কঙ্কগড়ের কঙ্কাল (কিশোর কর্নেল) – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ

শেয়ার করুনঃ

চার 

কঙ্কাল দর্শনের পর শ্মশানযাত্রা। যদিও দিনদুপুর, ব্যাপারটা বেশ অস্বস্তিকর। কর্নেলের সঙ্গে হাঁটতে-হাঁটতে বনবাদাড় ভেঙে যেখানে পৌঁছোলাম, সেখানে একটা নদী। নামেই নদী। বালি আর পাথরে ঠাসা অগভীর একটা সোঁতা। এঁকেবেঁকে ঝিরঝিরে একফালি কালো জল অবশ্য বয়ে যাচ্ছে। প্রকাণ্ড একটা বটগাছের তলায় জীর্ণ কুঁড়েঘর। নদীর বালিতে গর্ত খুঁড়ে তিনটে কাচ্চাবাচ্চা হুল্লোড় করে কী খেলা খেলছে।

 

কর্নেল কুঁড়েঘরের কাছে গেলেন। এতক্ষণে ওপাশে একটা বাঁশের মাচা দেখতে পেলাম। মাচায় বসে আছে একটা পনেরো-ষোলো বছরের ছেলে। কষ্টিপাথরে খোদাই করা চেহারা যেন। পরনে হাফপ্যান্ট আর ছেঁড়া লাল গেঞ্জি। আমাদের দেখে সে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। কর্নেল মিঠে গলায় বললেন, কী মনাই? আমাকে চিনতে পারছ না? গত বছর তুমি আমাকে জঙ্গলের গাছ থেকে কত অর্কিড পেড়ে দিয়েছিলে, মনে পড়ছে।

 

মনাই নামে ছেলেটির মুখে একই হাসি ফুটল। মাচা থেকে নেমে সেলাম দিয়ে বলল নদীর ওপারে একটা গাছে দেখেছি স্যার! লাল-লাল পাতা।

 

তোমার বাবার খবর শুনে মন খারাপ হয়ে গেছে মনাই!

 

মনাইয়ে মুখের খুশি চলে গেল। চোখ নামিয়ে আঙুল খুঁটতে থাকল। বুঝলাম, মনাই সেই জগাইয়ের ছেলে। তার চোখ ছলছল করছিল।

 

কর্নেল বললেন, তোমার মা কোথায়?

 

মনাই আস্তে বলল, ঘাটোয়ারিবাবুর অফিসে গেছে। বাবার মাইনের টাকা বাকি। বাবু রোজ ঘোরাচ্ছে মাকে।

 

কর্নেল বাঁশের মাচায় সাবধানে বসলেন। পুরোনো মাচা ওঁর ভার সইতে পারবে না মনে হচ্ছিল। উনি ইশারায় আমাকে বসতে বললেন। ভয়ে ভয়ে একপাশে বসলাম। কর্নেল বললেন, জগাইয়ের এটা আড্ডা-দেওয়ার আখড়া ছিল জয়ন্ত! সন্ধেবেলা ওর কাছে কত লোক আড্ডা দিতে আসত। তাই না মনাই?

 

মনাই মাথা নাড়ল।

 

মাঝে মাঝে সাধুসন্ন্যাসীরাও এসে এখানে ধুনি জ্বালিয়ে বসতেন শুনেছি। জগাই বলছিল। তো তোমার বাবা খুন হওয়ার আগেও নিশ্চয় কোনো সাধুসন্ন্যাসী এসেছিলেন। ওই যে! ধুনির ছাই দেখছি।

 

মনাই একটু ইতস্তত করে বলল, ম্যাজিকবাবুর সঙ্গে এক সাধু আসত স্যার! চেহারা দেখলে ভয় করে। মাথায় জটা। লাল চোখ। মা বলছিল, ওই সাধুই প্রথমে ম্যাজিকবাবুকে চণ্ডীর থানে বলি দিয়েছে। তারপর বাবাকে।

 

ম্যাজিকবাবু মানে শচীন হাজরা?

