আজব বলের রহস্য (কিশোর কর্নেল) – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ

শেয়ার করুনঃ

এক

“এক কিলো তুলো ভারী, না এক কিলো লোহা ভারী?” ষষ্ঠীচরণ ট্রে-তে কফি আর স্ন্যাক্স রেখে চলে যাচ্ছিল। এই বেমক্কা প্রশ্নে হকচকিয়ে ঘুরে দাঁড়াল এবং ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বলল, “আজ্ঞে বাবামশাই?”

 

তার বাবামশাই’ মানে, আমার বৃদ্ধ বন্ধু কর্নেল নীলাদ্রি সরকার চোখ কটমটিয়ে বললেন, “এক কিলো তুলো আর এক কিলো লোহার মধ্যে কোনটা বেশি ভারী?”

 

ষষ্ঠী ফিক করে হেসে বলল, “নোহা।” সে সবসময় ‘ল’-কে নি’ এবং ‘ন’-কে ‘ল’ করে ফেলে।

 

আমি হোহো করে হেসে ফেললুম। ষষ্ঠী গাল চুলকোতে-চুলকোতে সম্ভবত ভুলটা খোঁজার চেষ্টা করছিল। কিন্তু আমাকে অবাক করে কর্নেল বললেন, “ঠিক বলেছিস। বকশিস পাবি।”

 

ষষ্ঠী খুশি হয়ে চলে গেল। কর্নেল পেয়ালায় কফি ঢালতে থাকলেন। মুখে সিরিয়াস ভাবভঙ্গি। আমি একটু ধাঁধায় পড়ে গেলুম। কর্নেল আমার হাতে কফির পেয়ালা তুলে দিয়ে বলল, “ষষ্ঠী কিন্তু ঠিক বলেনি।”

 

“বলেছে।”কর্নেল কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন, “তুমি কী বলতে চাইছ জানি, জয়ন্ত। এ-ধরনের প্রশ্নকে আগের দিনে বলা হত ‘জামাই-ঠকানো প্রশ্ন’! এক কিলো তুলো আর এক কিলো লোহা। দুটোরই ওজন যখন এক, তখন একটা আর-একটার চেয়ে ভারী হতে পারে না। ঠিক কথা। কিন্তু সত্যিই তুলোর চেয়ে লোহা অনেক ভারী জিনিস। আয়তন ডার্লিং, আয়তন! তুমি আয়তনের কথাটা ভুলে যাচ্ছ। আমরা যখন কোনো বস্তুকে দেখি, আগে সেটার আয়তনই চোখে পড়ে। এক কিলো তুলোর যা আয়তন, তা যদি লোহার হয়, তা হলে লোহাটাই বেশি ভারী নয় কি?”

 

বিরক্ত হয়ে বললুম, “কিন্তু ভারী বলতে তো ওজনই বোঝায়।”

 

কর্নেল মিটিমিটি হেসে বললেন, “। তবে ভুলে যাচ্ছ, আমরা আয়তন বাদ দিয়ে কোনো বস্তুকেই কল্পনা করতে পারি না। একটু তলিয়ে ভাবা দরকার জয়ন্ত! বস্তুর যেমন ওজন আছে, তেমনই আয়তনও আছে।”

 

“আপনার যুক্তির মাথামুণ্ডু নেই। আমি দুঃখিত।”

 

কর্নেল আমার কথায় কান না দিয়ে বললেন, “আচ্ছা জয়ন্ত, সমান আয়তনের কোনো ধাতু, ধরো, একটা ক্রিকেটবলের সাইজ লোহা, সোনা আর সিসের মধ্যে কোনটা বেশি ভারী?”

 

একটু ভেবে বললুম, “সম্ভবত সোনা।”

 

“হুঁ, সোনা। আমরা সচরাচর যেসব জিনিস হাতে নাড়াঘাটা করে থাকি বা মোটামুটিভাবে হাতের কাছে পাই, তাদের মধ্যে সোনা সবচেয়ে ভারী এবং সেটা আয়তনের দিক থেকে।” বলে কর্নেল হেলান দিলেন এবং চোখ বন্ধ। সাদা দাড়ি এবং চওড়া টাকে বাঁ হাতটা পর্যায়ক্রমে বুলোতে থাকলেন। এটা ওঁর চিন্তাভাবনার লক্ষণ।

 

বললুম, “ব্যাপারটা কী? আজ সকালবেলায় হঠাৎ এসব নিয়ে মাথাব্যথার কারণ কী বুঝতে পারছি না।”

 

কর্নেল একই অবস্থায় থেকে বললেন, “ওই শোনো ডার্লিং! দোতলায় লিন্ডার প্রিয় কুকুর রেক্সি চেঁচামেচি জুড়েছে। সিঁড়িতে ধুপধুপ ভারী পায়ের শব্দ। এবার কলিং বেল বাজাটা অনিবার্য।” বলে হাঁকলেন, “ষষ্ঠী!” এবং চোখ খুলে সিধে হয়ে বসলেন।

 

সত্যিই কলিং বেল বাজল। ষষ্ঠীর দরজা খোলার শব্দ শোনা গেল। তারপর কর্নেলের এই জাদুঘরসদৃশ ড্রয়িংরুমে দু’টি মূর্তির আবির্ভাব ঘটল। আমি হাঁ করে তাকিয়ে রইলুম।

 

একজন মাঝারি গড়নের ছিমছাম চেহারার প্রৌঢ় ভদ্রলোক। পরনে ধুতি ও সিল্কের পাঞ্জাবি। অন্যজন একেবারে দানো বললেই চলে। পেল্লায় গড়নের পালোয়ান। পরনে হাফপেন্টুল ও স্পোর্টিং গেঞ্জি। মাথার চুল ছোট করে ছাঁটা। গলায় চাঁদির তক্তি। তার মাথায় একটা ছোট্ট চটের থলে, যে-ধরনের থলেতে বাজার করা হয়। থলের মুখটা দড়ি দিয়ে আঁটো করে বাঁধা আছে। পালোয়ান লোকটি দু’টি পেশিবহুল হাতে থলেটি ধরে আছে এবং এই মোলায়েম এপ্রিলে সে দরদর করে ঘামছে, টলছে এবং হাঁফাচ্ছে। ফেস-ফোঁস শব্দ ছাড়ছে নাক-মুখ থেকে।

 

ভেবেই পেলুম না একটা তোবড়ানো থলের ভেতর কী ওজনদার জিনিস আছে যে এমন পেল্লায় গড়নের মানুষকে কাহিল হতে হয়েছে।

 

প্রৌঢ় ভদ্রলোক বললেন, “কী রে ভোঁদা? দাঁড়িয়ে থাকবি, না নামাবি?”

 

পালোয়ান হাঁসফাঁস শব্দে বলল, “ধরতে হবে।”

 

কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “জয়ন্ত! এসো, আমরা ওকে একটু সাহায্য করি। ভবেশবাবু, মনে হচ্ছে আপনাকেও হাত লাগাতে হবে। ষষ্ঠী! তুইও আয়।”

 

ষষ্ঠী দরজার পরদায় উঁকি মেরে পিটপিটে চোখে ব্যাপারটা দেখছিল। এগিয়ে এল। তারপর আমরা সবাই মিলে পালোয়ানের মাথা থেকে চটের থলেটি নামিয়ে টেবিলে রাখলুম।

 

বলছি বটে নামিয়ে রাখলুম, যেন আস্ত একটা পাহাড়কে কাত করে ফেললুম। থলের ভেতরে কী আছে কে জানে, মনে হল, অন্তত পাঁচ কুইন্টালের কম নয় সেটির ওজন। টেবিলটা যে মড়মড় করে ভেঙে গেল না, এটাই আশ্চর্য! তবে টেবিলে রাখার সময় বাড়িটাই যেন ভূমিকম্পে নড়ে উঠল। অবশ্য মনের ভুল হতেও পারে।

 

কর্নেল থলে খুলতে ব্যস্ত হলেন। পালোয়ান মেঝের কার্পেটে বসে হুমহাম শব্দে বলল, “ফ্যান! ফ্যান! জল!”

 

ষষ্ঠী ফ্যানের স্পিড বাড়িয়ে দিল। তারপর জল আনতে দৌড়ল। ততক্ষণে কর্নেল দড়ি খুলে থলেটা ফাঁক করেছেন। দেখলুম, থলের ভেতর ক্রিকেটবলের সাইজের কালো একটা জিনিস। অবাক হয়ে বললুম, “এই জিনিসটা এত ভারী? কী এটা?”

