একেনবাবু ও বর্মণ বাড়ি রহস্য – সুজন দাশগুপ্ত
শমীতা দাশ দাশগুপ্ত
সুজন দাশগুপ্ত
বাপির কথা
এই গল্পের খসড়া আমার ডায়েরিতে লেখা ছিল না। সেখান থেকেই একেনবাবুর সব রহস্য কাহিনি আমি লিখি। তাই এই গল্পে ‘আমি’ নেই, আমার বা প্রমথর ভাবনাচিন্তার কথাও নেই। এখানে একেনবাবু আছেন ঠিকই, কিন্তু কাহিনিটি শুনেছি ওঁর পিসতুতো বোন রিনিতার কাছ থেকে। গত বছরই দেশে এসে ওর সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ। আমার কথা ও জানত। আলাপ হতেই বলল, “কানুদার অনেক কীর্তিকলাপ আমি জেনেছি আপনার বই পড়ে।”
“কানুদা?”
“আপনাদের একেনবাবু।”
“আরে, এই নামটা তো আমাদের একেবারেই জানাননি! পরে ওঁর কোনো গল্পে কানুবাবু নামটা লাগিয়ে তাক করে দেব!” বলেই অবশ্য বললাম, “মুশকিল হল আমার স্টকে আর বিশেষ কোনো গল্প নেই। কলকাতায় যেসব তদন্ত করছেন, সেসব নিয়ে কিচ্ছু বলেন না!”
মুচকি হেসে রিনিতা বলল, “বর্মণ বাড়ির রহস্য নিয়ে কানুদা কখনো কিছু বলেছে?”
“না-আ-আ।”
“শুনবেন?”
“অবশ্যই।”
“আপনার গল্পের হিউমারগুলো কিন্তু থাকবে না।”
“কোনো দরকার নেই, ওগুলো লিখে লিখে বস্তাপচা হয়ে গেছে।”
রিনিতার বলা সেই গল্পই আমি লিখছি। তবে লিখতে বেশ কসরত করতে হচ্ছে যেহেতু আমি নিজে জড়িত নই। কীভাবে যে গল্পটা খাড়া করব মাথায় আসছে না। যাক গে, শুরু তো করে দিই…
দিন চারেকের জন্য রিনিতা ওর বন্ধু শিখার আমন্ত্রণে বর্মণ বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিল। শিখার ভালো নাম শিখা বর্মণ। রিনিতার সঙ্গে ব্যাঙ্গালোরে একটা সফটওয়্যার কোম্পানিতে কাজ করে। ডিপার্টমেন্ট আলাদা শিখা ফাইনান্স সেকশনে, রিনিতা ক্লাউড কম্পিউটিং ডিভিশনে। প্রায় একই বয়সি কলকাতার দুই মেয়ে, বন্ধুত্ব হতে সময় লাগেনি। এক বছর হল ব্যাঙ্গালোরে টেকনোলজি পার্ক অঞ্চলে অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নিয়ে একসঙ্গে আছে। এবার দু-সপ্তাহের ছুটিতে দু-জনে যখন কলকাতায় ফিরল, শিখা ধরে বসল টালিগড়ে ওদের দেশের বাড়িতে ক’দিন কাটিয়ে যেতে হবে। ওর বাবা-মা-দাদা সবাই আজকাল ওখানেই থাকে। ইদানীং কারোর সঙ্গেই ওর বনছে না, একা একা সেখানে থাকলে পাগল হয়ে যাবে! রিনিতার মোটেই যাবার ইচ্ছে ছিল না, কিন্তু বন্ধু এত করে ধরেছে…
এক
হুগলির খন্যান স্টেশনের কাছে ছোট্ট একটা আধা গ্রাম টালিগড়। শুক্রবার শিখাই গাড়ি চালিয়ে রিনিতাকে নিয়ে এল। হাইওয়ে ধরে ঘণ্টা দুয়ের পথ। শেষ এক মাইলটাক হাইওয়ে থেকে নেমে ভাঙাচোরা মেঠো রাস্তা ধরে গেলে শিখাদের বাড়ি। চারিদিকে উঁচু দেয়াল দেওয়া কম্পাউন্ড। ভেতরে ঢোকা আর বেরোনোর জন্য গ্রিল দেওয়া দুটো আলাদা গেট। দুটোই বন্ধ, কিন্তু তালা দেওয়া নেই। গেটের সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে হর্ন দিয়েও কোনো লাভ হল না। শেষমেশ শিখা নিজেই মেইন গেট খুলতে গেল। রিনিতাও নামল গাড়ি থেকে।
লাল রঙের ইউ-শেপের বিশাল দোতলা বাড়ি, বলতে গেলে প্রাসাদ। এক তলার দুটো উইং-এ বোধহয় রিপেয়ারিং আর রঙের কাজ চলছে। ভেতরের প্রধান অংশের কাজ মোটামুটি শেষ। সেখানে বারান্দায় ওঠার চওড়া সিঁড়ি। সাইড বারান্দায়ও সিঁড়ি আছে, তবে সাইজে ছোটো। বাড়ির সামনে চত্বরের মাঝখানে একটা ফোয়ারা, জল পড়ছে না। দু-দিকে দুটো ভাস্কর্য। এককালে হয়তো মোহিনী নারীমূর্তি ছিল, এখন খুঁটিয়ে না দেখলে লিঙ্গ বোঝা দুষ্কর। দুটোতেই সংরক্ষণের অভাব প্রকট। চত্বরটা সবুজহীন। ঘাস থাকলে জায়গাটা খুবই সুন্দর লাগত। কিন্তু এত বড়ো কম্পাউন্ড আর বাড়ি ঠিকঠাক রাখা কম খরচার ব্যাপার নয়!
এ অঞ্চলে পরাই বোধহয় বাড়িটাকে টালিগড়ের রাজবাড়ি বলে। কাঁচা রাস্তায় গাড়ি থেকে নেমে মেয়ে ড্রাইভার গেট খুলছে দেখে কৌতূহলী জনতা ভিড় করল। তাদের মধ্যে একজন বয়স্ক লোক শিখাকে চিনতে পেরে এগিয়ে এল।
“দিদিমণি বাড়ি এয়েচেন? যান, সোজ্জা যান গে! গেট আমি বন্দ করে দেব।” সেই অন্যদের ধমক লাগাল তেড়ে।
“সর দিকি, যেতে দে দিদিমণিদের। ভিড় কচ্চিস কেন, ইল্লুতে সব গাড়ি রাজবাড়ি ঢুকবে। সর, সর, সরলি!”
বকুনিতে কাজ হল। ওদের কাটিয়ে গাড়ি কম্পাউন্ডে ঢুকিয়ে দু-জনে নামল। রিনিতা বলল, “তোর বাবা যে রাজা ছিলেন বলিসনি তো?”
শিখা লজ্জা পেল।
“আরে না, না, ওসব বাজে কথা। তবে শুনেছি উত্তরবঙ্গে নাকি ঠাকুরদার ঠাকুরদা বিশাল জমিদারি করেছিলেন। তিনিই বাড়িটা বানিয়েছেন। মানে অধস্তন চোদ্দো না হলেও তিন পুরুষকে উচ্ছন্নে দিয়ে গেছেন। ঠাকুরদার বাবা-কাকারা সারাজীবন কিচ্ছু করেনি, ঠাকুরদা আর ওঁর ভাইয়েরাও তাই। দু-পুরুষ শুধু টাকা উড়িয়েছেন! ফলে বাবাকে রোজগার করে খেতে হয়েছে— সারাজীবন ওকালতি করেছেন। তবে কী জানিস, রোজগারের বেশিরভাগই ঢেলেছেন এই বাড়ির পেছনে। টোটাল ওয়েস্ট, কিন্তু বাবার অবসেশন!”
“তা বলছিস কেন, এরকম দারুণ একটা বাড়ি। মেনটেন তো করতেই হবে। আমার তো মনে হয় হোটেল হিসেবে দারুণ হবে বাড়িটা!”
“কে আসবে এই ধ্যাড়ধ্যাড়ে গোবিন্দপুরে ছুটি কাটাতে? গঙ্গার পাশে-টাশে হলে তবু একটা কথা ছিল!”
“কেন রে, সিনেমা-টিভির শুটিং-এর জন্যেও তো দারুণ লোকেশন!”
“দাদাকে বলিস, খুশি হবে। দাদা তো সব ময়েই সুযোগ খুঁজছে প্রোমোটারদের হাতে বাড়ি তুলে দেওয়ার। তবে বাবাকে ক্ষুাক্ষরে বলতে যাস না, সঙ্গে সঙ্গে তোড়ে গালাগাল দিয়ে তাড়িয়ে দেবে! প্রাণ থাকতে এই বাড়ি হাতছাড়া করবে না বাবা। কত যে অশান্তি হয় এ নিয়ে!”
কথা বলতে বলতে ওরা সামনের বারান্দায় পৌঁছোল। রিনিতা এই প্রথম এমন একটা পুরোনো বাড়িতে এল।
“কত বয়স হবে রে এটার?”
“দেড়শোর বেশি।”
“ওরেব্বাস!”
তবে বাইরে থেকে বাড়িটা রিনিতার যত সুন্দর লাগছিল, বারান্দায় উঠে মোহভঙ্গ হল। পুরো বারান্দা চুন আর সিমেন্টের ধুলোয় ভরতি। রিপেয়ারের পর ভালো করে ঝাঁট পড়েনি। উঁচু ছাদের নীচে ঘুলঘুলির ফাঁকে ফাঁকে পায়রার বাসা,
তারাও যত্রতত্র নোংরা করেছে।
ওর মনোভাব আন্দাজ করে শিখা গজগজ করল, “নীচের তলায় কেউ থাকে না, সবাই দোতলায়। তাও এত রংচং কেন করতে হবে জানি না!”
রিনিতার মনে হল এই বিশাল অঙ্কের ব্যয় নিয়ে শিখার নিশ্চয়ই দুশ্চিন্তা হচ্ছে। ওর বাবা নাকি আর সব দিকে কৃপণতা করে টাকা ঢালেন বাড়ি সংরক্ষণে।
রিপেয়ার চলছে, তবে মিস্ত্রি কাউকে দেখা গেল না। বোধহয় ছুটি এখন। সামনে দোতলায় উঠবার সিঁড়ি। দোতলার বারান্দাটা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। বারান্দার পাশে সার দিয়ে অজস্র ঘর, গোটা আট-দশ তো হবেই। পাশের দুটো উইং মিলিয়ে আরও গোটা বারো।
ওদের আসার কথা শিখা বলে রেখেছিল। দিদিমণিকে দেখে কাজের লোক গোপাল ছুটল নীচে গাড়ি থেকে সুটকেস আনতে। এমনিতে গাড়িটা টালিগড়ের বাড়িতেই থাকে, শুধু শিখা কলকাতায় এলে ওর কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। শিখার বাবা তুঙ্গনাথ বর্মণ গাড়ি চালান না। দাদা ঋদ্ধি আগে গাড়ি খুব ব্যবহার করত। কিন্তু একবার বড়োসড়ো অ্যাক্সিডেন্ট করার পর থেকে তুঙ্গনাথবাবু তার গাড়ি চালানোর অধিকার কেড়ে নিয়েছেন। এক জন পার্ট-টাইম লোকাল ড্রাইভার আছে, দরকার হলে তুঙ্গনাথ তাকে ডাকেন। ড্রাইভার কাছেই থাকে।
বাড়িতে কাজের লোক বলতে গোপাল আর এক মাঝবয়সি রাঁধুনি-কল্পনা। এ বাড়িতে গোপাল কাজ করছে অনেকদিন। বাড়ির পেছনে ছোটো আউট হাউসে থাকে। বাড়ির মধ্যে কল্পনার একটা থাকার জায়গা আছে, কিন্তু সাধারণত সেখানে ও থাকে না। সকাল সকাল আসে, আর আটটা নাগাদ পাশের গ্রামে নিজের বাড়ি চলে যায়। এরা ছাড়া এই বিশাল বাড়িতে রয়েছে মাত্র তিনটি প্রাণী-শিখার মা-বাবা আর দাদা ঋদ্ধি।
শিখার চেয়ে ওর দাদা বছর তিনেকের বড়ো। রিনিতা ভাবল কলকাতা ছেড়ে ঋদ্ধি এই পাড়াগাঁয়ে পড়ে আছে কেন? শেষে শিখাই সে রহস্য উদ্ঘাটন করল।
“ঠাকুরদার রক্ত দাদা পেয়েছে। দেদার খরচ করে। ফলে বুঝেছিস তো, অজস্র পাওনাদার। তাদের হাত থেকে বাঁচতে পালিয়ে এসেছে। তুই আবার টাকা ধার দিতে যাস না ওকে।”
বন্ধুকে এই অদ্ভুত সতর্কবাণী দেওয়ার যৌক্তিকতা শিখার আছে। এর আগে ওর দু-এক জন বন্ধুর কাছে ঋদ্ধি টাকা ধার করেছিল। লজ্জায় পড়ে শিখাকেই পরে সেই দেনা শোধ করতে হয়েছে! এতে বোনের কাছে ঋদ্ধি এতটুকুও লজ্জা প্রকাশ করেনি।
“এর মধ্যে আরও একটা কাণ্ড ঘটিয়েছে দাদা। বাড়িতে কাউকে না জানিয়ে বিয়ে করে বসে আছে।” ফিক করে হেসে শিখা বলল, “হয়তো তার ধার শোধ করতে পারেনি বলেই!”
বিয়ে করেছে! সে তো আনন্দের কথা। শিখা অমন চেপে চেপে বলছে কেন!
“তুই দেখেছিস বউদিকে?”
“না, দেখতে চাইও না। এ বাড়ির কোনো কিছুর সঙ্গেই বেশি জড়াতে নেই। কিছু মনে করিস না, তুই এত বন্ধু বলেই পরিবারের ডার্টি লন্ড্রি খুলে দেখালাম। এখন বুঝতে পারছিস তো, কেন বাড়ি আসতে চাই না! তুই থাকলে জায়গাটা একটু সহনীয় হবে।”
কী বলবে ভেবে না পেয়ে বন্ধুকে প্রবোধ দেবার চেষ্টা করল রিনিতা, “শোন, অনেক সময় ভাই-বোনদের বনে না। কিন্তু তোর বাবা-মা তো আছেন।”
“মা ঠিক আছে, তবে সংসারে থেকেও নেই। একদম নির্লিপ্ত। আর বাবা ইম্পসিবল! শুধু বাড়ি, বাড়ি, আর বাড়ি। মাথায় খালি টাকা জোগাড়ের চিন্তা- সংসারের জন্য নয়, এই বাড়ি কী করে রক্ষা করবেন সেজন্যে! আমরা সব ফালতু। “ ফোঁস করে দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়ল শিখা।
বন্ধুকে তার মা-বাবার ঝামেলা নিয়ে কি মন্তব্য করা যায়! রিনিতা চুপ করে রইল, এ ব্যাপার নিয়ে আর ঘাঁটাঘাঁটি করল না।
দুই
দোতলায় উঠে শিখার মা’র সঙ্গেই প্রথম দেখা। নীচু হয়ে প্রণাম করতে যেতেই ঝট করে সরে গেলেন।
“থাক, থাক। শিখার মুখে তোমার কথা শুনেছি। তুমি এসেছ, ভালো। শিখার এই জায়গাটা আবার তেমন পছন্দ হয় না। এ হল বুড়ো-বুড়িদের জায়গা।”
শিখা আপত্তি জানাল, “না মা, আমি মোটেই তা বলিনি।”
“না, মুখে বলোনি,” ঠান্ডা হাসলেন অরুন্ধতী। মুখ ঘুরিয়ে রিনিতাকে বললেন, “এখানে শাকসবজি, মাছ খুব টাটকা। যা খেতে ইচ্ছে করবে কল্পনাকে বলবে, করে দেবে। গোপাল বাজার করে আনে। এ বাড়িতে রান্নাবান্না, ঘরদোর সামলানো কল্পনাই করে। আশাকরি তোমার ভালো লাগবে। তুমি একটু খেয়াল রেখো শিখা, বন্ধুর যেন কোনো অসুবিধা না হয়। ওর ঘর গুছিয়ে দেওয়া হয়েছে, দেখিয়ে দিয়ো।”
এতদিন পরে দেখা হয়েও মা-মেয়ের মিলনের শীতলতা দেখে রিনিতার অবাক লাগল। এ বাড়িতে সব কিছু কেমন অন্যরকম। সত্যি কথা বলতে কী, শিখাও মাঝে মাঝে কেমন যেন কাঠ কাঠ হয়ে যায়।
.
সুন্দর ঘর, টান টান করে ঢাকা দেওয়া বিছানা। এসি নেই, কিন্তু খাটের ওপর একটা মস্ত সিলিং ফ্যান ঝুলছে। রাতে অন্তত ঘুমোনো যাবে। মোটা দেয়ালের পুরোনো বাড়ি, উঁচু সিলিং, বড়ো বড়ো জানলা- রিনিতার খুব একটা গরম লাগল না।
দোতলাটা ভালোই সংস্কার করা হয়েছে। ঘরের লাগোয়া একটা মডার্ন বাথরুম– বিশাল সাইজ। শাওয়ার, ফ্লাশ টয়লেট, জামাকাপড় রাখার আলনা। কলকাতায় এরকম লাক্সারি কল্পনা করাও কঠিন। পরে শিখা বলল আগে নাকি পুরো দোতলার জন্যে তিনটে ওল্ড ফ্যাশন্ড চৌবাচ্চাওয়ালা বাথরুম ছিল। বছর আটেক আগে তুঙ্গনাথ যখন রিটায়ার করে এখানে এসে থাকার প্ল্যান করছিলেন, তখন বাড়ির চার সদস্যের ঘরের পাশের একটা ঘর বাথরুম করে ফেলা হয়েছে। পরে শিখা জোর করে তিনটি গেস্ট রুমে বাথরুম যোগ করিয়েছে। তারই একটিতে রিনিতা থাকছে।
শিখা আর রিনিতা দেরিতে পৌঁছেছে, শিখার বাবা, মা, আর দাদা আগেই খেয়ে নিয়েছেন। ওদের জন্যে খাবার তোলা ছিল। কল্পনামাসির রান্না, উনিই সার্ভ করলেন। শিখার বাবা তুঙ্গনাথ বা দাদা ঋদ্ধির দেখা পাওয়া গেল না। মা-ও নিজের ঘরে। টেবিলে বসে খেতে খেতে রিনিতা জিজ্ঞেস করল, “তোর দাদা তো এখন এ বাড়িতেই আছেন, তাই না?”
“হ্যাঁ, মনে তো হয়। এসে অবধি এখনও দেখা পাইনি। কোথাও চরতে গেছে! “বাবা?”
“বাবার সঙ্গে কে যেন দেখা করতে এসেছে শুনলাম, তাকে নিয়ে বেরিয়েছে।”
খাওয়ার পরে শিখা ঘুরে ঘুরে রিনিতাকে বাড়িটা দেখাল। তারপর বিকেলের রোদ একটু পড়তেই গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল দুই বন্ধু। কাছেই একটা ফার্ম হাউজ আছে। এক জার্মান সাহেব তার বাঙালি স্ত্রীকে নিয়ে একটা ভেঞ্চার শুরু করেছে। কিছু লোকাল মেয়ে তাতে কাজ করে। একটা আউটলেটে বিক্রি হচ্ছে তাদের তৈরি আচার, কাসুন্দি, আমসত্ত্ব, সস। কিছুক্ষণ ওখানে কাটিয়ে এদিক-ওদিক ঘুরতে ঘুরতে অন্ধকার হয়ে গেল।
বর্মণ বাড়িতে রাতের খাওয়া হয় তাড়াতাড়ি। তার কারণ বোধহয় কল্পনামাসির বাড়ি যাবার তাড়া। সে-ই ডাক দিয়ে সবাইকে টেবিলে নিয়ে এল। ডিনারে সবার সঙ্গে দেখা হল রিনিতার। ঋদ্ধি আগ বাড়িয়ে ভাব জমাবার চেষ্টা করছিল, কিন্তু শিখার সাবধানবাণী মনে পড়ায় রিনিতা সতর্কভাবে উত্তর দিল। শিখার মা মুখ বুজে খেয়ে যাচ্ছেন। ওর সঙ্গে একটা-দুটো ছাড়া শিখা কারোর সঙ্গে কথা বলছে না। বাবা আর ছেলের মধ্যে যে খুচরো বাক্যালাপ চলছে তাতে টেনশন স্পষ্ট। এমন অস্বস্তিতে রিনিতা বেশি পড়েনি।
মনে হল তুঙ্গনাথবাবু কিছু নিয়ে বেশ চিন্তিত। আলাপ হবার পর, ‘তুমি শিখার বন্ধু’, ‘কী করো”, “কোথায় থাকো’, টাইপের কয়েকটা প্রশ্ন করলেন বটে কিন্তু উত্তরগুলো কানে গেল কিনা বোঝা গেল না। খাওয়া প্রায় শেষ হব হব, উনি হঠাৎ ঘোষণা করলেন, “আজ রাতে একটা ছেলে আসবে, এ বাড়িতে ক’দিন থাকবে।”
“এত রাতে?” ঋদ্ধি অবাক হয়ে প্রশ্ন করল।
তুঙ্গনাথ ভুরু কোঁচকালেন, “যেখান থেকে আসছে সেখান থেকে চট করে তাসা যায় না।”
“কাল এলেই পারত!” ছাড়া ছাড়া গলায় অরুন্ধতী দেবীও মন্তব্য করলেন। “তোমাদের কোনো অসুবিধে আছে? আজ রাতে তো খাবে না। আর আমি কল্পনাকে বলেছি ঘর গুছিয়ে রাখতে। তোমাদের চিন্তা কীসের? সামলায় তো কল্পনা।” ওঁর কথায় উষ্মা, স্ত্রী আর ছেলের মতামতের প্রতি অবজ্ঞা। বোঝা যায় তুঙ্গনাথ কারোর কথা শুনে চলতে অভ্যস্ত নন। তবে রিনিতা যেটুকু দেখেছে, কল্পনাই যে সব কিছু সামলায়, সেটাও ঠিক। বাস্তবিকই অত্যন্ত এফিশিয়েন্ট মহিলা। বাড়ির সবাইকেই বকাঝকা করে সোজা রাখছে, এমনকী তুঙ্গনাথেরও নিষ্কৃতি নেই। এবার সে আপত্তি জানাল।
“এই শুনি ঝড়জল আসতিছে, এর মদ্দি আবার অতিথ আসার দরকার ছেল কী বাপু! ঝামিলায় পড়বেনি!”
