গিয়ে ল্যাম্পপোস্ট ধরে দাঁড়িয়েছিলে, সেদিন তোমার ভাবভঙ্গী দেখে তার সন্দেহ হয়। তবু সে তোমাকে চিঠি গছিয়ে দিয়ে গেল, তারপর অলক্ষ্যে তোমার অনুসরণ করলে। তুমি যখন এই বাড়ীতে এসে উঠলে তখন তার আর সন্দেহ রইল না যে, তুমি আমারই দূত। আশুবাবুর কেস আমার হাতে এসেছে, তা সে জানত, কাজেই তার দৃঢ় বিশ্বাস হল যে, আমি অনেক কথাই জানতে পেরেছি। অন্য লোক হলে কি করত বলা যায় না–হয়তো এ কাজ ছেড়েছুড়ে দিয়ে পালিয়ে যেত; কিন্তু প্রফুল্ল রায়ের অসীম দুঃসাহস–সে আমার মন বুঝতে এল। অর্থাৎ আমি কতটা জানি এবং পথের কাঁটা সম্বন্ধে কি করতে চাই, তাই জানতে এল। এতে তার বিপদের কোন আশঙ্কা ছিল না, কারণ প্রফুল্ল রায়ই যে পথের কাঁটা এবং গ্রামোফোন-পিন, তা জানা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না এবং জানলেও তা প্রমাণ করতে পারতুম না।–শুধু একটি ভুল প্রফুল্ল রায় করেছিল।”
“কি ভুল।”
“সেদিন সকালে আমি যে তারই পথ চেয়ে বসেছিলুম, এটা সে বুঝতে পারেনি। সে যে খোঁজ-খবর নিতে আসবেই, এ আমি জানতুম।”
“তুমি জানতে! তবে আসবামাত্র তাকে গ্রেপ্তার করলে না কেন?”
“কথাটা নেহাৎ ইয়ের মত বললে, অজিত। তখন তাকে গ্রেপ্তার করলে মানহানির মোকদ্দমায় খেসারতৎ দেওয়া ছাড়া আর কোনও লাভ হত না। সে যে খুনী আসামী, তার প্রমাণ কিছু ছিল কি? তাকে ধরার একমাত্র উপায় ছিল–যাকে বলে in the act, রক্তাক্ত হস্তে! আর সেই চেষ্টাই আমি করেছিলুম। বুকে প্লেট বেঁধে দুজনে যে গিয়েছিলুম, সে কি মিছিমিছি?
“যা হোক, প্রফুল্ল রায় আমার সঙ্গে কথা কয়ে বুঝলে যে, আমি অনেক কথাই জানি–শুধু বুঝতে পারলে না যে তাকেও চিনতে পেরেছি। সে মনে মনে ঠিক করলে যে, আমার বেঁচে থাকার নিরাপদ নয়। তাই সে আমাকে একরকম নিমন্ত্রণ করে গেল,–যেন রাত্রে রেসকোর্সের পাশের পথ দিয়ে যাই। সে জানত, একবার তোমাকে পাঠিয়ে ঠকেছি, এবার আমি নিজে যাব। কিন্তু একটা বিষয়ে তার খটকা লাগল, আমি যদি পুলিস সঙ্গে নিয়ে যাই! তাই সে পুলিসের প্রসঙ্গ তুললে। কিন্তু পুলিসের নামে আমি এমনি চটে উঠলুম যে, প্রফুল্ল রায় খুশী হয়ে তাড়াতাড়ি চলে গেল; আমাকে মনে মনে খরচের খায়ায় লিখে রাখলে।
“বেচারা ঐ একটা ভুল করে সব মাটি করে ফেললে। শেষকালে তার অনুতাপও হয়েছিল। আমার বুদ্ধিকে অবজ্ঞা করা যে তার উচিত হয়নি, এ কথা সেদিন সে মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করেছিল।”
কিছুক্ষণ নীরব থাকিয়া ব্যোমকেশ বলিল,–“তোমার মনে আছে, প্রথম যেদিন আশুবাবু আসেন, সেদিন তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলুম, বুকে ধাক্কা লাগবার সময় কোনও শব্দ শুনেছিলেন কি না? তিনি বলেছিলেন, বাইসিক্লের ঘণ্টির আওয়াজ শুনেছিলেন। তখন সেটা গ্রাহ্য করিনি। আমার হাওড়া ব্রিজের ঐখানটাই জোড়া লাগছিল না। তারপর ‘পথের কাঁটা’র চিঠি যখন পড়লুম এক নিমিষে সব পরিষ্কার হয়ে গেল। তোমার প্রশ্নের উত্তরে আমি বলেছিলুম–চিঠিতে একটি কথা পেয়েছি। সে কথাটি কি জানো–বাইসিক্ল!