 

ভবেশবাবু সোফায় বসে বললেন, “সেটাই তো রহস্য মশাই! তবে তার চেয়ে বেশি রহস্য, আমার বাথরুমে জিনিসটার আবির্ভাব।”

 

যে-টেবিলে আজব বলটি রাখা হয়েছে, সেটি কর্নেলের রিসার্চ-ক্ষেত্র বললে ভুল হয় না। টেবিলটি এতদিন ধরে দেখে আসছি। কিন্তু সেটি যে এমন শক্তিশালী তা এই প্রথম জানতে পারলুম। অমন ওজনদার জিনিসের চাপে একটুও মচকাল না। কর্নেল ড্রয়ার থেকে আতসকাঁচ বের বের করে ততক্ষণে খুঁটিয়ে পরীক্ষা শুরু করেছেন। এদিকে পালোয়ান পর-পর তিন গ্লাস জল খেয়ে মাথায় হাত বুলোচ্ছে। ভবেশবাবু খুব আগ্রহের সঙ্গে কর্নেলের দিকে লক্ষ রেখেছেন।

 

আমি ভবেশবাবুকে বললুম, “প্লিজ, ব্যাপারটা একটু খুলে বলবেন কি?”

 

ভদ্রলোক একটু বদরাগী অথবা উত্তেজিত অবস্থায় ছিলেন। যে-জন্যই হোক, খ্যাক করে উঠলেন। “ওই তো বললুম মশাই! রহস্য! আর রহস্য বলেই কর্নেলসায়েবের কাছে আসা।” বলে কর্নেলের দিকে তাকালেন। “কিছু আঁচ করতে পারলেন স্যার?”

 

কর্নেল আতশকাঁচ রেখে সোফার কাছে জানালার ধারে তাঁর ইজিচেয়ারে এসে বসলেন। বললেন, “আপাতত কিছু বোঝা যাচ্ছে না ভবেশবাবু! জিনিসটা সত্যিই রহস্যময়। কিছুটা সময় লাগবে।”

 

ভবেশবাবু বললেন, “বেশ তো! যত ইচ্ছে সময় নিন। তবে স্যার, সত্যি বলতে কী, ওই বকশিশ জিনিস আমার ফেরত নিয়ে যেতেও আপত্তি আছে! বাস্! গতকাল বিকেলে বাথরুমে ওটা আবিষ্কারের পর থেকে যা-সব ঘটেছে, সবই তো আপনাকে টেলিফোনে বলেছি।”

 

পালোয়ান এতক্ষণে মেঝে থেকে উঠে সোফায় বসল। তার ওজনও কম নয়। সোফা মচমচ শব্দে কেঁপে উঠল। সে বলল, “ভূতুড়ে জিনিস স্যার! মামাবাবুকে এত বলছি, কানে করছেন না। নির্ঘাত ওটা ভূতের ঢিল।”

 

কর্নেল বললেন, “ঠিক। ভূতটা সারারাত ঢিলটা ফেরত নিতে বাড়ি চক্কর দিয়েছে। নানারকম ভয়-দেখানো আওয়াজ করেছে। তাই না ভবেশবাবু?”

 

ভবেশবাবু বললেন, “হ্যাঁ স্যার! সারারাত ঘুমোতে পারিনি। জানলার বাইরে ফিসফিস। দরজায় টোকা। বাগানে শাঁইশাঁই ঘূর্ণি হাওয়া। তারপর ছাদে বেহালার বাজনা! আমার অমন দাপুটে অ্যালসেশিয়ান টারজন, স্যার, সে পর্যন্ত ভয়ে কুঁকড়ে কাঠ।”

 

পালোয়ান ভেদা বলল, “আর সেই ঝনঝন শব্দটা, মামাবাবু? সেটার কথা বলুন!”

 

“হ্যাঁ, ঝনঝন শব্দ।” ভবেশবাবু চাপা গলায় বললেন, “ঘুম ভেঙে প্রথমে ভাবলুম, পাড়ায় কোথায় মাইকে খত্তাল বাজছে। পরে বুঝলুম, না–অন্য কিছু।”

 

কর্নেল মুচকি হেসে বললেন, “ভূতের কেত্তন!”

 

পালোয়ান সোফা কাঁপিয়ে হ্যাঁ-হ্যাঁ করে হাসতে লাগল। তারপর তার মামাবাবুর ধমক খেয়ে গম্ভীর হয়ে গেল। আমি ওকে বললুম, “ভোঁদাবাবু! আপনি তো ব্যায়ামবীর..”।

 

পালোয়ান ঝটপট বলল, “আমার নাম জগদীশ। তবে আপনি ব্যায়ামবীর বললেন, সেটা ঠিকই। গত বছর স্টেট মা এগজিবিশনে ওই টাইটেল পেয়েছি।”

 

বলে সে ডান হাত তুলে তাগড়া-তাগড়া পেশি ফুলিয়ে নমুনা দেখাল। দেখার মতো বস্তু হলেও আমার কেন যেন অস্বস্তিকর লাগে। মানুষের শরীরকে মানুষ ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে বিকট করে তোলে এবং সেজন্য খেতাবও জুটে যায়! একে দেহসৌষ্ঠব বা সৌন্দর্য বলে প্রশংসাও করা হয় শ্রী’ শব্দ সহযোগে। ব্যাপারটার মানে বুঝি না। কিন্তু কর্নেল জগদীশ ওরফে ভোঁদার পেশি-প্রদর্শনীর তারিফ করে বললেন, “অসাধারণ।”

 

আর অমনি পালোয়ানটি উঠে দাঁড়িয়ে আচমকা অঁক শব্দ করে শরীর বাঁকিয়ে অদ্ভুত ভঙ্গিতে দাঁড়াল, যেমনটি ‘দেহশ্রী’-ক্যাপশনযুক্ত ছবিতে দেখা যায়। ষষ্ঠী ফের অতিথিদের জন্য কফি-টফি আনছিল। থমকে সভয়ে দাঁড়িয়ে গেল।

 

ভবেশবাবু ধমক দিলেন, “খুব হয়েছে। আর বীরত্ব দেখিয়ে কাজ নেই। কাল রাত্তিরে কোথায় ছিল পালোয়ানি? ঠকঠক করে কেঁপে মা-মা-মা-মা করে আমাকে জড়িয়ে ধরে..!”

 

কাঁচুমাচু হেসে পালোয়ান বসল। বলল, “মানুষ তো নয়! মানুষ হলে এক আছাড়ে ছাতু করে ফেলতুম। ভূত-প্রেতের সঙ্গে পারা যায়? ওদের তো বডি নেই।”

 

কর্নেল বললেন, “যাই হোক, খুব মেহনত করেছ তুমি। কফি খেয়ে চাঙ্গা হও।”

 

“কফি-চা এসব আমার মানা।” পালোয়ান বলল, “তবে কর্নেল-সার, ইওর অনার।” বলে সে কফির পেয়ালা তুলে একটানে গরম কফি গিলে ফেলল। তারপর স্ন্যাক্সের সবটাই প্রকাণ্ড দুই হাতের চেটোয় তুলে মুখে ভরল।

 

ভবেশবাবু উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “আমিও ভাগনেবাবাজির মতো চা-কফি খাই না। আর মনের যা অবস্থা, খাওয়াদাওয়াই ছেড়ে দিয়েছি। আমি উঠি স্যার! আপনি এই রহস্যের কিনারা করুন।”

 

মামা-ভাগনে চলে যাওয়ার পর বললুম, “তা হলে আপনার লোহা ভারী না তুলো ভারীর রহস্যের সূচনাটা বোঝা গেল। কিন্তু সবটা খুলে না বললে মাথা ভোঁ-ভোঁ করছে!”

 

কর্নেল হেলান দিয়ে বসে নিভে যাওয়া চুরুট জ্বেলে বললেন, “ওই ভদ্রলোক, ভবেশবাবু একজন লোহালক্কড়ের ব্যবসায়ী। দোকান বড়বাজারে। বাড়ি দমদম এলাকায়। গত পরশু একটা লোক ওঁর দোকানে ঠেলাগাড়িতে চাপিয়ে ওই জিনিসটা বেচতে নিয়ে গিয়েছিল। উনি লোহা ভেবে ওটা ওজন করার চেষ্টা করেন। কিন্তু ওজনে সাঙ্তিক ভারী এবং জিনিসটা লোহাও নয়। তাই কেনেননি। হঠাৎ নাকি গতকাল দুপুরে ওঁর স্ত্রী বাথরুমে স্নান করতে ঢুকে জিনিসটা মেঝেয় দেখতে পান। তিনিও নাড়াচাড়া করতে গিয়ে অবাক হন। ওঁকে ফোন করেন। তারপর যা ঘটেছে, তুমি তো শুনলে।”

 

“কিন্তু তা হলে তো রহস্যটা অনেক বেশি বেড়ে গেল দেখছি!”

 

“হুঁ। আমাদের হালদারমশাইয়ের ভাষায় বলা চলে প্রচুর রহস্য!”

 

হালদার প্রাইভেট ডিটেকটিভ এজেন্সির কে. কে. হালদারের কথা শুনে বললুম, “আমার মাথায় একটা প্ল্যান এসেছে। ভবেশবাবুর বাড়িতে যা-সব ঘটেছে, তার রহস্যভেদে হালদারমশাইকে লাগিয়ে দিন। আর জিনিসটা কী, সেটা জানার জন্য বিজ্ঞানী চন্দ্রকান্তই যথেষ্ট। খবর পেয়েছি, উনি বনে কী একটা বিজ্ঞানী সম্মেলনে যোগ দিয়ে সদ্য কলকাতা ফিরেছেন।”

 

কর্নেল হাসলেন। “তোমার প্ল্যান আমার মাথায় অনেক আগেই এসেছে, ডার্লিং! সাড়ে ন’টা বাজে। চন্দ্রকান্তবাবুর আসার সময় হয়ে গেল। হালদারমশাই এতক্ষণ ছদ্মবেশে ভবেশবাবুর বাড়ির আনাচে-কানাচে ঘুরছেন আশা করি। একটু অপেক্ষা করো।”

 

“একটা ব্যাপার অদ্ভুত লক্ষ করছি।”

 

“একটা কেন জয়ন্ত, সবটাই।”

 

“না…মানে, আমি বলতে চাইছি, যে-লোকটা ভবেশবাবুকে ওই জিনিসটা বেচতে গিয়েছিল, তার হাত থেকে কেন এবং কী করে ওটা ভবেশবাবুর বাথরুমে ঢুকে পড়ল?”

 

“এ-বিষয়ে তোমার কী ধারণা, শুনি।”

 

“লোকটা কোনো অজানা কারণে জিনিসটা ভবেশবাবুর কাছে পৌঁছে দিতে চেয়েছিল এবং তা দিয়েছে।”

 

এই সময় কলিং বেল বাজল। তারপর বিজ্ঞানী চন্দ্রকান্ত চৌধুরী হন্তদন্ত ঘরে ঢুকে দমফাটানো গলায় বললেন, “স্পেসিফিক গ্র্যাভিটি পঞ্চান্ন পয়েন্ট ছয়! ভাবতে পারেন? তামার আট পয়েন্ট নয়। সিসের এগারো পয়েন্ট চৌত্রিশ। সোনার উনিশ পয়েন্ট তিরিশ। ইউরেনিয়ামের প্রশ্ন তুলছি না। কারণ খালি হাতে তেজস্ক্রিয় ধাতু ঘাঁটা বিপজ্জনক। কিন্তু পৃথিবীর কোনো ধাতুর আপেক্ষিক গুরুত্ব অত বেশি হতেই পারে না। পঞ্চান্ন পয়েন্ট ছয়! আমার মাথা বনবন করে ঘুরছে। পশ্চিম জার্মানির বন থেকে ফিরে এই বনবন করে মাথা ঘোরা। ধুস!”

 

বেঁটে গাবদাগোবদা মানুষ, চিবুকে নিখুঁত তিনকোনা দাড়ি, বিজ্ঞানী চন্দ্রকান্ত ধপাস করে সোফায় বসলেন। কর্নেল প্যাটপেটে চোখে তাকিয়ে ছিলেন। বললেন, “জিনিসটা আপনি তো দেখেননি। হাতে পাওয়া দূরের কথা। তা হলে কী করে ওটার আপেক্ষিক গুরুত্ব হিসেব করলেন চন্দ্রকান্তবাবু?”

 

বিজ্ঞানীপ্রবর দাড়ি চুলকে ফিক করে হাসলেন। “ও! গোড়ার কথাটা বলাই হয়নি। দিন-তিনেক আগে রেডারে টের পেলুম কী-একটা খুদে জিনিস কলকাতার আকাশে এদিক-সেদিক করে বেড়াচ্ছে। তক্ষুনি কমপিউটারের সামনে বসে পড়লুম। বড্ড ফিচেল জিনিস মশাই! ঠিক আপনার ওইসব প্রজাপতির মতো। চিন্তা করুন, ছটফটে রংচঙে বিরল প্রজাতির প্রজাপতি দেখলে আপনার কেমন অবস্থা হয়।”

 

টিপ্পনি কাটলুম, “কর্নেল খাঁটি পাগল হয়ে যান তখন।”

 

“ঠিক তাই,– বিজ্ঞানী সায় দিলেন। “আমার অবস্থাও তাই হয়েছিল। ওটাকে ফলো করতে-করতে দক্ষিণ-পশ্চিমে থিতু হতে দেখলুম। আলট্রাসোনিক রে পাঠিয়ে জানলুম, একরকম শব্দতরঙ্গ সৃষ্টি করছে ওটা। সেই শব্দতরঙ্গের সূত্রে অপেক্ষিক গুরুত্ব মাপা হয়ে গেল। সারারাত তাই নিয়ে হিসেবনিকেশ করেছি। সকালে হঠাৎ আপনার ফোন। যাই হোক, জিনিসটা কি এসে গেছে?”

 

কর্নেল বলার আগে আমি বললুম, “ওই দেখুন।” চন্দ্রকান্ত তড়াক করে উঠে টেবিলের কাছে গেলেন। তারপর পকেট থেকে কয়েকটা নানারকম যন্ত্র বের করে ওটার গায়ে ঠেকাতে থাকলেন। সেই সঙ্গে নোটবই বের করে খসখস করে কীসব লিখেও নিলেন। শেষে বললেন, “হু। আশ্চর্য! জিনিসটা একটা অপার্থিব ধাতু। কোনো গ্রহ থেকে ছিটকে পড়েছে পৃথিবীতে। এটা আমার ল্যাবে নিয়ে যাওয়া দরকার।”

 

বললুম, “কিন্তু নিয়ে যাবেন কী করে? সাঙ্ঘাতিক ওজন। আপনার রোবট ধুন্ধুমারকে সঙ্গে আনা উচিত ছিল।”

 

“ধুন্ধু’র আজকাল বড় দুষ্টুমি জেগেছে, বুঝলেন?” বিজ্ঞানী গম্ভীর হয়ে বললেন, “এটা পেলে হয়তো ক্রিকেট খেলতে শুরু করে দেবে। আসলে আজকাল চারদিকে যেরকম ক্রিকেট নিয়ে বাড়াবাড়ি! ধুন্ধু’র দোষ নেই। বাগান থেকে খেলার মাঠটা দেখা যায়। ক্রিকেটবল অনেক সময় বাগানে এসে পড়ে। ধুন্ধু কুড়িয়ে ছুঁড়ে দেয়। হতভাগা এক্কেবারে ভুলে গেছে যে, সে মানুষ নয়, মেশিন। মানুষের মধ্যে বেশিদিন থাকলে যা হয়!”

 

কর্নেল বললেন, “তা হলে ওটা ট্রাকে চাপিয়ে পাঠানোর ব্যবস্থা করা যাক। নাকি ভবেশবাবুর পালোয়ান ভাগনেকে ওবেলা আসতে বলব? সে-ই কিন্তু জিনিসটা এতদূর বয়ে এনেছে।”

 

বিজ্ঞানী চন্দ্রকান্ত একটু হেসে বললেন, “বিকল্প ব্যবস্থা না করেই কি এসেছি ভাবছেন?” তিনি একটা ইঞ্চি ছয়েক লম্বা যন্ত্র দেখালেন। “দেখতে পাচ্ছেন? বলুন তো এটা কী?”

 

কর্নেল চুরুটের ধোঁয়া ছেড়ে মাথা দোলালেন।

 

“এ. জি. এল.। আমার আবিষ্কার।” চন্দ্রকান্ত হাসলেন। “মহাকাশের কোথাও দাঁড়িয়ে এটার সাহায্যে পৃথিবীকে ছুঁড়ে ফেলতে পারি মশাই! অ্যান্টি-গ্র্যাভিটি লিফটার। যা-তা জিনিস নয়। এটা দিয়ে যদি জয়ন্তবাবুকে ছুঁই, উনি ভরহীন এবং ওজনহীন হয়ে পড়বেন।”

 

বললুম, “বাঃ! বেশ মজা তো!”

 

“মজা!” বাঁকা হেসে বিজ্ঞানী বললেন, “ভরহীন হলে কী অবস্থা হবে, বুঝতে পারছেন? ওজনহীন হলে না-হয় পাখির মতো উড়ে বেড়াবেন। কিন্তু ভরহীন হলে? পরমাণু কেন, স্রেফ কণিকা-উপকণিকা হয়ে চূর্ণবিচূর্ণ অবস্থায় স্পেসে বিলীন হয়ে যাবেন। আপনার টিকিটিও খুঁজে পাওয়া যাবে না।”

 

আঁতকে উঠে বললুম, “সর্বনাশ!”

 

চন্দ্রকান্ত আরও ভয় পাইয়ে দিয়ে বললেন, “ফোটনেও পরিণত হতে পারেন।”

 

কর্নেল বললেন, “চন্দ্রকান্তবাবু, তা হলে আপনার এ. জি. এল. ওই আজব বলটি ছুঁলে তো কেলেঙ্কারি!”

 

“না। এই লাল সুইচটা দেখছেন। এটা পদার্থের ভরকে জিরোতে পরিণত করে। জয়ন্তবাবুর সঙ্গে আমি একটু জোক করছিলুম। যাই হোক, এই সুইচটা টিপব না! টিপব এই সাদা সুইচটা। এটা ওজনকে জিরো করে দেবে। ভর এবং ওজনের মধ্যে সম্পর্ক অচ্ছেদ্য। অথচ দেখুন, এই শর্মা সেই অসাধ্যসাধন করেছে।” বলে চন্দ্রকান্ত থলের মুখটা খুলে আজগুবি বলটার গায়ে যন্ত্রটা চেপে ধরলেন।

 

অমনি একটা আশ্চর্য ঘটনা ঘটে গেল।

 

বিদঘুঁটে বলটা শূন্যে ভেসে উঠল এবং বাঁই করে খোলা জান.. দিয়ে উধাও হয়ে গেল। চন্দ্রকান্ত চেঁচিয়ে উঠলেন, “যাঃ! পালিয়ে গেল! পালিয়ে গেল!” তারপর জানলায় গিয়ে উঁকি দিলেন।

 

কর্নেলের গলায় সবসময় বাইনোকুলার ঝোলে। তিনি চেয়ার ছেড়ে উঠে জানলায় গিয়ে বাইনোকুলার চোখে তুললেন। তারপর সেখান থেকে ব্যস্তভাবে ছাদের সিঁড়ির দিকে চললেন।

 

ছাদে কর্নেলের বাগান, গোয়েন্দাপ্রবর হালদারমশাই যেটির নাম দিয়েছেন শূন্যোদ্যান। সেখানে অদ্ভুত, বিকট, বিদঘুঁটে গড়নের সব উদ্ভিদ। ক্যাকটাস, অর্কিড, আরও কত বিচিত্র গাছপালা। সেই শূন্যোদ্যানে পৌঁছে দেখলুম চন্দ্রকান্ত তার যন্ত্রগুলোর এটা টিপছেন, ওটা টিপছেন এবং কর্নেল চোখে বাইনোকুলার রেখে পশ্চিমের আকাশ দেখছেন। এপ্রিলের উজ্জ্বল নীল আকাশে অবাধ শূন্যতা। দেখতে দেখতে চোখ টাটিয়ে গেল আমার।

 

একটু পরে বাইনোকুলার নামিয়ে কর্নেল মুচকি হেসে বললেন, “মনে হচ্ছে গঙ্গা পেরিয়ে হাওড়ায় গেল। ওখানে প্রচুর লোহালক্কড়ের দোকান আছে অবশ্য। দেখা যাক।”

 

চন্দ্রকান্ত ব্যস্তভাবে বললেন, “না। না। ওটার গতি সেকেন্ডে প্রায় হাজার কিলোমিটার। এই দেখুন। আমার ধারণা, এতক্ষণে ওটা সাহারা মরুভূমিতে পৌঁছে গেছে। আমার এখনই ল্যাবে ফেরা উচিত। কমপিউটারের সামনে বসতে হবে। প্রচুর হিসেবনিকেশ করতে হবে, প্রচুর!”

 

“হ্যাঁ, প্রচুর। তবে যন্ত্রে হইব না। এ সায়েন্টিস্টের কাম না মশায়! ডিটেকটিভের হাতে ছাইড়া দেওনই ভালো।”

 

ঘুরে দেখি, সিঁড়ির দিক থেকে এগিয়ে আসছেন গোয়েন্দা কে. কে. হালদার। মুখে রহস্যময় হাসি। কর্নেল বললেন, “খবর বলুন হালদারমশাই! এতক্ষণ আপনার জন্য হা-পিত্যেশ করছি!”

 

হালদারমশাই আগে একটিপ নস্যি নিলেন। তারপর চাপা স্বরে বললেন, “ভবেশ রক্ষিত লোকটা ভালো না। পুলিশ-সোর্সে আগে খবর নিয়েছিলাম। তিনবার চোরাই মালের দায়ে ধরা পড়েছিল।”

 

বিজ্ঞানী চন্দ্রকান্ত আমাদের পাশ কাটিয়ে চলে গেলেন। কোনো বিদায়সম্ভাষণ করলেন না। বুঝলুম, বাড়ি ফিরেই ল্যাবে ঢুকবেন।

 

কর্নেল বললেন, “চলুন হালদারমশাই! নীচে গিয়ে কফি খেতে-খেতে আপনার তদন্ত রিপোর্ট শোনা যাক।”

 

একটু পরে ড্রয়িংরুমে বসে প্রচুর দুধে প্রায় সাদা কফি ফুঁ দিয়ে খেতে-খেতে প্রাইভেট গোয়েন্দা কৃতান্তকুমার হালদার তার তদন্ত রিপোর্ট দিলেন।

 

আজকাল কোনো জিনিসই ফেলনা নয়। পুরনো ছেঁড়া জামাকাপড় বা জুতো, কৌটো-শিশি-বোতল, অ্যালুমিনিয়ামের টুটাফাটা পাত্র থেকে শুরু করে গেরস্থালির পরিত্যক্ত সমস্ত আবর্জনা কেনবার জন্য লোকেরা অলিগলি হাঁক দিয়ে বেড়ায়, “বিক্কিরিওলা! বিক্কিরি-ই-ই-ই!” হালদারমশাই বিক্কিরিওলা সেজে ভবেশবাবুর বাড়ি গিয়েছিলেন। ভবেশ-গিন্নি খুব জাঁদরেল মহিলা। বিক্কিরিওলা বড্ড বেশি খোঁজখবর নিচ্ছে দেখে ডাকাতের চর ভেবে পালোয়ান ভাগনেকে ডাক দেন। ভাগ্যিস, তখন সে মামার সঙ্গে বেরিয়ে গেছে। উনি পুলিশে ফোন করতে যাচ্ছেন আঁচ করেই গোয়েন্দা কেটে পড়েন। তবে আজব বলটার কথা ততক্ষণে জানা হয়ে গেছে। হ্যাঁ, সত্যি একটা প্রচণ্ড ভারী খুদে বল বাথরুমে পড়েছিল। গত রাতে বাড়ির আনাচেকানাচে ভূতেরা উৎপাতও করেছে বটে। কিন্তু সন্দেহজনক ব্যাপার হল, বড়বাজারে ভবেশবাবুর দোকানে ঠেলাগাড়িতে চাপিয়ে যে-লোকটা ওই ভুতুড়ে বল বেচতে গিয়েছিল, তার চোখ ট্যারা এবং গতকাল বিকেলে ভবেশবাবুর বাড়ির কাছাকাছি একটা গলিতে যে-লোকটাকে সিঁটিয়ে মরে পড়ে থাকতে দেখা যায়, তার চোখও ট্যারা। কাজেই হালদারমশাই থানা থেকে হাসপাতালের মর্গ ছোটাছুটি করে বেড়িয়েছেন। তার হাতে এখন বড় তথ্য মৃত লোকটির নামধাম।

 

নোটবই খুলে গোয়েন্দামশাই বললেন, “গজকুমার সিং। ৮২/৩/ই চারু মিস্ত্রি লেন। জায়গাটা বেলঘরিয়ায় একটা মেসবাড়ি। গজকুমারের রেস খেলার নেশা ছিল। ওঁর মেসের লোকেরা বললেন, ফালতু লোক। মাথায় ছিট ছিল। ইদানীং বড়াই করে বলতেন, শিগগির কোটিপতি হয়ে যাবেন। হঠাৎ হার্টফেল করে মারা গেছেন।”

 

এইসময় ফোন বাজল। কর্নেল রিসিভার তুলে সাড়া দিলেন। “…লোকেট করতে পেরেছেন? খুব ভালো কথা। …না, না। আপত্তি কী? শুভস্য শীঘ্রং। হাঃ হাঃ হাঃ! এই বুড়ো বয়সে মহাকাশযাত্রা? …ঠিক আছে। রাখছি।” ফোন রেখে কর্নেল মিটিমিটি হেসে হালদারমশাইকে বললেন, “গ্রহান্তরে গোয়েন্দাগিরি করবেন নাকি হালদারমশাই?”

 

আমি অবাক। হালদারমশাই সম্ভবত কিছু না বুঝেই ঝটপট নস্যি নাকে খুঁজে বললেন, “হুঃ!”

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *