কঙ্কগড়ের কঙ্কাল (কিশোর কর্নেল) – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ

শেয়ার করুনঃ

তিন 

কিচেনের পাশে মেইন সুইচ সত্যি নামানো ছিল। আমার সন্দেহ রঘুলালই কাজটা করেছে। কিন্তু কর্নেল তা মানতে রাজি নন। রঘুলাল তার চেনা লোক। অমন বিশ্বাসী লোক নাকি তিনি জীবনে দেখেননি। দুর্লভ প্রজাতির পাখি, প্রজাপতি, অর্কিডের খোঁজে বহুবার কঙ্কগড়ে এসেছেন। রঘুলাল তার সেবাযত্নের ত্রুটি করেনি। তার সঙ্গী হয়েও ঘুরেছে।

 

তবে লোকটি পাকা রাঁধুনি, স্বীকার না করে পারলাম না। খাওয়ার পর বারান্দায় কিছুক্ষণ গল্পসল্প করে যখন শুয়ে পড়লাম, তখন রাত প্রায় দশটা বাজে। আমার ঘুম আসছিল না। কর্নেল কিন্তু দিব্যি নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছেন। জানালার দিকে তাকাতে আমার ভয় করছে। এই বুঝি তান্ত্রিক আদিনাথের কঙ্কাল এসে উঁকি দেবে!

 

কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ কর্নেলের ডাকে ঘুম ভেঙে গেল। চাপা স্বরে বললেন, উঠে পড়ো ডার্লিং! শিগগির!

 

ধড়মড় করে উঠে বসে বললাম সকাল হয়ে গেলে নাকি?

 

নাহ। রাত দেড়টা বাজে! এখনই বেরিয়ে পড়া দরকার। ওঠো, ওঠো!

 

কোথায়?

 

বাইরে গিয়ে দ্যাখো। তা হলেই বুঝতে পারবে।

 

দরজা কর্নেলই খুলে রেখেছেন। বাংলোর লনে আলো পড়েছে! তার ওধারে আদিম প্রকৃতি। ঝিলের দক্ষিণে জঙ্গলের ভেতর একটা আলো চোখে পড়ল। আলোটা নড়াচড়া করছে। বললাম, দীপক এই আলোর কথাই বলেছিল তা হলে!

 

কর্নেল বললেন, হ্যাঁ সেই আলো। ঝটপট রেডি হয়ে নাও। টর্চ, ফায়ার আর্মস সঙ্গে নেবে। কিন্তু সাবধান! আলো জ্বালবে না বা মাথা খারাপ করে গুলি ছুঁড়বে না।

 

কর্নেল তৈরি হয়েই ছিলেন। আমি তৈরি হয়ে বেরোলে দরজায় তালা এঁটে দিলেন। তারপর দুজনে গেট পেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নীচে রাস্তায় নামলাম। এবার কর্নেল আগে, আমি পেছনে। জ্যোৎস্নার জন্য জঙ্গলের ভেতরটা মোটামুটি স্পষ্ট। কোথাও চকরাবকরা, কোথাও ঘন ছায়া। শনশন করে বাতাস বইছে। কর্নেল যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছেন, বুঝতে পারলাম, এই জঙ্গলের অন্ধিসন্ধি ওঁর পরিচিত। সেই আলোটা কখনো-কখনো আড়ালে পড়ে যাচ্ছে। আলোটা জ্বলছে ঝিলের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে।

 

প্রায় মিনিট পনেরো পরে আমরা যেখানে পৌঁছেছিলাম, সেখানে এখটা ধ্বংসস্তূপ। কর্নেল গুঁড়ি মেরে জঙ্গলে ঢাকা স্তূপের মাঝখান দিয়ে এগোলেন। ফিশফিশ করে বললেন, চুপচাপ এসো। টুঁ শব্দটি নয়।

 

খানিকটা এগিয়ে একটা উঁচু প্রকাণ্ড বটগাছের তলায় গেলাম দুজনে। প্রকাণ্ড সব ঝুরি নেমেছে বটগাছটার। একটা ঝুরির আড়ালে কর্নেল বসে পড়লেন। আমিও বসলাম। সামনে খানিকটা ফাঁকা জায়গা। সেখানেই একটা মশাল মাটিতে পোঁতা আছে। দাউদাউ জ্বলছে।