 

মনাই মাথা দোলাল। বলল, মা বলছিল, ওই সাধুই অজ্ঞান করে বাবাকে বলি দিয়েছে। বাবাকে যে রাত্তিরে বলি দেয়, খুব ঝড়বৃষ্টি হচ্ছিল। আমি জেগেই ছিলাম। মা বারবার ঘরের দোর ফাঁক করে বাবাকে ডাকছিল। বাবা এল না। শেষে জলঝড় থামলে মা লণ্ঠন হাতে এখানে এল। আমাকেও সঙ্গে নিয়ে এল। বলল, দুজনে ঠ্যাং ধরে টানতে-টানতে ঘরে ঢোকাব।

 

কর্নেল চুরুট জ্বেলে বললেন, বলো কী! তারপর?

 

এসে দেখি বাবা নেই। সাধু বসে আছে। মা সাধুবাবাকে ডাকাডাকি করল। সাধুবাবা চোখ বুজে মন্তর পড়ছিল। তাকালই না। তখন মা সাধুবাবাকে বকাঝকা করল। অনেকক্ষণ পরে সাধুবাবা চোখ কটমট করে বলল, জগাইকে একটা কাজে পাঠিয়েছি। তোরা ঘুমোগে যা।

 

তোমরা ঘুমোতে গেলে?

 

মনাই ছোট্ট শ্বাস ছেড়ে বলল, হুঁ। তারপর আর বাবার পাত্তা নেই। সক্কালে একটা মড়া এল। ঘাটোয়ারিবাবুর লোক এক পাঁজা কাঠ মাথায় করে এল। বাবা নেই দেখে সে মায়ের সঙ্গে ঝগড়া করল। সেই সময় রামু হাঁপাতে হাঁপাতে এসে খবর দিল চণ্ডীর থানে।

 

মনাই ঢোক গিলে থেমে গেল। কর্নেল বললেন, পুলিশ আসেনি তারপর?

 

এসেছিল স্যার! মা সব বলেছে পুলিশকে।

 

আচ্ছা মনাই, সেই সাধুবাবুকে আগে কখনও দেখেছ? ভালো করে ভেবে বলো।

 

দেখিনি। তবে চেনা-চেনা মনে হয়েছিল।

 

ভজুয়াকে নিশ্চয় চিনতে তুমি? সে-ও তো বলি হয়ে গেছে শুনেছি।

 

হ্যাঁ স্যার! মা বলছিল এ-ও সাধুবাবার কাজ। সাধুবাবা নাকি মানুষ না। মানুষের রূপ ধরে এসেছিল।

 

কর্নেল গম্ভীর মুখে মাথা দোলালেন। ঠিক বলেছ মনাই! শুনেছি সাধুবাবা আসলে একটা নরকঙ্কাল।

 

মনাই চমকে উঠল। ভয়-পাওয়া মুখে বলল, স্যার! মা বলছিল, সাধুবাবার কাছে যেন একটা কঙ্কাল দাঁড়িয়েছিল। আমি দেখতে পাইনি। মা নাকি দেখেছিল।

 

সেই ঝড়বৃষ্টির রাতে?

 

মনাই জোরে মাথা দোলাল। কর্নেল ওর হাতে একটা দশটাকার নোট গুঁজে দিলেন। সে টাকাটা নিয়ে পকেটে ঢোকাল। বলল, চলুন স্যার! সেই গাছ থেকে লালপাতার ঝুরি পেড়ে দেব।

 

ওবেলা আসব’খন। তো, ভজুয়া তোমার বাবার কাছে আড্ডা দিতে আসত না?

 

আসত। আসত স্যার!

 

সাধুবাবা থাকার সময় ভজুয়া এসেছিল?

 

হুঁ।

 

কর্নেল উঠলেন। বললেন, ওবেলা আসব। তখন তোমার মায়ের সঙ্গে দেখা করব। চলি!

 

শ্মশানতলা থেকে একফালি পায়ে-চলা পথে পৌঁছে বললাম, ছেলেটা বেশ স্মার্ট। এবং অত্যন্ত সরল।

 

প্রকৃতির মধ্যে যারা থাকে, তারা স্বভাবত সরল হয়। আর ওকে স্মার্ট বললে। সে-ও ঠিক। কারণ এখনই ওকে বেঁচে থাকার জন্য লড়াই দিতে হবে। সম্ভবত এই বয়সেই ঘাটোয়ারিবাবু ওকে কাজে বহাল করবেন। তবে মড়াপোড়ানো কাজটা ওর পক্ষে কঠিন হবে না। বাবার সঙ্গে এই কাজটা ওকে করতে হয়েছে। আমি দেখেছি।

 

এবার আমরা কোথায় যাচ্ছি?

 

ম্যাজিকবাবুর বাড়ি।

 

কঙ্কগড়ের এদিকটা চেহারায় একেবারে পাড়াগাঁ। গা ঘেঁষাঘেঁষি মাটির বাড়ি, টালি বা খড়ের চাল। কিন্তু কয়েকটা বাড়ির মাথায় টিভির অ্যান্টেনা দেখে অবাক হলাম। কিছুক্ষণ পরে একটা পিচের রাস্তায় উঠলাম। এরপর মফসসল শহরের চেহারা। নতুন-পুরোনো একতলা বা দোতলা বাড়ি। পিচ রাস্তায় ট্রাক, টেম্পো, জিপ, প্রাইভেট কার এবং সাইকেল রিকশার বিরক্তিকর আনাগোনা। মোড়ে একটা খালি সাইকেল রিকশার কাছে গেলেন কর্নেল। বললেন, ওহে রিকশাওলা, এখানে ম্যাজিকবাবুর বাড়িটা কোথায় জানো?

 

রিকশাওলা চমকে-ওঠা ভঙ্গিতে বলল, ম্যাজিকবাবু? সে তো মা চণ্ডীর থানে নরবলি হয়ে গেছে স্যার!

 

বলো কী!

 

আজ্ঞে হ্যাঁ। সে এক সাংঘাতিক কাণ্ড। কথায় বলে, বেদের মরণ সাপের হাতে। যে ভূতটাকে নিয়ে খেলা দেখাত, সেই ভূতটাই নাকি বলি দিয়েছে!

 

ভূত নিয়ে খেলা দেখাত ম্যাজিকবাবু? কেমন ভূত? তুমি দেখেছিলে ভূতের খেলা?

 

রিকশাওলা দুঃখিত মুখে একটু হাসল। দেখেছিলাম স্যার! নরকঙ্কাল ইস্টেজে এসে নাচত। ম্যাজিকবাবু বলত, ওঠ। উঠে দাঁড়াত। বোস, বললে বসত। নাচ, বললে নাচত। সে কী নাচ স্যার!

 

কর্নেল চুরুট জ্বেলে বললেন, ওর বাড়িটা কোথায়? নিয়ে চলো আমাদের।

 

রিকশাওলা বলল, ম্যাজিকবাবুর নিজের বাড়ি তো ছিল না স্যার! বাউন্ডুলে লোক। মাঝে-মাঝে এসে থাকত। আবার চলে যেত কোথায়।

 

কিন্তু কার বাড়িতে এসে থাকত?

 

মোহনবাবুর বাড়িতে। ইস্কুলের মাস্টার উনি।

 

চলো। মোহনবাবুর কাছে যাওয়া যাক। বলে কর্নেল রিকশায় উঠে বসলেন। ওঁর ইশারায় আমিও উঠে বসলাম।

 

রিকশাওলা বলল, কিন্তু মাস্টারমশাই তো এখন ইস্কুলে আছেন।

 

ওঁর বাড়ি গিয়ে খবর দেব’খন। তুমি ওঁর বাড়িতেই নিয়ে চলো।

 

বাড়ি অবধি রিকশা যাবে না।

 

যতদূর যায়, নিয়ে চলো।

 

রিকশাওলা অনিচ্ছা-অনিচ্ছা করে প্যাডেলে চাপ দিল। যেতে-যেতে বলল, মাস্টারমশাইয়ের বাড়িতে কাউকে পাবেন না। মিছিমিছি হয়রান হবেন, স্যার!

 

কর্নেল বললেন, কেন? বাড়িতে লোক নেই?

 

নাহ। মাস্টারমশাই একা থাকেন। বিয়ে-টিয়ে করেননি। বিধবা দিদিকে এনে রেখেছিলেন। তিনিও স্বগগে গেছেন।

 

ম্যাজিকবাবু সঙ্গে নিশ্চয় কোনও সম্পর্ক ছিল মাস্টারমশাইয়ের?

 

শুনেছি, পিসতুতো না মাসতুতো ভাই ওঁরা!

 

পিচরাস্তা ছেড়ে খোয়াঢাকা এবড়োখেবড়ো ঘিঞ্জি গলি রাস্তায় এগোচ্ছিল রিকশা। একসময় নিরিবিলি একটা জায়গায় পৌঁছোলাম। কাছাকাছি বাড়ি নেই। শুধু জরাজীর্ণ ছোটো ছোটো মন্দির আর পোড়ো ভিটে। জঙ্গল গজিয়ে আছে চারদিকে। সংকীর্ণ রাস্তাটা সোজা এগিয়ে গেছে। একধারে রিকশা দাঁড় করিয়ে রিকশাওলা বলল, আর যাওয়া যাবে না স্যার। এই যে পায়ে চলা রাস্তা দেখছেন, সিধে গিয়ে বাঁ দিকে তাকাবেন। মাস্টারমশাইয়ের বাড়ি দেখতে পাবেন!

 

আমরা নামলে সে রিকশা ঘুরিয়ে একটু হেসে বলল, মাস্টারমশাইকে খবর দেওয়ার লোক পাবেন কি? দেখুন। বরঞ্চ আমাকে দুটো টাকা বাড়তি দিলে ইস্কুলে খবর দেব। আপনাদের ফেরত নিয়েও যাব।

 

কর্নেল ওকে পাঁচ টাকার নোট দিয়ে বললেন, দরকার নেই। আমি লোক খুঁজে নেব। রিকশাওলা এতক্ষণে সন্দিগ্ধমুখে আমাদের দিকে তাকাতে তাকাতে রিকশার সিটে উঠল। তারপর কে জানে কেন, খুব জোরে রিকশা চালিয়ে চলে গেল। কর্নেল অভ্যাসমতো বাইনোকুলারে চারদিক দেখে নিয়ে বললেন, এসো জয়ন্ত। কুইক। আমার ধারণা, রিকশাওলা মোহনবাবুকে যেচে পড়েই খবর দেবে, দুজন উটকো লোক ওঁর বাড়িতে গেছেন।

 

পায়ে চলা পথে শুকনো পাতা পড়ে আছে। দু-ধারে পোড়ো ভিটে আর ভাঙাচোরা শিবমন্দির। ঘন ঝোপঝাড় আর উঁচু গাছপালা পাখিদের তুমুল চ্যাঁচামেচি চলেছে। এলোমেলো জোরালো হাওয়া দিচ্ছে। বাঁ দিকে প্রায় হানাবাড়ির মতো দেখতে একটা একতলা বাড়ি দেখা গেল। সদর দরজায় তালা আঁটা। কর্নেল বাড়ির পেছন দিকে এগিয়ে গেলেন। ওঁকে অনুসরণ করলাম। ওদিকটায় একটা হজামজা পুকুর দেখা গেল। কর্নেল আবার চারপাশটা খুঁটিয়ে দেখে নিয়ে বললেন, তুমি এই ঝোপের আড়াল থেকে ওই রাস্তার দিকে লক্ষ্য রাখো। কাউকে এদিকে আসতে দেখলে তিনবার শিস দেবে। বোকামি কোরো না কিন্তু। সাবধান।

 

বাড়ির পেছনের পাঁচিল জায়গায় জায়গায় ধসে গেছে কবে। সেখানে ডালপালার বেড়া দেওয়া হয়েছে। এখানে বেড়া ঠেলে সরিয়ে কর্নেল ঢুকে গেলেন। বুক ঢিপঢিপ করতে লাগল। পকেট থেকে রিভলভারটা বের করে বাগিয়ে ধরলাম এবং গুঁড়ি মেরে বসলাম। রাস্তাটার দিকে নজর রাখলাম।

 

তারপর কর্নেলের আর পাত্তা নেই। বসে আছি তো আছিই। অস্বস্তি যত, বিরক্তিও তত। কতক্ষণ পরে পেছনে কোথাও শুকনো পাতার মচমচ শব্দ এল। দ্রুত পিছু ফিরে দেখি, পুকুরের দিকে নেমে যাচ্ছে একটা গাধা। তার পিঠে একটা বোঁচকা বাঁধা। রামুর গাধাটা নয় তো?

 

গাধাটা অদৃশ্য হলে আবার রাস্তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। একটু পরে দেখি কর্নেল যা বলেছিলেন, ঠিক তা-ই। সেই রিকশাটা এসে থামল। রিকশা থেকে রোগা চেহারার ধুতিপাঞ্জাবি পরা এক ভদ্রলোক হন্তদন্ত নামলেন। অমনই তিনবার শিস দিলাম।

 

এতক্ষণে কর্নেল বেড়া গলে বেরিয়ে এলেন। চাপা স্বরে বললেন, কেটে পড়া যাক। চলে এসো।

 

আমরা গুঁড়ি মেরে পুকুরের দিকে এগিয়ে গেলাম। পুকুরের চারপাড়ে ঘন জঙ্গল। তলায় দামে ঢাকা খানিকটা জল। গাধাটা পিঠে বোঁচকা নিয়ে অদ্ভুত ভঙ্গিতে জলজ ঘাস খাচ্ছে। কর্নেল গাধাটার দিকে প্রায় দৌড়ে গেলেন। ওঁর এই পাগলামি দেখে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম।

 

উনি কাছে যেতেই গাধাটা এক লাফে পুকুরের ধারে ধারে নড়বড় করে দৌড়োতে থাকল। কর্নেল তাড়া করলেন। গাধাটা পাড়ের জঙ্গল ফুঁড়ে উধাও হয়ে গেল।

 

এবং কর্নেলও।

 

অগত্যা আমাকে দৌড়োতে হল। পাশের জঙ্গলে ঢুকেছি, পেছন থেকে চেরা গলায় হাঁকডাক ভেসে এল, চোর! চোর! ধর! ধর!

 

একবার ঘুরে দেখে নিলাম, সেই রিকশাওলা আর সম্ভবত মোহন মাস্টারমশাই দৌড়ে আসছেন। কেলেঙ্কারিতে পড়া গেল দেখছি। জঙ্গল পেরিয়ে গিয়ে দেখলাম কর্নেল বা গাধা নেই। হলুদ ফুলে ঢাকা সরষে আর সবুজ ধানখেত এদিকটায়। ডানদিকে পোড়ো ভিটে আর ভাঙাচোরা মন্দির। লুকিয়ে পড়ার জন্য সেদিকটায় দৌড়ে গেলাম। পেছনের চ্যাঁচামেচি ততক্ষণে বন্ধ হয়ে গেছে।

 

হাঁপাতে হাঁপাতে একটা ভাঙা শিবমন্দিরের আড়ালে গিয়ে গুঁড়ি মেরে বসলাম। তারপরে দেখতে পেলাম কর্নেলকে। চোখে বাইনোকুলার রেখে একটা উঁচু গাছের ডগায় কিছু দেখছেন। কাছে গিয়ে বললাম, কী অদ্ভুত কাণ্ড আপনার।

 

ডার্লিং। আমার চেয়ে অদ্ভুত কাণ্ড করল রামুর গাধাটা। রামু পাগল হয়েছে। গাধাটার তো পাগল হওয়ার কথা নয়।

 

বিরক্ত হয়ে বললাম, আর একটু হলেই কেলেঙ্কারি হত। সেই রিকশাওলা আর মোহনবাবু আমার পেছনে চোর-চোর, ধর-ধর বলে তাড়া করেছিলেন।

 

কর্নেল বাইনোকুলার নামিয়ে বললেন, তোমাকে দেখে ফেলেছিলেন নাকি?

 

হ্যাঁ।

 

সেটা তোমারই বোকামি। আমার পেছন-পেছন তোমারও দৌড়োনো উচিত ছিল। বলে কর্নেল চারপাশটা দেখে নিয়ে পা বাড়ালেন। কুইক জয়ন্ত। আর এখানে নয়। গাধাটা এতক্ষণে ঝিলের জঙ্গলে গিয়ে পৌঁছেছে।

 

নাহ। আপাতত গাধার পেছনে ছোটা নিরর্থক।

 

সোজা এগিয়ে সেই পিচের রাস্তায় পৌঁছোলাম দুজনে! তারপর একটা খালি সাইকেল রিকশা দাঁড় করিয়ে কর্নেল বললেন, জমিদারবাড়ি। তাড়াতাড়ি চলো ভাই।

 

আকার প্রকারে মনে হচ্ছিল, এসব বাড়িকেই হয়তো একসময় বলা হত সাতমহলা পুরী। কিন্তু এখন হতশ্রী অবস্থা। দেউড়ি আছে এবং মাথায় দুটো সিংহও আছে। কিন্তু সিংহের পেট ফুড়ে অশ্বত্থচারা গজিয়েছে। দারোয়ান থাকার কথা নয়। দু-ধারে পামগাছ এবং এবড়োখেবড়ো একফালি রাস্তা। পোর্টিকোর তলায় গিয়ে রিকশা থেকে দুজনে নামলাম। তারপর হলঘরের দরজায় দীপককে দেখলাম। বলল, আসুন, আসুন। ওপর থেকে আপনাদের দেখতে পেলাম। আবার কোনও গন্ডগোল হয়নি তো?

 

কর্নেল বললেন, নাহ। তোমার বাবা আছেন?

 

বাবা স্কুলে গেলেন একটু আগে। ম্যানেজিং কমিটির মিটিং আছে। উনি তো কমিটির সেক্রেটারি। ভেতরে আসুন।

 

হলঘরে ঢুকে কর্নেল বললেন, হালদারমশাইয়ের খবর কী?

 

দীপক হাসল, ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়েছেন! অদ্ভুত মানুষ!

 

আচ্ছা দিপু, তোমাদের পাতালঘরের চাবি কার কাছে থাকে?

 

দীপক একটু গম্ভীর হয়ে বলল, ভজুয়ার কাছে নীচে কিছু ঘরের চাবি থাকত। কারণ সেই-ই এসব ঘর দেখাশোনা করত। আসলে ভজুয়া যে ঘরে থাকত, তার পাশে একটা ঘরে পুরোনো ভাঙাচোরা আসবাবপত্র ঠাসা আছে। ওই ঘরের কোনাতেই পাতালঘরে নামার গোপন সিঁড়ি আছে।

 

ঘরটা একটু দেখতে চাই। মানে সেই সিন্দুকটা।

 

এক মিনিট! মায়ের কাছ থেকে চাবি নিয়ে আসছি।

 

একটু পরে সে চাবির গোছা নিয়ে ফিরে এল। গোলাকধাঁধার মতো কয়েকটা ঘরের ভেতর দিয়ে সেই ঘরটাতে নিয়ে গেল সে। দরজা খুলে সুইচ টিপে আলো জ্বালল। আবর্জনার মতো পুরোনো চেয়ার-টেবিল-খাট ইত্যাদির স্তূপে ঘরটা ভর্তি। এক কোণে কাঠের আলমারি দাঁড় করানো আছে। দীপক সেটা ঠেলে সরাতেই একটা ছোট্ট দরজা দেখা গেল। সে দরজা খুলে গোপন সুইচ টিপে আলো জ্বালল। বলল, আসুন।

 

সিঁড়ি দিয়ে নেমে ছোট্ট একটা ঘরে পৌঁছোলাম। কেমন ভ্যাপসা দুর্গন্ধ। দেওয়ালে সিঁদুরের ছোপে একটা স্বস্তিকা আঁকা। তার নীচেই কালো কাঠের সিন্দুকটা খুলল দীপক। কর্নেলের পকেটে সব সময় টর্চ থাকে দেখছি। টর্চের আলোয় ভেতরটা খুঁটিয়ে দেখতে থাকলেন। ততক্ষণে দুর্গন্ধে আমি অস্থির। কর্নেল হঠাৎ ঝুঁকে একটা কালচে ছোট্ট জিনিস সিন্দুকের ভেতর থেকে তুলে নিলেন। উজ্জ্বল মুখে বললেন, হুঁ! পাওয়া গেল তা হলে।

 

দীপক বলল, কী পাওয়া গেল কর্নেল?

 

কর্নেল বললেন, যা পাওয়া উচিত ছিল। চলো, বেরোনো যাক এখান থেকে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *