হিমালয়ের চূড়ায় একটি কল্পবিজ্ঞানের গল্প লিখেছেন প্রেমেন্দ্র মিত্র

শেয়ার করুনঃ

হিমালয়ের চূড়ায় গল্প প্রেমেন্দ্র মিত্র Bengali Story Himaloyer Churay Golpo Premendra Mitra

 

সম্প্রতি যে-কটি হিমালয় অভিযান হয়ে গেছে তার কথা আমরা সবাই জানি। অবশ্য কোনো

অভিযানই এ পর্যন্ত সফল হয়নি, একটি দুটি মানুষকে প্রত্যেক অভিযানে প্রাণও দিতে হয়েছে;

কিন্তু কুড়ি বৎসর আগে প্রথম যে হিমালয় অভিযান হয় তার মতো সর্বনাশা ব্যাপার কোনোটিতেই

ঘটেনি। একশো কুলি ও ইয়োরোপের বাছা বাছা বাইশ জন পাহাড়ে ওঠার ওস্তাদ বীরের ভেতর

একজন মাত্র সে অভিযান থেকে প্রাণ নিয়ে ফিরেছিলেন। তিনিই অভিযানের নেতা।

মানুষের স্মৃতি বড়ো দুর্বল, তাই কুড়ি বৎসর আগে যে অভিযান নিয়ে কাগজে কাগজে

কৌতূহল-প্রশ্ন ও নানা প্রকার আলোচনার আর অন্ত ছিল না, আজ তার কথা আমরা প্রায় ভুলেই

গেছি। সে অভিযান যে রহস্যের মাঝে শেষ হয়, আজ তার সমাধান না হলেও কেউ আর তা

নিয়ে মাথা ঘামায় না। সে তাভিযানের নেতা মি. লজ তাঁর চেষ্টা ব্যর্থ হবার পর কোথায় যে

আত্মগোপন করে ছিলেন তা নিয়ে তখন কিছুদিন নানা প্রকার জল্পনা-কল্পনা হলেও এখন আর

সাধারণের সে সম্বন্ধে কোনো কৌতূহল নেই।

হিমালয়ের শৃঙ্গে আরোহণের সেই রহস্য অভিযানের সঠিক বিবরণ চিরকালই হয়তো

মানুষের অজ্ঞাত থাকতে পারত, মি. লজের সন্ধানও সাধারণের কোনোদিন হয়তো মিলত না।

কিন্তু বিধাতার ইচ্ছা অন্যরকম। আমার মতো অত্যন্ত সাধারণ একজন লোকের মারফত

সেই রহস্যের সমাধান হবে কে তা জানত?

তাহলে গোড়ার কথাই বলি। গ্ল্যাসগোতে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া সাঙ্গ করে আমি তখন

কিছুদিনের জন্যে টহল দিতে বেরিয়েছি। প্রথমত ইংল্যান্ডের নানা জায়গা ঘুরে একদিন

স্কটল্যান্ডের ছোটো একটি গ্রামে গিয়ে আশ্রয় নিলাম। পাহাড়ের উপত্যাকায় ছোটো গ্রামটি।

আড়ম্বর নেই, ঐশ্বর্য নেই। লোকজনদের আচার ব্যবহার সেই সনাতন ধরনের। এ গ্রামে এলে

ভুলে যেতে হয় যে বিংশ শতাব্দীর বৈজ্ঞানিক সভ্যতা সমৃদ্ধ ব্রিটেনে আছি। গ্রামের এক ধারে

পাহাড়ে ঝরনায় সেই মান্ধাতার আমলের উইন্ডমিল ঘুরছে। গ্রামের একটিমাত্র সরাইয়ে সাবেক

কালের সাইনবোর্ড কালের সঙ্গে যুঝে যুঝে সাদা হয়ে গেছে।

সরাইটি প্রাচীন হলে কী হয়, খাবারদাবার ব্যবস্থা ভালো ; গ্রামটিও ছবির মতো। সুতরাং

একদিনের জায়গায় কয়েকদিন না থেকে পারলাম না। রোজ সকালে উঠে খেয়েদেয়ে মাছ ধরতে

যাই। ফিরে এসে সরাইয়ের বাইরে খোলা হাওয়ায় টেবিল পেতে আবার খাওয়া। বিকেলে

বেড়িয়ে এসে খেয়েদেয়ে রাত্রে ঘুম। এ ছাড়া কাজ নেই। সরাইয়ে লোকজন খুব কম আসে।

একজন মাত্র সেখানকার স্থায়ী বাসিন্দা। লোকটি বৃদ্ধ। শুনলাম আজ বিশ বছর নাকি তিনি এখান

থেকে নড়েননি। আকাশ পরিষ্কার থাকলে সারাদিন তিনি বাইরে একটি চেয়ার পেতে বসে

থাকেন। সরাইয়ের কর্তা বলেন, ‘লোকটি বড়ো ভালো, কোনো ঝঞ্ঝাট নেই, তবে—’

‘তবে কী’—জিজ্ঞাসা করায় সরাইয়ের কর্তা গলা নামিয়ে বললেন, ‘লোকটির মাথায় ছিট আছে।’

দু-দিন বাদে আমিও সে পরিচয় পেলাম। এ কয়দিন তাঁর সঙ্গে দেখা হলেও সামান্য একটু

সম্ভাষণ ছাড়া আর কোনো কথা হয়নি। সেদিন সকালে ছিপটিপ নিয়ে মাছ ধরতে বেরোব, এমন

সময় শুনলাম বৃদ্ধ ডাকছেন। কাছে গিয়ে দেখি তাঁর হাতে একটা কাগজ, এবং ভদ্রলোক তা

পড়ে অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে উঠেছেন। কোনোরকম ভূমিকা না করেই তিনি বললেন, ‘সব মুর্খ গোঁয়ারের দল!’

জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কাদের কথা বলছেন?’

তিনি তেমনি উত্তেজিতভাবে আমার প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়ে বললেন, ‘কখনো পারবে না, কখনো না!’

তাঁর কথা কিছুই না বুঝতে পেরে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলাম। বৃদ্ধ এবার বোধ হয়

আমার অবস্থা সম্বন্ধে একটু সচেতন হয়ে বললেন, ‘আজকের কাগজ পড়েছ? হিমালয় অভিযানে

একজন মারা পড়েছে যে!’

হিমালয় অভিযানের এই দুর্ঘটনায় এই সুদূর স্কট পল্লির এক বৃদ্ধের এত উত্তেজিত হবার

কী কারণ থাকতে পারে বুঝতে না পারলেও, বললাম, ‘পড়েছি। যে লোকটি মারা গেছেন তিনিই

পাহাড়ের সবচেয়ে ওপরে উঠেছিলেন। অত উঁচু পাহাড়ের ওপরকার পাতলা হাওয়ায় নিশ্বাস

নিতে না পেরেই সম্ভবত মারা গেছেন।’

বৃদ্ধ আমার প্রতি অত্যন্ত অবজ্ঞাভরে চেয়ে বললেন, ‘ছাই জান তুমি!

এবার আমার আত্মসম্মানে সত্যি আঘাত লাগল। রাগ একটু হলেও বৃদ্ধের বয়স স্মরণ করে

সংযত হয়ে বললাম, ‘স্কটল্যান্ডের পাহাড়ে আর হিমালয়ের শৃঙ্গে একটু তফাত আছে তা জানেন

কি? সেখানকার হাওয়া এত পাতলা যে মানুষের পক্ষে নিশ্বাস নিতেও পরিশ্রম করতে হয়। যত

ওপরে ওঠা যায় তত হাওয়া আরও পাতলা হয়ে যায়।’

বৃদ্ধ এবার শুধু একটু হাসলেন। তারপর খানিক চুপ করে থেকে অত্যন্ত গম্ভীর হয়ে

বললেন, ‘হিমালয়ের শৃঙ্গে তার চেয়ে ঢের বড়ো বিপদ আছে!’

বৃদ্ধের সঙ্গে এ নিয়ে বাকবিতণ্ডা বৃথা বুঝে তখনকার মতো চলে গেলাম।

ঘণ্টা দুই বাদে ফিরে এসে দেখি, বৃদ্ধ তখনও বাইরে তেমনিভাবে বসে আছেন। সামনে

তাঁর খবরের কাগজের হিমালয় অভিযানের পাতাটিই খোলা। বললাম, ‘আপনার হিমালয়

অভিযানে বিশেষ আগ্রহ দেখছি!’

বৃদ্ধ শুধু বললেন, ‘হুঁ।’ তারপর খানিকক্ষণ আমার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থেকে বললেন,

‘বসুন।’

কী আর করি, বৃদ্ধকে সন্তুষ্ট করবার জন্যে বসতে হল। বৃদ্ধ বললেন, ‘অভিযানের সমস্ত

বিবরণ ভালো করে পড়েছেন?’

বললাম, ‘হ্যাঁ।’

বৃদ্ধ বললেন, ‘তাত উঁচু শৃঙ্গে বরফের ওপর কোনোপ্রকার জানোয়ার থাকা সম্ভব না হলেও

পায়ের দাগের মতো একরকম চিহ্ন দেখা গেছে তার কথা পড়েছেন?’

বললাম, ‘ও তো সত্যি পায়ের দাগ নয়!’

বৃদ্ধ ব্যঙ্গ করে বললেন, ‘সত্যি পায়ের দাগ নয়, কেমন?’

‘তাহলে আপনি কী বলতে চান?’

বৃদ্ধ আবার উত্তেজিত হয়ে বললেন, ‘আমি বলতে চাই, হিমালয় পাহাড়ে প্রাণীবিজ্ঞানের

এখনও অনেক কিছু জানবার আছে!’

আমি একটু ব্যঙ্গ করেই বললাম, ‘আপনি কী করে জানলেন?

বৃদ্ধ ব্যঙ্গটুকু বুঝতে পেরে খানিক চুপ করে থেকে কী যেন ভেবে অবশেযে বললেন,

‘আমি মি. লজ।’

প্রথমটা কিছুই বুঝতে না পেরে ভাবলাম, লোকটা পাগল। কিন্তু পরের মুহূর্তেই সমস্ত কথা

মনে পড়ে গেল। কয়েকদিন আগেই বিলেতের এক কাগজে হিমালয় তাভিযান সম্পর্কে একটি

প্রবন্ধে প্রথম তাভিযানের নেতা হিসেবে মি. লজের সামান্য একটু বিবরণ বেরিয়েছিল—সেটা

পড়েছিলাম। অবাক হয়ে বললাম, ‘আপনি মি. লজ’।

বৃদ্ধ একটু হেসে বললেন, ‘আমিই মি. লজ, এবং আমার অহংকারে আঘাত দিয়ে তুমিই

প্রথম এ খবর জানতে পারলে।’

এরপর আর আমার কিছু লেখবার নেই। সেইদিন রাত্রে মি. লজের কাছে তাঁর অভিযানের

যে কাহিনি শুনলাম, তা-ই তাঁর নিজের ভাষাতেই তাঁর ডায়েরি থেকে এখানে প্রকাশ করছি। মি.

লজের কাছে অনেক কষ্টে এ বিবরণ সাধারণে প্রকাশ করবার অনুমতি পেয়েছি। শুধু তাঁর বর্তমান

ঠিকানা তাঁর নিজের অনুরোধে গোপন রাখলাম। এ বিবরণে শুধু সেই ভয়ংকর অভিযানের

পরিণাম নয়,—কেন মি. লজ তারপর আত্মগোপন করেছেন, তাও জানতে পারা যাবে।

 

মি. লজের বিবরণ

৭ই জুন, ১৯০৯

‘আজ প্রায় ২৬০০০ ফুটের কাছাকাছি আমরা পৌঁছেছি। নিশ্বাস নেওয়া বেশ কষ্টকর।

তাক্সিজেন ঘন ঘন ব্যবহার করতে হচ্ছে। চারদিকের সাদা বরফের ওপর প্রতিফলিত উজ্জ্বল

রোদের দিকে চেয়ে চেয়ে এর মধ্যেই আমাদের দুজনের চোখ উঠেছে ; বাকি সবাই রঙিন

কাঁচের চশমা নিয়েছি।

‘যে শৃঙ্গটিতে আমরা উঠতে চেষ্টা করছি তা এভারেস্টের মতো অত উঁচু না হলেও

পৃথিবীর যেকোনো পাহাড়ের চূড়াকে লজ্জা দিতে পারে। যত এগিয়ে চলেছি তত নতুন বাধা

এসে জমছে। এখন মনে হচ্ছে তিব্বতের দিক দিয়ে ওঠবার চেষ্টা না করে ভারতবর্ষের দিক দিয়ে

গেলেই বোধ হয় ভালো হত। কাল একটি স্খলিত বরফের স্তূপের সামনে পড়ে আমাদের একটি

তাঁবু পিষে গেছে। কী ভাগ্যি তখন সেখানে লোকজন ছিল না!

‘তিব্বতি কুলিরা এর মধ্যে বেঁকে দাঁড়িয়েছে। তাদের সামলানোই শক্ত হবে দেখছি।

পাহাড়ে উঠতে তারা ওস্তাদ, খাটুনিকেও তারা ভয় করে না; কিন্তু তারা উপরি পয়সার লোভেও

আর উঠতে নারাজ ; তাদের বিশ্বাস পাহাড়ের ওপরে একরকম পিশাচের জাত আছে। ওদের

কুসংস্কারাচ্ছন্ন মনের আজগুবি কল্পনা শুনলে হাসি পায়। আমি সেদিন ওদের সর্দারকে বললাম,

‘বেশ তো, পিশাচ থাকে থাক, আমাদেরও বন্দুক আছে।’ সর্দার তাতে খুব গম্ভীরভাবে হেসে

বললে, ‘বন্দুকে কী হবে? পিশাচেরা অদৃশ্য!’ আমাদের হাসতে দেখে লোকটা চটেই গেল।

‘তবে, পরশুদিন বরফে যে পায়ের দাগ দেখা গেছে সেটা ভারী রহস্যজনক। এত ওপরে

অত বড়ো পায়ের দাগওয়ালা কোন জানোয়ার থাকা সম্ভব নয়। কুলিরা তো ভয়েই অস্থির!

ওদের তাঁবুতে এর মধ্যে পিশাচ-পূজো আরম্ভ হয়ে গেছে। মি. আরভিং-এর চোখ-ওঠাটা এ সময়

ভারী অসুবিধের হল দেখছি। তিনিই আমাদের ভেতর প্রাণীবিজ্ঞানবিদ। ওটা পায়ের দাগ না কী,

তিনি বোধ হয় দেখলে বলতে পারতেন। বোধ হয় আমাদেরই ভুল হবে। বরফের ওপর অন্য

কোনো স্বাভাবিক কারণে দাগ পড়েছে হয়তো।

 

৮ই জুন, ১৯০৯১

‘না, এবার আমাকেও ভাবিয়ে তুলল! আজ সকাল থেকে ভয়ানক বরফ পড়া আর ঝড়

আরম্ভ হয়। তাঁবুর ভেতর গুটিসুটি মেরে সবাই ছ-সাত ঘণ্টা বসে কাটিয়েছি। দুপুরের

পরিষ্কার হতেই মি. বেন বললেন, আমি একটু বেরোব। এভাবে বসে থাকা যায় না। এখনি আবার

ঝড় উঠতে পারে—বলেও তাঁকে নিরস্ত করা গেল না। পায়ে বরফ-জুতোয় বেঁধে তিনি বেরিয়ে

পড়লেন। এই ফিরবেন ফিরবেন করে সন্ধে হলেও তাঁকে দেখতে পাওয়া গেল না। অথচ ঝড়ও

থেমে গেছে। সন্ধে হতেও তিনি যখন ফিরলেন না তখন খুঁজতে বেরোতে হল। মি. বেনের

পায়ের দাগ বরফের ওপর বেশ স্পষ্ট। বহু দূর পর্যন্ত তা ধরে আমবা এগিয়ে চললাম। কিন্তু কী

আশ্চর্য, খানিক দূর গিয়েই তাঁর পায়ের দাগ হঠাৎ অদৃশ হয়ে গেছে। সেখানে কোনো খাদ নেই

যে ভাবব তিনি পড়ে গেছেন, সেখানকার বরফ ঠুকে দেখলাম, তাও বেশ শক্ত। বরফের ভেতর

মাঝে মাঝে যে ফোকর থাকে সেরকম কোনো ফোকর দিয়েও তিনি গলে পড়েননি। তবে তিনি

হঠাৎ হাওয়ায় মিলিয়ে গেলেন কী করে? আশ্চর্যের বিষয় এই যে, এখানেও সেইরকম

রহস্যজনক পায়ের দাগ। বিপদের ওপর বিপদ ; আমাদের সঙ্গে যে দুজন কুলি মশাল নিয়ে

এসেছিল তারা এই পায়ের দাগ দেখেই হঠাৎ মশাল নিয়ে উর্ধ্বশ্বাসে তাঁবুর দিকে ছুট দিলে।

অন্ধকারে বিনা আলোয় এই পাহাড়ের ভেতর পথ খোঁজা একেবারে অসম্ভব জেনে বাধ্য হয়ে

তাদের পেছু পেছু ছুটতে হল। ভালো করে আশেপাশে দেখবার অবসরও পেলাম না। খানিক দূর

গিয়ে একজনকে ধরে ফেলে তার হাত থেকে মশালটা কেড়ে নিলাম বটে, কিন্তু তখন আবার

ঝড় ওঠবার সূচনা দেখা দিয়েছে। বিষণ্ন মনে তাঁবুতে ফিরে গেলাম। দ্বিতীয় বাড়ের বেগ একটু

শান্ত হয়ে এলে আমরা নিজেরা ক-জন মশাল নিয়ে আবার বেরোলাম বটে, কিন্তু নতুন বরফ

পড়ে এবার সমস্ত পায়ের চিহ্ন ঢেকে গেছে। কিছুই পাওয়া গেল না।

 

৯ই জুন, ১৯০৯

‘কুলিরা এবার খেপে উঠেছে। তাদের মাইনে চুকিয়ে বিদায় না দিলে তারা বোধ হয়

আমাদের আক্রমণ করতেও পেছপাও হবে না। তিব্বতি কুলিদের এত কুসংস্কার আছে জানলে

কখনো এদিক দিয়ে আসতাম না। তাদের অনুনয় করে, ভয় দেখিয়ে, ধমক দিয়ে, কিছুতেই কিছু

ফল হয়নি। আজকের মধ্যে একটা ব্যবস্থা করতেই হবে। এতদূর এসেও শেষকালে ব্যর্থ হয়ে

ফিরতে হবে ভাবতে ভয়ানক কষ্ট হচ্ছে। অবশ্য ভয় যে আমারও একটু হয়নি এ কথা বললে

মিথ্যা বলা হবে। আজ সারাদিন আমরা সবাই আকাশ পরিষ্কার থাকায় মি. বেনের সন্ধান করেছি।

কোথাও তাঁর চিহ্ন নেই। শুধু তাই নয়, আজ সকালে আমাদের তাঁবুর চারিধারে সেইরকম

পায়ের দাগ দেখা গেছে। এ পায়ের দাগের অর্থ কী?

 

১০ই জুন, ১৯০৯

‘সর্বনাশের ওপর সর্বনাশ! মনে হচ্ছে আমার মাথা বুঝি খারাপ হয়ে যাবে! আজ সকালেই

আমাদের তাঁবুর আধ মাইল উত্তরে মি. বেনের মৃতদেহ পাওয়া গেল। এ মৃতদেহ এখানে কী

করে এল বুঝতে পারছি না। শুধু মৃতদেহ পেলে এমন কিছু ভয়ের কথা ছিল না। কিন্তু সে

মৃতদেহ অর্ধভূক্ত, রক্তাক্ত। এই ২৬০০০ ফুট পাহাড়ের ওপর কী এমন জানোয়ার থাকা সম্ভব যা

একটা জোয়ান মানুষকে মেরে ফেলে তাকে আহার করতে পারে? প্রাণীবিজ্ঞানে এমন কোনো

জানোয়ারের কথা তো লেখে না!

‘কী ভাগ্যি কুলিরা কেউ সে মৃতদেহ দেখেনি! আমরা চুপেচুপে সেইখানেই তা গোরস্থ

করেছি। এর মধ্যেই অর্ধেকের বেশি কুলি মাইনে বুঝে নিয়ে নেমে গেছে। বাকি ক-জনকে

অনেক কষ্টে অনেক বকশিশের লোভ দেখিয়ে রাখা গেছে।

‘আজ সবচেয়ে আশ্চর্য যে ঘটনা ঘটেছে তার মানেও এখনও বুঝতে পারছি না। মিবেনের

দেহ কবর দিয়ে আর সবাই চলে যাবার পরও আমি খানিকক্ষণ সেখান দাঁড়িয়ে ছিলাম। হঠাৎ

পেছনে পায়ের শব্দ শুনে অবাক হয়ে ফিরে তাকিয়ে দেখি, কেউ কোথাও নেই। আমার সঙ্গীরা

তখন বহুদূরে। এ পায়ের শব্দ হঠাৎ কোথা থেকে এল ভেবে পেলাম না। হয়তো মনের ভুল

ভেবে নিশ্চিন্ত হতে পারতাম, কিন্তু পরক্ষণেই আমার ডান ধারে আবার সেই পায়ের শব্দ।

চারিধারে ভালো করে চেয়ে দেখলাম, শুধু বরফে ঢাকা পাহাড় রোদে ঝলমল করছে, কোথাও

কিছু নেই। সত্যিই এবার ভয় হল। এক পা এক পা করে তাঁবুর দিকে ফিরছি, মনে হল পেছনে

যেন সেইরকম পায়ের শব্দ এগিয়ে আসছে। চমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম, কিন্তু পরক্ষণেই কীসের

ধাক্কায় একেবারে উলটে পড়ে গেলাম। পড়ে গিয়ে ভয়ে হতবুদ্ধি হয়েই রিভলভারটা খাপ থেকে

বার করে উপরোউপরি দুটো গুলি সামনের দিকে ছুঁড়ে ফেলেছিলাম। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, তার

পরেই পায়ের শব্দ একেবারে বন্ধ হয়ে গেল। আমার সঙ্গীরা গুলির আওয়াজ শুনে সবাই আবার

ছুটে এল। কিন্তু তাদের এ আজগুবি কথা কেমন করে বলি! বললাম— অমনি একটু গুলি ছুঁড়তে

ইচ্ছে হয়েছিল। তারা আমার মাথা খারাপ হয়েছে ভাবল কি না কে জানে!

 

১১ই জুন, ১৯০৯

‘আজকের ডায়েরি এমন জায়গায় বসে লিখতে হবে কে জানত! তিব্বতি কুলিদের

তাঁবুতে, তাদের ময়লা কাপড়ের অসহ্য দুর্গন্ধের সঙ্গে ধুনির ধোঁয়া সহ্য করে কোনোরকমে বসে

লিখছি। আমার সমস্ত আশা একদিন হঠাৎ সফল হতে হতে একবারে নির্মূল হয়ে গেছে। আমার

সঙ্গীরা যে কোথায় আছে জানি না। নিজে কোনোদিন যে দেশে ফিরব, তাদের বিশেষ আশা নেই।

‘সকালবেলাই আকাশ পরিষ্কার দেখে পাহাড়ের চূড়ায় ওঠবার জন্যে আমরা বেরিয়ে

পড়লাম। বেশি উঁচুতে উঠবার সময় দরকার লাগবে বলে অক্সিজেনের গ্যাসওয়ালা একরকম

মুখোস তৈরি করিয়ে আনিয়েছিলাম। সেগুলো ছাড়া বরফে গাঁথবার সড়কি ও বন্দুক রইল সঙ্গে।

কুলিরা আর এগুবে না। আমাদেরই ভেতর কয়েকজন খাবারদাবার ও হালকা তাঁবুর সরঞ্জাম নিয়ে

পেছনে আসবে। আজকে যত দূর উঠতে পারা যায় ততদুরে নতুন করে সাময়িকভাবে আমাদের

তাঁবু ফেলতে হবে।

‘ওঠার পথ এখানে ভয়ানক বিপজ্জনক। কিছুদূর একা একা ওঠা যাবে, তারপরেই একটি

লম্বা দড়িতে সকলকে বদ্ধ হয়ে উঠতে হবে। দড়ি দিয়ে বাঁধা থাকলে হঠাৎ একজনের পা

ফসকালেও বিপদের সম্ভাবনা কম থাকে। একজন পড়লেও অপর সকলের দ্বারা সে রক্ষা পায়।

‘কিন্তু দড়ি ব্যবহারের সময়ই আর পেলাম না। আমি আর মি. সটন সকলের আগে ছিলাম,

কিছুদূর যাবার পরই দেখা গেল, দু-দিক দিয়ে পাহাড়ে ওঠা যায়। কোন দিকে কীরকম সুবিধে

আছে দেখবার জন্যে আমরা দুজনে দু-ধারে আলাদা হয়ে গেলাম। খানিক দূর পর্যন্ত দেখলাম,

আমার দিকে পথ বেশ সোজা। পাশে অতল খাদ হলেও পাহাড়ের গায়ে গায়ে পথ বেশ

চওড়াভাবে উঠে গেছে। এদিকে এসে সুবিধে হয়েছে ভেবে মনের আনন্দে এগিয়ে যাচ্ছি, হঠাৎ

পেছনে পায়ের শব্দ শুনে প্রথমে মনে হল, মি. সটন বুঝি ওধারে পথ না পেয়ে আমার দিক দিয়ে

আসছেন। বললাম, আমার ভাগ্যই ভালো তাহলে আজ মি. সটন। কোনো উত্তর না পেয়ে কিন্তু

হঠাৎ আমার বুকের রক্ত হিম হয়ে গেল। পেছু ফিরে দেখলাম, কেউ কোথাও নেই। সেদিন মি.

বেনের গোরের কাছে যেরকম ধাক্কা খেয়েছিলাম, এই সংকীর্ণ জায়গায় সেরকম ধাক্কা খেলেই

অতল খাদে পড়ে যাব বুঝে অত ভয়ের ভেতরও শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। কিন্তু কার বিরুদ্ধে

দাঁড়াব? কোথাও কিছু নেই। মনে হল, এই বিংশ শতাব্দীতে সত্যই কি তাহলে তিব্বতিদের

অদৃশ্য পিশাচের অস্তিত্ব বিশ্বাস করতে হবে! পিশাচই হোক আর নাই হোক আমি লড়াই না

করে মরব না পণ করে সামনে শূন্যের দিকে দু-বার গুলি ছুঁড়লাম। সঙ্গে সঙ্গে যে অদ্ভুত কাণ্ড

ঘটল তা কেউ বোধ হয় কখনো কল্পনাও করতে পারেনি। অদ্ভুত এক আর্তনাদের সঙ্গে মনে হল,

আমার গায়ে দু-মনি একটা বস্তা কে ছুঁড়ে দিয়েছে! টাল সামলাতে না পেরে সেই অদৃশ্য বস্তার

সঙ্গে গড়িয়ে গভীর খাদে আমি পড়ে গেলাম। মনে মনে বুঝলাম, এই শেষ।

…কিন্তু আয়ু আমার তখনও ফুরোয়নি। খাদ অতল হলেও বিদ্যুৎগতিতে তা দিয়ে গড়াতে

গড়াতে বুঝতে পারলাম, খাদের গা একটু ঢালু। যতক্ষণ সমানভাবে এইরকম ঢালু থাকবে ততক্ষণ

বিদ্যুৎগতিতে নামলেও আমার প্রাণের আশঙ্কা নেই; কিন্তু সে আর কয় সেকেন্ড! অদৃশ্য বস্তুটাও

আমার সঙ্গে কখনো আমার ওপরে, কখনো আমার নীচে গড়িয়ে পড়ছে টের পাচ্ছিলাম।

‘কতক্ষণ এভাবে গড়িয়ে আসছি স্মরণ নেই। হঠাৎ অনুভব করলাম, আমার নামবার গতি

মন্দ হয়ে এসেছে। ঢালু ক্রমশ কমে আসছে। আরও কিছুক্ষণ এইভাবে গড়িয়ে সামনের একটা

বরফের ঢিবির গায়ে আটকে যখন থেমে গেলাম তখন আশ্চর্য হয়ে দেখলাম, অত বড়ো

পাহাড়ের চূড়া থেকে পড়ে গিয়েও সামান্য দু-একটা আঁচড় ছাড়া কোনো ক্ষতচিহ্নও আমার গায়ে

নেই। বিধাতার দয়া ছাড়া একে আর কী বলতে পারি! কিন্তু একী?

‘আমার সামনে বিশাল এক অদ্ভুত জীবের মৃতদেহ পড়ে রয়েছে। একমাত্র উত্তর-মেরুর

ভাল্লুকের সঙ্গে সে জীবের তুলনা করা যেতে পারে। কিন্তু সে ভাল্লুকের চেয়ে এ জীব আকারে

বড়ো এবং এর মুখের আকার ও চেহারাও ভীষণ। সবচেয়ে আশ্চর্য এই যে, জানোয়ারটি যেন

আগাগোড়া স্বচ্ছ কাঁচ দিয়ে তৈরি। তার গায়ের ভেতর দিয়ে তলার বরফ দেখা যায়। কিন্তু

দেখতে দেখতে সে কাঁচের চেহারা ক্রমশ ঘোলাটে হয়ে এল। মিনিট দু-এক বাদে অবাক হয়ে

দেখলাম, সে দেহ ক্রমশ কালো হয়ে আসছে। কিছুক্ষণ বাদে সে দেহ একেবারে কালো হয়ে

গেল। এই কি তবে তিব্বতিদের অদৃশ্য পিশাচ? মি. বেন কি এরই হাতে প্রাণ দিয়েছেন?

‘কিন্তু তখন এ রহস্য নিয়ে মাথা ঘামাবার সময় নেই। নিজের প্রাণ বাঁচাতে হবে। বিধাতা

আমার সেদিন সহায়। যে পাহাড়ে আটকে গিয়েছিলাম সেটা ঘুরে একটু এগোতেই দেখি, যে

কুলিরা ক-দিন আগে আমাদের কাছে মাইনে ঢুকিয়ে নিয়ে নেমে গিয়েছিল, তাদের তাঁবু। তারা

ক-দিনে পাহাড়ের বাঁকা পথে যতটুকু নেমেছে, আমি এক ঘণ্টার মধ্যে পাহাড়ের ঢালু দিয়ে তার

চেয়ে কম নামিনি।

 

মি. লজের ডায়েরি এইখানেই শেষ। তারপর তিনি নিজের মুখে আমায় জানিয়েছেন যে

সেই কুলিদের তাঁবুতে গিয়ে তাদের আবার ওপরে সঙ্গীদের খোঁজে নিয়ে যাবার জন্যে তিনি

অনেক চেষ্টা করেন, কিন্তু তারা কিছুতেই রাজি হয়নি। একা সহায়-সম্বলহীন অবস্থায় সে চেষ্টা

করা তাঁর পক্ষে একেবারে পাগলামি বলেই তিনি নিজে আর কিছু করতে পারেননি। দু-দিন সে

তাঁবুতে থাকবার পর তাঁরা ওপরের পাহাড়ের এক বিরাট বরফের স্তূপ খসে পড়ার শব্দ পান।

এরপর কুলিরা আর সেখানে এক মুহূর্তও থাকতে চায় না। সেই অদ্ভুত জানোয়ারের মৃতদেহটাও

তারা পিশাচের দেহ বলে তাঁকে আনতে দেয় না। তাদের সঙ্গে আরও নীচে গিয়ে তিনি তাঁর

সঙ্গীদের জন্যে আরও বহুদিন অপেক্ষা করেন, কিন্তু তাদের আর কোনো পাত্তা পাওয়া যায় না।

কুলিরা বলে যে সেই বরফের ধস নামার সঙ্গে সঙ্গেই তারা মারা পড়েছে। হয়তো তাই সত্য।

তারপর তিনি যে কষ্টে তিব্বত থেকে দেশে ফেরেন তার বিবরণ এখানে নিষ্প্রয়োজন। এতগুলি

লোকের মৃত্যুর গৌণ কারণ হবার দরুন তাঁর মনে যে গভীর অনুশোচনা হয়, তার জন্যেই তিনি

গত ছয় বছর একেবারে আত্মত্মগোপন করে আছেন। সাধারণ মানুষের সঙ্গে এগিয়ে আলাপ করবার

মতো উৎসাহ ও মনের জোর তাঁর নেই।

সেই অদ্ভুত রহস্যময় জীব সম্বন্ধে তাঁর মন্তব্য জানিয়ে এ কাহিনি শেষ করলাম। মি. লজ

বলেন যে তাঁর গোড়া থেকেই বোঝা উচিত ছিল— তিব্বতিদের এরকম বদ্ধমূল সংস্কারের কোনো

একটা কারণ নিশ্চয়ই আছে। হিমালয়ের যেসব উঁচু জায়গায় কোনো জীবের অস্তিত্ব সম্ভব নয়

বলে বৈজ্ঞানিকদের ধারণা, সেইখানেই এই অদৃশ্য জীব ঘুরে বেড়ায়। প্রকৃতির যে, অদ্ভুত জাদুতে

উত্তর মেরুর ভাল্লুক সাদা হয়, সমুদ্রের তলায় মাছের গা দিয়ে আলো বেরোয়, জিরাফের গলা লম্বা

হয়, তাতে কোনো জানোয়ারের দেহ অদৃশ্য হওয়া আশ্চর্যজনক হলেও অসম্ভব নয়। দেহের মাংস

যে রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় রূপান্তরিত হয়ে তাদৃশ্য হতে পারে এ প্রস্তাবনা বৈজ্ঞানিকেরাও স্বীকার

করেন। কিন্তু জীবন্ত অবস্থায় যে দেহ অদৃশ্য, মৃত্যুর পর রক্তের স্রোতের সঙ্গে রাসায়নিক প্রক্রিয়া

বন্ধ হয়ে সেই দেহই, মি. লজ মনে করেন, তাঁর দৃষ্টিগোচর হয়েছিল। মি. লজ আশা করেন যে

ভবিষ্যতে কোনো দুঃসাহসী শিকারি হিমালয়ের দুর্গম শিখর থেকে এই অদৃশ্য জানোয়ার এনে

তাঁর কথা প্রমাণ করে দেবে। এবং তাঁর বিশ্বাস, এ জানোয়ারের অস্তিত্ব না জেনে ও তার বিরুদ্ধে

প্রস্তুত না হয়ে হিমালয়ের শিখরে আরোহণের চেষ্টা গোঁয়াতুমি ; সে চেষ্টা বিফল হতে বাধ্য।

 

Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments