রহস্যভেদী (কিরীটী অমনিবাস) – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

শেয়ার করুনঃ

এক

কিরীটী তখন পঞ্চম বার্ষিক শ্রেণীর ছাত্র। প্রাচুর্য থাকলেও বিলাসিতাকে কোন দিনই প্রশ্রয় দেয়নি। শিয়ালদহের এই অন্ধকার গলিতে অখ্যাতনামা এক ছাত্রাবাস ‘বাণীভবন’–মাসিক সাত টাকা খাওয়া-থাকা দিয়ে তারই তেতলার এক অন্ধকার খুপরির মধ্যে থাকত।

কলেজের বন্ধুর মধ্যে একজনই ছিল তার বিশেষ অন্তরঙ্গ–সলিল সরকার। সলিল সরকারের বাবা মধুসূদন সরকার ছিলেন কলকাতার একজন বিখ্যাত ধনী। পাট ও ধানচালের কারবার লক্ষ লক্ষ টাকা খাটত। সলিল তাঁর একমাত্র পুত্র। অত বড় অর্থশালী পিতার পুত্র হয়েও সলিলের মনে এতটুকুও অহঙ্কার ছিল না। বাড়িতে চার-পাঁচখানা গাড়ি থাকা সত্ত্বেও সে ট্রামে-বাসে ছাড়া কোনদিনও কলেজে আসেনি।

সেদিন রবিবার, কিরীটী সারাদিন কোথাও বের হয়নি।

শীতকাল। এর মধ্যেই কুয়াশার তমিস্রা কলিকাতা মহানগরীর বুকে ঘন হয়ে এসেছে। ঘরের মধ্যেও অন্ধকার চাপ বেঁধে উঠেছে একটু একটু করে। সিঁড়িতে কার পায়ের শব্দ শোনা গেল।

আগন্তুক দরজার কাছে আসতেই কিরীটী আহ্বান জানাল, এস সলিল, কি খবর?

আলো জ্বালাসনি এখনও?

না, কুঁড়েমিতে ধরেছে, বোস্‌। তারপর, আর তো আসবার কথা ছিল না সলিল!

মনটা ভালো নেই–তাই ভাবলাম তোর কাছে একটু ঘুরে যাই।

কি হয়েছে রে?

আশ্চর্য ঘটনা! বাবার ঘরের সিন্দুকের মধ্যে একটা দলিল ছিল। কয়েকদিন ধরে হাইকোর্টে একটা মামলা চলছে। দলিলটা সেই মামলা সংক্রান্ত। পরশুও বাবা সন্ধ্যার দিকে দলিলটা সিন্দুকেই দেখেছেন। আজ সকালবেলা সিন্দুক খুলে দলিলটা উকিলকে দিতে গিয়ে বাবা দেখেন, দলিলটা নেই! সিন্দুকের টাকাকড়ি এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় বস্তু সবই ঠিক আছে, কেবল দলিলটা নেই সিন্দুকে।

সিন্দুকের চাবি কার কাছে থাকে?

বাবার কোমরেই সর্বদা থাকে। চাবির বিষয়ে বাবা বিশেষ সাবধান চিরদিনই।

ভৃত্য এসে ঘরে হ্যারিকেন বাতিটা জ্বালিয়ে দিল।

দু কাল চা দিয়ে যেন নন্দু। কিরীটী বললে। নন্দু চলে গেল।

হঠাৎ একসময় কিরীটী প্রশ্ন করে সলিলকে, তোর বাবার ঠিক মনে আছে, গত পরশু সন্ধ্যায় দলিলটা সিন্দুকেই তিনি দেখেছিলেন?

হ্যাঁ, তাই তো বাবা বললেন।

এ ব্যাপারে কাউরে তিনি সন্দেহ করেন বলে জানিস কিছু?

বাড়ির লোকজনের মধ্যে বাবা, আমার এক কাকা, আমার তিনটে বোন, মা, পিসিমা, ম্যানেজার বনবিহারীবাবু, আর চাকরবাকর।

চাকরবাকরগুলো নিশ্চয়ই সবাই বিশ্বাসী?

হ্যাঁ। সকলেই অনেকদিন ধরে আমাদের কাজ করছে।

মামলাটা কার সঙ্গে হচ্ছে?

মামলাটার একটু ইতিহাস আছে কিরীটী।–মৃদু স্বরে সলিল বলে।

ইতিহাস! সবিস্ময়ে কিরীটী বন্ধুর মুখের দিকে তাকায়।

এমন সময় নন্দু দু হাতে দু কাপ ধূমায়িত চা নিয়ে ঘরের মধ্যে এসে প্রবেশ করল।

কিরীটী বলল, নন্দু, ঠাকুরকে বলে দিস সলিলবাবু আজ এখানেই খাবেন।

যে আজ্ঞে–নন্দু মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানিয়ে চায়ের কাপ দুটো রেখে চলে গেল।

সলিল বলতে লাগল, সে আজ প্রায় ২৪/২৫ বছর আগেকার কথা। আমি তখন বোধ হয় সবে হয়েছি। চব্বিশ-পরগণার সোনারপুরে একটা প্রকাণ্ড বাগানবাড়ি দেনার দায়ে বিক্রি হয়ে যায়। বাগানবাড়িটা ছিল রাজা ত্রিদিবেশ্বর রায়ের। এককালে রাজা ত্রিদিবেশ্বর রায়ের অবস্থা খুবই ভাল ছিল। রাজা ত্রিদিবেশ্বর ছিলেন যেমন শিক্ষিত উদারচেতা, তেমনি প্রচণ্ড খেয়ালী। ব্যবসার দিকে তাঁর একটা প্রবল ঝোঁক ছিল। ত্রিদিবেশ্বরের পিতামহ যজ্ঞেশ্বর রায় তাঁর নিচের চেষ্টায় ও অধ্যবসায়ে ব্যবসা করে মস্ত জমিদারি গড়ে তোলেন এবং গর্ভনমেণ্টের কাছ থেকে রাজা খেতাব পান। যজ্ঞেশ্বরের ছেলে রাজ্যেশ্বর পিতার উপার্জিত জমিদারি বাড়াতে না পারলেও টিকিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু তার ছেলে ত্রিদিবেশ্বর পিতার মত চুপটি করে পূর্বপুরুষের উপার্জিত অর্থ কেবলমাত্র আঁকড়ে না থেকে সেটা আরো বাড়িয়ে কি করে দ্বিগুন তিনগুন করা যায় সেই চেষ্টায় উঠে-পড়ে লাগলেন। কিন্তু চঞ্চলা লক্ষ্মীর সিংহাসন উঠল টলে। নানা দিক দিয়ে ঘরের অর্থ জলের মত বেরিয়ে যেতে লাগল। কিন্তু মদের নেশার মতই ত্রিদিবেশ্বরকে তখন ব্যবসার নেশায় পেয়ে বসেছে। সংসারে তাঁর আপনার বলতে এক স্ত্রী ছাড়া আর কেউ ছিল না, কারণ তিনি ছিলেন নিঃসন্তান। আত্মীয় বন্ধুবান্ধবের অবিশ্যি সংখ্যা কম ছিল না। স্ত্রীর নিষেধ, আত্মীয় বন্ধুবান্ধবদের সতর্কবাণী কিছুই তাঁকে টলাতে পারল না। চোদ্দ-পনের বছরের মধ্যে প্রায় পাঁচ লক্ষ টাকা আয়ের জমিদারী নিঃশেষে কোথায় মহাশূন্যে মিলিয়ে গেল। অবশেষে দেনার দায়ে একদিন তাঁর শেষ বসতবাটি সোনারপুরের বাগানবাড়িটাও বিক্রি করতে হল। বাবা সাত হাজার টাকায় সেই বাগানবাড়িটা কিনেছিলেন। বাগানবাড়িটা বাবা কতকটা ঝোঁকের মাথায়ই কিনেছিলেন এবং তার কোন সংস্কারও করেননি। হঠাৎ বছরখানে আগে অনিল চৌধুরী নামে একজন ভদ্রলোক বাবার কাছে এসে অনুরোধ জানান, বাগানবাড়িটা তিনি কিনতে চান। বাবাও রাজী হয়ে যান। অনিল চৌধুরী বলেছিলেন, বাগানবাড়িটা কিনে সেখানে তিনি একটা স্কুল স্থাপন করবেন। উদ্দেশ্য খুবই ভালো। লেখাপড়া হবে, সব ঠিকঠাক, এমন সময় হঠাৎ বাবা একটা বেনামী চিঠি পেলেন, চিঠিতে লেখা ছিলঃ

 

প্রিয় মধুসূদনবাবু, লোকপরম্পরায় শুনলাম, রাজা ত্রিদিবেশ্বরের বাড়িটা নাকি আপনি বিক্রি করছেন। আপনি জানেন না কিন্তু আমি জানি, ঐ বাড়ির কোন এক স্থানে ত্রিদিবেশ্বরের পিতামহ যজ্ঞেশ্বর রায়ের গোটা দশ-বারো দামী হীরা পোঁতা আছে। সে হীরার দাম সাত-আট লক্ষ টাকা তো হবেই, আরো বেশী হতে পারে। যাআর কাছে আপনি রাজা ত্রিদিবেশ্বরের বাড়ীটা বিক্রী করছেন সে সেকথা কোন সূত্রে জানতে পেরেছে বলেই বাড়িটা কেনবার জন্য ব্যস্ত হয়েছে, তা না হলে এতদিনকার ভাঙা বাড়ি, তাও কলকাতার বারিরে কেউ কিনতে চায়? আপনিই ভেবে দেখুন। রাজা ত্রিদিবেশ্বর বা তাঁর পিতা রাজ্যেশ্বরও সেকথা জানতেন না। হীরার কথা একমাত্র রাজা যজ্ঞেশ্বর ও তাঁর নায়েব কৈলাস চৌধুরীই জানতেন। কিন্তু হীরাগুলো যে ঠিক কোথায় পোঁতা আছে, সেকথা একমাত্র যজ্ঞেশ্বর ভিন্ন দ্বিতীয় প্রাণী কেউ জানতেন না। রাজা যজ্ঞেশ্বর হঠাৎ সন্ন্যাস রোগে মারা যান। কাজেই মৃত্যুর সময় তাঁর লুকানো হীরাগুলোর কথা কাউকে বলে যেতে পারেননি। আপনাকে সব কথাই খুলে বললেন। ইতি–

আপনার জনৈক ‘শুভাকাঙ্খী’।

 

চিঠিখানা পড়ে, কি জানি কেন বাবার মন বদলে গেল। বাবা বাড়িটা বিক্রি করবেন না বলে সঙ্গে সঙ্গে মনস্থির করে ফেললেন। পরের দিন লেখাপড়া হবে, অনিলবাবু এলেন। বাবা তাঁকে স্পষ্টই বললেন, বাড়ি তিনি বিক্রী করবেন না। অনিলবাবু তো শুনে অবাক। শেষ অনিলবাবু বিশ হাজার পর্যন্ত বাড়িটার দাম দিতে চাইলেন। কিন্তু বাবা তখন একপ্রকার স্থিরপ্রতিজ্ঞ হয়েছেন যে বাড়িটা বিক্রী করবেন না। তা ছাড়া অনিলবাবুর জেদ দেখে বাবার মনের সন্দেহটা যেন আরো বদ্ধমূল হয়েছে। অবশেষে এক প্রকার বাধ্য হয়েই অনিলবাবু ফিরে গেলেন। এর পরে মাসখানেক কেটে গেল।

আচ্ছা, তোমার বাবা তারপর খোঁজ করেছিলেন কি সত্যি ঐ বাড়ির কোথাও কোন হীরা লুকানো আছে কিনা–was there any truth in it? কিরীটী প্রশ্ন করে।

না। মনের মধ্যে বাবার কোন সন্দেহ থাকলেও বাইরে তার কোন কিছুই প্রকাশ করেননি। অর্থাৎ সত্যি সত্যি হীরাগুলো সে-বাড়ির কোনখানে লুকানো আছে কিনা সে সম্পর্কে কোন সন্ধানই বাবা করেননি। যাহোক এমন সময় এক অভাবিক ঘটনা ঘটল। বাবার কাছে এক উকিলের চিঠি এল; তার মর্ম এই যে রাজা ত্রিদিবেশ্বরের সোনারপুরের যে বাড়ি বাবা কিনেছেন সে ক্রয় আইনত অসিদ্ধ। কেননা প্রথমত সে বাড়িটা আগেই রাজা ত্রিদিবেশ্বর ভুবন চৌধুরীর কাছে দেনার দায়ে বন্ধক রেখেছিলেন। বন্ধকী জিনিস কখনো আইনত বিক্রী করা যায় না। তা ছাড়া বাবার দলিল-দস্তাবেজ নিয়ে প্রমাণ করতে হবে যে, বাড়িটা সত্যই তিনি রাজা ত্রিদিবেশ্বরের কাছ থেকে কিনেছিলেন। উকিলের চিঠি পেয়ে বাবা হাসলেন, কোন জবাবই দিলেন না। কেননা বাবার সিন্দুকে যে দলিল আছে, সেটাই তার প্রমাণ। অবশেষে কোর্টে মামলা উঠল।…গতকাল ছিল দলিল কোর্টে পেশ করবার দিন। এমন সময় অকস্মাৎ দলিলটা গেল চুরি।

কিরীটী বললে, এ যে একটা রহস্য উপন্যাস সলিল!

হ্যাঁ, রহস্য উপন্যাসই বটে।

পুলিসে সংবাদ দেওয়া হয়েছে?

হ্যাঁ, বাবা পুলিসে সংবাদ দিয়েছেন। আজ বিকেলের দিকে তাদের আসবার কথা; কিন্তু পুলিসের লোক আসবার আগেই বাড়ি থেকে চলে এসেছি আমি।

আমি কি ভাবছি জানিস সলিল? ব্যাপারটা এমন কিছুই নয়। একটু চেষ্টা করলেই ব্যাপারটার সুরাহা করা যেতে পারে।

সলিল উৎসাহে একবার উঠে বসে, পারবি দলিলটা খুঁজে বের করে দিতে কিরীটী?

কিরীটী সলিলের কথার কোন জবাবই দিল না, একটু হাসলে শুধু।

নন্দু এসে জানাল রাত্রির আহার্য প্রস্তুত।

কিরীটী নন্দুকে দুজনের খাবার ওপরে দিয়ে যেতে বলল।

 

দুই

যখনকার কথা বলছি, ঢাকুরিয়া অঞ্চলে তখনো আধুনিকতার হাওয়া লাগেনি, লেক তো দূরের কথা, সেখানে তখন ছিল ঘন বনজঙ্গল ও ধানক্ষেত। রেল লাইনের ধার দিয়ে দু-একটা পাকা বাড়ি দেখা যেত মাত্র।

ঢাকুরিয়া স্টেশনের কাছেই মধুসূদন সরকারের প্রকাণ্ড চারমহলা বাড়ি। বাড়ির সামনের দিকে একটি চমৎকার ফুলের বাগান। নানা জাতীয় ফুলগাছ সংগ্রহ করে বাগানটিকে তিনি সাজিয়েছেন। বাগানটি তাঁর অতি প্রিয়। কাজকর্মের অবকাশে সকাল-সন্ধ্যায় যে সময়টুকু তিনি অবসর পান, ওই বাগানেই ঘুরে ঘুরে বেড়ান।

বাগানটা যেন তাঁর কাছে একটা নেশার বস্তুর মতই হয়ে উঠেছিল। চিরদিনই তিনি অতি প্রত্যুষে শয্যাত্যাগ করেন, বাগানের মধ্যে খালি গায়ে চটিপায়ে পায়চারি করেন সূর্য ভাল করে না ওঠা পর্যন্ত। সেদিন সকালের দিকে শীতটা যেন বেশ একটু চেপেই পড়েছে। ভোরবেলা একটা হালকা কমলালেবু রংয়ের দামী শাল গায়ে জড়িয়ে মধুসূদন বাগানের মধ্যে একাকী পায়চারি করছেন, এমন সময় সলিলের সঙ্গে কিরীটী এসে বাগানের মধ্যে প্রবেশ করল।

কিরীটী এর আগেও দশ-বারোবার সলিলদের বাড়িতে বেড়াতে এসেছে এবং মধুসূদনবাবুর সঙ্গে যথেষ্ট পরিচয়ও আছে। কিরীটী মধুসূদনবাবুকে কাকাবাবু বলে ডাকে।

ওদের দেখে মধুসূদনবাবু বললেন, এই যে! তোমরা এত সকালে কোথা থেকে?

কিরীটী জবাব দিল, সলিল কাল আমার ওখানে ছিল কাকাবাবু, সলিলকে আসতে দিইনি, আজ সকালে একসঙ্গে আসব বলে। আপনার শরীর ভাল তো কাকাবাবু?

হ্যাঁ বাবা, বুড়ো হাড় কোনমতে জোড়াতালি দিয়ে যে কটা দিন চালানো যায়। তারপর তোমার শরীর ভাল তো?

হ্যাঁ কাকাবাবু।

তোমাদের পরীক্ষাও তো এসে গেল, না?

হ্যাঁ, আর মাস তিনেক বাকী আছে।

বাবা, কিরীটী বলছিল তোমার হারানো দলিলটা ও খুঁজে বের করে দেবে। বললে সলিল।

মধুসূদন পুত্রের কথায় চকিতে ঘুরে দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে কিরীটীর দিকে তাকালেন।

কিরীটী ধীরভাবে বললে, খুঁজে বের করে দেবো এমন কথা আমি বলিনি, তবে চেষ্টা করব, অবিশ্যি কাকাবাবু আপনার যদি তাতে কোন আপত্তি না থাকে।

কিরীটীর কথা শুনে মধুসূদন খানিকক্ষণ গুম হয়ে রইলেন, তারপর মৃদুস্বরে বললেন, বেশ তো, চেষ্টা করে দেখ।

কিন্তু চেষ্টা করতে হলে যে আপনার সাহায্যই সর্বপ্রথম আমার প্রয়োজন কাকাবাবু!

সাহায্য?

হ্যাঁ।

কি ভাবে তোমাকে সাহায্য করতে পারি বল?

আমি যে দলিলটার খোঁজবার ভার নিয়েছি, সে কথা আপনি ও সলিল ছাড়া ঘুণাক্ষরেও কেউ জানতে পারবে না। আর আমি যা বলল আপনাকে তা করতে হবে।

মধুসূদন আবার খানিকক্ষণ কি যেন ভাবলেন, মনে মনে বেশ কৌতূহলীই হয়ে উঠেছিলেন তিনি কিরীটীর কথাবার্তায়। মৃদুস্বরে বললেন, বেশ, তাই হবে।

বাইরে ততক্ষণে রোদ উঠে গেছে।

কিরীটী বললে, চলুন কাকাবাবু ঘরে চলুন, আপনার সঙ্গে কয়েকটা কথা আছে।

সকলে বাড়ির দিকে অগ্রসর হল।

আগেই বলেছি, বাড়িটা চারমহলা, দোতলা। প্রথম মহলে মধুসূদনের ব্যবসা সংক্রান্ত দশ-বারোজন কর্মচারী ও ম্যানেজার বনবিহারীবাবু থাকেন। দ্বিতীয় মহল ব্যবসায়ের জিনিসপত্রের গুদাম হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। তৃতীয় মহলে দাস-দাসীরা থাকে ও বাইরের লোকেরা আহারাদি করে। চতুর্থ মহলই প্রকৃতপক্ষে অন্দরমহল।

অন্দরমহলে ওপরের দক্ষিণের দুটো ঘরে মধুসূদনবাবু থাকেন–একটা তার বসবার ঘর, অন্যটা শয়নকক্ষ। অন্য দুটির একটিতে থাকে সলিল, আর একটি পূজার ঘর হিসাবে ব্যবহৃত হয়।

নীচের একটি ঘরে খাওয়াদাওয়া হয়, একটিতে পিসীমা সলিলের তিনটি বোনকে নিয়ে থাকেন, একটিতে থাকেন সলিলের কাকা বিপিনবাবু, অন্যদিতে অতিথি-অভ্যগত এলে থাকে।

কিরীটী বললে, যে ঘরে সিন্দুকটা ছিল সেই ঘরটা সর্বপ্রথমে দেখতে চাই।

মধুসূদন বললেন, তুমি সলিলের সঙ্গে গিয়ে ঘরটা দেখ, ততক্ষণে আমি ম্যানেজারের সঙ্গে কয়েকটা কথা সেরে আসি। এই বলে তিনি চলে গেলেন।

সলিলের সঙ্গে সঙ্গে কিরীটী মধুসূদনের শয়নকক্ষে এসে প্রবেশ করল। ঘর খালি, মা অনেকক্ষণ উঠে গেছেন, হয়তো পূজার ঘরে ব্যস্ত।

বেশ বড় আকারের ঘরখানি, দক্ষিণ-পূব খোলা। কিরীটী তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে চারদিকে তাকিয়ে দেখতে লাগল। ব্যলকনির ঠিক পাশ দিয়েই একটা নারিকেল গাছ উঠে গেছে। ব্যালকনির থেকে হাত বাড়িয়ে অনায়াসেই নারিকেল গাছটা ধরা যায়। তবে তাতে বিপদের সম্ভাবনা যে একেবারেই নেই তা নয়। হাত ফসকে যাওয়ার খুব সম্ভাবনা আছে। ঘরটা একেবারে বারান্দার শেষপ্রান্তে। তা ছাড়া ঐ ঘরের সংলগ্নই ছাদে যাওয়ার দরজা। ঘরের মধ্যে আসবাবপত্রের তেমন বাহুল্য নেই। দুটি সিংগল বেড পাশাপাশি, নিভাঁজ শয্যা বিছানো। মধুসূদন যে খাটে শয়ন করেন তার এক পাশে একটি শ্বেতপাথরের গোল টেবিলের ওপরে রক্ষিত ফোন। এক পাশে একটা আয়না বসানো কাপড়ের আলমারি এবং আলমারির ঠিক পাশেই মানুষ-প্রমাণ উঁচু মজবুত লোহার সিন্দুক। সিন্দুকের গায়ে বেশ বড় একখানি জার্মান তালা ঝুলছে। সিন্দুকের ঠিক পাশেই একটি টুলের ওপরে জলের কুঁজো; তার মাথায় বসানো একটি কারুকার্যখচিত শ্বেতপাথরের গ্লাস।

ঘরের দেওয়ালে টাঙানো মুখোমুখি পূব-পশ্চিমে দুখানি বড় অয়েল-পেনটিং–মধুসূদনের মা ও বাবার। ফটোটি ঠিক সিন্দুকের ওপরেই টাঙানো।

ছেলেবেলায় কিরীটীর ছবি আঁকার দিকে খুব ঝোঁক ছিল। সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ছবি দুটিকে খুঁটিয়ে শিল্পীর মন নিয়ে দেখতে লাগল। ফটো দুটির গায়ে ঝুল পড়েছে সামান্য। বেশ কিছুদিন যে ঝাড়াপোঁছা হয়নি তা বুঝতে কষ্ট হয় না।

সলিল প্রশ্ন করলে, অমন করে কি দেখছিস কিরীটী?

বিলিতী ফ্রেম বলেই মনে হয়। তোর ঠাকুর্দার ফটোটা ঠিক দেওয়ালের সঙ্গে সেট করা হয়নি–একটু যেন বাঁয়ে হেলে আছে। কিরীটী জবাব দেয়। এমন সময় মধুসূদন এসে ঘরে প্রবেশ করলেন।

কি দেখছ? প্রশ্ন করলেন মধুসূদনবাবু।

আপনার বাবার অয়েলপেনটিংটা দেখছিলাম। বেশ সুন্দর। শিল্পীর হাত চমৎকার, যেন একটা প্রাণের সাড়া পাওয়া যায় তুলির প্রতিটি টানে।

হ্যাঁ, একজন ইটালিয়ান শিল্পীর আঁকা। তোমার চা-পর্ব এখনও হয়নি নিশ্চয়ই। চল আমার বসবার ঘরে; ওখানে বসে চা-পান করতে করতে তোমার যা আলোচ্য আছে তা আলোচনা করা যাবে।

চলুন।

সকলে এসে পাশের ঘরে প্রবেশ করলেন

সুদৃশ্য ট্রেতে করে ভৃত্য চায়ের সরঞ্জাম নিয়ে এল। একটি ছোট গোল টেবিলে চায়ের সরঞ্জাম নামিয়ে দিয়ে সে ঘর হতে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল।

সলিল উঠে চা ঢালতে লাগল।

কিরীটী একটু অন্যমনস্ক হয় পড়েছিল; সে ভাবছিল ওয়েলপেনটিংটার কথা। কোথায় কোন্‌ মাটির তলায় একটা সন্দেহের বীজ যেন অঙ্কূরোদ্গমের সম্ভাবনায় ওপরের দিকে ঠেলে উঠতে চাইছে।

 

তিন

চা-পানের সঙ্গে সঙ্গে নানা আলাপ আলোচনা চলছিল।

হঠাৎ একসময় মধুসূদন বললেন, তুমি বোধ হয় জান না কিরীটী, ঐ দলিলটার একটা পূর্ব ইতিহাস আছে।

কিরীটী মৃদু হেসে বললে, সলিলের মুখে গতকাল অনেকটা শুনেছি কাকাবাবু এবং সে ইতিহাস শোনবার পর থেকেই আমার মনে একটা অদম্য স্পৃহা জেগেছে দলিলটা খুঁজে বের করবার। আচ্ছা দলিলটা চুরি যাওয়ার আগের দিন থেকে এবং আপনি যখন জানতে পারলেন দলিলটা সিন্দুকে নেই, ঐ সময়কার সমস্ত ঘটনা যতটা আপনি জানেন, একটু বাদ না দিয়ে আমাকে সব বলতে পারবেন কাকাবাবু?

মধুসূদন কী যেন একটু ভাবলেন, তারপর মৃদুস্বরে বললেন, দলিলটার পূর্ব ইতিহাস যখন তুমি সলিলের মুখে শুনেছই, তখন সেটার আর পুনরাবৃত্তি করতে চাই না। দলিলটা যে সিন্দুক থেকে কি করে চুরি যেতে পারে, এখনো তার মাথামুণ্ডু আমি কিছুই ভেবে স্থির করতে পাচ্ছি না। তবে স্থূল চক্ষে দেখতে পাচ্ছি, দলিলটা চুরি গেছে এবং এখন সেইটাই সবচাইতে বড় কথা। বাড়িতে লোকজনের মধ্যে আমি, বিপিন, দিদি, সলিলের মা আর সলিলের তিন বোন। প্রতিদিন আমি বিকেল পাঁচটার মধ্যেই দোকান থেকে ফিরি। কিন্তু পরশু ফিরতে আমার রাত্রি নটা হয়ে যায়। সকালবেলা দোকানে যাওয়ার আগে সেদিন সিন্দুক খুলে যখন কয়েকটা আবশ্যকীয় কাগজপত্র রাখছি, দলিলটা তখনো সিন্দুকেই ছিল মনে আছে।

আপনার দেখতে ভুল হয়নি তো কাকাবাবু?

দেখবার ভুল আমার কোন দিনই হয় না বাবা, তা হলে এত বড় ব্যবসাটা চালানো আজ কষ্টকর হত। যাহোক শোন। দলিলটা তখনও সিন্দুকেই ছিল। সেই রাত্রে একটা ব্যাপার ঘটেছিল; প্রথমে ভেবেছিলাম তার হয়তো কোন গুরুত্ব নেই, কিন্তু পরে অনেক ভেবে মনে মনে হচ্ছে যে ব্যাপারটার সঙ্গে কোথাও দলিল চুরি যাওয়ার একটা সূত্র জট পাকিয়ে থাকলেও থাকতে পারে। রাত্রি তখন বোধ করি একটা হবে। রাত্রে আমার তেমন সুনিদ্রা হয় না কিছুদিন থেকে। সামান্য শব্দে ঘুম ভেঙে যায়। কিন্তু সেদিন বড় ক্লান্ত ছিলাম বলে ঘুমটা যেন বেশ গাঢ়ই হয়ে এসেছিল। হঠাৎ একটা খস্‌খস্‌ শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। প্রথমে ভাবলাম ও কিছু নয়। কিন্তু তবুও কান খাড়া করেই রইলাম। আবার খস্‌খস্‌ শব্দ কানে এল, শব্দটা যেন পাশের ঘর থেকেই আসছে মনে হল। ভাবলাম হয়তো বেড়াল হবে। হঠাৎ একটা ক্যাঁচ করে শব্দও হল। এবার আর দেরি না করে উঠে পড়লাম। ঘরের বাতি নিভানো। ডায়নামো রাত্রি এগারটার পর বন্ধ হয়ে যায়। ঘরে মোমবাতি থাকে, প্রয়োজন হলে তাই জ্বালানো হয়। শয্যা থেকে উঠে শিয়রের কাছে রক্ষিত মোমবাতিটা হায়ে নিয়ে নিঃশব্দে পাশের ঘরের দিকে চললাম। পাশের ঘরটা খালি। কিন্তু বারান্দার দিকের দরজাটা হা-হা করছে, খোলা। ও দরজাটা চিরদিন আমি নিজ হাতেই বন্ধ করে শুই, সেদিনও তাই করেছিলাম। কেমন খটকা লাগল। তাড়াতাড়ি দরজা দিয়ে বাইরে বারান্দায় এলাম। আকাশে সামান্য একটুখানি চাঁদ; তারই অস্পষ্ট আলোয় মনে হল, যেন কে দ্রুতপদে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে যাচ্ছে। মোমবাতিটা চট্‌ করে নিভিয়ে দিয়ে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেলাম; কিন্তু আর কিছুই চোখে পড়ল না। তবু নীচে পর্যন্ত গেলাম। বাইরে যাবার দরজা বন্ধ। মানে রাত্রে ওটা তালা দেওয়া থাকে কিনা বরাবর। তোমার কাকীমাই প্রত্যহ রাত্রে শুতে যাবার আগে তালা দিয়ে যান, আবার সকালে উঠে তালা খুলে দেন। নীচের তিনটে ঘরও বন্ধ, ঠেলে দেখলাম। হয়তো ব্যাপারটা আগাগোড়া আমার চোখের ভুল হতে পারে। ঘুমের চোখে উঠে গেছি। কিন্তু মনের খুঁতখুঁতুনিটা কিছুতেই যেন গেল না। নীচেরটা পর্যন্ত তন্নতন্ন করে অনুসন্ধান করেও কিছু পেলাম না। সকালে উঠে দারোয়ান চন্দন সিংকে ও গুরবলিকে প্রশ্ন করলাম, কিন্তু তারাও বলতে পারলে না। শেষ নটার দিকে সিন্দুক খুলে দলিলটা নিতে গিয়ে দেখি সিন্দুকে দলিল নেই। যথারীতি খোঁজাখুঁজি করে বাধ্য হয়ে শেষটায় পুলিসে সংবাদ দিলাম। গতকাল রাত্রে, তখন বোধ করি সাড়ে বারোটা হবে, আমার শোবার ঘরের সংলগ্ন ব্যালকনিতে চুপচাপ চেয়ারটায় অন্ধকারে বসে আছি, হঠাৎ শুনতে পেলাম ব্যালকনির নীচে থেকে যেন একটা তীক্ষ্ণ শিসের শব্দ। চমকে উঠে দাঁড়ালাম এবং অন্ধকারে ঝুঁকে নীচে বাগানের দিকে তাকালাম। অন্ধকারে কিছুই বোঝবার উপায় নেই। আর দেরি না করে তক্ষুন চিৎকার করে গুরবলিকে ডাকলাম। সঙ্গে সঙ্গেই নীচের বাগানে কে যেন দ্রুতপদে ছুটে পালিয়ে গেল, তার স্পষ্ট শব্দ পেলাম। তোমার কাকীমার কাছ থেকে তখুনি চাবি নিয়ে নীচের দরজা খুলে বাইরে গেলাম। তারপর দারোয়ানকে সঙ্গে নিয়ে বাগানটা তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কিছু দেখতে পেলাম না। কিন্তু টর্চের আলোয় বুঝতে পারলাম, ব্যালকনির নীচে কেউ কিছুক্ষণ আগে দাঁড়িয়ে ছিল, কেননা ঐ জায়গায় কতকগুলো নতুন ফুলের চারা লাগানো হয়েছে, মালী সেখানে বিকেলের দিকে জল দিয়েছিল। নরম মাটির ওপরে অনেকগুলো জুতোর ছাপ পড়েছে।…

কিরীটী এতক্ষণ গভীর মনোযোগের সঙ্গে মধুসূদনের কথা শুনছিল, একটা কথাও বলেনি। হঠাৎ সে ধীর সংযত ভাবে বললে, দলিলটা বোধ হয় আপনার পাওয়া যাবে কাকাবাবু। আচ্ছা পুলিসের কাছে কি এসব কথা আপনি বলেছেন কাকাবাবু?

না। হয়তো তারা হাসবে এই ভয়ে বলিনি।

বেশ করেছেন, এখনও বলবেন না। তবে একটা কাজ করতে হবে আপনাকে।

কী?

দিনরাত্রি গোপনে বাড়ির আশেপাশে পাহারা রাখতে হবে এখন থেকে।

সে আর এমন কঠিন কি? আমার বাড়িতে তিনজন দারোয়ান আছে এবং দোকানে দুজন আছে। দোকান থেকে একজনকে নিয়ে আসব; চারজন অনায়াসেই পাহারা দিতে পারবে।

আপনি এখুনি সেই ব্যবস্থা করুন। আপনাকে আর আপাততঃ আমার প্রয়োজন হবে না।

এরপর মধুসূদনবাবু চেয়ার ছেড়ে উঠে ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেলেন।

মধুসূদন চলে গেলে কিরীটী ওঁর কাছে শোনা কথাগুলো আগাগোড়া আর একবার মনে মনে বিশ্লেষণ করে দেখল। চাবির রহস্যটা কিছুতেই সে যেন উদ্ধার করতে পারছে না। চাবিটা চুরি গিয়েছিল এ বিষয়ে কোন ভুলই নেই। কিন্তু কেমন করে চুরি গেল সেটাই রহস্য। কে চুরি করতে পারে? কার দ্বারা চুরি হওয়া সম্ভব? সহসা তার মুখটা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। একটা পথ সে অস্পষ্ট যেন দেখতে পাচ্ছে। তাই যদি হয়, তবে চাবি চুরিরও একটা মীমাংসা পাওয়া যায়, সেই সঙ্গে মধুসূদনের কাহিনীরও একটা মীমাংসা আপাততঃ খাড়া করা সম্ভবপর। কিন্তু তাও কি সম্ভব? সম্ভবই বা নয় কেন? এ দুনিয়ায় মানুষ স্বার্থের জন্য করতে না পারে এমন কিছু আছে কি? কিন্তু স্বার্থটা কোথায় এবং কার?

কি ভাবছিল কিরীটী? সলিল প্রশ্ন করে।

আজকের রাতটা জাগতে হবে সলিল, পারবি তো?

নিশ্চয়ই পারব।

তবে শোন্‌ কি করতে হবে আমাদের। ঐ আলমারিটার পিছনে তোকে আজ রাত্রি দশটার পর থেকে অতি গোপনে থাকতে হবে। আর আমি থাকব তোদের ছাদের ওপরে চিলেকোঠার মধ্যে। সন্ধ্যার পরই আমি সে ঘরে যাব। যতক্ষণ না আমার বাঁশীর আওয়াজ পাবি বের হবি না।

বেশ। কিন্তু চিলেকোঠাটা তো ভীষণ নোংরা হয়ে আছে।

ক্ষতি নেই তাতে এতটুকু।

 

চার

রাত্রি বারোটা। শীতের রাত্রি যেন ঘুম-ভারাক্রান্ত। কোথাও এতটুকু হাওয়া নেই। চারিদিক নীরব নিথর। কিরীটী নিঃশব্দে কাঠের প্যাকিং কেসের ওপরে বসে আছে।

রাত্রি দেড়টা।

ছাদের ওপর কার নিঃশব্দ চাপা পায়ে চলাচলের আভাস। কিরীটী উদ্‌গ্রীব হয়ে ওঠে।

পায়ের শব্দ ক্রমেই এগিয়ে আসছে…হ্যাঁ, এগিয়ে আসছে এই ঘরের দিকেই। খুট করে একটা শব্দ হল শিকল খোলার। কিরীটী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।

মাথায় স্বল্প ঘোমটা, সারাদেহ বস্ত্রাবৃত কে যেন ঘরে এসে প্রবেশ করল। ফস্‌ করে দেশলাই জ্বালাবার শব্দ হল। আগন্তুক একটা মোমবাতি জ্বালালে। মোমবাতির আলোয় ঘরটা যেন সহসা জেগে উঠল।

মোমবাতিটা হাতে করে আগন্তুক এগিয়ে বাগানের দিকে জানালার ওপরে মোমবাতিটা বসালে। তারপর নিঃশব্দে জানালার সামনে দাঁড়িয়ে রইল।

এক মিনিট দু মিনিট কেটে গেল। কিরীটীও তেমনি চুপচাপ, আগন্তুকও নিঃশব্দ। এমনি করে আধ ঘণ্টা কেটে গেল। সহসা এমন সময় আগন্তুক সেই ধূলিমলিন মেঝের ওপর লুটিয়ে কাঁদতে শুরু করলে।

কিরীটী এবার এগিয়ে এল।

ভূলুণ্ঠিতা নারীর সর্বাঙ্গ কান্নার বেগে ফুলে ফুলে উঠছে। এলোচুল মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে।

ধীরে ধীরে কিরীটী ডাকলে, পিসিমা?

কে? ত্রস্তে পিসিমা উঠে মোমবাতিটা হাতে নিয়ে পেছনদিকে তাকালেন, তাঁর অবস্থা দেখে মনে হয় যেন আচমকা পথের মাঝে ভূত দেখেছেন! কপাল বেয়ে তখনও অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে।

পিসিমা উঠে বসুন। ভয় নেই আপনার, আমি কিরীটী।

পিসিমা যেন বিস্ময়ে একেবারে হতবাক হয়ে গেছেন। কিরীটী এই সময়–এত রাত্রে–এইখানে? সমস্ত কেমন গোলমাল হয়ে যাচ্ছে।

 

পাঁচ

কিরীটী ফুঁ দিয়ে মোমবাতিটা নিভিয়ে দিতে যেতেই আর্তস্বরে পিসিমা বলে উঠলেন, না না–নিভিও না।

কিন্তু তবু কিরীটী আলোটা নিভিয়ে দিল, না পিসিমা, আলোটা না নিভিয়ে দিলে সে ধরা পড়বে। তাতে আপনার লজ্জা আরো বেশী হবে।

নিঃশব্দে সে পালিয়ে যাক। ধরা পড়লে যে কলঙ্ক হবে, তা থেকে তাকে বাঁচানো মুশকিল হবে। ভয় নেই পিসিমা আপনার কোন ক্ষতি হবে না। কত বড় দুঃখে যে আপনি এ কাজে হাত দিয়েছেন, আপনি না বললেও তা আমি বুঝতে পারছি। আপনি আমাকে বিশ্বাস করতে পারেন। কিরীটীর কথার কখনো খেলাপ হয় না।

সহসা পিসিমা কিরীটীর দু হাত চেপে ধরে চাপা কান্নায় ভেঙে পড়লেন, শম্ভুকেও বাঁচাও কিরীটী। সে আমার ছেলে। আজ তোমাকে আমি সব খুলে বলব। দীর্ঘদিন এই দুঃসহ ব্যথা ও লজ্জা আমি বুকে চেপে বেড়াচ্ছি। লোকে জানে শম্ভু মারা গেছে, কিন্তু আসলে তা নয়। শম্ভুর যখন তেরো বছর বয়স তখন তার বাবা মারা যান। লেখাপড়া শিখিয়ে তাকে মানুষ করতে আমি অনেক চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু অসৎ সঙ্গে মিশে সে গোল্লায় গেল। চোদ্দ বছরের বয়সের সময় সে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেল। দু বছর কত খুঁজছিলাম, কিন্তু তার কোন সন্ধানই পেলাম না। শেষে দাদার এখানে চলে এলাম। দীর্ঘ এগার বছর পরে দিনদশেক আগে কালীঘাটের মন্দিরে সন্ধ্যার সময় তার সঙ্গে দেখা হল। তাকে দেখেই আমি চিনেছিলাম। সে আমাকে কালীমন্দিরে দেখা করবার জন্য আগে একটা চিঠি দিয়েছিল। সঙ্গদোষে আজ সে অধঃপতনের শেষ সীমানায় এসে দাঁড়িয়েছে। রোগজীর্ণ কঙ্কালসার দেহ। বোধ হয় আজ আর তার কোন নেশাই বাদ নেই।

আর তার নেশাই বাদ নেই।

কাঁধের ওপরে তার একরাশ ধার। যার কাছ থেকে সে টাকা ধার নিয়েছে, সে শাসিয়েছে আগামী দশদিনের মধ্যে টাকা না শোধ করতে পারলে তাকে তারা জেলে দেবে। তাই সে আমার শরণাপন্ন হয়েছে। কিন্তু আমি বিধবা, মান খুইয়ে ভাইয়ের সংসারে এসে পড়ে আছি, কোথায় আমি টাকা পাব? একটা কাজ করতে পারলে একজন তাকে এক হাজার টাকা দেবে বলছে। সে কাজ হচ্ছে দাদার সিন্দুক থেকে সোনারপুরের বাড়ির দলিলটা এনে দেওয়া। শুনে ভয়ে আমার বুক কেঁপে উঠল। কিন্তু সে কাঁদতে লাগল, টাকা না পেলে তাকে জেলে যেতে হবে। আর কোন উপায়ই নেই। হায় রে মায়ের প্রাণ!…তিন রাত বিবেকের সঙ্গে যুদ্ধ করছি; শেষে সন্তানের দাবিই জয়ী হল। কি করে যে দলিলটা চুরি করেছিলাম, সে লজ্জার কথা আর বলতে চাই না বাবা তোমার কাছে। কথা ছিল পরের দিন রাত্রে সে বাগানে এসে দাঁড়াবে এবং শিস দেবে, আমি দলিলটা জানালা দিয়ে নীচে ফেলে দেব। কিন্তু সব গোলমাল হয়ে গেল। তাই আজ এসেছিলাম এ ঘরে–আলোর নিশানা তাকে জানাতে।…আমার মানসম্ভ্রম আজ সবই তোমার হাতে বাবা। পিসিমা কাঁদতে লাগলেন।

কাঁদবেন না পিসিমা, চুপ করুন। আমি জানি দলিলটা কোথায়। এ কাহিনী আমি ছাড়া আর কেউই জানতে পারবে না। আপনি নীচে যান। যা করবার আমি করব।

পিসিমা নিঃশব্দে নীচে চলে গেলেন। কিরীটীও নীচে গেল। সলিল তখনো আলমারির পিছনে চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছে।

সলিল বেরিয়ে আয়! ডাকলে কিরীটী।

সলিল আলমারির পিছন থেকে বের হয়ে এল, কি ব্যাপার?

দলিল পাওয়া গেছে।

সত্যি?

হ্যাঁ–বলতে বলতে হাত বাড়িয়ে কিরীটী মধুসূদনের বাবার ফটোর পিছন থেকে খামসমেত দলিলটা বের করে দিল।…পাশের ঘরে মধুসূদনবাবু তখনো জেগেই বসে ছিলেন, কিরীটীর সঙ্গে সলিল গিয়ে মধুসূদনের হাতে দলিলটা দিল।

মধুসূদন বিস্ময়ে একেবারে থ হয়ে গেছেন যেন। জিজ্ঞাসা করলেন, কোথা থেকে পেলে?

ঐটি আমাকে মাফ করতে হবে কাকাবাবু। আমি বলতে পারব না কেমন করে কোথায় পেলাম এবং কে চুরি করেছিল!

বেশ। কিন্তু অপরাধীর শাস্তি হওয়া প্রয়োজন, এ কথা তো মানো তুমি?

কাকাবাবু, পৃথিবীতে সব অপরাধেরই কি শাস্তি হয়? আপনার দলিলের প্রয়োজন, দলিল পেয়েছেন। আর একটা অনুরোধ আপনার কাছে–এ বিষয় নিয়ে কোন উচ্চবাচ্য করতে পারবেন না আপনি।

বেশ তাই হবে।

এর পরদিন কিরীটী এক হাজার টাকা এনে পিসিমার হাতে দিল।

এ টাকা কিসের কিরীটী? পিসিমা জিজ্ঞেসা করলেন।

শম্ভুকে দেবেন পিসিমা। আর তাকে বলবেন এবার সৎপথে চলতে। ওপথে কেবল দুঃখই বাড়ে, সুখ নেই। এটা আমার প্রণামী পিসিমাকে।

একটা কথা কাল থেকে কেবলই আমার মনে হচ্ছে বাবা, কী করে তুমি জানতে পেরেছিলে?

কিরীটী তখন মধুসূদনের কথাগুলো আগাগোড়া বলে গেল। প্রথম থেকেই বুঝতে পেরেছিলাম, কোন বাইরের লোক দলিল চুরি করতে পারে না। নিশ্চয়ই কোন ঘরের লোক এ কাজ করেছে। কিন্তু কে? বাড়ির লোকজনের মধ্যে আপনি, সলিলের কাকা, এ ছাড়া আর কাউকেই সন্দেহ করা যায় না–এবং বুঝেছিলাম দলিল এখনও বাড়ির বাইরে যায়নি এবং শীঘ্রই সেটা বাইরে যাবে। দ্বিতীয় রাত্রে চেষ্টা হয়েছিল, কিন্তু সংগ্রহকারী বিফল হয়ে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছে। আবার সে আসবেই, তাই সব আঁটঘাট বেঁধে আমি কাজে নেমেছিলাম। তবে আপনাকে আমি একেবারেই সন্দেহ করিনি–করেছিলাম সলিলের কাকাকে। আপনাকে চিলেকোঠায় দেখে সত্যিই চমকে গিয়েছিলাম। কাকাবাবুও বাবার ফটোটা একটা কাত হয়ে ছিল, কিন্তু মনে একটা খটকা লাগলেও সেটা খুঁজে দেখিনি। পরে আপনার কথা শুনে বুঝেছিলাম, তাড়াতাড়িতে আপনি ফটোর পিছনে দলিলটা রেখে পালিয়ে এসেছিলেন।

সত্যিই তাই, দাদার পায়ের শব্দ পেয়ে আমি ভয়ানক ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু ঘরের লোকই যে নিয়েছে তা তুমি বুঝলে কি করে?

কাকাবাবুর একটি মাত্র কথায়। পায়ের শব্দ শুনে তিনি যখন পাশের ঘরে আসেন, তখন দরজাটা খোলা ছিল পাশের ঘরের এবং তিনি দেখেছিলেন কাউকে পালিয়ে যেতে, তারপর নীচে গিয়ে দেখলেন, বাইরে যাওয়ার দরজাটা তালা দেওয়া। তাতেই বুঝেছিলাম বাইরের কেউ নয়, ভিতরেরই কেউ।…আচ্ছা পিসিমা, আজ তবে আসি।

কিরীটী পিসিমাকে প্রণাম করে ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *


সূচিপত্রঃ—

সূচিপত্র