ভাগাভাগি গল্প জসীম উদ্দীন
বাপ মরিয়া গিয়াছে। দুই ভাই পৃথক হইবে। বড়ভাই ছোটভাইকে বলিল, “দেখ্, আমাদের একটিমাত্র গাই আছে, কাটিয়া ত আর দুই ভাগ করা যাইবে না। তুই ছোটভাই । তোকেই গাই’র বড় ভাগটা দেই । তুই গাই’র মুখের দিকটা নে। আর আমি গাই’র লেজের দিকটা লই।”
ছোটভাই ভারি খুশি! বড়ভাই যে তাহাকে ভাল ভাগটা দিয়াছে, সেজন্য সে বড়ভাইয়ের প্রতি খুবই কৃতজ্ঞ। সে সারাদিন এখান হইতে ওখান হইতে ঘাস কাটিয়া আনিয়া গাইকে খাওয়ায় । বড়ভাই রোজ সকালে হাঁড়ি ভরিয়া দুধ দোয়ায় ।
সেই দুধ দিয়া ছানা বানায়, ছানা দিয়া রসগোল্লা বানায়, সন্দেশ বানায় আরও কত কি বানায়! বল ত খোকাখুকুরা আর কি কি বানায় ? যে আগে বলিবে তারই জিত।
বড়ভাই ভারি খুশি, “বেশ আমার ছোটভাই। এমনিই ত চাই। এবার বুঝিতে পারিলাম, বাপের সম্পত্তি তুমি ঠিকই রক্ষা করিতে পারিবে। তোমার ভাগে যখন গাইর মুখের দিকটা পড়িয়াছে, তখন নিশ্চয়ই তোমাকে ভালমতো তাকে খাওয়াইতে হইবে।”
বড়ভাইর তারিফ শুনিয়া ছোটভাই আরও বেশি করিয়া গরুকে ঘাস দেয়। বড়ভাই আরও বেশি করিয়া গরুর দুধ দোয়ায়; আর ছোটভাইকে আরও বেশি করিয়া তারিফ করে ।
একজন চালাক লোক একদিন ছোটভাইকে বলিল, “আরে বোকা! তুই গরুর মুখের দিকটা লইয়া, দিনরাত গরুকে ঘাস খাওয়াইয়া মরিতেছিস, আর ওদিকে তোর বড়ভাই মজা করিয়া দুধ দোয়াইয়া লইতেছে।”
ছোটভাইর তখন টনক নড়িল, “তাই ত! কিন্তু এখন ত কিছুই করার উপায় নাই। আমি যে আগেই গরুর মাথার দিকটা লইয়া ফেলিয়াছি । ঘাস আমাকে খাওয়াইতেই হইবে।”
চালাক লোকটি তখন ছোটভাইকে কানে কানে একটি বুদ্ধি দিয়া গেল ।
পরদিন সকাল। যেই বড়ভাই গাইর দুধ দোয়াইতে আসিয়াছে, অমনি ছোটভাই গাইর মাথায় একটি মুগুর লইয়া বাড়ি মারিতে আরম্ভ করিল। মুগুরের ঘায়ে গাই এদিক ওদিক নড়ে । গাই দোয়ানো অসম্ভব। বড়ভাই তখন বলে, “আরে করিস কি ? করিস কি ?”
ছোটভাই উত্তর দেয়, “রোজ আমি গরুকে ঘাস খাওয়াই। দুধ দুইয়া লইয়া যাও তুমি। আমাকে একফোঁটা দুধও দাও না। গরুর মাথার দিকটা যখন আমার, তার উপরে আমি মুগুরই মারি, আর কুড়ালই মারি, তুমি কোনো কথা বলিতে পারিবে না।”
বড়ভাই বুঝিল, কোনো চালাক লোক ছোটভাইকে বুদ্ধি দিয়াছে। সে তখন ছোটভাইকে বলিল “আর তুই গাইর মাখায় মুগুর মারিস না। এখন হইতে গরুর দুধের অর্ধেক তোকে দিব।” ছোটভাই বলিল, “শুধু অর্ধেক দুধ দিলেই চলিবে না, তোমাকে আজ হইতে গরুর জন্য অর্ধেক ঘাসও কাটিতে হইবে। নইলে এই মারিলাম আমি গরুর মাথায় মুগুরের ঘা!”
“আরে রাখ্ রাখ্ ।” বড়ভাই মুলাম হইয়া বলে, “আজ হইতে অর্ধেক ঘাসও আমি কাটিব!”
বাড়িতে ছিল একটা খেজুর গাছ। শীতকাল, খেজুর গাছ কাটিয়া রস বাহির করিতে হইবে। বড়ভাই ছোটভাইকে বলে, “আমাদের একটামাত্র খেজুর গাছ। কাটিয়া ত ভাগ করা যায় না। সেরার গরুর মাথার দিকটা লইয়া তুই ঠকিয়াছিলি । এবার বল্ খেজুর গাছের কোন দিকটা নিবি ? গোড়ার দিকটাই বুঝি তোর পছন্দ হইবে।”
ছোটভাই কিছু না ভাবিয়াই উত্তর করে, “আমি খেজুর গাছের গোড়ার দিকটাই লইব।” বড়ভাই খুশি হইয়া বলে, “আচ্ছা তোর কথাই থাক। তুই ছোটভাই, ভাল ভাগটা চাহিলি, আমি বড়ভাই হইয়া ত না করিতে পারি না!”
ছোটভাই লইল খেজুর গাছের গোড়ার দিকটা। সে গাছের গোড়ায় রোজ পানি ঢালে। তাহাতে গাছ আরও তাজা হয়। বড়ভাই গাছের আগায় হাঁড়ি বসাইয়া মনের আনন্দে রস পাড়িয়া আনে । শীতকালে খেজুরের রস খাইতে কি মজা!
রস দিয়া গুড় তৈরি হয়— গুড় দিয়া চিনি তৈরি হয়, চিনি দিয়া কি কি তৈরি হয় খোকাখুকুরা ? বল বল, যে আগে বলিতে পারিবে তারই জিত।
এইভাবে কিছুদিন যায়। বড়ভাই খেজুরের রস খাইয়া মোটা হইয়া উঠিয়াছে। আর ছোটভাই খেজুর গাছের গোড়ায় পানি ঢালিতে ঢালিতে মাজায় ব্যথা করিয়া ফেলিয়াছে।
এমন সময় সেই চালাক লোকটি আবার আসিয়া দেখিল ছোটভাই কেমন ঠকিয়াছে । সে তখন ছোটভাইকে সমস্ত বুঝাইয়া বলিল। ছোটভাই বলিল, “তাই ত, এবারও আমি ঠকিয়াছি । কিন্তু খেজুর গাছের গোড়ার দিকের ভাগ ত আমি নিজেই চাহিয়া লইয়াছি । এর ত আর কোনো প্রতিকার হইবে না।”
“দূর বোকা কোথাকার! বুদ্ধি থাকিলে প্রতিকার হইবে না কেন ?” এই বলিয়া চালাক লোকটি ছোটভাইর কানে কানে আর একটি বুদ্ধি দিয়া গেল। বল ত খোকাখুকুরা, কি বুদ্ধি দিয়া গেল ?
পরদিন সন্ধ্যাবেলা, যেই বড়ভাই খেজুর গাছে উঠিয়া সেখানে হাঁড়ি পাতিতে গাছের খানিকটা কাটিতেছে, অমনি ছোটভাই একখানা কুড়াল লইয়া খেজুর গাছের গোড়া কাটিতে লাগিল, খপ্-খপ্-খপ্।
বড়ভাই গাছের উপর হইতে শব্দ শুনিয়া বলিল, “আরে করিস কি ? করিস কি ?”
ছোটভাই গাছের গোড়ায় কুড়াল মারিতে মারিতে উত্তর করিল, “তুমি গাছের মাথা লইয়াছ। রোজ গাছের মাথা হইতে রস পাড়িযা খাও। আমাকে একটু দাও না। আমার যখন গাছের গোড়াটা, সেখানে আমি কুড়াল মারি আর যাই করি তুমি কিছু বলিতে পার না।” এই বলিয়া ছোটভাই আবার গাছের গোড়ায় কুড়ালের কোপ দিতে আরম্ভ করিল, খপ্-খপ্-খপ্। “আরে থাম্-থাম্-থাম্”, বড়ভাই বলে, “আজ হইতে খেজুরের রসও অর্ধেক তোকে দিব।”
দুই ভাই বেশ আছে, গরুর দুধ আর খেজুরের রস দুইজনে সমান সমান ভাগ করিয়া লয় ।
তাহাদের বাড়িতে ছিল একখানা মাত্র কাঁথা! বড়ভাই ছোটভাইকে বলে, “দেখ্ কাঁথাখানাকে ত ছিঁড়িয়া দুই টুকরা করা যায় না। তুই কাঁথাখানি দিনের ভাগে তোর কাছে রাখ্ । আমাকে রাত্র হইলে দিস।”
ছোটভাই খুব খুশি। বড়ভাই দিনের বেলার জন্য কাঁথাখানা তাহাকে দিয়াছে! কিন্তু দিনের বেলা গরম। তখন কাঁথা গায়ে দেওয়া যায় না। সে কাঁথাখানাকে সারাদিন এ ভাঁজ করিয়া ও ভাঁজ করিয়া দেখে। রাত্র হইলে বড়ভাই কাঁথাখানা লইয়া যায়। ছোটভাই সারারাত্র শীতে ঠিরঠির করিয়া কাঁপে। বড়ভাই দিব্যি আরামে কাঁথা গায়ে দিয়া ঘুমায় ।
সেই চালাক লোকটি আবার আসিয়া ছোটভাইর অবস্থা দেখিল । দেখিয়া তার কানে কানে আর একটি বুদ্ধি দিয়া গেল ।
পরদিন সন্ধ্যাবেলা ছোটভাই কাঁথাখানা পানির মধ্যে ভিজাইয়া রাখিল । বড়ভাই যখন শুইবার সময় ছোটভাইর কাছে কাঁথা চাহিল, সে তাহাকে ভিজা কাঁথাখানা আনিয়া দিল।
বড়ভাই খুব রাগ করিয়া বলিল, “আরে করিয়াছিস কি ? কাঁথাখানা ভিজাইয়া রাখিয়াছিস ?” ছোটভাই উত্তর করিল, “কাঁথাখানা যখন দিনের ভাগে আমার, তখন সেটা দিয়া আমি দিনের ভাগে যাহা ইচ্ছা করিতে পারি! তোমার ইহাতে কোনো কথা বলিবার নাই ।”
বড়ভাই তখন বলিল, “কাল হইতে আমরা দুই ভাই-ই একত্র কাঁথার তলে শুইব।”