 

আর মশালের পাশে দাঁড়িয়ে বিকট অঙ্গভঙ্গি করছে সেই নরকঙ্কালটা। মশালের পেছনে একটা পাথুরে দেওয়াল। দেওয়ালে কঙ্কালটার ছায়াও নড়ছে। নিজের চোখকে বিশ্বাস করা কঠিন, এ এমন একটা দৃশ্য।

 

সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ব্যাপার, কঙ্কালের দুহাতের মুঠোয় একটা চকচকে খাঁড়া। একটু তফাতে একটা হাড়িকাঠ পোঁতা আছে। তার পাশে একটা লোক আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে। কঙ্কালটা খাড়া নাচিয়ে খ্যানখেনে গলায় বলে উঠল, এখনও বলছি ওটা কোথায় আছে বল। না বললেই বলি হয়ে যাবি।

 

বন্দি লোকটা গোঁ-গোঁ করে কী বলার চেষ্টা করল। পারল না।

 

কঙ্কালটা হুংকার দিল। ন্যাকামি হচ্ছে? তুই আমার খুলির সমাধি খুঁড়েছিস। তুই, তুই ওটা পেয়েছিস। দে বলছি!

 

বন্দি লোকটা আবার গোঁ-গোঁ করে উঠল। তখন কঙ্কালটা এক পা বাড়িয়ে খাঁড়া তুলে তেমনই খ্যানখেনে গলায় বলে উঠল, তবে মর!

 

এরপর আমার মাথার ঠিক রইল না। কর্নেলের নিষেধ ভুলে গেলাম। চোখের সামনে নরবলি হবে! আস্ত একটা ভূত মানুষের গলায় কোপ বসাবে। এ সহ্য করা যায়? একলাফে বেরিয়ে গিয়ে রিভলবার তুলে গর্জে উঠলাম, নিকুচি করেছে ব্যাটাছেলে ভুতের!

 

অমনই কঙ্কালটা শূন্যে ভেসে পেছনের পাঁচিলের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল। তাড়া করতে যাচ্ছি, কর্নেল ডাকলেন, জয়ন্ত! জয়ন্ত! কী পাগলামি করছ? খাপ্পা হয়ে বললাম পাগলামি আমি করছি না আপনি? চোখের সামনে একটা মানুষকে একটা ভূত ব্যাটাচ্ছেলে বলি দেবে…

 

কর্নেল অট্টহাসি হাসলেন। প্রেতাত্মার পেছনে তাড়া করে লাভ নেই, ডার্লিং! বরং এসো হলদারমশাইয়ের বাঁধন খুলে দিই।

 

আকাশ থেকে পড়ে বললাম, উনি হালদারমশাই? কী সর্বনাশ!

 

কর্নেল মশালটা উপড়ে এনে বন্দি হালদারমশাইয়ের কাছে পুঁতলেন। মশালটা তৈরি করা হয়েছে একটা ত্রিশুলে। টর্চের আলোয় গোয়েন্দা ভদ্রলোকের দুর্দশা দেখে কষ্ট হল। দড়ির বাঁধন খুলে দেওয়ার পর উনি তড়াক করে উঠে দাঁড়ালেন। খি-খি করে একচোট হেসে বললেন, বলি দিত না। ভয় দ্যাখাইতাছিল।

 

কর্নেল টর্চের আলো জ্বেলে সেই ভাঙা দেওয়ালের কাছে কিছু তদন্ত করতে গেলেন। আমি বললাম, হালদারমশাই! কঙ্কালটার হাতে খাঁড়া ছিল। সে সত্যি আপনার গলায় কোপ বসাতে যাচ্ছিল।

 

ক্কী? কঙ্কাল? হালদারমশাই পোশাক থেকে ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে বললেন। কই কঙ্কাল? কোথায় কঙ্কাল? কোথায় দেখলেন?

 

গোয়েন্দা ভদ্রলোক বাধা দিয়ে বললেন, নাহ। একজন সাধুবাবা। ক্যাপালিক কইতে পারেন। তারে ফলো করে আসছিলাম। হঠাৎ সে গাছের উপর থেকে জাম্প দিল। ওঃ! কী সাংঘাতিক জোর তার গায়ে মশাই!

 

কিন্তু আমরা দেখলাম একটা কঙ্কাল খাঁড়া হাতে আপনাকে শাসাচ্ছে।

 

ভুল দ্যাখছেন! বলে হালদারমশাই প্যান্টের পকেটে হাত ঢোকালেন। আবার একচোট হেসে বললেন, আমার ফায়ার আর্মস আছে টের পায় নাই।

 

তা হলে কোনো কঙ্কাল আপনি দেখেননি?

 

নাহ।

 

কিন্তু সে আপনার সঙ্গে কথা বলছিল। শাসাচ্ছিল।

 

কাপালিক! কাপালিক!

 

কর্নেল এসে বললেন, কঙ্কালটাকে হালদারমশাই দেখতে পাননি। কারণ ওঁকে ওপাশে কাত করে ফেলে রেখেছিল। উনি ভাবছিলেন, যে কাপালিক ওঁকে ধরেছে, সে-ই কথা বলছে।

 

হালদারমশাই নস্যির কৌটো বের করে নস্যি নিলেন। তারপর বললেন, কর্নেলস্যার! জয়ন্তবাবু কঙ্কালের কথা বলছেন। কিছু বুঝতে পারছি না। আপনি বুঝাইয়া দেন, এখানে স্কেলিটন আইল ক্যামনে?

 

পরে বুঝিয়ে দেব। এদিকটায় ঝিলের একটা ঘাট আছে। চলুন ঝিলের জলে ঘাড়ে আর চোখেমুখে জলের ঝাপটা দেবেন। ব্রেন ঝরঝরে হয়ে যাবে।

 

কর্নেল মশালটা মাটিতে ঘষটে নেভালেন। তারপর ধ্বংসস্তূপের ভেতর দিয়ে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেলেন। এখানেও একটা ভাঙাচোরা পাথুরে ঘাট।

 

হালদারমশাই রগড়ে হাত-মুখ ধুলেন। কাঁধে জলের ঝাপটা দিলেন। তারপর বললেন, ওই যাঃ! হোয়ার আর মাই শুজ? অ্যান্ড মাই টর্চ?

 

কর্নেল হাসলেন। দেখলেন তো? জল আপনার ব্রেন কেমন চাঙ্গা করে দিয়েছে।

 

হালদারমশাইয়ের জুতো দুটো ওপাশে একটি ভাঙা মন্দিরের তলায় অনেক খোঁজার পর পাওয়া গেল। কিন্তু টর্চটা পাওয়া গেল না। এদিকটায় একসময় দালানকোঠা ছিল বোঝা যাচ্ছে। কর্নেলকে জিজ্ঞেস করলে বললেন, হ্যাঁ। এখানেই কঙ্কগড়ের রাজধানী ছিল। এখন জঙ্গল। মুঘল আমলের একটা গড়ও ছিল। সেটা এই জঙ্গলের দক্ষিণ-পশ্চিমে। এখন একটা ঢিবিমাত্র। যাই হোক, আর এখানে নয়। বাংলোয় ফেরা যাক।

 

হালদারমশাই শ্বাস ছেড়ে বললেন, টর্চটা গেল। কাপালিকেরই কাজ!

 

কর্নেল বললেন, কাপালিক আপনার টর্চ কুড়োনোর সময় পায়নি। কাল সকালে এসে বরং ভালো করে খুঁজবেন।

 

আমরা কয়েক পা এগিয়েছি, হঠাৎ পেছন থেকে একঝলক টর্চের আলো এসে পড়ল। তারপর দীপকের সাড়া পেলাম। কর্নেল! আমি দিপু।

 

হালদারমশাই ঘুরে দাঁড়িয়ে সহাস্যে বললেন, এসো ভাগনে! এসো, মামা ভাগনে একসঙ্গে বাড়ি ফিরব।

 

দীপক প্রায় দৌড়ে এল। উত্তেজিতভাবে বলল জঙ্গলে আলো দেখতে পেয়েছিলাম কিছুক্ষণ আগে। তাই বেরিয়ে পড়েছিলাম, জঙ্গলে ঢুকতে যাচ্ছি, হঠাৎ একটা বিকট হাসি শুনলাম। টর্চ জ্বেলে দেখি…

 

কর্নেল বলে উঠলেন, কঙ্কাল?

 

হ্যাঁ! আস্ত কঙ্কাল। দীপকের হাতে একটা বল্লম দেখা গেল। সেটা তুলে সে বলল, বল্লমটা তাক করতেই কঙ্কালটা ভ্যানিশ! নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছি না কর্নেল! তবে আমি মরিয়া হয়ে উঠেছিলাম। কী করা উচিত ভাবছি, সেই সময় ঝিলের ঘাটে টর্চের আলো চোখে পড়ল। আপনাদের কথাবার্তা শুনতে পেলাম। আলোটা দেখেই কি আপনারাও এখানে এসেছিলেন?

 

হ্যাঁ। কর্নেল বললেন। এবং আমরাও কঙ্কালটাকে দেখেছি।

 

হালদারমশাই জোরে মাথা নেড়ে বললেন, আমি দেখি নাই। আমি একজন কাপালিক দেখেছি। তারে ফলো করেছিলাম।

 

দীপক বলল, কাপালিক! বলেন কী মামাবাবু?

 

হঃ! কাল রাত্রেও তারে ফলো করেছিলাম। চণ্ডীর মন্দিরে ওখানে ত্রিশূল দিয়ে মাটি খুঁড়ছিল। আমার সাড়া পেয়ে পালিয়ে গেল। আবার আজও বহুক্ষণ ওত পেতে থেকে তারে দেখলাম। আজ আর মাটি খুঁড়ছিল না। তার পিঠে একটা বোঁচকা বাঁধা ছিল। বোঁচকা লইয়া দৌড়ানো সহজ নয়। বোঁচকায় কী থাকতে পারে বলুন তো কর্নেলসাব?

 

কর্নেল বললেন, কঙ্কাল থাকতেও পারে।

 

দীপক বলল, তা হলে ওটা কি ঠাকুরদার জ্যাঠামশাইয়ের সেই কঙ্কাল?

 

কর্নেল বললেন, কিছু বলা যায় না।! তবে আর এখানে নয়। বাংলোয় ফেরা যাক। দিপু তুমিও এসো। মামাবাবুর সঙ্গে বাড়ি ফিরবে।

 

দীপক পা বাড়িয়ে নার্ভাস হেসে বলল, ঠাকুরদার লেখা বইটার কথা তা হলে সত্যি? কিন্তু কে ওই কাপালিক?

 

আমি বললাম, সে-যে-ই হোক, আপনাদের পাতালঘর থেকে সে কঙ্কাল চুরি করেছে। এবং কোথায় খুলি পোঁতা ছিল তাও আবিষ্কার করেছে। তারপর ধড়ের সঙ্গে মুণ্ড জুড়েছে। প্রেতাত্মায় বিশ্বাস করি বা না করি, এই ব্যাপারটা বোঝা যাচ্ছে।

 

হালদারমশাই আনমনে বললেন, আমি কঙ্কাল দেখলাম না ক্যান?

 

বললাম, চোখে দেখেননি। তার বিদঘুঁটে কথাবার্তা কানে তো শুনেছেন।

 

হঃ। বলে গুম হয়ে গেলেন গোয়েন্দা ভদ্রলোক।

 

ডাকবাংলোয় আবার আলো নেই। তার চেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার, আমাদের ঘরের দরজার তালা ভাঙা। কিচেনের দিকে গিয়ে দেখি, মেন সুইচ আগের মতো অফ করা আছে। অন করে দিলাম। আলো জ্বলে উঠল। ঘরে ফিরে এসে দেখলাম, লন্ডভন্ড অবস্থা। কর্নেল তাঁর কিটব্যাগ গোছাচ্ছেন। হালদারমশাই বিড়বিড় করছেন, চোর! চোর! কাপালিক না, চোর!

 

দীপক আর আমি ওলট-পালট বিছানা দুটো ঠিকঠাক করে ফেললাম। আমার ব্যাগের জিনিসপত্র মেঝেয় ছত্রখান হয়ে পড়েছিল। গুছিয়ে নিলাম।

 

কর্নেল একটু হেসে বললেন, চোর বড্ড বোকা। তার এটুকু বোঝা উচিত ছিল, যা সে খুঁজতে এসেছে, তা বাংলোয় রেখে যাওয়ার পাত্র আমি নই। আসলে প্রথমে সে ধরেই নিয়েছিল জিনিসটা হালদারমশাইয়ের কাছে আছে। তাই তাকে বলিদানের ভয় দেখাচ্ছিল। আমরা গিয়ে পড়ার পর সে পালিয়ে গেল। কিন্তু তার মাথায় তখন খটকা বেধেছে। বলিদানের হুমকিতেও যখন জিনিসটা পাওয়া গেল না তখন ওটা নিশ্চয় হালদারমশাইয়ের কাছে নেই। সম্ভবত আমার কাছেই আছে। অতএব আমাদের অনুপস্থিতির সুযোগে সে বাংলোয় এসে হানা দিয়েছিল।

 

কর্নেল মেঝের দিকে তাকালেন। খালি পায়ে এসেছিল চোর। লাল সুরকির স্পষ্ট ছাপ পড়েছে। হুঁ, একটুখানি জলকাদা ভেঙেই মানে শর্টকাটে এসেছিল সে। যাইহোক, রাত তিনটে বাজে প্রায়। জয়ন্ত, তুমি কিচেনে গিয়ে কেরোসিন কুকার জ্বেলে, প্লিজ, একপট কফি করে ফেলো। কফি! কফি এখন খুবই দরকার!

 

দীপক বলল, চলুন জয়ন্তদা! আমি আপনাকে হেল্প করছি।

 

রঘুলাল কাজের লোক। কিচেনে সব কিছু ঠিকঠাক রেখে গিয়েছিল। কফি তৈরির কাজটা আমিই করলাম। দীপক প্রহরীর মতো বল্লম আর টর্চ হাতে দাঁড়িয়ে রইল। তার ভাবভঙ্গিতে বোঝা যাচ্ছিল, যে ভীষণ ভয় পেয়েছে। পাওয়ারই কথা। ভয় কি আমিও পাইনি? এই চর্মচক্ষে জ্যান্ত কঙ্কাল দর্শন আর তার বিকট খ্যানখেনে গলায় কথাবার্তা শোনা জীবনে একটা সাংঘাতিক অভিজ্ঞতা। কর্নেল ঠিকই বলেন, প্রকৃতির রহস্যের শেষ নেই সভ্যতার আলোর তলায় আদিম রহস্যে ভরা অন্ধকার থেকে গেছে।

 

কফি করতে করতে হালদারমশাইয়ের দুর্দশার বিবরণ দিলাম দীপকবাবুকে। দীপক হাসবার চেষ্টা করে বলল, ডিটেকটিভদ্রলোকের মাথায় ছিট আছে।

 

বললাম, কর্নেলের মাথাতেও কম ছিট নেই।

 

ট্রেতে কফির পট আর পেয়ালা সাজিয়ে নিয়ে এলাম। দীপক কিচেনে তালা এঁটে দিল। ঘরে ঢুকে দেখি হালদারমশাই চাপা গলায় কর্নেলকে তার তদন্ত রিপোর্ট দিচ্ছেন।

 

কফি খেতে-খেতে ক্রমশ চাঙ্গা হচ্ছিলেন প্রাইভেট ডিটেকটিভ। প্যান্ট শার্টে লালচে দাগড়া-দাগড়া ছোপ। খি-খি করে হেসে বললেন, কর্নেলস্যার কইলেন, যে দড়ি দিয়া আমারে– বাঁধছিল, তা নাকি রামু ধোপার গাধা বাঁধার দড়ি। ঠিক, ঠিক। তাই তো ভাবছিলাম, কাপালিক দড়ি পাইল কই?

 

রামু এবং তার গাধাকে নিয়ে কর্নেল হালদারমশাইয়ের সঙ্গে কিছুক্ষণ রসিকতার পর হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বললেন, নাহ দিপু এবার শুয়ে পড়া উচিত। তোমার মামাবাবুর ওপর বড় ধকল গেছে। ওঁর বিশ্রাম দরকার।

 

হঃ। বলে হালদারমশাই উঠে দাঁড়ালেন।

 

ওঁরা চলে যাওয়ার পর দরজা বন্ধ করে বাতি নিভিয়ে আমরা শুয়ে পড়লাম। কর্নেল বললেন, তা হলে ডার্লিং, তোমাকে যা বলেছিলাম…

 

ওঁর কথার ওপর বললাম, হ্যাঁ। রহস্য ঘনীভূত। কিন্তু কঙ্কাল যে জিনিসটা চাইছিল, সেটা কি ওই চাকতি?

 

হ্যাঁ। ব্রোঞ্জের সিল।

 

কী আছে ওতে?

 

কর্নেল সেই ছড়াটা আওড়ালেন ঘুমঘুম কণ্ঠস্বরে :

 

আটঘাট বাঁধা

বার পনেরো চাঁদা

বুড়ো শিবের শূলে

আমার মাথা ছুঁলে

ওঁ হ্রীং ক্লীং ফট

কে ছাড়াবে জট।

 

তারপর ওঁর নাক-ডাকা শুরু হল। কয়েকবার ডেকে আর সাড়া পাওয়া গেল না। ঘুমোবার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু এমন সাংঘাতিক অভিজ্ঞতার পর ঘুমোনো যায় না। বারবার সেই দৃশ্যটা চোখে ভাসছিল। মশালের আলোয় ভাঙা দেওয়ালের ধারে একটা নরকঙ্কাল। দুহাতে চকচকে খাঁড়া; তার ওই খ্যানখেনে অদ্ভুত কণ্ঠস্বর।

 

কেউ ধাক্কা দিচ্ছিল। তড়াক করে উঠে বসলাম। কর্নেলকে দেখতে পেলাম। মাথার টুপিতে শুকনো পাতা, মাকড়সার জাল, খড়কুটো আটকে আছে। হাতে প্রজাপতি ধরা নেট-স্টিক। গলায় কামেরা এবং বাইনোকুলার ঝুলছে। বললেন, দশটা বাজে প্রায়। ব্রেকফাস্ট রেডি। রঘুলালকে বলে গিয়েছিলাম, তোমাকে যেন যথেচ্ছ ঘুমোতে দেয়।

 

উনি পোশাক বদলাতে ব্যস্ত হলেন। বুঝলাম, যথারীতি ভোরবেলা প্রকৃতিজগতে চলে গিয়েছিলেন। তবে অনেক দেরি করেই ফিরেছেন আজ।

 

কিছুক্ষণ পরে ব্রেকফাস্টে বসে বললাম, কঙ্কালের ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারছি না। সত্যিই কি ওটা তান্ত্রিক আদিনাথের কঙ্কাল? কর্নেল দাড়ি থেকে এটা পোকা বের করে উড়িয়ে দিলেন। বললেন, কাল রাতেই একটা বোঝাপড়া হয়ে যেত। কিন্তু তোমার হঠকারিতার জন্যই সব ভেস্তে গেল। তুমি যদি আমার কথা মেনে চুপচাপ থাকতে, আমাকে আর বেশি পরিশ্রম করতে হত না।

 

কী মুশকিল! ব্যাটাচ্ছেলে হালদারমশাইয়ের গলায় খাঁড়ার কোপ চালাতে যাচ্ছিল যে। কর্নেল আনমনে বললেন, যা হওয়ার হয়ে গেছে। খেয়ে নিয়ে বেরোনো যাক।

 

ওই ভূতুড়ে জঙ্গলে?

 

নাহ। শ্মশানে।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *