রাত্রে – লীলা মজুমদার

শেয়ার করুনঃ

নীলডাঙার জমিদার বাড়িতে চুরি হবার দুমাস পরে বিশে গিয়ে ধরা দিল। ততদিনে খোঁজ-খোঁজ রব অনেক কমে এসেছে, কেন যে বিশে ধরা দিল কেউ ভেবেই পায় না।

 

“বাবু, আমাকে এখন থেকেই গারদে পুরে রাখুন। অতগুলো গয়নাগাঁটি চুরি করেছি, আমাকে ছেড়ে রাখা ঠিক হবে না।”

 

থানার ইন্‌স্পেক্টরবাবু ওকে পাগল ঠাওরালেন। এক সঙ্গে অত সোনাদানা পেয়ে ব্যাটার চোখ ঝলসে নিশ্চয় মাথা খারাপ হয়ে গেছে, নইলে গামছায় বাঁধা এমন রাশি-রাশি হীরে-মণি দেখে ইন্‌স্পেক্টার বাবুর নিজেরই সৎজীবনের উপর ঘেন্না ধরে যাচ্ছিল, আর এ লোকটা বলে কী!

 

“বাবু, আমি কিচ্ছু চাই না, খালি আমাকে এখুনি ফাটকে দিন। অনুতাপ? না বাবু, অনুতাপ-টাপ আমার হয়নি। আমার এখনো মনে হয় যারা ওইরকম অসাবধান, তাদের জিনিসপত্র সরিয়ে ফেলাই উচিত। তাছাড়া আমরা যদি চুরিচামারিই না করব তবে আপনাদের চাকরিরই বা কী অবস্থা হবে? সেজন্য নয় বাবু; আমার উপর দয়া করে আমাকে হাজতে দিন। দেখুন আমি মোটেই ভালো লোক নই। তাছাড়া কী আর বলব বলুন, এরপর আমি কখনো একা-একা অন্ধকার রাতে ঘুরে বেড়াতে পারব না, এখানে-ওখানে নির্জন জায়গা দেখে গা ঢাকা দিতে পারব না, খালি বাড়িতে রাত কাটাতে পারব। না।”

 

ইন্‌স্পেক্টরবাবু অবাক হয়ে দেখলেন, বিশের সর্বাঙ্গে কাঁটা দিচ্ছে, কপাল দিয়ে ঘাম ঝরছে। একটা টুলে তাকে বসিয়ে বারবার বললেন, “তোমার কোনো ভয় নেই। সমস্ত ব্যাপারটা আমাকে খুলে বল দিকি— কোনো ভয়ের কারণ নেই।”

 

কাষ্ঠহাসি হেসে বিশে বললে, “ভয়? ইন্‌স্পেক্টরবাবু ভয়ের কথা বলছেন? তবে শুনুন: ঠিক দুমাস হল গয়নাগুলো নিয়েছিলাম। একা হাতেই কাজ সেরেছিলাম। একতলায় গয়নাগাঁটি রেখে কেউ দোতলায় ঘুমোয় বলে শুনেছেন? তায় আবার বাজে তালা দেওয়া সস্তা খেলো একটা লোহার সিন্দুক। ওঁদের একটু দয়া করে বলে দেবেন তো গয়নাগাঁটিতে কিছু কম পয়সা খরচ করে, সিন্দুক একটা ভালো দেখে কিনতে।

 

পরের জিনিস কখনো চুরি করেছেন? পালিয়ে বেড়ানো কাকে বলে জানেন? যাকে দেখি তাকেই মনে হয় শত্রু, বন্ধুবান্ধবকেও মনে হয় বিশ্বাসঘাতক, কোথাও নিশ্চিন্ত হবার যো থাকে না, নিরাপদ একটি জায়গা খুঁজে পাওয়া দায় হয়ে ওঠে। যাই হোক, একদিন এখানে দুদিন ওখানে লুকিয়ে বেড়াচ্ছি। উঃ বলিহারি আপনাদের পুলিসদের বুদ্ধি! কতবার যে তাদের নাকের ডগা দিয়ে ঘুরে এসেছি, একবার পথ বাতলে দিয়ে ছিলাম পর্যন্ত। বয়সও হচ্ছে আজকাল, ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। একদিন দুপুররাতে আমাকে ধরে ফেলেছিল আর কী! ছুটতে ছুটতে আমার দম বেরিয়ে গেছে, বুকের ভিতর হাতুড়ি পিটছে, চোখে অন্ধকার দেখছি। কোথায় যাই? সামনে দেখি একটা প্রকাণ্ড বাড়ি, তার সদর দরজা একটুখানি খোলা।

 

ঢুকে পড়ে সেটাকে ঠেলে বন্ধ করে তাতেই ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে হাঁপাচ্ছি। ভাঙা জানলা দিয়ে একটু একটু রাস্তার আলো আসছে। এখুনি ঝড় উঠবে, বৃষ্টি পড়বে, বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। অন্ধকারে যখন চোখ অভ্যস্ত হয়ে গেল, বুঝতে পারলাম এটা খালি বাড়ি। আঃ! কী আরাম যে লাগল বাবু, সে আর কী বলব! একটি রাত অন্তত নিশ্চিন্তে ঘুমোন যাবে, কে জানে হয়তো দু’-চারদিন এখানে এই খালি বাড়িতে লুকিয়ে থাকাও যাবে। এখানে আবার কে আমার খোঁজ করবে, আমি নিজেই আবার ও জায়গাটা খুঁজে পাব কিনা সন্দেহ। হেঁটে হেঁটে পালিয়ে পালিয়ে পায়ের গুলিদুটো দড়ির মতো পাকিয়ে উঠেছে, দুটো দিন একটু বিশ্রাম পাওয়া যাবে। একটু নিশ্চিন্তে ঘুমানো যাবে।

 

আস্তে আস্তে দরজার খিল তুলে দিলাম। দেশলাই জ্বালতে সাহস হল না যদি ভাঙা জানলা দিয়ে দেখা যায়। হাতড়ে হাতড়ে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠলাম। কেউ কোথাও নেই। বহুদিন কেউ এখানে থাকেনি, চারদিক ধুলোয় ধূসর। আশ্চর্য হলাম ভেবে রেফেউজিরা কেন‌ এটাকে দখল করেনি। বোধহয় খুঁজে পায়নি। কোথাও কিচ্ছু নেই। একেবারে খালি বাড়ি।

 

কাঠের সিঁড়ি মাঝে মাঝে ক্যাঁচ কোঁচ করে ওঠে, তা ছাড়া চারদিক একেবারে নিঝুম। তিনতলায় গিয়ে দাঁড়ালাম। সেখানে ঘুটঘুটে অন্ধকার, জানালার খড়খড়ি সব এঁটে বন্ধ করা, একটুও আলো আসে না। সাহস করে দেশলাই জ্বেলে সামনের বড় ঘরটাতে ঢুকলাম।

 

সঙ্গে সঙ্গে বাইরে ঝম্‌ ঝম্‌ করে বৃষ্টি এল শুনতে পেলাম। পকেট থেকে মোমবাতির টুকরো বের করে জ্বাললাম। মস্ত খালি ঘরে শুধু একটা বড় তক্তপোষ, বিশাল উঁচু ছাদ। কাঠের জানলাগুলো ভালো করে বন্ধ করা। মোমবাতিটা তক্তপোষের উপর নামিয়ে, গামছা দিয়ে তক্তপোষটা ভালো করে ঝেড়ে নিলাম।

 

তারপর পা দু’খানি মেলে তার উপর বসে পড়লাম। সে যে কী আরাম সে আর আপনি কী বুঝবেন!

 

গামছায় বাঁধা পুঁটলিটি খুলে ফেলে তক্তপোষের উপর গয়নাগুলো ঢেলে ফেললাম। মোমবাতির আলোতে সেগুলো চিকমিক করতে লাগল। এই আমার এত দুঃখের কারণ। এমন সময় স্পষ্ট শুনলাম পায়ের শব্দ! পুলিসের লোক? কী বলব বাবু, বুকটা এমন জোরে ঢিপ ঢিপ করতে লাগল যে নিজের কানে সে শব্দ শুনতে পেলাম। সিঁড়ি দিয়ে আস্তে আস্তে কে উঠে আসছে। সামনের দরজায় আগল দিয়ে এসেছি। তবে কি পিছনে কোনো দরজা খোলা ছিল? সত্যি বলছি, সে যে বাইরে থেকে নাও আসতে পারে একথা আমার একবারও মনে হয়নি।

 

কাঠ হয়ে বসে রইলাম। গয়নাগুলো লুকিয়ে ফেলতেও ভুলে গেলাম।

 

পায়ের শব্দ আস্তে আস্তে তিনতলায় এসে পৌঁছল, তারপরই দরজার সামনে তাকে দেখতে পেলাম। সে যে কীরকম রূপসী, আমি মুখ মানুষ, কথায় বোঝাতে পারব না। এই এক হাঁটু কালো কোঁকড়া চুল, সাদা পদ্মফুলের মতো মুখখানি, টানা টানা চোখ দুটি হিরের মতো জ্বলজ্বল করছে, চাঁপাফুলের মতো হাত দিয়ে গায়ের উপর সাদা কাপড়খানিকে জড়িয়ে ধরেছে। বিধবা মনে হল। মাথায় সিঁদুর নেই, গায়ে গয়না নেই, খালি রূপ দিয়ে, ঘর আলো করে দাঁড়িয়ে রইল।

 

আমি তাকে দেখে একেবারে হাঁ করে চেয়ে রইলাম, মুখে কথাটি সরল না। তার চোখ দুখানি আমার কোলের কাছের গয়নার ঢিপির উপর পড়ল। অমনি তার মুখখানি ছলছলিয়ে উঠল, কাছে এসে আমাকে বলল, “ওমা! এত গয়না কোথায় পেলে?” দু’খানি ফর্সা হাত বাড়িয়ে গোছা গোছা গয়না তুলে ধরে নেড়েচেড়ে দেখতে লাগল।

 

“এর জন্য মানুষ খুন করে, পাপ করে, প্রাণ দেয়! ইস, এত গয়না কারো থাকতে পারে আমি জানতাম না। দেখি, দেখি, এ যেন চুনি পান্না গজমোতি মনে হচ্ছে।”

 

আস্তে আস্তে দুগাছা লম্বা মালা নিজের গলায় পরিয়ে দিল। দুহাতে হাঙ্গরের মুখ দেওয়া বালা পরল, চুড় পরল, আঙুলে আংটি পরল। সেইখানে তক্তপোষের উপর হাঁটুগেড়ে বসে পড়ে গা ভরে গয়না পরল। আমার কেমন যেন দশার মতো হল, কিচ্ছু বলতে পারলাম না। ভাবছিলাম যদি বাইরে থেকেই এল তো ওর চুল কাপড়-চোপড় ভেজেনি কেন?

 

তারপর আস্তে আস্তে যখন উঠে দাঁড়াল, ঠিক যেন দুগগো ঠাকরুন। আমায় বললে, “একটি আয়না দিতে পার?” আমি মাথা নাড়লাম। “আয়না নেই? সে কী কথা! তবে আমি কোথায় আয়না পাব?” চারদিকে একবার তাকাল, তারপর দরজার দিকে চলল। তখন আমার চৈতন্য হল। ছুটে গেলাম তার পিছন পিছন, “কোথায় যাচ্ছেন মা-ঠাকরুন আমার গয়না নিয়ে?” সেও ছুটে দরজা দিয়ে বেরোল, আমিও তার পিছন পিছন দৌড়লাম। সিঁড়ির মাথায় ধরে ফেলি আর কী। এমন সময় মাথা ফিরিয়ে একবার আমার দিকে তাকিয়ে দেখল। মুখখানি যে কী হতাশায় ভরা! তারপর সেইখান থেকে সিঁড়ির নিচু রেলিং-এর উপর দিয়ে এক লাফ দিল।

 

বিশে দুহাতে কান ঢেকে বলল, সে পড়ার শব্দ এখনো আমার কানে লেগে আছে। তারপর সব যখন চুপ হয়ে গেল, ধীরে ধীরে পুঁটলিটা বেঁধে মোমবাতি হাতে করে নীচে নামলাম। এখানে আর নয়, শেষে কি খুনের দায়ে পড়ব।

 

নিচে এসে দেখলাম চারদিকে গয়নাগুলি ছড়িয়ে পড়ে আছে, সে মেয়েটির চিহ্নমাত্র নেই। আলো ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পাগলের মতো সবদিক চেয়ে দেখলাম, ধুলোর উপর আমার ছাড়া কারো পায়ের ছাপ পর্যন্ত নেই। এতক্ষণে আমার প্রাণে ভয় ঢুকল, আমার গায়ের রক্ত হিম হয়ে গেল, নিশ্বাস বন্ধ হয়ে এল। গয়না যেমন তেমনই পড়ে রইল, কোনোরকমে দরজার আগল খুলে ছুটে জল-ঝড়ের মধ্যে বেরিয়ে পড়লাম।— “বাবু, এই নিন বাকি গয়নাগুলো, আর আমাকে আরো চার-পাঁচজন দুষ্টলোকের সঙ্গে এক ঘরে বন্ধ করে রাখুন।”

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments