আগমনী ছোট গল্পটি লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আয়োজন চলেইছে। তার মাঝে একটুও ফাঁক পাওয়া যায় না যে ভেবে দেখি, কিসের আয়োজন।
তবুও কাজের ভিড়ের মধ্যে মনকে এক-একবার ঠেলা দিয়ে জিজ্ঞাসা করি, “কেউ আসবে বুঝি?”
মন বলে, “রোসো। আমাকে জায়গা দখল করতে হবে, জিনিসপত্র জোগাতে হবে, ঘরবাড়ি গড়তে হবে, এখন আমাকে বাজে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা কোরো না।”
চুপচাপ করে আবার খাটতে বসি। ভাবি, জায়গা-দখল সারা হবে, জিনিসপত্র সংগ্রহ শেষ হবে, ঘরবাড়ি-গড়া বাকি থাকবে না, তখন শেষ জবাব মিলবে।
জায়গা বেড়ে চলেছে, জিনিসপত্র কম হল না, ইমারতের সাতটা মহল সারা হল। আমি বললেম, “এইবার আমার কথার একটা জবাব দাও।”
মন বলে, “আরে রোসো, আমার সময় নেই।”
আমি বললেম, “কেন, আরো জায়গা চাই? আরো ঘর? আরো সরঞ্জাম? ”
মন বললে, “চাই বৈকি।”
আমি বললেম, “এখনো যথেষ্ট হয় নি? ”
মন বললে, “এতটুকুতে ধরবে কেন।”
আমি জিজ্ঞাসা করলেম, “কী ধরবে। কাকে ধরবে।”
মন বললে, “সে-সব কথা পরে হবে।”
তবু আমি প্রশ্ন করলেম, “সে বুঝি মস্ত বড়ো? ”
মন উত্তর করলে, “বড়ো বৈকি।”
এত বড়ো ঘরেও তাকে কুলোবে না, এত মস্ত জায়গায়! আবার উঠে-পড়ে লাগলেম। দিনে আহার নেই, রাত্রে নিদ্রা নেই। যে দেখলে সেই বাহবা দিলে; বললে, “কাজের লোক বটে।”
এক-একবার কেমন আমার সন্দেহ হতে লাগল, বুঝি মন বাঁদরটা আসল কথার জবাব জানে না।
সেইজন্যেই কেবল কাজ চাপা দিয়ে জবাবটাকে সে ঢাকা দেয়। মাঝে মাঝে এক-একবার ইচ্ছা হয়, কাজ বন্ধ করে কান পেতে শুনি পথ দিয়ে কেউ আসছে কি না। ইচ্ছা হয়, আর ঘর না বাড়িয়ে ঘরে আলো জ্বালি, আর সাজ-সরঞ্জাম না জুটিয়ে ফুল-ফোটার বেলা থাকতে একটা মালা গেঁথে রাখি।
কিন্তু, ভরসা হয় না। কারণ, আমার প্রধান মন্ত্রী হল মন। সে দিনরাত তার দাঁড়িপাল্লা আর মাপকাঠি নিয়ে ওজন-দরে আর গজের মাপে সমস্ত জিনিস যাচাই করছে। সে কেবলই বলছে, “আরো না হলে চলবে না।”
“কেন চলবে না।”
“সে যে মস্ত বড়ো।”
“কে মস্ত বড়ো।”
বাস্, চুপ। আর কথা নেই।
যখন তাকে চেপে ধরি “অমন করে এড়িয়ে গেলে চলবে না, একটা জবাব দিতেই হবে” তখন সে রেগে উঠে বলে, “জবাব দিতেই হবে, এমন কী কথা। যার উদ্দেশ মেলে না, যার খবর পাই নে, যার মানে বোঝবার জো নেই, তুমি সেই কথা নিয়েই কেবল আমার কাজ কামাই করে দাও। আর, আমার এই দিকটাতে তাকাও দেখি। কত মামলা, কত লড়াই; লাঠিসড়কি-পাইক-বরকন্দাজে পাড়া জুড়ে গেল; মিস্ত্রিতে মজুরে ইঁট-কাঠ-চুন-সুরকিতে কোথাও পা ফেলবার জো কী। সমস্তই স্পষ্ট; এর মধ্যে আন্দাজ নেই, ইশারা নেই। তবে এ-সমস্ত পেরিয়েও আবার প্রশ্ন কেন।”
শুনে তখন ভাবি, মনটাই সেয়ানা, আমিই অবুঝ। আবার ঝুড়িতে করে ইঁট বয়ে আনি, চুনের সঙ্গে সুরকি মেশাতে থাকি।
(২)
এমনি করেই দিন যায়। আমার ভূমি দিগন্ত পেরিয়ে গেল, ইমারতের পাঁচতলা সারা হয়ে ছ’তলার ছাদ পিটোনো চলছে। এমন সময়ে একদিন বাদলের মেঘ কেটে গেল; কালো মেঘ হল সাদা; কৈলাসের শিখর থেকে ভৈরোঁর তান নিয়ে ছুটির হাওয়া বইল, মানস-সরোবরের পদ্মগন্ধে দিনরাত্রির দণ্ডপ্রহরগুলোকে মৌমাছির মতো উতলা করে দিলে। উপরের দিকে তাকিয়ে দেখি, সমস্ত আকাশ হেসে উঠেছে আমার ছয়তলা ঐ বাড়িটার উদ্ধত তারাগুলোর দিকে চেয়ে।
আমি তো ব্যাকুল হয়ে পড়লেম; যাকে দেখি তাকেই জিজ্ঞাসা করি, “ওগো, কোন্ হাওয়াখানা থেকে আজ নহবত বাজছে বলো তো।”
তারা বলে, “ছাড়ো,আমার কাজ আছে।”
একটা খ্যাপা পথের ধারে গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে, মাথায় কুন্দফুলের মালা জড়িয়ে চুপ করে বসে ছিল। সে বললে, “আগমনীর সুর এসে পৌঁছল।”
আমি যে কী বুঝলেম জানি নে; বলে উঠলেম, “তবে আর দেরি নেই।”
সে হেসে বললে, “না, এল ব’লে।”
তখনি খাতাঞ্জিখানায় এসে মনকে বললেম, “এবার কাজ বন্ধ করো।”
মন বললে, “সে কী কথা। লোকে যে বলবে অকর্মণ্য।”
আমি বললেম, “বলুক গে।”
মন বললে, “তোমার হল কী। কিছু খবর পেয়েছ নাকি।”
আমি বললেম, “হাঁ, খবর এসেছে।”
“কী খবর।”
মুশকিল, স্পষ্ট করে জবাব দিতে পারি নে। কিন্তু, খবর এসেছে। মানস-সরোবরের তীর থেকে আলোকের পথ বেয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে হাঁস এসে পৌঁছল।
মন মাথা নেড়ে বললে, “মস্ত বড়ো রথের চুড়ো কোথায়, আর মস্ত ভারি সমারোহ? কিছু তো দেখি নে, শুনি নে।”
বলতে বলতে আকাশে কে যেন পরশমণি ছুঁইয়ে দিলে। সোনার আলোয় চার দিক ঝল্মল্ করে উঠল। কোথা থেকে একটা রব উঠে গেল, “দূত এসেছে।”
আমি মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে দূতের উদ্দেশে জিজ্ঞাসা করলেম, “আসছেন নাকি।”
চার দিক থেকে জবাব এল, “হাঁ, আসছেন।”
মন ব্যস্ত হয়ে বলে উঠল, “কী করি! সবেমাত্র আমার ছয়তলা বাড়ির ছাদ পিটোনো চলছে; আর, সাজ-সরঞ্জাম সব তো এসে পৌঁছল না।”
উত্তর শোনা গেল, “আরে ভাঙো ভাঙো, তোমার ছ’তলা বাড়ি ভাঙো।”
মন বললে, “কেন।”
উত্তর এল, “আজ আগমনী যে। তোমার ইমারতটা বুক ফুলিয়ে পথ আটকেছে।”
মন অবাক হয়ে রইল।
আবার শুনি, “ঝেঁটিয়ে ফেলো তোমার সাজ-সরঞ্জাম।”
মন বললে, “কেন।”
“তোমার সরঞ্জাম যে ভিড় করে জায়গা জুড়েছে।”
যাক গে। কাজের দিনে বসে বসে ছ’তলা বাড়ি গাঁথলেম, ছুটির দিনে একে একে সব-ক’টা তলা ধূলিসাৎ করতে হল। কাজের দিনে সাজ-সরঞ্জাম হাটে হাটে জড়ো করা গেল, ছুটির দিনে সমস্ত বিদায় করেছি।
কিন্তু, মস্ত বড়ো রথের চুড়ো কোথায়, আর মস্ত ভারি সমারোহ?
মন চার দিকে তাকিয়ে দেখলে।
কী দেখতে পেলে।
শরৎপ্রভাতের শুকতারা।
কেবল ঐটুকু?
হাঁ, ঐটুকু। আর দেখতে পেলে শিউলিবনের শিউলিফুল।
কেবল ঐটুকু?
হাঁ, ঐটুকু। আর দেখা দিল লেজ দুলিয়ে ভোরবেলাকার একটি দোয়েল পাখি।
আর কী।
আর, একটি শিশু, সে খিল্খিল্ করে হাসতে হাসতে মায়ের কোল থেকে ছুটে পালিয়ে এল বাইরের আলোতে।
“তুমি যে বললে আগমনী, সে কি এরই জন্যে।”
“হাঁ, এরই জন্যেই তো প্রতিদিন আকাশে বাঁশি বাজে, ভোরের বেলায় আলো হয়।”
“এরই জন্যে এত জায়গা চাই? ”
“হাঁ গো, তোমার রাজার জন্যে সাতমহলা বাড়ি, তোমার প্রভুর জন্যে ঘরভরা সরঞ্জাম। আর, এদের জন্যে সমস্ত আকাশ, সমস্ত পৃথিবী।”
“আর, মস্ত বড়ো? ”
“মস্ত বড়ো এইটুকুর মধ্যেই থাকেন।”
“ঐ শিশু তোমাকে কী বর দেবে।”
“ঐ তো বিধাতার বর নিয়ে আসে। সমস্ত পৃথিবীর আশা নিয়ে, অভয় নিয়ে, আনন্দ নিয়ে। ওরই গোপন তূণে লুকোনো থাকে ব্রহ্মাস্ত্র, ওরই হৃদয়ের মধ্যে ঢাকা আছে শক্তিশেল।”
মন আমাকে জিজ্ঞাসা করলে, “হাঁ গো কবি, কিছু দেখতে পেলে, কিছু বুঝতে পারলে? ”
আমি বললেম, “সেইজন্যেই ছুটি নিয়েছি। এতদিন সময় ছিল না, তাই দেখতে পাই নি, বুঝতে পারি নি।”