তুঙ্গনাথ জবাব দিলেন না। খাওয়া শেষ হয়ে গিয়েছিল, উঠে চলে গেলেন।
কল্পনা দেখছি সব খবরই রাখে, মনে মনে ভাবল রিনিতা। এই ঝড়-বৃষ্টির খবর রিনিতাও বিকেলে ফোনে পেয়েছে। গতকাল পর্যন্ত সেটা ধীরে ধীরে এগোচ্ছিল উড়িষ্যার দিকে, হঠাৎ দিক পরিবর্তন করে দিন তিন-চারের মধ্যে এদিকে ধেয়ে আসবে মনে হচ্ছে। প্রেডিকশন হল ঝড়ের পূর্ণ দাপটে বাতাসের বেগ ঘণ্টায় একশো কিলোমিটার পর্যন্ত হতে পারে। তার মানে সেই তাণ্ডবে পুরো জায়গাটাই ওলটপালট হয়ে যাবে! হালকা ফোর্সে এলেও বৃষ্টির জন্যে রাস্তাঘাটে জল জমবে।
খবরটা পেয়ে অবধি রিনিতার মনে ঘুরে চলেছে আশঙ্কা, ফিরবে কী করে! শিখা অবশ্য বলছে থেকে যেতে, ঝড় চলে গেলে দু-জনে একসঙ্গে কলকাতায় ফিরে যাবে। রিনিতার সেটা পছন্দ হচ্ছে না। এই একদিনেই টেনশনপূর্ণ আবহাওয়ায় পুরোনো বাড়ি দেখার কৌতূহল উবে গেছে। শিখাকে তো বলতে পারবে না ‘ফেরত দিয়ে আয়’! রিনিতা ঠিক করল ঘরে গিয়েই কানুদাকে ফোন করে বলবে এখান থেকে ফেরার ব্যবস্থা করতে। ওর এই মামাতো দাদাটি অসম্ভব করিতকর্মা। বাইরে থেকে দেখতে ভিজে বেড়াল, ন্যাল্যাখ্যাপা, খামখেয়ালি। কিন্তু মস্তিষ্ক চলে ক্ষুরধার ছুরির মতো। সে ঠিক কিছু না কিছু ব্যবস্থা করবে।
কানুদা আজকাল প্রায় সময়ই নিউ ইয়র্কে থাকে, এখন দেশে এসেছে। এটুকু কাজ করতে ওকে বলাই যায়। রিনিতা ঠিক করল তাড়াতাড়ি ফোন করে ফেরার প্ল্যান করে ফেলবে। ঝড়ে সেলফোনের টাওয়ার-ঠাওয়ার পড়ে সিগন্যাল উড়ে গেলেই চিত্তির। তখন সব কমিউনিকেশন বন্ধ!
.
খাবার টেবিল থেকে বাবা চলে যেতেই ঋদ্ধি বলে উঠল, “ভীমরতি হয়েছে! কোথাকার কোন লোককে এই দুর্যোগের মধ্যে আসতে বলেছে। একে পুরোনো বাড়ি, একশো কিলোমিটার বাতাসের ধাক্কা, ধসে পড়ে কিনা ঠিক নেই। মা, তুমি বাবাকে চাপ দাও সময় থাকতে কোনো প্রোমোটারকে বাড়িটা দিয়ে দিক। টাকা, ফ্ল্যাট দুটোই পাবে। আমিও চিনি কয়েক জনকে। একজনের তো ক’দিন বাদেই বাড়ি দেখতে আসার কথা। এখন আসতে পারবে কিনা কে জানে!”
ঋদ্ধির উত্তেজিত কথার মধ্যে শিখা বলল, “বাবাকে না জানিয়ে এসব করতে গেছিস কেন?”
“আরে না, না, আসবে আমার বন্ধু হয়ে। বাড়িটা দেখে-টেখে একটা আইডিয়া দেবে কত টাকা পাওয়া যেতে পারে। কনট্র্যাক্ট নিয়ে কথা পরে হবে।”
“তাতে লাভ কী? বেঁচে থাকতে বাবা থোড়াই বাড়ি ছাড়বে! শুধু শুধু ঝামেলা পাকাচ্ছিস।”
“ঝামেলা আবার কী? বাড়ি তো নয়, হাতি পোষা হচ্ছে। আর টাকার জন্যে তো বাবা সবসময়ই খিঁচিয়ে থাকে!”
“তোমাদের এসবের মধ্যে আমি নেই,” অরুন্ধতী বললেন। “কল্পনা, লোকটা কোথায় শোবে ঠিক করেছ?”
“বাবুর ওপেশে অতিথঘরে গো। বাবুই বলে দেছে। দিদিমণিদের পাশটিতে আর দেলেম না।”
“বাবু বলে দিয়েছে? তাহলে তো আর কথাই নেই, ঠিক আছে,” শিখার মায়ের গলায় কি শ্লেষের ছোঁয়া? “আর শোনো কল্পনা, বাড়িতে বলে এসো, কাল: থেকে ক’দিন এখানেই থাকবে। ঝড়-বৃষ্টি আসছে, অতিথি আসছে। আমাদের দরকার হবে।”
কল্পনা উত্তর দিল না। কিন্তু প্রস্তাবটা যে ওর মনঃপূত নয়, তা মুখ দেখে বোঝা গেল। রিনিতা ভাবল কাল আর এসেছে কল্পনা!
.
ডিনার পর্ব শেষ। ঘরে গিয়ে কানুদাকে ফোন করল রিনিতা।
“কিচ্ছু ভাবিস না, এই দু-দিন হবে না, কিন্তু গাড়ি ভাড়া করে সোমবার সক্কাল সক্কাল বেরিয়ে তোর কাছে চলে যাব, ঝড়-বৃষ্টি শুরু হবার আগেই আমরা ফিরে আসতে পারব। মাত্র তো কয়েক ঘণ্টার পথ।”
“ঝড়-বৃষ্টিতে আটকে গেলে?”
“তাহলে আর কী, তোর বন্ধুর বাড়িতে থেকে যাব। থাকার জায়গা হবে না?”
“দাদা, এটা একটা রাজপ্রাসাদ!”
“বলিস কি রে! তাহলে তো এক্সট্রা জামাকাপড় নিতেই হবে। আটকা পড়লে রাজপ্রাসাদে থাকাও হবে!”
“উফ, তুমি পারো-ও। চিন্তায় মরছি কী করে ফিরব, আর তুমি রাজবাড়িতে থাকার প্ল্যান করছ! তাড়াতাড়ি চলে এসো।”
ফোনে কানুদার হাসি ভেসে এল, “ভাবিস না, শিগিরি দেখা হবে।”
কিছুটা শাস্তি। কানুদাটা এত অ্যাকোমোডেটিং, রিনিতা জানত একটা সুরাহা করবেই।
মোবাইলে মেসেজ নোটিফিকেশন বাজল জলতরঙ্গের শব্দে। এত রাত্রে কার মেসেজ? রিনিতা ফোন তুলে দেখল অফিস থেকে নির্দেশ এসেছে- একটা জরুরি কাজ, দ্রুত শেষ করে পাঠাতে হবে। ছুটিতে এসেও মুক্তি নেই! ভাগ্যিস বুদ্ধি করে ল্যাপটপ সঙ্গে এনেছে! এখানে ওয়াইফাই নেই, তবে মোবাইল সিগন্যাল আছে। তাই দিয়ে নেট-এর কাজ মোটামুটি চলে যাবে। এত রাতে না, কিন্তু কাল সকাল থেকেই কাজে লাগতে হবে। তার ফাঁকে ফাঁকে সামান্য ঘুরে দেখা।
রিনিতা ওয়েদার আপডেট দেখল। হ্যাঁ, মঙ্গলবারই ঝড় আসছে— বিকেল বা রাতের দিকে— তবে আসার গতিটা একটু বেড়েছে!
পরশু যে ও চলে যাবে শিখাকে জানানো দরকার। হঠাৎ এই চেঞ্জ অফ প্ল্যান-এ রাগ না করে! অফিসের কাজটা ঠিক সময়ে এসে পড়েছে, সেটার অজুহাত দেখানো যাবে। কাজের প্রেশার শিখা বুঝবে।
ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় এসে রিনিতা দেখল শিখা একজন অচেনা লোকের সঙ্গে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। শিখাই পরিচয় করিয়ে দিল, ভদ্রলোকের নাম সত্য। এঁর কথাই কিছুক্ষণ আগে খাবার টেবিলে তুঙ্গনাথ বলেছিলেন। তুঙ্গনাথের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন, দিন কয়েক থেকে চলে যাবেন। অতিথিকে শিখার সঙ্গে আলাপ করিয়ে তুঙ্গনাথ শুতে চলে গেছেন। এখন শিখার দায়িত্ব নতুন অতিথিকে সব কিছু দেখিয়ে দেওয়া! ভদ্রলোক খুবই সুদর্শন, বয়সে শিখার চেয়ে একটু ছোটোই হবেন। মার্জিত কথাবার্তা। রিনিতার মনে হল নবাগতের সঙ্গে গল্প করতে শিখার খুব একটা খারাপ লাগছে না!
সেখানে না দাঁড়িয়ে থেকে শিখাকে জানাল রিনিতা, “সোমবার চলে যেতে হবে রে। কাজ পাঠিয়েছে রাওসাহেব। তা ছাড়া যা ঝড়-বৃষ্টি আসছে, না গেলে আটকে পড়ব।”
বন্ধুর আসন্ন বিরহে শিখাকে খুব একটা কাতর দেখাল না।
“কী করে যাবি?”
“এক্ষুনি কানুদাকে ফোন করলাম। গাড়ি করে এসে নিয়ে যাবে।”
“কানুদা?”
“তোকে বলিনি ওর কথা? আমার মামাতো দাদা- একেন্দ্র সেন। আমাকে নিয়ে যাওয়ার চেয়ে রাজবাড়ি দেখতে বেশি উৎসাহী।”
“ভালোই হল। আমিও ফিরে যাব তোর সঙ্গে। অফিসের প্রচুর কাজ ফেলে এসেছি। এখানে নেট তো ঈশ্বরের মতন— ‘মাঝে মাঝে তব দেখা পাই’! তোর দাদার গাড়িতে জায়গা হবে না? এই ঝড়-বৃষ্টিতে বাবা গাড়ি নিতে দেবে না।”
“নিশ্চয় হবে। আমরা তো শুধু দু-জন থাকব।”
নতুন অতিথি বললেন, “ইসস, পারলে আমিও একটা রাইড নিতাম, কিন্তু আমি থাকি উলটো দিকে—রামপুরহাট। কী মুশকিল বলুন তো? গাঁয়ে-গঞ্জে ঝড়-বৃষ্টি শুনলেই পিলে চমকে যায়।”
কথাটা একটু মজা করেই বলা। শিখা জিজ্ঞেস করল, “কিন্তু আপনি তো একটা কাজ নিয়ে এসেছেন? সেটা হয়ে যাবে?”
প্রশ্নটা শুনে সত্য একটু থতমত খেলেন। “না, তেমন বিশেষ কোনো কাজ নয়।”
রিনিতা যখন শুতে গেল সত্য আর শিখা তখনও বারান্দায় দাঁড়িয়ে কথা বলছে।
ঘরে ঢুকে রিনিতা দেখল এর মধ্যে ঢাকা সরিয়ে পরিপাটি বিছানা পাতা। টেবিল ল্যাম্পের পাশে নাইট স্ট্যান্ডে এক গ্লাস জল লেসের ঢাকা দিয়ে রাখা। সব কাজে যত্নের ছাপ।
ঘর থেকে মুখ বাড়িয়ে শিখাকে সেটা বলতেই মুচকি হেসে বলল, “ভাবিস না, কল্পনামাসি সকালে বেড-টিও দিয়ে যাবে। বেড-টি ছাড়া আমরা কেউ বিছানা ছাড়ি না।”
তিন
সকালের ঘুম ভাঙতে না ভাঙতে আঁ আঁ আঁ চিৎকারে বাড়ি সচকিত।
কান ফাটানো শব্দে রিনিতা তড়াং করে বিছানায় উঠে বসল। কাঁচা ঘুম ভেঙে এদিক-ওদিক তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল কোথায় আছে! গোটা বৰ্মণ বাড়িতে কেউ বোধহয় তখনও বিছানা ছাড়েনি।
অরুন্ধতী উঠেছেন, কিন্তু অভ্যেসমতো ঘর থেকে বেরোননি। সকালে উঠে ঘণ্টা খানেক বই পড়া ওঁর নিত্যকার রুটিন। তারই মধ্যে দু-কাপ চা খান। সবাই ব্রেকফাস্ট করে দেরিতে। ওঁর হাত থেকে টেনিসনের কবিতা সংকলন খসে পড়ল। বুঝতে সময় লাগল না এই প্রাণঘাতী চিৎকারের উৎস কে। হঠাৎ কী হল! এই তো ট্রে হাতে চায়ের কাপ নামিয়ে গেল। বেশ তো ছিল তখন। চেয়ার ছেড়ে উঠে দরজা অবধি পৌঁছোতে পারলেন না!
উলুর-ঝুলুর কাপড়, ভয়ে চোখ বিস্ফারিত, তুঙ্গনাথের ঘর থেকে বেরিয়ে এল কল্পনা। তখনও গলা থেকে একটা বিশ্রী কর্কশ শব্দ বেরোচ্ছে। অরুন্ধতী বারান্দায় বেরিয়ে ওকে টেনে আনলেন ঘরে।
“কী হয়েছে? কল্পনা, চেঁচানো বন্ধ করো। কী হয়েছে?”
“মেইরে ফেইলছে, মেইরে ফেইলছে। বাবু মইরে গেছে এক্কেরে! ও বাবা গো!”
“কী আজেবাজে বকছ!”
কল্পনাকে ফেলে অরুন্ধতী দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলেন স্বামীর কামরার দিকে। ইতিমধ্যে অন্যান্যরাও ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে।
ঋদ্ধি মায়ের পাশে এসে উত্তেজিত স্বরে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে মা? কী ব্যাপার! কল্পনামাসি, কী হল?”
অরুন্ধতী উত্তর দিলেন না। এগিয়ে চললেন হ্যামেলিনের পাইড পাইপারের মতো। ওঁর পেছনে ঋদ্ধি, শিখা, আর রিনিতা। উলটো দিক থেকে এগিয়ে এলেন রাতের নবাগত।
অরুন্ধতী ঘরে ঢুকলেন, অন্যেরা ভিড় করে দাঁড়াল তুঙ্গনাথের ঘরের দরজার সামনে। রিনিতা উঁকি মেরে দেখল চোখ বন্ধ করে বিছানায় পড়ে আছেন তুঙ্গনাথ। কী হয়েছে, হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোক? মারা গেছেন, না এখনও প্রাণ আছে?
টেবিলে রাখা জলের গ্লাস তুলে চোখে-মুখে জল ছিটোতে লাগলেন অরুন্ধতী। শিখা কোত্থেকে একটা পাখা জোগাড় করে মাথায় হাওয়া দিতে থাকল। ঋদ্ধি চেঁচিয়ে উঠল, “বাবা, বাবা!” কোনো সাড়া নেই। রিনিতা যখন প্রায় নিশ্চিত সব শেষ, একটা বড়ো নিঃশ্বাসের শব্দ এল কানে। তুঙ্গনাথবাবু নড়ে উঠলেন। সামান্য আশ্বাস! একটুক্ষণের মধ্যেই চোখের পাতা কেঁপে উঠল ওঁর। কিছুক্ষণ পরে চোখ মেললেন তুঙ্গনাথ বৰ্মণ।
“কী হয়েছিল তোমার?” এই প্রথম অরুন্ধতীর গলায় আবেগের রেশ শুনতে পেল রিনিতা।
শিখা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল, “শরীর কি খুব খারাপ লাগছে, বাবা? দাদা, একজন ডাক্তার ডাক!
হাত নেড়ে তুঙ্গনাথ অপেক্ষা করতে বললেন সবাইকে। ফ্যাসফ্যাসে গলায় বললেন, “জল।” সঙ্গে সঙ্গে ঠোঁটের কাছে জলের গ্লাস তুলে দিলেন অরুন্ধতী। দু-ঢোঁক খেয়ে তুঙ্গনাথ বললেন, “ডাক্তার ডাকার দরকার নেই। অনেকটা ভালো লাগছে। একটু সময় দাও, বলছি।”
কয়েক মিনিট সময় গেল। তারই মধ্যে অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠলেন উনি। ধীরে ধীরে যা বললেন, তা শুনে রিনিতার গা হিম!
ভোররাতে হঠাৎ একটা শব্দে তুঙ্গনাথের ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। এমনিতে উনি ঘুমের ওষুধ খেয়ে শোন, তাই ঘুমের ঘোরে কী ব্যাপার বুঝতে সময় লাগল। আবছা দেখলেন একটা ছায়াশরীর ঘরে ঢুকেছে। চেঁচিয়ে ওঠার আগেই গলায় দড়ি পেঁচিয়ে কেউ চাপ দিতে লাগল। দম বন্ধ হয়ে যাবার জোগাড়! ঝাপটা ঝাপটিতে দড়ি ছিঁড়ে ফুসফুসে হাওয়া ঢুকে প্রাণ বেঁচেছে। কিন্তু সেই সময়েই ভারী কিছু দিয়ে কেউ মাথায় আঘাত করে। তারপর আর কিছু মনে নেই। তুঙ্গনাথ শুধু একটা অবয়ব দেখেছেন, কাউকে চিনতে পারেননি। এমনকী লোকটা ছেলে না মেয়ে তাও বলতে পারলেন না। রিনিতা দেখল মাটিতে পড়ে আছে মশারি বাঁধার দড়ির ছেঁড়া টুকরো। পুরোনো পলকা দড়ি। একটু চাপ দিলে ছিঁড়তে বাধ্য। ভাগ্যিস! শক্ত রশি হলে ব্যাপারটা ভয়াবহ আকার নিত।
কল্পনা এতক্ষণ বারান্দায় পা ছড়িয়ে, মাথায় হাত দিয়ে বসেছিল। গোপাল স্থবিরের মতো পাশে দাঁড়িয়ে। মনিব মারা যাননি বুঝে দু-জনেই দরজায় এসে দাঁড়াল। কী সর্বনাশ! রাতে চোর-ডাকাত এসেছিল? এমন তো আগে হয়নি! বিশাল বাড়ি হলেও চট করে লোক ঢুকতে পারে না। বাড়িতে রং-টং হচ্ছে, তাদের মধ্যে কেউ চুরি করতে এসেছিল? গ্রামের চেনা লোক সব, এত সাহস হবে! অন্যরাও তো কিছু টের পায়নি!
ঋদ্ধি দৌড়ে নীচে গেল। সদর দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। গোপাল জানাল, রাতে নতুনবাবু আসার পর ও নিজের হাতে চাবি দিয়ে দরজা বন্ধ করেছে। কল্পনা তার আগেই বাড়ি চলে গিয়েছিল। অন্য দিনের মতো চাবি ওর গেঁজেই সারারাত গোঁজা ছিল। সকালে কল্পনাকে দরজা খুলে দিয়ে আবার বন্ধ করেছে। সেই থেকে চাবি বাড়ির ভেতরেই রয়েছে।
বাইরে থেকে কারোর ঢোকার চিহ্ন না থাকলেও লোক ঢোকার সম্ভাবনা একেবারে উপেক্ষা করা যায় না। উদ্দেশ্য চুরিই হবে। খুন করতে এলে মশারির দড়ি গলায় পেঁচাবে কেন! মানে ধরা পড়ার ভয়ে হাতের কাছে যা পেয়েছে তাই ব্যবহার করেছে।
ঋদ্ধিই প্রথম বলল, “মা, দেখো তো ঘর থেকে কিছু গেছে কিনা! তুইও দেখ শিখা।”
অরুন্ধতীর নির্লিপ্ততা আবার জাঁকিয়ে বসেছে। উনি নড়লেন না। খাটের মাথার দিকে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন। শিখাই একটু ঘুরে-ফিরে দেখল। না, কিছুই খোয়া যায়নি, অন্তত ও দেখতে পেল না। এর মধ্যে তুঙ্গনাথও মোটামুটি সুস্থ হয়ে উঠেছেন। উনিও ঘাড় ঘুরিয়ে এদিক-সেদিক তাকিয়ে বললেন, “না, তেমন কিছু গেছে বলে মনে হচ্ছে না। হয়তো সময় পায়নি। গোলমালে যদি অন্যেরা জেগে যায় ভয়ে পালিয়েছে।” ততক্ষণে তুঙ্গনাথকে বেশ তাজাই দেখাচ্ছে।
“আমি ডাক্তার ডেকে আনি,” ঋদ্ধি বলল।
“কোনো দরকার নেই।” তুঙ্গনাথ একটু বিরক্ত হয়ে আপত্তি করলেন। “এখন ভালোবোধ করছি, আর কিছু খোয়া যায়নি। ওসব ঝামেলার প্রয়োজন নেই।”
“তাও এক বার হাসপাতালে যাওয়া উচিত। মাথা স্ক্যান করে দেখতে হয় রক্ত জমাট বাঁধল কিনা। মাথাটা একটু টেস্ট করা দরকার।”
“তোর নিজের মাথা টেস্ট করা, যা! সেটার জরুরি দরকার আছে।” ঘোর ঘোর ভাব কাটিয়ে তুঙ্গনাথ স্বমূর্তি ধরলেন।
ওঁকে আর বেশি না ঘাঁটিয়ে শিখা বলল, “বেশ, পুলিশে অন্তত রিপোর্ট করি, বাবা। মার্ডার অ্যাটেম্পট বলে কথা!”
“পুলিশ আমাকে উদ্ধার করবে! বেরো সব আমার ঘর থেকে।”
একটি কথা না বলে অরুন্ধতী বেরিয়ে গেলেন। মুখ ব্যাজার করে ওঁর পেছন পেছন হাঁটা দিল ঋদ্ধি। রিনিতার হাত ধরে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে শিখা বলল, “কিছু দরকার হলে ডেকো, বাবা। শরীর খারাপ লাগলে ইগনোর কোরো না।” ওদের পেছন পেছন নতুন আসা অতিথিও বেরোচ্ছিলেন, দাঁড়িয়ে গেলেন তুঙ্গনাথের কথায়। “তুমি একটু বসো, সত্য। দরকার আছে।”
তুঙ্গনাথের ঘরে রয়ে গেলেন সত্য।
.
ঘর থেকে বেরিয়ে রিনিতা দেখল ঋদ্ধি বারান্দার এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে কল্পনার সঙ্গে কথা বলছে। শিখার সঙ্গে নিজের ঘরের দিকে এগোতে গিয়ে দু-একটা কথা কানে এল।
“লোকটা কখন উঠেছে, কল্পনামাসি? তুমি চা দেবার সময় কী করছিল?”
ঋদ্ধির মুখে সন্দেহের ছাপ।
“বেট্টি যকন দিনু ঘরে চেল না। আমি রেকে এলুম টেবুলে। আর তো যাইনি গো!”
শিখাকে দেখে এবারে তাকে নিয়ে পড়ল ঋদ্ধি, “তুই এই লোকটার সম্পর্কে কিছু জানিস?”
“তুই যা জানিস, আমিও তাই। কিচ্ছু না।”
“কে লোকটা? বাবার সঙ্গে কী এত গোপন কথা? উড়ে এসে জুড়ে বসেছে, মতলব কী? এদিকে তো বাবার ওয়ান পাইস ফাদার-মাদার, কেন থাকতে দিচ্ছে কে জানে!”
“তোর কি ওকে সন্দেহ হচ্ছে?”
“কী বলিস, হবে না? ও যে রাতে এল, সেই রাত পোয়াতে না পোয়াতে বাড়িতে ডাকাতি হল? বাইরের আর কে আছে?”
“বাড়িতে তো রিনিতাও আছে। তুই কি আমার বন্ধুকেও সন্দেহ করছিস?” রিনিতার সামনেই জিজ্ঞেস করল শিখা।
“না, তা করব কেন?” ঋদ্ধি ডিফেন্সিভ হয়ে রিনিতার দিকে কাঁচুমাচু হয়ে তাকাল। “রিনিতা তো তোর পরিচিত। ওই লোকটাকে কেউ চিনি না- অজ্ঞাতকুলশীল!”
“অবভিয়াসলি বাবা চেনে। বাবাই তো এনেছে। অজ্ঞাত হোক আর যাই হোক, হঠাৎ বাবাকে মারতে যাবে কেন? দুম করে উলটোপালটা অভিযোগ আনিস না! তার চেয়ে পুলিশে খবর দে, তারা ইনভেস্টিগেট করুক।”
শিখা কথাটা বলল বটে, তবে সত্যকে সত্যিই কেউ চেনে না। মানুষের মনের মধ্যে কী থাকে, সেটা বাইরে থেকে বোঝা দুষ্কর! কিন্তু দাদার খামখেয়ালিপনাকেও ও প্রশ্রয় দিতে চাইল না।
ঋদ্ধি গজগজ করতে করতে চলে গেল। বারান্দায় শিখার পাশে দাঁড়িয়ে রিনিতা ভাবতে লাগল পুলিশকে একেবারে না জানানো কি ঠিক হল!
তুঙ্গনাথের ঘর থেকে বেরিয়ে সত্য ওদের দিকে এলেন।
“কী সাংঘাতিক ব্যাপার ঘটে গেল, না?”
রিনিতা ওর মুখের দিকে তাকিয়ে মনের ভেতরটা দেখার চেষ্টা করল। লোকটা কি খুনি হতে পারে?
“আপনার মনে হয় না মেসোমশাইয়ের ওপর একটা মার্ডার অ্যাটেম্পট হয়েছে? কী বললেন উনি?”
প্রশ্নটা শুনিনি শুনিনি ভাব করে এড়িয়ে গেলেন সত্য।
“কী হল সেটা বুঝতে পারছি না।”
শিখা তীব্র সুরে বলল, “আপনার মনে হয় না পুলিশে খবর দেওয়া উচিত?”
“মনে তো হয়। কিন্তু উনি…”
“হ্যাঁ, বাবা চাইছেন না।”
“বুঝতে পারছি না কেন। এটা তো নেগলেক্ট করার ব্যাপার নয়!
শিখা চাপ দিল, “আপনি একটু বলে দেখুন। এ নিয়ে আমরা কিছু বলতে গেলে বিরক্ত হচ্ছেন।”
“আমি বাইরের লোক, আমার কথা কি শুনবেন?” সত্য বারান্দা দিয়ে আবার তুঙ্গনাথের ঘরের দিকে এগোলেন।
চার
ঘণ্টা খানেকের মধ্যে কল্পনা সবাইকে খেতে ডাকল। এমনিতে সকাল সাড়ে আটটায় ব্রেকফাস্ট হয়ে যায়। সকাল আটটায় জলখাবার আর রাত্রি সাড়ে সাতটায় ডিনার – এই দুটো সময় বর্মণ বাড়িতে বাঁধা, এর অন্যথা হয় না। আজ উত্তেজনায় দেরি হয়েছে। রিনিতা খাবার ঘরে পৌঁছে দেখল তুঙ্গনাথ আর সত্য ছাড়া সবাই হাজির।
“বাবা কী আসবেন, নাকি ঘরে খাবেন?” ঋদ্ধি জিজ্ঞেস করল।
“বাবু আইসচে গো।”
“আর বাবার গেস্ট?”
“সে বাবুর সনে গপ্পো বলচে। দুইজনে আইসচে।”
“বাঃ!”
ঋদ্ধির মুখে অসন্তুষ্টি পরিষ্কার। তবে ওর বিরাগের কারণ আছে। স্ত্রী- ছেলেমেয়েদের ঘর থেকে তাড়িয়েছেন, কিন্তু সত্যের সঙ্গে কথা বলতে তুঙ্গনাথের অসুবিধে নেই। অরুন্ধতী দেবীর অভিব্যক্তিতে পরিবর্তন ঘটল না, তবে মুহূর্তের জন্যে চোখে যেন একটু ঝিলিক খেলল। কয়েক মিনিট বাদেই তুঙ্গনাথ ঘরে ঢুকলেন, সঙ্গে সত্য।
খাওয়া শুরু হতে ঋদ্ধি ভাববাচ্যে সবার উদ্দেশে বলল, “আমি পুলিশে খবর দেব ঠিক করেছি, মায়ের সঙ্গে কথা বলেছি। বাবা ব্যাপারটা উড়িয়ে দিতে পারে, কিন্তু এটা বাড়ির সবার পক্ষেই ভয়াবহ। আজ বাবাকে আক্রমণ করেছে, কাল মাকে করতে পারে। আমি বা শিখাও এই খুনির টার্গেট হতে পারি। কে এই কাজটা করেছে বের না করা পর্যন্ত আমরা কেউই এখানে নিরাপদ নই।”
হয়তো আরও কিছু বলত, কিন্তু তুঙ্গনাথের চোখে চোখ পড়ায় থমকে গেল। তুঙ্গনাথ ক্রূর চোখে ঋদ্ধির দিকে তাকালেন।
“তোমাকে এখানে কেউ ধরে রাখেনি, এত ভয় করলে যেখানে ইচ্ছে গিয়ে থাকো। পুলিশ এ বাড়িতে আসবে না। আমার কথার যেন অন্যথা না হয়।”
বাবার কঠোর কথায় ঋদ্ধি রীতিমতো হকচকিয়ে গেল, অন্য সকলেও অস্বস্তিতে। শুধু অরুন্ধতী দেবী চোখ নীচু করে খেয়ে চললেন। রিনিতার ভীষণ বিশ্রী লাগছিল এই পারিবারিক টেনশনের মধ্যে বসে থাকতে। খাবার ইচ্ছে লোপাট। শিখা ধমক লাগাল ঋদ্ধিকে, “দাদা, তুই চুপ কর! খাবার টেবিলে এসব আলোচনা না করলে নয়!”
ঋদ্ধি প্রসঙ্গটা আর উত্থাপন করল না বটে, কিন্তু ভুরু কুঁচকে রইল।
প্রায় নিঃশব্দেই ব্রেকফাস্ট শেষ করল সবাই। খাওয়ার শেষে রিনিতাকে বলল শিখা, “আজকেও আবহাওয়া ঠিক আছে, চল তোকে বেড়াতে নিয়ে যাই। কাছে একটা গ্রামীণ শিল্প মেলা হচ্ছে। বেশ ইন্টারেস্টিং জিনিস পাবি। তারপর কোথাও লাঞ্চ খেয়ে ফিরব। তোর কাজের একটু দেরি হবে, অসুবিধে নেই তো?”
“না চল, বেড়াতেই তো এসেছি। দেরি হলে হবে।”
সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে শিখা বলল, “বাড়িটা কেন অসহ্য লাগে, বুঝলি? মা সব কিছু থেকে আউট, বাবা আর দাদার মধ্যে কথায় কথায় ঝগড়া। কিন্তু দাদা এখান থেকে নড়বে না পাছে বাবা ত্যাজ্যপুত্র করে! পুরো চোখটাই সম্পত্তির দিকে। সেই ভয়ে বিয়ে করা বউকে পর্যন্ত বাড়িতে আনেনি! বাবা আর দাদা, দু-জনেই এত মার্সেনারি! এসব বলতেও ইচ্ছে করে না।”
দুই বন্ধু পুরো দিনটাই কাটাল আশেপাশের জায়গা দেখে। একটু দূরে গিয়ে লাঞ্চ খেল। ফেরার পথে টিপ টিপ বৃষ্টি শুরু। গাড়ির রেডিয়োতে যে খবর ওরা শুনল, তা খুবই উদ্বেগজনক। ঝড় আসার গতি নাকি আরও বেড়েছে।
“কী করে কলকাতায় ফিরব জানি না,” শিখাকে বলল রিনিতা, “কানুদার সোমবার সকালে আসার কথা।”
“কানুদাকে নিয়ে এখানে থেকে যাবি, আবার কী? জায়গার তো সমস্যা নেই।”
“তা হোক, তোর দাদা আবার মাইন্ড না করে। এমনিতেই বাড়িতে এখন দু-জন বাইরের লোক।”
“শোন রিনিতা, বাড়িটা দাদার নয়, বাবার। আমার অধিকার এতে এতটুকু কম নয়। ওর সর্দারি একদম পাত্তা দিস না। হ্যাঁরে, তোর কানুদা কী করেন?”
রিনিতা সরাসরি উত্তর দিল না। কানুদা নিজের পরিচয় সবাইকে জানাতে চায় না। এমনকী বহুদিন পর্যন্ত রিনিতাও জানত না দাদা ঠিক কী করে! একসময় পুলিশে কাজ করত, তারপর শুনেছিল কনসাল্টিং করছে। সবে কিছুদিন হল জেনেছে কানুদা নাকি দুর্ধর্ষ গোয়েন্দা। কিন্তু এই কথা ফাঁস করার অধিকার ওর আছে কি?
“কী একটা কনসাল্টিং ফার্মে কাজ করে। একটু খ্যাপাটে, উলটোপালটা কথা বলে, তবে মনটা ভালো।”
রিনিতার বর্ণনা শুনে শিখা হেসে ফেলল।
.
এইসব কথাবার্তার মধ্যেই কানুদা, মানে একেনবাবুর ফোন এল।
“হ্যাঁরে। তোদের ওখানে যাবার হঠাৎ করে একটা রাইড পেয়ে গেছি। আমার পরিচিত, পুলিশেরই লোক। ওই অঞ্চলেই পোস্টেড ছিল একসময়, রাজবাড়িটা চেনে। আমাকে নামিয়ে দেবে। বলল খন্যান থেকে ভাড়ার গাড়ি পেতে কোনো অসুবিধা হবে না, ওই জোগাড় করে দেবে— তবে সোমবারের আগে হবে না। তাহলে ওখানে তো এক রাত থাকতেই হবে। তোর বন্ধুদের অসুবিধা হবে কি?”
“দাঁড়াও জিজ্ঞেস করি।”
শিখা জিজ্ঞেস করল, “কার ফোন রে?”
“কানুদার। একটা রাইড পেয়েছে, কালকেই আসতে পারে দুপুর নাগাদ। একটু হেজিটেট করছে রাইডটা নিতে।”
“কেন?”
“এক রাত থাকতে হবে… তোদের অসুবিধার কথা ভাবছে। তবে আমি জানি, কানুদার কিন্তু তোদের রাজবাড়ি দেখার খুব আগ্রহ। তার ওপর রাজবাড়িতে এক রাত থাকবে! দাদা একটু ছেলেমানুষ।
“ওমা! বলে দে কালকেই রওনা হতে। আমার খুউব ভালো লাগবে উনি এক রাত থাকলে।”
“মেসোমশাই…”
শিখা ধরতে পারল রিনিতার চিন্তা।
“আমি রোজগেরে ইন্ডিপেন্ডেন্ট মেয়ে, বাবা আমাকে তেমন ঘাঁটায় না। তারপর যদি শোনে ওঁর বাড়ি দেখার জন্য কারোর এত আগ্রহ, তাহলে তো আর কথাই নেই…! একটা গেস্ট রুম ফাঁকা আছে, তোর ঘরের পাশে। আমি কল্পনামাসিকে বলে দেব। কী খেতে ভালোবাসে তোর দাদা?” সত্যিই খুশি হল শিখা।
“আরে না, কিচ্ছু স্পেশাল করবি না, প্লিজ।
পাঁচ
একেনবাবু এসে পৌঁছোলেন রোববার দুপুর বারোটা নাগাদ। তখনও ঝড় আসেনি
আসছে আসছে রব চারদিকে। মনে হয় মঙ্গলবার পর্যন্ত অপেক্ষা করবে না।
অল্প অল্প বৃষ্টি শুরু হয়েছে। গেটের সামনে গাড়ি এসে দাঁড়াতেই একেনবাবু রিনিতাকে ফোন করলেন।
“আমি কি অপেক্ষা করব স্যার?” পুলিশের জুনিয়র অফিসারটি জিজ্ঞেস করল।
“আরে না ভাই, ওরা এক্ষুনি আসছে,” ছোটো ব্যাগটা হাতে নিয়ে নেমে ছাতা খুলতে খুলতে একেনবাবু বললেন। কয়েক মিনিটের মধ্যেই রিনিতা আর শিখা দু-জনেই নেমে এল।
“আসতে অনেক দেরি হয়ে গেল রে! মাঝরাস্তায় হঠাৎ স্টার্টার সমস্যা…!”
“যাক, এসে পৌঁছেছ ঠিকঠাক।” শিখার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল রিনিতা।
একেনবাবু ওঁর স্বভাবসিদ্ধ বিনয়ের সঙ্গে বললেন, “গুড আফটারনুন ম্যাডাম… সরি, প্রিন্সেস।”
শিখা চোখ কপালে তুলল, “এমা! ম্যাডাম আর প্রিন্সেস কেন? আমি শিখা।”
“ঠিক আছে, তাহলে মিস শিখা বলি?”
“না, শুধু শিখা। আমি তো আপনার ছোটো বোনের বন্ধু। বোনকেও মিস রিনিতা ডাকেন নাকি?”
“না, না, তা কেন! আসলে হঠাৎ এভাবে এত দেরি করে এলাম, তারপর এক দিন থেকে যেতে হবে… খুব বাজে লাগছে।”
“কেন কানুদা, থেকে গেলে তো বোনেদেরও ভালো লাগতে পারে! আমি তো আশাই করছিলাম, আপনি ক’দিন এখানে থাকবেন। তারপর আমিও আপনাদের সঙ্গে কলকাতা ফিরব।”
“বাঃ, তাহলে তো খুব ভালো হয়। এই ঝড়-বৃষ্টি তো বড়োজোর দু-এক দিনের ব্যাপার।”
“ব্যস, তাহলে এই নিয়ে আর কোনো কথা নয়। বাবার অনেক ধুতি আছে, দু-একটা বের করে দেব। পুরোনো পাঞ্জাবিও আছে।”
“সেসব লাগবে না, ম্যাডাম… মানে মিস… শিখা। আমি বাইরে এলে এক সেট জামাকাপড় নিয়েই ঘুরি, কখন কোথায় কাজে লাগে… এই যে হাতে ব্যাগ।”
“তাহলে আবার কী!”
একেনবাবুকে ঘর দেখিয়ে শিখা খাবার ঘরে গেল।
.
লাঞ্চের জন্য বাড়ির সবাই টেবিলে বসে গেছে। কল্পনামাসি আর মাকে শিখা আগেই বলে রেখেছিল কানুদা, মানে একেনবাবুর কথা। টেবিলে এক্সট্রা চেয়ারের বন্দোবস্ত হয়েছে দেখে ঋদ্ধি প্রশ্ন করল, “আবার কাকে এনেছিস?”
শিখা বিরক্ত হয়ে উত্তর দিল, “তোর জানার দরকার কী?”
বোনকে না ঘাঁটিয়ে ঋদ্ধি বাবার দিকে তাকাল। তুঙ্গনাথবাবু মেয়েকে জিজ্ঞেস করলেন, “কে আসছে?”
“রিনিতার দাদা, ওকে নিয়ে যেতে।” ও নিজেও যে ফিরে যাচ্ছে, সেটা বলল না।
তুঙ্গনাথ বললেন, “এই ঝড়-বৃষ্টিতে যেতে পারবে?”
“তেমন হলে থেকে যাবে। কল্পনামাসিকে বলে দিয়েছি।”
তুঙ্গনাথ আর কিছু বললেন না। শিখা ঠিকই বলেছে, বাড়িতে যত দাপট দেখান না কেন, কন্যাকে উনি বেশি ঘাঁটান না।
.
একেনবাবু আর রিনিতা ঘরে ঢুকতেই শিখা সবার সঙ্গে কানুদার পরিচয় করিয়ে দিল। সত্যর পরিচয় দিল ‘অতিথি’ বলে। একেনবাবু প্রথমেই তুঙ্গনাথকে বললেন, “আপনার এই প্রাসাদটা স্যার আউট অফ দ্য ওয়ার্ল্ড। এর কথা আগে এত শুনেছি, দেখার খুব ইচ্ছে ছিল।”
তুঙ্গনাথের মুখে সন্তুষ্টি ফুটে উঠল। “পরে ভালো করে ঘুরে দেখো, এখনও নীচটার সারাই শেষ হয়নি। কবে হবে কে জানে! বাগানটাও নতুন করে বসাতে হবে।” তারপর স্বগতোক্তি করলেন, “আমি ছাড়া কারোর চাড় আছে! কত যে খরচ আর পরিশ্রম…”
“সে কী স্যার, কাজ তো চলছে নীচে।”
“তা চলছে, তবে খুবই আস্তে আস্তে, লোকগুলো মর্জিমাফিক আসে, হঠাৎ হঠাৎ অদৃশ্য হয়। এদিককার মিস্তিরিরা ফাঁকিবাজ! “
“এত বড়ো বাড়ি, ঠিকঠাক করা তো কঠিন ব্যাপার। পুরোনো বাড়ির সৌন্দর্য আর ঐতিহ্য… এখনকার মিস্তিরিরা তো বুঝতেই পারবে না।”
উত্তরে কিছু বললেন না তুঙ্গনাথবাবু, কিন্তু কথাটায় যে পূর্ণ সম্মতি আছে মাথা নাড়িয়ে প্রকাশ করলেন।
কল্পনাকে জিজ্ঞেস করলেন অরুন্ধতী, “বাবুর থাকার বন্দোবস্ত করেছ?” একেনবাবু বলে উঠলেন, “একটা গাড়ি পেলে আজকেই রিনিতাকে নিয়ে চলে যেতাম ম্যাডাম। কিন্তু গাড়িটা সোমবারের আগে পাচ্ছি না।”
ঋদ্ধি বলে উঠল, “ট্রেন অনেকগুলোই পাবেন খন্যান থেকে। রিকশা ধরে স্টেশনে চলে যেতে পারেন।”
দাদার দিকে অগ্নিদৃষ্টি হেনে শিখা বলল, “ওঁদের যাওয়া নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না।”
“না না, এই বৃষ্টিতে কেন যাবে।” অরুন্ধতী দেবী আবেগহীন ভদ্রতা করলেন।
ঋদ্ধি বিরক্ত মুখে বসে রইল। এমনিতে এতগুলো বাইনের লোক, তার ওপর আরেক জন এসে হাজির! খন্যান থেকে প্রমোটারের বাড়ি দেখতে আসার কথা ছিল আজ- বন্ধু সেজে কিছুক্ষণের জন্য। এদের জন্য বাড়ি দেখানো নিয়ে ঝামেলা না হয়!
আর একজন অতিথির আগমনে কল্পনাও খুশি হয়নি। তার কাজ বাড়ল।
তার ওপর বাড়ি ফেরা নিয়ে নিষেধাজ্ঞা!
একেনবাবু অ্যাজ ইউজুয়াল রান্নার অজস্র প্রশংসা করলেন। “কলাইয়ের ডালটা একেবারে অপূর্ব!” কল্পনাকে বললেন, “ঝুরিভাজা, পোস্তবড়া, চচ্চড়ি… কোনটে ছেড়ে কোনটে খাই।”
এতেও চিঁড়ে ভিজল বলে মনে হল না। একমাত্র সত্যর কোনো বৈকল্য নেই। চুপচাপ খেয়ে গেলেন।
একেনবাবুর কথায় মজা পাচ্ছিল শিখা। রিনিতার কাছে ওঁর চরিত্র সম্পর্কে অ্যাডভান্স ওয়ার্নিং পেয়েছে, মিলিয়ে দেখছিল।
খাওয়া-দাওয়ার পর তুঙ্গনাথবাবু নিজের ঘরে চলে গেলেন—সত্যকেও ডেকে নিলেন সঙ্গে।
.
ওঃ, একটা কথা একেবারেই মনে ছিল না। তুঙ্গনাথবাবুর ওপর মার্ডার অ্যাটেম্পট-এর কথা রিনিতা ফোনেই একেনবাবুকে জানিয়েছিল। ওর ইচ্ছে কী ঘটেছে কানুদা যদি একটু খুঁটিয়ে দেখে। সেটা শুনে একেনবাবুর অ্যান্টেনা খাড়া। সবার সঙ্গে কথাবার্তার ফাঁকে ফাঁকে বোঝার চেষ্টা করছিলেন সাসপেক্ট বাড়ির ভেতরকার কেউ হতে পারে কিনা। বাইরে থেকে লোক ঢুকে থাকলে বাড়িটা ঘুরে দেখা দরকার। সেই সুযোগ অবশ্য তুঙ্গনাথবাবুই করে দিয়েছেন ‘বাড়িটা ভালো করে দেখো’ বলে।
একেনবাবু শিখাকে ধরলেন, “স্যার বললেন, বাড়িটা ঘুরে ঘুরে দেখতে, ওপরটা তো প্রায় দেখাই হল। নীচ আর বাড়ির পেছনটা একটু দেখি?”
“নীচে ধুলোবালি ছাড়া কিছুই নেই, পেছনে একটা পুকুর আর কিছু ঝোপজঙ্গল-গাছপালা, কোনোটাই ভালো অবস্থাতে নেই।”
ঋদ্ধি শুনতে পেয়ে বলল, “বাড়ি দেখবেন? আমি নিয়ে যাচ্ছি, চলুন।”
“আপনি সময় নষ্ট করবেন কেন, স্যার। আমি তো নিজেই যেতে পারি।”
“কিচ্ছু না, চলুন।” ঋদ্ধির সন্দেহ হল একেনবাবু নিশ্চয়ই প্রোমোটিং-এর সঙ্গে যুক্ত, নইলে বাড়ি দেখতে এত আগ্রহ কেন? তা ছাড়া লোকটাকে একটু বাজিয়ে দেখা যাবে মতিগতি কী। রিনিতা মেয়েটাকে ঋদ্ধি আগে দেখেনি। তার ক্যারেক্টারও জানা নেই। রাতে যে খুনের চেষ্টা করছিল সে ছেলে না মেয়ে বাবা বোঝেনি। বাবা এখন আর শক্ত-সমর্থ নয়, অতর্কিতে রাত্রে আক্রমণ করলে রিনিতার মতো একটা মেয়েও তাঁকে অবশ্যই কাবু করে ফেলতে পারে। হয়তো এখন সঙ্গীকে এনেছে কাজ ফিনিশ করতে!
ঋদ্ধির সঙ্গে একেনবাবু নীচে গেলেন। ওঁকে একা পেয়ে ঋদ্ধি জিজ্ঞেস করল, “আপনি কী করেন?”
“একসময়ে কাজ করতাম এখন স্যার খুচখাচ কনসাল্টেন্সি। কেন, স্যার?”
“বাড়ি দেখতে এত ইন্টারেস্টেড বলে ভাবলাম হয়তো প্রোমোটিং-এর সঙ্গে যুক্ত।”
“আপনারা কি প্রোমোটার খুঁজছেন, স্যার?”
“না, ঠিক তা নয়। এটা বিক্রির কোনো প্ল্যান বাবার আপাতত নেই, তবে দারুণ অফার পেলে কী করবেন সেটা কি বলা যায়?”
“একদিন তো, স্যার, আপনারাই এটার মালিক হবেন। খোঁজখবর করে রাখা তো ভালোই, স্যার। … আচ্ছা, স্যার, এটাই কি পেছন থেকে ঢোকার একমাত্র দরজা?” সিঁড়ির নীচে খিল লাগানো একটা বড়ো দরজা দেখিয়ে একেনবাবু জিজ্ঞেস করলেন।
“হ্যাঁ, এই একটাই। এটা খুললে একদিকে একটা আউট হাউস, সেখানে গোপাল মানে আমাদের কাজের লোকটি থাকে। অন্যদিকে একটা ছোটোখাটো পুকুরের মতো… ঝোপঝাড়ে জংলা।”
“গোপাল একা থাকে স্যার?”
“হ্যাঁ, ও বিয়ে-টিয়ে করেনি।”
“নীচের ঘরগুলো তো রিপেয়ার হচ্ছে, কী করবেন রিপেয়ার হয়ে গেলে?”
“বাবার খেয়াল, আমাদের কোনো ইচ্ছে খাটবে না।”
“হোম-স্টে বানাতে পারেন স্যার, এই রাজবাড়িতে থাকার জন্যে অনেকেই আসবেন। মেনটেনেন্সের খরচা উঠে আসবে।”
“বাবার মাথায় এটা ঢোকান না আপনি, আমার কথা তো কানেই তোলেন না। শিখা বা মা এসব নিয়ে ভাবেও না।”
“ওঁদের কোনো ইন্টারেস্ট নেই, স্যার?
“মা”র কোনো কিছুতেই নেই, বোন নিজের কাজ নিয়েই ব্যস্ত।”
“এসব বিষয়ে ভাবনা-চিন্তা শুরু করে, আপনি কিন্তু স্যার, ছেলের কর্তব্য করছেন।”
“আমার নিজের ইচ্ছে এটাকে বেচে দেওয়া, এই গেঁয়ো জায়গায় পিতৃপুরুষের ভিটেমাটি আঁকড়ে পড়ে থাকা সিলি! কাছাকাছি কোনো হাসপাতাল নেই, বিপদে- আপদে খবর দিলেও পুলিশ আসে না। বাবার বয়স হচ্ছে, কিন্তু সেটা মানতে চান না।”
“তা তো বটেই স্যার, তবে ওঁকে তো বেশ স্বাস্থ্যবান লাগল।”
“স্বাস্থ্যবান হতে পারেন, কিন্তু কালকেই তো বাবার ওপর মার্ডার অ্যাটেম্পট হল! এর আগেও বাবা মাঝেমধ্যে বলেছেন, রাতে খুটখাট আওয়াজ শুনতে পান। “ একেনবাবুর দিকে তাকিয়ে ঋদ্ধি বোধহয় কথাগুলোর রিয়্যাকশন বোঝার চেষ্টা করল।
“সে কী, স্যার! এ তো সব্বোনেশে কথা!” একেনবাবু অবাক হয়ে বললেন। “হ্যাঁ, লাকিলি বেঁচে গেছেন, কিন্তু পুলিশে খবর দেবেন না। আমি দিতে চেয়েছি বলে সবাইকে গালাগাল দিলেন।
“আপনি কিন্তু স্যার, একটা ডায়েরি করলে পারতেন। এত ভয়ংকর ব্যাপার!”
“খেপেছেন! দিলেই আমাকে বাড়ি-ছাড়া করতেন।”
“আপনি যা বললেন, তাতে তো আমারই ভয় করছে স্যার, এখানে রাতে করল।”
“আমার ধারণা বাবাই টার্গেট।”
“এটা কেন ভাবছেন স্যার?”
“আপনি বাবার সম্পর্কে কিছুই জানেন না। একসময় খুব দুদে উকিল ছিলেন – অনেককে ঘোল খাইয়েছেন। শত্রু কম ছিল না। তা ছাড়া সারাজীবন শুধু চিন্তা কী করে আরও টাকা করে বাড়িটা পুরোনো ঐতিহ্যে ফিরিয়ে নেবেন। যাচ্ছেতাই! তাও, ঠিকই বলেছেন, আমাদের সাবধান থাকতে হবে।”
“যদি তেমন মনে হয় স্যার, তাহলে আপনি বরং বাবাকে অন্য কোনো ঘরে ক’দিন শুতে বলুন। আপনি বাবার ঘরে ঘুমোন— অন্তত যদ্দিন না বাড়ির সিকিউরিটির ব্যাপারটা জোরদার হয়। আর সবাইকে ব্যাপারটা জানাবার দরকার নেই। আপনাদের মধ্যেই রেখে দিন।”
“এটা মন্দ বলেননি। দেখি, আজ ডিনারের পরে কথাটা বলি। …আর কিছু দেখতে চান নীচে?”
“না, না, স্যার, এই যথেষ্ট। থ্যাংক ইউ। চলুন, ওপরে যাই।”
.
ওপরে উঠে একেনবাবু দেখলেন বারান্দায় বেশ ক’টা চেয়ার রাখা। শিখা আর রিনিতা বসে গল্প করছে। ঋদ্ধি ওর মায়ের ঘরে গেল। একেনবাবু আরেকটা চেয়ার টেনে বারান্দায় শিখাদের কাছে বসলেন।
“কেমন দেখলেন বাড়ি?”
“দারুণ!”
“আজকে রাতে শুধু খিচুড়ি।”
“এই ঝড়-বৃষ্টিতে সেটাই তো জমবে।”
“ওটা আনপ্ল্যানড, গোপাল এসে খবর দিল খন্যান স্টেশনের বাজার আজ বন্ধ। ওটাই এদিককার বড়ো বাজার।”
“ওখান থেকেই বাজার আসে?”
“এমনিতে না, এদিকের বাজার সপ্তাহে তিন দিন বসে। সত্যর কী একটা চিঠি পাঠাবার দরকার ছিল। সেটা ক্যুরিয়ারে পাঠাবার জন্য বাবা ডিএইচএল-এর অফিসে গোপালকে পাঠিয়েছিল। ওটা বাজারের পাশেই।”
“উনি কি আপনাদের বহুদিনের পরিচিত… মানে এই সত্যবাবু?”
“না, এবার এসে প্রথম দেখলাম। তবে বাবার খুবই পরিচিত মনে হল।”
.
বাইরে যাবার উপায় নেই, ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি পড়ছে। গেটের বাতি বার দুই ফ্লিকার করল।
“এখানে লোডশেডিং হয়?” একেনবাবুর গলা আতঙ্কিত।
“আগে খুবই হত। আমাদের জেনারেটর আছে তাই সমস্যা হয় না। কিন্তু ওটাও মাঝে মাঝে গোলমাল করে, তখন ঝামেলা— বাতি, ফ্যান, পাম্প কিছুই কাজ করে না।”
.
আকাশ অন্ধকার, ঝোড়ো হাওয়া আরম্ভ হয়েছে। বাড়ির ভেতরে বিশেষ কিছু দেখার বা করার নেই। পাছে আলো চলে যায়, জেনারেটর কাজ না করে… একেনবাবু ঘরে গিয়ে ফোন চার্জ করতে দিলেন। বাইরে গেলে ব্যাগে একটা টর্চ থাকে, সেটা আছে কিনা দেখলেন। গভীর রাতে বাতি নিভলে কেউ নিশ্চয় গিয়ে জেনারেটর চালাবে না, তখন অন্ধকারে বাথরুম বা অন্য কোথাও যেতে হলে সমস্যা হবে। নিউ ইয়র্ক ছেড়ে কলকাতায় এসে আবার আধ ঘণ্টার মতো দিবানিদ্রার অভ্যাস হয়েছে। চোখ ঢুলে ঢুলে আসছে। ভাবছিলেন একটু ঘুমিয়ে নেবেন, এমন সময়ে রিনিতা এসে হাজির।
“কি রে তোদের গল্প হয়ে গেল?”
“শিখার কী একটা কাজ ছিল। আমারও অনেক কাজ আছে, কিন্তু এই ঝড়ে নেট থাকবে বলে মনে হয় না।”
“তাহলে বোস। এবারে কলকাতায় এসে তো তোর সঙ্গে গল্পই করা হয়নি। ভালোকথা, আমার গোয়েন্দা পরিচয়টা কেউ এখানে জানে না তো?”
“না, তুমি বলতে বারণ করলে না?”
“হ্যাঁ, আসলে তুই মার্ডার অ্যাটেম্পটের কথা বলার পর থেকে আমি একটু বোঝার চেষ্টা করছি কী হয়ে থাকতে পারে!”
“আমার কিন্তু পুরো ব্যাপারটাতে ভয় করছে। শিখাও ভয় পেয়েছে। কিন্তু ওর বাবা অদ্ভুত মানুষ। কারোর কথা কানে তোলেন না, শুধু নিজের বাড়ি আর নিজের জগৎ নিয়েই আছেন।”
একেনবাবু মুচকি হাসলেন, “ওই সত্যবাবু লোকটির সঙ্গে তো বেশ ভালো সম্পর্ক।”
“তাতেই তো সবাই অবাক! শিখার দাদা, আর মায়ের ইচ্ছে ছেলেটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাড়ি থেকে বিদায় হোক। এখন দেখছি শিখাও ওদের দলে যোগ দিয়েছে।”
“হঠাৎ?”
“এমনিতে সত্যকে বেশ ভদ্র-সভ্য লাগছিল। আমাদের দু-জনেরই ভালো লেগেছিল ওর সঙ্গে গল্প করতে। এখন মনে হচ্ছে তুঙ্গনাথবাবুকে ছেলেটি তুর্ক করেছে।”
“মানে?”
“হঠাৎ তুঙ্গনাথবাবু আর সত্য হরিহর আত্মা হয়ে গেছেন… ঘরে বসে দরজা বন্ধ করে দু-জনে নানান আলোচনা করছেন। শিখা একসময় ঘরের সামনের বারান্দা দিয়ে যাচ্ছিল, তখন আবছা দু-একটা কথা ওর কানে গেছে… ‘দলিল’, ‘উইল’… টুকরো টুকরো শব্দ। শিখার মনে হয়েছে কথা চলছে সম্পত্তি নিয়ে। ওর মাকে সেটা জানাতে উনি প্রচণ্ড চটেছেন, যদিও এমনি কিছুতে থাকেন না! আর শিখার দাদা তো প্রথম থেকেই সত্যর ওপর খচা— কোনো কারণ ছাড়াই। শিখার এই কথা শুনলে আগুন হয়ে যাবে।”
“ভেরি ইন্টারেস্টিং ব্যাপার!” বলে একেনবাবু পা নাড়াতে শুরু করলেন। কিছু মাথায় এলে উনি এটা করে থাকেন।
ছয়
সাড়ে সাতটার একটু আগেই সবাই ডিনার টেবিলে এসে বসল- তুঙ্গনাথবাবু তখনও আসেননি। ঋদ্ধি মুখ-চোখ লাল করে মাকে রুদ্ধস্বরে বলল, “বাবা, রাজি তো হলই না। উলটে ঘর থেকে কাগজপত্র চুরি করার মতলব করছি বলে যাচ্ছেতাই করল!”
“কী বলতে গিয়েছিলি?” শিখা জিজ্ঞেস করল।
“বলেছিলাম বাবার সঙ্গে ঘর পালটে রাতে শোব, যাতে কেউ ঘরে ঢুকলে বাবাকে না পায়। আমার গলায় দড়ি দেওয়া অত সহজ হবে না, আমি রেডি হয়েই থাকব।”
“তুই বাবাকে চিনিস না? এতে বাবা কখনো রাজি হবে?”
ঋদ্ধি একেনবাবুর দিকে তাকাল। একেনবাবু একটু লজ্জা-লজ্জা মুখ করে বসে রইলেন— সাজেশনটা উনিই দিয়েছিলেন।
সত্য বোধহয় ঋদ্ধিকে দুর্ভাবনা মুক্ত করার জন্য বললেন, “দুশ্চিন্তা করছেন কেন? আমরা এতগুলো লোক বাড়িতে রয়েছি, সবাই খেয়াল রাখব ওঁর ঘরের দিকে।”
আগুনে ঘৃতাহুতি পড়ল। ঋদ্ধি চিড়বিড়িয়ে উঠল, “চিন্তা তো আপনাকে নিয়ে আপনি কে কারোর জানা নেই, হঠাৎ এসে বাবার সঙ্গে এত আত্মীয়তা করছেন কেন? মতলবটা কী? কেন এসেছেন এখানে?”
হঠাৎ এই আক্রমণে সত্য হতবাক হয়ে গেলেন!
“কী বলছেন আপনি!”
“ঠিকই বলছি, আপনার ধান্ধা আমি ভালোমতোই বুঝেছি। বাবার সামনে একটা বিশ্রী সিন হবার আগে এখান থেকে মানে মানে কেটে পড়ুন তো… পারলে এখনি!”
কথাটা ঋদ্ধি এত বিশ্রীভাবে চেঁচিয়ে বলল যে শিখা পর্যন্ত প্রতিবাদ না করে পারল না।
“দাদা, কী যা-তা বলছিস!”
ঋদ্ধির কথায় সত্যর মুখ কালো হয়ে গেল। রিনিতা ভাবছিল হে ধরণী দ্বিধা হও— এই বিষাক্ত পরিবেশ থেকে কখন পালানো যায়! আর একমুহূর্ত এ বাড়িতে থাকতে ইচ্ছে করছিল না ওর! কানুদার দিকে তাকাল। একেনবাবু চুপ করে বসে যেন নাটক দেখছেন। তুঙ্গনাথবাবু তখনই খাবার ঘরে ঢুকলেন। ঋদ্ধির শেষ কথাগুলো নিশ্চয় শুনতে পেয়েছেন। গম্ভীর মুখে সত্যকে জিজ্ঞেস করলেন, “কী ব্যাপার?”
সত্য উঠে দাঁড়ালেন। শান্তভাবে তুঙ্গনাথবাবুকে বললেন, “আপনি আমাকে ক্ষমা করবেন, আমার এখান থেকে চলে যাওয়া উচিত।”
ওঁকে থামিয়ে দিয়ে তুঙ্গনাথ বললেন, “না, তুমি যাবে না! কারোর যেতে হলে ঋদ্ধি যাবে।” তারপর সবার উদ্দেশে ঘোষণা করলেন, “তোমরা সবাই শুনে নাও। সত্য আমারই ছেলে… হ্যাঁ, ওর মাকে আমি বিয়ে করিনি, কিন্তু ওর পিতৃত্ব অস্বীকার করি না।”
ঘরে যেন বাজ পড়ল! ঘোষণাটা এত ড্রামাটিক, সবাই নির্বাক! অরুন্ধতী রাগে-অপমানে কাঁপতে কাঁপতে চেয়ার ছেড়ে উঠে টলতে টলতে নিজের ঘরের দিকে এগোলেন। শিখা দৌড়ে উঠে মাকে ধরে ফেলল, তারপর ওঁর কাঁধ জড়িয়ে, ধরে ধরে নিয়ে গেল। কল্পনা ডেকচি থেকে হাতা দিয়ে থালায় খিচুড়ি পরিবেশন করছিল। সশব্দে হাতা ফেলে ঘর থেকে অদৃশ্য হল। ঋদ্ধি কিছুক্ষণ হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে মাথা নীচু করে বেরিয়ে বোধহয় মায়ের কাছে গেল।
ঠিক কী করণীয় রিনিতা বুঝতে পারল না। এরকম অস্বভাবিক জঘন্য একটা পারিবারিক অশান্তিতে ওর কী কর্তব্য? সত্য মুখ-চোখ লাল করে করে বসে আছেন। ঘরের মধ্যে মৃদু হাসিমাখা মুখে একেনবাবু নির্বিকার।
.
তুঙ্গনাথবাবু হাঁক দিয়ে কল্পনাকে ডেকে আনলেন।
“এঁদের খাবার দাও। অন্যদের জিজ্ঞেস করো তারা কোথায় খাবে। আমার আর সত্যর খাবার আমার ঘরে দিয়ে যাও।” বলে এতটুকু দেরি না করে সত্যকে নিয়ে ঘরে চলে গেলেন।
কল্পনা কোনো কথা না বলে খিচুড়ি আর ভাজাভুজি রিনিতা আর একেনবাবুর প্লেটে দিল। “এ ছাড়া আর কিছু নেই।” জানিয়েই বোধহয় ছুটল গৃহকর্ত্রীর কাছে।
একেনবাবু গভীরভাবে কিছু চিন্তা করছেন।
রিনিতা ফিসফিস করে বলল, “কী ভাবছ, কানুদা?”
“খুব কনফিউজিং। খাওয়া-দাওয়া করে তোর ঘরে চল।”
রিনিতার কিছুই খেতে ইচ্ছে করছিল না। নিতান্ত প্লেটের খাবার একেবারে ফেলে দেওয়া যায় না, নামমাত্র খুঁটল। দেখল একেনবাবু দিব্যি পরিপাটি করে খেলেন।
“বুঝলি রিনিতা, ভুনি খিচুড়ির টেস্টই আলাদা, একেবারে পারফেক্ট রান্না— ভাজামুগের খাসা গন্ধ নাকে এল!”
“কানুদা! বাইরে ঝড়ের তাণ্ডব, ভেতরে এইসব চলছে… এর মধ্যেও তোমার ভাজা মুগডালের গন্ধ নাকে গেল!”
“শোন, ঝড় বন্ধ করতে পারব না, আর এই পারিবারিক ব্যাপারেও কিছু করতে পারব না… তাই না? কিন্তু এমন খিচুড়ি ভালো না বললে রাঁধুনিকে অপমান করা হবে।”
সত্যি, কানুদা মাঝে মাঝে বড্ড ইরিটেট করে! বাপিদা ওঁর গল্পে ঠিকই লেখেন!
রিনিতা আর কোনো কথা বলল না। একবার ভাবছিল শিখার কাছে যাবে, কিন্তু কী বলবে ওকে!
.
খাওয়া হয়ে গেলে রিনিতার ঘরে এসে বসলেন একেনবাবু। রিনিতা গোঁজ হয়ে রইল।
“তুমি কিছু জানতে চাও?”
“হ্যাঁ, সত্যবাবুর সম্পর্কে কী জানিস তুই?”
“প্রায় কিছুই না। গল্প করেছি কিছুক্ষণ, তবে নিজের সম্বন্ধে কিছুই বলেননি। না, ভুল বললাম… কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন অল্প কিছুদিন আগে ওঁর মা মারা গেছেন। আর জানি বাড়ি রামপুরহাটে।”
“তার মানে তো বীরভূমে—সিউড়ির কাছে।”
“তাই হবে। যখন শুনলেন তুমি কলকাতা থেকে গাড়ি নিয়ে আমাকে নিতে আসছ, বললেন যা ঝড়-বৃষ্টি আসছে… পারলে উনিও একটা রাইড নিতেন, কিন্তু যাবেন উলটো দিকে।”
“পুরো নামটা জানিস?”
“না, সত্যকাম বোধহয়, পদবি বলেননি। কেন বলো তো?”
“যাক গে, জেনেই-বা কী লাভ!”
“আচ্ছা কানুদা, তুঙ্গনাথবাবু যদি সত্যিই সত্যর বাবা হন, তাহলে তো সত্য
. অবৈধ সন্তান, তাই না?”
“তাই তো হবে, বিয়ে যখন করেননি।”
“সত্যকে দেখে তো আমাদের থেকে একটু ছোটোই মনে হয়…
“তাহলে পরকীয়া! …ভেরি ইন্টারেস্টিং।”
রিনিতা গজগজিয়ে উঠল, “এর মধ্যে বড়োলোকদের কেচ্ছাকাহিনি ছাড়া কী ইন্টারেস্টিং পেলে তুমি?”
একেনবাবুর ঠোঁটে সামান্য হাসি, “তুই শুয়ে পড় এবার। রাত্রে ভয় করলে আমার দরজায় ধাক্কা দিস। যা ঝড়ঝঞ্ঝা চলছে! চাস তো আমি এই ঘরেই মেঝেতে শুতে পারি।”
“না না, তার কোনো দরকার নেই। শুধু একটাই চিন্তা, তুঙ্গনাথবাবুকে যে মার্ডার করার চেষ্টা করেছিল, সে আবার আজ রাতে না হানা দেয়!”
“ওটা নিয়ে একেবারেই ভাবিস না। কি হবে না।” বোনকে আশ্বাস দিয়ে একেনবাবু নিজের ঘরে চলে গেলেন।
রিনিতা ভাবল এত নিশ্চিন্তে কানুদা কথাটা বলল কী করে!
সাত
সোমবার ভোর বেলা ঘুম থেকে উঠে রিনিতা দেখল পুরো বাড়ি যেন আরও থমথমে এমনিতে সকালে শিখা বারান্দায় চলে আসে, দুই বন্ধু গল্প করে, চা খায়। মনে হয় বাবার লাম্পট্যের এই বেপরোয়া স্বীকৃতিতে শিখা এত লজ্জিত যে বন্ধুর কাছে মুখ দেখাতে পারছে না। অথচ রিনিতা ব্যাপারটাকে সেরকম বড়ো করে দেখছে না। শিখারও দেখা উচিত নয়। ওরা এ যুগের ছেলেমেয়ে, প্রি-ম্যারিটাল আর এক্সট্রা ম্যারিটাল রিলেশানশিপ ওদের কাছে অতটা ট্যাবু নয়। শিখা যথেষ্ট প্রোগ্রেসিভ। বিয়ে না করে ‘লিভ টুগেদার’ নিয়ে সিরিয়াস আলোচনা ওরা করেছে। এ নিয়ে কোনো নৈতিক সমস্যা ওদের নেই। আসলে নিজের বাবা জড়িত বলেই ব্যাপারটা শকিং! হয়তো অরুন্ধতী দেবীর সম্মান ও কষ্টের জন্যে ওর এত খারাপ লাগছে।
সত্য কী করছেন কে জানে… তাঁর তো কোনো ‘দোষ’ নেই। বারান্দায় বসে এসব হাবিজাবি ভাবছে, দরজা খুলে সত্য বেরিয়ে এলেন। এই এক রাতেই ওঁর ওপর একটা ঝড় বয়ে গেছে, চেহারায় সেটা স্পষ্ট। দূর থেকে রিনিতা হাত নেড়ে ডাকল সত্যকে। ইতিমধ্যে একেনবাবুও ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছেন।
“আসুন স্যার, আসুন স্যার,” তিনিও সত্যকে আহ্বান জানালেন। সত্য এসে একটা চেয়ারে বসতেই জিজ্ঞেস করলেন, “কেমন আছেন স্যার?”
এই একটা প্রশ্নের জবাবে ইমোশনাল হয়ে সত্য একসঙ্গে গুচ্ছের কথা বলে ফেললেন।
“কেমন আছি! ব্যাপারটা এরকম হবে জানলে আমি আসতাম না। এতদিন জানতাম আমার আব্বা নেই, কিন্তু যখন জানতে পারলাম তিনি আছেন এবং জীবিত… না এসে পারলাম না। আর কিছু না হোক, আব্বা কেন আম্মাকে আর আমাকে ছেড়ে গেছেন সেটা জানার ইচ্ছে আমাকে তাড়া করে নিয়ে এসেছে! এসে অবশ্য বুঝতে পেরেছি ভুল করেছি। আব্বার এখনকার ফ্যামিলির কথা এক বারও ভাবিনি… তাদের দুঃখের কারণ হয়েছি। তা ছাড়া আব্বার ওপর মার্ডার অ্যাটেম্পট… সেটাও আমাকে খুব চিন্তায় ফেলেছে। কিছুদিন আগে নানা-নানিকে হারিয়েছি, ক’দিন আগে আম্মাকে। এখন আমার একমাত্র মুরুব্বি আব্বাকেও যদি হারাতে হয়!”
“আসলে, স্যার, আমরা ব্যাপারটা জানি না। এমনকী, স্যার, আপনার পুরো নামটাই জানি না! আপনার মা’র সঙ্গে তুঙ্গনাথবাবুর সম্পর্ক ছিল, সেটুকুই শুধু বুঝেছি।”
“আমার নাম জাফরউল্লা সত্যকাম। রামপুরহাটে প্রায় সবাই আমাকে জাফর নামেই চেনে।”
“ভেরি ইন্টারেস্টিং স্যার। তার মানে আপনি মুসলিম?”
উফফ, কানুদা না মাঝে মাঝে এত বোকা বোকা ভাব দেখায়! রিনিতা মনে মনে ভাবল।
“জি হ্যাঁ।”
“আপনি যে তুঙ্গনাথবাবুর ছেলে, সেটা বলতেই উনি মেনে নিলেন?”
উত্তরে সত্য গড়গড় করে যা বললেন, তা শুনে রিনিতা হতবাক! স্বল্প পরিচিত দু-জনের সামনে এমন অকপটে সত্য কেন নিজেকে উজাড় করে দিচ্ছেন? এই ভার আর চেপে রাখতে পারছেন না? কাউকে বলা দরকার?
“শুধু আমার মায়ের নামটা বলেছিলাম। বলেছিলাম, “ওঁর মৃত্যুসংবাদ দিতে এসেছি।” আব্বা প্রথমে খুব বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমাকে কেন?” একটু বানিয়েই বললাম, ‘মা মৃত্যুসংবাদ আপনাকে জানাতে বলে গেছেন।”
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আব্বা জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার নানা-নানি এখন কোথায় থাকেন?”
‘ওঁরা কেউ বেঁচে নেই। “
‘তোমার ভাই-বোন নেই?”
‘না, আমিই মায়ের একমাত্র ছেলে। মা কোনোদিন বিয়ে করেননি।”
“তার মানে তুমি একেবারে একা?”
‘জি।”
‘বিয়ে করেছ?”
‘আজ্ঞে না।”
‘তুমি জানো তুমি আমার সন্তান?”
‘জি, মা বলে গেছেন।
আমার মাথায় হাত দিয়ে বললেন, ‘চলো, আমার বাড়িতে ক’দিন আমার কাছে থাকবে।” এই প্রথম আব্বার স্বর কোমল ঠেকল।”
“একটা কথা স্যার। আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে, আপনার মা তুঙ্গনাথবাবুকে ওঁর মৃত্যুসংবাদ দিতে বলে যাননি, তাই কি?”
“ঠিক। মাস ছয়েক আগে আব্বার নাম হঠাৎ আবিষ্কার করেছিলাম। মা তখন অসুস্থ। কী কারণে আম্মার আলমারি ঘাঁটতে হয়েছিল। তখনই আম্মাকে লেখা আব্বার কিছু পুরোনো চিঠিপত্র দেখি। নামটা অচেনা, তার থেকে একটা চিঠি হাতে দিতেই আম্মা কাঁদতে শুরু করলেন। জিজ্ঞেস করলাম, ‘চিঠি দেখে তুমি কাঁদছ কেন?” মা বললেন, ‘তোর আব্বার চিঠি। কিন্তু কসম খেয়ে বল, কোনোদিন ওর সঙ্গে যোগাযোগ করবি না। করলে ওর পরিবারে অশান্তি হবে।” এসব ঘটনা অল্প কিছুদিন আগের ব্যাপার। আমি বরাবর জানতাম আব্বা আমার জন্মের আগে মারা গেছেন। আম্মা সুন্দরী ছিল… শুধু সুন্দরী নয়, অপূর্ব সুন্দরী। বড়োলোকের একমাত্র সন্তান, তার ওপর এত সুন্দরী… নানা-নানির মুখে শুনেছি আম্মাকে বিয়ে করার জন্য অনেকেই পাগল ছিল। আমি জন্মাবার পরও বিয়ের বহু প্রস্তাব এসেছিল। আম্মা রাজি হয়নি।”
এটুকু বলার পর একটু থেমে সত্য আবার বললেন, “বিশ্বাস করুন, আমি এসেছিলাম আব্বাকে শুধু এক বার চোখে দেখতে… কোনো এক্সপেক্টেশন নিয়ে আসিনি। কিন্তু আব্বার আদেশ অমান্য করতেও চাইনি। আব্বাকে অনুরোধ করেছিলাম, যদি থাকি আমার পরিচয় গোপন রাখতে। আব্বা বলতেনও না। হঠাৎ আমাকে নিয়ে এত গোলমাল হচ্ছে দেখে বোধহয় মেজাজ ঠিক রাখতে পারেননি।”
“আমার খুব খারাপ লাগছে,” রিনিতা বলল, “এরকম অপমানজনক পরিস্থিতিতে আপনাকে পড়তে হল।”
“আসলে আম্মার কথা না রেখে এখানে আসাটাই আমার ভুল হয়েছে… তবে না এসে পারিনি।”
“ভেরি স্যাড, স্যার। আচ্ছা, তুঙ্গনাথবাবুর কথা আপনার নানা-নানি জানতেন না?”
“মনে হয় না। মা ওঁদেরও কোনোদিন বলেননি। এমনিতে আম্মা খুব নরম, কিন্তু অসাধারণ মনের জোর ছিল… শুধু শেষের কটা দিন…।” সত্যর চোখ দুটো জলে ভরে উঠল।
এ নিয়ে আর বেশি প্রশ্ন করা গেল না, কল্পনা আসছে। বারান্দায় এসে কল্পনা সবাইকে উদ্দেশ করে জিজ্ঞেস করল, “আপনারা খাবার ঘরে খাবেন নাকি?”
“আমার খাবার কি আমার ঘরে দেওয়া যাবে?” সত্য জিজ্ঞেস করলেন। “যাবে,” বলে কল্পনা চলে গেল। সত্যও “আসছি,” বলে উঠে নিজের ঘরে গেলেন।
শিখা বারান্দায় আসেনি, ঘরেও নেই। মনে হয় মা’র ঘরে আছে। একেনবাবু আর রিনিতা কিছুক্ষণ চুপচাপ বারান্দায় বসে রইল। একেনবাবু হঠাৎ রিনিতাকে প্ৰশ্ন করলেন, “রিনি, ধর্ম নিয়ে তোর কি কোনো সমস্যা আছে?”
“না, কেন বলো তো!”
“ভাবছিলাম।”
“কী ভাবছিলে?”
“ছেলেটা হ্যান্ডসাম, তার ওপর রাজার ছেলে… রাজরানি হবার এরকম একটা সুযোগ…”
“কানুদা! তুমি এবার থামো।”
“কী মুশকিল, দাদা হিসেবে আমার একটা দায়িত্ব আছে তো!”
“অত্যন্ত ইরিটেটিং তুমি! যাও, আমার পেছনে না লেগে ঘরে গিয়ে নিজের কাজ করো, আমারও অনেক কাজ আছে!”
“যাচ্ছি, যাচ্ছি!” একগাল হেসে একেনবাবু পালালেন।
রিনিতা ঘরে গিয়ে ল্যাপটপ খুলে অফিসের কাজে মন দেবার চেষ্টা করল। কাল রাতের ওই ড্রামার পর মাথা ভালো কাজ করছে না। কিছুক্ষণ সময় লাগল মনস্থির করতে। পাশের ঘর থেকে আসা শব্দ শুনে মনে হল কানুদা ফোন করছে বেশ কয়েকটা। একটা নিশ্চয়ই বউদিকে, সেটা গলার সুরে ধরা যায়। অন্যগুলো কাজের।
সাড়ে আটটার সময় দরজায় টোকা, কানুদা মাথা গলাল।
“আজকে বোধহয় লেট ব্রেকফাস্ট। খাবার ঘরে কাউকে দেখলাম না।”
“তোমার খুব খিদে পেয়েছে?”
“আরে না। বুঝলি, একটা জিনিস ভাবছি। … বাবা-মায়ের সম্পত্তির ওপর অবৈধ সন্তানদেরও কিন্তু সমান অধিকার।
তখনও রিনিতার মাথায় কাজের কথা ঘুরছে। অন্যমনস্কভাবে বলল, “বুঝলাম না।”
“মানে এই বাড়ির ওপর ঋদ্ধিবাবু আর শিখার যতটা অধিকার, সত্যবাবুরও ঠিক ততটাই অধিকার।”
“তার মানে তুঙ্গনাথবাবু খুন হলে সত্যর লাভ আছে?”
“তা আছে। উনি নিজেই তো আমাদের সবার সামনে সত্যবাবুকে সন্তানের স্বীকৃতি দিয়েছেন।”
“কী সর্বনাশ, তার মানে তো তুঙ্গবাবুকে খুনের চেষ্টার পেছনে সত্য জড়িত থাকতে পারেন!”
“তা পারেন, কিন্তু সেটা প্রমাণিত হলে গলায় দড়ি ছাড়া কিছুই পাবেন না।”
“হুঁ!” রিনিতা কথা ঘোরাল। “সাতসকালে কাকে ফোন করছিলে? একটা নিশ্চয়ই বউদিকে, অন্যগুলো?”
“নিউ ইয়র্কে বাপিবাবুকে। ওঁর মামা সিউড়িতে ওকালতি করেন, হয়তো রামপুরহাটের অনেককে চিনবেন।”
“কার খোঁজখবর নেবেন উনি, সত্যর?”
“ভাবছি। আমি বুঝলি, ট্রাস্ট বাট ভেরিফাই-এ বিশ্বাসী। উনি যা বললেন, সেটা হান্ড্রেড পারসেন্ট ঠিক কিনা একটু দেখে নিতাম।”
“তিরিশ-পঁয়তিরিশ বছরের পুরোনো খবর, কে ভেরিফাই করবে?”
“গুড পয়েন্ট।”
“কী তোমার মাথায় ঘোরে কানুদা, তুমিই জানো! চলো, দেখি খাবারের কী অবস্থা।”
.
ততক্ষণে খাবার ঘরে সবাই, অর্থাৎ তুঙ্গনাথবাবু, অরুন্ধতী দেবী, ঋদ্ধি আর শিখা — চার জনই উপস্থিত। একেনবাবু আর রিনিতাই শুধু বাইরের লোক। কল্পনা খাবার দিচ্ছে, সবাই নিঃশব্দে খাচ্ছে। ময়দার লুচি, ছোলার ডাল, আর বেগুনভাজা। রিনিতার প্রিয় খাবার। ব্যাঙ্গালোরে এসব জোটে না, পাওয়া যায় শুধু পুরি। কিন্তু কাল থেকে একেবারেই খাওয়ায় মন নেই। ঝড় না এলে আজকেই পালাত রিনিতা। কিন্তু তা হবার নয়। শেষ খবর ঝড় বিকেলের মধ্যে হানা দেবে। শেষ হতে হতে কাল দুপুর। কাল গাড়ি না পেলে ট্রেনেই ফিরে যাবে। এখানে যা অবস্থা, শিখা হয়তো ওদের সঙ্গে যাবে না। তবু এক বার জিজ্ঞেস করতে হবে।
এমনিতেই তুঙ্গনাথ বেশি কথা বলেন না। আজ প্রায় মুখ বন্ধ। শুধু এক বার কল্পনাকে জিজ্ঞেস করলেন, “সত্যকে খাবার দিয়েছ?”
“দিছি,” কল্পনার সংক্ষিপ্ত উত্তর।
শিখা চুপচাপ, শুধু ঋদ্ধি মায়ের সঙ্গে ফিসফিস করে কিছু আলোচনা করছে। এতই আস্তে, রিনিতা কান পেতেও শুনতে পেল না। খাওয়া শেষ করে ওঠার আগে শিখার কাছে গিয়ে রিনিতা বলল, “হ্যাঁরে, খাওয়া হলে একটু আমার ঘরে আসবি? কিছু কথা আছে। তোর ঘরেও যেতে পারি, যেটা সুবিধে।”
“তুই যা, আমি আসছি।”
.
খানিকক্ষণের মধ্যেই শিখা এল, মুখ-চোখ বিধ্বস্ত। বন্ধুকে জড়িয়ে ধরল রিনিতা।
“ঠিক আছিস তুই?”
“আমি ঠিক আছি, মাকে নিয়েই এখন চিন্তা… হঠাৎ কিছু না করে বসে!”
“বুঝতে পারছি রে, উনি অন্য যুগের মানুষ। এটা ওঁর কাছে অত্যন্ত শকিং!”
“এমনিতেই বাবার সঙ্গে মায়ের সম্পর্ক প্রায় নেই। সেটা আজ নয়, বহুদিন থেকেই। জানিস, মা ছিল সে সময়কার প্রোগ্রেসিভ মেয়ে। পড়াশুনো করছিল, খুব ভালো ছাত্রী ছিল শুনেছি। পড়াশুনো শেষ না করে বিয়ে করতে মা রাজি হয়নি। বিয়ের পরে মাকে পড়াশুনো করতে দেওয়া হবে প্রতিশ্রুতি দিয়ে বাবা বিয়েতে রাজি করিয়েছিল। বিএ ফাইনাল ইয়ারে যখন পড়ছে, বিয়ে হল। সেখানেই পড়াশুনোয় ইতি। বউদের পড়াশুনোর দরকার নেই— ঠাকুরদা বিধান দিলেন। বাবা বেমালুম প্রতিশ্রুতি ভুলে নিজের বাবাকে সাপোর্ট করন হান্ড্রেড পারসেন্ট। বর্মণ বাড়ির ট্র্যাডিশন বলে কথা! সেই যে মা নিজেকে গুটিয়ে নিল…। বিশ্বাস কর, মায়ের ওয়ার্থ বলতে যা বোঝায়, আমরা তা পাইনি। সব প্রয়োজন মিটিয়েছে মা, কিন্তু ছোট্টবেলা থেকে মনে হয়েছে কোথাও যেন ফাঁক রয়ে গেছে! বাবা তো চিরকালই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। এই বাড়িটাই বাবার সন্তান। দাদা স্পয়েন্ট চাইল্ড, কিন্তু তার জন্য দায়ী ঠাকুরদা-ঠাকুরমা, বাবা-মায়ের স্নেহ বেশি পায়নি। আমিও পাইনি, কিন্তু ছোটোবেলা থেকেই আমি শক্ত। আজকেই প্রথম দেখলাম দাদার হয়ে মা দাঁড়িয়েছে… একটু আগেই আমাকে বলেছে গাড়ি করে সবাইকে কলকাতার বাড়িতে নিয়ে যেতে। বাবা এখানে থাকুক তার নতুন ছেলেকে নিয়ে।”
একনাগাড়ে কথাগুলো বলে শিখা হাঁপাতে লাগল। চোখ দিয়ে টস টস করে জল পড়ছে। রিনিতা বন্ধুকে জড়িয়ে ধরল আবার।
“সরি।” কান্না কান্না গলায় শিখা বলল।
“সরি কেন?” রিনিতা অবাক হয়ে প্রশ্ন করল।
“তোকে এ বাড়িতে এনে এরকম জঘন্য একটা পরিস্থিতিতে ফেলেছি।”
‘কী স্টুপিডের মতো কথা বলছিস! শোন তোর যদি গাড়ি ম্যানেজ করতে অসুবিধা হয়, কানুদাকে বলছি, তোদের জন্য একটা বড়ো গাড়ির বন্দোবস্ত করে দেবে। আর তুই চাইলে ক’দিন আমার বাড়িতে থাকবি। তারপর তো আমরা দু-জনেই ব্যাঙ্গালোরে পালাচ্ছি।
“দেখি, মা’র জন্য একটা ব্যবস্থা না করে তো যাওয়া যাবে না।”
“মাসিমাকে ব্যাঙ্গালোরেও নিয়ে যাওয়া যায়… ভেবে দেখিস।”
শিখা কিছুক্ষণ চুপ করে বসে তারপর রিনিতাকে একটু জড়িয়ে ধরে চলে গেল। সত্যর যে খবরগুলো দেবে বলে শিখাকে ডেকেছিল রিনিতা, তা আর দেওয়া হল না।
আট
দুপুরে রিনিতা নিজের কাজ নিয়ে বসল। ঝড় আসার আগেই যতটা শেষ করা সম্ভব। এরপর নেট-এর টিকির দেখা পাওয়া যাবে না। কদ্দিন বাদে মিলবে, তাও জানা নেই। পুরো দিনটা কাজেই কাটল। লাঞ্চ খেল না, সেটা বড়ো ব্যাপার নয়, অনেকদিনই ও লাঞ্চ খায় না। কাজের ফাঁকেই দেখল বারান্দায় কানুদার সঙ্গে শিখা কথা বলছে। ঋদ্ধিও কিছুক্ষণের জন্য এসে বসল। সাতটা নাগাদ দরজা-জানলা কাঁপিয়ে ঝড় বেশ ভালোমতোই এসে গেল, সেইসঙ্গে বিদায় জানাল নেট। কিছুক্ষণের জন্য আলো চলে গিয়েছিল, জেনারেটরের দৌলতে ফিরে এসেছে। ঝড়ের শব্দের সঙ্গে জেনারেটরের ঘড়ঘড় আওয়াজ যোগ হয়েছে। ল্যাপটপ বন্ধ করে, ঘর থেকে বেরিয়ে এসে রিনিতা দেখে বারান্দায় জল ছপছপ করছে। বারান্দা উলটো দিকে ঢালু বলে রক্ষে, ঘরে জল ঢোকেনি।
.
কল্পনা তাড়াতাড়ি রাতের খাবার বানিয়েছে। ডিনারের ফিক্সড রুটিন আজ মানা যাবে না। কানুদাকে ডেকে নিয়ে খাবার ঘরে একবার ঢুঁ মারতেই কল্পনা বলল, “আবনারা বইসে পড়েন।”
“অন্যরা কেউ আসছেন না?”
গজগজ করল কল্পনা, “না, আমার কাজ বাড়ায়ে সব নিজের ঘরে খাইবেন!”
.
নিরামিষ আহার। একটা তরকারি, ডাল আর রুটি। বাতাসের গতি যেভাবে বেড়ে চলেছে, তাতে কাল বাজারের অস্তিত্ব থাকবে কিনা কে জানে! সারাদিন ঘরে বন্দি থেকে কাজ করার ক্লান্তিতে রিনিতার ঘুম পেল। কোনোমতে খেয়ে, “কানুদা আমি ঘুমোতে যাচ্ছি,” বলে শুতে চলে গেল। শুল, কিন্তু ঘুম এল না অনেকক্ষণ। ঝড়ের সোঁ-সোঁ, ঝমঝম বৃষ্টি, আর বজ্র-বিদ্যুতের আওয়াজের মধ্যেও টের পেল কানুদা ফোনে কথা বলছে। ঘুম ঘুম চোখে ভাবল, তার মানে টাওয়ার এখনও দাঁড়িয়ে। তারপর কখন যে ঘুমিয়ে পড়ল জানে না।
ঘুম ভাঙল ভোর ছ’টা নাগাদ, তুঙ্গনাথবাবুর আর্তনাদে। তখনও কল্পনা বেড-টি দিতে আসেনি। কোনোমতে সালোয়ার-কামিজ গলিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে কানুদার দরজায় ধাক্কা দিল। ভেতর থেকে ‘আসছি’ শুনে বুঝল কানুদা তৈরি হচ্ছে। দ্রুত পায়ে ভেজা বারান্দা দিয়ে এগোতেই দেখে তুঙ্গনাথবাবু উদ্ভ্রান্তের মতো দুম দুম করে নিজের ঘরের দরজায় ধাক্কা দিচ্ছেন! গোলমাল শুনে ঋদ্ধি ছুটে আসছে, শিখা ঘর থেকে বেরোচ্ছে।
তুঙ্গনাথবাবু ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে দরজা খুলতে পারছেন না, ভেতর থেকে বন্ধ। ঋদ্ধি বাবার সঙ্গে হাত মেলাল। বাবা-ছেলে দু-জনে মিলে ধাক্কা দিচ্ছে, কিন্তু দরজা খুলল না।
ঋদ্ধি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “দরজা লক হল কী করে? তালা দিয়েছিলে?”
প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে তুঙ্গনাথ বললেন, “তোর চাবিটা নিয়ে আয়।”
ঋদ্ধি দৌড়ে চাবি নিয়ে এল। তুঙ্গনাথবাবু দরজায় চাবি লাগিয়ে ঘোরালেন।
দরজা খুলতেই রিনিতা উঁকি মেরে দেখতে পেল এক ভয়ংকর দৃশ্য! জানলার কাছে দেয়ালে হেলান দিয়ে সত্য ঝুলে আছে। একটা বেল্টের বকলসের প্রাস্ত গলায় আটকানো, অন্য প্রান্ত জানলার শিকে বাঁধা। সত্যর চোখ কোটর ঠেলে বেরিয়ে এসেছে। মৃত্যু ঘটেছে, সন্দেহ নেই! কিছু ভাবার আগে রিনিতার মনে প্রশ্ন জাগল, ‘সত্য এ ঘরে কেন? ওই কী দরজায় তালা দিয়েছিল?”
একেনবাবু দৌড়ে এসে নিমেষে ব্যাপারটা মেপে নিলেন। তারপর ঘরে ঢুকে সত্যর গলায় হাত দিয়ে পাল্স দেখার চেষ্টা করলেন।
“নাঃ, এক্সপায়ার্ড।”
বলেই জানলার শিকগুলো নেড়ে নেড়ে কী যেন দেখতে লাগলেন।
ঋদ্ধি চাপা গলায় বলল, “সুইসাইড? কিন্তু বাবার ঘরে সত্য এল কী করে!”
রিনিতার মনেও সেই একই প্রশ্ন।
তুঙ্গনাথবাবু নিজের মার্ডার অ্যাটেম্পট পাত্তা দেননি, কিন্তু সত্যর মৃত্যুতে ভেঙে পড়লেন! কান্না চাপতে চাপতে রুদ্ধস্বরে আত্মগতভাবেই বললেন, “কী করে এটা হল? এটা কেন করতে গেল সত্য!”
রিনিতা চাপা স্বরে একেনবাবুকে জিজ্ঞেস করল, “কী বুঝছ, কানুদা?”
উত্তর না দিয়ে একেনবাবু সবার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন, “দরজা কি ভেতর থেকে বন্ধ ছিল?”
সকলেই হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে, শেষে রিনিতাই বলল, “হ্যাঁ।”
ঋদ্ধি বলল, “বাবা, খোলার চেষ্টা করে খুলতে পারছিলেন না। আমরা দু-জনে ধাক্কা মেরে খুলতে পারিনি, চাবি দিয়ে খুলতে হয়েছে। কিন্তু বুঝতে পারছি না, ঘরে সত্য কেন!”
ফিসফিসে গলায় শিখা আবার জিজ্ঞেস করল, “সুইসাইড করেছে?”
একেনবাবু বললেন, “সম্ভবত। ইনভেস্টিগেট করতে হবে। পুলিশকে এক্ষুনি খবর দিন। আর এখানে কেউ কিছু ছোঁবেন না। আপনারা সবাই বাইরে যান।”
ওঁর গলা ভীষণ অফিশিয়াল শোনাল।
“খবর দিচ্ছি,” ঋদ্ধি কড়া চোখে একেনবাবুর দিকে তাকাল। “কিন্তু আপনি বলার কে?”
ইতিমধ্যে অরুন্ধতী দেবী চলে এসেছেন।
রিনিতা বুঝল এখন আর কানুদার পরিচয় গোপন রাখার অর্থ হয় না। একটু গর্বভরেই বলল, “কানুদার নাম একেন্দ্র সেন, কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা ডিপার্টমেন্টে ছিল, এখন নিউ ইয়র্ক পুলিশের ডিটেকটিভ কনসাল্টেন্ট।”
যাঁরা আগে একেনবাবুর কাহিনি পড়েছেন, তাঁরা জানেন একেনবাবুর চেহারা সাদামাটা— একেবারে আন-ইম্প্রেসিভ! পরিচয় শুনে সবারই মুখ ‘হাঁ” হয়ে গেল!
ঋদ্ধিকে একটু আড়ালে ডেকে একেনবাবু বললেন, “আপনি স্যার পুলিশে ফোন করার সময় আমাকেও ডাকবেন। পুলিশের ব্যাপার তো, হ্যারাসমেন্ট কম হতে পারে।”
“নিশ্চয়, নিশ্চয়, আমাকে আবার ‘স্যার’ বলছেন কেন!”
এই পরিস্থিতির মধ্যেও ঋদ্ধির এই সুর বদলে রিনিতা মজা পেল। শিখাও কেমন জানি ভক্তিভরে একেনবাবুর দিকে তাকাচ্ছে।
.
পুলিশকে ফোনে ধরতে সময় লাগল না। তবে তারা জানিয়ে দিল ঝড় না কমলে আসতে পারবে না। তারপর শুরু হল একতরফা প্ৰশ্ন।
ঋদ্ধি তাড়াতাড়ি বলল, “আমাদের বাড়িতে এক জন গেস্ট আছেন, গোয়েন্দা একেন্দ্র সেন। উনি এখানেই দাঁড়িয়ে।”
ব্যস, আর কিছু বলতে হল না। একটু শুনে ঋদ্ধি বলল, একেনবাবুর দিকে মোবাইলটা এগিয়ে দিল।
“নিশ্চয়,” তারপর একেনবাবু ‘হ্যালো’ বলার পর কিছুক্ষণ চুপ। মানে অন্য পক্ষ থেকে অনেক কথা আসছে। ওদিকের কথা রিনিতার কানে এল না, শুধু কানুদার দিকটাই শুনতে পেল।
“…ও বুঝেছি, আপনি আমার ট্রেনিং-এ ছিলেন… আচ্ছা, আচ্ছা, ‘তুমি’। …হ্যাঁ হ্যাঁ রমেন, নামটা ভালো মনে আছে। …না, না, আমি আছি, তুমি না আসা পর্যন্ত থাকব। …এরকম করে বলছ কেন, সাহায্যের যা দরকার নিশ্চয় করব- আমার বোনের বন্ধুর ফ্যামিলি বলে কথা। …ঠিক আছে, আমি ওদের বলে দিচ্ছি।”
ঋদ্ধিকে ফোন ফেরত দিয়ে একেনবাবু তাকালেন তুঙ্গনাথের দিকে।
“ভাববেন না। পুলিশ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আসবে। কিন্তু এই ঝড়ে দুপুরের আগে হবে না। ওদের নির্দেশ— ঘরে কেউ ঢুকবেন না। …আর স্যার, আপনাদের ওপর একটু ইম্পোজ করব। পুলিশকে কথা দিয়েছি ওদের সাহায্য করব। সেই জন্য সবাইকেই কিছু প্রশ্ন আমায় করতেই হবে। তাতে আপনাদের সমস্যা থাকলে পুলিশ এসে করবে, আমি এতটুকু মাইন্ড করব না। অবশ্যই রিফিউজ করতে পারেন।”
“কী আশ্চর্য! সমস্যা হবে কেন?” তুঙ্গনাথবাবু বলে উঠলেন। “এদিকে, আমি তো আপনাকে মেয়ের বন্ধুর দাদা বলে ‘তুমি, তুমি’ করছি।”
“সে কী স্যার, রিনিতা তো এখনও আমার বোন। আপনি প্লিজ ‘তুমি’ করেই বলবেন। এখন চলুন স্যার, সবাই ঘরের বাইরে গিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিই।”
তারপর শিখার দিকে তাকিয়ে অনুরোধ করলেন, “বাড়ির কাজের লোকদের একটু বলে দিও, যাতে কেউ এ ঘরে না ঢোকে।”
“বলছি। আর গোপালকে দিয়ে দুটো চেয়ার আনিয়ে দরজার সামনে রাখতে বলছি যাতে ভুল করে কেউ ঢুকে না পড়ে।”
রিনিতা বলল, “প্রত্যেক ঘরেই তো দুটো করে চেয়ার আছে। গোপালের কী দরকার, আমরাই চেয়ারগুলো এনে রেখে দিই।”
“না, না, এই ঘরের চেয়ার নয়। এই ঘরের কিছু ছোঁয়া চলবে না।” একেনবাবু সতর্ক করলেন।
ঘর খালি হয়ে গেলে চারিদিকে চট করে তাকিয়ে পকেটের রুমাল বের করে একেনবাবু স্টিলের দেরাজটা টেনে খোলার চেষ্টা করলেন। খুলল না, চাবি দিয়ে আটকানো। ব্যস, বেরিয়ে এসে দরজা বন্ধ করলেন।
পাশের ঘরের দরজা খোলা, সত্যর ঘর। সেখান থেকে চেয়ার আনতে ঋদ্ধি আর একেনবাবু ঢুকলেন। চেয়ার তুলতে গিয়ে একেনবাবুর চোখে পড়ল ঘরের এককোণে কাগজের কিছু পোড়া টুকরো। কপালে চিন্তার ভাঁজ ফুটল। একটু পরে বেরিয়ে দরজা বন্ধ করলেন। দুটো চেয়ার তুঙ্গনাথবাবুর ঘরের সামনে পাঁচিল হিসেবে রাখা হল।
“আপনি স্যার, তাহলে কাল রাতে সত্যবাবুর ঘরে শুয়েছিলেন?”
প্রশ্ন শুনে তুঙ্গনাথ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন, উত্তর দিলেন না।
একটা জিনিস রিনিতার চোখে লাগছিল। বাড়িতে একজন মারা গেছে, অস্বাভাবিক মৃত্যু। সবাই তাতে বিচলিত ঠিকই, কিন্তু বিমর্ষ নয়। হয়তো সত্যের মৃত্যুর সঙ্গে একটা সমবেত দুঃস্বপ্নের অবসান ঘটেছে। একমাত্র ব্যতিক্রম তুঙ্গনাথবাবু। তাঁকে দেখে বোঝা যাচ্ছে তিনি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। শিখা মাকে নিয়ে ব্যস্ত। কিন্তু ঋদ্ধি এত ভয় পেয়েছে কেন? ওর কী ধারণা বাঘের মতো, পুলিশ ছুঁলেই আঠেরো ঘা!
এতক্ষণ কী চলছে কল্পনা দূর থেকে দেখছিল। সত্য সম্পর্কে তার মনোভাব বৈরী। এই মৃত্যুতে কষ্ট পেয়েছে বলে মনে হল না। সবাইকে বারান্দায় আসতে দেখে বিড়বিড় করে জিজ্ঞেস করতে লাগল কাকে কোথায় ‘বেট্টি’ দেবে। তুঙ্গনাথবাবু, “আমি এখন কিছু খাব না,” বলে নিজের ঘর, মানে সত্যের ঘরের দিকে চলে গেলেন।
রিনিতার দিকে তাকিয়ে একেনবাবু বললেন, “আমরা বারান্দায় বসি চল। ওখানেই চা দিক না।”
ঋদ্ধি আর শিখাও ওদের সঙ্গে এসে বসল। অরুন্ধতী দেবী নিজের ঘরে চলে গেলেন।
সবাই এসে বসতে একেনবাবু বললেন, “ব্রেকফাস্টের পর সবার সঙ্গে আলাদা আলাদা কথা বলতে চাই। তার আগে দুয়েকটা সাধারণ প্রশ্ন করি। এ বাড়ির দরজাগুলো কি ভেতর থেকে লক করা যায়?”
ঋদ্ধিই উত্তর দিল, “হ্যাঁ, ভেতর-বাইরে দু-দিক থেকেই করা যায়। সব গেস্ট রুমের চাবি এক। আবার আমাদের চারটে রুমেরও এক চাবি, যাতে কেউ ভেতর থেকে লক করে বেরিয়ে এলে বাইরে আটকা না পড়ে। গেস্ট রুমের চাবিও আমাদের কাছে থাকে।”
“বুঝেছি স্যার, ডবল সিলিন্ডার লক। ভেরি নাইস, ভেরি নাইস। এখন দ্বিতীয় প্রশ্ন। সত্যবাবু কাল রাতে তুঙ্গনাথবাবুর সঙ্গে ঘর পালটাপালটি করেছিলেন। কেন? কাউকে উনি জানিয়েছিলেন?”
সবাই মাথা ঝাঁকাল, “না।”
ঋদ্ধি উলটে প্রশ্ন করল, “আপনি তো আমাকে বলেছিলেন বাবার সঙ্গে ঘর এক্সচেঞ্জ করে শুতে! সত্যকেও কি তাই বলেছিলেন?”
“না স্যার, বলিনি। আপনাকে বলেছিলাম, কারণ আপনার চিন্তা ছিল আপনার বাবাকে কেউ যদি আবার খুন করার চেষ্টা করে। খুনি অবভিয়াসলি জানে তুঙ্গনাথবাবু কোন ঘরে ঘুমোন। তাই না?”
প্রশ্নটা শুনে ঋদ্ধি একটু নার্ভাস হয়ে গেল।
“আপনি কি মনে করেন এটা মার্ডার?” শিখা প্রশ্ন করল।
“জানি না, সুইসাইডও হতে পারে!”
“বেল্টে গলা জড়িয়ে?”
“সবই সম্ভব। আপাতত এখানেই থাক। কারোরই তো সকাল থেকে হাত-মুখ ধোওয়ার সময় হয়নি। সকালে খাওয়া-দাওয়ার পর সবার সঙ্গে আলাদা করে বসব। আমার রুমেই বসা যেতে পারে। তাহলে অন্য কাউকে ডিস্টার্ব করতে হবে না।”
.
একেনবাবু আরম্ভ করলেন রিনিতাকে দিয়ে। অন্যদের জবানবন্দির সত্যতা চেক করার জন্যে একটা বেস-লাইন খাড়া করা দরকার। সব কথোপকথন রেকর্ড করলেন নিজের মোবাইল ফোনে।
“আমার দু-মিনিট আগে তুই অকুস্থলে পৌঁছেছিলি। পৌঁছে কী দেখলি আর তারপর যা যা ঘটেছে, সব কিছু খুঁটিয়ে বল।”
“ছ’টা নাগাদ তুঙ্গনাথবাবু চিৎকার করে সত্যকে ডাকছিলেন। সেই শব্দ আর দরজায় ধাক্কার আওয়াজ শুনে আমি ঘর থেকে বেরোই। তোমাকে ডেকেছিলাম, মনে আছে? তুমি তখন তৈরি হচ্ছিলে। তুঙ্গনাথবাবুর কাছে গিয়ে দেখি উনি দরজা খোলার চেষ্টা করছেন। আমি আর ঋদ্ধি প্রায় একই সময়ে ওখানে পৌঁছোই, ঋদ্ধি সামান্য একটু পরে। তার একটু পরে শিখা, তারপর তুমি। তারও বেশ কিছুক্ষণ পরে মাসিমা। ঋদ্ধি চাবি নিয়ে এসে দরজা খুলল, আমরা সবাই ঘরে ঢুকলাম। ঘরে ঢোকার পরে মাসিমা এলেন। তুমি ছুটে গিয়ে যখন পাল্স দেখছিলে আমি দেখছিলাম ঘরে সব কিছু ঠিকঠাক আছে কিনা। অস্বাভাবিক কিছু নজরে পড়েনি।”
“বিছানার পাশে জলের গ্লাস ছিল কিনা খেয়াল করেছিলি?”
রিনিতা একটু চিন্তা করে বলল, “মনে তো হয় ছিল।”
“ভরতি ছিল, না খালি?”
“অত খেয়াল করিনি।”
“বুঝেছি।”
“কী বুঝলে?”
“তোর কাছে নির্ভরযোগ্য কি পাব না।”
“তার মানে?”
“মানে গ্লাস ছিল, কিন্তু তাতে জল ছিল না।”
“আশ্চর্য! জানলে আমাকে জিজ্ঞেস করছ কেন?
“ঠিক উত্তর পেলে আরও অনেক প্রশ্ন করতাম। এখন চল, সাড়ে আটটা প্রায় বাজতে চলল। ঝড়-বৃষ্টি আরও কিছুক্ষণ চলবে। ব্রেকফাস্ট খেয়ে কাজ এগোই।”
নয়
খাবার ঘরে সবাইকেই পাওয়া গেল। শুধু সত্য নেই। উপস্থিত সবার চোখে-মুখে হালকা টেনশন।
সারারাত তাণ্ডবের পর ঝড়ের দাপট ধীরে ধীরে কমছে। একেনবাবু বসলেন তুঙ্গনাথবাবুর পাশের চেয়ারে। খেতে খেতেই সবার উদ্দেশে বললেন, “আগেই বলেছি খাওয়া-দাওয়ার পর আপনাদের কয়েকটা প্রশ্ন করব, প্রত্যেককে আলাদা করে।” তারপর তুঙ্গনাথবাবুকে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি প্রথম এলে অসুবিধা আছে, স্যার?”
“না, না, অসুবিধার কী আছে? যা দরকার তা তো করতেই হবে। তুমি কি এর মধ্যে কোনো ফাউল প্লে দেখছ?”
“জানি না স্যার, হয়তো নেই। সেটাই নিশ্চিত হতে চাই। এমনিতে আপনার ঘরে গিয়েই প্রশ্নগুলো করতাম, স্যার, কিন্তু এখন তার উপায় নেই। তাই আমার ঘরে একটু আসতে হবে।”
“বেশ।”
.
ব্রেকফাস্ট শেষ করে তুঙ্গনাথবাবুকে নিয়ে একেনবাবু নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করলেন।
“প্রথমেই ক্ষমা চেয়ে নিই স্যার, আপনি আমার চেয়ে অনেক অভিজ্ঞ। যদি মনে করেন প্রশ্নের বাইরেও আমার কিছু জানা উচিত, প্লিজ সেগুলো বলবেন… আমার প্রশ্নের অপেক্ষা করবেন না।”
“ঠিক আছে।”
“আমার প্রথম প্রশ্ন স্যার, সত্যবাবু কি রাতে আপনার ঘরে শুয়েছিলেন?”
“হ্যাঁ।”
“কেন, স্যার?”
“ও খুব দুশ্চিন্তা করছিল যদি আমার ওপর আবার মার্ডার অ্যাটেম্পট হয়! রাতে জোর করে ওর ঘরে শুতে পাঠিয়ে দিল।”
“আমি একটু কনফিউজড স্যার, তার আগে তো ঋদ্ধিবাবু একই প্রোপোজাল নিয়ে আপনার কাছে গিয়েছিলেন, আপনি রাজি হননি।”
“ঋদ্ধি আমার ছেলে হতে পারে, কিন্তু ও কুলাঙ্গার। কতরকম ঠগ-জোচ্চুরি যে করেছে! কত বার ওকে পুলিশের হাত থেকে ছাড়াতে হয়েছে বলার নয়। অনেকদিন আগেই ত্যাজ্যপুত্র করতাম, শুধু অরুন্ধতীর কথা ভেবে করিনি। ওকে আমার ঘরে রাতে থাকতে দিলে কী যে চুরি করত কে জানে! আমার জীবন নিয়ে ও চিন্তিত? আমি মরলেই তো ওর লাভ। বাড়িটা প্রোমোটারকে দিয়ে দেবে।”
“কিন্তু সত্যবাবুর সঙ্গে তো মাত্র ক’দিন আগে আপনার প্রথম দেখা হয়েছে! তাঁকে থাকতে দিলেন স্যার?”
“সত্যর মাকে চিনতাম, অনারেবল মেয়ে ছিল নুর। শুধু সামাজিক বাধার জন্য ঘরে আনতে পারিনি। তাও যোগাযোগ রেখেছিলাম কিছুদিন।”
“বুঝলাম স্যার। কিন্তু কী করে আপনি বুঝলেন সত্যবাবু আপনার সন্তান?”
“প্রায় তিরিশ বছর আগের কথা… ও যে জন্মাতে পারে সে সম্ভাবনা অবশ্যই ছিল, কিন্তু নুর কোনোদিন জানায়নি, আমিও কখনো জিজ্ঞেস করিনি। সত্য যখন জানাল ওর মায়ের নাম এবং মা আর বিয়ে করেনি, তখনই বুঝতে পারলাম। আর কী চমৎকার ছেলে!” তুঙ্গনাথবাবু মাথা নীচু করলেন।
“আমার খুব খারাপ লাগছে আপনাকে সত্যবাবু সম্পর্কে প্রশ্ন করতে। আপনি কত কষ্ট পাচ্ছেন অনুমান করতে পারছি, স্যার। আসলে…” বলতে বলতে একেনবাবু মাঝপথে থেমে গেলেন।
“যা প্রশ্ন করার করে নাও।”
“হ্যাঁ স্যার, আপনার কী মনে হয়, এটা খুন না সুইসাইড?”
“কী করে বলব বলো, কিন্তু খুন হল অথচ পাশের ঘর থেকে কোনো আওয়াজ পেলাম না… একটু অবিশ্বাস্য! আমি অবশ্য ঘুমের ওষুধ খাই, তাও।”
“আমিও তাই ভাবছি স্যার, কিন্তু সুইসাইড কি এভাবে করা যায়? মানে গলায় বেল্ট জড়িয়ে?”
“হুঁ।”
“আর বেল্টটাই-বা উনি পেলেন কোথায়?
“ঘরের আলনায় বেশ ক’টা পুরোনো বেল্ট ঝোলানো আছে। এককালে পরতাম, এখন আর পরি না। তারই একটা হয়তো নিয়েছিল।”
“যাক, এটা অন্তত জানা গেল স্যার। তবে সুইসাইড কেন করতে গেলেন, সেটাও একটা প্রশ্ন।”
“ওর নিজের পরিবারের সকলে মারা গেছে। মায়ের মৃত্যুতে মন খুব খারাপ ছিল। তা ছাড়া আমার পরিবারের সবাই ওকে হেনস্থা করছিল।”
“হুমম। ভালোকথা স্যার, কখন আপনারা ঠিক করলেন, ঘর পালটাবেন?”
“বেশ রাতে। ঝড়ের আওয়াজে ঘুম আসছিল না, সেইসঙ্গে আবার খট খট শব্দ… আগেও এরকম শুনেছি। বারান্দায় উঠে দেখার চেষ্টা করছিলাম কেউ ঢুকেছে-টুকেছে কিনা। আমার দরজা খোলার শব্দে সত্যও উঠে বারান্দায় এল। ওরও ঘুম আসছিল না। আবার খট খট আওয়াজ শুনেছি বলায় জোর করে বলল ওর ঘরে শুতে। ও আমার ঘরে শোবে। বুঝতে পারি, ওর আর কেউ নেই… ভয় পাচ্ছিল আমাকেও না হারায়! তখনই বলল ঝড় কমলেই চলে যাবে… অরুন্ধতী আর ঋদ্ধি কিছুক্ষণ আগে এসে ওকে নাকি শাসিয়ে গেছে! বললাম সেটা কখনোই ঘটতে দেব না।”
‘বুঝলাম স্যার, আরেকটা প্রশ্ন, আপনি কি রাতে জল খেয়েছিলেন?”
“না, কেন?”
“ঘরে জলের গ্লাসটা ফাঁকা ছিল বলে বলছি।”
“তাই নাকি? কল্পনা হয়তো রাতে জল দিয়ে যায়নি। সবারই হস্টাইল অ্যাটিচুড ছিল ওর ওপর।”
“আই সি।”
“এর আগে ঋদ্ধি একসময়ে অপমান করে ওকে বলেছিল সম্পত্তির লোভে
আমার ছেলে সেজে এসেছে।”
“সেটা কি গত রাতেই? যখন চলে যেতে বলেছিলেন?”
“না, তার আগে। কবে মনে নেই। সত্য সরল মনের ছেলে। জিজ্ঞেস করেছিল আমি উইলে কিছু লিখে না দিলে ও সম্পত্তি পাবে কেন! বুঝিয়েছিলাম অবৈধ সন্তান হলেও আমার সম্পত্তিতে ওর পুরো দাবি আছে। ও বলল সেসব কিচ্ছু চায় না!”
“উনি কি, স্যার, উইল নিয়ে চিন্তা করছিলেন?”
“না, তেমন কিছু না। জিজ্ঞেস করেছিল উইল লেখা খুব কঠিন কিনা। আসলে আমার কাজকর্ম সম্পর্কে জানতে চাইছিল।
“ভেরি ইন্টারেস্টিং, স্যার। আপাতত এই যথেষ্ট। অনেক ধন্যবাদ স্যার। এখন দেখি ম্যাডাম…। আর একটা কথা স্যার, আপনি ঘুমের ওষুধ খান বললেন। আপনার ওষুধ-বিষুধ কোথায় থাকে?”
“স্টিলের দেরাজে।”
“তার চাবি আপনার কাছেই থাকে?”
“হ্যাঁ, কেন বলো তো?”
“দেখলাম বন্ধ, তাই জিজ্ঞেস করলাম।”
“ওতে অনেক দরকারি কাগজ রাখি, তাই বন্ধ রাখি। চাবিও আমার সঙ্গে থাকে সব সময়ে।”
“এখনও আছে স্যার?”
তুঙ্গনাথ পকেটে হাত দিয়ে পরীক্ষা করে বললেন, “হ্যাঁ।”
“যাক স্যার। আমি ভাবছিলাম সত্যবাবুকে খুন করে কেউ কিছু চুরি করে নিয়ে গেল কিনা।”
“খুন! তুমি কি ভাবছ সত্য খুন হয়েছে?”
“না, না স্যার, তবে সব অ্যাঙ্গেল থেকেই তো ভাবতে হবে।”
“আর কিছু?”
“না, স্যার।”
তুঙ্গনাথ উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন।
“সরি স্যার, এক মিনিট। আর একটা প্রশ্ন।” একেনবাবু দাঁড়িয়ে পড়লেন। সারা মুখে অসহিষ্ণুতা, তুঙ্গনাথ থামলেন। “বলো।”
“স্যার, সত্যবাবু কি সিগারেট খেতেন?”
“সিগারেট? নাঃ, কোনোদিন তো খেতে দেখিনি। কেন?”
“না, স্যার। মানে আজকালকার ইয়ং ছেলে তো!”
একটু যেন বিরক্ত হয়েই তুঙ্গনাথ ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
.
সবাইকে নিজের ঘরে আসতে বললেও একেনবাবু নিজেই গেলেন অরুন্ধতী দেবীর কাছে। মহিলা অল্প কথা বলেন। এখন সব কিছু নিয়ে আরোই আপসেট। সত্যর ওপর খুশি ছিলেন না, দু-একটা কথাতেই স্পষ্ট হল। তবে সত্যর থেকেও রাগ তুঙ্গনাথবাবুর ওপর বেশি, এত বছর ধরে ওঁর জীবনে এই কপটতা চালিয়ে যাবার জন্য। তার থেকেও অপমানজনক সবার সামনে গলা চড়িয়ে সেসব ঘোষণা করেছেন। ডিগ্নিফায়েড মহিলা, আত্মমর্যাদায় লেগেছে।
একেনবাবুর প্রশ্নের উত্তরে স্বীকার করলেন, “হ্যাঁ, ব্যাপারটা নিয়ে আমি খুব বিরক্ত। কিন্তু সেজন্য ছেলেটা যে সুইসাইড করবে ভাবিনি।”
“সুইসাইড ভাবছেন কেন ম্যাডাম?”
“তা না হলে কী?” অরুন্ধতী দেবীর দৃষ্টিতে শঙ্কা
“সেটা পুলিশ তদন্ত করে বের করবে ম্যাডাম। …একটা প্রশ্ন, কাল কি সত্যবাবুর ঘরে গিয়েছিলেন?”
“হ্যাঁ।”
“কখন ম্যাডাম?”
“ঘড়ি ধরে বলতে পারব না। এই সাড়ে আটটা-ন’টা নাগাদ।”
“কেন ম্যাডাম?”
“ওর আসাতে কী হচ্ছিল দেখেছ তো! বেশ কড়া করেই বলেছিলাম যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চলে যেতে। সংসারে আর অশান্তি বাড়াতে আমি দেব না।”
“সত্যবাবুর বডি পাওয়া গেল তুঙ্গনাথবাবুর ঘরে, সেটা কেন জানেন ম্যাডাম?”
“ওরা ঘর বদলাবদলি করেছিল, আজ সকালে এসে কথাটা বলল।” “তুঙ্গনাথবাবু?”
“হ্যাঁ।”
“ম্যাডাম, আমিও দেখলাম ওঁকে আপনার কাছে যেতে। আর কিছু বললেন?”
“নানান কথা, ঠিক তোমাকে শোনাবার মতো নয়। তবে ঋদ্ধিকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করছিল। ছেলেটার সুইসাইড করার পেছনে ঋদ্ধি কোনোমতে জড়িয়ে আছে কিনা…
“সেটা কেন বললেন?”
“বুঝলাম না। জিজ্ঞাসাও করিনি। ওর সঙ্গে আমার সদ্ভাব নেই- এর মধ্যে লুকোচুরির কিছু নেই। তবে ঋদ্ধিকে নিয়ে আমাদের সবারই চিন্তা।”
“থ্যাংক ইউ, ম্যাডাম,” নমস্কার করে একেনবাবু বেরিয়ে এলেন।
.
এরপর ডাক পড়ল শিখার।
“বলুন কী জানতে চান, কানুদা।”
“প্রশ্ন করতে খুব খারাপ লাগছে শিখা, দেখো তো কী মুশকিল হল!”
“তা আর কী করা, কানুদা। আমার ভালো লাগছে আপনার পরিচয় পেয়ে এখানকার পুলিশের খপ্পরে পড়লে আমার হয়তো আর কাজেই ফিরে যাওয়া হবে না।”
“আরে না, তা কেন। ভয় তো শুধু যদি কোনো ক্রাইম হয়ে থাকে, তাই না? আচ্ছা, তুমি সত্যবাবুকে শেষ কখন দেখেছিলে?”
“ডিনার টেবিলে বাবা যখন হঠাৎ বলে উঠল, ‘সত্য আমার ছেলে।” মনে হল মা জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যাবে। তারপর থেকে মায়ের কাছেই ছিলাম, ওঁর দিকেই চোখ রাখছিলাম। আপনারা অতিথি, আপনাদেরও খোঁজ করিনি!”
“তাতে কী হয়েছে? আমরা একদম ঠিক আছি। আচ্ছা, কাল রাতে কোথায় শুয়েছিলে?”
“নিজের ঘরেই।”
“মা”র ঘর থেকে কখন গেলে?”
“একটু দেরি করেই প্রায় দশটা নাগাদ।”
“তোমার মা কি সারাক্ষণ ঘরেই ছিলেন?”
“না, কয়েক মিনিটের জন্য সত্যর ঘরে গিয়েছিলেন এ বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলতে।”
“নিজের থেকেই?”
“ঠিক তা না,” শিখা একটু ইতস্তত করল। “দাদা পাগলামি করছিল। মাকে বলছিল বাড়ি থেকে না গেলে সত্যকে খুন করবে। আমি জানি এগুলো মুখের কথা, কিন্তু মা একটু ঘাবড়ে গিয়েই সত্যকে চলে যেতে বলতে গিয়েছিলেন।”
“ঋদ্ধিবাবুর এত রাগের কারণ কী?”
“আপনাকে বলতে খারাপ লাগছে, দাদা একেবারে উলটে পালটে ঠাকুরদার স্বভাব পেয়েছে। উচ্ছৃঙ্খল, কোনো রোজগার না করে বাবার টাকার ওপর বসে জীবন কাটাতে চায়। তাই বাড়িটা বিক্রি করতে উৎসুক। ওর ধারণা— সত্য ওর টাকায় ভাগ বসাতে এসেছিল!”
“তোমার তাতে কোনো সমস্যা নেই?”
“আমি নির্লোভ নই। বাইরের কেউ এসে ঠকিয়ে আমাদের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করবে তা মানব না। তবে তা নিয়ে সারাক্ষণ ভাবিও না। বাবার সঙ্গে আমার মনের মিল কোনোদিন হয়নি। এমনকী মায়ের সঙ্গেও আমার মানসিক বন্ধন তেমন শক্ত নয়। কিন্তু সবার সামনে মায়ের সম্মতি না নিয়ে হঠাৎ ওইভাবে সত্যকে সস্তানের স্বীকৃতি দেওয়া আমার অসহ্য লেগেছে।
“সত্যবাবু কি সম্পত্তির লোভে এখানে এসেছিলেন বলে তোমার মনে হয়েছিল?”
“জানি না। তবে বাবার সঙ্গে সত্যর এই দহরম-মহরম বিরক্তিকর।
“কী মনে হয়, সত্যবাবুর মৃত্যু কি আত্মহত্যা?”
“আমার কোনো ধারণাই নেই… তবে আত্মহত্যাই মনে হয়।”
“কেন বলো তো?”
শিখা ভেবে-চিন্তে সংযত উত্তর দিল। “যে রাতে সত্য এসেছিল, সেই রাতেই বাবার ঘরে কেউ ঢুকেছিল— নিশ্চয়ই কাগজপত্র দেখতে বা সরাতে। আমার ধারণা, সেই জন্যেই ও এসেছিল। বাবা জেগে যাওয়াতে ভয় পেয়ে গলায়…” কথাটা শেষ না করে বলল, “পরে প্রচণ্ড আত্মগ্লানিতে আত্মহত্যা করেছে। তা ছাড়া ও যে সত্যি বাবার ছেলে তাই-বা নিশ্চিত হব কেমন করে! আমার মনে হয় লোকটা ফ্রড।
একেনবাবু বিচক্ষণ ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন। “হ্যাঁ, তা তো হতেই পারে। ঠিক আছে— আমার আর কিছু জানার নেই। না, না আছে, তোমার বাবা কি ঘুমের ওষুধ খেতেন?”
“হ্যাঁ, নিয়মিত। গোপাল তো নিয়েও এল সেদিন – যেদিন খন্যান স্টেশনে কী একটা কাজে গিয়েছিল। বাবার থিয়োরি, ওখানেই নাকি ভালো ওষুধ পাওয়া যায়, এখানকার দোকানের ওষুধে ভেজাল।”
বাকি রইল ঋদ্ধি। ঘরে ঢুকেই একেনবাবুকে চার্জ করল, “আমাকে একবারে শেষে ডাকলেন কেন?
“একজনকে তো স্যার শেষে ডাকতেই হবে।”
“আবার ‘স্যার’ বলছেন কেন? স্যার তো আপনি।”
‘কী যে বলেন, স্যার! হ্যাঁ, যে কথা নিয়ে আলোচনা করতে ডেকেছি… আপনি সত্যবাবুকে শেষ কখন দেখেছিলেন?”
“কাল রাতে।”
“কখন?”
“এই ন’টার পরে।”
“কেন স্যার?”
“মা কিছু বলেননি আপনাকে?”
“আপনার মুখ থেকে শুনতে চাই।”
“আসলে আমাদের মধ্যে হঠাৎ এসে অশান্তি সৃষ্টি করায় মা সত্যর ওপর খুব রেগে গিয়েছিল। ওকে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলতে মা ওর ঘরে গিয়েছিল। আমি মায়ের পেছন পেছন গিয়েছিলাম। প্রথমে মা কথা বলল, তারপর আমি ঘরে ঢুকেছিলাম।”
“দাঁড়ান স্যার, দাঁড়ান, আপনি রাগ করেননি?”
“নিশ্চয় করেছিলাম, নইলে গেলাম কেন?”
“আপনার রাগের কারণটা কী?”
“ও বাবাকে ঠকিয়ে সম্পত্তি বাগাবার চেষ্টা করছিল। কোত্থেকে না কোত্থেকে এসে বাবাকে দিয়ে বলাল ও বাবার ছেলে? এটা হিপ্নোটিজম!”
“বুঝলাম। সত্যবাবু না থাকায় এখন তো সম্পত্তি ভাগ হওয়ার দরকার নেই।”
“আপনি কী ইমপ্লাই করছেন?” ঋদ্ধির গলায় ভয় আর রাগ।
“কথাটা ঠিক না?”
“সেটা অস্বীকার করছি না, কিন্তু তার জন্য আমি দায়ী নই।”
“সেটা তো পুলিশ এসে বিচার করবে।”
এটা শুনে একমুহূর্ত চুপ করে থেকে ঋদ্ধি ভেঙে পড়ল, “বিশ্বাস করুন স্যার, আমি সত্যিই কিছু জানি না। আমি ফিরে এসে মা আর শিখার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলে শুতে চলে যাই। শিখা সাক্ষী দেবে। আমি জানতামও না সত্য যে বাবার ঘরে শুয়েছে।”
“আপনি কি সত্যবাবুকে খুন করবেন বলে শাসিয়েছিলেন?”
“না।”
“না? একটু ভেবে বলুন।”
“না… মানে হ্যাঁ… কিন্তু… কিন্তু সেটা রাগ করে মাকে বলেছিলাম… এরকম আমি অনেক সময়েই বলি, ওগুলো কথার কথা। আপনাকে এটা বিশ্বাস করতেই হবে কানুবাবু, প্লিজ!”
“আপনারও কি মনে হয় সত্যবাবু আত্মহত্যা করেছেন?”
“অবশ্যই। বাবাকে খুন করতে গিয়েছিল, আর দু-এক দিনে ধরা পড়ে যেত। সেই কেলেঙ্কারির ভয়ে।”
দশ
দুটো নাগাদ পুলিশ এল। দেখে-শুনে ডেডবডি নিয়ে গেল। একেনবাবু ওসি রমেন গুপ্তকে বললেন, “খন্যানের ডিএইচএল অফিসে খোঁজ নিয়ে দেখো তো একবার সত্যবাবু একটা চিঠি ক্যুরিয়ার করিয়েছিলেন, সেটা কার কাছে, কোথায় পাঠিয়েছিলেন। জেনেই আমাকে কলকাতায় ফোন করবে। ঘরের দেরাজটা খুলে কাগজপত্র কিছু ওলটপালট হয়েছে কিনা ভালো করে দেখবে। তুঙ্গনাথবাবুর ওষুধপত্রগুলো ওখানেই থাকে, তারও একটা ইনভেন্টরি নেবে। চাবি ওঁর পকেটেই থাকে। ফিঙ্গারপ্রিন্টও দেখো। সেটাও জানাবে।”
“আপনি জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন স্যার?”
“যতটুকু জানার জেনেছি, তবে কিছু ফলো-আপ করা দরকার। কাজের লোকদের প্রশ্ন করার সময় পাইনি, তাদেরও জিজ্ঞাসাবাদ কোরো। ইন্টারভিউগুলো এসএমএস করে দিচ্ছি তোমাকে। পোস্ট-মর্টেম করতে কত সময় লাগে এখানে?”
“দিন সাতেক লেগে যাবে, স্যার। তবে তার আগে করাতে চেষ্টা করব।”
“বাড়ির সবাই সাসপেক্ট লিস্ট-এ, এঁদের কোথাও যেতে দিও না কিছুদিন। আমার বোনকে নিয়ে যাচ্ছি, অনলাইনে অনেক কাজ করতে হবে ওকে। চিন্তা কোরো না, আমি চোখে চোখে রাখব।”
কথাটা শুনে ওসি হেসে ফেললেন।
“আপনি কি আজকেই ফিরছেন স্যার?”
“হ্যাঁ, এক্ষুনি গাড়ি আসছে। আমারই এক কলিগ গাড়ির বন্দোবস্ত করে দিয়েছে।”
“আমরাও করে দিতে পারতাম, তাহলে আরও ক’টা দিন কাটিয়ে যেতে পারতেন। খন্যানের মিষ্টি খুব বিখ্যাত, শক্তিগড়ের ল্যাংচা আর বর্ধমানের সীতাভোগ- মিহিদানার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে।”
“আরে ভাই, আবার আসব। বোনের বন্ধুর রাজবাড়ি তো এখানেই।”
.
ভাগ্যিস শিখা ঠিকই করেছিল মায়ের সঙ্গে কয়েকটা দিন থাকবে, সুতরাং ওকে ফেলে যেতে রিনিতার কষ্ট হল না।
“তাড়াতাড়ি চলে আসিস, একসঙ্গে ব্যাঙ্গালোরে ফিরব।” দুই বন্ধু কিছুক্ষণ দু-জনে দু-জনকে জড়িয়ে রইল।
.
গাড়িতে এ নিয়ে কথা হল না। একেনবাবু কিছুটা পথ ঘুমোলেন, বাকিটা বোনের সঙ্গে নানান গল্প করতে করতে ফিরলেন।
কলকাতায় এসে পিসির বাড়িতে বিকেলের খাবার জাঁকিয়ে খেতে বসার আগে একেনবউদিকে ফোন করলেন। হোম ফ্রন্টে সব কিছু ঠিকঠাক। তেমন বিধ্বংসী ঝড় কলকাতায় হয়নি। একেনবাবু জানিয়ে দিলেন ডিনার খেয়ে বাড়ি ফিরবেন। তারপর রিনিতার সঙ্গে কেসটা নিয়ে আলোচনা শুরু করলেন।
“কী বুঝলে কানুদা, খুন না আত্মহত্যা।”
“তোর কী মনে হয়?”
“খুন, ওইভাবে কেউ আত্মহত্যা করে?”
“ইংরেজি ডিটেকটিভ বই একটু-আধটু পড়িস, এইভাবে আত্মহত্যার উদাহরণ পেয়ে যাবি। ক’বছর আগে অভিনেতা রবিন উইলিয়ামস তো অমনি করেই গলায় দড়ি দিয়েছিল।”
“তার মানে আত্মহত্যা?”
“তা তো বলিনি।”
“আমার মনে হচ্ছে খুনই। কিন্তু কে খুন করেছে?”
“তুই-ই ভাব, কে লাভবান হতে পারে?”
“ঋদ্ধি?”
“কেন তোর বন্ধু হতে পারে না?”
“সম্পত্তির জন্য শিখা তেমন কেয়ার করে না।”
“আমার কিন্তু সেটা মনে হয়নি।”
“শিখা একা একা মোটেই খুন করতে পারত না, ওর গায়ের জোরে কুলোবে না!”
“দু-জনে মিলে তো করতে পারে— ভাই-বোন দু-জনে? বা মা-মেয়ে? বা মা-মেয়ে-ছেলে?”
“তাহলে বলছ মাসিমাও জড়িত থাকতে পারেন?”
“তাও পারেন, ঠেকাচ্ছে কে?”
“তুমি যত অ্যাবসার্ড কথা বলো!” রিনিতা অধৈর্য হয়ে উঠল।
“শোন, সত্যবাবুর বদলে যদি তুঙ্গনাথবাবু ওইভাবে মারা যেতেন, তাহলে কাকে সন্দেহ করতিস?”
“সত্য আর ঋদ্ধিকে। তুমি তো বলেছ সত্যও সম্পত্তির ভাগ পেতেন।“
“তা ঠিক, কিন্তু সত্যবাবুকে প্রমাণ করতে হত যে তিনি তুঙ্গনাথবাবুর পুত্র।”
“তাহলে তো শুধু ঋদ্ধি!”
“সেটা হওয়া কি অসম্ভব? ছেলে সম্পত্তির লোভে বাবাকে হত্যা করেছে — গাদা গাদা উদাহরণ আছে। বিশেষ করে ঋদ্ধি যখন জানত না তুঙ্গনাথবাবু ঘর পালটেছেন। হয়তো রাতের অন্ধকারে তুঙ্গনাথ ভেবে সত্যবাবুর গলায় বেল্ট লাগিয়ে হত্যা করেছে! ভুলটা ভাঙল সকালে তুঙ্গনাথ চেঁচামেচি করায়।”
“উফ, এত অদ্ভুত তোমার চিন্তাধারা!” রিনিতা অস্থির হয়ে বলল। ওর মনে আরেকটা সম্ভাবনা উঁকি দিল।
“আচ্ছা কানুদা বলো তো, তুঙ্গনাথবাবু তো ছুঁদে উকিল ছিলেন। উনি নিশ্চয় জানতেন বাবার সম্পত্তিতে অবৈধ সন্তানের অধিকার আছে, তাহলে ছেলের সম্পত্তিতে অবৈধ বাবার অধিকার থাকবে না কেন?”
“এটা দারুণ বলেছিস! এই তো বুদ্ধি খুলছে!” একেনবাবু বোনের পিঠ চাপড়ে দিলেন। “এমন কোনো আইন আছে কিনা জানি না, কিন্তু কোর্টে যুক্তিটা দাঁড়িয়ে যেতে পারে। প্রশ্ন হচ্ছে, এরকম চান্স উনি নেবেন কি? যে চিঠিটা সত্যবাবু ক্যুরিয়ার করেছিলেন, সেটার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। দেখা যাক!”
কথাগুলো বলে রিনিতার কানুদা, আমাদের একেনবাবু বাড়ি চলে গেলেন।
সারারাত রিনিতার ঘুম হল না। কাজের চিন্তা, শিখার চিন্তা, খুনির চিন্তা। ভোর না হতেই কানুদাকে ফোন করল।
একেনবাবু ঘুম থেকে উঠে সদ্য চায়ের কাপে চুমুক দিয়েছেন। রিনিতার ফোন পেয়ে বললেন, “এত সকালে উঠেছিস কেন? আমার না হয় এখনও জেট ল্যাগ চলছে।”
“ঘুম হয়নি কানুদা, আত্মহত্যা না হলে সত্যকে খুন করল কে? কেন?”
“ওঃ বুঝেছি, নেশা লেগেছে। শোন, এক্ষুনি খন্যানের ওসি রমেনের মেসেজ পেলাম। তোকে বললাম না, সত্যের পাঠানো ওই চিঠিটাই হল গিঁঠ খোলার চাবি!”
রিনিতা বুঝল কানুদা উপমা গুলিয়েছে। যাক গে!
“বলো না কী হয়েছে!”
“ট্রেস করা গেছে চিঠিটা পাঠানো হয়েছিল রামপুরহাটের এক উকিল, মহম্মদ করিমের কাছে। ভদ্রলোক সত্যের মায়ের হয়ে আইনি কেস-টেস দেখতেন। ঝড়ের জন্যে চিঠিটা ক্যুরিয়ারের কাছে আটকে আছে, আজকালের মধ্যেই জায়গামতো পৌঁছোবে। তখন সব কিছু ক্লিয়ার হবে। পোড়া কাগজের ব্যাপারটাও বোঝা যাবে।”
“কী যে উলটোপালটা বলো কানুদা। পোড়া কাগজ আবার এল কোত্থেকে? সেটা সম্বন্ধে তো কিছু জানি না!”
একেনবাবু গুনগুন করে কবিতা আবৃত্তি আরম্ভ করলেন, “বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি’— দেশে দেশে কত শত খুন-রাহাজানি…”
“ধ্যাত, কানুদা এত হেঁয়ালি করো না!” রিনিতা ফোন রেখে দিল।
.
ঠিক তিন দিন পরে কানুদার ফোন, “এই যে মিস রিনিতা, কী হল শুনবেন?”
এ ক’দিন ঠান্ডা মাথায় রিনিতা কোনো কাজ করতে পারেনি। একেনবাবুর গলা শুনে উদগ্রীব হয়ে উঠল।
“বলো, বলো, কী হল বলো!”
“মহম্মদ করিমের কাছে পুলিশ পেয়েছে।”
“কী পেয়েছে, কানুদা!”
“সত্যবাবুর ক্যুরিয়ার করা চিঠি। সেটা কী জানিস— ওঁর উইলের খসড়া। নিজের মৃত্যুতে সব সম্পত্তির মালিকানা দিয়ে গেছে বাবাকে, মানে তুঙ্গনাথবাবুকে।”
“কী বলছ কানুদা! তাহলে কি সত্য আত্মহত্যাই করেছে? আর… উইলটা বৈধ?”
“পুলিশ সেটা করিম উকিলকে জিজ্ঞেস করেছে। উত্তর হল, হ্যাঁ, অবশ্যই। খসড়াটা পাকা আইনি বয়ান — অবশ্যই কোনো উকিলের খসড়া করা। জাফরউল্লা সত্যকামের হাতে লেখা। সঙ্গে চিঠিতে ওঁর প্রতি নির্দেশ দেওয়া আছে যা যা প্রয়োজন তা করে এই ইচ্ছাপত্র যেন রেজিস্ট্রি করা হয়।”
“তার মানে কি তুঙ্গনাথবাবু খুন করেছেন? সত্যর সম্পত্তির জন্য? সত্যর কি টাকাপয়সা আদৌ আছে?”
“বাঃ, এইটে ধরতে পেরেছিস। আসলে মায়ের দিক থেকে অজস্র সম্পত্তির মালিক সত্যবাবু। সেই টাকায় রাজবাড়ি সংরক্ষণ করে, সাজিয়েও পরম ঐশ্বর্যের মধ্যে বাকি জীবনটা কাটাতে পারবেন তুঙ্গনাথবাবু। লোভনীয় ব্যাপার! “
“একটা কমবয়সি ছেলেকে মারার মতো ওঁর শক্তি ছিল?”
“পোস্ট-মর্টেমে সত্যবাবুর শরীরে হেভি ডোজে মরফিন জাতীয় ঘুমের ওষুধ পাওয়া গেছে। সেটাও তুঙ্গনাথবাবুর কীর্তি নিশ্চয়ই। একটা ইয়ং ছেলেকে গলায় বেল্ট বেঁধে মারা সহজ নয়। অচেতন করে দিয়ে করতে হয়েছে।”
“আমি ভাবতে পারছি না। …তোমার সন্দেহ হল কেমন করে?”
“একটা ছেলে এসে বলল আমি তোমার সন্তান, আর তুঙ্গনাথবাবু মেনে নিলেন? উনি দুদে উকিল, এত কাঁচা কাজ করবেন না। তখনই কেমন শুঁড়গুলো খাড়া হয়ে উঠেছিল। উনি জানতেন সত্যের মায়ের বাড়ি ধনী। তারপর সত্যের কাছ থেকেও নিশ্চয়ই বিশদ জেনেছিলেন। তখনই সত্যের মৃত্যুর ছক কাটা হয়েছিল।”
“কিন্তু কানুদা, একজন কমবয়সি ছেলে, বাবার সঙ্গে এই প্রথম দেখা হচ্ছে। তাও এমন অদ্ভুত পরিস্থিতিতে। এত অল্প সময়ে নিজের সম্পত্তির ওয়ারিশ করে ফেলল একজন আধ-চেনা মানুষকে? কেমন যেন বিশ্বাস হচ্ছে না।”
“ওদের নিজেদের মধ্যে কী কথা হয়েছিল আমরা জানি না। তুঙ্গনাথ ধুরন্ধর ব্যক্তি। হয়তো ছেলেকে বোঝাতে পেরেছিলেন—ও যখন এত সম্পত্তির মালিক, ওর একটা উইল থাকা দরকার। হয়তো ছেলেকে বলেছিলেন তোমাকে আমার সম্পত্তি লিখে দিচ্ছি। আর ছেলেও পালটে বলল তাহলে আমিও ইচ্ছাপত্র লিখব। ছেলেটার তো আর কেউ ছিল না সদ্য আবিষ্কৃত বাবা ছাড়া! হয়তো ছেলেকে বুঝিয়েওছিলেন পরে বিয়ে-টিয়ে করার পর উইলটা বাতিল করতে। সেক্ষেত্রে নিজের স্ত্রী-ছেলেমেয়েদের কাছে সম্পত্তি যাবে। সবই অনুমান।”
“কিন্তু কানুদা, তার কয়েক দিন আগেই তো তুঙ্গনাথবাবুর ওপর আক্রমণ হয়েছিল। সেটা কি কাকতালীয়?”
“না রে। সেটা তুঙ্গনাথবাবুর কীর্তি। গভীর জলের মাছ! পরে কী হবে চিন্তা করে নিজেকে সন্দেহের তালিকা থেকে সরাবার বন্দোবস্ত করেছিলেন। বাইরের কেউ যে ঢোকেনি তা ওখানে গিয়েই বুঝতে পেরেছিলাম। মশারির দড়ি দিয়ে কেউ খুন করে না।”
রিনিতা দাঁতে ঠোঁট চেপে ধরল। “সত্যি, শিখার জন্যে বড্ড খারাপ লাগছে। কী হল বলো তো! …আচ্ছা, ওই কাগজ পোড়া নিয়ে তুমি অত উত্তেজিত হয়েছিলে কেন?”
“ক্লু… ক্লু… বুঝলি! উকিলবাবুর কাছ থেকে জানা গেল উইলের যে খসড়া সত্যবাবু ওঁকে পাঠিয়েছেন তাতে কোনো ফাঁকফোকর নেই। একেবারে পাকা উকিলের মকশো করা। শুধু রেজিস্ট্রি করার ওয়াস্তা। অমন উইল লেখা সত্যবাবুর ক্ষমতার বাইরে। বোঝা যায় তুঙ্গনাথবাবু মুসাবিদা করে দিয়েছিলেন। সত্যবাবু সেটা নিজের হাতে লিখে উকিলকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। আমার ধারণা নিজের লেখা সেই কাগজটাই তুঙ্গনাথবাবু পুড়িয়ে ফেলেছিলেন। সেই পোড়া কাগজের ছাই সত্যবাবুর ঘরে দেখেছি।”
“কিন্তু সেটাই যথেষ্ট?”
“শুধু তা কেন, আরও আছে। সত্যবাবুর স্টমাকে যে স্লিপিং ট্যাবলেটের ট্রেস পাওয়া গেছে, সেটা তুঙ্গনাথের ওষুধ। গোপালকে দিয়ে ক’দিন আগে তুঙ্গনাথবাবু তিরিশটা ট্যাবলেট আনিয়েছিলেন। ওসি রমেন বলল মাত্র পনেরোটা দেরাজে পাওয়া গেছে। অতগুলো তো আর তুঙ্গনাথবাবু দু-তিন দিনে খেতে পারেন না! ওষুধের শিশি বা দেরাজে সত্যবাবুর কোনো ফিঙ্গারপ্রিন্ট নেই। …আসলে এই ঘুমের ওষুধ নিয়ে আমার একটা সন্দেহ ছিল, যার জন্য আমি রমেনকে স্টিল-এর দেরাজটা ভালো করে পরীক্ষা করতে বলেছিলাম।”
“কী নিয়ে সন্দেহ?”
“আমি যখন তুঙ্গনাথবাবুকে প্রশ্ন করেছিলাম, ‘আপনি কি রাতে জল খেয়েছিলেন?” তুঙ্গনাথবাবুর উত্তর, ‘না, কেন?” বললাম, ‘ঘরে জলের গ্লাসটা ফাঁকা ছিল বলে বলছি।” ‘তাই নাকি? কল্পনা হয়তো রাতে জল দিয়ে যায়নি। সবারই হস্টাইল অ্যাটিচুড ছিল সত্যর ওপর।” অথচ ভেবে দেখ, ঘরটা ছিল তুঙ্গনাথবাবুর। সুতরাং সেখানে জল না দেবার কোনো প্রশ্নই নেই। উনি শুধু ঘুমের ওষুধ জলে মেশাননি, কিছু একটা বুঝিয়ে সত্যবাবুকে সেটা খাইয়েও ছিলেন যাতে পরে গলায় বেল্ট জড়িয়ে মারতে পারেন। ফাঁস দিয়ে মৃত্যু বেশিরভাগ সময় আত্মহত্যা বলে চালানো যায়। এই তথ্যগুলোই ঠিকমতো সাজালে তুঙ্গনাথবাবুকে দোষী প্রমাণ করা কষ্টকর হবে না। তবে পুলিশ আরও ডিপ ইনভেস্টিগেশন চালাচ্ছে। আমার দায়িত্ব ছিল একটু গাইডেন্স দেওয়া। তা শেষ, আই অ্যাম ডান।”
“বড়ো মনখারাপ লাগছে, কানুদা। … তুঙ্গনাথবাবু এখন কোথায়?”
“একটু আগে পুলিশ গ্রেফতার করেছে।”
“ইসস, আর শিখা? দেখি, ওকে একটা ফোন করি।”
