অন্ধকারে, হাতে হাত রেখে (ভূতনাথের ডায়েরি) – অনীশ দেব
‘প্ল্যানচেট’ শব্দটা প্রথম কে উচ্চারণ করেছিল জানি না, তবে তাকে আমি দোষ দিতে চাই না। কারণ সে-রাতে শেষ পর্যন্ত যা হয়েছিল তার জন্যে আমরা কেউই দায়ী ছিলাম না। দায়ী ছিল একমাত্র নিয়তি।
ঘটনার শুরু সায়েন্স কলেজের ক্যান্টিনের আড্ডা থেকে।
পি-কে-সি-র ক্লাস কেটে আমরা পাঁচজন চায়ের কাপ সামনে রেখে ‘টাইটানিক’ নিয়ে তুমুল তর্ক করছিলাম। বিষয় ছিল, কেট উইনস্লেট বেশি সুন্দর দেখতে, না মাধুরী দীক্ষিত।
হঠাৎই রমেশ তিওয়ারি বলে উঠল, ‘পরশু আমি জুমেলিয়াকে স্বপ্নে দেখেছি—।’
আমাদের আড্ডা ‘ঝুপ’ করে থেমে গেল। সবাই চুপ।
কারণ জুমেলিয়া তিনমাস আগে অ্যাকসিডেন্টে মারা গেছে।
ও আমাদের সঙ্গেই পড়ত। মাস তিনেক আগে আমরা, মানে বি.টেক. থার্ড ইয়ারের স্টুডেন্টরা, শৌনকদের মাইকেলনগরের বাগানবাড়িতে পিকনিক করতে গিয়েছিলাম। দলে আমরা মোট সতেরোজন ছিলাম। পিকনিকটা ছিল একেবারেই আমাদের নিজেদের ব্যাপার—ফলে কোনও স্যার-ট্যার সঙ্গে যাননি। শীতের ছুটির দিনটা আমাদের দারুণ কেটেছিল।
টেপ রেকর্ডার চালিয়ে দিয়ে নাচ-গান। স্যারদের ক্যারিকেচার। ব্যাডমিন্টন, তাস, জমাটি আড্ডা। একটু-আধটু নেশা করা। তারপর কবজি ডুবিয়ে মাংস-ভাত। দিনটা সবাই দারুণ এনজয় করেছিল।
তা ছাড়া শৌনকদের বাগানবাড়িটাও ছিল চমৎকার। বিশাল গাছ-গাছালির বাগান, আর তার সঙ্গে প্রকাণ্ড মাপের দোতলা বাড়ি। কলকাতায় যে-নির্জনতার দেখা পাওয়াই ভার, এখানে তাকে দ্যাখে কে! তাই হারিয়ে যাওয়ার কোনও মানা ছিল না। জোড়ায়-জোড়ায় অনেকে হারিয়েও গেছি।
দিনটা আমার স্পষ্ট মনে আছে দুটি কারণে।
সেদিন আমি সুছন্দাকে প্রথম চুমু খেয়েছিলাম।
আর, ফেরার সময় যশোর রোডের ওপর জুমেলিয়া অ্যাকসিডেন্টে মারা যায়।
সেদিন ওর সিগারেট খাওয়ার ঝোঁক চেপেছিল। একে তো পিকনিকে হুল্লোড় করে এক-দু-পেগ খেয়ে একটু টিপসি ছিল, তার ওপর একটু জেদি—তাই ফেরার পথে জেদ ধরল এক্ষুনি ওর ক্লাসিক সিগারেট চাই।
আমাদের কারও সঙ্গে ক্লাসিক ছিল না। আমরা অন্য ব্র্যান্ড ওকে দিতে চাইলাম। কিন্তু ওর সেই এক কথা, ‘আমার বাপি ক্লাসিক ছাড়া খায় না—আমারও ওই চাই—রাইট নাউ। সো স্টপ দ্য ব্লাডি বাস।’
বাস থামিয়ে জুমেলিয়া একা-একাই নেমে পড়েছিল। রাস্তা পার হয়ে গিয়েছিল একটা পান-সিগারেটের দোকানে। তারপর ফেরার সময় একটা ট্রাক ওর সিগারেট খাওয়ার সাধ চিরজীবনের মতো শেষ করে দিল।
ট্রাকটার একটা হেডলাইট খারাপ ছিল, আর জুমেলিয়ার নজর ছিল ঝাপসা! ফলে চোখের পলকে সব শেষ হয়ে গেল।
জুমেলিয়ার সঙ্গে আমাদের ক্লাসের বাপ্পাদিত্যর ‘ইয়ে’ আছে। কিন্তু বাপ্পা নিজেও সেদিন একটু-আধটু আউট ছিল। তার ওপরে জুমেলিয়া হল বড়লোক বাবা-মায়ের একমাত্র মেয়ে—আদুরে এবং জেদি। সুতরাং ওর ভবিতব্য কেউ বদলাতে পারেনি।
নির্জন শীতের রাস্তায় সেই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা আমাদের সাঙ্ঘাতিক এক ধাক্কা দিয়েছিল। আমরা পাথর হয়ে গিয়েছিলাম।
বাপ্পাদিত্য প্রায় দু-মাস পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিল। তারপর কোনওরকমে সামলে উঠেছে। এখনও ও প্রায়ই আনমনা হয়ে পড়ে, ক্লাসের পড়ায় মনোযোগ দিতে পারে না। সবকিছু ভীষণ ভুলে যায়। অথচ ও পড়াশোনায় দারুণ ছিল। বি. টেক. পার্ট ওয়ান আর পার্ট টু মিলিয়ে ওর র্যাঙ্ক সেকেন্ড। জানি না, ফাইনাল ইয়ারে কীরকম রেজাল্ট করবে।
জুমেলিয়ার থেঁতলানো দেহটা এখনও আমার চোখের সামনে ভাসে। ওর ফরসা সুন্দর মুখটা অটুট ছিল। গাড়ির হেডলাইটের আলোয় ওর মুখ দেখে মনেই হয়নি ও আর নেই। ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি। অপলক দু-চোখে অনেক সাধ ও স্বপ্ন। আর ঠোঁটের বাঁদিকে ছোট্ট কালো জড়ুলটা বরাবরের মতোই সুন্দর। বাপ্পা ওই জড়ুলটার জন্যে পাগল ছিল।
আমরা পাঁচজনই সেই পিকনিকে ছিলাম। আমি, বাপ্পা, রমেশ তিওয়ারি, শৌনক, আর ঐন্দ্রিলা।
রমেশের কাণ্ডজ্ঞান বেশ কম। যখন যা মনে হয় হুটহাট করে বলে দেয়। যেমন, এখন। বাপ্পার অবস্থা জেনেশুনেও ও ফস করে জুমেলিয়ার কথা তুলে বসল। তা ছাড়া, আমরা অনেকেই জানি, জুমেলিয়ার ব্যাপারে তিওয়ারির ইন্টারেস্ট ছিল। ভালো করে বাংলা শেখার জন্যে ও আমাকে আড়ালে বহুবার ধরেছে। বলছে ‘রঙ্গন, ইয়ার, আমাকে দো-তিন বাংলা লাভ ডায়ালগ শিখিয়ে দে।’
আমি হেসে জানতে চেয়েছি ‘কেন? কোথায় অ্যাপ্লাই করবি?’
জুমেলিয়ার কথা তিওয়ারি আর বলতে পারেনি। কারণ ও জানত, বাপ্পাকে আমরা সবাই ভালোবাসি। এমনকী ঐন্দ্রিলাও বাপ্পাকে মনে মনে চাইত। পরে শৌনকের সঙ্গে ওর রিলেশান হয়।
তিওয়ারি জুমেলিয়ার কথা বলামাত্রই আমাদের আলোচনার বিষয় পালটে গেল। আলোচনা শুরু হল পিকনিক আর জুমিকে নিয়ে।
আমার খুব অস্বস্তি হচ্ছিল। মনে-মনে চাইছিলাম এ-আলোচনা বন্ধ হোক, কিন্তু তা হয়নি। ধাপে-ধাপে আলোচনা পৌঁছে গেল আত্মা, প্রেতাত্মা, প্ল্যানচেট, সিয়াঁস, প্রেতচক্র, এইসবের দিকে। তবে ‘প্ল্যানচেট’ শব্দটা প্রথম কে উচ্চারণ করেছিল তা আমার মনে নেই।
ঐন্দ্রিলা এক চুমুকে চায়ের কাপ শেষ করে বলল, ‘আমার বড়জেঠু ছোটবেলায় খুব প্ল্যানচেট করতেন। নামকরা সব লোকদের নাকি ডেকে আনতেন। একবার নাথুরাম গডসে-কে ডেকেছিলেন। তখন অন্ধকার ঘরের মধ্যে গুলির শব্দ শুনেছিলেন—।’
শৌনিক হো-হো করে হেসে উঠে বলল, ‘যত্ত সব লাটাই-ঘুড়ি। আর-একটু তোল্লাই দিলেই বলবি মহাত্মা গান্ধীর ”হা রাম!” কথাটাও তিনি শুনতে পেয়েছিলেন।’
ঐন্দ্রিলা রীতিমতো খেপে গিয়ে বলে উঠল, ‘প্ল্যানচেটের তুই কী বুঝবি! তোর কাছে তো সবকিছু ট্যান হয়ে বেরিয়ে যায়।’
আমি ওদের শান্ত করার জন্যে বললাম, ‘তোরা যা-ই বল, প্ল্যানচেট ব্যাপারটা বোধহয় একেবারে বোগাস নয়। আমি একজনকে জানি…।’
বাপ্পা আমাকে বাধা দিল : ‘আমি জুমিকে প্রায়ই স্বপ্নে দেখি। কিছুতেই ওকে ভুলতে পারছি না।’
কথা বলতে-বলতেই বাপ্পা মাথা নীচু করল, চোখ বুঝে চোখের কোণ আঙুলে টিপে ধরল। ওর পিঠটা বারবার কেঁপে উঠতে লাগল। বুঝতে কোনও অসুবিধে হল না যে বাপ্পা, কাঁদছে।
ঐন্দ্রিলা বাপ্পার পিঠে হাত বুলিয়ে দিল, বিষণ্ণ গলায় বলল, ‘অন্য কথা ভাবার চেষ্টা কর। জুমি তো আর নেই। ওর কথা ভেবে শুধু শুধু কষ্ট পাচ্ছিস।’
আমি আর শৌনক বাপ্পাকে বোঝাতে লাগলাম। ওর মনটা বড্ড নরম আর সাদাসিধে—ঠিক কচি কলাপাতার মতো—অল্পেতেই আঁচড় পড়ে যায়।
অনেকক্ষণ পর বাপ্পা নিজেকে সামলে নিয়ে ভারী গলায় বলল, ‘আমার কপালটাই খারাপ! জুমিকে যদি একটিবার দেখতে পেতাম!’
শৌনক আনমনা হয়ে কী যেন ভাবছিল। হঠাৎই ও ক্যান্টিনের বেঞ্চি ছেড়ে উঠে এল বাপ্পার খুব কাছে। তারপর সিরিয়াস গলায় বলল, ‘তোকে একটা কথা জিগ্যেস করব?’
বাপ্পা অবাক হয়ে মুখ তুলে তাকাল ওর দিকে। আমরাও খানিকটা বিমূঢ় হয়ে চেয়ে রইলাম শৌনকের চোখে।
শৌনক আবার বলল, ‘একটা কথা তোকে জিগ্যেস করব?’
‘কী কথা?’ বাপ্পা জানতে চাইল।
জুমেলিয়াকে একবার দেখতে পেলেই তোর সাধ মিটবে?’
বাপ্পা অস্বাভাবিক ঝটকায় মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ—।’
রমেশ এতক্ষণ গোবেচারাভাবে এর-ওর মুখের দিকে তাকাচ্ছিল, এইবার বলে উঠল, ‘ক্যায়সে দেখা যাবে?’
আমি আর ঐন্দ্রিলাও মুখে-চোখে একই প্রশ্ন ফুটিয়ে চেয়ে রইলাম শৌনকের দিকে।
শৌনক বাপ্পাকে আড়াল করে ঐন্দ্রিলার দিকে তাকিয়ে ষড়যন্ত্রের হাসি হাসল। তারপর বলল, ‘আমরা পাঁচজন মিলে প্ল্যানচেটে বসব। ঐন্দ্রিলা মিডিয়াম হবে। জুমেলিয়ার সঙ্গে ওর ভালোরকম দোস্তি ছিল। সুতরাং আমার বিশ্বাস, প্ল্যানচেটে জুমেলিয়া দেখা দেবে।’
আমি কেমন যেন হতভম্ব হয়ে গেলাম। একটু আগেই যে প্রেতচক্র নিয়ে ঐন্দ্রিলাকে ঠাট্টা-তামাসা করে নাজেহাল করছিল সে হঠাৎ সিরিয়াসলি প্রেতচক্রের কথা ভাবছে! আর শুধু তা-ই নয়, জুমেলিয়া যে দেখা দেবে সে-কথাও প্রায় নিশ্চিতভাবে বলছে!
আমি ইতস্তত করে বললাম, ‘আমি ওতে নেই। প্ল্যানচেটের ব্যাপারে আমার ফান্ডা নেই।’
তিওয়ারি বলল, ‘রঙ্গন, তুই বেকার ঘাবড়াচ্ছিস। ভূতে আমার জবরদস্ত ফান্ডা আছে।’
পৃথিবীতে হেন কোনও বিষয় নেই যাতে রমেশ তিওয়ারির ফান্ডা নেই। সাধে কি আমরা ওকে ‘ফান্ডামেন্টাল তিওয়ারি’ বলে খ্যাপাই!
ঐন্দ্রিলা বলল, ‘তিওয়ারির ফান্ডার ওপরে ঠিক রিলাই করা যাবে না। রঙ্গন, তুই ব্যাপারটা নিয়ে একটু পড়াশোনা কর। আমি তোকে প্রচুর বইপত্র দেব। তোর হোমটাস্ক হয়ে গেলে আমরা কাজে নামব।’
আমি বাপ্পাকে দেখছিলাম। ওর মুখচোখে এক অদ্ভুত উজ্জ্বল আভা ফুটে উঠেছে। জুমেলিয়াকে একটিবার দেখার জন্যে ও সত্যিই পাগল হয়ে গেছে।
তিওয়ারি বলল, ‘রঙ্গন পড়াশোনা করে করুক, হামি ভি থোড়াবহৎ স্টাডি করে আসব। কিন্তু কোথায় বসে প্ল্যানচেট করবি?’
আমরা মুখ চাওয়া-চাওয়ি শুরু করতেই শৌনক বলল, ‘মাইকেলনগরে আমাদের বাগানবাড়িতে হবে। জায়গাটা জুমির হেবি পছন্দ ছিল।’
আমি বললাম, ‘প্ল্যানচেটের ব্যাপারটা রাতে হলেই ভালো হয় বলে শুনেছি। যদি সেটাই হয়, তা হলে সে-রাতে আমরা ফিরতে পারব না। ঐন্দ্রিলা কি আমাদের সঙ্গে থাকতে পারবে? কাকিমা কি পারমিশান দেবেন?’
শৌনক অন্যরকম করে হাসল, বলল, ‘আমি যখন আছি তখন পারমিশান পাওয়া যাবে। আমরা তো ফাইনাল পরীক্ষার পরই সেটল করব। কী বল, মিতি?’
‘মিতি’ ঐন্দ্রিলার ডাকনাম। শৌনক মাঝে-মাঝে ওকে এই নামে ডাকে। মজা করে বলে, ‘ওর ডাকনামটা জ্যামিতি থেকে এসেছে।’
ঐন্দ্রিলা বলল, ‘মাম্মির প্ল্যানচেটের ব্যাপারে খুব ইন্টারেস্ট। তা ছাড়া জুমিকে চিনত। জুমি আমাদের বাড়িতে বেশ কয়েকবার গিয়েছিল। জুমিকে প্ল্যানচেট করা হবে শুনলে মাম্মি হয়তো আমার সঙ্গে যেতে চাইবে।’
শৌনক একেবারে হাততালি দিয়ে উঠল : ‘তা হলে তো দারুণ হবে! কাকিমার হাতের রান্না খাওয়া যাবে—ঠিক পিকনিকের মতন…।’
বাপ্পাদিত্য বিড়বিড় করে বলল, ‘জুমেলিয়াকে যদি দেখাতে পারিস, ‘তোদের কাছে আমি এভার গ্রেটফুল থাকব।’
ঐন্দ্রিলা আমার দিকে আঙুল তুলে বলল, ‘রঙ্গন, কাল থেকে তোমার প্ল্যানচেটের প্রজেক্ট শুরু—কালই আমি বড়জেঠুর কাছ থেকে একগাদা বইপত্র চেয়ে নিয়ে আসব।’
ব্যাপারটা সেদিন পিকনিক গোছের শুনিয়েছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত মোটেই সেরকম হয়নি।
ঐন্দ্রিলার দেওয়া বইপত্র নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেছিলাম বটে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখলাম তার কোনও প্রয়োজন ছিল না। কারণ ঘটনার দিন ঐন্দ্রিলা ওর মায়ের সঙ্গে মাঝবয়েসি এক ভদ্রলোককে নিয়ে হাজির হল।
মাইকেলনগর যাওয়ার পথে তাঁর সঙ্গে আমাদের আলাপ-পরিচয় হল। ভদ্রলোকের নাম প্রিয়নাথ জোয়ারদার—ভূত-প্রেতের ব্যাপারে আগ্রহের সীমা নেই। প্রেতাত্মাচর্চায় একেবারে ওস্তাদ মানুষ। ঐন্দ্রিলার বড়জেঠুর খুব বন্ধু। আমাদের প্ল্যানচেটের মতলবের কথা জানতে পেরে নিজেই আগ বাড়িয়ে সঙ্গী হতে চেয়েছে।
প্রিয়নাথ জোয়ারদারের মাথায় কপাল থেকে শুরু করে বেশ বড় মাপের টাক, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, দীর্ঘ সৌম্যকান্তি ফরসা চেহারা। পরনে গাঢ় রঙের প্যান্ট আর নীল-সাদা স্ট্রাইপ দেওয়া শার্ট। পুরু ঠোঁটে সিগারেট।
ওঁকে দেখে সিনেমা বা নাটকের লোক বলে মনে হয়। ভূত-প্রেতের সঙ্গে ওঁর যে কোনওরকম সম্পর্ক থাকতে পারে তা অনুমান করা এককথায় অসম্ভব।
এরকম একজন বিচিত্র সঙ্গী পেয়ে মাইকেলনগর যাওয়ার পথে সময়টা দারুণ কাটল।
প্রিয়নাথের ভরাট গলা, আর কথাও বলেন ভারী চমৎকার। আমরা জুমির ব্যাপারটা ওঁকে জানিয়েছিলাম। এখন জুমিকে ঘিরে নানা ঘটনার কথা বলছিলাম। শুধু বাপ্পা চুপচাপ বসে ছিল, আর ঐন্দ্রিলাও ওর মায়ের পাশে বসে কেমন যেন আনমনা, উদাস—দেখে মনে হচ্ছিল, ভেতরে-ভেতরে জটিল কোনও অঙ্ক কষছে।
প্রিয়নাথ তখন বলছিলেন, ‘জানো তো, ভূতচর্চা করি বলে সবাই আমার নাম দিয়েছে ভূতনাথ। তবে ওতে আমি কিছু মাইন্ড করি না। কোনও কিছু নিয়ে গবেষণা করাটা তো আর খারাপ না! এই ধরো না, এ-লাইনে না এলে আমি মাইকেল ফ্যারাডের ভূতের কথা জানতেই পারতাম না…।’
‘মাইকেল ফ্যারাডের ভূত!’ তিওয়ারি আর আমি অবাক হয়ে বললাম।
প্রিয়নাথ হেসে বললেন, ‘হ্যাঁ, শুনতে অবাক লাগলেও মাইকেল ফ্যারাডের ভূত। ব্যাপারটা প্রথম রিপোর্টেড হয় ১৯৬২ সালে। রিপোর্ট করেছিলেন লন্ডনের ইম্পিরিয়াল কলেজের হেভি ইলেকট্রিক্যাল এঞ্জিনিয়ারিং-এর অধ্যাপক ডক্টর এরিক লেইথওয়েট। লন্ডনের রয়্যাল ইন্সটিটিউশনে তিনি বক্তৃতা দিতে গিয়েছিলেন। বক্তৃতা দেওয়ার সময় তিনি হঠাৎ টের পেলেন তাঁর কাছে ফ্যারাডের ছায়া-শরীর দাঁড়িয়ে আছে। ফ্যারাডের প্রেত তাঁকে যেন বলল, ”নাউ ইটস অলরাইট, ল্যাড। য়ু আর ডুয়িং ফাইন।” লেইথওয়েট যখন অন্য বিজ্ঞানীদের এ-কথা জানালেন, তখন অনেকেই স্বীকার করেন যে, তাঁদেরও একইরকম অভিজ্ঞতা হয়েছে। তোমারা নিশ্চয়ই জানো, ১৮১৩ সালে রয়্যাল ইন্সটিটিউশনে ফ্যারাডে স্যার হামফ্রি ডেভির ল্যাবরেটারি অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে কাজ করতেন। পরে, ১৮৩৩ সালে, তিনি ডেভির জায়গায় প্রফেসর অফ কেমিস্ট্রি হয়েছিলেন।’
হাতের সিগারেটে বেশ কয়েকবার টান দিয়ে প্রিয়নাথ সেটা গাড়ির জানলা দিয়ে ফেলে দিলেন। তারপর হেসে বললেন, ‘লেইথওয়েটের ব্যাপারটা ওখানেই শেষ হয়নি। ১৯৬৪ সালে ক্রিসমাসের ছুটিতে লেইথওয়েট আবার রয়্যাল ইন্সটিটিউশনে যান। উদ্দেশ্য ছিল, স্কুলের ছেলেমেয়েদের জন্যে বেশ কয়েকটি বক্তৃতা দেওয়া। এ-ধরনের বক্তৃতামালার ব্যাপারটা ফ্যারাডে নিজেই একসময় শুরু করেছিলেন। তো বক্তৃতার মাঝে একদিন লেইথওয়েট দর্শকদের সামনে একটা পরীক্ষা সরাসরি করে দেখাতে চাইলেন। দুটো তারের কয়েল নিয়ে একটা ইলেকট্রিক্যাল এক্সপেরিমেন্ট। এক্সপেরিমেন্টটা ঠিকঠাক হলে কয়েলে কারেন্ট পাঠানোমাত্রই একটা প্লেট থেকে একটা বল ছিটকে লাফিয়ে উঠবে। আর যদি ঠিক সময়ে কারেন্ট পাঠানো না হয় তা হলে বলটা প্লেটের ওপরে শুধু এপাশ-ওপাশ ঠকঠক করে কাঁপবে—লাফিয়ে উঠবে না।
‘তো লেইথওয়েট দু-বার পরীক্ষাটা করার চেষ্টা করলেন, কিন্তু সাকসেসফুল হলেন না। এটা কোনও অস্বাভাবিক ব্যাপার না—কারণ, লেইথওয়েট অঙ্ক কষে দেখেছিলেন এক্সপেরিমেন্টটা ৬৯৬ বার চেষ্টা করলে একবার মাত্র সফল হওয়া সম্ভব। সুতরাং তিনি আবার এক্সপেরিমেন্ট শুরু করার তোড়জোড় করতে লাগলেন। ঠিক তখনই একটা বিচিত্র ঘটনা ঘটল। লেইথওয়েটের কানে কে যেন ফিসফিস করে বলল, তৃতীয়বারে এক্সপেরিমেন্টটা সাকসেসফুল হবে। ইচ্ছে করলে লেইথওয়েট আগেভাগেই সেটা দর্শকদের জানিয়ে দিতে পারেন। লেইথওয়েট ভীষণ অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু কী ভেবে তিনি সত্যি সত্যিই দর্শকদের আগাম জানিয়ে দিলেন যে, এইবার পরীক্ষাটা সফল হবেই।’
একটু থামলেন প্রিয়নাথ। তারপর ছোট্ট করে হেসে বললেন, ‘সত্যি-সত্যিই থার্ডবারে এক্সপেরিমেন্টটা সাকসেসফুল হয়েছিল।’
কাকিমা—মানে, মিতির মা—জিগ্যেস করে বসলেন, ‘কানে-কানে কে ওইরকম কথা বলেছিল?’
প্রিয়নাথ এবার শব্দ করে হাসলেন : ‘সেটাও কি আর বলতে হবে!’
আমি মাইকেল ফ্যারাডের কথা ভাবছিলাম, কোথা থেকে জুমি তার মধ্যে ঢুকে পড়ল। আমি যেন স্পষ্ট শুনতে পেলাম জুমেলিয়া আমাকে বলছে, ‘চটপট কর— তোদের সঙ্গে দেখা করার জন্যে আমি যে ছটফট করছি।’
প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই যশোর রোড থেকে বাঁদিকে বাঁক নিয়ে আমাদের গাড়ি মাইকেলনগরে ঢুকে পড়ল।
অন্ধকার কখন যেন পা টিপে-টিপে নেমে এসেছে। রাস্তার সামান্য আলো কিংবা ছোটখাটো দোকানপাটের আলো তাকে ঠেলে দূরে সরিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। কিন্তু আমার মনে হল, অন্ধকার যেন শিকারি বাঘের মতো গাছ-গাছালির মাথায় ওত পেতে অপেক্ষা করছে—সুযোগ পেলেই ঝাঁপিয়ে পড়ে সব গ্রাস করবে।
প্রিয়নাথ বললেন, ‘তোমরা সবাই জুমেলিয়ার কথা ভাবো। প্ল্যানচেট সাকসেসফুল হওয়ার জন্যে এটা খুব জরুরি।’
শৌনক বলল, ‘আমরা তো রাত দশটায় বসব। তা হলে এখন থেকেই ভাবার কী দরকার।’
মিতি ওকে প্রায় বকুনি দিয়ে বলল, ‘এসব ব্যাপারে আঙ্কল এক্সপার্ট। আঙ্কল যা বলেন তা-ই শুনবি।’
তিওয়ারি বলল, ‘আমি কিন্তু শুরুসেই তনমন দিয়ে জুমির কথাই ভাবছি। খেয়াল করেছিস, আমরা ওর অ্যাক্সিডেন্টের স্পটের ওপর
দিয়েই এলাম।’
ব্যাপারটা আমিও খেয়াল করেছি, কিন্তু ইচ্ছে করেই সে-কথা আর মুখে উচ্চারণ করিনি। কিন্তু রমেশটার তো কাণ্ডজ্ঞান নেই। দেখলাম, বাপ্পা দু-হাতে মুখ ঢেকে মাথা ঝুঁকিয়ে বসে আছে।
শৌনকদের বাগানবাড়ির পাশের মাঠে গাড়ি রেখে আমরা লোহার সদর দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। শৌনকের ডাকে বাগানবাড়ির কেয়ারটেকার মতিলাল এসে তালা খুলে দিল। দরজার পাল্লা ঠেলতেই গা-শিউরে-ওঠা ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ হল।
আমি অবাক হয়ে ভাবছিলাম, মাত্র তিনমাস আগে এই বাগানবাড়িতে এসে আমরা কত হইহুল্লোড় করে গেছি। তখন জায়গাটাকে দারুণ লেগেছিল। অথচ আজ এখানে ঢুকতেই কীরকম যেন গা ছমছম করছে।
বাগানের গাছ-গাছালির পাশ দিয়ে এগোতে-এগোতে শৌনক প্রিয়নাথকে লক্ষ্য করে বলল, ‘আঙ্কল, আজ আমাদের মিশন-সাকসেসফুল হবেই।’ তারপর ঐন্দ্রিলার দিকে তাকিয়ে : ‘কী বল, মিতি?’
ঐন্দ্রিলা আনমনাভাবে বলল, ‘হ্যাঁ, হতেও পারে।’
প্রিয়নাথ শৌনককে জিগ্যেস করলেন, ‘তুমি কী করে এত শিওর হচ্ছ বলো তো? তুমি কি কিছু ফিল করছ? অনেক সময় প্রেতাত্মারা আসার আগে মনের ওপর ছাপ ফেলে জানান দেয়।’
শৌনক খানিকটা বিব্রতভাবে বলল, ‘না, সেরকম কিছু না—এমনি মনে হচ্ছে।’
প্রিয়নাথ আর কোনও কথা বললেন না। তবে ওঁর কপালে কয়েকটা ভাঁজ যেন চোখে পড়ল।
আমরা শৌনকদের বাড়িতে ঢুকে পড়লাম।
প্রায় দেড়কাঠা জুড়ে দোতলা বাড়ি। শৌনকের দাদুর নামে বাড়িটার নাম রাখা হয়েছে ‘ভুজঙ্গ নিবাস।’ বাড়িটার বয়েস তিরিশ-পঁয়ত্রিশ বছর হবে। বাড়িতে ঢুকেই কাকিমা আর মিতি রান্নাঘরের দিকে রওনা হল। প্রথমে আমাদের চা-জলখাবারের ব্যবস্থা, তারপর রাতের আয়োজন। আমরা সাতজন যে আজ এখানে আসব, থাকব, সে-কথা মতিলালকে আগেই টেলিফোনে বলা ছিল। তাই সব ব্যবস্থা ও আগেই করে রেখেছিল। কিন্তু কাকিমা আর মিতি রান্নাঘরের দিকে রওনা হতেই প্রিয়নাথ ওদের ডাকলেন : মিসেস ঘোষ, এক মিনিট—একটু দাঁড়িয়ে যান।’
প্রিয়নাথ আঙ্কলকে ঘিরে আমরা ছ’জন দাঁড়িয়ে পড়লাম। ওঁর কথা শোনার জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলাম। বালবের আলোয় বিশাল হলঘরে আমাদের লম্বা লম্বা ছায়া পড়েছে।
প্রিয়নাথ কখন যেন আমাদের দলপতি হয়ে পড়েছেন। একটু কেশে নিয়ে হাতঘড়ি দেখে তিনি বললেন, ‘এখন ছ’টা বাজে। ঠিক ন’টায় আমরা খেতে বসব। সেই বুঝে রান্নাবান্না করবেন। আর ঠিক দশটায় আমরা প্রেতচক্র শুরু করব। এ ছাড়া আর-একটা কথা—এখন থেকে প্রতিটি মুহূর্ত আমরা জুমেলিয়ার কথা ভাবব, ওকে নিয়ে আলোচনা করব। তা হলে ও বুঝতে পারবে, ওকে আমরা আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। আমি আগে গোটা বাড়িটা একটু ঘুরে দেখে নিই, তারপর ঠিক করব কোন ঘরে বসলে আমাদের কাজের সুবিধে হবে। ব্যস, এবার আপনারা রান্নাঘরে যান। তবে সময়টা মনে রাখবেন—রাত ঠিক দশটায় কাঁটায়-কাঁটায়।’
কাকিমা আর মিতি চলে যেতেই প্রিয়নাথ আমাদের বললেন, ‘তোমরা বাড়িটায় ঘুরে ফিরে বেড়াতে পারো, বই-টই পড়তে পারো, এ-ঘরে টিভি দেখতে পারো—শুধু বাড়ির বাইরে কোথাও যাবে না—এমনকী বাগানেও না। আর শৌনক, তুমি আমার সঙ্গে একটু থাকো, আমাকে একটু হেল্প করো।’
প্রিয়নাথ সঙ্গে করে মাঝারি মাপের একটা ব্রিফকেস নিয়ে এসেছিলেন। সেটা দেখে মিতি কী জিগ্যেস করতেই তিনি হেসে বললেন, ‘ওতে ভূত নামানোর সরঞ্জাম আছে। আবার অনেক সময় ভূত তাড়ানোর জিনিসপত্তরও থাকে।’
ব্রিফকেসটা হলঘরের একপাশে রাখা ছিল। সেটা হাতে নিয়ে প্রিয়নাথ শৌনকের সঙ্গে বাড়ি পরিদর্শনের কাজে এগোলেন।
ঠিক তখনই এরোপ্লেনের শব্দ শুনতে পেলাম।
শৌনকদের বাগানবাড়িটা এয়ারপোর্টের এত কাছে যে, সবসময়ই এরোপ্লেন ওঠা-নামার বিকট শব্দ শোনা যায়।
বাপ্পাদিত্য হলঘরের একটা খোলা জানলার সামনে বসে ছিল। লক্ষ করলাম, জানলার বাইরেটা এখন অন্ধকার হয়ে গেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও বাপ্পা বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে কী যেন দেখতে চেষ্টা করছে।
তিওয়ারি হলঘরে অস্থিরভাবে পায়চারি করছিল। হঠাৎই আমার কাছে এসে বলল, ‘অ্যাই, রঙ্গন—কুছ টের পাচ্ছে?’
আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘না তো!’
ও চাপা গলায় বলল, ‘আমি টের পাচ্ছে। আমি ঘরের ওই কোণটায় গিয়েছিল—ওই আলমারিটার পাশে। তো শুনলাম, কে যেন খুব সফটলি বলল, ”রমেশ, আমি তোকে ফোন করব।” কী বলব তোকে…একদম স্পষ্ট জুমেলিয়ার গলা। রঙ্গন, ইয়ার, মেরা তো ডর লগ রহা হ্যায়।’
আমি তিওয়ারিকে ইশারায় চুপ করতে বললাম। আমার ভয় হচ্ছিল, বাপ্পা এ-কথা শুনতে পেলে আপসেট হয়ে পড়বে। কিন্তু তিওয়ারি কি ভুল বকছে? আমি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ভয়ের ছাপ দেখতে পেলাম। তাই সাহস দেওয়ার জন্যে বললাম, ‘ভয়ের কিছু নেই। প্রিয়নাথ আঙ্কল আমাদের সঙ্গে আছেন।’
তিওয়ারিকে দেখে মনে হল না খুব একটা ভরসা পেল। ও তাড়াতাড়ি গিয়ে টিভির সুইচ অন করে দিল। তারপর একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে পড়ল টিভির সামনে।
আমার কেমন অস্বস্তি হচ্ছিল। শৌনকদের বাড়িটা আজ কেমন যেন অদ্ভুত লাগছিল। এ-বাড়ির সব ঘরেই সাধারণ বালব—কোনও টিউব লাইট নেই। পিকনিকের দিন তাতে কোনও অসুবিধে হয়নি। কিন্তু আজ বালবের আলো কেমন মলিন রহস্যময় লাগছে। আর সেই সঙ্গে অদ্ভুত দীর্ঘমাপের বিকৃত সব ছায়া। আমাদেরই চেনা জিনিসের ছায়া, অথচ কেমন অচেনা লাগছে।
আবার একটা প্লেনের শব্দ শুনতে পেলাম।
মনে পড়ে গেল, জুমিরা গত বছর প্লেনে করে আন্দামান বেড়াতে গিয়েছিল।
কী আশ্চর্য! আমরা দেখছি ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় যে-কোনও প্রসঙ্গে জুমেলিয়াকে জড়িয়ে ফেলছি! তিওয়ারি কি তা হলে টেলিফোনের কথা ভাবছিল? ফার্স্ট ইয়ারে পড়ার সময় ও প্রায়ই জুমিকে ফোন করত।
এমন সময় টেলিফোনের রিং শুনতে পেলাম। দোতলায় ফোন বাজছে। তিওয়ারি আর বাপ্পাকে বলে আমি দোতলায় রওনা হলাম। রাত যত ঘন হচ্ছে, ততই যেন শীত-শীত ভাবটা বাড়ছে। অথচ পথে আসার সময় শীত খুব একটা টের পাওয়া যায়নি।
সিঁড়ি দিয়ে উঠে সামনেই একটা ছোট মাপের ঘর। সে-ঘরেই টেলিফোনটা রাখা আছে। ঘরে পা দিয়েই দেখি শৌনক রিসিভার হাতে দাঁড়িয়ে। আমাকে দেখেই চোখ টিপে বলল, ‘নে, তোর ফোন। সুছন্দা।’
সুছন্দা এখানে ফোন করবে জানতাম। তাই টেলিফোনের শব্দ পেয়েই ওপরে রওনা হয়েছিলাম। ফোনে কথা বলতে-বলতেই নজরে পড়ল, পাশের ঘরে প্রিয়নাথ ব্যস্তভাবে চলাফেরা করে কীসব করছেন। শৌনকের দিকে তাকাতেই ও ইশারা করে বলল। ওই ঘরটাকেই প্রিয়নাথ প্ল্যানচেটের জন্যে পছন্দ করেছেন।
আমি জানি, ওই ঘরটার পরেই আছে লম্বা বারান্দা। আর তার পাশেই কাদের যেন বিশাল বাগান। সেই বাগান গাছ আর আগাছা সমান দাপটে রাজত্ব করে।
সুছন্দার সঙ্গে কথা বলতে-বলতে আমি খোলা জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিলাম। অন্ধকারে জোনাকি পোকার আলো চোখে পড়ছিল। আর কেন জানি না, জুমেলিয়ার কথা খুব মনে পড়ছিল।
বালবের আলোয় দেওয়ালে আমার ছায়া নড়ছিল। সেই বিচিত্র ছায়ার দিকে তাকিয়ে আমার মন হঠাৎই বলে উঠল, ‘আজ রাতে জুমির সঙ্গে দেখা হবে।’
অন্ধকারে, হাতে হাত ধরে আমরা জুমেলিয়ার জন্যে অপেক্ষা করছিলাম।
একটা টেবিলকে ঘিরে আমরা ছ’জন চুপচাপ বসেছিলাম, আর প্রিয়নাথের নির্দেশমতো জুমেলিয়ার কথা ভাবছিলাম।
ঘরের সব জানলা-দরজা বন্ধ। এক কোণে একটা কাঠের বাক্সের আড়ালে একটা বড় মোমবাতি জ্বলছে। মোমবাতির আলো দেওয়ালে পড়ে আবছা একটা আলোর আভা তৈরি করেছে। আলোটা যাতে মলিন হয় সেজন্যে প্রিয়নাথ আড়ালের ব্যবস্থা করেছেন। আমাদের সামনে টেবিলে একটা ডিজিটাল থার্মোমিটার আর কম্পাস রয়েছে। মাঝে-মাঝে পেনসিল-টর্চ জ্বেলে প্রিয়নাথ সে-দুটোর রিডিং দেখছেন। প্রিয়নাথের পাশেই বসেছে বাপ্পাদিত্য—ওর সামনে একটা বড় সাদা কাগজ আর পেনসিল।
প্রিয়নাথ ফিসফিস করে বললেন, ‘বাপ্পা, আমি বললেই তুমি পেনসিলটা হাতে তুলে নেবে, আলতো করে ধরে রাখবে কাগজের ওপরে—যাতে ইচ্ছাশক্তি দিয়ে কেউ তোমাকে দিয়ে কিছু লিখিয়ে নিতে পারে।’
বাপ্পা চাপা গলায় বলল, ‘ঠিক আছে। কিন্তু পেনসিল ধরতে গেলে তো আমাকে রঙ্গনের হাত ছেড়ে দিতে হবে!’
‘ছেড়ে দেবে।’ প্রিয়নাথ তারপর আমাকে উদ্দেশ করে বললেন, ‘রঙ্গন, তুমি তখন বাপ্পাকে টাচ করে থাকবে।’
বাপ্পার ডানপাশ থেকে আমি জবাব দিলাম, ‘ও. কে.।’
‘ব্যস, আর কোনও কথা নয়—।’
শৌনক জিগ্যেস করল, ‘আমিও কি কাগজ-পেনসিল নেব?’
প্রিয়নাথ সিদ্ধান্তের সুরে বললেন, ‘না।’ একটু থেমে তারপর : ‘আমি নাম ধরে না ডাকলে কেউ সাড়া দিয়ো না। মিসেস ঘোষ, আপনিও না।’
আবার সব চুপচাপ।
একটা ব্যাপার আমার অদ্ভুত লাগছে। যে-শৌনক কখনও ভূত-প্রেতে বিশ্বাস করে না, সবসময় প্ল্যানচেট ইত্যাদি নিয়ে রঙ্গ-ব্যঙ্গ করে, সে যেন এই প্ল্যানচেটের ব্যাপারে এসে থেকেই অতি-আগ্রহ দেখাচ্ছে। আর বারবার বলছে, আমাদের মিশন সাকসেসফুল হবেই।
ঐন্দ্রিলা আমাদের সঙ্গে হাত ধরাধরি করে বসে নেই। কারণ, ও মিডিয়াম হয়েছে। প্রিয়নাথ ওকেই মিডিয়াম হিসেবে বেছে নিয়েছেন। কাকিমা এ-ব্যাপারে সামান্য খুঁতখুঁত করলেও শৌনক আর ঐন্দ্রিলার উৎসাহের কাছে তাঁর অনিচ্ছা ভেসে গেছে। তা ছাড়া প্রিয়নাথ বলেছেন, আমাদের মধ্যে ঐন্দ্রিলাই সবচেয়ে ভালো মিডিয়াম হবে—কারণ, ও জুমেলিয়ার সমবয়েসি মেয়ে।
ঘরের সবচেয়ে গাঢ় অন্ধকার অংশে মিতি স্থির হয়ে বসে আছে। ওকে দেখতে না পেলেও ওকে আমরা অনুভব করতে পারছি। ওর হাত দুটো সরু সাদা সুতো দিয়ে বেঁধে দিয়েছেন প্রিয়নাথ।
বাঁধার সময় তিওয়ারি বলেছে, ‘এ কাচ্চে ধাগে তো স্যার টান মারলেই ছিঁড়ে যাবে!’
প্রিয়নাথ উত্তরে বলেছেন, ‘ঐন্দ্রিলা তো আর নিজে-নিজে সুতো ছিঁড়বে না। যাকে আমরা ডাকছি সে যদি চায় তবেই সুতো ছিঁড়বে।’
আমরা চুপচাপ অপেক্ষা করতে লাগলাম। শুধু আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ শোনা যেতে লাগল। আর মাঝে-মাঝে এরোপ্লেনের শব্দ। তবে বুকের ভেতর একটা ঢিপঢিপ শব্দও যেন টের পাচ্ছিলাম।
হঠাৎই জোরে শ্বাস ফেলার মতো ‘ফোঁস’ করে একটা শব্দ হল। আর তারপরই আমাদের টেবিলটা সামান্য নড়ে উঠল।
প্রিয়নাথ সঙ্গে সঙ্গে পেনসিল-টর্চ জ্বেলে কম্পাস ও থার্মোমিটার দেখলেন। আমিও সেদিকে চোখ রাখলাম। কম্পাসের কাঁটা উত্তর দিকে মুখ করে স্থির হয়ে আছে, আর থার্মেমিটারে উষ্ণতা ১৯.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস—প্রেতচক্রে বসার আগে যা ছিল প্রায় তাই।
প্রিয়নাথ জোয়ারদার বলেছিলেন, কোনও প্রেতাত্মার উপস্থিতিতে কম্পাসের কাঁটা যে-কোনও দিকে মুখে করে অস্থিরভাবে ছটফট করতে থাকে। অনেক সময় বনবন করে পাক খায়। আর উষ্ণতা নামতে থাকে নীচের দিকে।
ফলে আমি একটু স্বস্তি পেলাম।
প্রিয়নাথ চাপা অথচ স্পষ্ট গলায় প্রশ্ন করলেন, ‘কেউ কি এসেছেন?’
কোনও উত্তর পাওয়া গেল না। তবে মনে হল যেন, আচমকা শ্বাস টানার একটা শব্দ পেলাম। তারপর সব চুপচাপ।
বাপ্পা বোধহয় টেনশান আর সইতে পারছিল না। প্রিয়নাথের নিষেধ না মেনে ও ফিসফিসে স্বরে প্রশ্ন করল, ‘কে, জুমি?’
আমাদের পাথর করে দিয়ে ফিসফিস করে কেউ জবাব দিল, ‘হ্যাঁ—।’
শব্দটা একটানা সুরে দীর্ঘশ্বাসের মতো বেরিয়ে এল। যেন বিশাল কোনও বেলুন থেকে ধীরে-ধীরে বাতাস বেরিয়ে যাচ্ছে।
প্রিয়নাথ উত্তেজিতভাবে ধমক দিয়ে বললেন, ‘বাপ্পা কী হচ্ছে!’ তারপর অন্ধকার লক্ষ্য করে আবার প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন, ‘কেউ কি এসেছেন?’
কোনও উত্তর পাওয়া গেল না।
কিন্তু পরক্ষণেই যা দেখলাম তাতে আমার চেতনায় কেউ যেন ভারী একটা হাতুড়ি দিয়ে নিষ্ঠুরভাবে আঘাত করল।
মিতি কখন যেন ওর চেয়ার ছেড়ে উঠে এসেছে। মোমবাতির আলোর সামান্য আভায় ওকে আবছাভাবে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু এ কোন মিতি!
ও কালচে রঙের একটা চুড়িদার পরেছিল—সেটা এখন ভৌতিক আলখাল্লার মতো লাগছে। ওর মুখে মূকাভিনেতাদের মতো সাদা রং মাখা। কেউ কি রং মাখিয়েছে, নাকি ভয় ফ্যাকাসে হয়ে ওর মুখের এই চেহারা দাঁড়িয়েছে! ওর মুখের সাদা রঙের জন্যেই ওর ঠোঁটের বাঁ দিকে একটা কালো জড়ুল নজরে পড়ল—ঠিক জুমেলিয়ার মতো। কিন্তু মিতির মুখে তো কোনও জড়ুল নেই! হঠাৎ করে এ-জড়ুল এল কোথা থেকে!
হাত দুটো বিচিত্র ভঙ্গিতে মাথার ওপরে তুলে মিতি এপাশ-ওপাশ দুলছিল। বড়-বড় শ্বাস ফেলতে-ফেলতে ও বাপ্পাদিত্যর নাম ধরে ফিসফিস করে দু-বার ডেকে উঠল।
প্রিয়নাথ চাপা গলায় আদেশের সুরে বললেন, ‘বাপ্পা, পেনসিল নিয়ে রেডি হও—।’
বাপ্পার হাত যে কাঁপছিল সেটা আমি বেশ টের পাচ্ছিলাম। ও আমার হাত ছেড়ে পেনসিল নিয়ে তৈরি হল। আমি অন্ধকারেই আন্দাজ করে ওর কাঁধ ছুঁয়ে বসে রইলাম।
প্রিয়নাথ পেনসিল-টর্চ জ্বেলে কম্পাস আর থার্মোমিটার দেখলেন। সেখানে কোনও পরিবর্তন নজরে পড়ল না। তিনি উৎকণ্ঠিত গলায় প্রশ্ন করলেন, ‘কেউ কি এসেছেন?’
উত্তরে ঐন্দ্রিলা খলখল করে হেসে উঠল।
কাকিমা একটা ভয়ের চিৎকার দিয়ে উঠলেন। টেবিলে খটখট করে কয়েকবার শব্দ হল। আমার বুকের ভেতরে একটা পাগল তখন দুরমুশ পিটছিল।
এমন সময় একটা এরোপ্লেনের শব্দ শোনা গেল।
শৌনকদের বাড়ির ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়া প্রতিটি প্লেনের শব্দ ঠিক একইভাবে ক্ষীণ থেকে শুরু হয়ে জোরালো হয়, তারপর গোঁ-গোঁ শব্দটা কমজোরি হয়ে ক্রমে দূরে মিলিয়ে যায়।
কিন্তু এইবারের শব্দটা আচমকা মাঝপথে থেমে গেল। কেউ যেন গলা টিপে একটা কথা-বলা পুতুলকে থামিয়ে দিল।
ভীষণ অবাক হয়ে গেলাম। প্লেনটা আকাশ থেকে গেল কোথায়! কিন্তু ভাবার আর সময় পেলাম না। কারণ, ঠিক তক্ষুনি ঐন্দ্রিলা পাগলের মতো দিগ্বদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে মাথা ঝাঁকাতে লাগল।
সে কী মাথা ঝাঁকানি! যেন একটা ‘মাথা-নাড়া বুড়ো’ পুতুলের পা ধরে কেউ পাগলের মতো ঝাঁকাচ্ছে।
ওই অবস্থাতেই মিতি বাপ্পার নামটা ফিসফিস করে বলছিল।
বাপ্পা ডুকরে কেঁদে উঠল। কাগজের ওপরে ওর পেনসিল ধরা হাত খসখস শব্দে চলতে লাগল।
আর স্পষ্ট টের পেলাম ঘরের উষ্ণতা কমছে। ভীষণ শীত করছে আমাদের।
প্রিয়নাথ পেনসিল-টর্চ জ্বেলে থার্মোমিটার আর কম্পাস দেখলেন। ঘরের উষ্ণতা প্রায় ১০ ডিগ্রি, আর কম্পাসের কাঁটাটা বনবন করে ঘুরছে।
প্রিয়নাথ একরকম চিৎকার করেই জিগ্যেস করলেন, ‘কেউ কি এসেছেন?’
উত্তরে মিতি আবার খলখল করে হেসে উঠে অদ্ভুত চেরা গলায় বলল, ‘এখনও তুই বুঝিসনি?’
পাশের ঘরের টেলিফোনটা হঠাৎই পাগলা-ঘণ্টির মতো বাজতে শুরু করল। এরকম দ্রুত লয়ে কখনও আমি টেলিফোন বাজতে শুনিনি।
একটা জানলা ‘দড়াম’ করে খুলে গেল। ঠান্ডা বাতাস সাপের মতো পাক খেয়ে ঢুকে পড়ল ঘরে। তারপর প্রলয়নৃত্য নাচতে শুরু করল।
আমাদের অবাক করে দিয়ে বাতাসের সঙ্গে-সঙ্গে ঢুকে পড়ল অসংখ্য জোনাকি। লক্ষ-লক্ষ কোটি-কোটি জোনাকি। অন্ধকার ঘরে আগুনের ফুলকি হয়ে ওরা ঝাঁক বেঁধে ভেসে বেড়াতে লাগল। ওদের এলোমেলো ভেসে বেড়ানো দেখে বাতাসের স্রোত বোঝা যাচ্ছিল।
তিওয়ারি আর্তনাদের মতো একটা শব্দ করল। তারপর চেঁচিয়ে উঠল, ‘ভাগজোগনি। ভাগজোগনি! জুগনু! জগনু!’
ততক্ষণে ঠান্ডায় আমরা ঠকঠক করে কাঁপতে শুরু করেছি। আর কাকিমা ‘মিতি! মিতি!’ বলে ডেকে-ডেকে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করেছেন।
মিতি পাগলের মতো মাথা-ঝাঁকাচ্ছিল। হঠাৎই ও শক-খাওয়া মানুষের মতো ছিটকে পড়ল মেঝেতে। টেলিফোনের ঘণ্টি তখনও কিন্তু থামেনি।
প্রিয়নাথ চেঁচিয়ে বললেন, ‘শৌনক, লাইট জ্বেলে দাও।’ তারপর চেয়ার ছেড়ে উঠে ছুটে গেলেন মোমবাতির কাছে। ওটা তুলে নিয়ে ঐন্দ্রিলার কাছে গেলেন।
ঘরের মধ্যে ঠিক কী যে হচ্ছিল মনে করে বলতে পারব না। শুধু মনে আছে এলোমেলো ভয়ের চিৎকার, কথাবার্তা, আর টেলিফোনের পাগলা-ঘণ্টি।
শৌনক ঘরের আলো জ্বেলে দিয়ে চিৎকার করে বলল, ‘এক মিনিট। সবাই শোনো। এসবে ভয়ের কিছু নেই। এই ব্যাপারটা পুরোটাই সাজানো নাটক।’
মুহূর্তে সব চিৎকার চেঁচামেচি থেমে গেল। শৌনক ফোন ধরার জন্যে এগোতেই ফোনের ঘণ্টিও আচমকা ‘চুপ’ করে গেল।
আমরা সবাই তখন মিতিকে ঘিরে দাঁড়িয়েছি। ও চোখ বুজে মেঝেতে চিত হয়ে পড়ে আছে।
কিন্তু এ কী অদ্ভুত চেহারা হয়েছে মিতির!
ওর সারা মুখে সাদা রং। ঠোঁটজোড়া টুকটুকে লাল। ঠোঁটের বাঁদিকে একটা কালো জড়ুল আঁকা রয়েছে।
প্রিয়নাথ মিতির ওপরে ঝুঁকে পড়ে ওকে নানাভাবে পরীক্ষা করছিলেন। শৌনক ওঁর পাশে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর ঠাট্টার হাসি হেসে বলল, ‘আঙ্কল, আপনি উঠে পড়ুন। মিতির কিস্যু হয়নি। বাপ্পাকে একটু সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্যে আমি আর মিতি নকল ভূত নামানোর প্ল্যান করেছিলেন। ওর হাতব্যাগে মেকাপের জিনিস ছিল। অন্ধকারে লুকিয়ে মুখে মেখে নিয়েছে। আর জুমেলিয়ার এফেক্ট আনার জন্যে ভুরু আঁকার পেনসিল দিয়ে জড়ুলটা এঁকে নিয়েছে।’ কথা শেষ করেই শৌনক হো-হো করে হেসে উঠল : ‘তবে সবাই যে এরকম ব্যাপক ভয় পেয়ে যাবে ভাবিনি।’
রমেশ তিওয়ারি হতভম্ব মুখে দাঁড়িয়ে ছিল। জোনাকিগুলোর দিকে দেখিয়ে আমতা-আমতা করে শৌনককে জিগ্যেস করল, ‘তা হলে এই ভাগজোগনিগুলো কোথা থেকে এল?’
জোনাকিগুলো তখনও ঘরের ভেতর উড়ছিল। তবে ঘরের আলোয় ওদের অনেক নিষ্প্রভ লাগছিল।
শৌনক থতমত খেয়ে বলল, ‘জানি না—।’
প্রিয়নাথ কপালে হাত চেপে মিতির পাশে উবু হয়ে বসেছিলেন। শৌনকের দিকে ঘুরে তাকিয়ে গম্ভীর গলার প্রশ্ন করলেন, ‘টেলিফোনটা অমন পাগলের মতো বাজছিল কেন? প্লেনের গর্জনটাই বা মাঝপথে অমন থেমে গেল কেন? আর ঐন্দ্রিলা যেভাবে মাথা ঝাঁকাচ্ছিল মানুষ কি অমনভাবে মাথা ঝাঁকাতে পারে?’
শৌনক কী বলবে ভেবে পাচ্ছিল না। বিব্রত অপরাধী মুখে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। কাকিমা মিতির ওপরে ঝুঁকে পড়তে যাচ্ছিলেন, প্রিয়নাথ চিৎকার করে ওঁকে বাধা দিলেন : ‘খবরদার, এখন ওর কাছে এগোবেন না!’
আমি যেন নিজেকেই প্রশ্ন করলাম, শৌনক আর ঐন্দ্রিলা মিলে এসব কারসাজি করেছে? তা হলে টেম্পারেচার এরকম কমে গেল কেমন করে! বেশ শীত করছে…তা ছাড়া কম্পাসের নিডলটাই বা অমন বনবন করে ঘুরছিল কেন?’
শৌনক বলল, ‘টেবিলের শব্দগুলো আমি করেছিলাম। আর কথা ছিল, মিতি বাপ্পার নাম ধরে কয়েকবার ডাকবে। ও আর কিছু করছে কি না আমি জানি না। ওকে ডাকুন—ও বলতে পারবে।’
ঐন্দ্রিলার ওপরে ঝুঁকে পড়ে শৌনক ডেকে উঠল, ‘মিতি! মিতি! ওঠ, সবাই খুব ভয় পেয়ে গেছে—।’
চিৎ হয়ে বিচিত্র ভঙ্গিতে শুয়ে থাকা ঐন্দ্রিলা কোনও সাড়া দিল না।
প্রিয়নাথ ওর কবজি ধরে বসেছিলেন। আমাদের ভয় পাওয়া মুখগুলোর দিকে একপলক নজর বুলিয়ে তিনি ভারী গলায় বললেন, ‘ও আর উঠবে না। শি ইজ ডেড। আমি এতক্ষণ ধরে ওর পালস খোঁজার চেষ্টা করছিলাম। যদি পারো তো কেউ একজন ডাক্তার ডেকে আনো।’
প্রিয়নাথের কথায় আকুল ঝড় বয়ে গেল ঘরে।
শৌনক মিতির নাম ধরে পাগলের মতো ডেকে উঠে ওর ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়তে গেল। কাকিমার বুকফাটা কান্না শুরু হয়ে গেল একই সঙ্গে। কিন্তু আবেগের ঝড় বেড়ে ওঠার আগেই বাজ পড়ার মতো একটা শব্দ হল, টেলিফোনটাও আগের অদ্ভুত ঢঙে হঠাৎই বাজতে শুরু করল। মোমবাতির আলোটা একবার কেঁপে উঠেই নিভে গেল। কিন্তু বালবের আলোয় আমাদের দেখতে কোনও অসুবিধে হল না।
মিতির মৃতদেহের মুখটা ধীরে-ধীরে হাঁ হয়ে যেতে লাগল। দেখতে-দেখতে ওর টুকটুকে লাল ঠোঁটজোড়া ফাঁক হয়ে গোল গর্তের চেহারা নিল। একটা অপার্থিব হাসি শোনা গেল ওর মৃতদেহের ভেতর থেকে। আর তারপরই একটা সবুজ রঙের মুখ দেখা গেল ওর মুখের গহ্বরে। ওর ঠোঁট চিরে মুখের গর্ত দিয়ে প্রাণপণ চাপে ঠেলে বেরিয়ে এল মাথাটা। গোটা মাথায় কেমন এক চকচকে লালা জড়ানো।
মাথাটা মাপে ছোট ফুটবলের মতো। চোখ দুটো টানা-টানা ঢুলু-ঢুলু। সারা মুখে অসংখ্য ভাঁজ। আর ঠোঁটের বাঁদিকে একটা কালো জড়ুল।
মাথাটা নেশাগ্রস্ত চোখে এপাশ-ওপাশ তাকিয়ে আমাদের একবার দেখল। তারপর ফিসফিসে হিমেল স্বরে বলল, ‘বাপ্পা, এবার যাই।’
প্রিয়নাথ একলাফে ছিটকে চলে গেলেন ওঁর ব্রিফকেসের কাছে। কিন্তু তার বেশি কিছু করে ওঠার আগেই ঐন্দ্রিলার মৃতদেহ আচমকা চোখ খুলে তাকাল। এবং একটা ‘ফট’ শব্দ করে ঘরের বালবটা কেটে গেল।
ঘরের মধ্যে ভয়ার্ত চিৎকারের ঝড় উঠল আবার। আরও দুটো জানলা ‘দড়াম’ করে খুলে গেল। জানলার পাল্লাগুলো দেওয়ালে এলোপাতাড়ি বাড়ি খেতে লাগল। আর অসংখ্য জোনাকির স্রোত ঘরে হাউইবাজির মতো পাক খেয়ে মাথা খুঁড়ে মরতে লাগল।
আমাদের ভীষণ শীত করছিল। ভয়ে আর ঠান্ডায় আমরা সকলে ঠকঠক করে কাঁপছিলাম। অন্ধকারে নজর চলছিল না। কিন্তু তারই মধ্যে দেখলাম, একরাশ কালো ধোঁয়া ঘরের আঁধার থেকে ভেসে উঠে জানলা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছে। আর জোনাকিগুলো যেন এক পৈশাচিক উল্লাসে ঘরের বাতাসে মাতালের মতো নাচছে…নাচছে…নাচছে।
তারই মধ্যে কাকিমার সর্বহারা মর্মান্তিক কান্না আমার কানে আসছিল।
আমরা সবাই অসহায়ের মতো অন্ধকারে দাঁড়িয়ে রইলাম।