বামুন ঠাকুর কিছুই আয় করিতে পারে না। পূজা আর্চা করিয়া কিইবা সে পায়। বউ দিনরাত খিটখিট করে, এটা আন নাই—ওটা আন নাই । শুধু কি এমনি খিটিখিটি ? মাঝে মাঝে ঝাঁটা উঁচাইয়া ঠাকুর মশায়কে মারিয়া নাস্তানাবুদ করে। কাঁহাতক আর এত সওয়া যায়! সব সময় বউ বলে, “তুমি বাড়ি হইতে বাহির হইয়া যাও ।”
সেদিন ঠাকুরমশায় বউকে বলিল, “তুমি আমাকে চারখানা রুটি বানাইয়া দাও । আমি বিদেশে যাইব। দেখি কোথাও কোনো কিছু উপার্জন করিতে পারি কি না।”
আপদ বিদায় হইলেই বউ বাঁচে। সে চারিখানা রুটি বানাইয়া দিল। রুটি চারখানা গামছার খোঁটে বাঁধিয়া ঠাকুরমশায় ঘরের বাহির হইল।
যাইতে যাইতে দুপুরের বেলা গড়াইয়া পড়ে, মাথার রোদ পায়ে আসিয়া লাগে। ঠাকুরমশায়ের ক্ষুধা পাইল। সে সামনে একটা ইঁদারার উপর বসিল। বসিয়া গামছার খোঁট হইতে রুটি চারখানা খুলিয়া নাড়াচাড়া করিতে লাগিল। আর বিড়বিড় করিয়া বলিতে লাগিল, “এই চারটার মধ্যে একটা খাই, কি দুইটা খাই ? আমার এত ক্ষুধা পাইয়াছে যে, চারটা খাইলেও পেট ভরিবে না। কিন্তু কাল খাইব কি ?”
সেই ইঁদারার মধ্যে চারজন পরী ছিল। তাহারা ভাবিল, ঠাকুরমশায় বুঝি আমাদের চারজনকেই খাইয়া ফেলিবে।
তাহারা ভয়ে জড়সড় হইয়া হাত জোড় করিয়া ঠাকুরমশায়কে বলিল, “আপনি আমাদিগকে খাইবেন না।”
তাহাদের ভয় দেখিয়া ঠাকুরমশায়ের মনে সাহস হইল। সে বলিল, “তবে আমি কি খাইব ? আমার বড্ড ক্ষিধা পাইয়াছে।”
পরীরা নিজেদের মধ্যে একটু আলাপ করিল। তারপর একটি হাঁড়ি আনিয়া বলিল, “এই হাঁড়ি লইয়া যান। ইহার মধ্যে হাত দিলে সন্দেশ রসগোল্লা যা কিছু চাহিবেন পাইবেন।”
হাঁড়ি পাইয়া ঠাকুরমশায় কি খুশি ! প্রথমে সে হাঁড়ির ভিতর হইতে সন্দেশ বাহির করিল,— তারপর রসগোল্লা, তারপর পানতোয়া— তারপর মিহিদানা, আবার খাব, জামাই পিঠা, বউ পিঠা, আরও কত কি? টপাটপ টপাটপ খাইতে খাইতে পেটে যখন আর ধরে না, তখন হাঁড়ির মুখ বন্ধ করিয়া ঢেকুর তুলিতে তুলিতে ঠাকুরমশায় বাড়ির পথে রওয়ানা হইল । কিন্তু বেলা তখন ডুবিয়া গিয়াছে। পথে অন্ধকার। রাত্রে একা একা পথ চলিতে ভয় করে।
সামনে ঠাকুরমশায়ের এক বন্ধুর বাড়ি। সেই বাড়িতে যাইয়া সে অতিথি হইল। মিষ্টির হাঁড়িটি কি করিয়া পাইয়াছে কাউকে তাহা না বলিতে পারিয়া ঠাকুরের দম আটকাইয়া আসিতেছিল। বন্ধুর বউ ঠাকুরমশায়ের জন্য রান্না করিতে যাইতেছিল। সে তাহাকে বলিল, “আজ আর তোমাদের রান্না করিতে হইবে না। আমার নিকট এই যে হাঁড়িটা আছে, উহার মধ্যে হাত দিলে সন্দেশ রসগোল্লা যাহা চাহিবে, তাহাই পাইবে।”
একগাল হাসিয়া বন্ধুর বউ সেই হাঁড়ির মধ্যে হাত দিয়া দেখে, সত্য সত্যই হাঁড়ির কাছে সন্দেশ, রসগোল্লা, যা কিছু চাওয়া যায়, সবই পাওয়া যায়। তখন ঠাকুরমশায় আরম্ভ হইতে শেষ পর্যন্ত এই হাঁড়ি পাওয়ার কাহিনী বন্ধুর বউকে বলিল। তারপর সারাদিনের পরিশ্রমে ঘুমাইয়া পড়িল।
বন্ধুর বউ কিন্তু ঘুমাইল না। সে মিষ্টির হাঁড়িটি সরাইয়া সেখানে সেই হাঁড়িটির মতো, একই মাপের, একই রঙের আর একটি হাঁড়ি আনিয়া রাখিয়া দিল।
সকালে বামুন ঠাকুর উঠিয়া সেই নকল হাঁড়িটি লইয়া জোরে জোরে পা ফেলিয়া বাড়ির দিকে রওয়ানা হইল। কিন্তু পথ কি ফুরাইতে চাহে! কতক্ষণে যাইয়া সে তার বউকে এই হাঁড়ি হইতে মিষ্টি খাওয়াইতে পারিবে ?
বাড়ির সামনে যাইয়া ঠাকুর জোরে জোরে তার বউকে বলে, “শিগ্গির করিয়া স্নান করিয়া আস।”
বউ জিজ্ঞাসা করিল, “কেন ?”
ঠাকুর বলে, “পরে জানিতে পারিবে। তুমি শিগ্গির করিয়া স্নান করিয়া আস। এই হাঁড়ির মধ্যে যা কিছু আছে তা পরে জানিতে পারিবে।”
বউ তাড়াতাড়ি স্নান করিয়া আসিল। ঠাকুরমশায় তখন বলিল, “এই হাঁড়ির মধ্যে হাত দাও। সন্দেশ, রসগোল্লা যাহা চাহিবে তাহাই পাইবে।”
এইটি ত সেই পরীদের দেওয়া সত্যিকার হাঁড়ি নয়। বন্ধুর বউ যে নকল হাঁড়িটি দিয়াছিল ইহা সেইটি। বউ হাঁড়ির ভিতর হাত দিয়া বলিল, “রসগোল্লা খাইব” কিন্তু হাত শূন্য। বউ আবার হাঁড়ির মধ্যে হাত দিয়া বলিল, “সন্দেশ খাইব” কিন্তু হাত শূন্য। বউ বুঝিল, ঠাকুর তাকে ফাঁকি দিয়াছে।
তখন সে চটিয়া ঠাকুরকে মারিতে আসিল। ঠাকুর কোনোরকমে পালাইয়া বাঁচিল।
পরদিন ঠাকুর বউকে অনেক অনুনয় বিনয় করিয়া বলিল, “দেখ, আমাকে আর চারখানা রুটি বানাইয়া দাও। আমি সত্য সত্যই এক হাঁড়ি সন্দেশ লইয়া আসিব।”
ঠাকুরের বউ হাঁড়ি পাতিল নাড়িয়া চাড়িয়া, সামান্য কিছু আটা বাহির করিয়া, তাই দিয়া চারখানা রুটি বানাইয়া ঠাকুরকে দিল। তাহা গামছায় বাঁধিয়া ঠাকুর পথে রওয়ানা হইল। তারপর সেই কুয়ার কাছে আসিয়া চারিখানা রুটি লইয়া নাড়াচাড়া করিতে লাগিল, “দুইটা খাইব, না চারটা খাইব।”
কুয়ার ভিতর হইতে পরীরা তাহা শুনিতে পাইয়া জোড়হাত করিয়া ঠাকুরকে বলিল, “দেখুন, আমাদিগকে খাইবেন না।”
ঠাকুর খুব রাগ করিয়া বলিল, তোমরা আমাকে নকল মিষ্টির হাঁড়ি দিয়াছিলে। বাড়িতে লইয়া গিয়া এত নাড়াচাড়া করিলাম; একটা সন্দেশ, রসগোল্লাও বাহির হইল না! আজ তোমাদের চারজনকেই গিলিয়া খাইব।”
পরীরা নিজেদের মধ্যে কিছু আলাপ করিয়া বলিল, “এই বাক্সটি লইয়া যান। ইহার মধ্যে হাত দিলেই শাড়ি, গহনা, যা কিছু চাহিবেন পাইবেন।”
বাক্সটি হাতে লইয়া ঠাকুর বাড়ি রওয়ানা হইল। পথের মধ্যে রাত্র হইল ঠাকুর যাইয়া আবার সেই বন্ধুর বাড়ি অতিথি হইল। এবারও আগের মতোই বাক্সটি পাওয়ার সমস্ত ঘটনা বন্ধুর বউকে বলিল। ঠাকুর ঘুমাইলে বন্ধুর বউ তাহার শিয়র হইতে আসল বাক্সটি সরাইয়া অপর একটি বাক্স সেখানে রাখিয়া দিল।
পরদিন সকালে সেই নকল বাক্সটি লইয়া ঠাকুর বাড়ি গেল। বউকে বলিল, ‘জলদি স্নান করিয়া আস। এবার বাক্স আনিয়াছি। ইহার মধ্যে হাত দিলেই শাড়ি, গহনা যা কিছু চাহিবে পাইবে।”
ঠাকুরের কথা বিশ্বাস করিয়া বউ স্নান করিয়া আসিল। তারপর সেই বাক্সের মধ্যে হাত দিয়া শাড়ি চাহিল— গহনা চাহিল। কিন্তু বাক্স শূন্য ঠন ঠন! কিছুই নাই তাহাতে। তখন রাগিয়া বউ ঝাঁটা হাতে লইয়া ঠাকুর মশায়কে বেদম মারিল।
পরদিন গাট্টি বোঁচকা লইয়া ঠাকুর মশায় বউকে বলিল, “তুমি যখন আমাকে দেখিতে পার না, তখন আমি দেশ ছাড়িয়াই যাইতেছি। এই নাকে খত দিলাম, আর ফিরিয়া আসিব না। দয়া করিয়া আমাকে আর চারখানা রুটি বানাইয়া দাও ?”
বউ ঝঙ্কার দিয়া উঠিল, “কোথায় পাইব আটা যে রুটি বানাইব ?”
ঠাকুর অনেক কাকুতি মিনতি করিয়া বলিল, “পাড়া প্রতিবেশীর কাছ হইতে চাহিয়া চিন্তিয়া আমাকে মাত্র চারখানা রুটি বানাইয়া দাও।”
বউ তাহাই করিল। এবাড়ি ওবাড়ি হইতে ধার কর্জ করিয়া আটা আনিয়া ছোট্ট চারখানা রুটি বানাইয়া ঠাকুরের হাতে দিল।
তাহা লইয়া আগের মতো সেই কুয়ার উপরে বসিয়া ঠাকুর বলিতে লাগিল, “দুইটা খাইব, না চারটা খাইব ?”
পরীরা কুয়ার ভিতর হইতে উঠিয়া আসিয়া বলিল, “ঠাকুর মশায়! আবার আমাদিগকে খাইতে চান কেন ?”
ঠাকুর মশায় রাগিয়া বলিল, ‘খাইব না ? সেবার আমাকে হাঁড়ি দিয়াছিলে। তাহা হইতে একটাও সন্দেশ রসগোল্লা বাহির হইল না। এবার দিয়াছিলে বাক্স তাহা হইতে একখানাও শাড়ি গহনা বাহির হইল না। তোমাদের ফাঁকির জন্য আমি আমার বউয়ের হাতে কত না নাজেহাল হইলাম। দেখ, আমাকে মারিয়া কি করিয়াছে।” এই বলিয়া ঠাকুর মশায় তাহার পিঠ দেখাইল। সমস্ত পিঠ ভরিয়া ঝাঁটার বাড়ির দাগ।
পরীরা তখন একে একে ঠাকুর মশায়ের কাছে সব কথা শুনিল। বাড়ি যাইবার সময় ঠাকুর যে এক বন্ধুর বাড়িতে রাত্রিবাস করে, তাহাও জানিয়া লইল। তাহারা ঠাকুরকে বুঝাইয়া দিল, “বন্ধুর বউ আপনার নিকট হইতে হাঁড়ি ও বাক্স বদলাইয়া লইয়াছে।”
পরীরা সকলে মিলিয়া কি পরামর্শ করিল। তারপর ঠাকুরকে বলিল, “এই লাঠিখানি দিলাম। সঙ্গে লইয়া যান। যাহাকে যখন মারিতে বলিবেন, লাঠি যাইয়া তখনই তাহাকে মারিবে।”
লাঠি লইয়া ঠাকুর পূর্বের মতো সেই বন্ধুর বাড়িতে আসিল। বন্ধুর বউ এই কয়দিন— সেই হাঁড়ি হইতে সন্দেশ রসগোল্লা খাইয়া আর সেই বাক্স হইতে শাড়ি গহনা পরিয়া একেবারে নতুন মানুষ সাজিয়াছে!
একগাল হাসিয়া বন্ধুর বউ জিজ্ঞাসা করিল, “এবারে কি আনিয়াছ, ঠাকুর ?”
ঠাকুর বলিল, “এবার আনিয়াছি এই লাঠিখানা। যাকে মারিতে বলিব লাঠি তাহাকেই মারিবে।”
বউ অবিশ্বাসের অভিনয় করিয়া বলিল, “ইস, তাই বিশ্বাস হয় ? আচ্ছা দেখাও ত কি করে তোমার লাঠি ?”
ঠাকুর লাঠিকে বলিল, “লাঠি! যাও। আমার বন্ধুর বউকে একটু লাঠি-পেটা কর।”
ঠাকুরের আদেশে লাঠি যাইয়া বন্ধুর বউকে মারিতে লাগিল। বউ কাঁদিয়া ঠাকুরের পায়ে পড়িল। ঠাকুর বলিতে লাগিল, “তবে আন আমার সেই আসল মিষ্টির হাঁড়ি, আন আমার সেই আসল শাড়ি গহনার বাক্স। তবে লাঠিকে মারিতে বারণ করিব।”
বউ আর কি করে! লাঠির বাড়িতে তার সমস্ত শরীর ঝালাপালা হইয়াছে। সেই হাঁড়ি আর বাক্স আনিয়া ঠাকুরের সামনে তাড়াতাড়ি রাখিল। ঠাকুর লাঠিকে মারিতে বারণ করিল। বন্ধুর বউ হাঁপ ছাড়িয়া বাঁচিল ।
পরদিন সকালে, হাতে লাঠি আর দুই বগলে হাঁড়ি আর বাক্স লইয়া ঠাকুর বাড়ি রওয়ানা হইল।
বাড়ির সামনে আসিয়াই ঠাকুর ডাক ছাড়িল, “বউ! শিগ্গির যাও— স্নান করিয়া আস।”
পরপর দুইদিন ঠাকুর মশায় ফাঁকি দিয়া বউকে এই সাতসকালে স্নান করাইয়াছে। শীতকালের সকালে স্নান করা কি কম কষ্ট ? বউ ঝাঁটা লইয়া ঠাকুরমশায়কে মারিতে আসিল, “বলি, আবার তুই কেন ফিরিয়া আসিলি ?”
বউ যেই ঠাকুরের গায়ে ঝাঁটার বাড়ি তুলিয়াছে, অমনি ঠাকুর লাঠিকে আদেশ করিল, “লাঠি! যাও ত দেখি, কেন আমার বউ কথা শোনে না ? তাকে একটু লাঠি-পেটা করিয়া আস।”
লাঠি অমনি যাইয়া বউয়ের ঘাড়ে সপাসপ বাড়ি মারিতে লাগিল। বউ এদিক হইতে ওদিকে যায়, লাঠি তাহার পিছে পিছে ছোটে, ওদিক হইতে সেদিক যায়, লাঠি তাহার পিছে পিছে ছোটে। বউ তখন হাতজোড় করিয়া ঠাকুরের পায়ের উপর দণ্ডবৎ—“শিগ্গির তোমার লাঠি থামাও। লাঠির বাড়িতে আমার পিঠ ঝালাপালা হইয়া গেল।”
ঠাকুর তখন বলিল, “তবে যাও, শিগ্গির স্নান করিয়া আস।”
বউ বগলে কাপড় লইয়া বলিল, “এই আমি স্নান করিতে যাইতেছি।”
ঠাকুর তখন লাঠিকে থামাইল। বউ স্নান করিয়া আসিলে, ঠাকুর বলিল, “এই বাক্সের মধ্যে হাত দিয়া শাড়ি-গহনা চাও।”
বউ বাক্সের মধ্যে হাত দিয়া শাড়ি পাইল— নানারকমের গহনা পাইল । সেসব পরিয়া এক গাল হাসিয়া ঠাকুর মশায়ের সামনে আসিয়া দাঁড়াইল। ঠাকুর মশায় তখন অপর হাঁড়িটি দেখাইয়া বলিল, “এই হাঁড়ির মধ্যে হাত দিয়া সন্দেশ চাও— রসগোল্লা চাও, তোমার যা কিছু খাইতে ইচ্ছা করে, তা চাও।”
হাঁড়ির মধ্যে হাত দিয়া বউ সন্দেশ চাহিল—– সন্দেশ পাইল রসগোল্লা চাহিল— রসগোল্লা পাইল। আর যাহা চাহিল তাহাও পাইল। তখন ঠাকুর আর তাহার বউ দুইজনে মনের খুশিতে খাইয়া ঢেকুর তুলিতে লাগিল। এরপরে যদি বউ কোনোদিন ঠাকুর মশায়ের উপর রাগ করিতে যায়, ঠাকুর অমনি তাহার লাঠি দেখায় বউয়ের রাগ গলিয়া পানি হইয়া যায়।