“বাইসিক্লের কথা কেন যে তখন পর্যন্ত মাথায় ঢোকেনি, এটাই আশ্চর্য। বাস্তবিক, এখন ভেবে দেখলে বোঝা যায় যে, বাইসিক্ল ছাড়া আর কিছুই হতে পারত না। এমন সহজে অনাড়ম্বরভাবে খুন করবার আর দ্বিতীয় উপায় নেই। তুমি রাস্তা দিয়ে যাচ্ছ, সামনে একটা বাইসিক্ল পড়ল। বাইসিক্ল-আরোহী তোমাকে সরে যাবার জন্য ঘণ্টি দিয়েই পাশ কাটিয়ে চলে গেল। তুমিও মাটিতে পড়ে পটলোৎপাটন করলে। বাইসিক্ল-আরোহীকে কেউ সন্দেহ করতে পারে না। কারণ, সে দু’হাতে হাণ্ডেল ধরে আছে–অস্ত্র ছুঁড়বে কি করে? তার দিকে কেউ ফিরেও তাকায় না।
“একবার পুলিস ভারী বুদ্ধি খেলিয়েছিল, তোমার মনে থাকতে পারে। গ্রামোফোন পিনের শেষ শিকার কেদার নন্দী লালবাজারের মোড়ের উপর মরেছিলেন। তিনি পড়বামাত্র পুলিস সমস্ত ট্রাফিক বন্ধ করে দিয়ে প্রত্যেক লোকের কাপড়-চোপড় পর্যন্ত অনুসন্ধান করে দেখেছিল। কিন্তু কিছুই পেলে না। আমার বিশ্বাস, প্রফুল্ল রায়ও সেখানে ছিল এবং তাকেও যথারীতি সার্চ করা হয়েছিল। প্রফুল্ল রায় তখন মনে মনে খুব হেসেছিল নিশ্চয়। কারণ, তার বাইসিক্ল বেল্এর মাথা খুলে দেখবার কথা কোনও পুলিস-দারোগার মাথায় আসেনি।” বলিয়া ব্যোমকেশ সস্নেহে বেল্টি নিরীক্ষণ করিতে লাগল।
টেবিলের উপর হইতে সরকারী লম্বা খামখানা হাওয়ায় উড়িয়া আমার পায়ের কাছে পড়িল। সেখানে তুলিয়া টেবিলের উপর রাখিয়া দিয়া আমি জিজ্ঞাসা করিলাম,–“পুলিস কমিশনার সাহেব কি লিখেছেন?”
ব্যোমকেশ বলিল,–“অনেক কথা। গোড়াতেই আমাকে পুলিস এবং সরকার বাহাদুরের পক্ষে থেকে ধন্যবাদ দিয়েছেন; তারপর প্রফুল্ল রায় আত্মহত্যা করাতে দুঃখ প্রকাশ করেছেন; যদিও এতে তাঁর খুশী হওয়াই উচিত ছিল–কারণ, গভর্মেণ্টের অনেক খরচ এবং মেহনত বেঁচে গেল। যা হোক, সরকার বাহাদূরের কাছ থেকে প্রতিশ্রুত পুরস্কার যে আমি শীঘ্রই পাব, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কারণ, পুলিস সাহেব জানিয়েছেন যে, দরখাস্ত করবামাত্র আমার আর্জি মঞ্জুর হবে, তার ব্যবস্থা তিনি করেছেন। প্রফুল্ল রায়ের লাস কেউ সনাক্ত করতে পারেনি, জুয়েল ইন্সিওরেন্স কোম্পানীর লোকরা লাস দেখে বলেছে যে, এ তাদের প্রফুল্ল রায় নয়, তাদের প্রফুল্ল রায় উপস্থিত কর্ম উপলক্ষে যশোহরে আছেন। সুতরাং বেশ বোঝা যাচ্ছে যে, প্রফুল্ল রায় নামটা ছদ্মনাম। কিন্তু তাতে কিছু আসে যায় না, আমার কাছে ও চিরকাল প্রফুল্ল রায়ই থাকবে। চিঠির উপসংহারে পুলিস সাহেব একটা নিদারুণ কথা লিখেছেন–এই ঘণ্টিটি ফেরৎ দিতে হবে। এটা না কি এখন গভর্নমেণ্টের সম্পত্তি।”
আমি হাসিয়া বলিলাম,–“ওটার ওপর তোমার ভারী মায়া পড়ে গেছে–না? কিছুতেই ছাড়তে পারছ না?”
ব্যোমকেশও হাসিয়া ফেলিল,–“সত্যি, দু’হাজার টাকা পুরস্কারের বদলে সরকার বাহাদুর যদি আমাকে এই ঘণ্টিটা বক্শিশ করেন, আমি মোটেই দুঃখিত হই না। যা হোক, প্রফুল্ল রায়ের একটা স্মৃতিচিহ্ন তবু আমার কাছে রইল।”
“কি?”
“ভুলে গেলে? সেই দশ টাকার নোটখানা। সেটাকে ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখবো ভেবেছি। তার দাম এখন আমার কাছে একশ’ টাকারও বেশী।” বলিয়া ব্যোমকেশ সযত্নে দেরাজের মধ্যে বন্ধ করিয়া রাখিয়া আসিল।
সে ফিরিয়া আসিলে আমি তাহাকে একটা প্রশ্ন করিলাম,–“আচ্ছা ব্যোমকেশ, সত্যি বল, পানের মধ্যে বিষ আছে তুমি জানতে?”
ব্যোমকেশ একটু চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল,–“জানা এবং না জানার মাঝখানে একটা অনিশ্চিত স্থান আছে, সেটা সম্ভাবনার রাজ্য।” কিছুক্ষণ পরে আবার বলিয়া উঠিল,–“তুমি কি মনে কর প্রফুল্ল রায় যদি সামান্য খুনীর মত ফাঁসি যেত তাহলে ভাল হত? আমার তা মনে হয় না। বরং এমনি ভাবে যাওয়াই তার ঠিক হয়েছে, সে যে কতবড় আর্টিস্ট ছিল, ধরা পড়েও হাত পা বাঁধা অবস্থায় সে তা দেখিয়ে দিয়ে গেছে।”
স্তব্ধ হইয়া রহিলাম। শ্রদ্ধা ও সহানুভূতি কোথা দিয়া যে কোথায় গিয়া পৌঁছতে পারে তাহা দেখিলে বিস্মিত না হইয়া থাকা যায় না।
“চিঠি হ্যায়।”
ডাক-পিয়ন একখানা রেজিস্ট্রি চিঠি দিয়া গেল। ব্যোমকেশ খাম খুলিয়া ভিতর হইতে কেবল একখানা রঙীন কাগজের টুকরা বাহির করিল, তাহার উপর একবার চোখ বুলাইয়া সহাস্যে আমার দিকে বাড়াইয়া দিল।
দেখিলাম, শ্রীআশুতোষ মিত্রের দস্তখৎ-সম্বলিত একখানি হাজার টাকার চেক।
(সমাপ্ত)