কঙ্কগড়ের কঙ্কাল (কিশোর কর্নেল) – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ
দুই
কক্ষগড়ে আমরা উঠেছিলাম সরকারি ডাকবাংলোয়। বাংলোটি পুরনো ব্রিটিশ আমলে তৈরি। গড়নে বিলিতি ধাঁচ। কিন্তু অযত্নের ছাপ আষ্টেপৃষ্ঠে লেগে আছে। লনের ফুলবাগান আর চারপাশের দেশি-বিদেশি গাছপালা একেবারে জঙ্গুলে হয়ে গেছে। চৌকিদার রঘুলাল দুঃখ করে বলছিল, নতুন সার্কিট হাউস হওয়ার পর সরকারি কর্তারা এলে সেখানেই ওঠেন। সেখানে জায়গা না পেলে তবে কদাচিৎ কেউ এখানে জোটেন। আসলে বসতি থেকে বেশ খানিকটা দূরে বলেই এই দুরবস্থা।
তবে নীচেই সেই বিশাল ঝিল এবং পাশে জঙ্গলের শুরু। তার ওধারে একটা নদী আছে। তার মানে, একসময় ঝিলটি নদীর অববাহিকার একটা স্বাভাবিক জলা ছিল। ইদানীং অনেকে একে ‘লেক’ বলতে শুরু করেছে। খনি অঞ্চলের শিল্পনগরী থেকে দল বেঁধে অনেকে পিকনিক করতেও আসে। রঘুলাল বলছিল, নরবলির পর পিকনিক বন্ধ হয়ে গেছে। সন্ধ্যার অনেক আগে এদিকটা জনহীন হয়ে পড়ে। রঘুলালও সূর্যাস্তের আগে বাড়ি চলে যায়। তবে কর্নেলস্যার যখন এসেছেন, তখন রাত্তিরটা এখানে কাটাতে তার ভয় নেই। এই সায়েবকে সে ভালোই চেনে। এর আগে কতবার উনি এখানে এসেছেন।
আমরা পৌঁছেছিলাম বিকেল চারটে নাগাদ। আমাকে বিশ্রাম করতে বলে কর্নেল একা বেরিয়েছিলেন। বাংলোর বারান্দা থেকে লক্ষ করছিলাম, উনি বাইনোকুলারে পাখি টাখি দেখতে-দেখতে জঙ্গলের ভেতর ঢুকে গেলেন। রঘুলাল একটা থামে হেলান দিয়ে বসে কঙ্কগড়ের গল্প করেছিল। তান্ত্রিক আদিনাথের অলৌকিক কীর্তিকলাপের কথাও বলছিল। আদিনাথের কঙ্কালের ধড় ও মুণ্ডের কাহিনিও তার জানা। ধড় ও মুণ্ড জোড়া লাগলে তান্ত্রিক আদিনাথ যে সশরীরে আবার আবির্ভূত হবেন, এটা সে বিশ্বাসও করে এবং তবে ধারণা, এই কাজটা কেউ করতে পেরেছে এতদিনে। তাই তান্ত্রিকবাবা নিজের কাজে নেমে পড়েছেন।
বললাম, কিন্তু তান্ত্রিকবাবা তো শুনেছি ১০৮টা নরবলি দিয়ে সিদ্ধিলাভ করেছিলেন। আবার কেন উনি নরবলি দিচ্ছেন?
রঘুলাল বাংলা বলতে পারে বাঙালির মতোই। মাথা নেড়ে বলল, না স্যার! ১০৮টা নরবলির আগে উনি নিজেই বলি হয়েছিলেন। শুনেছি, তিনটে নরবলি বাকি ছিল। এতদিনে হয়ে গেল।
এই লোক তিনটিকে তুমি চিনতে?
চিনব না কেন স্যার? প্রথমে বলি হলেন শচীনবাবু। উনি ম্যাজিক দেখাতেন।
ম্যাজিশিয়ান ছিলেন?
আজ্ঞে হ্যাঁ। এ-দেশ ও-দেশ ঘুরে ম্যাজিক দেখিয়ে বেড়াতেন। তো তারপর গেল জগাই। জগাই শ্মশানে মড়া পোড়াত। শেষে গেল ভজুয়া। জমিদারবাড়ির কাজের লোক। জমিদারি আমাদের ছোটোবেলায় উঠে গেছে। তা হলেও জমিদারবাড়ি নামটা টিকে আছে। তবে দেখলে বোঝা যায় কী অবস্থা ছিল। কিন্তু ব্যাপারটা বুঝুন, তান্ত্রিকবাবা ছিলেন ওই জমিদারবাড়ির লোক। শুনেছি, বিষয়সম্পত্তি ছেড়ে জপতপ নিয়েই পড়ে থাকতেন।
এরপর রঘুলাল রামু ধোপা আর তার গাধার গল্পে চলে এল। একঘেয়ে উদ্ভট গল্প শোনার চেয়ে ঝিলের ধারে কিছুক্ষণ বেড়ানো ভালো। লনে নামলে রঘুলাল চাপা গলায় সাবধান করে দিল, আঁধার হওয়ার আগেই চলে আসবেন স্যার! কর্নেলস্যারের কথা আলাদা। উনি মিলিটারির লোক।
গেট পেরিয়ে ধাপবন্দি পাথরের সিঁড়ি। ফাটলে ঝোপ আর আগাছা গজিয়ে আছে। নীচের রাস্তা এবড়োখেবড়ো। রাস্তাটা এসেছে বাঁ দিক থেকে এবং এখানেই তার শেষ। ডান দিকে ছোটো-বড়ো নানা গড়নের পাথর এবং ঝোপঝাড়, গাছপালা। সামনে একফালি পায়েচলা পথ নেমে গেছে ঝিলের ধারে। সেখানে গিয়ে দেখি, একটা ভাঙাচোরা পাথুরে ঘাট। ঝিলের জলটা স্বচ্ছ। সূর্য পেছনে গাছপালার আড়ালে নেমে গেছে। তাই ঝিলে ছায়া পড়েছে। সামনে-দূরে ধূসর কুয়াশা। একটা পানকৌড়ি আপনমনে ডুবসাঁতার খেলছে। একটু দূরে থামের আড়ালে কোথাও জলপিপির ডাক শোনা গেল পি-পি-পি!
ঘাটের মাথায় বসে ছিলাম। কর্নেলের সংসর্গে মাথার ভেতর হয়তো প্রকৃতিপ্রেম ঢুকে গেছে। দিনশেষের এই ধূসর সময়টা সত্যি অনুভব করার মতো। জলমাকড়সার অবিশ্বাস্য গতিতে ছোটাছুটি, জলজ ফুলের ওপর টুকটুকে প্রজাপতি ও গাঙফড়িংয়ের ওড়াউড়ি, পাখপাখালির ডাক। সব মিলিয়ে জীবজগতের একটা আশ্চর্য স্পন্দন।
হঠাৎ পাশে খুট করে একটা শব্দ। চমকে উঠে দেখি, এক টুকরো ঢিল সদ্য গড়িয়ে পড়ছে। বুকটা ধড়াস করে উঠল। ঝটপট উঠে দাঁড়িয়ে চারপাশে তন্নতন্ন খুঁজলাম। কাউকেও দেখতে পেলাম না। ঢিলটার দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলাম। গাড়ার দিয়ে ভাঁজ করা একটুকরো কাগজ বাঁধা আছে। কাঁপা কাঁপা হাতে কুড়িয়ে নিলাম। কাগজটার ভাঁজ খুলে দেখি ডটপেনের লাল কালিতে লেখা আছে।
ওঁ
ওহে টিকটিকির চ্যালা! কাল সকালেই কঙ্কগড় ছেড়ে না গেলে মা চণ্ডিকার পায়ে বলি হয়ে যাবে। বুড়ো টিকটিকিকে জানিয়ে দিয়ো!
আজ রাতে প্রেতাত্মা পাঠিয়ে আগাম সংকেত দেব। সাবধান!
হাতের লেখা আঁকাবাঁকা, খুদে হরফ। খুব ব্যস্তভাবে লেখা। চিরকুটটা পকেটে ভরে আবার কিছুক্ষণ চারপাশে খুঁটিয়ে দেখলাম। কেউ কোথাও নেই। ঝিলের পশ্চিম পাড় এটা। উত্তর-পূর্ব কোণে কঙ্কগড় বসতি এলাকা শুরু। প্যান্টের পকেট থেকে রিভলভারটা বের করে এদিকে ওদিকে নজর রেখে বাংলোর নীচে পৌঁছালাম। গা ছমছম করছিল আজানা ত্রাসে। লোকটা কি আড়াল থেকে নজর রেখেছে? আবার কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর রিভলভার পকেটে ঢুকিয়ে দ্রুত বাংলোয় উঠে গেলাম। রঘুলাল আমাকে দেখে সুইচ টিপে বাতিগুলো জ্বেলে দিল। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে উদ্বিগ্ন মুখে বলল, আপনি কি কিছু দেখে ভয় পেয়েছেন স্যার?
রুক্ষ মেজাজে বললাম, নাহ। কেন?
রঘুলাল বিনীতস্বরে বলল, আপনাকে কেমন যেন দেখাচ্ছে।
কিছুই দেখাচ্ছে না। তুমি শিগগির এক কাপ চা করো।
কর্নেল ফিরলেন ঘণ্টাখানেক পরে। সহাস্যে বললেন, রামুর গাধাটার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল, ডার্লিং! গাধাটার সাহসের প্রশংসা করতে হয়। ওকে বুঝিয়ে বললাম, দ্যাখো বাপু, এত বাড়াবাড়ি ভালো নয়! গাধাবলির বিধান শাস্ত্রে আছে বলে শুনিনি। তবে বলা যায় না।
আস্তে বললাম, ব্যাপারটা রসিকতা করার মতো নয়। রীতিমতো বিপজ্জনক। এই দেখুন।
কর্নেল চিঠিটা পড়ে নিয়ে বললেন, কোথায় পেলে?
ঘটনাটা বললাম। শোনার পর কর্নেল একটু ব্যাজার মুখে বললেন, লোকটা আমাকে টিকটিকি বলেছে, এটাই আমার পক্ষে যথেষ্ট অপমানজনক। তুমি তো জানো জয়ন্ত, টিকটিকি কথাটা এসেছে ডিটেকটিভ থেকে। আমি লোকদের বোঝাতে পারি না, আমি ডিটেকটিভ নই এবং কথাটা আদতে গালাগাল।
আজ রাতে ভূত পাঠাবে বলে শাসিয়েছেও।
তা একটা কেন, একশোটা পাঠাক। কিন্তু টিকটিকি… ছি! বলে কর্নেল হাঁকলেন, রঘুলাল!
রঘুলাল কিচেন থেকে ট্রেতে কফির পট, পেয়ালা সাজিয়ে এনে টেবিলে রাখল। সেলাম দিয়ে বলল, কর্নেলসারকে আসতে দেখেই আমি কফি বানাতে গিয়েছিলাম।
কর্নেল চোখে কৌতুক ফুটিয়ে বললেন, খবর পেয়েছি, আজ রাতে এ বাংলোয় ভূত এসে হানা দেবে। তৈরি থেকো রঘুলাল।
রঘুলাল কাঁচুমাচু হাসল। কর্নেলস্যার থাকতে ভূতপেরেত ডাকবাংলোর কাছ ঘেঁষতে সাহস পাবে না। কিন্তু স্যার, একটু আগে আমার মেয়ে দুলারি এসেছিল। বলল, ওর মায়ের খুব জ্বর। আমি ওকে ডাক্তারবাবুর কাছে যেতে বললাম। তো…
কর্নেল হাত তুলে বললেন, না, না! তুমি বাড়ি চলে যেয়ো। রাতের খাবারটা বরং এখনই তৈরি করে রাখো। আমরা খেয়ে নেব’খন।
রঘুলাল হন্তদন্ত কিচেনের দিকে চলে গেল। বললাম, রঘুলাল আসলে কেটে পড়তে চাইছে। ওর মেয়ের এসে মায়ের জ্বরের খবর দেওয়াটা স্রেফ মিথ্যা।
কেন বলো তো?
ওর মেয়ে এলে টের পেতাম।
তুমি কিছুই টের পাও না, জয়ন্ত! কর্নেল হাসলেন। তারপর টেবিলে রাখা বাইনোকুলারটি দেখিয়ে বললেন, এই যন্ত্রচোখ দিয়ে ফ্ৰকপরা একটা বাচ্চা মেয়েকে বাংলোর লনে আমি দেখেছি। অবশ্য তোমাকে দেখতে পাইনি। কারণ বাংলোটা উঁচুতে। তুমি নীচে ঝিলের ধারে ছিলে। ওখানে যথেষ্ট ঝোপঝাড়। তবে তোমার সাবধান হওয়া উচিত ছিল। তান্ত্রিক হরনাথের প্রেতাত্মা ধারালো খাঁড়া হাতে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
কর্নেল কফি শেষ করে ঘরে ঢুকলেন। সত্যি বলতে কি, একা বারান্দায় বসে থাকতে কেমন অস্বস্তি হচ্ছিল। ঘরে ঢুকে দেখি, কর্নেল টেবিলবাতির আলোয় একগোছা অর্কিড খুঁটিয়ে দেখছেন। বোঝা গেল, জঙ্গলে কোথাও সংগ্রহ করেছেন। আমাকে সেই অর্কিডটার বৈশিষ্ট্য বোঝাতে শুরু করলে বললাম, ওসব পরে শুনব। রঘুলালের কাছে কিছু তথ্য জোগাড় করেছি। অর্কিডের চেয়ে সেগুলো দামি।
কী তথ্য?
শচীনবাবু ছিলেন ম্যাজিশিয়ান। আর জগাই ছিল শ্মশানের…।
হুঁ, ম্যাজিশিয়ানদের বলা হয় জাদুকর। জাদুর সঙ্গে নাকি তন্ত্রমন্ত্রের সম্পর্ক আছে। আবার তন্ত্রমন্ত্রের সঙ্গে তান্ত্রিক এবং তান্ত্রিকের সঙ্গে শ্মশানের সম্পর্ক আছে। কাজেই তোমার তথ্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু শাস্ত্রীমশাই, মানে দিপুর বাবার কাছে সে-খবর কলকাতায় বসেই পেয়ে গেছি।
চাপা গলায় বললাম, যা-ই বলুন, এই রঘুলাল লোকটিকে আমার পছন্দ হচ্ছে না। খুব ধূর্ত! আমাকে ভয় দেখাচ্ছিল। তাছাড়া ঝিলের ঘাট থেকে বাংলোয় ফেরার সময় কী করে ও টের পেল, অমি সত্যি সত্যিই ভয় পেয়েছি? বলল, আপনি কি ভয় পেয়েছেন? আপনাকে কেমন যেন দেখাচ্ছে ….।
তোমাকে এখনও কেমন যেন দেখাচ্ছে, ডার্লিং! কর্নেল মুচকি হেসে বললেন। ভূতপ্রেত বিশ্বাস করে না যারা, ভূতপ্রেতের ভয় তাদেরই বেশি। বিশেষ করে ভূতের চিঠি ভূতের চেয়ে সাংঘাতিক।
চটে গিয়ে বললাম, ভূতপ্রেত হুমকি দিয়ে চিঠিটা লেখেনি। লিখেছে কোনো মানুষ।
হুঁ, মানুষ। সেই মানুষকে সম্ভবত তান্ত্রিক আদিনাথের ভূত ভর করেছে।
রসিকতা শোনার মেজাজ ছিল না। তবে বরাবর এটা লক্ষ্য করেছি, রহস্য যত জটিল এবং সাংঘাতিক হয়, আমার বৃদ্ধ বন্ধুটিকে রসিকতা তত বেশি ভূতের মতো ভর করে। বিছানায় গিয়ে হাত-পা ছড়িয়ে দিলাম। ট্রেন আর বাসজার্নির ধকল এতক্ষণে পেয়ে বসেছিল। একটু পরে লক্ষ করলাম, কর্নেল পকেট থেকে একটুকরো ভাঙা চাকতির মতো কী একটা ছোট্ট জিনিস বের করলেন। তারপর কিটব্যাগ থেকে খুদে একটা ব্রাশ আর লোশনের শিশিও বেরোতে দেখলাম। চাকতিটার আধখানা চাঁদের মতো গড়ন। লোশনে ব্রাশ চুবিয়ে ঘষতে থাকলেন কর্নেল! জিজ্ঞেস করলাম, জঙ্গলে মোহর কুড়িয়ে পেয়েছেন বুঝি?।
কর্নেল আনমনে বললেন, মোহরের ভাঙা টুকরো বলতেও পারো! তবে সোনার নয়। সেকেলে মুদ্রাও নয়। কী সব খোদাই কার সিলের টুকরো। কাদা ধুয়ে ফেলেও কিছু বুঝতে পারিনি। দেখা যাক।
কিছুক্ষণ পরে রঘুলালের সাড়া পাওয়া গেল। ওর হাতে টর্চ আর লাঠি দেখলাম। দরজায় দাঁড়িয়ে বলল, সব রেডি রইল স্যার! কিচেনঘরের চাবিটা দিয়ে যাচ্ছি। আমি ভোর ছটায় এসে যাব।
কর্নেলের ইশারায় ওর হাত থেকে কিচেনের চাবি নিয়ে এলাম। ও চলে গেল। কর্নেল ভাঙা সিলটা আতশ কাচে দেখতে থাকলেন। জিজ্ঞেস করলাম, গুপ্তযুগের সিল নাকি?
কী? গুপ্তযুগ? কর্নেল নিঝুম সন্ধ্যারাতের পুরোনো ডাকবাংলোর স্তব্ধতা ভাঙচুর করে অট্টহাসি হাসলেন। হুঁ, ওই এক পুরাতাত্ত্বিক বাতিক জয়ন্ত! মাটির তলায় কিছু পাওয়া গেলেই সটান গুপ্তযুগ। তার আগে বা পরে নয়! তবে এটাই আশ্চর্য! এটা পুরো একটা সিলের আধখানা মাত্র। সিলটা আধখানা কেন, এটাই প্রশ্ন।
এই সময় আচমকা বাংলোর আলো নিভে গেল। কর্নেল তখনই টর্চ জ্বেলে বললেন, ফায়ারপ্লেসের ওপর থেকে হারিকেনটা এনে জ্বেলে দাও জয়ন্ত! লোডশেডিং প্রেতাত্মাকে বাংলোয় আসার সুযোগ করে দিতে পারে, কুইক! তাঁর কণ্ঠস্বরে স্বভাবসিদ্ধ কৌতুক। কিন্তু আমার গা ছমছম করতে লাগল।
ইংরেজ আমলের বাংলা। কাজেই ফায়ারপ্লেস আছে। ঝটপট হারিকেন জ্বেলে এনে টেবিলে রাখলাম। দরজা বন্ধ করতে যাচ্ছিলাম। কর্নেল বললেন, চলো! বরং বারান্দায় বসে জ্যোৎস্নায় প্রকৃতিদর্শন করা যাক।
বেরিয়ে গিয়ে দেখি সুন্দর জ্যোৎস্না ছড়িয়ে আছে। ঝিলের জল ঝিলমিল করছে। গাছপালা তোলপাড় করে বাতাস বইছে। সেই অস্বস্তিকর অনুভূতি আবার ফিরে এল। ভয়ের চোখে এদিকে ওদিকে তাকাচ্ছিলাম। হাতে টর্চ এবং পকেটে রিভলবার তৈরি। আস্তে বললাম, সত্যি লোডশেডিং, নাকি কেউ মেইন সুইচ অফ করেছে দেখে আসা উচিত। কারণ ওই তো দূরে আলা দেখা যাচ্ছে।
কর্নেল বললেন, ছেড়ে দাও! জ্যোৎস্নায় পুরোনো পৃথিবীকে ফিরে পাওয়া যায়। তাছাড়া জ্যোৎস্নায় একটা নিজস্ব সৌন্দর্যও আছে। কোন কবি যেন লিখেছিলেন, এমন চাঁদের আলো/মরি যদি সেও ভাল/ সে মরণ স্বরগ সমান।
বিরক্ত হয়ে বললাম, মৃত্যটা প্রেতাত্মার হাতে হওয়া বড় অপমানজনক। আমরা মানুষ।
ডার্লিং! তা হলে দেখছি এই আদিম পরিবেশ তোমাকে প্রেতাত্মায় বিশ্বাসী করতে পেরেছে।
বোগাস! আসলে আমি বলতে চাইছি…
বলার আগে দেখে নাও। ওই দ্যাখো, ডান দিকে ঝোপের আড়ালে প্রেতাত্মা উঁকি দিচ্ছে!
ভ্যাবাচাকা খেয়ে সেইদিকে টর্চের আলো ফেললাম। কয়েক সেকেন্ডের জন্য বোধবুদ্ধি হারিয়ে গেল। দক্ষিণ-পশ্চিমের ঢালের মাথায় উঁচু ঝোপজঙ্গল। একখানে ঝোপ থেকে মুখ বের করে আছে সত্যিই একটা কঙ্কাল। খুলি থেকে কাঁধ অবধি দেখা যাচ্ছে।
সঙ্গে-সঙ্গে টর্চ টেবিলে রেখে রিভলবার বের করে ছুঁড়লাম। কর্নেল আমার কাঁধ ধরে নাড়া দিলেন। জয়ন্ত! জয়ন্ত! করছ কী?
এবার টর্চ জ্বেলে দেখি কঙ্কাল অদৃশ্য। উত্তেজিতভাবে বললাম, অবিশ্বাস্য! অসম্ভব!
কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে চাপা স্বরে বললেন, সব ভেস্তে দিলে তুমি! আমাদের কাছে ফায়ার আর্মস আছে জেনে গেল প্রেতাত্মাটা। এবার ও খুব সাবধান হয়ে যাবে।
বলে কর্নেল টর্চের আলো ফেলতে-ফেলতে ঝোপটার দিকে এগিয়ে গেলেন। ভেতরে ঢুকে কিছুক্ষণ চারদিকে আলো ফেলে তন্নতন্ন খুঁজে ফিরে এলেন। একটু হেসে বললেন, যা ভেবেছি তাই। একটা কথা বলি, ডার্লিং! এখানে কোথাও যা কিছু ঘটুক, কখনও মাথা খারাপ করে ফেলবে না। বিশেষ করে গুলি ছোঁড়াটা চলবে না।
চটে গিয়ে বললাম, বলি দিলেও চুপচাপ থাকব?
তোমাকে বলি দিয়ে ওর লাভ হবে না।
আপনাকে যদি চোখের সামনে বলি দেয়, চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখব?
কর্নেল বারান্দায় বসে চুরুট জ্বেলে বললেন, আমাকে বলি দেওয়ার সাহস ওর হবে না। কারণ আমার মনে হচ্ছে, ও আমাকে ভালোই চেনে। কঙ্কগড়ে আমি তো এই প্রথম আসছি না।
হেঁয়ালি করা কর্নেলের এক বিরক্তিকর অভ্যাস। তাই চুপ করে গেলাম। একটু পরে নীচের দিকে মোটরসাইকেলের শব্দ শোনা গেল! আলোর ঝলকানি দেখা যাচ্ছিল। গেটের নীচের রাস্তায় এসে মোটরসাইকেলটা থামল। তারপর টর্চের আলোয় দীপককে আসতে দেখলাম।
তার হাতেও টর্চ ছিল। বারান্দায় এসে বলল, আলো নেই কেন কর্নেল? সার্কিট হাউসে আলো দেখে এলাম। ওখানে আলো থাকলে এখানেও থাকার কথা।
সম্ভবত প্রেতাত্মা মেইন সুইচ অফ করে দিয়ে গেছে। কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন। দিক না। জ্যোৎস্না আজকাল দুর্লভ হয়ে উঠেছে। যাই হোক, আমরা এখানে উঠেছি কী করে জানলে?
দীপক হাসল। কিছুক্ষণ আগে রামু পাগলা–মানে সেই রামু বাবার কাছে গিয়েছিল। বিকেলে ঝিলের জঙ্গলে ওর গাধার খোঁজে গিয়ে নাকি আড়াল থেকে দেখেছে, এক দাড়িওয়ালা সায়েব ভুত ওর গাধার সঙ্গে কথা বলছেন। দেখেই সে পালিয়ে এসেছে। আপনি তো শুনেছেন, বাবার কোবরেজি বাতিক আছে। রামুকে রোজ সাংঘাতিক-সাংঘাতিক কী সব পাঁচন গেলাচ্ছেন। রামু লক্ষ্মীছেলের মতো রোজ তিনবেলা বাবার কাছে পাঁচন গিলতে যায়। তো বাবা আমাকে খোঁজ নিতে বললেন, আপনি এই ডাকবাংলোয় উঠেছেন কি না। কারণ এই বাংলোটা ঝিল আর জঙ্গলের কাছেই।
আমাদের হালদারমশাইয়ের খবর কী?
ওঁকে নিয়ে প্রবলেম। সকালে ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়েছেন, এখনও ফেরেননি। গতকালও তা-ই। রাত দুপুরে ফিরেছিলেন। আজ কখন ফেরেন কে জানে?
কতদূর এগোলেন, কিছু বলেছেন তোমাকে?
ঠাকুরদার জ্যাঠামশাইয়ের খুলি কোথায় পোঁতা ছিল, সেই জায়গাটা নাকি খুঁজে পেয়েছেন। কিন্তু আপাতত আমাকে জায়গাটা দেখাতে চান না। যথাসময়ে দেখাবেন। দ্যাটস মাচ। দীপক উঠে দাঁড়াল। মেইন সুইচটা দেখে আসি। এভাবে বসে থাকার মানে হয় না!
থাক দিপু! পরে আলো জ্বালা হবে। তুমি গিয়ে দ্যাখো, হালদারমশাই ফিরলেন কিনা। ওঁর জন্য একটু চিন্তা হচ্ছে। গোয়েন্দা হিসাবে পাকা। পুলিশের প্রাক্তন দারোগা। দুর্দান্ত সাহসী। তবে বড্ড হঠকারী মানুষ। আর শোনো, আমার সঙ্গে প্রকাশ্যে যোগাযোগ কোরো না। দরকার হলে আমিই করব। বাবাকে বোলো, আমরা খাসা আছি। প্রেতাত্মা-দর্শনেরও সৌভাগ্য হয়েছে।
দীপক চমকে উঠল, মাই গুডনেস! প্রেতাত্মা মানে?
ভূত। দিপু, তুমি এখনই কেটে পড়ো।
দীপক হেসে ফেলল। তারপর, ঠিক আছে, চলি। বলে চলে গেল।
