ফেলুদা ওয়ান ফেলুদা টু – সত্যজিৎ রায়
নেপোলিয়নের চিঠি
তুমি কি ফেলুদা
‘তুমি কি ফেলুদা?’
প্রশ্নটা এল ফেলুদার কোমরের কাছ থেকে। একটি বছর ছয়েকের ছেলে ফেলুদার পাশেই দাঁড়িয়ে মাথাটাকে চিৎ করে তার দিকে চেয়ে আছে। এই সেদিনই একটা বাংলা কাগজে ফেলুদার একটা সাক্ষাৎকার বেরিয়েছে, তার সঙ্গে হাতে চারমিনার নিয়ে একটা ছবি। তার ফলে ফেলুদার চেহারাটা আজকাল রাস্তাঘাটে লোকে ফিল্মস্টারের মতোই চিনে ফেলছে। আমরা এসেছি পার্ক স্ট্রীট আর রাসেল স্ট্রীটের মোড়ে খেলনা আর লাল মাছের দোকান হবি সেন্টারে। সিধু জ্যাঠার সত্তর বছরের জন্মদিনে তাঁকে একটা ভালো দাবার সেট উপহার দিতে চায় ফেলুদা।
ছেলেটির মাথায় আলতো করে হাত রেখে ফেলুদা বলল, ‘ঠিক ধরেছ তুমি।’
‘আমার পাখিটা কে নিয়েছে বলে দিতে পার?’ বেশ একটা চ্যালেঞ্জের সুরে বলল ছেলেটি। ততক্ষণে ফেলুদারই বয়সী এক ভদ্রলোক ব্রাউন কাগজে মোড়া একটা লম্বা প্যাকেট নিয়ে আমাদের দিকে এগিয়ে এসেছেন, তাঁর মুখে খুশির সঙ্গে একটা অপ্রস্তুতভাব মেশানো।
‘তোমার নিজের নামটাও বলে দাও ফেলুদাকে,’ বললেন ভদ্রলোক।
‘অনিরুদ্ধ হালদার’, গম্ভীর মেজাজে বলল ছেলেটা।
‘ইনি আপনার খুদে ভক্তদের একজন’, বললেন ভদ্রলোক। ‘আপনার সব গল্প ওর মার কাছ থেকে শোনা।’
‘পাখির কথা কী বলছিল?’
‘ও কিছু না’, ভদ্রলোক হালকা হেসে বললেন, ‘পাখি পোষার শখ হয়েছিল, তাই ওকে একটা চন্দনা কিনে দিয়েছিলাম। যেদিন আসে সেদিনই কে খাঁচা থেকে পাখিটা বার করে নিয়ে যায়।’
‘খালি একটা পালক পড়ে আছে’, বলল ফেলুদার খুদে ভক্ত।
‘তাই বুঝি?’
‘রাত্তিরে ছিল পাখিটা, সকালবেলা নেই। রহস্য।’
‘তাই ত মনে হচ্ছে। তা অনিরুদ্ধ হালদার এই রহস্যের ব্যাপারে কিছু করতে পারেন না?’
‘আমি বুঝি গোয়েন্দা? আমি ত ক্লাস টু-তে পড়ি।’
ছেলের বাবা আর বেশিদূর কথা এগোতে দিলেন না।
‘চল অনু। আমাদের আবার নিউ মার্কেট যেতে হবে। তুমি বরং ফেলুদাকে একদিন আমাদের বাড়িতে আসতে বল।’
ছেলে বাবার অনুরোধ চালান করে দিল। এবার ভদ্রলোক একটা কার্ড বের করে ফেলুদার হাতে দিয়ে বললেন, ‘আমার নাম অমিতাভ হালদার।’
ফেলুদা কার্ডটায় একবার চোখ বুলিয়ে বলল, ‘বারাসতে থাকেন দেখছি।’
‘আপনি হয়ত আমার বাবার নাম শুনে থাকতে পারেন। পার্বতীচরণ হালদার।’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ। ওঁর লেখা-টেখাও ত পড়েছি। ওঁরই সব নানারকম জিনিসের কালেকশন আছে না?’
‘ওটা বাবার নেশা। ব্যারিস্টারি ছেড়ে এখন ওসবই করেন। সারা পৃথিবী ঘুরেছেন ওই সবের পিছনে। আপনার ত অনেক ব্যাপারে ইয়ে আছে, আমার মনে হয় আপনি দেখলে আনন্দ পাবেন। আদ্যিকালের গ্রামোফোন, মুগল আমলের দাবা বড়ে, ওয়ারেন হেস্টিংসের নস্যির কৌটো, নেপোলিয়নের চিঠি…। তাছাড়া আমাদের বাড়িটাও খুব ইন্টারেস্টিং। দেড়শো বছরের পুরনো। একদিন যদি ফ্রী থাকেন, একটা ফোন করে দিলে—রোববার-টোববার…। আমিই বরং একটা ফোন করব। ডাইরেকটরিতে ত আপনার—?’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ, আমার নামেই আছে। এই যে।’
ফেলুদাও তার একটা কার্ড ভদ্রলোককে দিয়ে দিল।
কথা হয়ে গেল আমরা এই মাসেই একদিন বারাসত গিয়ে হাজির হব। লালমোহনবাবুর গাড়ি আছে, যাবার কোনো অসুবিধে নেই। এখানে বলে রাখি লালমোহনবাবু বহাল তবিয়তে এবং খোশমেজাজে আছেন, কারণ এই পুজোয় জটায়ুর জায়ান্ট অমনিবাস বেরিয়েছে, তাতে বাছাই করা দশটা সেরা রহস্য রোমাঞ্চ উপন্যাস। দাম পঁচিশ টাকা এবং লালমোহনবাবুর ভাষায় ‘সেলিং লাইক হট কচুরিজ।’
সন্ধ্যাবেলা ফেলুদার মুখ শুকনো দেখে জিজ্ঞেস করলাম, কী ব্যাপার। ও বলল, ‘খুদে মক্কেলের আর্জিটা মাথায় ঘুরছে রে।’
‘সেই চন্দনার ব্যাপারটা?’
‘খাঁচা থেকে পাখি চুরি যায় শুনেছিস কখনো?’
তা শুনিনি সেটা স্বীকার করতেই হল। —’তুমি কি এর মধ্যেও রহস্যের গন্ধ পাচ্ছ নাকি?’
‘ব্যাপারটা ঠিক দৈনন্দিন ঘটনার মধ্যে পড়ে না। চন্দনা ত আর বার্ড অফ প্যারাডাইজ নয়। এক যদি না কারো নেগলিজেন্সে খাঁচার দরজাটা বন্ধ করতে ভুল হয়ে গিয়ে থাকে।’
‘কিন্তু সেটাত আর জানবার কোনো উপায় নেই।’
‘তা থাকবে না কেন? ওখানে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেই জানা যায়। আসলে বুঝতে পারছি এ ব্যাপারটা ও-বাড়ির কেউ সিরিয়াসলি নেয়নি। ঘটনাটা যে অস্বাভাবিক সেটা কারুর মাথায় ঢোকেনি। অথচ ছেলের মনটা যে খচ্ খচ্ করছে সেটা বুঝতে পারছি, না হলে আমায় দেখে ও কথাটা বলত না। অন্তত একবার যদি গিয়ে দেখা যেত…’
‘তা ভদ্রলোক ত বললেনই যেতে।’
‘হ্যাঁ—কিন্তু সেটাও হয়ত আমাকে সামনা সামনি দেখলেন বলে। বাড়ি ফিরে সে কথা আর মনে নাও থাকতে পারে। ছোট ছেলের অনুরোধ বলেই মনে হচ্ছে সেটাকে একেবারে এড়িয়ে যাওয়া ঠিক নয়।’
ক্রিসমাসের যখন আর পাঁচদিন বাকি তখনই এক শনিবারের সকালে এসে গেল অমিতাভবাবুর ফোন। আমি কলটা ফেলুদার ঘরে ট্রানসফার করে বসবার ঘরের মেন টেলিফোনে কান লাগিয়ে শুনলাম।
‘মিঃ মিত্তির?’
‘বলুন কী খবর।’
‘আমার ছেলে ত মাথা খেয়ে ফেলল। কবে আসছেন?’
‘পাখির কোনো সন্ধান পেলেন?’
‘নাঃ—সে আর পাওয়া যাবে না।’
‘ভয় হয়, আপনার ছেলে যদি ধরে বসে থাকে তার পাখি উদ্ধার করে দেব, তখন সেটা না পাওয়া গেলে ত বেইজ্জতের ব্যাপার হবে।’
‘সে নিয়ে আপনি চিন্তা করবেন না। ছেলেকে খানিকটা সময় দিলেই সে খুশি হয়ে যাবে। আসলে আমার বাবার সঙ্গে একবার আপনার আলাপ করিয়ে দিতে চাই। আজ ত আমার ছুটি; আপনি কী করছেন?’
‘তেমন কিছুই না। আজ দশটা নাগাদ হলে হবে?’
‘নিশ্চয়ই।’
শনি রবি দু’দিনই আমাদের বাড়িতে সকাল ন’টায় লালমোহনবাবুর আসাটা একেবারে হান্ড্রেড পারসেন্ট শিওর। ঘড়ির কাঁটায় কাঁটায় আসাটা কলকাতা শহরে আজকাল আর সম্ভব নয়, তবে দশ মিনিট এদিক ওদিকের বেশি হয় না কোনোদিনই। আজও হল না। ঠিক নটা বেজে পাঁচ মিনিটে ঘরে ঢুকে ধপ্ করে সোফায় বসে পড়ে বললেন, ‘কালি কলম মন, লেখে তিনজন। মশাই, পুজোর লেখার ধকলের পর শীতকালটা এলে লেখার চিন্তাটা থাউজ্যাণ্ড মাইলস দূরে চলে যায়—কালি কলম খাতার দিকে আর চাইতেই ইচ্ছা করে না।’
লালমোহনবাবু ইদানীং প্রবাদ নিয়ে ভীষণ মেতে উঠেছেন। সাড়ে তিনশো প্রবাদ নাকি উনি মুখস্থ করেছেন। লেখার ফাঁকে ফাঁকে লাগসই প্রবাদ গুঁজে দিতে পারলে সাহিত্যের রস নাকি ঘনীভূত হয়। তিনি অবিশ্যি শুধু লেখায় নয়, কথাতেও যখন তখন প্রবাদ লাগাচ্ছেন। আজ ভদ্রলোকের পরনে ছাই রঙের টেরিলিনের প্যান্ট আর সবুজ সোয়েটার, আর হাতে এক চাঙাড়ি কচুরি। কচুরির কারণ আর কিছুই না—হট কচুরির আজকাল আর তেমন ডিমাণ্ড আছে কিনা ফেলুদার এই প্রশ্নের উত্তরে লালমোহনবাবু বলেন, ‘মশাই, বাগবাজারের মোহন ময়রার দোকানে কচুরির জন্য কিউ দেখলে মনে হবে সেখানে কোনো বোম্বাইমার্কা হিন্দি হিট ছবি চলছে। আপনাকে খাওয়ালে বুঝবেন উপমাটা কত অ্যাপ্রোপ্রিয়েট।’
সঙ্গে এক ফ্লাস্ক জল আর কচুরির চাঙাড়িটা নিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। লালমোহনবাবু পার্বতী হালদারের নাম শোনেননি। তবে নেপোলিয়নের চিঠি শুনে ভয়ানক ইমপ্রেস্ড হলেন। বললেন ইস্কুলে থাকতে ওঁর হিরো নাকি ছিল নেপোলিয়ন। ‘গ্রেট ম্যান, বোনাপাটি’ কথাটা বার তিনেক চাপা গলায় বললেন যাবার পথে।
ভি আই পি রোডের আগে স্পীড তুলতে পারলেন না লালমোহনবাবুর ড্রাইভার হরিপদবাবু। বারাসতে যখন পৌঁছলাম তখন প্রায় সাড়ে দশটা।
অমিতাভবাবুদের বাড়িটা মেন রোডের উপরেই, তবে গাছপালায় ঘেরা বলে আসল বাড়িটা রাস্তা থেকে চোখে পড়ে না। গেট দিয়ে ঢুকে নুড়ি ফেলা রাস্তায় খানিকটা গিয়ে তবে থামওয়ালা দালানটা দেখা যায়। একেবারে সাহেবী ঢং-এর বাড়ি, বয়সের ছাপ যতটা থাকার কথা ততটা নেই; মনে হয় বছরখানেকের মধ্যেই অন্তত সামনের অংশটায় চুণকাম ও রিপেয়ার দুই-ই হয়েছে। বাড়ির সামনে একটা বাঁধানো পুকুরের চারিপাশে সুপুরিগাছের সারি।
অমিতাভবাবু নিচেই অপেক্ষা করছিলেন আমাদের জন্য, ফেলুদা লালমোহনবাবুর সঙ্গে আলাপ করানোতে বললেন, ‘আমি নিজে আপনার লেখা পড়িনি বটে, তবে আমার স্ত্রী রহস্য রোমাঞ্চ সিরিজের ভীষণ ভক্ত।’
আমরা শ্বেতপাথরের সিঁড়ি দিয়ে, দোতলায় উঠলাম। পার্বতীবাবুর কালেকশনের জিনিস নাকি সবই দোতলায়।
‘বাবার আগে আমার পুত্রের সঙ্গে দেখাটা সেরে নিন’, বললেন অমিতাভবাবু। ‘বাবার কাছে এখন লোক আছে। উনি বাইরের লোকের সঙ্গে দেখাসাক্ষাতগুলো সকালেই করেন।’
‘অ্যাদ্দুরেও লোক এসে উৎপাত করে?’
‘বাবার মতো কিছু কালেক্টর আছেন, তাঁরা প্রায়ই আসেন। তাছাড়া সম্প্রতি বাবা একজন সেক্রেটারির জন্য কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েছেন। তার জন্য কিছু লোক দেখা করতে আসছে।’
‘ওনার সেক্রেটারি নেই?’
‘আছে, তবে তিনি দিল্লী চলে যাচ্ছেন সামনের সপ্তাহে একটা ভালো কাজ পেয়ে। লোকটি বেশ কাজের ছিল। আসলে সেক্রেটারির ব্যাপারে বাবার লাক্টাই খারাপ। গত দশ বছরে চারটি সেক্রেটারি এল গেল। একটি ত বছরখানেক কাজ করার পর মেনিনজাইটিসে মারা গেলেন। আরেকটি কথা নেই বার্তা নেই, সাইবাবার ভক্ত হয়ে বিবাগী হয়ে গেলেন। এখন যে ভদ্রলোকটির সঙ্গে বাবা কথা বলছেন, তাকে সাত বছর আগে তাড়িয়ে দেন। সেও ছিল সেক্রেটারি।’
‘কেন, তাড়ান কেন?’
‘ভদ্রলোক কাজ খুব ভালোই করতেন, তবে অসম্ভব কুসংস্কারী। বাবা সেটা একেবারে সহ্য করতে পারতেন না। একবার ঈজিপ্ট থেকে একটা জেড পাথরের মূর্তি আনার পর কলকাতায় এসে বাবার অসুখ করে। সাধনবাবু বাবাকে সিরিয়াসলি বলেন যে, মূর্তিটি যে দেবীর, তাঁর অভিশাপ পড়েছে বাবার ওপর। এই এক কথাতেই বাবা তাঁকে একরকম ঘাড় ধরে বার করে দেন।’
‘এই সাধনবাবু যদি আবার এসে থাকেন তাহলে তাঁকে খুবই অপটিমিস্টিক বলতে হবে, এবং আপনার বাবাকে অত্যন্ত ক্ষমাশীল বলতে হয়।’
‘আসলে লোকটাকে তাড়িয়ে দেবার পর বাবার একটু অনুশোচনা হয়েছিল। কারণ ভদ্রলোকের অবস্থা মোটেই ভালো ছিল না। আর বাবা ওঁকে সার্টিফিকেটও দেননি।’
বাড়িটা বাইরে থেকে বিলিতি ধাঁচের হলেও, ভিতরটা বাংলা জমিদারী বাড়ির মতোই। মাঝখানের নাটমন্দিরকে ঘিরে দোতলার বারান্দার এক পাশে সারি সারি ঘর। বৈঠকখানা, আর পার্বতীচরণের স্টাডি বা কাজের ঘর সামনের দিকে, আর ভিতর দিকে সব শোবার ঘর। ফেলুদার খুদে মক্কেল বারান্দায় তার ঘরের সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল। আমরা সেই দিকে এগিয়ে যাব, এমন সময় জুতোর শব্দ শুনে বৈঠকখানার দিকে চেয়ে দেখি নীল কোট পরা হাতে ব্রীফকেসওয়ালা একজন লোক গটগটিয়ে ঘরটা পেরিয়ে সিঁড়ির দিকে চলে গেল। অমিতাভবাবু বললেন, ‘এই সেই প্রাক্তন সেক্রেটারি সাধনবাবু। ভদ্রলোককে খুব প্রসন্ন বলে মনে হল না।’
‘এই যে আমার পাখির খাঁচা’, ফেলুদা তার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই বলল অনিরুদ্ধ।
‘আমি ত সেটাই দেখতে এলাম।’
খাঁচাটা একটা হুক থেকে ঝুলছে বারান্দায় রেলিং-এর উপরে। ঝকঝকে ভাবটা দেখে বোঝা যায় খাঁচাটাও কেনা হয়েছিল পাখির সঙ্গেই। ফেলুদা সেটার দিকে এগিয়ে গেল। দরজাটা এখনো খোলাই রয়েছে।
‘আপনার বাড়ির কোনো চাকরের পাখিতে অ্যালার্জি আছে বলে জানেন?’
অমিতাভবাবু হেসে উঠলেন।
‘সেটা ভাববার ত কোনো কারণ দেখি না। আমাদের বাড়ির কোনো চাকরই কুড়ি বছরের কম পুরনো নয়। তাছাড়া এক কালে এ বাড়িতে একসঙ্গে দুটো গ্রে প্যারট ছিল। বাবা নিজেই এনেছিলেন। অনেকদিন ছিল, তারপর মারা যায়।’
‘এই ব্যাপারটা লক্ষ করেছেন কি?’
ফেলুদা বেশ কিছুক্ষণ হাত দিয়ে খাঁচাটাকে নেড়ে চেড়ে প্রশ্নটা করল।
অমিতাভবাবুর সঙ্গে আমরা দুজনও এগিয়ে গেলাম।
ফেলুদা খাঁচার দরজাটার একটা অংশে আঙুল দিয়ে দেখাল।
‘ছোট্ট একটা লালের ছোপ বলে মনে হচ্ছে?’ বললেন অমিতাভবাবু। তার মানে কি—?’
‘যা ভাবছেন তাই। ব্লাড।’
‘চন্দনা মার্ডার?’ বলে উঠলেন লালমোহনবাবু।
ফেলুদা খাঁচার দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে বলল, ‘পাখির রক্ত না মানুষের রক্ত সেটা কেমিক্যাল অ্যানালিসিস না করে বোঝা যাবে না। তবে একটা স্ট্রাগ্ল হয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। অবিশ্যি সেটা তেমন অস্বাভাবিক কিছু নয়। এটা বোঝাই যাচ্ছে যে খাঁচার দরজা খোলা রাখার জন্য পাখি পালায়নি; দরজা খুলে পাখিকে বার করে নেওয়া হয়েছে। আপনারা কোত্থেকে কিনেছিলেন পাখিটা?’
‘নিউ মার্কেট’, বলে উঠল অনিরুদ্ধ।
অমিতাভবাবু বললেন, ‘নিউ মার্কেটের তিনকড়িবাবুর পাখির দোকান খুব পুরনো দোকান। আমাদের জানা শোনা অনেকেই ওখান থেকে পাখি কিনেছে।’
অনিরুদ্ধর ইচ্ছা ছিল তার নতুন কেনা খেলনাগুলো আমাদের দেখায়, বিশেষ করে মেশিনগানটা, কিন্তু অমিতাভবাবু বললেন, ‘এঁরা আবার তোমার কাছে আসবেন। তখন তোমার খেলনা দেখবেন, তোমার মা-র সঙ্গে আলাপ করবেন, চা খাবেন—সব হবে। আগে দাদুর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই, কেমন?’
আমরা পার্বতীবাবুর স্টাডির উদ্দেশে রওনা দিলাম।
কিন্তু দাদুর সঙ্গে আর আলাপ হল না। লালমোহনবাবু পরে বলেছিলেন, এক-একটা ঘটনার শক্-এর এফেক্ট নাকি সারা জীবন থাকে। এটা সেইরকম একটা ঘটনা।
বৈঠকখানায় ঢুকেই বুঝেছিলাম চারিদিকে দেখবার জিনিস গিজগিজ করছে। সে সব দেখার সময় ঢের আছে মনে করে আমরা এগিয়ে গেলাম ঘরের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে পরদা দেওয়া স্টাডির দরজার দিকে।
‘আসুন’ বলে অমিতাভবাবু গিয়ে ঢুকলেন ঘরের মধ্যে। আর ঢোকামাত্র এক অস্ফুট চীৎকার দিয়ে উঠলেন—
‘বাবা!’
ফেলুদার অমিতাভবাবুকে দু’হাত দিয়ে ধরতে হল, কারণ ভদ্রলোক প্রায় পড়েই যাচ্ছিলেন।
ততক্ষণে আমরা দুজনেও ঘরে ঢুকেছি।
বিরাট মেহগনি টেবিলের পিছনে একটা রিভলভিং চেয়ারে বসে আছেন পার্বতীচরণ হালদার। তাঁর মাথাটা চিৎ, দুটো পাথরের মত চোখ চেয়ে আছে সিলিং-এর দিকে, হাত দুটো ঝুলে রয়েছে চেয়ারের দুটো হাতলের পাশে।
ফেলুদা এক দৌড়ে চলে গেছে ভদ্রলোকের পাশে। নাড়ীটা দেখার জন্য হাতটা বাড়িয়ে আমাদের দিকে ফিরে বলল, ‘তোরা দৌড়ে গিয়ে ওই সাধন লোকটাকে আটকা… দারোয়ানকে বল। দরকার হলে বাইরে রাস্তায় দ্যাখ্—’
আমার সঙ্গে সঙ্গে লালমোহনবাবুও ছুট দিলেন। মন বলছিল দশ মিনিট চলে গেছে, সে লোককে আর পাওয়া যাবে না—বিশেষ করে যদি সে খুন করে থাকে।
সিঁড়ি দিয়ে নামবার সময় এক ভদ্রলোকের সঙ্গে প্রায় কোলিশন হয়েছিল। পরে জেনেছিলাম উনি পার্বতীচরণের বর্তমান সেক্রেটারি হৃষিকেশবাবু। দুজন অচেনা লোককে এইভাবে তড়িঘড়ি নামতে দেখে তিনি কী ভাবলেন সেটা আর তখন ভাবার সময় ছিল না।
বাইরে কেউ নেই, রাস্তায়ও না, কারুর থাকার কথাও নয়। যেটা সবচেয়ে অদ্ভুত লাগল সেটা হল এই যে দারোয়ান জোর গলায় বলল গত দশ মিনিটের মধ্যে কেউ গেট দিয়ে বাইরে যায়নি। বাবুর কাছে লোক আসবে বলে সে সকাল থেকে ডিউটিতে রয়েছে, তার ভুল হতেই পারে না।
‘চলো বাগানের দিকটা দেখি’, বললেন লালমোহনবাবু, ‘হয়ত কোথাও ঘাপটি মেরে আছে।’
তাই করলাম। দক্ষিণের পুকুরের ধার, পশ্চিমের গোলাপ বাগান, কম্পাউণ্ড ওয়ালের পাশটা, চাকরদের ঘরের আশেপাশে, কোথাও বাদ দিলাম না। পাঁচিল টপকানোও সহজ নয়, কারণ প্রায় আট ফুট উঁচু।
হাল ছাড়তে হল।
সাধনবাবু উধাও।
মৃত্যুটা হয়েছে মারার সঙ্গে সঙ্গেই
পার্বতীবাবুকে মাথার উপরের একটা ভারী জিনিস দিয়ে আঘাত মেরে খুন করা হয়েছে। এঁদের বাড়ির ডাক্তার সৌরীন সোম বললেন, মৃত্যুটা হয়েছে মারার সঙ্গে সঙ্গেই। ভদ্রলোকের রক্তের চাপ ওঠা-নামা করত, হার্টেরও গোলমাল ছিল।
ইতিমধ্যে পুলিশও এসে গেছে। ইনস্পেক্টর হাজরা ফেলুদাকে চেনেন। মোটামুটি খাতিরও করেন। সাধারণ পুলিশের লোক প্রাইভেট ইনভেসটিগেটরকে যেরকম অবজ্ঞার চোখে দেখে সেরকম নয়। বললেন, ‘আমাদের যা রুটিন কাজ তা করে যাচ্ছি আমরা, যদি কিছু তথ্য বেরোয় ত আপনাকে জানাব।’
ফেলুদা বলল, ‘যে ভারী জিনিসটা দিয়ে খুন করা হয়েছিল সেটা সম্বন্ধে কোনো আইডিয়া করেছেন?’
হাজরা বললেন, ‘তেমন ত কিছু দেখছি না আশেপাশে। খুনি সেই জিনিসটা নিয়েই ভেগেছে বলে মনে হচ্ছে।’
‘পেপারওয়েট।’
‘পেপারওয়েট?’
‘একবার আসুন আমার সঙ্গে।’
হাজরা ও ফেলুদার পিছন পিছন আমরাও ঢুকলাম ঘরের মধ্যে। ফেলুদা টেবিলের একটা অংশে আঙুল দিয়ে দেখাল।
সবুজ ফেল্টের উপর মিহি ধুলো জমে আছে। তারই একটা অংশে একটা ধুলোহীন গোল চাকতি। খুব ভালো করে লক্ষ না করলে বোঝা যায় না।
‘অমিতাভবাবুকে জিগ্যেস করেছিলাম’, বলল ফেলুদা, ‘একটা বেশ বড় এবং ভারী ভিক্টোরীয় আমলের কাচের পেপারওয়েট থাকত এই টেবিলের উপর। এখন নেই।’
‘ওয়েল ডান, মিস্টার মিত্তির!’
‘কিন্তু আসল লোক ত বেমালুম হাওয়া হয়ে গেল বলে মনে হচ্ছে’, ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বলল ফেলুদা।
হাজরা বললেন, ‘নাম আর ডেস্ক্রিপশন যখন পাওয়া গেছে, তখন তাকে খুঁজে বের করতে অসুবিধা হবে না। তাছাড়া সে ত অ্যাপ্লিকেশন করেছিল; সেটা থেকে থাকলে ত তার ঠিকানাই পাওয়া যাবে। আমার মনে হয় দারোয়ান সত্যি কথা বলছে না। একটা সময় সে গেটের কাছে ছিল না; তখনই লোকটা পালিয়েছে। মেন রোডের উপর বাড়ি, হয়ত বেরিয়েই বাস পেয়ে গেছে। অবিশ্যি সে ছাড়াও ত আরো লোক এসেছিল সকালে। সাধনবাবু আসার ঠিক আগেই আরেকজন ভদ্রলোক এসেছিলেন। খুনটা তিনিও করে থাকতে পারেন।’
‘কিন্তু পার্বতীবাবুকে মৃত দেখলে সাধনবাবু আর থাকবেন কেন?’
‘আপনি ত দেখেছেন ঘরটা; ও ত কিউরিওর দোকান মশাই। একজন লোক যদি অসৎ হয়, ও ঘরে ঢুকে মালিক মৃত দেখলে ত তার পোয়া বারো!’
‘আপনি দেখলে বুঝতে পারবেন কোনো জিনিস গেছে কিনা?’
ফেলুদা প্রশ্নটা করল বর্তমান সেক্রেটারি হৃষিকেশ দত্তকে। ভদ্রলোক দশটার ঠিক আগে বেরিয়েছিলেন পোস্ট আপিসে দুটো জরুরী বিদেশী টেলিগ্রাম করতে। ফেরার পরেই আমাদের সঙ্গে সিঁড়িতে দেখা হয়।
‘তা হয়ত পারতে পারি’, বললেন হৃষিকেশবাবু। ‘বাইরের যা জিনিস তা মোটামুটি সবই আমার জানা। ভিতরে আলমারিবন্দী জিনিসেরও একটা তালিকা একবার আমাকে দিয়ে করিয়েছিলেন মিঃ হালদার। তার কিছু জিনিস বোধ হয় আজ পেস্টনজীকে দেখাবার জন্য বার করেছিলেন। পেস্টনজী আসেন সাড়ে নটায়।’
‘এই পেস্টনজীর সঙ্গে কি আগেই আলাপ ছিল পার্বতীবাবুর?’
‘খুব। প্রায় দশ বছরের আলাপ। মাসে অন্তত দুবার করে আসতেন। উনিও একজন কালেকটার। মিঃ হালদারের সংগ্রহে একটা চিঠি ছিল, সেটা দেখতেই ভদ্রলোক আসেন।’
‘এটা কি সেই নেপোলিয়নের চিঠি?’
‘হ্যাঁ।’
‘সেটা কি মিঃ হালদার বিক্রী করার কথা ভাবছিলেন?’
‘মোটেই না। পেস্টনজীর খুব লোভ ছিল ওটার উপর। তিনি মোটা টাকা অফার করবেন, আর মিঃ হালদার রিফিউজ করবেন—তাতে পেস্টনজীর মুখের ভাবটা কেমন হবে সেটা দেখেই মিঃ হালদারের আনন্দ। এ ব্যাপারে ওঁর একটা জিদও ছিল। এই চিঠিটা কেনার জন্য একবার এক আমেরিকান দাম চড়াতে চড়াতে বিশ হাজার ডলারে উঠেছিল। মিঃ হালদার ক্রমাগত মাথা নেড়ে গেলেন। সাহেবের মুখ লাল, শেষ পর্যন্ত মুখ খারাপ করতে আরম্ভ করল, আর সমস্ত ব্যাপারটা বসে বসে উপভোগ করলেন মিঃ হালদার। আজও পেস্টনজী গলা চড়াতে শুরু করেছিলেন সেটা আমি বাইরে থেকেই বুঝতে পেরেছিলাম।’
‘কিসের মধ্যে থাকত জিনিসটা?’
‘একটা অ্যালক্যাথীনের খামে।’
‘তাহলে বোধ হয় যায়নি চিঠিটা। কারণ খামটা টেবিলের উপরই রয়েছে। আর তার মধ্যে একটা সাদা ভাঁজ করা কাগজও দেখলাম।’
‘না গেলেই ভালো। ও চিঠির মর্ম সকলে বুঝবে না।’
চুরি হয়েছে কিনা সেটা এখন জানা যাবে না, কারণ পুলিশ ও ঘরে কাজ করছে; তাছাড়া পুলিশের ডাক্তার এইমাত্র এসেছেন, তিনি লাশ পরীক্ষা করছেন।
হৃষিকেশবাবু বললেন, ‘আশ্চর্য। যে সময় সাধনবাবু গেলেন, প্রায় সে সময়ই আমি ফিরেছি। অথচ লোকটার সঙ্গে দেখা হল না।’
‘আপনি বেরিয়েছেন ক’টায়?’ ফেলুদা জিগ্যেস করল।
‘ঠিক দশটা বাজতে পাঁচ। এখান থেকে পাঁচ মিনিট লাগে পোস্টাপিস যেতে। খোলার সঙ্গে সঙ্গে টেলিগ্রামগুলো দিতে চেয়েছিলাম।’
‘সে তো পাঁচ মিনিটের কাজ, তাহলে ফিরতে এত দেরি হল কেন?’
হৃষিকেশবাবু মাথা নাড়ালেন। —’আর বলবেন না মশাই। ঘড়ির ব্যাণ্ডের খোঁজ করছিলুম স্টেশনারি দোকানগুলোতে। দেখছেন না ডান হাতে ঘড়ি পরেছি। ব্যাণ্ডটা ঢিলে হয়ে গেছে। বাঁ কব্জি আমার ডান কব্জির চেয়ে প্রায় আধ ইঞ্চি সরু। ব্যাণ্ড ঢলঢল করে। কোনো লাভ হল না। সেই নিউ মার্কেট ছাড়া গতি নেই।’
ভদ্রলোক ডান হাতে ঘড়ি পরেন সেটা আগেই লক্ষ করেছি।
‘আপনি এ বাড়িতেই থাকেন?’ ফেলুদা জিগ্যেস করল। অমিতাভবাবু ভিতরে সামলাচ্ছেন, তাছাড়া উনি নিজেও বেশ ভেঙে পড়েছেন, তাই ফেলুদা হৃষিকেশবাবুর কাছ থেকে যা তথ্য পাওয়া যায় বার করে নিচ্ছে।
‘হ্যাঁ, এ বাড়িতেই’, বললেন, হৃষিকেশবাবু, ‘একতলায়। ফ্যামিলি-ট্যামিলি নেই, তাই মিঃ হালদার বললেন এখানেই থাকতে; ঘরের ত অভাব নেই। সাধনবাবুও শুনেছি এ বাড়িতেই থাকতেন।’
‘এ কাজ ত ছেড়ে চলে যাচ্ছিলেন আপনি। ভালো লাগছিল না বুঝি?’
‘প্রাণ হাঁপিয়ে উঠছিল মশাই। তাছাড়া উন্নতির সুযোগ আজকের দিনে কে ছাড়ে বলুন। মিঃ হালদার অবিশ্যি এমপ্লয়ার হিসেবে ভালোই ছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে কিছু বলার নেই আমার।’
আরেকজন ভদ্রলোকের সঙ্গে এর মধ্যে আলাপ হয়েছে, যদিও কথা হয়নি। তিনি হলেন অমিতাভবাবুর ছোট ভাই অচিন্ত্যবাবু। ভদ্রলোক বাড়িতেই ছিলেন, তাই বোধ হয় পুলিশ এখন তাঁকে জেরা করছে। ফেলুদা হৃষিকেশবাবুকেই জিগ্যেস করলেন ছোট ভাইয়ের কথা।
‘অচিন্ত্যবাবু কী করেন?’
‘থিয়েটার।’
‘থিয়েটার?’
আমরা তিনজনেই অবাক।
‘পেশাদারী থিয়েটার? মানে থিয়েটার করেই ওঁর রোজগার?’
হৃষিকেশবাবুকে উত্তরটা দিতে যেন বেশ একটু ভাবতে হল। বললেন, ‘এসব ভেতরের ব্যাপার। আর সত্যি, আমার পক্ষে বলাটা বোধ হয় খুব শোভা পায় না। এ ফ্যামিলিতে থিয়েটার করাটা বেমানান তাতে সন্দেহ নেই, তবে আমার একটা সন্দেহ হয়েছে যে অচিন্ত্যবাবুর মনে একটা বড় রকমের অভিমান ছিল। চার ভাইয়ের মধ্যে উনিই একমাত্র বিলেত যাননি পড়াশুনো করতে। আসলে বড় ফ্যামিলিতে ছোট ভাই অনেক সময় একটু নেগলেকটেড হয়। ওনার ক্ষেত্রে মনে হয় সেটাই হয়েছে। আমার সঙ্গে মাঝে-মধ্যে কথাবার্তা থেকেও সেটাই মনে হয়েছে। চাকরি একটা করিয়ে দিয়েছিলেন মিঃ হালদারই, কিন্তু অচিন্ত্যবাবু সেটা ছেড়ে দেন। থিয়েটারের শখটা বোধ হয় এমনিতেই ছিল। বারাসতে একটা ড্রামাটিক ক্লাব নিয়ে খুব মেতে ওঠেন, কিন্তু তাতে মন ভরে না। এখন নবরঙ্গমঞ্চে ঘোরাঘুরি করছেন। দু-একটা হিরোর পার্টও নাকি করেছেন। কালও দেখছিলাম পার্ট মুখস্থ করছেন।’
এবারে ইনস্পেক্টর হাজরা এগিয়ে এলেন আমাদের দিকে। অচিন্ত্যবাবুর জেরা শেষ। তিনি গোমড়া মুখে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। হাজরা বললেন, ‘খুনটা হয়েছে দশটা থেকে সাড়ে দশটার মধ্যে। পেস্টনজী ছিলেন সাড়ে ন’টা থেকে দশটার কিছু পর অবধি। সাধন দস্তিদার এসেছেন সোয়া দশটায়, গেছেন সাড়ে দশটায়। ছোট ছেলের ঘর থেকে বাইরের বারান্দা দিয়ে সোজা বাপের ঘরে যাওয়া যায়। বাড়ির ভেতরের লোক দেখতে পাবে না। দশটা পাঁচ থেকে সোয়া দশটার মধ্যে অচিন্ত্যবাবু বাপের ঘরে এসে থাকতে পারেন। উনি বলছেন সারা সকাল পার্ট মুখস্থ করেছেন, কেবল সাড়ে দশটা নাগাদ একবার ভাইপো অনিরুদ্ধর ডাক পেয়ে তার কাছে যান তার খেলার মেশিনগানটা দেখতে। তখনও তিনি বাপের মৃত্যুসংবাদ পাননি। যাই হোক, মোটামুটি তিন জনেরই মোটিভ ছিল। ছেলের সঙ্গে বাপের বনত না, পেস্টনজী ছিলেন মিঃ হালদারের রাইভ্যাল, আর সাধন দস্তিদারের ছিল পুরনো আক্রোশ। এই হল ব্যাপার। এবার আপনি এসে একটু দেখে বলুন ত কিছু চুরি গেছে কিনা।’
শেষ অনুরোধটা করা হল হৃষিকেশবাবুকে। ভদ্রলোক এগিয়ে গেলেন স্টাডির দিকে, আমরা তাঁর পিছনে।
ঘরটায় ঢুকে হৃষিকেশবাবু একবার চারিদিকে চোখ বুলিয়ে নিলেন। মেক্যানিক্যাল জিনিসে পার্বতীবাবুর খুব শখ ছিল, কারণ বৈঠকখানায় দেখেছি একটা প্রথম যুগের সিলিণ্ডার গ্রামোফোন, আর এ ঘরে দেখছি একটা আদ্যিকালের ম্যাজিক ল্যানটার্ন। তাছাড়া ছোট ছোট মূর্তি, পাত্র, দোয়াত, কলম, পিস্তল, পুরনো ছবি, ম্যাপ, বই—এসব ত আছেই। বাইরের জিনিসপত্র দেখে, চাবি দিয়ে আলমারি, বাক্স দেরাজ ইত্যাদি খুলে দেখে অবশেষে হৃষিকেশবাবু জানালেন যে কোনো জিনিস গেছে বলে ত মনে হচ্ছে না।
ফেলুদা বলল, ‘আপনি অ্যালক্যাথীনের খামটা একবার দেখলেন না?’
‘ওতে ত চিঠিটা রয়েছে বলেই মনে হচ্ছে।’
‘তবু একবার দেখে নেওয়া উচিত।’
হৃষিকেশবাবুকে খামটা খুলে ভেতরের কাগজটা টেনে বার করতে হল। কাগজের রংটা দেখেই আমার সন্দেহ হয়েছিল; পুরনো কাগজ কি এত সাদা হয়? ভাঁজ করা কাগজটা খুলে ফেলেই ভদ্রলোক চেঁচিয়ে উঠলেন।
‘এ কী! এতো প্যাড থেকে ছেঁড়া হালদার মশাইয়ের নিজের চিঠির কাগজ!’
অর্থাৎ নেপোলিয়নের চিঠি উধাও।
ফেলুদা বাড়ির কম্পাউন্ডটা ঘুরে দেখল
আরো আধ ঘণ্টা ছিলাম আমরা হালদারবাড়িতে। সেই সময়টা ফেলুদা বাড়ির কম্পাউণ্ডটা ঘুরে দেখল। বাগানটা দেখা শেষ করে, কম্পাউণ্ড ওয়ালের কোনো অংশ নিচু বা ভাঙা আছে কিনা দেখে আমরা পুকুরের কাছে এলাম। ফেলুদার দৃষ্টি মাটির দিকে, জানি ও পায়ের ছাপ খুঁজছে। শুকনো মাটি, পায়ের ছাপের সম্ভাবনা কম, তবে পুকুরের পূর্ব পাড়ে একটা অংশ ফেলুদার দৃষ্টি আকর্ষণ করায় সে থেমে গেল।
একটা ছোট্ট বুনো ফুলের গাছ যেন কিসের চাপে পিষে গেছে। আর সেটা হয়েছে কিছুক্ষণ আগেই।
ফেলুদা ফুলের আশপাশটা দেখে পুকুরের দিকে চেয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। এ পুকুর ব্যবহার হয় না, তাই জলটা পানার আবরণে ঢেকে গেছে। আমরা যেখানটা দাঁড়িয়ে আছি সেখান থেকে হাত পাঁচেক দূরে বেশ খানিকটা জায়গা জুড়ে পানা সরে গিয়ে জল বেরিয়ে পড়েছে।
কিছু ফেলা হয়েছে কি জলের মধ্যে? তাইত মনে হয়।
কিন্তু ফেলুদা এনিয়ে কোনো মন্তব্য করল না। যা দেখবার ও দেখে নিয়েছে।
বাড়ি ফেরার সময় লালমোহনবাবু হঠাৎ বললেন, ‘বাগানে একটা চন্দনা দেখলুম বলে মনে হল। একটা পেয়ারা গাছ থেকে উড়ে একটা সজনে গাছে গিয়ে বসল।’
‘সেটা আমাদের বললেন না কেন?’ ধমকের সুরে বলল ফেলুদা।
‘কী জানি, যদি বেরিয়ে যায় টিয়া! দুটো পাখি এত কাছাকাছি। তবে এ পাখিটা কথা বলে।’
‘আপনি শুনলেন কথা।’
‘শুনলুম বৈকি। আপনারা তখন বাগানের উল্টো দিকে। আমি আরেকটু হলেই একটা তেঁতুলে বিছের উপর পা ফেলেছি, এমন সময় শুনলুম “বাবু সাবধান।” আর মুখ তুলে দেখি পাখি।’
‘পাখি বলল বাবু সাবধান?’
‘তাই ত স্পষ্ট শুনলুম। আপনারা বিশ্বাস করবেন না বলেই বলিনি।’
বিশ্বাস করাটা সত্যিই কঠিন, তাই কথা আর এগোল না।
তবে এটা ঠিক যে এরকম একটা খুন আর এরকম চুরির পরেও ফেলুদার মন থেকে চন্দনার ব্যাপারটা যাচ্ছে না। খুনের দু’দিন পর, সোমবার সকালে চা খাওয়ার পর ফেলুদার কথায় সেটা বুঝতে পারলাম। ও বলল, ‘পার্বতীবাবুর খুন আর নেপোলিয়নের চিঠি চুরি—এই দুটো ঘটনাই গতানুগতিক। কিন্তু আমাকে একেবারে বোকা বানিয়ে দিয়েছে এই পাখি চুরির ব্যাপারটা।’
গতকাল অমিতাভবাবু ফোন করেছিলেন; ফেলুদা জানিয়ে দিয়েছে যে নেহাৎ দরকার না পড়লে এই অবস্থায় ও আর ওঁদের বিরক্ত করবে না, বিশেষ করে পুলিশ যখন তদন্ত চালাচ্ছেই। লালমোহনবাবু বলেছেন সোমবার হলেও আজ একবার আসবেন, কারণ কী ডেভেলাপমেন্ট হচ্ছে না হচ্ছে সেটা জানার ওঁর বিশেষ আগ্রহ।
আমি বললাম, ‘পাখির খাঁচার গায়ে রক্তটা পাখির না মানুষের সেটা ত এখনো জানা গেল না।’
‘ওটা যে মানুষের সেটা অ্যানালিসিস না করেই বলা যায়’, বলল ফেলুদা। ‘কেউ যদি পাখিকে খাঁচা থেকে বার করতে যায় তাহলে সেটা সাবধানেই করবে, কিন্তু পাখি ছটফট করতে পারে, খামচাতে পারে, ঠোক্রাতে পারে। অর্থাৎ যে লোকে পাখিটাকে বার করেছে তার হাতে জখমের চিহ্ন থাকা উচিত।’
‘সে জিনিস ও বাড়ির কারুর হাতে দেখলে?’
‘উঁহু। সেটার দিকে আমি চোখ রেখেছিলাম। বাবু, চাকর কারুর হাতেই দেখিনি। অথচ টাট্কা জখম। অমিতাভবাবু বললেন পার্ক স্ট্রীটে আমাদের সঙ্গে দেখা হবার দু’দিন আগে পাখিটা কিনেছিলেন। তার মানে ১৩ই ডিসেম্বর। খুনটা হয় ১৯শে ডিসেম্বর।…এই পাখির জন্য আমি অন্য ব্যাপারগুলোতে পুরোপুরি মনও দিতে পারছি না।’
‘খুনের সুযোগ কার কার ছিল তার একটা লিস্ট করছিলে না তুমি কাল রাত্তিরে?’
‘শুধু সুযোগ নয়, মোটিভও।’
ফেলুদার পাশেই সোফায় পড়েছিল খাতাটা। সে ওটা খুলে বলল, ‘সাধন দস্তিদার সম্বন্ধে নতুন কথা বলার বিশেষ কিছু নেই। রহস্যটা হচ্ছে তার অন্তর্ধানে। এটা সম্ভব হয় একমাত্র যদি দারোয়ান মিথ্যে কথা বলে থাকে। সাধন তাকে ভালোরকম ঘুষ দিয়ে থাকলে এটা হতে পারে। সেটা পুলিশে বার করুক। মিথ্যেবাদীকে সত্যি বলানোর রাস্তা তাদের জানা আছে।’
‘দ্বিতীয় সাসপেক্ট—পেস্টনজী। তবে পেস্টনজীর সত্তর বছর বয়স; বুড়ো মানুষের পক্ষে এ খুন সম্ভব কিনা সেটা ভাবতে হবে। আঘাতটা করা হয়েছিল রীতিমতো জোরে। অবিশ্যি সত্তরেও অনেকের স্বাস্থ্য দিব্যি ভালো থাকে। সেটা ভদ্রলোককে চাক্ষুষ না দেখা পর্যন্ত বোঝা যাবে না।’
‘তৃতীয়—অচিন্ত্য হালদার। বাপের উপর ছেলের টান না থাকলেও খুন করার মতো আক্রোশ ছিল কিনা সেটা ভাবার কথা। তবে নেপোলিয়নের চিঠি হাতাতে পারলে ওর আর্থিক সমস্যা কিছুটা মিটত ঠিকই। আর কেউ না হোক, পেস্টনজী যে সে চিঠি কিনতে রাজি হতেন সেটা বোধহয় অনুমান করা যায়। চতুর্থ—’
‘আবার আরো একজন আছে নাকি?’
‘তাকে সাসপেক্ট বলে বলছি না, কিন্তু অমিতাভবাবু সে সময়টা কী করছিলেন সেটা জানা দরকার বৈ কি। তাঁর জবানীতে তিনি বলেছেন সকালে তিনি বাগানে থাকেন। ওঁর খুব ফুলের শখ। সেদিন দশটা পর্যন্ত তিনি বাগানে ছিলেন। মাঝে একবার আমাদের ফোন করতে ন’টার সময় তাঁকে নিচের বৈঠকখানায় আসতে হয়। তারপর আমরা আসার আগে আর দোতলায় যাননি। চাকর তাঁকে চা দিয়ে যায় দশটার সময় একতলায় বাগানের দিকের খোলা বারান্দায়। আমাদের গাড়ির আওয়াজ পেয়ে তিনি সামনের দিকে চলে আসেন। দোতলায় যান তিনি একেবারে আমাদের নিয়ে, তার আগে নয়।’
‘সব শেষে হলেন হৃষিকেশবাবু। ইনি দশটা বাজতে পাঁচে বেরিয়েছেন সেটা দারোয়ান দেখেছে, কিন্তু ফিরতে দেখেছে কিনা মনে করতে পারছে না। দারোয়ানের কথাবার্তা খুব রিলায়েবল বলে মনে হয় না। চল্লিশ বছর চাকরি করছে বটে হালদার বাড়িতে, হয়ত এমনিতে বিশ্বস্ত, কিন্তু বয়স হয়েছে সত্তরের উপর, কাজেই স্মরণশক্তি ক্ষীণ হয়ে আসা অস্বাভাবিক নয়। হৃষিকেশবাবু স্টেশনারি দোকানে অতটা সময় কাটিয়েছেন কিনা সেটা জানা দরকার। যদি সে ব্যাপারে মিথ্যেও বলে থাকেন, তার খুনের সুযোগ সম্বন্ধে সন্দেহ থেকেই যায়। একমাত্র নেপোলিয়নের চিঠি হাত করা ছাড়া মোটিভও খুঁজে পাওয়া যায় না।’
ফেলুদা খাতাটা বন্ধ করল। আমি বললাম, ‘চাকর-বাকরদের বোধহয় সব কটাকেই বাদ দেওয়া যায়!’
‘শুনলিই ত চাকর সব কটাই পুরনো। তাদের মধ্যে বেয়ারা মুকুন্দ পার্বতীচরণের ঘরে কফি নিয়ে যায় পেস্টনজী ও পার্বতীবাবুর জন্য।
পার্বতীচরণ একা থাকলেও রোজ দশটায় কফি খেতেন। এছাড়া আর কোনো চাকর ন’টার পর পার্বতীচরণের ঘরে যায়নি। বাড়িতে লোক বলতে আর আছে অমিতাভবাবুর স্ত্রী, অনিরুদ্ধ, পার্বতীবাবুর আশি বছরের বুড়ী মা, মালি, মালির এক ছেলে, ড্রাইভার ও দারোয়ান। অচিন্ত্যবাবু বিয়ে করেননি।’
ফেলুদা একটা চারমিনার ধরাবার সঙ্গে সঙ্গেই ফোন বেজে উঠল। ইনস্পেক্টর হাজরা।
‘কী খবর বলুন স্যার’, বলল ফেলুদা।
‘সাধন দস্তিদারের ঠিকানা পাওয়া গেছে।’
‘ভেরি গুড।’
‘ভেরি ব্যাড, কারণ সে ঠিকানায় ওই নামে কেউ থাকে না।’
‘বটে?’
‘এবং কোনদিন ছিলও না।’
‘তাহলে?’
‘তাহলে আর কি—যে তিমিরে সেই তিমিরে। মহা ফিচেল লোক বলে মনে হচ্ছে।’
‘আর হৃষিকেশবাবুর অ্যালিবাই ঠিক আছে?’
‘উনি পোস্টাপিসে গিয়েছিলেন দশটায় এবং টেলিগ্রামগুলো করেছেন এটা ঠিক। তারপর স্টেশনারি দোকানে যাবার কথা যেটা বললেন সেটা ভেরিফাই করা গেল না, কারণ দোকানে কেউ মনে করতে পারল না।’
‘আর পেস্টনজী?’
‘অসম্ভব তিরিক্ষি মেজাজের লোক। প্রচণ্ড ধনী। দেড়শো বছর কলকাতায় আছে এই পার্সী ফ্যামিলি। এমনিতে বেশ শক্ত সমর্থ লোক, তবে কাবু হয়ে আছেন আরথ্রাইটিসে, ডান হাত কাঁধের উপর ওঠে না। ওঁর পক্ষে এই খুন প্রায় ইমপসিবল। লর্ড সিন্হা রোডে গিয়ে রোজ সকালে ফিজিওথেরাপি করান। চেক করে দেখেছি; কথাটা সত্যি।’
‘তাহলে ত সাধন দস্তিদারের সন্ধানেই লেগে থাকতে হয়।’
‘আমার ধারণা লোকটা বারাসতেই থাকে, কারণ ওর অ্যাপ্লিকেশনের খামে বারাসতের পোস্টমার্ক রয়েছে।’
‘সে কি, এতো খুবই ইন্টারেস্টিং ব্যাপার।’
‘আমরা খোঁজ করছি। এখানে গা ঢাকা দিয়ে থাকতে পারবে বলে মনে হয় না। ও, ভাল কথা, খোকার ঘরে চোর এসেছিল।’
‘আবার?’
‘আবার মানে?’
হাজরা পাখির কথাটা জানেন না। ফেলুদা সেটা চেপে গিয়ে বলল, ‘না, বলছিলাম—একটা চুরি ত হল বাড়িতে, আবার চোর?’
‘যাই হোক, কিছু নেয়নি।’
‘খোকা টের পেল কি করে?’
‘সে বাবা-মায়ের পাশের ঘরে একা শোয়। বিলিতি কায়দা আর কি! তা কাল মাঝ রাত্তিরে নাকি খুটখাট শব্দে ঘুম ভেঙে যায়। ছেলের সাহস আছে। ‘কে’ বলে চেঁচিয়ে ওঠে, আর তাতেই নাকি চোর পালিয়ে যায়। আমি খোকাকে জিজ্ঞেস করলুম—তোমার ভয় করল না? তাতে সে বললে যে বাড়িতে খুন হবার পর থেকে নাকি সে বালিশের তলায় মেশিনগান নিয়ে শোয়, আর সেই কারণেই নাকি তার ভয় নেই।’
দশটার সময় লালমোহনবাবু এসে হাজির। ফেলুদাকে গম্ভীর দেখে ভদ্রলোক ভারী ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। —’সে কি মশাই, আপনি এখনো অন্ধকারে নাকি?’
‘কী করি বলুন—রোজ যদি একটা করে নতুন রহস্যের উদ্ভব হয় তাহলে ফেলু মিত্তির কী করে?’
‘আবার রহস্য?’
‘খোকার ঘরে চোর ঢুকেছিল কাল রাত্তিরে।’
‘বলেন কি? চোরের কি কোনো বাছবিচার নেই? মুড়ি-মিছরি একদর?’
‘এখন আপনার উপর ভরসা।’
‘হুঁ—চন্দ্র-সূর্য অস্ত গেল, জোনাক ধরে বাতি—ভীষ্ম দ্রোণ কর্ণ গেল, শল্য হল রথী! তবে হ্যাঁ—চন্দনার ব্যাপারটা কিন্তু আমায় হণ্ট্ করছে। ওটা নিয়ে একটা আলাদা তদন্ত করা উচিত। আপনার সময় না থাকলে আমি করতে রাজি আছি। তিনকড়িবাবুর দোকানে আমার খুব যাতায়াত ছিল এককালে।’
‘সে কি, এটা ত বলেননি আগে।’
‘আরে মশাই, এককালে খুব পাখির শখ ছিল আমার। একটা ময়না ছিল, সেটাকে মেঘনাদবধ কাব্যের প্রথম লাইন আবৃত্তি করতে শিখিয়েছিলাম।’
‘জল পড়ে পাতা নড়ে দিয়ে শুরু করা উচিত ছিল আপনার।’
ভদ্রলোক ফেলুদার খোঁচাটা অগ্রাহ্য করে আমার দিকে ফিরে বললেন, ‘কী হে তপেশবাবু, যাবে নিউ মার্কেট?’
ফেলুদা বলল, ‘যেতে হয় ত বেরিয়ে পড়ুন। আমি ঘণ্টাখানেক পরে আপনাদের সঙ্গে মীট করব।
‘কোথায়?’
‘নিউ মার্কেটের মধ্যিখানে, কামানটার পাশে। বিস্তর ঘোরাঘুরি আছে, বাইরে খাওয়া আছে।’
সপ্তাহে একদিন রেস্টুর্যাণ্টে খাওয়াটা আমাদের রেগুলার ব্যাপার।
লালমোহনবাবুর গাড়িতে করে বেরিয়ে পড়লাম।
নিউ মার্কেটের পাখির বাজারের জবাব নেই। তবে তিনকড়িবাবু যে জটায়ুকে চিনবেন না তাতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই, কারণ ভদ্রলোক এ দোকানে শেষ এসেছেন সিকসটি এইটে। লালমোহনবাবু এক গাল হেসে ‘চিনতে পারছেন?’ জিগ্যেস করাতে তিনকড়িবাবু তাঁর মোটা চশমার উপর দিয়ে লালমোহনবাবুর দিকে চেয়ে বললেন, ‘চেনা মুখ ত ভুলি না চট করে। নাকু বাবু ত? আপনি কারবালা ট্যাঙ্ক রোডে থাকেন না?’
লালমোহনবাবুর চুপসোন ভাব দেখে আমিই কাজের কথাটা পাড়লাম।
‘আপনার এখান থেকে গত দিন দশেকের মধ্যে কি কেউ একটা চন্দনা কিনে নিয়ে গেছে? বারাসতের এক ভদ্রলোক?’
‘বারাসতে কিনা জানি না, তবে দুখানা চন্দনা বিক্রী হয়েছে দিন দশেকের মধ্যে। একটা নিল জয়শক্তি ফিলিম কোম্পানির নেপেনবাবু। বলল চিন্ময়ী মা না মৃন্ময়ী মা কি একটা বইয়ের শুটিং-এ লাগবে। ভাড়ায় চাইছিল—আমি বললুম সেদিন আর নেই। নিলে ক্যাশ দিয়ে নিয়ে যান, কাজ হয়ে গেলে পর আপনাদের হিরোইনকে দিয়ে দেবেন।’
‘আর অন্যটা যে বেচলেন, সেটা কোত্থেকে এসেছিল আপনার দোকানে মনে আছে?’
‘কেন মশাই, অত ইনফরমেশনে কী দরকার?’
ভদ্রলোক একটু সন্দিগ্ধ বলে মনে হল।
‘সেই পাখিটা খাঁচা থেকে চুরি গেছে অত্যন্ত রহস্যজনকভাবে’, বললেন লালমোহনবাবু, ‘সেটা ফিরে পাওয়া দরকার।’
‘ফিরে পেতে চান ত কাগজে অ্যাডভারটাইজ দিন।’
‘তা না হয় দেব, কিন্তু আপনার দোকানে কোত্থেকে এসেছিল সেটা—’
‘অতশত বলতে পারব না। আপনি অ্যাডভারটাইজ দিন।’
‘পাখিটা কথা বলত কি?’
‘তা বলবে না কেন? তবে কী বলত জিগ্যেস করবেন না। সতেরোটা টকিং বার্ড আছে আমার দোকানে। কেউ বলে গুড মর্নিং, কেউ বলে ঠাকুর ভাত দাও, কেউ বলে জয় গুরু, কেউ বলে রাধাকেষ্ট—কোন্টা কোন্ পাখি বলে সেটা ফস্ করে জিগ্যেস করলে বলতে পারব না।’
আধ ঘণ্টা সময় ছিল হাতে, তার মধ্যে লালমোহনবাবু একটা নখ কাটার ক্লিপ, আধ ডজন দেশবন্ধু মিলসের গেঞ্জি আর একটা সিগন্যাল টুথ পেস্ট কিনলেন। তারপর চীনে জুতোর দোকানে গিয়ে একটা মোকাসিনের দাম করতে করতে আমাদের অ্যাপয়ন্টমেন্টের সময় এসে গেল। আমরা কামানের কাছে যাবার তিন মিনিটের মধ্যেই ফেলুদা হাজির।
‘এবার কোথায় যাওয়া?’ মার্কেট থেকে বাইরে বেরিয়ে এসে জিগ্যেস করলেন লালমোহনবাবু।
‘পার্সীরা প্রায় দুশো বছর ধরে কলকাতায় আছে সেটা জানতেন?’
‘বলেন কি? সেই সিরাজদ্দৌলার আমল থেকে?’
‘সেইরকম একটি প্রাচীন পার্সী বাড়িতে এখন যাব আমরা। ঠিকানা হচ্ছে’—ফেলুদা পকেট থেকে খাতা বার করল—
‘একশো তেত্রিশের দুই বৌবাজার স্ট্রীট।’
বৌবাজার স্ট্রিট
একশো তেত্রিশের দুই বৌবাজার স্ট্রীট দেড়শো বছরের পুরনো বাড়ি কিনা জানি না। তবে এত পুরনো বাড়িতে এর আগে আমি কখনো যাইনি তাতে কোনো সন্দেহ নেই। দুটো দোকানের মাঝখানে একটা খিলেনের মধ্যে দিয়ে প্যাসেজ পেরিয়ে কাঠের সিঁড়ি। সেই সিঁড়ি দিয়ে তিনতলায় গিয়ে ডান দিকে ঘুরে সামনেই দরজার উপর পিতলের ফলকে লেখা আর ডি পেস্টনজী। কলিং বেল টিপতেই একজন বেয়ারা এসে দরজা খুলল। ফেলুদা তার হাতে তার নিজের নাম আর পেশা লেখা একটা কার্ড দিয়ে দিল।
মিনিট তিনেক পর বেয়ারা এসে বলল, ‘পাঁচ মিনিটের বেশি সময় দিতে পারবেন না বাবু।’
তাই সই। আমরা তিনজন বেয়ারার সঙ্গে গিয়ে একটা ঘরে ঢুকলাম। বিশাল অন্ধকার বৈঠকখানা, তারই এক পাশে দেয়ালের সামনে সোফায় বসে আছেন ভদ্রলোক। সামনে টেবিলে রাখা বোতলে পানীয় ও গেলাস। গায়ের রং ফ্যাকাশে। নাকটা টিয়া পাখির মতো ব্যাঁকা, চওড়া কপাল জুড়ে মেচেতা।
সোনার চশমার মধ্যে দিয়ে ঘোলাটে চোখে আমাদের দিকে চেয়ে কর্কশ গলায় বললেন, ‘বাট ইউ আর নট ওয়ান ম্যান, ইউ আর এ ক্রাউড!’
ফেলুদা ক্ষমা চেয়ে ইংরাজিতে বুঝিয়ে দিল যে তিন জন হলেও, সে একাই কথা বলবে; বাকি দুজনকে ভদ্রলোক অনায়াসে অগ্রাহ্য করতে পারেন।
‘ওয়েল, হোয়াট ডু ইউ ওয়ণ্ট?’
‘আপনি পার্বতী হালদারকে চিনতেন বোধহয়?’
‘মাই গড্, এগেন!’
ফেলুদা হাত তুলে ভদ্রলোককে ঠাণ্ডা করার চেষ্টা করে বলল, ‘আমি পুলিশের লোক নই সেটা আমার কার্ড দেখেই নিশ্চয় বুঝেছেন। তবে ঘটনাচক্রে আমি এই খুনের তদন্তে জড়িয়ে পড়েছি; আমি শুধু জানতে চাইছিলাম—এই যে নেপোলিয়নের চিঠিটা চুরি হয়েছে, সেটা সম্বন্ধে আপনার কী মত।’
পেস্টনজী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ‘তুমি দেখেছ চিঠিটা?’
ফেলুদা বলল, ‘কী করে দেখব, যেদিন ভদ্রলোকের মৃত্যু, সেদিনেই ত আমি প্রথম গেলাম তার বাড়িতে।’
পেস্টনজী বললেন, ‘নেপোলিয়নের বিষয় পড়েছ ত তুমি?’
‘তা কিছু পড়েছি।’
ফেলুদা গত দু’দিনে নেপোলিয়ন সম্বন্ধে আর পুরনো আর্টিস্টিক জিনিস সম্বন্ধে সিধু জ্যাঠার কাছ থেকে বেশ কিছু বই ধার করে এনে পড়েছে সেটা আমি জানি।
‘সেন্ট হেলেনায় তার শেষ নিবার্সনের কথা জান ত?’
‘তা জানি।’
‘কোন্ সালে সেটা হয়েছিল মনে আছে?’
‘১৮১৫।’
ভদ্রলোকের ঠোঁটের কোণে হাসি দেখে বুঝলাম তিনি ইম্প্রেস্ড হয়েছেন। বললেন, ‘এই চিঠি লেখা হয়েছিল ১৮১৪ খৃষ্টাব্দে। সেন্ট হেলেনায় যে ছ’ বছর বেঁচেছিলেন নেপোলিয়ন সেই সময়টা তাঁকে চিঠি লিখতে দেওয়া হয়নি। তার মানে এই চিঠিটা তাঁর শেষ চিঠিগুলির মধ্যে একটা। কাকে লেখা সেটা জানা যায়নি—শুধু ‘মঁশেরামী’—অর্থাৎ “আমার প্রিয় বন্ধ।” চিঠির ভাব ও ভাষা অপূর্ব। সব হারিয়েছেন তিনি, কিন্তু এই অবস্থাতেও তিনি এক বিন্দু আদর্শচ্যুত হননি। এ চিঠি লাখে এক। জুরিখ শহরে এক সর্বস্বান্ত মাতালের কাছ থেকে জলের দরে এ চিঠি কিনেছিলেন পার্বতী হালদার। আর সে জিনিস আমার হাতে চলে আসত মাত্র বিশ হাজার টাকায়।’
‘কি রকম?’—আমরা সকলেই অবাক—’মাত্র বিশ হাজার টাকায় এ চিঠি আপনাকে বিক্রী করতে রাজি ছিলেন মিঃ হালদার?’
পেস্টনজী মাথা নাড়লেন।—’নো নো। হি ডিডন্ট ওয়ণ্ট টু সেল ইট। হালদারের গোঁ ছিল সাংঘাতিক। ওঁর এদিকটা আমি খুব শ্রদ্ধা করতাম।’
‘তাহলে?’
পেস্টনজী গেলাসটা তুলে মুখে খানিকটা পানীয় ঢেলে বললেন, ‘তোমাদের কিছু অফার করতে পারি? চা, বিয়ার—?’
‘না না, আমরা এখুনি উঠব।’
‘ব্যাপারটা আর কিছুই না’ বললেন পেস্টনজী, ‘এটা পুলিশকে বলিনি। ওদের জেরার ঠেলায় আমার ব্লাড প্রেসার চড়িয়ে দিয়েছিল সাংঘাতিকভাবে। ইউ লুক লাইক এ জেন্টলম্যান, তাই তোমাকে বলছি। কাল সকালে একটা বেনামী টেলিফোন আসে। লোকটা সরাসরি আমায় জিজ্ঞেস করে আমি বিশ হাজার টাকায় নেপোলিয়নের চিঠিটা কিনতে রাজি আছি কিনা। আমি তাকে গতকাল রাত্রে আসতে বলি। সে বলে সে নিজে আসবে না, লোক পাঠিয়ে দেবে, আমি যেন তার হাতে টাকাটা দিই। সে এও বলে যে আমি যদি পুলিশে খবর দিই তাহলে আমারও দশা হবে পার্বতী হালদারের মতো।
‘এসেছিল সে লোক?’—আমরা তিনজনেই যাকে বলে উদ্গ্রীব, উৎকর্ণ।
পেস্টনজী মাথা নাড়লেন। —’নো। নোবডি কেম।’
আমরা তখনই উঠে পড়তাম, কিন্তু ফেলুদার হঠাৎ পেস্টনজীর পিছনের তাকের উপর রাখা একটা জিনিসের দিকে দৃষ্টি গেছে।
‘ওটা মিং যুগের পোর্সিলেন বলে মনে হচ্ছে?’
ভদ্রলোকের দৃষ্টি উদ্ভাসিত।
‘বাঃ, তুমি ত এসব জানটান দেখছি। এক্স্কুইজিট জিনিস।’
‘একবার যদি…’
‘নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই। হাতে নিয়ে না দেখলে বুঝতে পারবে না।’
ভদ্রলোক উঠে গিয়ে জিনিসটার দিকে হাত বাড়িয়েই ‘আউচ!’ বলে যন্ত্রণায় কুঁচকে গেলেন।
‘কী হল?’ ফেলুদা গভীর উৎকণ্ঠার সুরে বলল।
‘আর বোল না! বুড়ো বয়সের যত বিদ্ঘুটে ব্যারাম। আরথ্রাইটিস। হাতটা কাঁধের উপর তুলতেই পারি না।’
শেষকালে ফেলুদা নিজেই এগিয়ে গিয়ে তাক থেকে চীনে মাটির পাত্রটা নামিয়ে নিয়ে হাতে করে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে বার দু-এক ‘সুপার্ব’ বলে আবার যথাস্থানে রেখে দিল।
‘ভদ্রলোকের সত্যিই হাত ওঠে কিনা সেটা যাচাই করা দরকার ছিল’, রাস্তায় এসে বলল ফেলুদা।
‘ধন্যি মশাই আপনার মস্তিষ্ক! বলুন, এবার কোন্দিকে?’
‘বলতে সংকোচ হচ্ছে। এবার একেবারে কর্ণওয়ালিস স্ট্রীট।’
‘কেন, সংকোচের কী আছে?’
‘যা দাম হয়েছে আজকাল পেট্রোলের।’
‘আরে মশাই, দাম ত সব কিছুরই বেশি। আমার যে বই ছিল পাঁচ টাকা সেটা এখন এইট রুপীজ। অথচ সেল একেবারে স্টেডি। আপনি ওসব সংকোচ-টংকোচের কথা বলবেন না।’
কর্ণওয়ালিস স্ট্রীটের নতুন থিয়েটার নবরঙ্গমঞ্চে গিয়ে হাজির হলাম। প্রোপ্রাইটারের নাম অভিলাষ পোদ্দার। ফেলুদা কার্ড পাঠাতেই তৎক্ষণাৎ আমাদের ডাক পড়ল। দোতলার আপিস ঘরে ঢুকলাম গিয়ে।
‘আসুন আসুন, কী সৌভাগ্য আমার, স্বনামধন্য লোকের পায়ের ধুলো পড়ল এই গরীবের ঘরে!’
নাদুস নুদুস বার্নিশ করা চেহারাটার সঙ্গে এই বাড়িয়ে কথা বলাটা বেশ মানানসই। হাতে সোনার ঘড়ি, ঠোঁট দুটো টুকটুকে লাল—এই সবে একখিলি পান পুরেছেন মুখে, গা থেকে ভুরভুরে আতরের গন্ধ।
ফেলুদা লালমোহনবাবুকে আলাপ করিয়ে দিল ‘গ্রেট থ্রিলার রাইটার’ বলে।
‘বটে?’ বললেন পোদ্দারমশাই।
‘একটা হিন্দি ফিল্ম হয়ে গেছে আমার গল্প থেকে’, বললেন জটায়ু। ‘বোম্বাইয়ের বোম্বেটে। নাটকও হয়েছে একটা গল্প থেকে। গড়পারের রিক্রিয়েশন ক্লাব করেছিল সেভেনটি এইটে।’
ফেলুদা বলল, ‘আপনার জায়ান্ট অমনিবাস একটা পাঠিয়ে দেবেন না মিস্টার পোদ্দারকে।’
‘সার্টেনলি, সার্টেনলি’, বললেন মিঃ পোদ্দার। ‘আমি নিজে অবিশ্যি বই-টই পড়ি না, তবে আমার মাইনে করা লোক আছে। তারা পড়ে ওপিনিয়ন দেয় আমাকে। তা বলুন মিঃ মিত্তির, আপনার কী কাজে লাগতে পারি।’
‘আপনাদের একটি হিরো সম্বন্ধে ইনফরমেশন চাই।’
‘হিরো? মানস ব্যানার্জি?’
‘অচিন্ত্য হালদার।’
‘অচিন্ত্য হালদার? কই সেরকম নামে ত—ও হো, হ্যাঁ হ্যাঁ, ওই নামে একটি ছেলে ঘোরাঘুরি করছে বটে। একটা বইয়ে একটা পার্টও করেছিল। চেহারা মোটামুটি ভালো, তবে ভয়েসে গণ্ডগোল। বরং সিনেমা লাইনে কিছু হতে পারে। আমি সেই কথাই বলেছি তাকে। ইন ফ্যাক্ট, ছেলেটি আমাকে টাকা অফার করেছে।’
‘মানে? হিরোর ,পার্ট পাবার জন্য?’
‘আপনি আকাশ থেকে পড়লেন যে। এরকম হয় মিঃ মিত্তির।’
‘আপনি আমল দেননি?’
‘নো মিঃ মিত্তির। আমাদের নতুন কোম্পানি, এসব ব্যাপার খুব রিস্কি।
এ প্রস্তাবে রাজি হবার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। ইয়ে—চা, কফি…?’
‘নো, থ্যাঙ্কস।’
আমরা উঠে পড়লাম। দেড়টা বাজে, পেটে বেশ চন্চনে খিদে।
রয়েল হোটেলে খাবারের অর্ডার দিয়ে ফেলুদা চন্দনা চুরির ব্যাপারে একটা বিজ্ঞাপনের খসড়া করে ফেলল। ওর চেনা আছে খবরের কাগজের আপিসে; সম্ভব হলে কালকে না হয় লেটেস্ট পরশু কাগজে বেরিয়ে যাবে। গত দশ দিনের মধ্যে নিউ মার্কেটে তিনকড়িবাবুর দোকানে কেউ যদি একটা চন্দনা বিক্রী করে থাকেন, তাহলে তিনি যেন নিম্নলিখিত ঠিকানায়, ইত্যাদি।
বিরিয়ানি খেতে খেতে একটা নলী হাড় কামড় দিয়ে ভেঙে ম্যারোটা মুখে পুরে ফেলুদা বলল, ‘রহস্য যেরকম উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে, কোথাকার জল কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় বলা মুশকিল।’
‘দাঁড়ান দাঁড়ান, দেখি গেস্ করতে পারি কিনা’, বললেন লালমোহনবাবু, ‘এই নতুন রহস্য হচ্ছে—সেই লোক চিঠি নিয়ে আসবে বলে এল না কেন, এই ত?’
‘ঠিক ধরেছেন। আমার মতে এর মানে একটাই। সে লোক চিঠিটা পাবে বলে আশা করেছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত পায়নি।’
আমি বললাম, ‘তার মানে যে চুরি করেছে সে নয়, অন্য লোক।’
‘তাইত মনে হচ্ছে।’
‘ওরেব্বাস’, বললেন লালমোহনবাবু, ‘তার মানে ত একজন ক্রিমিন্যাল বাড়ল।’
‘আচ্ছা ফেলুদা’—এ প্রশ্নটা কদিন থেকেই আমার মাথায় ঘুরছে—’পেপারওয়েট দিয়ে মাথায় মারলে লোক মরবেই এমন কোনো গ্যারান্টি আছে কি?’
‘গুড কোয়েশ্চেন’, বলল ফেলুদা। ‘উত্তর হচ্ছে, না নেই। তবে এক্ষেত্রে যে মেরেছে তার হয়ত ধারণা ছিল মরবেই।’
‘কিম্বা অজ্ঞান করে জিনিসটা নিতে চেয়েছিল; মরে যাবে ভাবেনি।’
‘রয়েলের খাওয়া যে ব্রেন টনিকের কাজ করে সেটাত জানতাম না। তুই ঠিক বলেছিস তোপ্সে। সেটাও একটা পসিব্ল ব্যাপার। কিন্তু সেগুলো জানলেও যে এ ব্যাপারে খুব হেল্প হচ্ছে তা ত নয়। যে লোকটাকে দরকার সে এমন আশ্চর্য ভাবে গা ঢাকা দিয়েছে যে ঘটনাটা প্রায় অসম্ভবের পর্যায়ে পড়ে।’
অবিশ্যি ভ্যানিশ যে করেনি সে লোক সেটা সন্ধেবেলা জানতে পারলাম, আর সেটা ঘটল বেশ নাটকীয় ভাবে।
সেটা বলার আগে জানানো দরকার যে সাড়ে চারটের সময় হাজরা ফোন করে জানালেন বারাসতে সাধন দস্তিদারের কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি।
লালমোহনবাবু হোটেল থেকে আর বাড়ি ফেরেননি। আমাদের পৌঁছে দিয়ে আমাদের এখানেই রয়ে গিয়েছিলেন। সাড়ে সাতটার সময় শ্রীনাথ আমাদের কফি এনে দিয়েছে, এমন সময় কলিং বেল বেজে উঠল। শীতকালের সন্ধে, পাড়াটা এর মধ্যেই নিঝুম, তাই বেলের শব্দে বেশ। চমকে উঠেছিলাম।
দরজা খুলে আরো এক চমক।
এসেছেন হৃষিকেশবাবু।
‘কিছু মনে করবেন না—অসময়ে খবর না দিয়ে এসে পড়লাম—আমাদের টেলিফোনটা ফাঁকা পাওয়া যাচ্ছে না মিঃ হালদারের মৃত্যুর পর থেকেই…’
শ্রীনাথকে বলতে হয় না, সে নতুন লোকের গলা পেয়েই আরেক কাপ কফি দিয়ে গেল।
ফেলুদা বলল, ‘আপনাকে বেশ উত্তেজিত মনে হচ্ছে। বসে ঠাণ্ডা হয়ে কী ঘটনা বলুন।’
হৃষিকেশবাবু কফিতে একটা চুমুক দিয়ে দম নিয়ে বললেন, ‘আপনি আমার একতলার ঘরটা দেখেননি, তবে আমি বলতে পারি ও ঘরটায় থাকতে বেশ সাহসের দরকার হয়। অতবড় বাড়ির একতলায় আমি একমাত্র বাসিন্দা। চাকরদের আলাদা কোয়ার্টারস আছে। এ ক’বছরে অভ্যেস খানিকটা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু পুরোপুরি হয় না। সন্ধে থেকে গাটা কেমন ছমছম করে। যাই হোক, কাল রাত্তিরে, তখন সাড়ে দশটা হবে, আমি খাওয়া সেরে ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে মশারিটা ফেলেছি সবে, এমন সময় দরজায় টোকা পড়ল। সত্যি বলতে কি, নক্ করার লোক ও বাড়িতে কেউ নেই। যারা আমাকে চায় তারা বাইরে থেকে হাঁক দেয়—এমন কি চাকর-বাকরও। কাজেই বুঝতেই পারছেন, আমার মনে বেশ একটু খট্কা লাগল। খোলার আগে জিজ্ঞেস করলুম, কে? উত্তরের বদলে আবার টোকা পড়ল। একবার ভাবলুম খুলব না। কিন্তু সারারাত যদি ওই ভাবে খট্খট্ চলে তাহলে ত আরো গণ্ডগোল। তাই কোনোরকমে সাহস সঞ্চয় করে যা থাকে কপালে করে দরজাটা খুললুম; খোলামাত্র একটি লোক ঢুকে এসে দরজাটা বন্ধ করে দিল। তখনও মুখ দেখিনি; তারপর আমার দিকে ফিরতে চাপ দাড়ি দেখে আন্দাজ করলুম কে। ভদ্রলোক আমাকে কোন কথা বলতে না দিয়ে সোজা গড়গড় করে তাঁর কথা বলে গেলেন এবং যতক্ষণ বললেন ততক্ষণ তাঁর ডান হাতে একটি ছোরা সোজা আমার দিকে পয়েন্ট করা।’
বর্ণনা শুনে আমারই ভয় করছিল। লালমোহনবাবুর দেখলাম মুখ হাঁ হয়ে গেছে।
‘কী বললেন সাধন দস্তিদার?’ প্রশ্ন করল ফেলুদা।
‘সাংঘাতিক কথা’, বললেন হৃষিকেশবাবু। ‘মিঃ হালদারের কালেকশনে কী জিনিস আছে তা যেমন মোটামুটি আমি জানি, তেমনি ইনিও জানেন। বললেন বাহাদুর শা-র যে পান্না বসানো সোনার জর্দার কৌটোটা মিঃ হালদারের সংগ্রহে রয়েছে, সেটার একজন ভালো খদ্দের পাওয়া গেছে, সেটা তার চাই। আমি যেন আজ রাত্তিরে এগারোটার সময় মধুমুরলীর দিঘির ধারে ভাঙা নীলকুঠির পাশে শ্যাওড়া গাছটার নিচে ওয়েট করি—ও এসে নিয়ে যাবে।’
‘এই যে কাজটা করতে বলেছে তার জন্য আপনার পারিশ্রমিক কী?’
‘কচু পোড়া। এতো হুমকির ব্যাপার। বললে যদি পুলিশে খবর দিই তাহলে নির্ঘাৎ মৃত্যু।’
‘রাত্তিরে দারোয়ান গেটে থাকে না?’
‘থাকে বৈকি, কিন্তু আমার ধারণা হয়েছে লোকটা পাঁচিল টপকে আসে।’
‘আপনার ঘর চিনল কি করে?’
‘সাধু দস্তিদারও ত ওই ঘরেই থাকত—চিনবে না কেন?’
‘ভদ্রলোকের ডাক নাম সাধু ছিল বুঝি?’
‘মিঃ হালদারকে ত সেই নামই বলতে শুনেছি!’
‘আপনি তাকে কী বললেন?’ জিজ্ঞেস করল ফেলুদা।
‘আমি বললুম, এখন মিঃ হালদারের জিনিসপত্রে কড়া পাহারা, সে কৌটো আমি নেব কি করে? সে বললে, চেষ্টা করলেই পারবে। তুমি মিঃ হালদারের সেক্রেটারি ছিলে; জরুরী কাগজপত্র দেখার জন্য তোমার সে ঘরে ঢোকার সম্পূর্ণ অধিকার আছে; ব্যস্—এই বলেই সে চলে গেল। আমি জানি আপনি ছি ছি করবেন, বলবেন পুলিশে খবর দেওয়া উচিত ছিল, অন্তত বাড়ির লোককে জানানো উচিত ছিল। কিন্তু প্রাণের ভয়ের মতো ভয় আর কী আছে বলুন। আপনার কথাটাই মনে হল। আপনিও যে তদন্ত করছেন সেটা আমার মনে হয় সাধু জানে না।’
‘আপনি তাহলে কৌটো বার করেননি।’
‘পাগল!’
‘আপনি কি প্রস্তাব করছেন যে আমরা সেখানে যাই?’
‘আপনারা যদি একটু আগে গিয়ে গা ঢাকা দিয়ে থাকেন—আমি গেলাম এগারোটায়—তারপর সে এলে যা করার দরকার সে ত আপনিই ভালো বুঝবেন। এইভাবে হাতেনাতে লোকটাকে ধরার সুযোগ ত আর পাবেন না।’
‘পুলিশকে খবর দেব না বলছেন?’
‘অমন সর্বনাশের কথা উচ্চারণ করবেন না, দোহাই। আপনি আসুন, সঙ্গে এঁদেরও নিতে পারেন। তবে সশস্ত্র অবস্থায় যাবেন, কারণ লোকটা ডেঞ্জারাস।’
‘লেগে পড়ুন’, বিনা দ্বিধায় বললেন লালমোহনবাবু। ‘রাজস্থানের ডাকাত যখন আমাদের পেছু হটাতে পারেনি, তখন এর কাছে কী ভয়? এতো নস্যি মশাই।’
‘আমি অবিশ্যি জায়গাটা দেখিয়ে দেব’, বললেন হৃষিকেশবাবু; ‘মেন রোড ছেড়ে খানিকটা ভেতর দিকে যেতে হয়। স্টেশন থেকে মাইল চারেক।’
ফেলুদা রাজি হয়ে গেল। হৃষিকেশবাবু কফি শেষ করে উঠে পড়ে বললেন, ‘দশটা নাগাদ তাহলে আপনারা মীট করছেন আমাকে।’
‘কোথায়?’
‘আমাদের বাড়ি ছাড়িয়ে দু ফার্লং গেলেই একটা তেমাথার মোড় পাবেন। সেখানে দেখবেন একটা মিষ্টির দোকান। সেই দোকানের সামনে থাকব আমি।’
রাত্রে বিশেষ ট্রাফিক নেই
রাত্রে বিশেষ ট্র্যাফিক নেই, তাও এক ঘণ্টা হাতে নিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। খাওয়াটা বাড়িতেই সেরে নিলাম। এত তাড়াতাড়ি খাওয়া অভ্যেস নেই আমাদের; লালমোহনবাবু বললেন, ‘খিদে পেলে ওই মিষ্টির দোকানে ঢুকে পড়া যাবে। কচুরি আর আলুর তরকারি নির্ঘাৎ পাওয়া যাবে।’
একটা সুবিধে এই যে লালমোহনবাবুর ড্রাইভার হরিপদবাবু ফেলুদার ভীষণ ভক্ত। তার উপর বোম্বাই মার্কা ফাইটিং-এর ছবি দেখার সুযোগ ছাড়েন না কখনো। এরকম না হলে রাতবিরেতে বারাসতে ঠ্যাঙাতে অনেক ড্রাইভারই গজগজ করত; ইনি যেন নতুন লাইফ পেলেন।
ভি আই পি রোডে পড়ে লালমোহনবাবু গান ধরেছিলেন—’জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে’, কিন্তু ফেলুদা তাঁর দিক চাইতে অমাবস্যায় গানটা বেমানান হচ্ছে বুঝতে পেরে থেমে গেলেন।
আকাশে এক টুকরো মেঘ নেই। তারার আলো বলে একটা জিনিস আছে, সেটা হয়ত আমাদের কিছুটা হেল্প করতে পারে। ফেলুদার ফরমাশ অনুযায়ী গাঢ় রঙের জামা পরেছি। লালমোহনবাবুর পুলোভারটা ছিল হলদে, তাই তার উপর ফেলুদার রেনকোটটা চাপিয়ে নিয়েছেন। ভদ্রলোক এখন গাড়িতে বসা; যখন হাঁটবেন তখন একটা পকেট ভীষণ ঝুলে থাকবে, কারণ তাতে ভরা আছে একটা হামানদিস্তার লোহার ডাণ্ডা। ওয়েপন হিসেবে ব্যবহার করার জন্য ভদ্রলোক ওটা চেয়ে নিয়েছেন শ্রীনাথের কাছে। ফেলুদার পকেটে অবশ্য রয়েছে তার কোল্ট রিভলভার।
আমাদের আন্দাজ ভুল হয়নি; দশটার কিছু আগে আমরা তেমাথায় পৌঁছে গেলাম। মিষ্টির দোকানের পাশেই একটা পানের দোকান—তার সামনে থেকে হৃষিকেশবাবু এগিয়ে এসে আমাদের গাড়িতে উঠে হরিপদবাবুকে বললেন, ‘ডাইনের রাস্তাটা নিন।’
খানিক দূর যেতেই বাড়ি কমে এল। আলোও বেশি নেই; রাস্তায় যা আলো ছিল তাও ফুরিয়ে গেল বাঁয়ে মোড় নিতে। বুঝলাম এটা প্রায় পল্লীগ্রাম অঞ্চল। ‘বারাসতেই ছিল প্রথম নীলকুঠি।’ বললেন হৃষিকেশবাবু। ‘এদিকটাতে এককালে অনেক সাহেব থাকত; দিনের আলোয় তাদের সব ভাঙা বাগানবাড়ি দেখতে পেতেন।’
মিনিট কুড়ি চলার পর একটা জায়গায় এসে গাড়ি দাঁড় করাতে বললেন হৃষিকেশবাবু।
‘আসুন।’
গাড়ি থেকে নামলাম চার জনে। ‘গাড়িটা এখানেই ওয়েট করুক’, বললেন হৃষিকেশবাবু, ‘আমি আপনাদের জায়গাটা দেখিয়ে দিয়ে আসি, তারপরে এই গাড়িই আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আবার ফিরে আসবে। আমি সাইকেল রিকশা করে ঠিক এগারোটার সময় চলে আসব।’
লালমোহনবাবু হরিপদবাবুকে টাকা দিয়ে বললেন, ‘তুমি এঁকে পৌঁছে দিয়ে ফেরার সময় কোনো দোকানটোকান থেকে খাওয়াটা সেরে নিও। ফিরতে রাত হবে আমাদের।’
ঘাসের উপর দিয়ে মিনিট পাঁচেক হাঁটতে একটা জংলা জায়গা এসে পড়ল।
‘এখানেই ছিল মধুমুরলীর দিঘি’, বললেন হৃষিকেশবাবু। ‘আমাদের যেতে হবে ওইখানটায়।’
খুবই কম আলো, কিন্তু তাও বুঝতে পারছি যে গাছপালা ছাড়াও ওদিকে একটা দালানের ভগ্নস্তূপ রয়েছে। শীতকাল বলে রক্ষে, না হলে এ জায়গাটা হত সাপ ব্যাঙের ডিপো!
‘এখন টর্চের আলোটা বোধহয় তেমন বিপজ্জনক কিছু নয়,’ বলল ফেলুদা।
‘মনে ত হয় না,’ বললেন হৃষিকেশবাবু।
ছোট্ট পকেট টর্চের আলোতে ঝোপঝাড় খানাখন্দ বাঁচিয়ে আমরা পৌঁছে গেলাম নীলকুঠির ভগ্নস্তূপের পাশে।
‘ওই যে দেখুন শ্যাওড়া গাছ’, বললেন হৃষিকেশবাবু! ফেলুদা সেদিকে একবার টর্চ ফেলে সেটা নিবিয়ে পকেটে পুরল।
‘আমি তাহলে আসি।’
‘আসুন।’
‘তিন কোয়ার্টার আপনাদের একটু অপেক্ষা করতে হবে।’
আমরা যেদিক দিয়ে এসেছিলাম সেদিক দিয়েই চলে গেলেন হৃষিকেশবাবু। এক মিনিটের মধ্যেই তাঁর পায়ের আওয়াজ মিলিয়ে গেল।
‘ওডোমসটা লাগিয়ে নিন।’
ফেলুদা পকেট থেকে টিউব বার করে লালমোহনবাবুর দিকে এগিয়ে দিল।
‘যা বলেছেন মশাই। ম্যালেরিয়া শুনছি আবার খুব বেড়েছে।’
আমরা তিন জনেই ওডোমস লাগিয়ে নিয়ে একটা বড়রকম দম নিয়ে অপেক্ষার জন্য তৈরি হলাম। আমাদের কাউকেই দাঁড়াতে হবে না, কারণ ভগ্নস্তূপে নানান হাইটের ইটের পাঁজা রয়েছে, তাতে চেয়ার চৌকি মোড়া সব কিছুরই কাজ হয়। কথা বলতে হলে ফিস্ফিস্ ছাড়া গতি নেই, তাও প্রথম দিকটায়। পরের দিকে কমপ্লীট মৌনী। অন্ধকারে চোখ সয়ে গেছে, এখন চারিদিকে চাইলে বট, অশ্বথ, আমগাছ, বাঁশঝাড়—এসব বেশ তফাৎ করা যায়। ঝিঁঝির শব্দ ছাড়াও যে অন্য শব্দ আছে সেটা বেশ বুঝতে পারছি। ট্রেনের আওয়াজ, সাইকেল রিকশার চড়া হর্ন, রাস্তার কুকুরের ঘেউ ঘেউ, এমনকি দূরের কোনো বাড়ি থেকে ট্রানজিস্টারের গান পর্যন্ত। ফেলুদার ঘড়িতে রেডিয়াম ডায়াল, তাই অন্ধকারেও টাইম দেখতে পারে।
শীত যেন মিনিটে মিনিটে বাড়ছে। শহরের চেয়ে নির্ঘাৎ পাঁচ সাত ডিগ্রী কম। লালমোহনবাবু তাঁর টুপি আনেননি, রুমাল সাদা, তাই সেটা বাঁধলেও চলে না; নিরুপায় হয়ে দু’ হাতের তেলো দিয়ে টাক ঢেকেছেন। একবার মুখ দিয়ে একটা অস্ফুট শব্দ করাতে ফেলুদা বলল, ‘কিছু বললেন?’ তাতে ভদ্রলোক ফিস্ফিস্ করে জবাব দিলেন, ‘শ্যাওড়া গাছেই বোধহয় পেত্নী না শাঁকচুন্নি কী যেন থাকে।’
‘শ্যাওড়া গাছের নামই শুনেছি,’ ফিস্ফিসিয়ে বলল ফেলুদা, ‘চোখে এই প্রথম দেখলাম।’
আকাশে তারাগুলো সরছে। একটু আগে একটা তারাকে দেখেছিলাম নারকোল গাছের মাথার উপরে, এখন দেখছি গাছটায় ঢাকা পড়ে গেছে। কোনো চেনা কনস্টেলেশন আছে কিনা দেখার জন্য মাথাটা উপর দিকে তুলেছি, এমন সময় একটা শব্দ কানে এল। পায়ের শব্দ।
এগারোটা বাজেনি এখনো। ফেলুদা দু মিনিট আগে ঘড়ি দেখে ফিস্ফিস্ করে বলেছে, ‘পৌনে।’
আমরা পাথরের মতো স্থির।
যেদিক দিয়ে এসেছি, সেদিক দিয়েই আসছে শব্দটা। ঘাসের উপর মাঝে মাঝে ইট পাটকেল রয়েছে, তার জন্যই শব্দ। তাও কান না পাতলে, আর অন্য শব্দ না কমলে শোনা যায় না। এখন ঝিঁঝির ডাক ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই।
এবার লোকটাকে দেখা গেল। সে এগিয়ে এসেছে শ্যাওড়া গাছটাকে লক্ষ করে।
এবারে তার হাঁটার গতি কমাল। আমরা মাটিতে ঘাপটি মেরে বসা, সামনে একটা ভাঙা পাঁচিল আমাদের শরীরের নীচের অংশটা ঢেকে রেখেছে। আমরা তার উপর দিয়ে দেখছি।
‘হৃষিকেশবাবু—’
লোকটা চাপা গলায় ডাক দিয়েছে। হাঁটা থামিয়ে। তার দৃষ্টি যে শ্যাওড়া গাছটার দিকে সেটা মাথাটা দেখে আন্দাজ করতে পারছি, যদিও মানুষ চেনার কোনো প্রশ্ন ওঠে না।
‘হৃষিকেশবাবু—’
ফেলুদা ওঠার জন্য তৈরি। তার শরীর টান সেটা বেশ বুঝতে পারছি। লোকটা ধীরে ধীরে এগিয়ে আসতে শুরু করল।
লালমোহনবাবুর ডান কনুইটা উঁচিয়ে উঠেছে। উনি পকেট হাতড়াচ্ছেন হামানদিস্তাটার জন্য।
লোকটা এখন দশ হাতের মধ্যে।
‘হৃষিকেশ—’
ফেলুদা বাঘের মতো লাফিয়ে উঠতেই একটা রক্ত জল করা ব্যাপার ঘটে গেল।
আমাদের পিছন থেকে দুটো লোক এসে তার উপর হুমড়ি খেয়ে পড়েছে।
ফেলুদার সঙ্গে থেকেই বোধহয় আমার নার্ভও শক্ত হয়ে গেছে। চট করে বিপদে মাথা গুলোয় না। আমি তৎক্ষণাৎ লাফিয়ে উঠে ঝাঁপিয়ে পড়লাম সামনের দিকে। ফেলুদার ঘুঁষি খেয়ে একটা লোক আমারই দিকে ছিটকে এসেছিল। আমি তাকে লক্ষ করে আরেকটা ঘুঁষি চালাতে সে হুমড়ি খেয়ে পড়ল ঘাসের উপর।
কিন্তু এ কি, আরো লোক এসে পড়েছে পিছন থেকে! তার মধ্যে একটা আমায় জাপটে ধরেছে, আরো দুটো গিয়ে আক্রমণ করেছে ফেলুদাকে। ধস্তাধস্তির শব্দ পাচ্ছি। কিন্তু আমি নিজে বন্দী, যদিও তারই। মধ্যে জুতো পরা ডান পাটা দিয়ে ক্রমাগত পিছন দিকে লাথি চালাচ্ছি।
লালমোহনবাবু কী করছেন এই চিন্তাটা মাথায় আসতেই থুৎনিতে একটা বিরাশি শিক্কা ঘা খেলাম, আর সঙ্গে সঙ্গে চারিদিকের অন্ধকার যেন আরো দশ গুণ গাঢ় হয়ে গেল।
তারপর আর কিছু জানি না।
‘কিরে, ঠিক হ্যায়?’
ফেলুদার চেহারাটাই প্রথম দেখতে পেলাম জ্ঞান হয়ে।
‘ঘাবড়াসনি, আমিও নক-আউট হয়ে গেসলাম দশ মিনিটের জন্য।’
এবারে দেখলাম ঘরের অন্য লোকেদের। অমিতাভবাবু তাঁর পাশে একজন মহিলা—নিশ্চয়ই তাঁর স্ত্রী—লালমোহনবাবু, হৃষিকেশবাবু, আর দরজার মুখে দাঁড়িয়ে অচিন্ত্যবাবু। এ ঘরটা আগে দেখিনি; বাড়ির বত্রিশটা ঘরের কোনো একটা হবে।
আমি বিছানায় উঠে বসলাম। একটা কন্কনে ব্যথা থুৎনির কাছটায়। তাছাড়া আর কোনো কষ্ট নেই। ফেলুদা ঘুঁষিটা খেয়েছিল ডান চোখের নীচে সেটা কালসিটে দেখেই বোঝা যাচ্ছে। ব্ল্যাক-আই ব্যাপারটা অনেক বিদেশী ছবিতে দেখেছি; স্বচক্ষে এই প্রথম দেখলাম।
‘একমাত্র জটায়ুই অক্ষত’, বলল ফেলুদা।
সেকি। আশ্চর্য ব্যাপার ত!—’কী করে হল?’
‘মোক্ষম ওয়েপন ওই হামানদিস্তা’, বললেন লালমোহনবাবু, ‘হাতে নিয়ে মাথার উপর তুলে হেলিকপটারের মত বাঁই বাঁই করে ঘুরিয়ে গেলাম। আমার ধারে কাছেও এগোয়নি একটি গুণ্ডাও।’
‘ওরা গুণ্ডা ছিল বুঝি?’
‘হায়ার্ড গুণ্ডাজ’, বললেন লালমোহনবাবু।
‘বললাম লোকটা ডেঞ্জারাস’, বললেন হৃষিকেশবাবু। ‘তবে ও যে এতটা করবে তা ভাবিনি। আমি ত গিয়ে অবাক। একজন শোয়া একজন বসা একজন হুমড়ি খেয়ে পড়ে মাটিতে। আর আসল যে লোক সে হাওয়া।’
ফেলুদা আর লালমোহনবাবু নাকি আমাকে ধরাধরি করে গাড়িতে এনে তোলেন। অমিতাভবাবু নিজে বেশ রাত অবধি পড়েন, তাই উনি জেগে ছিলেন। যে ঘরটায় আমরা রয়েছি সেটা একতলার একটা গেস্টরুম। বেশ বড় ঘর, পাশেই বাথরুম। পুবে জানালা দিয়ে নাকি বাগান দেখা যায়। অমিতাভবাবুই জোর করলেন আজ রাতটা এখানে থাকার জন্য। অসুবিধা এই যে বাড়তি কাপড় নেই, যা পরে আছি তাই পরেই শুতে হবে। ‘হৃষিকেশবাবুর ভয়ের জন্যই এই গোলমালটা হল’, বললেন অমিতাভবাবু, ‘পুলিশকে বলা থাকলে সাধু সমেত গুণ্ডারা এতক্ষণে হাজতে।’
হৃষিকেশবাবুও অবিশ্যি অ্যাপলজাইজ করলেন। কিন্তু ভদ্রলোককেই বা দোষ দেওয়া যায় কি করে?, ওরকম শাসানির পর যে কোনো মানুষেরই ভয় হতে পারে।
অমিতাভবাবুর স্ত্রীই সব ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। বললেন, ‘বাড়িতে এইদুর্যোগ, আপনাদের সঙ্গে বসে দু’ দণ্ড কথা বলারও সুযোগ হল না। এনার এত বই আমি পড়েছি— কী যে আনন্দ পাই তা বলতে পারি না।’
শেষের কথাটা অবিশ্যি লালমোহনবাবুকে উদ্দেশ্য করে বলা।
ফেলুদা বলল, ‘কাল সকালে যাবার আগে আপনার ছেলের সঙ্গে একবার কথা বলে নেব। ঘরে চোর ঢোকার পরেও ও যা সাহস দেখিয়েছে তেমন সচরাচর দেখা যায় না।’
সাড়ে বারোটা নাগাদ যখন আমরা শোবার আইয়োজন করছি তখন ফেলুদা একটা কথা বলল।
‘ঘুঁষিটাও যে ব্রেন টনিকের কাজ করে সেটা আজ প্রথম জানলাম।’
‘কিরকম?’ বললেন লালমোহনবাবু।
‘সাধুবাবু ভ্যানিশ করার ব্যাপারটা বুঝতে পারছি এতদিনে।’
‘বলেন কি!’
‘তুখোড় লোক। তবে যার সঙ্গে মোকাবিলা করছে সেও ত কম তুখোড় নয়!’
এর বেশি আর ফেলুদা কিছু বলল না।
এ বি সি ডি – এশিয়া’জ বেস্ট ক্রাইম ডিটেক্টর
অনিরুদ্ধ সকালে স্কুলে যায়, তাই চা খাবার আগেই ফেলুদা ওর সঙ্গে দেখা করে নিল।
চোর ঢোকার কথাটা আজ শুনে মনে হল ছেলেটি বেশিরকম কল্পনাপ্রবণ। পরপর দুবার! একটু বাড়াবাড়ি বলে মনে হল। ফেলুদা বলল, ‘তুমি যে বন্দুকটা দিয়ে চোরকে মারবে ঠিক করেছিলে সেটাত আমাকে দেখালে না। শুনলাম তোমার ছোটকাকাকে দেখিয়েছ।’
অনিরুদ্ধ বন্দুকটা বার করে ফেলুদার হাতে দিয়ে বলল, ‘এটা থেকে আগুনের ফুলকি বেরোয়।’
লাল প্লাস্টিকের তৈরি মেশিনগান, ট্রিগার টিপলে মেশিনগানের মতো শব্দের সঙ্গে নলের মুখ দিয়ে সত্যিই স্পার্ক বেরোয়।
ফেলুদা বন্দুকটা নিয়ে নেড়ে চেড়ে দেখে সেটার খুব তারিফ করে ফেরত দিয়ে বলল, ‘তোমার যে ঘুমের ব্যাঘাত হচ্ছে, দেখা যাক সেটা বন্ধ করা যায় কিনা।’
‘তুমি চোর ধরে দেবে?’
‘গোয়েন্দার ত ওই কাজ।’
‘আর আমার চন্দনা যে চুরি করেছে সেই চোর?’
‘সেটারও চেষ্টা চলেছে, তবে কাজটা খুব সহজ নয়।’
‘খুব শক্ত?’
‘খুব শক্ত।’
‘দারুণ রহস্য?’
‘দারুণ রহস্য।’
‘আর সেদিন যে বললে খাঁচার দরজায় রক্ত লেগে আছে?’
‘ওটাইত ভরসা। ওটাইত ক্লু।’
‘ক্লু মানে?’
‘ক্লু হল যার সাহায্যে গোয়েন্দা দুষ্ট লোককে জব্দ করে।’
লালমোহনবাবু হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন, ‘আচ্ছা, তোমার পাখিকে কথা বলতে শুনেছ?
‘হ্যাঁ,’ বলল অনিরুদ্ধ। ‘আমি ঘরে ছিলাম, আর শুনলাম পাখিটা কথা বলছে।’
‘কী কথা?’
‘বলছে ‘দাদু ভাত খান, দাদু ভাত খান।’ আমি তক্ষুণি বেরিয়ে এলাম কিন্তু তারপর আর কিছু বলল না।’
লালমোহনবাবুর মুখে হাসি। অনিরুদ্ধ শুনেছে দাদু ভাত খান আর লালমোহনবাবু শুনেছেন বাবু সাবধান। মানতেই হয় দুটো খুব কাছাকাছি। পাখি নিশ্চয়ই ওই ধরনেরই কিছু বলছিল।
‘আপনার এখানে পাখি ধরতে পারে এমন কেউ আছে?’ ফেলুদা অমিতাভবাবুকে জিজ্ঞেস করল।
‘আমাদের মালির ছেলে আছে, শঙ্কর’, বললেন অমিতাভবাবু। ‘এর আগে দু-একবার ধরেছে পাখি। খুব চালাকচতুর ছেলে।’
‘তাকে বলবেন একটু চোখ রাখতে। খুব সম্ভব চন্দনাটা আপনাদের বাগানেই রয়েছে।’
বারাসতে থাকতেই দেখেছিলাম যে খবরের কাগজে চন্দনার বিষয় বিজ্ঞাপনটা বেরিয়েছে। সেটার কাজ যে এত তাড়াতাড়ি হবে তা ভাবতে পারিনি।
বারোটা নাগাদ একটি বছর পঁচিশের ছেলে আমাদের বাড়িতে এসে হাজির। বেশ চোখাচোখা চেহারা, পরনে জীন্স আর মাথার চুলের কপাল-ঢাকা কায়দা দেখলেই বোঝা যায় ইনি হালফ্যাসানের তরুণ।
ফেলুদা বসতে বুলাতে ভদ্রলোক মাথা নেড়ে বললেন, ‘বসব না। আজ একটা ইন্টারভিউ আছে। ইয়ে, আমি আসছি ঐ পাখির ব্যাপারে কাগজে যে বিজ্ঞাপনটা দিয়েছেন সেইটে দেখে।’
‘ওটা আপনাদের পাখি ছিল?’
‘আমাদের মানে আমার দাদুর। দাদু মারা গেছেন লাস্ট মান্থ। তাই বাবা ওটাকে বেচে দিলেন। ওটার দেখাশুনা দাদুই করতেন। বাবা কোর্ট কাচারি করেন, মা বাতে ভোগেন, আর আমার ওসবে ইন্টারেস্ট নেই।’
‘কদ্দিন ছিল আপনাদের বাড়ি?’
‘তা বছর দশেক। দাদুর খুব পিয়ারের চন্দনা ছিল।’
‘কথা বলত?’
‘হ্যাঁ। দাদুই শিখিয়েছিলেন। খুব রসিক মানুষ ছিলেন। অদ্ভুত অদ্ভুত কথা শিখিয়েছিলেন।’
‘অদ্ভুত মানে?’
‘এই যেমন—দাদুর পাশার নেশা ছিল; পাখিটাকে শিখিয়েছিলেন “কচে বারো” বলতে। তারপর ব্রিজও খেলতেন দাদু। খেলার সময় অপোনেন্টের তাস ভালো বুঝতে পারলে পার্টনারকে একটা কথা খুব বলতেন। সেটা পাখিটা তুলে নিয়েছিল।’
‘কী কথা?’
‘সাধু সাবধান।’
‘ঠিক আছে। অনেক ধন্যবাদ।’
‘আর কিছু—?’
‘না, আর কিছু জানার নেই।’
‘ইয়ে, বিজ্ঞাপন দেখে বুঝতে পারিনি এটা আপনার বাড়ি।’
‘সেটা না বোঝারই কথা।’
‘আপনাকে মীট করে খুব ইয়ে হলাম।’
ঝাড়া পাঁচ ঘণ্টা তার ঘরের দরজা বন্ধ করে বসে থেকে বিকেলে চা খেতে বেরিয়ে এসে ফেলুদা হাজরাকে একটা টেলিফোন করল;
‘কাল সকালে কী করছেন?’
‘কেন বলুন ত?’
‘হালদার বাড়িতে আসতে পারবেন—ন’টা নাগাদ? মনে হচ্ছে রহস্যের কিনারা হয়েছে। তৈরি হয়ে আসবেন।’
লালমোহনবাবুকে টেলিফোনে বলে দেওয়া হল আমরা ট্যাক্সি করে চলে যাব তাঁর বাড়ি সাড়ে আটটায়। সেখান থেকে তাঁর গাড়িতে বারাসত।
‘রহস্য আরো বৃদ্ধি পেল নাকি?’
‘না। সম্পূর্ণ উদঘাটিত।’
সব শেষে অমিতাভবাবুকে ফোন করা হল।
‘আপনাদের বাড়িতে কাল সকালে একটা ছোটখাটো মিটিং করব ভাবছি।’
‘মিটিং?’
‘আপনাদের পুরুষ মেমবার যে কজন আছেন তাঁরা যেন থাকেন। আর হাজরাকে থাকতে বলেছি।’
‘কটায় করতে চাইছেন?’
‘নটায় হাজিরা। আপনার কাজের হয়ত একটু দেরি হতে পারে, কিন্তু ব্যাপারটা জরুরী।’
অমিতাভবাবু রাজি হয়ে গেলেন। —’পুরুষ মেমবার মানে কি অনুকেও চাইছেন?’
‘না। সে না থাকাটাই বাঞ্ছনীয়। এটা শুধু প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য।’
আমরা যখন পৌঁছলাম, তার আগেই হাজরার দল হাজির। ফেলুদা এরকম ধরনের মিটিং এর আগেও করেছে। প্রত্যেকবারই আমার মনের মধ্যে একটা চনমনে ভাব, কারণ জানি না কী হতে চলেছে, কার ভাগ্যে হাতকড়া আছে, কী ভাবে ফেলুদা রহস্যের সমাধান করেছে। লালমোহনবাবু আমাকে বললেন, ‘আমি চিন্তাটাকে স্রেফ অন্য পথে ঘুরিয়ে নিয়েছি। এ ব্যাপারে ব্রেন খাটিয়ে কোনো লাভ নেই, কারণ আমার ঘিলুতে অনেক ভেজাল, তোমার দাদারটা পিওর। নিজের তৈরি রহস্যের সমাধান এক জিনিস, আর অ্যাকচুয়েল লাইফে সমাধান আরেক জিনিস।’
নীচের বৈঠকখানা ঘরে জমায়েত হয়েছি। হৃষিকেশবাবুর দিল্লী যাবার সময় হয়ে এসেছে। বললেন, ‘এ বাড়ি ছেড়ে যেতে পারলে বাঁচি মশাই। কাজ থাকলে তবু একটা কথা। এখন প্রাণ হাঁপিয়ে ওঠে।’
অচিন্ত্যবাবুর সঙ্গে ভালো করে আলাপ হয়নি। তিনি আপত্তি করেছিলেন এই মিটিং-এ উপস্থিত থাকার ব্যাপারে। তাঁর নাকি একটা বড় পার্ট নিয়ে খুব পরিশ্রম করতে হচ্ছে। কালই নাকি নাটকটার প্রথম শো। ভদ্রলোক ফেলুদাকে বললেন, ‘আপনার এ ব্যাপারটা কতক্ষণ চলবে?’
ফেলুদা বলল, ‘খুব বেশি ত আধ ঘণ্টা।’
ভদ্রলোক তাও গজগজ করতে লাগলেন।
কফি খাবার পর ফেলুদা উঠে দাঁড়াল। কালসিটে ঢাকার জন্য ও আজ কালো চশমা পরেছে। এটা ওর একেবারে নতুন চেহারা। হাত দুটোকে প্যান্টের পকেটে পুরে সে আরম্ভ করল তার কথা।
‘পার্বতীচরণের খুনের ব্যাপারে আমাদের যেটা সবচেয়ে অবাক করেছিল সেটা হল সাধন দস্তিদারের অন্তর্ধান। দশটা থেকে সাড়ে দশটার মধ্যে খুনটা হয়। সাধন দস্তিদার পার্বতীবাবুর ঘরে ছিলেন সোয়া দশটা থেকে সাড়ে দশটা পর্যন্ত। সাড়ে দশটায় তাঁকে আমরা ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ির দিকে যেতে দেখেছি; দশটা পঁয়ত্রিশে অনিরুদ্ধর সঙ্গে কথা বলে পার্বতীবাবুর ঘরে গিয়ে আমরা তাঁকে মৃত অবস্থায় দেখি। তৎক্ষণাৎ সাধন দস্তিদারকে খোঁজা হয়, কিন্তু পাওয়া যায় না। দারোয়ান বলে তাঁকে গেট থেকে বেরোতে দেখেনি। বাগানে খোঁজা হয়, সেখানেও পাওয়া যায়নি। কম্পাউণ্ডের যে পাঁচিল, সেটা আট ফুট উঁচু। সেটা টপকানো সহজ নয়, বিশেষ করে হাতে একটা ব্রীফ কেস থাকলে। আমরা—’
এখানে অচিন্ত্যবাবু ফেলুদাকে বাধা দিলেন।
‘সাধনবাবুর আগে যিনি এসেছিলেন তাকে কি আপনি বাদ দিচ্ছেন?’
‘আপনার বাবাকে যেভাবে আঘাত করা হয়েছিল, সেটা শক্ত সমর্থ লোকের পক্ষেই সম্ভব। পেস্টনজীর আরথ্রাইটিস আছে, তিনি ডান হাত কাঁধের উপর তুলতে পারেন না। অবিশ্যি পেস্টনজী ছাড়াও একজন তৃতীয় ব্যক্তি ছিলেন যিনি পেস্টনজী ও সাধনবাবুর ফাঁকে পার্বতীবাবুর ঘরে গিয়ে থাকতে পারেন।’
‘তিনি কে?’
‘আপনি।’
অচিন্ত্যবাবু সোফা ছেড়ে উঠে পড়েছেন।
‘আ—আপনার কি ধারণা আমি—?’
‘আমি শুধু বলেছি আপনার সুযোগ ছিল। আপনি খুন করেছেন সে কথাত বলিনি।’
‘তাও ভালো।’
‘যাই হোক—সাধনবাবুর অন্তর্ধান বিশ্বাসযোগ্য হয় এক যদি দারোয়ান ভুল বা মিথ্যে বলে থাকে। আর দুই, যদি সাধনবাবু এ বাড়ি থেকে না বেরিয়ে থাকেন।’
‘কোনো চোরাকুঠুরিতে আত্মগোপন করার কথা বলছেন?’ হৃষিকেশবাবু প্রশ্ন করলেন।
অমিতাভবাবু বললেন, ‘সে রকম লুকনোর কোনো জায়গা এ বাড়িতে নেই। একতলার অধিকাংশ ঘরই তালাচাবি বন্ধ। এক বৈঠকখানা খোলা, রান্নাঘর ভাঁড়ার ঘর খোলা আর হৃষিকেশবাবুর ঘর খোলা।’
‘এবং সে ঘরে তাকে আমি আশ্রয় দিইনি সেটা আমি বলতে পারি’, বললেন হৃষিকেশবাবু। ‘শুধু তাই নয়, সাধনবাবু যখন আসেন তখন আমি ছিলাম না।’
‘আমরা পোস্টাপিসে খোঁজ নিয়েছি’, বলল ফেলুদা। ‘আপনি টেলিগ্রাম পাঠিয়েছেন পোস্টাপিস খোলার সঙ্গে সঙ্গে। তখন দশটা। পাঁচ মিনিট লেগেছে আপনার টেলিগ্রাম করতে। তারপরেই আপনি—’
‘তারপর আমি যাই ঘড়ির ব্যাণ্ড কিনতে।’
‘দুঃখের বিষয় দোকানের লোক আপনাকে মনে করতে পারছে না।’
‘মিঃ মিত্তির, দোকানের লোকের স্মরণশক্তির উপর নির্ভর করেই কি আপনি গোয়েন্দাগিরি করেন?’
‘না, তা করি না। এবং তাদের কথায় আমরা খুব আমল দিইনি। আর আপনিও যে সত্যি কথা বলছেন সেটা আমরা মানতে বাধ্য নই।’
‘কেন, আমি মিথ্যে বলব কেন?’
‘কারণ সোয়া দশটার সময় আপনারও ত পার্বতীচরণের ঘরে যাবার প্রয়োজন হয়ে থাকতে পারে!’
‘এসব কী বলছেন আপনি? আপনি নিজেই বলছেন সাধনবাবুকে বেরোতে দেখেছেন, আবার বলছেন আমি গিয়েছি?
‘ধরুন সাধন দস্তিদার যদি নাই এসে থাকেন। তার জায়গায় আপনি গেলেন।’
আমার মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে। ঘরে সবাই চুপ, তারই মধ্যে হৃষিকেশবাবু হো হো করে হেসে উঠলেন।
‘মিঃ হালদার কি উন্মাদ না জরাগ্রস্ত, যে আমি দাড়ি গোঁফ লাগিয়ে তাঁর ঘরে ঢুকব আর তিনি আমাকে চিনবেন না?’
‘কী করে চিনবেন, হৃষিকেশবাবু? আপনি যদি গোঁফ দাড়ি লাগিয়ে চোখের চশমাটা খুলে পোশাক বদলে তাঁর ঘরে ঢোকেন, তাহলে আপনাকে সাত বছর আগের সাধন দস্তিদার বলে কেন মনে করবেন না পার্বতীবাবু? আপনি আর সাধন দস্তিদার যে আসলে একই লোক! প্রতিশোধ নেবার জন্য চেহারা পাল্টে নাম পাল্টে সেই একই লোক যে আবার সেক্রেটারি হয়ে ফিরে এসেছে সেটা ত আর বোঝেননি পার্বতীচরণ!’
হৃষিকেশবাবুর মুখের ভাব একদম পালটে গেছে। তাঁর ঠোঁট নড়ছে কিন্তু মুখ দিয়ে কথা বেরোচ্ছে না। দুজন কনস্টেবল এগিয়ে গেল তাঁর দিকে।
ফেলুদার কথা এখনো শেষ হয়নি।
‘খুনের পর কি আপনার ভাড়া করা কোটের পকেটে পেপার ওয়েট পুরে তার ওজন বাড়িয়ে আপনি পুকুরের জলে ফেলে দেননি? তারপর নিজের ঘরে গিয়ে আবার হৃষিকেশ দত্ত সেজে বেরিয়ে আসেননি?’
এই শীতকালেও হৃষিকেশবাবুর সার্টের কলার ভিজে গেছে।
‘আরো একটা কথা’, বলে চলল ফেলুদা। ‘সাধু সাবধান কথাটা কি চেনা চেনা লাগছে? অনিরুদ্ধের জন্য কেনা চন্দনার মুখে কি কথাটা শোনেননি আপনি সম্প্রতি? আর শুনে আপনার কুসংস্কারাচ্ছন্ন মনে কি বিশ্বাস ঢোকেনি যে কথাটা আপনাকে উদ্দেশ্য করেই বলছে? আপনি সাধু সেজে মনিবের সর্বনাশ করতে যাচ্ছেন জেনেই পাখি এই সাবধানবাণী উচ্চারণ করছে? আপনিই কি এই পাখিকে খাঁচা থেকে বার করে বাগানে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দেননি? এবং এই কাজটা করার সময় আপনাকেই কি পাখি জখম করেনি?’
হৃষিকেশবাবু এবার লাফিয়ে উঠলেন চেয়ার থেকে।
‘অ্যাবসার্ড! অ্যাবসার্ড! কোথায় জখম করেছে? কোথায়?’
‘ইনস্পেক্টর হাজরা, আপনার লোককে বলুন ত ওঁর ডান হাত থেকে ঘড়িটা খুলে নিতে।’
প্রচণ্ড বাধা সত্ত্বেও ঘড়ি খুলে এল।
কজিতে প্রায় এক ইঞ্চি লম্বা একটা আঁচড়ের দাগ, সেটা দিব্যি ঘড়ির ব্যাণ্ডের তলায় লুকিয়ে ছিল।
‘আমি খুন করতে যাইনি—দোহাই আপনার—বিশ্বাস করুন!’
হৃষিকেশবাবুর অবস্থা শোচনীয়।
‘সেটা অবিশ্বাস্য নয়’, বলল ফেলুদা, ‘কারণ আপনার আসল উদ্দেশ্য ছিল নেপোলিয়নের চিঠিটা নেওয়া। পেস্টনজী বড় রকম দর দিয়েছেন সেটা আপনি জানতেন। মিঃ হালদার বেচবেন না সেটাও আপনি পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে জানতেন। কিন্তু জিনিসটা চুরি করে ত পেস্টনজীর কাছে বিক্রী করা যায়! তাই—’
‘আমি না, আমি না!’ মরিয়া হয়ে প্রতিবাদ জানালেন হৃষিকেশবাবু।
‘আগে আমার কথা শেষ করতে দিন। ফেলু মিত্তির আধাখাঁচড়া ভাবে সমস্যার সমাধান করে না। এ ব্যাপারে আপনি একা নন সেটা আমি জানি। চিঠিটা বার করে এনে নিজের ঘরে গিয়ে মেক-আপ বদলে আপনি যান আরেকজনের কাছে চিঠিটা দিতে। কিন্তু বাড়িতে খুন হয়েছে, খানাতল্লাসী হবে, সেটা জেনে এই দ্বিতীয় ব্যক্তিও সাময়িকভাবে চিঠিটাকে অন্য জায়গায় চালান দেন। তাই নয়, অচিন্ত্যবাবু?’
প্রশ্নটা একেবারে বুলেটের মতো। কিন্তু লোকটার আশ্চর্য নার্ভ। অচিন্ত্যবাবু ঠোঁটের কোণে হাসি নিয়ে দিব্যি বসে আছেন সোফায়।’
‘বলুন বলুন কী বলবেন’, বললেন ভদ্রলোক, ‘আপনি ত দেখছি সবই জেনে বসে আছেন।’
‘আপনি সাড়ে দশটার একটু পরে একবার আপনার ভাইপোর ঘরে জাননি?’
‘গিয়েছিলাম বৈকি। আমার ভাইপোর ঘরে যাওয়ায় ত কোনো বাধা নেই। সে কদিন থেকেই বলছে তার নতুন খেলনা দেখাবে, তাই গিয়েছিলাম।’
‘আপনার ভাইপোর ঘরে গতকাল এবং তার আগের রাত্রে একজন চোর ঢুকেছিল। সে যা খুঁজছিল তা পায়নি। আপনি কি অস্বীকার করতে পারেন যে সে চোর আপনিই এবং আপনি খুঁজতে গিয়েছিলেন নেপোলিয়নের চিঠি— যেটা আপনিই তার ঘরে লুকিয়ে রেখেছিলেন? চিঠিটা পাবেন এই বিশ্বাসে আপনিই পেস্টনজীকে ফোন করে অফার দিয়েছিলেন, তারপর সেটা না পেয়ে আর পেস্টনজীর ওখানে যেতে পারেননি?’
‘আমিই যখন লুকিয়েছিলাম, তখন সেটা আমি কেন পাব না সেটা বলতে পারেন?’
‘কারণ যাতে লুকিয়েছিলেন সেটা ছিল খোকার বালিশের তলায়। এই যে।’
ফেলুদা মিঃ হাজরার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। হবি সেন্টার থেকে কেনা লাল প্লাস্টিকের মেশিনগান চলে এল ফেলুদার হাতে। তার নলের ভিতরে আঙুল ঢুকিয়ে টান দিতে বেরিয়ে এল গোল করে পাকানো নেপোলিয়নের চিঠি।
‘হৃষিকেশবাবুর মেক-আপের ব্যাপারে আপনিই মালমশলা সাপ্লাই করেছিলেন বোধহয়? প্রশ্ন করল ফেলুদা, ‘ভাগ বাঁটোয়ারা কিরকম হত? ফিফ্টি ফিফ্টি?’
*
মালির ছেলে শঙ্কর চন্দনাটা ধরতে পেরেছিল ঠিকই, যদিও পাখি ফেরত পাওয়ার পুরো ক্রেডিটটা তার খুদে মক্কেলের কাছে ফেলুদাই পেল।
অমিতাভবাবু ফেলুদাকে অফার করেছিলেন পার্বতীচরণের কালেকশন থেকে একটা কোনো জিনিস বেছে নিতে। ফেলুদা রাজি হল না। বলল, ‘এই কেসটায় আমার জড়িয়ে পড়াটা একটা আকস্মিক ঘটনা। আসলে আমি এসেছিলাম আপনার ছেলের ডাকে। তার কাছ থেকে ত আর ফী নেওয়া যায় না!’
ঘটনার দু’দিন পরে শনিবার সকালে লালমোহনবাবু এসে বললেন, ‘জলের তল পাওয়া যায়, মনের তল পাওয়া দায়। আপনার অতলস্পর্শী চিন্তাশক্তির জন্য আপনাকে একটি অনরারি টাইটেলে ভূষিত করা গেল।
—এ বি সি ডি।’
‘এ বি সি ডি?’
‘এশিয়াজ বেস্ট ক্রাইম ডিটেক্টর।’
এবার কাণ্ড কেদারনাথে
কী ভাবছেন ফেলুবাবু
‘কী ভাবছেন, ফেলুবাবু?’
প্রশ্নটা করলেন রহস্য-রোমাঞ্চ ঔপন্যাসিক লালমোহন গাঙ্গুলী ওরফে জটায়ু। আমরা তিনজনে রবিবারের সকালে আমাদের বালিগঞ্জের বৈঠকখানায় বসে আছি, লালমোহনবাবু যথারীতি তার গড়পারের বাড়ি থেকে চলে এসেছেন গল্পগুজবের জন্য। কিছুক্ষণ হল এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে, কিন্তু এখন গন্গনে রোদ। রবিবার লোডশেডিং নেই বলে আমাদের পাখাটা খুব দাপটের সঙ্গে ঘুরছে।
ফেলুদা বলল, ‘ভাবছি আপনার সদ্যপ্রকাশিত উপন্যাসটার কথা।’
পয়লা বৈশাখ জটায়ুর ‘অতলান্তিক আতঙ্ক’ বেরিয়েছে, আর আজ পাঁচই বৈশাখের মধ্যেই নাকি সাড়ে চার হাজার কপি বিক্রী হয়ে গেছে।
লালমোহনবাবু বললেন, ‘ও বইতে যে আপনার মতো লোকের ভাবনার খোরাক ছিল তা তো জানতুম না মশাই।’
‘ঠিক সেরকম ভাবনা নয়।’
‘তবে?’
‘ভাবছিলাম আপনার গল্প যতই গাঁজাখুরি হোক না কেন, স্রেফ মশলা আর পরিপাকের জোরে শুধু যে উৎরে যায় তা নয়, রীতিমতো উপাদেয় হয়।’
লালমোহনবাবু গদগদ ভাব করে কিছু বলার আগেই ফেলুদা বলল, ‘তাই ভাবছিলাম আপনার পূর্বপুরুষদের মধ্যে কোনো গল্প লিখিয়ে-টিখিয়ে ছিলেন কি না।’
সত্যি বলতে কি, আমরা লালমোহনবাবুর পূর্বপুরুষদের সম্বন্ধে প্রায় কিছুই জানি না। উনি বিয়ে করেননি এবং ওঁর বাপ-মা আগেই মারা গেছেন সেটা জানি, কিন্তু তার বেশি উনিও বলেননি, আর আমরাও কিছু জিজ্ঞেস করিনি।
লালমোহনবাবু বললেন, ‘পাঁচ-সাত পুরুষ আগের কথা ত আর বিশেষ জানা যায় না, তাঁদের মধ্যে হয়ত কোনো কথক ঠাকুর-টাকুর থেকে থাকতে পারেন। তবে গত দু-তিন জেনারেশনের মধ্যে ছিল না সেটা বলতে পারি।’
‘আপনার বাবার আর ভাই ছিল না?’
‘থ্রী ব্রাদার্স। উনি ছিলেন মিড্ল। জ্যাঠা মোহিনীমোহন হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার ছিলেন। ছেলেবেলা আরনিকা রাসটকস বেলাডোনা পালসেটিলা যে কত খেয়েছি তার ইয়ত্তা নেই। গ্রেট গ্র্যাণ্ডফাদার ললিতমোহন ছিলেন পেপার মার্চেন্ট। এল এম গাঙ্গুলী অ্যাণ্ড সসের দোকান এই সেদিন অবধি ছিল। ভালো ব্যবসা ছিল। গড়পারের বাড়িটা এল-এমই তৈরি করেন। ঠাকুরদাদা, বাবা দুজনেই ব্যবসায় যোগ দেন। বাবা যদ্দিন বেঁচে ছিলেন তদ্দিন ব্যবসা চালান। ফিফটি-টুতে চলে গেলেন। তারপর যা হয় আর কি। এল এম গাঙ্গুলী অ্যাণ্ড সন্স-এর নামটা ব্যবহার হয়েছিল কিছুদিন, কিন্তু মালিক বদল হয়ে গেসল।’
‘আপনার ছোটকাকা? তিনি ব্যবসায় যোগ দেন নি?’
‘নো স্যার। ছোটকাকা দুর্গামোহনকে দেখি আমার জন্মের অনেক পরে। আমার জন্ম থার্টি সিক্সে। দুর্গামোহন টোয়েন্টি নাইনে সন্ত্রাসবাদীদের দলে যোগ দিয়ে খুলনার অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার টার্নবুল সাহেবকে গুলি মেরে তাঁর থুৎনি উড়িয়ে দেন।’
‘তারপর?’
‘তারপর হাওয়া। বেপাত্তা। পুলিশ ধরতে পারেনি ছোটকাকাকে। আমার ধারণা আমার অ্যাডভেঞ্চার প্রতিটা ছোটকাকার কাছ থেকেই পাওয়া।’
‘উনি আর আসেন নি?’
‘এসেছিলেন। একবার। স্বাধীনতার পর ফর্টি নাইনে। তখন আমি থার্ড ক্লাসে পড়ি। সেই প্রথম আর সেই শেষ দেখা ছোটকাকার সঙ্গে। তবে যাঁকে দেখলাম তিনি সেই অগ্নিযুগের ছোটকাকা দুর্গামোহন গাঙ্গুলী নন। কমপ্লীট চেঞ্জ। কোথায় সন্ত্রাস, কোথায় পিস্তল। একেবারে নিরীহ, সাত্ত্বিক পুরুষ। মাসখানেক ছিলেন, তারপর আবার চলে যান।’
‘কোথায়?’
‘যদূর মনে পড়ে কোনো জঙ্গলে কাঠের ব্যবসা করতে যান।’
‘বিয়ে করেননি?’
‘নাঃ।’
‘কিন্তু আপনার আপন বা জ্যাঠতুতো ভাইবোন আছে নিশ্চয়ই।’
‘আপন বোন একটি আছেন, দিদি। স্বামী রেলওয়েতে চাকরি করেন; ধানবাদে পোস্টেড। জ্যাঠার ছেলে নেই, তিন মেয়ে, তিনজনের স্বামীই ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন। বিজয়া দশমীতে একটি করে পোস্টকার্ড—ব্যস্। আসলে রক্তের সম্পর্কটা কিছুই নয়, ফেলুবাবু। এই যে আপনার আর তপেশের সঙ্গে আমার ইয়ে, তার সঙ্গে কি ব্লাড রিলেশনের কোনো—?’
লালমোহনবাবুর কথা থামাতে হল, কারণ দরজায় টোকা পড়েছে। এটা যাকে বলে প্রত্যাশিত, কারণ টেলিফোনে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করা ছিল সাড়ে ন’টার জন্য, এখন বেজেছে ন’টা তেত্রিশ।
ভদ্রলোকের নামটা জানা ছিল টেলিফোনে—উমাশঙ্কর পুরী—এবার চেহারাটা দেখা গেল। মাঝারি হাইট, দোহারা গড়ন, পরনে ঘী রঙের হ্যাণ্ডলুমের সূট। দাড়ি-গোঁফ কামানো। মাথার চুল কাঁচা-পাকা মেশানো, ডান দিকে সিঁথি। এই শেষের ব্যাপারটা দেখলেই কেন জানি আমার অসোয়াস্তি হয়; মনে হয় মুখটা যেন আয়নায় দেখছি। পুরুষদের মধ্যে শতকরা একজনের বেশি ডান দিকে সিঁথি করে কিনা সন্দেহ, যদিও কারণটা জিজ্ঞেস করলে বলতে পারব না।
‘আপনাকে খুব তাড়াহুড়ো করে চলে আসতে হয়েছে বলে মনে হচ্ছে?’ ফেলুদা মন্তব্য করল আলাপ পর্বের পর ভদ্রলোক চেয়ারে বসতেই।
‘হ্যাঁ, তা—’ উমাশঙ্করের ভুরু কপালে উঠে গেল—‘কিন্তু সেটা আপনি জানলেন কী করে?’
‘আপনার বাঁ হাতের সব নখই পরিষ্কার করে ক্লিপ দিয়ে কাটা, তার একটি নখ এখনো কোটের পকেটের ধারে লেগে আছে, অথচ ডান হাতে দুটো নখের পরে আর বাকিগুলো…’
‘আর বলবেন না!’ বললেন মিঃ পুরী, ঠিক সেই সময় একটা ট্রাঙ্ক কল এসে গেল; কথা শেষ হতে হতে দেখি আপনার সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্টের সময় হয়ে গেছে।’
‘যাক্ গে—এবার বলুন আপনাকে কী ভাবে সাহায্য করতে পারি।’
মিঃ পুরী গম্ভীর হয়ে নিজেকে সংযত করে নিলেন। তারপর বললেন, ‘মিঃ মিটার, আমি থাকি ভারতবর্ষের আরেক প্রান্তে। আপনার নাম আমি শুনেছি ভগওয়ানগড়ের রাজার কাছ থেকে। শুধু নাম নয়, প্রশংসা। তাই আমি আপনার কাছে এসেছি।’
‘আমি তাতে গর্ব বোধ করছি।’
‘এখন কথা হচ্ছে কি—’ মিঃ পুরী থামলেন। তাঁর মধ্যে একটা ইতস্তত ভাব লক্ষ করছিলাম। তিনি আবার বললেন, ‘ব্যাপারটা হচ্ছে কি—একটা দুর্ঘটনা ঘটতে পারে; সেইটে যাতে না ঘটে তাই আমি আপনার সাহায্য চাইছি। সেটা পাওয়া যাবে কি?’
ফেলুদা বলল, ‘আপনি কী ঘটনা বা দুর্ঘটনার কথা বলছেন সেটা না জানা পর্যন্ত আমি মতামত দিতে পারছি না।’
শ্রীনাথ এই সময় চা-চানাচুর-বিস্কুট এনে রাখাতে কথায় একটু বিরতি পড়ল। তারপর মিঃ পুরী একটা বিস্কুট তুলে নিয়ে বললেন, ‘আপনি রূপনারাণগড় স্টেটের নাম শুনেছেন?’
‘নামটা চেনা-চেনা লাগছে’, বলল ফেলুদা, ‘উত্তর প্রদেশে কি?’
‘ঠিকই বলেছেন,’ বললেন মিঃ পুরী। ‘আলিগড় থেকে ৯০ কিলোমিটার পশ্চিমে। আমি যখনকার কথা বলতে যাচ্ছি সেটা আজ থেকে ত্রিশ বছর আগে। তখন রাজা ছিলেন চন্দ্রদেও সিং। আমি ছিলাম এস্টেটের ম্যানেজার। ভারত স্বাধীন হয়ে গেলেও তখনও এসব নেটিভ স্টেটের উপর তত চাপ পড়েনি; রাজারা রাজাই ছিলেন। চন্দ্ৰদেও-এর বছর চুয়ান্ন বয়স, কিন্তু তখনও সিংহের মতো চেহারা। শিকার করেন, টেনিস খেলেন, পোলো খেলেন, প্রৌঢ়ত্বের কোনো লক্ষণ নেই। একটি ব্যারাম তাঁকে মাঝে মাঝে বিব্রত করত, কিন্তু সেটা যে হঠাৎ এমন আকার ধারণ করবে সেটা কেউ স্বপ্নেও ভাবেনি। হাঁপানি। সে যে কী হাঁপানি সে আমি আপনাকে বলে বোঝাতে পারব না। একটা জলজ্যান্ত জোয়ান মানুষকে ছ’ মাসের মধ্যে কঙ্কালে পরিণত হতে এই প্রথম দেখলাম। কোনো ওষুধে কোনো কাজ দিল না। হয়ত দুদিন দেয়, আবার যেই কে সেই।
‘সেই সময় খবর এল, হরিদ্বারে নাকি এক ভদ্রলোক থাকেন, নাম ভবানী উপাধ্যায়, তিনি নাকি হাঁপানির অব্যর্থ ওষুধ জানেন। বহু রুগী তাঁর ওষুধে সম্পূর্ণ আরোগ্যলাভ করেছে।
‘আমি নিজেই চলে গেলাম হরিদ্বার। ঠিকানা জানা ছিল না ভদ্রলোকের, কিন্তু খোঁজ পেতে অসুবিধা হল না, কারণ ওঁকে অনেকেই চেনে। সাদাসিধা মানুষ, ছোট্ট একটা বাড়িতে থাকেন, আমাকে যথেষ্ট খাতির করে তাঁর তক্তপোষে বসালেন। তারপর সব শুনেটুনে বললেন, আমি যাব আপনার সঙ্গে, রাজাকে ওষুধ দেব; সারবার হলে দশদিনের মধ্যে সারবে, নাহলে নয়। সেই দশদিন আমি ওখানে থাকব। ওষুধে কাজ না দিলে আমি কোনো পয়সা নেবো না।
‘বললে বিশ্বাস করবেন না মিঃ মিটার, দশদিন নয়, সাতদিন নয়, তিনদিনের মধ্যে রাজার হাঁপানি উধাও। এমন যে ঘটতে পারে সেটা না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। উপাধ্যায় বললেন তাঁর ওষুধের দাম পঞ্চাশ টাকা। রাজাকে বলতে তিনি ত কথাটা কানেই তুললেন না। বললেন, আমি মরতে বসেছিলাম, উনি এসে আমাকে নতুন জীবন দান করলেন, আর তার দাম হল কিনা পঞ্চাশ টাকা?
‘এখানে বলে রাখি যে রাজা চন্দ্রদেও মানুষটা একটু খামখেয়ালী ছিলেন। তাছাড়া তাঁর শোক, তাঁর আনন্দ, তাঁর ক্রোধ, তাঁর দয়াদাক্ষিণ্য—সবই সাধারণ মানুষের চেয়ে মাত্রায় অনেকটা বেশি ছিল। পঞ্চাশ টাকার বদলে উনি উপাধ্যায়কে যেটা দিলেন সেটা একটা মণিমুক্তাখচিত সোনার বালগোপাল। জিনিসটা আসলে একটা পেনডেন্ট বা লকেট—লম্বায় ইঞ্চি তিনেক। তখনকার দিনে সেটার দাম পাঁচ-সাত লাখ টাকা।’
একটু ফাঁক পেয়ে ফেলুদা প্রশ্ন করল, ‘উপাধ্যায় নিলেন সেই লকেট?’
‘সেই কথাই ত বলছি,’ বললেন উমাশঙ্কর পুরী। উপাধ্যায় বললেন, আমি সাদাসিধে মানুষ, আমাকে এমন বিপাকে ফেলছেন কেন? এত দামী একটা জিনিস আমার কাছে থাকবে, সেটা লোকে আমার বলে বিশ্বাস করবে কেন? সবাই ভাববে আমি চুরি করেছি।’
‘রাজা বললেন—কারুর ত জানার দরকার নেই। আমরা ত আর খবরটা ঢাক পিটিয়ে জাহির করতে যাচ্ছি না। আর নেহাৎই যদি কেউ জেনে ফেলে, তার জন্য আমি আমার নিজের শীলমোহর দিয়ে লিখে দিচ্ছি যে এটা আমি তোমাকে পারিতোষিক হিসেবে দিলাম। এর পরে ত আর কারুর কিছু বলার নেই।
‘উপাধ্যায় বলল, তাই যদি হয়, তাহলে আমি মাথা পেতে নেবো আপনার এ পারিতোষিক।’
ফেলুদা বলল, ‘আপনি, রাজা,এবং উপাধ্যায়—এই তিনজন ছাড়া আর কেউ কি ঘটনাটা জানত?’
‘আমি সত্যি কথা বলব,’ বললেন উমাশঙ্কর পুরী, ‘রাজা নিজে যদি খেয়ালবশে কাউকে বলে থাকেন ত সে আমি জানি না; ব্যাপারটা জানত রাজা, রাণী এবং দুই রাজকুমার—সূরয ও পবন। বড় কুমার সূরয অতি চমৎকার ছেলে, রাজপরিবারে এমন দেখা যায় না। তার বয়স তখন বাইশ-তেইশ। ছোট কুমারের বয়স পনের। এছাড়া জানতাম আমি, আমার স্ত্রী আর আমার ছেলে দেবীশঙ্কর—তার বয়স তখন পাঁচ কি ছয়। ব্যস্, আর কেউ না। আর এটাও আপনি খেয়াল করে দেখুন মিঃ মিটার—এ খবর কিন্তু গত ত্রিশ বছরে কোনো কাগজে বেরোয়নি। আপনি ত সাংবাদিকদের জানেন; তারা এর গন্ধ পেলে কি ছেড়ে দিত?’
‘সে কথা ঠিক,’ বলল ফেলুদা, ‘ব্যাপারটার গোপনীয়তা রক্ষিত হয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।’
যাই হোক, এবার আমি এগিয়ে আসছি বর্তমানের দিকে। রাজা চন্দ্রদেও সিং বেঁচেছিলেন আর বছর বারো। তারপর সূরযদেও রাজা হলেন। রাজা মানে, তখন ত আর রাজা কথাটা ব্যবহার করা চলে না; বলতে পারেন উনিই হলেন কর্তা।’
‘আপনি তখনো ম্যানেজার?’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ; এবং আমি প্রাণপণে চেষ্টা করছি যাতে ব্যবসা ইত্যাদির সাহায্যে রূপনারাণগড়ের ভবিষ্যৎকে আরো মজবুত করা যায়। কিন্তু মুশকিল হয়েছে কি, সূরযদেও-এর এসব দিকে কোনো উৎসাহ নেই। তার নেশা হচ্ছে বই। সে দিনের মধ্যে ষোল ঘণ্টা তার লাইব্রেরিতে পড়ে থাকে। সেখানে আমার একার চেষ্টায় আমি কী করতে পারি? ফলে আর্থিক দিক দিয়ে স্টেটের অবস্থা ক্রমেই খারাপ হয়ে আসতে থাকে।’
‘আপনার নিজের ছেলেও ত ততদিনে বড় হয়েছে?’
‘হ্যাঁ। দেবীকে অবশ্য আমি আগেই আলিগড়ে স্কুলে পাঠিয়ে দিই। সে আর রূপনারাণগড়ে ফেরেনি। দিল্লী গিয়ে নিজেই ব্যবসা শুরু করেছে।’
‘আপনার কি ওই একই ছেলে?’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ। যাই হোক্, আমার নিজের অনেকবার মনে হয়েছে যে ম্যানেজারি ছেড়ে দিয়ে আমার নিজের দেশ মোরাদাবাদে গিয়ে একটা কিছু করি, কিন্তু মায়া কাটাতে পারছিলাম না।’
মিঃ পুরী এবার পকেট থেকে একটা চরুট বার করে ধরিয়ে নিয়ে বললেন, ‘এবার আমি আসল ঘটনায় আসছি; আপনার ধৈর্যচ্যুতি হয়ে থাকলে আমায় মাপ করবেন।
‘সাতদিন আগে, অর্থাৎ ঊনত্রিশে এপ্রিল, শনিবার রূপনারাণগড়ের ছোটকুমার পবনদেও সিং হঠাৎ আমার কাছে এসে হাজির হন। তার প্রথম কথাই হল, “আমার বাবার হাঁপানি যিনি সারিয়েছিলেন তাঁর নাম ও তাঁর হরিদ্বারের ঠিকানাটা আমার চাই।”
‘স্বভাবতই আমি প্রথমে জিজ্ঞেস করলাম কারুর কোনো অসুখ করেছে কি না। পবন বলল, না, তা নয়; সে একটা টেলিভিশনের ছবি করছে, তার জন্য তার এই ভদ্রলোককে দরকার।
‘পবন যে ক্যামেরা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে সেটা আমি জানতাম, কিন্তু সেটা যে টেলিভিশন নিয়ে মেতে উঠেছে, সে খবর জানতাম না। আমি বললাম, “তুমি কি তোমার ছবিতে সে ভদ্রলোককে দেখাতে চাও?” সে বললে, “অবশ্যই। শুধু তাই না। বাবা তাকে যে লকেটটা দিয়েছিলেন সেটাও দেখাব। একটা অসুখ সারিয়ে এরকম বকশিস আর কেউ কোথাও পেয়েছে বলে আমার মনে হয় না।”
‘তখন আমার পবনকে বলতেই হল যে উপাধ্যায় তাঁর এই পারিতোষিকের ব্যাপারটা একেবারেই প্রচার করতে চাননি। পবন বলল, “ত্রিশ বছর আগে একটা লোক যে কথা বলেছে, আজও যে সে তাই বলবে এমন কোনো কথা নেই। সমস্ত পৃথিবীর কাছে নানারকম তথ্য পরিবেশন করা টেলিভিশনের একটা প্রধান কাজ। আপনি আমাকে নাম ঠিকানা দিন। ওঁকে রাজি করাবার ভার আমার।”
‘কী আর করি; বাধ্য হয়ে উপাধ্যায়ের নাম ঠিকানা দিয়ে দিলাম; সে ধন্যবাদ দিয়ে চলে গেল।’
‘উপাধ্যায়ের বয়স এখন আন্দাজ কত হবে?’ ফেলুদা জিগ্যেস করল।
‘তা সত্তর-বাহাত্তর ত হবেই। রূপনারায়ণগড়ে যখন এসেছিল তখন তার যৌবন পেরিয়ে গেছে।’
ফেলুদা উমাশঙ্করের দিকে কিছুক্ষণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে বলল, আপনি কি শুধু এই ব্যাপাটার গোপনীয়তা রক্ষা হবে না বলে চিন্তিত হচ্ছেন?’
মিঃ পুরী মাথা নাড়লেন।
‘না মিঃ মিটার। আপনি ঠিকই আন্দাজ করেছেন। শুধু যদি তাই হত তাহলে আমি আপনার কাছে আসতাম না। আমার ভয় হচ্ছে ওই লকেটটাকে নিয়ে। পবনের নতুন শখ হয়েছে টেলিভিশনের ছবি তোলার। আপনি নিশ্চয় জানেন যে কাজটা খরচ সাপেক্ষ। পবনের নিজের কোনো অর্থ সংগ্রহের রাস্তা আছে কিনা জানি না, কিন্তু এটা জানি যে ওই একটি লকেট ওর সমস্ত অর্থসমস্যা দূর করে দিতে পারে।’
‘কিন্তু ওই লকেটটি হাত করতে হলে ত তাকে অসদুপায় অবলম্বন করতে হতে পারে।’
‘তা ত বটেই।’
‘পবনদেও ছেলে কেমন?’
‘সে বাপের কিছু দোষগুণ দুটোই পেয়েছে। পবনের মধ্যেও একটা বেপরোয়া দিক আছে। ভালো খেলোয়াড়। ছবি ভালো তোলে। আবার জুয়ার নেশাও আছে। অথচ তার দরাজ মনের পরিচয়ও পেয়েছি। ওকে চেনা ভারী শক্ত। যেমন ছিল ওর বাপকে।’
‘তাহলে আপনি আমার কাছে কী চাইছেন?’
‘আমি চাইছি আপনি দেখেন যাতে এই অসদুপায়টি অবলম্বন না করা হয়।’
‘পবনদেও কি হরিদ্বার যাচ্ছেন?’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ, তবে তাঁর যেতে একটু দেরি হবে—অন্তত পাঁচ-সাতদিন, কারণ এখন উনি প্যালেসের ছবি তুলছেন।’
‘আমাদেরও যেতে গেলে সময় লাগবে, কারণ তার আগে ত ট্রেনে বুকিং পাওয়া যাবে না।’
‘তা বটে।’
‘কিন্তু ধরুন যদি আমি কেসটা নিই, আমি আপনাদের ছোট কুমারকে চিনছি কি করে?’
‘সে ব্যবস্থাও আমি করে এনেছি। দিল্লীর একটি সাপ্তাহিক কাগজে কুমারের এই রঙীন ছবিটা বেরিয়েছিল গত মাসে। একটা বিলিয়ার্ড চ্যামপিয়নশিপে জিতেছিল। এটা আপনি রাখুন। আর ইয়ে, আপনাকে আগাম কিছু…?’
‘আমি হাজার টাকা অ্যাডভান্স নিই,’ বলল ফেলুদা। ‘কেস সফল না হলেও সেটা ফেরত দিই না, কারণ সফল না হওয়াটা অনেক সময় গোয়েন্দার অক্ষমতার উপর নির্ভর করে না। সফল হলে আমি আরো এক হাজার টাকা নিই।’
‘বেশ। আপনাকে এখনই কিছু বলতে হবে না। আমি পার্ক হোটেলে আছি। আপনি কী স্থির করেন বিকেলে চারটে নাগাদ ফোন করে জানিয়ে দেবেন। হ্যাঁ হলে আমি নিজে এসে আপনাকে আগাম টাকা দিয়ে যাবো।’
মাইক্রোক্যাসেট রেকর্ডার
ফেলুদা যে কেসটা নেবে সেটা আমি আগে থেকেই জানতাম। আজকাল আমরা মক্কেলের কথাবার্তা হংকং থেকে কেনা একটা মাইক্রোক্যাসেট রেকর্ডারে তুলে রাখি। মিঃ পুরীর বেলাতে ওঁর অনুমতি নিয়ে তাই করেছিলাম। ফেলুদা দুপুরে সেই সব কথাবার্তা প্লে ব্যাক করে খুব মন দিয়ে শুনে বলল, ‘কেসটা নেবার সপক্ষে দুটো যুক্তি রয়েছে; একটা হল এর অভিনবত্ব, আর দুই হল—গোয়েন্দাগিরির প্রথম যুগে দেখা হরিদ্বার-হৃষিকেশটা আরেকবার দেখার লোভ।’
বাদশাহী আংটির ক্লাইম্যাকসটা যে হরিদ্বারেই শুরু হয়েছিল সেটা আমিও কোনোদিন ভুলব না।
পার্ক হোটেলে টেলিফোন করে কেসটা নিচ্ছে বলে ফেলুদা মিঃ পুরীকে জানিয়ে দিয়েছিল। আর মিঃ পুরীও আধ ঘণ্টার মধ্যে এসে আগাম টাকা দিয়ে গিয়েছিলেন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পুষ্পক ট্র্যাভলসে ফোন করে ফেলুদা ডুন এক্সপ্রেসে আমাদের বুকিং-এর জন্য জানিয়ে দিয়েছিল। হঠাৎ দুদিন পরে এক অদ্ভুত ব্যাপার। রূপনারায়ণগড় থেকে মিঃ পুরীর এক টেলিগ্রাম এসে হাজির—
‘রিকুয়েস্ট ড্রপ কেস। লেটার ফলোজ।’
ড্রপ কেস! এতো তাজ্জব ব্যাপার! এমন ত আমাদের অভিজ্ঞতায় কখনো হয়নি।
মিঃ পুরীর চিঠিও এসে গেল দুদিন পরে। মোদ্দা কথা হচ্ছে—ছোটকুমার মত পালটেছে। সে হরিদ্বার-হৃষিকেশ গিয়ে ছবি তুলবে, তাতে উপাধ্যায় থাকবেন, কিন্তু তাতে শুধু দেখান হবে তিনি কিভাবে নিজের তৈরি ওষুধ দিয়ে স্থানীয় লোকের চিকিৎসা করেন। রূপনারায়ণগড়ের রাজার চিকিৎসাও যে উপাধ্যায় করেছিলেন সেটা ছবিতে বলা হবে, কিন্তু মহামূল্য পারিতোষিকের কথাটা বলা হবে না।
ফেলুদা টেলিগ্রামে উত্তর দিল—‘ড্রপিং কেস, বাট গোইং অ্যাজ পিলগ্রিমস।’ অর্থাৎ কেস বাতিল করছি, কিন্তু তীর্থযাত্রী হিসেবে যাচ্ছি।
আমি জানি ফেলুদা ও কথা লিখলেও ও নিজের গরজেই চোখ-কান খোলা রাখবে, আর তদন্তের কোনো কারণ দেখলে তদন্ত করবে। সত্যি বলতে কি, ভবানী উপাধ্যায় আর ছোটকুমার পবনদেও সিং—এই দুটি লোককেই আমার খুব ইন্টারেস্টিং বলে মনে হচ্ছিল।
আমরা তিনজন এখন ডূন এক্সপ্রেসের একটা থ্রি টিয়ার কম্পার্টমেন্টে বসে আছি। ফৈজাবাদ স্টেশনে মিনিট দু-এক হল গাড়ি থেমেছে, আমরা ভাঁড়ের চা কিনে খাচ্ছি।
‘আপনি যে বলছিলেন হরিদ্বার গেসলেন, সেটা কবে?’ ফেলুদা তার সামনের সীটে বসা লালমোহনবাবুকে জিজ্ঞাসা করল।
‘আমার ঠাকুরদা একবার সপরিবারে তীর্থভ্রমণে যান,’ বললেন লালমোহনবাবু, ‘ইনক্লডিং হরিদ্বার। তখন আমার বয়স দেড়; কাজেই নো মেমারি।’
এবার অন্যদিক থেকে একটা প্রশ্ন এল।
‘আপনারা কি শুধু হরিদ্বারই যাচ্ছেন, না ওখান থেকে এদিকে ওদিকেও ঘুরবেন?’
এ-প্রশ্ন করলেন লালমোহনবাবুর পাশে বসা এক বৃদ্ধ। মাথায় সামান্য চুল যা আছে তা সবই পাকা, কিন্তু চামড়া টান, দাঁত সব ওরিজিন্যাল, আর চোখের দুপাশে যে খাঁজগুলো রয়েছে সেগুলো যেন হাসবার জন্য তৈরিই হয়ে আছে।
‘হরিদ্বারে একটু কাজ ছিল,’ বলল ফেলুদা। ‘সেটা হয়ে গেলে পর⋯দেখা যাক্—’
‘কী বলছেন মশাই!’ বৃদ্ধের চোখ কপালে উঠে গেছে—‘অ্যাদ্দূর এসে কেদার-বদ্রীটা দেখে যাবেন না? বদ্রীনাথ ত সোজা বাসে করেই যাওয়া যায়। কেদারের শেষের কটা মাইল অবিশ্যি এখনো বাস রুট হয়নি। তবে এও ঠিক যে কেদারের কাছে বদ্রী কিছুই নয়। যদি পারেন ত একবার কেদারটা ঘুরে আসবেন। শেষের হাঁটা পথটুকু আর—’ ফেলুদা আর আমার দিকে তাকিয়ে—‘আপনাদের বয়সে কী! আর—’ লালমোহনবাবুর দিকে তাকিয়ে—‘এনার জন্য ত ডাণ্ডি আর টাট্টুঘোড়াই আছে। টাট্টু ঘোড়ায় চড়েছেন কখনো?’
শেষের প্রশ্নটা অবিশ্যি লালমোহনবাবুকেই করা হল। লালমোহনবাবু হাতের ভাঁড়টায় একটা শেষ চুমুক দিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে দিয়ে গম্ভীরভাবে অন্য দিকে চেয়ে বললেন, ‘আজ্ঞে না, তবে থর ডেজার্টে একবার উটের পিঠে চড়ে দৌড়ের অভিজ্ঞতা হয়েছে। সেটা আপনার হয়েছে কি?’
বৃদ্ধ মাথা নাড়লেন।—‘তা হয়নি। আমার চরবার ক্ষেত্র হল হিমালয়ের এই বিশেষ অংশ। তেইশবার এসেছি কেদার-বদ্রী। ভক্তি-টক্তি আমার যে তেমন আছে তা নয়, তবে এখানকার প্রাকৃতিক দৃশ্য থেকেই আমি সব আধ্যাত্মিক শক্তি আহরণ করি। কোনো বিগ্রহের দরকার হয় না।’
ভদ্রলোকের নাম পরে জেনেছিলাম মাখনলাল মজুমদার। শুধু কেদার বদ্রী নয়, যমুনোত্রী, গঙ্গোত্রী, গোমুখ, পঞ্চকেদার, বাসুকিতাল—এসবও এঁর দেখা আছে। নেহাৎ একটা সংসার আছে, না হলে হিমালয়েই থেকে যেতেন। অবিশ্যি এটাও বললেন যে আজকের বাস-ট্যাক্সিতে করে যাওয়া আর আগেকার দিনের পায়ে হেঁটে যাওয়া এক জিনিস নয়। বললেন, ‘আজকাল ত আর কেউ পিলগ্রিম নয়, সব পিকনিকারস। তবে হ্যাঁ, গাড়ির রাস্তা তৈরি করে ত আর হিমালয়ের দৃশ্য পালটানো যায় না। নয়নাভিরাম বলতে যা বোঝায়, সেরকম দৃশ্য এখনও অফুরন্ত আছে।’
ভোর ছ’টায় ডুন এক্সপ্রেস পৌঁছাল হরিদ্বার।
সেই বাদশাহী আংটির সময় যেমন দেখেছিলাম পাণ্ডার উপদ্রবটা যেন তার চেয়ে একটু কম বলে মনে হল। স্টেশনেই একটা রেস্টোরান্টে চা বিস্কুট খেয়ে নিলাম। উপাধ্যায়ের নাম এখানে অনেকেই জানে আন্দাজ করেই বোধহয় ফেলুদা রেস্টোরান্টের ম্যানেজারকে তাঁর হদিস জিগ্যেস করল।
উত্তর শুনে বেশ ভালোরকম একটা হোঁচট খেলাম।
ভবানী উপাধ্যায় তিন চার মাস হল হরিদ্বার ছেড়ে রুদ্রপ্রয়াগ চলে গেছেন।
‘তাঁর বিষয় আরো খবর কে দিতে পারে বলতে পারেন?’ জিগ্যেস করল ফেলুদা। উত্তর এল—‘এখনকার খবর পেতে হলে রুদ্রপ্রয়াগ যেতে হবে, আর যদি আগেকার খবর চান ত কান্তিভাই পণ্ডিতের কাছে যান। উনি ছিলেন উপাধ্যায়জীর বাড়িওয়ালা। তিনি সব খবর জানবেন।’
‘তিনিও কি লক্ষ্মণ মহাল্লাতেই থাকেন?’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ। পাশাপাশি বাড়িতে থাকতেন ওঁরা। সবাই ওঁকে চেনে ওখানে। জিগ্যেস করলেই বলে দেবে।’
আমরা আর সময় নষ্ট না করে বিল চুকিয়ে দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।
কান্তিভাই পণ্ডিতের বয়স ষাট-পঁয়ষট্টি, বেঁটেখাটো চোখাচাখা ফরসা চেহারা, খোঁচা খোঁচা গোঁফ, কপালে চন্দনের ফোঁটা আর চোখে বাইফোক্যাল চশমা। আমরা ভবানী উপাধ্যায়ের খোঁজ করছি জেনে উনি রীতিমতো অবাক হয়ে বললেন, ‘কী ব্যাপার বলুন ত? আরেকজন ত ওঁর খোঁজ করে গেলেন এই তিন চার দিন আগে।’
‘তাঁর চেহারা মনে আছে আপনার?’
‘তা আছে বৈ কি।’
‘দেখুন ত এই চেহারার সঙ্গে মেলে কিনা।’
ফেলুদা পকেট থেকে ছোটকুমার পবনদেও-এর ছবিটা বার করে দেখান।
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, এই ত সেই লোক,’ বললেন কান্তিভাই পণ্ডিত। ‘আমি রুদ্রপ্রায়াগের ঠিকানা দিয়ে দিলাম তাঁকে।’
‘সে ঠিকানা অবিশ্যি আমারও চাই,’ বলে ফেলুদা তার একটা কার্ড বার করে দিল মিঃ পণ্ডিতের হাতে।
কার্ডটা পাওয়ামাত্র মিঃ পণ্ডিতের হাবভাব একদম বদলে গেল। এতক্ষণ আমরা দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম, এবার আমাদের সকলকে চেয়ার, মোড়া আর তক্তপোষে ভাগাভাগি করে বসতে দেওয়া হল।
‘কেয়া, কুছ গড়বড় হুয়া মিঃ মিত্তর?’
‘যত দূর জানি, এখনও হয়নি, বলল ফেলুদা। ‘তবে হবার একটা সম্ভাবনা আছে। এবার আমি আপনাকে একটা প্রশ্ন করতে চাই, মিঃ পণ্ডিত; আপনি সঠিক উত্তর দিতে পারলে খুব উপকার হবে।’
‘আই উইল ট্রাই মাই বেস্ট।’
‘মিঃ উপাধ্যায়ের ব্যক্তিগত সংগ্রহে কি কোনো একটা মূল্যবান জিনিস ছিল?’
মিঃ পণ্ডিত একটু হেসে বললেন, ‘এ প্রশ্নটাও আমাকে দ্বিতীয়বার করা হচ্ছে। আমি মিঃ সিংকে যা বলেছি আপনাকেও তাই বলছি। মিঃ উপাধ্যায়ের একটা থলি উনি আমার সিন্দুকে রাখতে দিয়েছিলেন। কিন্তু তাতে যে কী ছিল সেটা আমি কোনোদিন দেখিনি বা জিগ্যেসও করিনি।’
‘সেটা উনি রুদ্রপ্রয়াগ নিয়ে গেছেন?’
‘ইয়েস স্যার। অ্যাণ্ড অ্যানাদার থিং—আপনি ডিটেকটিভ তাই এখবর আমি আপনাকে বলছি, আপনার হয়ত কাজে লাগতে পারে— পাঁচ-ছে মহিনে আগে দুজন লোক—তখনও মিঃ উপাধ্যায় ছিলেন এখানে—একজন সিন্ধী কি মাড়োয়ারি হবে—হি লুক্ড এ রিচ ম্যান—অ্যাণ্ড অ্যানাদার ম্যান—দুজন উপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। অনেক কথা হচ্ছিল সেটা আমি বুঝতে পারছিলাম। এক ঘণ্টার উপর ছিল। তারা যাবার পরে উপাধ্যায় একটা কথা আমাকে বলে—“পণ্ডিতজী, আজ আমি একটি রিপুকে জয় করেছি। মিঃ সিংঘানিয়া আমাকে লোভের মধ্যে ফেলেছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমি সে লোভ কাটিয়ে উঠেছি।”’
‘আপনি উপাধ্যায়ের এই সম্পত্তির কথা আর কাউকে বলেন নি?’
‘দেখুন মিঃ মিত্তর, ওঁর যে একটা কিছু লুকোবার জিনিস আছে সেটা অনেকেই জানত। আর সেই নিয়ে আড়ালে ঠাট্টাও করত। আমার আবার সন্ধ্যাবেলায় একটু নেশা করার অভ্যাস আছে, হয়ত কখনো কিছু বলে ফেলেছি। কিন্তু উপাধ্যায়জীকে সকলে এখানে এত ভক্তি করত যে সিন্দুকে কী আছে সেই নিয়ে কেউ কোনোদিন মাথা ঘামায় নি।’
‘এই যে রুদ্রপ্রয়াগ গেলেন তিনি, এর পিছনে কোনো কারণ আছে?’
‘আমাকে বলেছিলেন গঙ্গার ঘাটে ওঁর একজন সাধুর সঙ্গে আলাপ হয়। তাঁর সঙ্গে কথা বলে উপাধ্যায়ের মধ্যে একটা মানসিক চেঞ্জ আসে। আমার মনে হয় চেঞ্জটা বেশ সিরিয়াস ছিল। কথা-টথা সব কমিয়ে দিয়েছিলেন। অনেক সময় চুপচাপ বসে ভাবতেন।’
‘ওঁর ওষুধপত্তর কি উনি সঙ্গেই নিয়েছিলেন?’
‘ওষুধ বলতে ত বেশি কিছু ছিল না : কয়েকটা বৈয়াম, কিছু শিকড় বাকল, কিছু মলম, কিছু বড়ি—এই আর কি। এগুলো সবই উনি নিয়ে গিয়েছিলেন। তবে আমার নিজের ধারণা উনি ক্রমে পুরোপুরি সন্ন্যাসের দিকে চলে যাবেন।’
‘উনি বিয়ে করেননি?’
‘না। সংসারের প্রতি ওঁর কোনো টান ছিল না। যাবার দিন আমাকে বলে গেলেন—“ভোগের রাস্তা, ত্যাগের রাস্তা, দুটোই আমার সামনে ছিল। আমি ত্যাগটাই বেছে নিলাম।”’
‘ভালো কথা, বলল ফেলুদা, ‘আপনি যে বললেন ওঁর রুদ্রপ্রয়াগের ঠিকানা আপনি দিয়ে দিয়েছেন ওই ভদ্রলোকটিকে—আপনি ঠিকানা পেলেন কি করে?’
‘কেন, উপাধ্যায় আমাকে পোস্টকার্ড লিখেছে সেখান থেকে।’
‘সে পোস্টকার্ড আছে?’
‘আছে বৈ কি।’
মিঃ পণ্ডিত তাঁর পিছনের একটা তাকে রাখা বাক্সের ভিতর হাত ঢুকিয়ে একটা পোস্টকার্ড বার করে ফেলুদাকে দিলেন। হিন্দিতে লেখা আট দশ লাইনের চিঠি। সেটা ফেলুদা বার বার পড়ল কেন, আর পড়ে বিড় বিড় করে দুবার ‘মোস্ট ইন্টারেস্টিং’ বলল কেন, সেটা বলতে পারব না।
মিঃ পণ্ডিত আমাদের একটা ভালো ট্যাক্সির কথা বলে দিলেন। আপাতত রুদ্রপ্রয়াগ, তারপর যেখানেই যাওয়া দরকার সেখানেই যাবে। গাড়োয়ালী ড্রাইভারের নাম যোগীন্দররাম। লোকটিকে দেখে আমাদের ভালো লাগল। আমরা বললাম বারোটা নাগাদ খেয়ে দেয়ে রওনা দেব হৃষিকেশ থেকে। হৃষিকেশ এখান থেকে মাইল পনের। হরিদ্বারে কিছুই দেখবার নেই, গঙ্গার ঘাটটা পর্যন্ত আগেরবার যা দেখেছিলাম তেমন আর নেই। বিশ্রী দেখতে সব নতুন বাড়ি উঠেছে আর তাদের দেয়াল জোড়া বিজ্ঞাপন। হৃষিকেশে যাওয়া দরকার কারণ আমাদের রুদ্রপ্রয়াগে থাকার বন্দোবস্ত করতে হবে। ইচ্ছে করলে ধরমশালায় থাকা যায়; এখানে প্রায় সব শহরেই বহুদিনের পুরোন নাম করা কালীকমলী ধরমশালা রয়েছে, কিন্তু ফেলুদা জানে যে রূপনারায়ণগড়ের ছোটকুমার ওসব ধরমশালায় থাকবে না।
আমরা হৃষীকেশে গিয়ে গাড়ওয়াল মণ্ডল বিকাশ নিগমের রেস্ট হাউসে একটা ডবলরুম পেয়ে গেলাম। ওরা বলল যে, তিনজন লোক হলে বাড়তি একটা খাটিয়া পেতে দেবে। বারোটা নাগাদ খেয়ে আমরা রওনা দিয়ে দিলাম রুদ্রপ্রয়াগ। কয়েক মাইল যাবার পর ডাইনে পড়ল লছমনঝুলা। এখানেও দুদিকে বিশ্রী বিশ্রী নতুন বাড়ি আর হোটেল হয়ে জায়গাটার মজাই নষ্ট করে দিয়েছে। তাও বাদশাহী আংটির শেষ পর্বের ঘটনা মনে করে গা-টা বেশ ছম ছম করছিল।
রুদ্রপ্রয়াগ জরুরী দুটো কারণে। এক হল জিম করবেট। দ্য ম্যানইটিং লেপার্ড অফ রুদ্রপ্রয়াগ যে পড়েছে সে কোনোদিন ভুলতে পারবে না কী আশ্চর্য ধৈর্য, অধ্যবসায়, আর সাহসের সঙ্গে করবেট মেরেছিল এই মানুষখেকোকে আজ থেকে পঞ্চান্ন বছর আগে। আমাদের ড্রাইভার যোগীন্দর বলল সে ছেলেবেলায় তার বাপ-ঠাকুর্দার কাছে শুনেছে এই বাঘ মারার গল্প। করবেট যেমন ভালোবাসত এই গাড়োয়ালীদের, গাড়োয়ালীরাও ঠিক তেমনই ভক্তি করত করবেটকে।
রুদ্রপ্রয়াগের আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে—এখান থেকে বদ্রী ও কেদার দু জায়গাতেই যাওয়া যায়। দুটো নদী এসে মিশেছে রুদ্রপ্রয়াগে—মন্দাকিনী আর অলকনন্দা। অলকনন্দা ধরে গেলে বদ্রীনাথ আর মন্দাকিনী ধরে গেলে কেদারনাথ। বদ্রীনাথের শেষ পর্যন্ত বাস যায়; কেদারনাথ যেতে বাস থেমে যায় ১৪ কিলোমিটার আগে গৌরীকুণ্ডে। সেখান থেকে হয় হেঁটে, না হয় ডাণ্ডি বা টাট্টু ঘোড়া ভাড়া করে যাওয়া যায়।
হৃষিকেশ থেকে বেরিয়েই বনের মধ্যে দিয়ে পাহাড়ে পথ আরম্ভ হয়ে গেল। পাশ দিয়ে বয়ে চলছে স্থানীয় লোকেরা বলে থাকে গঙ্গা মাঈ। হৃষিকেশ থেকে রুদ্রপ্রয়াগ ১৪০ কিলোমিটার; পাহাড়ে রাস্তায় ঘণ্টায় ৩০ কিলোমিটার করে গেলেও সেই সন্ধ্যার আগে পৌঁছান যাবে না। তাছাড়া পথে তিনটে জায়গা পড়ে—দেবপ্রয়াগ, কীর্তিনগর, আর শ্রীনগর। এই শ্রীনগর কাশ্মীরের রাজধানী নয়, গাড়ওয়াল জেলার রাজধানী।
পাহাড় ভেদ করে বনের মধ্যে দিয়ে কেটে তৈরি করা রাস্তা একবার ঘুরে ঘুরে উঠছে, একবার ঘুরে ঘুরে নামছে। মাঝে মাঝে গাছপালা সরে গিয়ে খোলা সবুজ পাহাড় বেরিয়ে পড়ছে, তারই কোলে ছবির মতো ছোট ছোট গ্রাম দেখা যাচ্ছে।
দৃশ্য সুন্দর ঠিকই, কিন্তু আমার মন কেবলই বলছে ভবানী উপাধ্যায়ের কাছে একটা মহামূল্য লকেট রয়েছে। একজন সন্ন্যাসীর কাছে এমন একটা জিনিস থাকবে, আর তাই নিয়ে কোনো গোলমাল হবে না এটা যেন ভাবাই যায় না। তাছাড়া মিঃ পুরীর একবার ফেলুদাকে কাজের ভার দিয়ে, তারপরই টেলিগ্রাম করে বারণ করাটাও কেমন যেন গণ্ডগোল লাগছে। অবশ্য তিনি চিঠিতে কারণ দিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু এ জিনিস এর আগে কক্ষনো হয়নি বলেই বোধহয় একটা খট্কা মন থেকে যাচ্ছে না।
লালমোহনবাবু কিছুক্ষণ থেকেই উস্খুস্ করছিলেন, এবার বললেন, ‘আমি ভূগণ্ডগোল আর ইতিহাঁসফাঁশে চিরকালই কাঁচা ছিলাম ফেলুবাবু—সেটাত আপনি আমার লেখা পড়েও অনেকবার বলেছেন। তাই, মানে, আমরা ভারতবর্ষের এখন ঠিক কোনখানে আছি সেটা একটু বলে দিলে নিশ্চিন্ত বোধ করব।’
ফেলুদা তার বার্থোলোমিউ কোম্পানির বড় ম্যাপটা খুলে বুঝিয়ে দিল। ‘এই যে দেখুন হরিদ্বার। আমরা এখন যাচ্ছি এই দিকে। এই যে রুদ্রপ্রয়াগ। অর্থাৎ পূবে নেপাল, পশ্চিমে কাশ্মীর, আমরা তার মধ্যিখানে, বুঝেছেন?’
‘হ্যাঁঃ। এই বারে ক্লিয়ার।’
রুদ্রপ্রয়াগ
পথে শ্রীনগরে থেমে চা খেয়ে রুদ্রপ্রয়াগ পৌঁছতে পৌঁছতে হয়ে গেল প্রায় পাঁচটা। ইস্কুল কলেজ হাসপাতাল পোস্টাপিস থানা সব মিলিয়ে রুদ্রপ্রয়াগ বেশ বড় শহর। করবেট যেখানে লেপার্ডটা মেরেছিল সেখানে অনেকদিন পর্যন্ত নাকি একটা সাইনবোর্ড ছিল, কিন্তু যোগীন্দর বলল সেটা নাকি কয়েক বছর হল ভেঙে গেছে।
আমরা সোজা চলে গেলাম গাড়ওয়াল নিগম রেস্ট হাউসে। শহরের একটু বাইরে সুন্দর নিরিবিলি জায়গায় তৈরি রেস্ট হাউসে গিয়ে যে খবরটা প্রথমেই শুনলাম সেটা হল যে কেদারনাথের রাস্তায় এক জায়গায় ধস নামাতে নাকি বাস চলাচল বেশ কয়েকদিন বন্ধ ছিল, আজই আবার নতুন করে শুরু হয়েছে। এতে যে আমাদের একটা বড়রকম সুবিধে হয়েছিল সেটা পরে বুঝেছিলাম।
ম্যানেজার মিঃ গিরিধারী ফেলুদাকে না চিনলেও আমাদের খুব খাতির করলেন। উনি নাকি হিন্দি অনুবাদে বহু বাংলা উপন্যাস পড়ে খুব বাঙালী ভক্ত হয়ে পড়েছেন। ওঁর ফেভারিট অথরস হচ্ছেন বিমল মিত্র আর শংকর।
মিঃ গিরিধারী ছাড়াও আরেকজন ভদ্রলোক ছিলেন রেস্ট হাউসে,তিনি কেদারের পথ বন্ধ বলে আটকা পড়ে গিয়েছিলেন। ইনি কিন্তু ফেলুদাকে দেখে চিনে ফেললেন। বললেন, ‘আমি একজন সাংবাদিক, আমি আপনার অনেক কেসের খবর জানি; সেভেনটি নাইনে এলাহাবাদে সুখতঙ্কর মাডার কেসে আপনার ছবি বেরিয়েছিল নর্দার্ন ইণ্ডিয়া পত্রিকায়। সেই থেকেই আমি আপনাকে চিনেছি। আমার নাম কৃষ্ণকান্ত ভার্গব। আই অ্যাম ভেরি প্রাউড টু মিট ইউ, স্যার।’
ভদ্রলোকের বছর চল্লিশেক বয়স, চাপদাড়ি, মাঝারি গড়ন। মিঃ গিরিধারী স্বভাবতই ফেলুদার পরিচয় পেয়ে ভারী উত্তেজিত হয়ে পড়লেন। —‘দেয়ার ইজ নো ট্রাবল হিয়ার আই হোপ?”
‘ট্রাব্ল সর্বত্রই হতে পারে, মিঃ গিরিধারী, তবে আমরা এসেছি একটা অন্য ব্যাপারে। আপনাদের এখানে ভবানী উপাধ্যায় বলে একজন ভদ্রলোক—’
‘উপাধ্যায় ত এখানে নেই,’ বলে উঠলেন সাংবাদিক মিঃ ভার্গব। ‘আমি ত ওঁকে নিয়েই একটা স্টোরি করব বলে এখানে এসেছি। হরিদ্বারে গিয়ে শুনলাম উনি রুদ্রপ্রয়াগ গেছেন; এখন এখানে এসে শুনছি তিনি খুব সম্ভবত কেদারনাথ গেছেন। আমি তাই কাল সকালে কেদার যাচ্ছি ওঁর খোঁজে। হি ইজ এ মোস্ট ইন্টারেস্টিং ক্যারাকটার, মিঃ মিটার।’
‘আমি অবিশ্যি ওঁর অসুখ সারানোর কথা শুনেছি,’ বলল ফেলুদা। তারপর লালমোহনবাবুর দিকে দেখিয়ে চাপা গলায় বলল, ‘আমার এই বন্ধুটির মাঝে মাঝে একটা মস্তিষ্কের ব্যারামের মতো হয়। ভুল বকেন, সামান্য ভায়োলেন্সও প্রকাশ পায়। তাই একবার ওঁকে দেখাব ভাবছিলাম। কলকাতার অ্যালোপ্যাথি হোমিওপ্যাথিতে কোনো কাজ দেয় নি।’
লালমোহনবাবু প্রথমে কেমন থতমত খেয়ে, তারপর ফেলুদার কথা সত্যি প্রমাণ করার জন্য মুখে একটা হিংস্র ভাব আনার চেষ্টা করলেন যেটা আমাদের একটা নেপালি মুখোশ আছে সেটার মতো দেখাল।
‘তাহলে আপনাদের ওই কেদার-বদ্রী যাওয়া ছাড়া গতি নেই’, বললেন মিঃ ভার্গব। ‘আমি বদ্রী গিয়ে ওঁকে পাইনি। অবিশ্যি উনি নাকি সন্ন্যাসী হয়ে গেছেন, তাই নামও হয়ত বদলে নিয়েছেন।’
এই সময় রেস্টহাউসের গেটের বাইরে একটা আমেরিকান গাড়ি থামল, আর তার থেকে তিনজন ভদ্রলোক নেমে আমাদের দিকে এগিয়ে এলেন। এদের যিনি দলপতি, তাঁকে চিনতে মোটেই অসুবিধা হল না, কারণ তাঁরই রঙীন ছবি রয়েছে ফেলুদার কাছে। ইনি হলেন রূপনারায়ণগড়ের ছোটকুমার বিলিয়ার্ড চ্যাম্পিয়ন পবনদেও সিং। অন্য দুজন নির্ঘাৎ এঁর চামচা।
আমরা পাঁচজন এতক্ষণ বাংলোর সামনের বারান্দায় বসে চা খাচ্ছিলাম, এবার আরো তিনজন লোক বাড়ল। পবনদেও একটা বেতের চেয়ার দখল করে বললেন, ‘আমরা বদ্রীনাথ থেকে আসছি। নো লাক্। উপাধ্যায় ওখানে নেই।’
মিঃ গিরিধারী বললেন, ‘আশ্চর্য ব্যাপার এই যে, আমার এখানে যতজন অতিথি এসেছেন সকলেই উপাধ্যায়ের খোঁজ করছেন, এবং প্রত্যেকে বিভিন্ন কারণে। আপনি ওঁর ছবি তুলবেন, মিঃ ভার্গব ওঁকে ইন্টারভিউ করবেন, আর মিঃ মিটার তাঁর বন্ধুর চিকিৎসা করাবেন।’
পবনদেও-এর দলের সঙ্গে যে টেলিভিশনের যন্ত্রপাতি রয়েছে। ক্যামেরাটা পবনদেবও-এর নিজের হাতে, আর তাতে লাগানো একটা পেল্লায় লেন্স।
‘ওটা ত আপনার টেলি লেন্স দেখছি,’ ফেলুদা মন্তব্য করল।
পবনদেও ক্যামেরাটা টেবিলের উপর রেখে বলল, ‘হ্যাঁ। সকালের রোদে বদ্রীনাথের চুড়ো থেকে বরফ গলে গলে পড়তে দেখা যায়। অ্যাকচুয়েলি আমার পুরো সরঞ্জাম একজনে হ্যাণ্ডল করতে পারে। ক্যামেরা, সাউণ্ড, সব কিছু। আমার এই দুই বন্ধু থাকবেন গৌরীকুণ্ড পর্যন্ত। বাকিটা আমি একাই তুলব।’
‘তার মানে আপনিও কেদারনাথ যাচ্ছেন?’
‘হ্যাঁ। কাল ভোরেই বেরিয়ে পড়ছি।’
‘আপনি ভবানী উপাধ্যায়কে নিয়ে ফিল্ম তুলছেন?’
‘হ্যাঁ। অস্ট্রেলিয়ান টেলিভিশনের জন্য। উপাধ্যায় মানে, তার সঙ্গে হরিদ্বার-হৃষিকেশ কেদার-বদ্রীও কিছু থাকবে। তবে সেন্ট্রাল ক্যারেকটার হবেন ভবানী উপাধ্যায়। আশ্চর্য চরিত্র। উনি আমার বাবার হাঁপানি যে ভাবে সারিয়েছিলেন সেটা একটা মিরাক্ল।
আমি আড়চোখে পবনদেওকে লক্ষ করে যাচ্ছিলাম। মিঃ উমাশঙ্কর পুরী যে চরিত্র বর্ণনা করেছিলেন তার সঙ্গে কোনো মিল পাচ্ছিলাম না। ফেলুদা দেখলাম উমাশঙ্কর পুরীর কোনো উল্লেখ করল না।
রুদ্রপ্রয়াগে পৌঁছানর সময় একটা হোটেল দেখে রেখেছিলাম, সেইখানেই আমরা তিনজন গিয়ে ডিনার সারলাম। বয় যখন অর্ডার নিতে এল, তখন লালমোহনবাবু হঠাৎ ভীষণ তেজের সঙ্গে টেবিলের উপর একটা ঘুষি মেরে একটা গোলমরিচদান উল্টে দিয়ে বললেন তিনি আরমাডিলোর ডিমের ডালনা খাবেন। তখন ফেলুদার তাঁকে বুঝিয়ে বলতে হল যে যাদের কাছে ওঁর অসুখের কথাটা বলা হয়েছে, শুধু তাদের সামনেই এই ধরনের ব্যবহার চলতে পারে, অন্য সময় নয়। বিশেষ করে ভায়োলেন্সটা যারতার সামনে দেখাতে গেলে হয়ত লালমোহনবাবুকেই প্যাদানি খেতে হবে।
‘তা বটে’; বললেন লালমোহনবাবু। ‘তবে অপরচুনিটি পেলে কিন্তু ছাড়বনা।’
পরদিন ভোরে উঠতে হবে বলে আমরা খাওয়ার পর্ব শেষ করেই রেস্ট হাউসে চলে এলাম। কেউ কোনো হুম্কি চিঠি দিয়ে যায়নি ত এই ফাঁকে? আমাদের আবার এই জিনিসটার একটা ট্র্যাডিশন আছে। কিন্তু না; এদিক ওদিক দেখেও তেমন কিছু পেলাম না।
আমাদের দুটো ঘর পরেই যে পবনদেও তার দুই বন্ধু আর মিঃ গিরিধারীকে নিয়ে পানীয়ের সদ্ব্যবহার করছেন সেটা গেলাসের টুংটাং আর দমকে দমকে হাসি থেকেই বুঝতে পারছিলাম।
লালমোহনবাবু তার বালিশে মাথা দিয়ে বললেন, ‘একটা কথা কিন্তু বলতেই হবে ফেলুবাবু—সেদিন আপনার ঘরে বসে পুরী সাহেব ছোটকুমার সম্বন্ধে যাই বলে থাকুন না কেন, আমার কিন্তু ভদ্রলোককে বেশ মাই ডিয়ার বলেই মনে হচ্ছে।’
ফেলুদা বলল, ‘প্রকৃতি কিন্তু অনেক হিংস্র প্রাণীকেই সুন্দর করে সৃষ্টি করেছে। বাংলার বাঘের চেয়ে সুন্দর কোনো প্রাণী আছে কি? ময়ূরের ঠোকরানিতে যে কী তেজ আছে তা তো আপনি জানেন, জানেন না?’
লালমোহনবাবু তাঁর অ্যালার্ম ক্লকের চাবিটায় একটা মোচড় দিয়ে চোখে একটা হিংস্র উন্মাদ ভাব এনে বললেন, ‘পোপোক্যাটাপেটাপোটোপুলটিশ!’
পবনদেওর আমেরিকান গাড়ি
আমরা ঠিক সাড়ে পাঁচটার সময় ট্যাক্সির সামনে গিয়ে হাজির হলাম। যোগীন্দররাম তার আগেই রেডি। আমাদের গাড়ির কাছেই পবনদেও-এর আমেরিকান গাড়িতে মাল তোলা হচ্ছে। ও গাড়ি আধ ঘণ্টার আগে বেরোতে পারবে বলে মনে হয় না। তবে এও ঠিক যে মাঝপথে ও আমাদের ছাড়িয়ে যাবে।
ট্যাক্সিতে যখন উঠতে যাব, তখন ছোটকুমার হঠাৎ আমাদের দিকে এগিয়ে এলেন। বোঝাই যাচ্ছে কিছু বলার আছে।
ভদ্রলোক ফেলুদাকে উদ্দেশ করে বললেন, ‘কাল রাত্রে মিঃ গিরিধারী নেশার ঝোঁকে আপনার আসল পরিচয়টা আমাদের দিয়ে দিয়েছেন। আমি আপনাকে একটা সোজা প্রশ্ন করতে চাই।’
‘বলুন।’
‘উমাশঙ্কর কাকা কি আমার উপর চোখ রাখার জন্য আপনাকে এ কাজে বহাল করেছেন?’
‘তিনি যদি সেটা করেও থাকতেন, বলল ফেলুদা, ‘সেটা আমি নিশ্চয়ই আপনার কাছে প্রকাশ করতাম না, কারণ সেটা নীতিবিরুদ্ধ এবং বোকামি হত। তবে আমি আপনাকে বলেই দিচ্ছি—আসলে আমি মিঃ পুরীর হয়ে কিছু করছি না। আমাদের এখানে আসার প্রধান উদ্দেশ্য ভ্রমণ। তবে যদি কোনো গণ্ডগোল দেখি তাহলে গোয়েন্দা হয়ে আমার নিজেকে সংযত রাখা খুবই মুশকিল হবে। ভবানী উপাধ্যায় সম্পর্কে আমার নিজেরও একটা প্রবল কৌতূহল জেগে উঠেছে। তার একটা বিশেষ কারণ আছে, যদিও এখনো সেটা প্রকাশ করতে পারছি না।’
‘আই সী।’
‘এবার আমি আপনাকে একটা প্রশ্ন করতে পারি?’
‘করুন।’
‘আপনি কি আপনার ফিল্মে সেই বিখ্যাত লকেটটি দেখাতে চান?’
‘নিশ্চয়ই। অবিশ্যি সেটা যদি এখনো উপাধ্যায়ের কাছে থেকে থাকে।’
‘কিন্তু উপাধ্যায়ের কাছে যে ওরকম একটা জিনিস আছে সেটা জানাজানি হয়ে গেলে ত ওঁর জীবন বিপন্ন হয়ে উঠবে। এতদিন যে ব্যাপারটা গোপন ছিল সেটা আপনি প্রচার করে দেবেন?’
‘মিঃ মিত্তির, তিনি যদি সত্যিই সন্ন্যাসী হয়ে থাকেন তাহলে ত তাঁর আর ও জিনিসের কোনো প্রয়োজনই থাকতে পারে না। আমি ওঁকে বলব একটা কোনো বড় মিউজিয়ামে ওটা দান করে দিতে। জিনিসটা চারশো বছর আগে ত্রিবাঙ্কুরের রাজার ছিল। কারিগরির দিক দিয়ে অতুলনীয়। উনি ওটা ডোনেট করলে চিরকাল ওঁর নাম ওই লকেটের সঙ্গে জড়িত থাকবে। মোটকথা, ওই লকেট আমি ছবিতে দেখাচ্ছি, এবং সেখানে আপনি আশা করি কোনো বাধা দিতে চেষ্টা করবেন না।’
শেষের কথাটা বেশ দাপটের সঙ্গেই বলে ছোটকুমার তার গাড়িতে ফিরে গেলেন। এবার তাঁর জায়গায় সাংবাদিক মিঃ ভার্গব এসে বললেন, ‘আপনারা তিনজন আছেন জানলে ত আপনাদের সঙ্গেই যাওয়া যেত। উপাধ্যায় সম্বন্ধে আমি যে সব তথ্য আবিষ্কার করেছি সেগুলো আপনাকে বলতে পারতাম।’
‘আপনার এই তথ্যের সোর্স কী?’ ফেলুদা জিগ্যেস করল।
‘কিছু দিয়েছেন রূপনারায়ণগড়ের বড় কুমার সূরযদেও, কিন্তু আসল তথ্য দিয়েছে রাজবাড়ির এক আশি বছরের বুড়ো বেয়ারা। আপনি কি জানেন যে রূপনারায়ণগড়ের রাজা চন্দ্রদেও সিং-এর হাঁপানি উপাধ্যায় সারিয়ে দিয়েছিলেন?’
‘তাই বুঝি?’
‘আর তার জন্য রাজা তাঁকে ইনাম দিয়েছিলেন ওয়ান অফ হিজ মোস্ট প্ৰেশাস অর্নামেন্টস। এ খবর এতদিন ওদের ফ্যামিলির বাইরে কেউ জানত না। আপনি ভাবতে পারেন খবরের কাগজের কাছে এই ঘটনার কী দাম?’
‘আপনি ত তাহলে রাজা হয়ে যাবেন, মিঃ ভার্গব!’
‘আমি আপনাকে বলছি মিঃ মিত্তর, এই লকেট উপাধ্যায়ের কাছে বেশিদিন থাকবে না। আপনি কি ছোটকুমারের কথায় বিশ্বাস করেন যে ও শুধু টি ভি ছবি তুলতে এসেছে? আমি বলছি আপনাকে, এখানে শিগগিরই আপনার নিজের পেশার আশ্রয় নিতে হবে।’
‘তার জন্য আমি সদা প্রস্তুত’, বলল ফেলুদা।
মিঃ ভার্গব চলে গেলেন।
‘লোকটা ত ঘোড়েল আছে, মশাই,’ বললেন লালমোহনবাবু।
‘সাংবাদিক মাত্রেই ঘোড়েল, বলল ফেলুদা। ‘গোয়েন্দাগিরিতে ওরাও কম যায় না। রাজবাড়ির পুরনো বেয়ারাকে জেরা করায় ও খুব বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছে। চাকররা অনেক সময় এমন খবর রাখে যা মনিবেরা জানতেই পারে না। কিন্তু তাও—’
‘তাও কী?’ আমি জিগ্যেস করলাম। আমি বুঝতে পারছিলাম ফেলুদার মনটা খচখচ করছে।
‘তাও যে কেন লোকটাকে দেখে অসোয়াস্তি লাগছে তা বুঝতে পারছি না।’
আমাদের গাড়ি রুদ্রপ্রয়াগ থেকে রওনা হয়ে অলকনন্দার পাশ দিয়ে কিছুদূর গিয়ে হঠাৎ একটা টানেলে ঢুকে পড়ল। সেই টানেল থেকে যখন আবার আলোয় বেরোলাম, তখন নদী পালটে গিয়ে হয়ে গেছে মন্দাকিনী। এটাই এখন চলবে আমাদের সঙ্গে সঙ্গে কেদার পর্যন্ত। কেদার থেকেই। নাকি মন্দাকিনীর উৎপত্তি।
ফেলুদার ভ্রূকুটি থেকেই বুঝতে পারছিলাম কোনো একটা কারণে ওর বিরক্ত লাগছে, এবারে ওর কথায় বুঝতে পারলাম।
‘আমার সমস্ত রাগটা পড়ছে ওই গিরিধারী লোকটার উপর। ও যে এত ইরেসপনসিব্ল তা ভাবতে পারিনি। ছোটকুমার এখন যে কথাগুলো বললেন সেগুলো অবিশ্যি ওঁর পক্ষে স্বাভাবিক, তবে আশ্চর্য লাগছে জেনে যে মিঃ পুরীর সঙ্গে ওঁর আর দ্বিতীয়বার কোনো কথাই হয়নি। সেক্ষেত্রে মিঃপুরীর চিঠি, টেলিগ্রাম দুটোই রহস্যজনক হয়ে উঠছে। অবিশ্যি সবই নির্ভর করছে কে সত্যি বলছে কে মিথ্যে বলছে তার উপর। মোটকথা, কেস ড্রপ করলেও, এখানে আসার সিদ্ধান্ত যে ড্রপ করিনি সেটা খুব ভাগ্যের কথা।’
গৌরীকুণ্ড রুদ্রপ্রয়াগ থেকে আশি কিলোমিটার হলেও এত চড়াই-উৎরাই আর এত ঘোরপ্যাঁচের রাস্তা যেতে বেশ সময় লাগে। পথে তিনটে শহর পড়ে। ৩০ কিলোমিটারের মাথায় অগস্ত্যমুনি, হাইট আন্দাজ ৯০০ মিটার; সেখান থেকে ৯ কিলোমিটার দূরে গুপ্তকাশী—যদিও হাইট এইটুকুর মধ্যে বেড়ে যাচ্ছে ডবল। গুপ্তকাশী থেকে শোনপ্রয়াগ, যেখানে শোনগঙ্গা মন্দাকিনীর সঙ্গে এসে মিশেছে। এই শোনপ্রয়াগ থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে হল গৌরীকুণ্ড—যদিও সেখানে গিয়ে হাইট হয়ে যাচ্ছে সোয়া দুহাজার মিটার।
আমাদের গরম জামা যাতে প্রয়োজন হলে সহজেই বার করে নেওয়া যায় তার ব্যবস্থা আমরা করে নিয়েছিলাম। বড় সুটকেস জাতীয় মাল আমাদের সঙ্গে যা ছিল তা সবই গাড়ওয়াল নিগম রেস্ট হাউসের লকারে রেখে দিয়ে এসেছি, ফেরার সময় আবার নিয়ে যাব। লালমোহনবাবুর টাকের জন্য উনি এর মধ্যেই টুপি পরে নিয়েছেন , যদিও আমাদের বাঙালী মাঙ্কি ক্যাপ না; রাজস্থান থেকে কেনা কান-ঢাকা পশমের লাইনিং দেওয়া স্মার্ট চামড়ার টুপি।
অগস্ত্যমুনি পৌঁছে গাড়ি থামিয়ে যখন আমরা গরম জামা পরছি, তখন আমাদের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল পবনদেও-এর আমেরিকান টুরার। ছোটকুমার জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে ওয়েভ করাতে ফেলুদাকেও হাত নাড়াতে হল।
আমরা শীতের সঙ্গে লড়াই করবার জন্য তৈরী হয়ে আবার রওনা দিলাম। বাঁয়ে মন্দাকিনী একবার আমাদের পাশে চলে আসছে, আবার পরক্ষণেই নেমে যাচ্ছে সেই খাদের একেবারে নিচে। নদীর শব্দ ছাপিয়ে শোনা যাচ্ছে লালমোহনাবুর সুর করে বলা, ‘ওরে তোরা কি জানিস কেউ, জলে কেন এত ওঠে ঢেউ’। আমার দৃঢ় বিশ্বাস উনি পুরো কবিতাটার কেবলমাত্র ওই দুটো লাইনই জানেন।
শেষে ফেলুদা আর থাকতে না পেরে লাইন যোগ করতে শুরু করে দিল—ওরে তোরা কি জানিস কেউ, কেন বাঘ এলে ডাকে ফেউ..ওরে তোরা কি শুনিস কেউ কুকুরের ঘেউ ঘেউ, খোকা কাঁদে ভেউ ভেউ…
গুপ্তকাশী যখন পৌঁছলাম তখন বেজেছে দশটা। এখানে একটা চায়ের দোকান দেখে থামতে হল। যাকে ব্রেকফাস্ট বলে সেটা সকালে হয়নি, কাজেই খিদেটা ভালোই হয়েছিল। গরম জিলিপি, কচুরি আর চা দিয়ে দিব্যি ব্রেকফাস্ট হয়ে গেল।
যোগীন্দরের এক ভাই কাছেই থাকে, সে বলল তার সঙ্গে পাঁচ মিনিটের জন্য দেখা করে আসছে। সেই ফাঁকে লালমোহনবাবু চন্দ্রশেখর মহাদেব আর অর্ধনারীশ্বরের মন্দিরগুলো দেখতে গেলেন।
গুপ্তকাশী থেকে পাহাড়ের উপর দেখা যায় উখীমঠ। নভেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত কেদারের পথ যখন বরফের জন্য বন্ধ থাকে তখন কেদারেশ্বরের পুজো এই উখীমঠেই হয়ে থাকে।
লালমোহনবাবু মন্দির দেখে ফিরে এলেন, কিন্তু যোগীন্দরের ফেরার নাম নেই। ফেলুদা আর আমি ব্যস্তভাবে এদিক ওদিক দেখছি। এমন সময় দেখি ছোটকুমারের গাড়ি আসছে। ওরা আমাদের পেরিয়ে গিয়ে আবার পিছিয়ে পড়ল কেন?
আমাদের দেখে গাড়ি থামিয়ে কুমার নেমে এলেন। বললেন গুপ্তকাশী থেকে নাকি কেদার ও বদ্রী দুটো চুড়োরই ভিউ পাওয়া যায়, তাই ওঁরা এখানে কিছুটা সময় দিলেন। তবে আর দেরি করলে চলবে না, কারণ তাহলে যাত্রীদের রওনা দেবার দৃশ্য তোলার জন্য আর আলো থাকবে না।
কিন্তু তাও যোগীন্দরের দেখা নেই। তার বদলে দেখা দিলেন সাংবাদিক মিঃ ভার্গব। তাঁর গাড়িটা আগে দেখেছিলাম, আর ভাবছিলাম তিনি এখানে এতক্ষণ কী করছেন। ভদ্রলোক বললেন যে কেদারনাথের সেবায়েতের একজন নাকি এখানে রয়েছেন। এরা সকলেই রাওয়াল পরিবারের লোক; এই বিশেষ রাওয়ালটির সঙ্গে নাকি একটা ইন্টারভিউ নিতে গিয়েছিলেন মিঃ ভার্গব। এখনই আবার তাঁকে ছুটতে হবে শোনপ্রয়াগ হয়ে গৌরীকুণ্ড।
মিঃ ভার্গব চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে একটা বছর পনেরর ছেলে হঠাৎ এসে ‘ফোর-থার্টি-ফোর ট্যাক্সি কি কোই পাসিঞ্জর হ্যায় ইঁহা?’ বলে হাঁক দিতেই ফেলুদা ব্যস্তভাবে তার দিকে এগিয়ে গেল।
‘ফোর-থ্রী-ফোর কি পাসিঞ্জর?’
‘হ্যাঁ। কেন, কী হয়েছে?’
ব্যাপার আর কিছুই না, আমাদের গাড়ির ড্রাইভার জখম হয়ে পড়ে আছে কিছু দূরে। ছেলেটি তাকে চেনে বলে সে খবর দিতে এসেছে।
লালমোহনবাবুকে আমাদের জিনিসপত্র পাহারা দেবার জন্য রেখে আমরা দুজন ছেলেটাকে অনুসরণ করে গেলাম।
পাঁচ সাতটা বাড়ি নিয়ে একটা নিরিবিলি পাড়ায় একটা কলাগাছের ধারে যোগীন্দররাম মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। তার মাথার পিছন দিকের ঘন কালো চুলে রক্তের ছোপ। শরীরের ওঠানামা থেকে বোঝা যাচ্ছে সে মরেনি, কিন্তু ফেলুদা তাও দৌড়ে গিয়ে তার নাড়ী পরীক্ষা করল।
কে এই কুকীর্তি করেছে এ নিয়ে চিন্তা করার সময় নেই; এখন দরকার ওর চিকিৎসা। ছোকরাটি বলল এখানে হাসপাতাল দাওয়াখানা দুইই আছে। সে আবার গাড়িও চালাতে জানে। শেষ পর্যন্ত সে-ই নিজে ট্যাক্সি চালিয়ে যোগীন্দরকে হাসপাতালে নিয়ে গেল।
সব মিলিয়ে ঘণ্টা দেড়েক দেরি হয়ে গেল। যোগীন্দরের মাথায় ব্যাণ্ডেজ, ব্যথাও আছে; তাকে বলা হল যে এখান থেকে অন্য ট্যাক্সির ব্যবস্থা করে দিলে আমরা তাতেই যাব। কিন্তু সে রাজি হল না। সে নিজেই যাবে আমাদের নিয়ে।
‘কে মেরেছিল কিছু বুঝতে পেরেছিলে?’ ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।
‘নেহী’, বলল যোগীন্দর, ‘পিছে সে আ কর মারা।’
‘এখানে তোমার কোনো দুষমণ আছে?’
‘কোই ভি নেহী।’
ফেলুদা কী ভাবছে সেটা আমি জানি। দুষমণ যদি থাকে ত সে আমাদের দুষমণ। আমাদের দেরি করিয়ে দেবার জন্য ব্যাপারটা করা হয়েছে। শত্রু কে আমরা বুঝতে না পারলেও, শত্রু যে রয়েছে তাতে সন্দেহ নেই।
আমরা রওনা হবার পর আমি ফেলুদাকে বললাম, ‘আচ্ছা, মিঃ পুরী যে তোমার কাছে এসেছিলেন, সেটা জানতে পেরে ছোটকুমার তাঁকে দিয়ে টেলিগ্রামটা করিয়ে চিঠিটা লেখায় নি ত?—যাতে তার কাজে ফেলু মিত্তির কোনো বাধার সৃষ্টি না করতে পারে?’
‘এটা তুই খুব ভাল ভেবেছিস তোপ্সে। আমারও কথাটা মনে হয়েছে। অবিশ্যি তার মানে এটাও বোঝা যায় যে,মিঃ পুরীর উপর এতটা কর্তৃত্ব করার ক্ষমতা ছোটকুমারের আছে।’
‘তা থাকবে না কেন,’ বললেন লালমোহনবাবু, ‘ছোটকুমার ইজ এ প্রিন্স, অ্যাণ্ড পুরী ইজ ওনলি এ কর্মচারী।’
‘ঠিক বলেছেন আপনি,’ বলল ফেলুদা, ‘এখানে বয়সের তফাৎটা কিছু ম্যাটার করে না। তবে হ্যাঁ—এটাও ঠিক যে টেলিগ্রাম আর চিঠি সত্ত্বেও যে আমি চলে আসব সেটা বোধহয় ছোটকুমার ভাবতেই পারেনি।’
‘তার মানে যোগীন্দরকে জখম ওরাই করিয়েছে?’
‘যোগীন্দর যখন বলছে এখানে ওর কোনো শত্রু নেই তখন আর কী হতে পারে?’
‘এক্সকিউজ মি স্যার,’, বললেন লালমোহনবাবু, ‘আমার কিন্তু ওই সাংবাদিক লোকটিকেও বিশেষ সুবিধের লাগছে না।’
‘কেন বলুন ত? আমার নিজেরও যে ভদ্রলোককে একেবারে আদর্শ চরিত্র বলে মনে হচ্ছে তা নয়, কিন্তু আপনার ভালো না-লাগার কারণটা জানার কৌতূহল হচ্ছে।’
‘সাংবাদিক হলে পকেটে কলম থাকবে না?’ বললেন লালমোহনবাবু। ‘বাইরের পকেটে ত নেই-ই, কাল যখন কোট পরছিল তখন দেখলাম বুক পকেটেও নেই, সার্টের পকেটেও নেই।’
‘আমার মতো যদি একটা মাইক্রোক্যাসেট রেকর্ডার থাকে?’
লালমোহনবাবু যেন কথাটা শুনে একটু দমে গেলেন। বললেন, ‘তা যদি হয় তাহলে অবশ্য আলাদা কথা। আসলে আমার চাপ দাড়ি দেখলেই কেমন যেন একটা সন্দেহ হয়।’
‘যাক্গে—এবার একটু কাজের কথায় আসা যাক।’
‘কী?’
‘আপনি কোনটা প্রেফার করবেন—ঘোড়া না ডাণ্ডি?’
‘ন্যাচারেলি আপনারা যেটা প্রেফার করবেন সেটাই। এক যাত্রায় ত আর পৃথক ফল হতে পারে না।’
‘কেদারের পথ সম্বন্ধে আপনার কিঞ্চিৎ ধারণা আছে আশা করি?’
‘হ্যাঃ হাঃ হাঃ হ্যাঃ!’
‘হাসছেন কেন?’
‘আমার ধারণাটা বোধহয় আপনার চেয়েও ভিভিড়, কারণ কেদার যাত্রা সম্বন্ধে এথিনিয়ামের বাংলা শিক্ষক বৈকুণ্ঠ মল্লিক যা লিখে গেছেন তার তুলনা লিটারেচরে বেশি পাবেন না। তপেশ, জান পোয়েমটা?’
‘না ত!’
‘শুনুন ফেলুবাবু।’
‘দাঁড়ান, সামনে দুটো ইউ-টার্ন আসছে, সেগুলো পেরিয়ে যাক। সোজা রাস্তা না পেলে আবৃত্তি করাও যায় না, শোনাও যায় না।’
মিনিট দশেক পরে একটা সোজা রাস্তা পেয়ে লালমোহনবাবু তাঁর আবৃত্তি আরম্ভ করলেন।—
“শহরের যত ক্লেদ, যত কোলাহল
ফেলি পিছে সহস্র যোজন
দেখ চলে কত ভক্তজন
হিমগিরি বেষ্টিত এই তীর্থপথে
শুধু আজ নয়, সেই পুরাকাল হতে—
সাথে চলে মন্দাকিনী
অটল গাম্ভীর্য মাঝে ক্ষিপ্রা প্রবাহিনী”—
এইবার হচ্ছে আসল ব্যাপার। শুনুন কি ভাবে ওয়ার্নিং দিচ্ছেন ভদ্রলোক যাত্রীদের—
“তবে শুন এবে অভিজ্ঞের বাণী—
দেবদর্শন হয় জেনো বহু কষ্ট মানি’
গিরিগাত্রে শীর্ণপথে যাত্রী অগণন
প্রাণ যায় যদি হয় পদস্খলন,
তাও চলে অশ্বারোহী, চলে ডাণ্ডিবাহী,
যষ্টিধারী বৃদ্ধ দেখ তাঁরও ক্লান্তি নাহি
আছে শুধু অটল বিশ্বাস
সব ক্লান্তি হবে দূর, পূর্ণ হবে আশ
যাত্রা অন্তে বিরাজেন কেদারেশ্বর
সর্বগুণ সর্বশক্তিধর
মহাতীর্থে মহাপুণ্য হবে নিশ্চয়
উচ্চকণ্ঠে বল সবে—কেদারের জয়!”
‘হুঁ,’ বলল ফেলুদা, ‘বোঝাই যাচ্ছে মল্লিক মশাই এ কবিতা লিখেছিলেন বাস-ট্যাক্সির যুগের অনেক আগে।’
‘সার্টেনলি,’ বললেন লালমোহনবাবু, ‘তাঁকে তীর্থযাত্রীর পুরো ধকল ভোগ করতে হয়েছিল।’
‘কিন্তু আমার প্রশ্ন হচ্ছে আপনি কি অশ্বারোহী হতে চান, না ডাণ্ডির দ্বারা বাহিত হতে চান, না পয়দল যেতে চান।’
‘সেটা সব ডিপেণ্ড করছে আপনাদের উপর। দলচ্যুত হবার প্রশ্ন ত আর উঠতে পারে না।’
‘আমি আর তোপ্সে ত হেঁটেই যাব স্থির করেছি। আপনার পক্ষে ডাণ্ডিটা সবচেয়ে নিরাপদ, কারণ ঘোড়াগুলোর টেণ্ডেন্সি হচ্ছে পথের যে দিকটায় খাদ, তার কানা ধরে চলা। সে টেনশন আপনার সহ্য হবে না।’
লালমোহনবাবু ভয়ঙ্কররকম গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘শুনুন ফেলুবাবু, আপনি কিন্তু আমার ক্ষমতাকে ক্রমান্বয়ে আণ্ডারএস্টিমেট করে চলেছেন। আমি গেলে হেঁটে যাব, আর নয়ত যাব না। এই আমার সোজা কথা।’
‘যাক্, তাহলে এটা সেট্লড,’ বলল ফেলুদা।
‘একটা প্রশ্ন আমি করতে পারি কি?’ বললেন লালমোহনবাবু—‘অবিশ্যি এটা জার্নি সম্বন্ধে নয়।’
‘নিশ্চয়ই পারেন।’
‘এরা ত মশাই আমাদের চিনে ফেলেছে; এখন কেদার গিয়ে আমরা করছিটা কী?’
‘সেটা সব নির্ভর করছে কে আগে উপাধ্যায়ের সন্ধান পায় তার উপর।’
‘ধরুন যদি আমরাই পাই।’
‘তাহলে তাঁকে সবিস্তারে ব্যাপারটা বলতে হবে। সন্ন্যাসী হয়ে তাঁর মনোভাব যদি বদলে গিয়ে থাকে, তাহলে হয়ত লকেটটা উনি আর নিজের কাছে রাখতে চাইবেন না। আমাদের কর্তব্য হবে তিনি সেটা কাকে দিয়ে যেতে চান তাঁর অনুসন্ধান করা—অবশ্য সেরকম লোক যদি কেউ থেকে থাকে। এর মধ্যে যদি ছোটকুমারও উপাধ্যায়ের সন্ধান পেয়ে যান, তাহলে তিনি হয়ত লকেটটার ছবি তুলতে চাইবেন। চন্দ্ৰদেও-এর ছেলে বলে উপাধ্যায় হয়ত স্নেহবশত তাতে রাজিও হয়ে যেতে পারেন। কিন্তু উপাধ্যায়ের অমতে পবনদেওকে কোনোমতেই লকেটটা হস্তগত করতে দেওয়া যায় না। অবিশ্যি সে যে সেটা হাত করতে চাইছে এমন বিশ্বাস করার কোনো কারণ এখনো ঘটেনি। আমরা শুধু অনুমান করছি যে সে-ই হুম্কি দিয়ে মিঃ পুরীকে চিঠি ও টেলিগ্রামটা পাঠাতে বাধ্য করেছিল। কিন্তু তারও এখনো কোনো প্রমাণ নেই। টেলিভিশনের ছবি তোলা ছাড়া তার আর কোনো উদ্দেশ্য নাও থাকতে পারে।’
আমি বললাম, ‘কিন্তু সাংবাদিক মিঃ ভার্গবও যে উপাধ্যায়ের খোঁজ করছেন।’
ফেলুদা বলল, ‘আমার বিশ্বাস ভার্গব যখন আসল ঘটনা জেনে গেছে। তখন তার শুধু দুটো ছবি পেলেই কাজ হয়ে যাবে—একটি উপাধ্যায়ের, একটি লকেটের। কারণ এই কাহিনী খবরের কাগজে প্রকাশিত হলে ভার্গবের অন্তত কিছুদিন আর অন্নচিন্তা থাকবে না।’
ইতিমধ্যে আমাদের গাড়িটা কিন্তু অত্যন্ত বেয়াড়ারকম চড়াই উঠে দশ হাজার ফুট বা সাড়ে তিন হাজার মিটারের উপর পৌঁছে গেল। অন্তত যোগীন্দর তাই বলল, আর সেই সঙ্গে বাইরের কনকনে শীতেও তার প্রমাণ পেলাম। এখন মাঝে মাঝে বরফের পাহাড়ের চুড়ো দেখা যাচ্ছে, কিন্তু কোনটা যে কোন শৃঙ্গ তা বুঝতে পারছি না। মিনিট পনেরর মধ্যেই গৌরীকুণ্ড পৌঁছে যাওয়া উচিত। ঘড়ি বলছে পাঁচটা পনের। দূরে পাহাড়ের চুড়োয় উজ্জ্বল রোদ থাকলেও আশেপাশের পাহাড়ে পাইন আর রডোডেনড্রনের বনে অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে।
একটা মোড় ঘুরে সামনে ঘর বাড়ি গাড়ি ঘোড়া ইত্যাদি দেখে বুঝলাম যে আমরা গৌরীকুণ্ডে এসে গেছি। এটাও বুঝলাম যে আজ রাতটা এখানেই থাকতে হবে। আমাদের কেদার যাত্রা শুরু হবে কাল ভোরে। আর ভোরে রওনা হলেও চোদ্দ কিলোমিটার চড়াই পথ যেতে সন্ধে হয়ে যাবে। অর্থাৎ আসল ঘটনা যা ঘটবার তা পরশুর আগে নয়।
বাস টারমিনাস হবার ফলে ছোট জায়গা হওয়া সত্ত্বেও গৌরীকুণ্ডে ব্যস্ততার শেষ নেই। ঘোড়া, ডাণ্ডি, কাণ্ডি, কুলি—এদের সঙ্গে দরদস্তুরী চলছে। কাণ্ডি জিনিসটা ঝুড়ি টাইপের। এতে করেও মানুষ যায়, যদিও দেখে মোটেই ভরসা হয় না।
এখানে রাত্রে থাকতে হবে জেনেও আগে কোন বন্দোবস্ত করিনি, কারণ জানি অন্তত একটা ধরমশালা কি চটি পেয়ে যাব। সত্যিই দেখা গেল জায়গার কোন অভাব নেই। এখানে পাণ্ডারা ঘর ভাড়া দেয়। বিছানা বালিশ লেপ কম্বল সবই দেয়। পাণ্ডারা বাঙালী না হলেও বাঙালী যাত্রী এত আসে যে এরা দিব্যি বাংলা শিখে গেছে। এদের থাকার ঘরগুলো হয় দোতলায়। বেঁটে বেঁটে ঘর, যার সীলিং-এ ফেলুদার প্রায় মাথা ঠেকে যায়। এই ঘরের নীচে থাকে সেইরকমই বেঁটে বেঁটে সার বাঁধা দোকান। সস্তার ব্যাপার, তবে আমাদের কথা হচ্ছে, রাত্তিরে ঘুমোন। সেই কাজটায় কোনো ব্যাঘাত হবে বলে মনে হল না।
আমরা এখানে এসেই ছোটকুমারের হলদে আমেরিকান গাড়িটা দেখেছিলাম। ওরা আমাদের চেয়ে ঘণ্টা চারেক আগে পৌঁছেছে নিশ্চয়ই। অর্থাৎ দুপুরে ঘোড়া নিয়ে রওনা হয়ে রাত্তিরের মধ্যে পৌঁছে যাবে। তার মানে কেদারে একটা পুরো দিনেরও বেশি সময় পাচ্ছে ছোটকুমার।
আমার ধারণা মিঃ ভার্গবও আজ রাত্তিরের মধ্যে পৌঁছে যাবেন।
আশ্চর্য এই যে সকলেরই উদ্দেশ্য এক—উপাধ্যায় মশাইয়ের সন্ধান করা।
পাঁচটার মধ্যে অ্যালার্ম
পাণ্ডাদের ঘরে গভীর ঘুমে রাত কাটিয়ে ভোর পাঁচটার মধ্যে আলার্ম বাজিয়ে উঠে আমরা তিনজনে বাইরে বেরিয়ে এলাম।
এত ভোরে বিভিন্ন দেশীয় এত যাত্রীর ভীড় এখানে জমায়েত হয়েছে। সেটা ভাবতেই পারিনি। এদের মধ্যে বাঙালী আছে প্রচুর, আর তাদের প্রায় সবাই দলে এসেছে। দল বলতে অবিশ্যি পরিবারও বোঝায়। সত্তর বছরের দাদু থেকে নিয়ে পাঁচ বছরের নাতনী পর্যন্ত, তার মধ্যে মাসি-পিসিও যে নেই তা নয়।
ভিড়ের মধ্যে হঠাৎ ক্যামেরা হাতে পবনদেওকে দেখে বেশ অবাক হলাম। তিনি ঘোড়া ভাড়া করেছেন দুটো—একটা নিজের জন্য, একটার পিঠে থাকবে সরঞ্জাম। আমাদের দেখে বললেন, শোনপ্রয়াগে নাকি অনেক ইন্টারেস্টিং ছবি তোলার ছিল, তাই কাল এসে পৌঁছাতে পৌঁছাতে বেশ রাত হয়েছে। আমাদের সঙ্গেই অবিশ্যি রওনা হচ্ছেন, তবে উনি থেমে থেমে ছবি তুলতে তুলতে যাবেন; ক্যামেরা ও সাউণ্ডের সরঞ্জাম থাকবে নিজের সঙ্গে—ফিল্ম, অর্থাৎ কাঁচামাল, থাকবে অন্য ঘোড়ার পিঠে।
ফেলুদা ছোটকুমারের কাছ থেকে সরে এসে বলল, ‘রহস্যের শেষ নেই। উনি কি তাহলে কেদারে লোক লাগিয়েছেন উপাধ্যায়কে খুঁজে বার করার জন্য?’
যাই হোক, এসব ভাববার সময় এখন নয়, কারণ আমাদের রওনা দেবার সময় এসে গেছে।
‘আপনি তাহলে দৃঢ়সংকল্প যে হেঁটেই যাবেন?’ ফেলুদা লালমোহনবাবুকে আবার জিজ্ঞেস করল।
‘ইয়েস স্যার,’ বললেন জটায়ু, ‘তবে হ্যাঁ, আপনাদের সঙ্গে তাল রেখে হাঁটতে পারব কিনা সে বিষয়—’
‘সে বিষয় আপনি আদৌ চিন্তা করবেন না। আপনি আপনার নিজের ক্ষমতা অনুযায়ী হাঁটবেন। গন্তব্য যখন এক, রাস্তা যখন এক, তখন পিছিয়ে পড়লেও চিন্তার কারণ কিছু নেই। এই নিন, এইটে হাতে নিন।’
আমরা তিনজনের জন্য তিনটে লাঠি কিনে নিয়েছি যার নিচের অংশটা ছুঁচোলো লোহা লাগানো। এ লাঠি এখন প্রত্যেক পদযাত্রীর হাতে। এর দাম দু’ টাকা, ফিরে এসে আবার ফেরত দিলে এক টাকা ফেরত পাওয়া যায়। তারই একটা ফেলুদা লালমোহনবাবুকে দিয়ে দিল।
আমরা ঘড়ি ধরে ছটায় রওনা দিলাম। লালমোহনবাবু যেরকম হাঁক দিয়ে ‘জয় কেদার’ বলে তাঁর প্রথম পদক্ষেপ নিলেন, আমার ত মনে হল তাতেই তাঁর অর্ধেক এনার্জি চলে গেল।
পাহাড়ের গা দিয়ে পাথরে বাঁধানো রাস্তা। শুধু যে শীর্ণ তা নয়, এক এক জায়গায় একজনের বেশি একসঙ্গে পাশাপাশি যেতে পারে না। একদিকে পাহাড়, একদিকে খাদ, খাদের নিচ দিয়ে বেগে বয়ে চলেছে মন্দাকিনী। দুদিকেই মাঝে মাঝে বড় বড় গাছ থাকার ফলে যাত্রীদের মাথার উপর একটা চাঁদোয়ার সৃষ্টি হয়েছে। তবে বেশির ভাগ অংশেই গাছপালা নেই, খালি শুক্নো ঘাস আর পাথর। পায়ে যারা হাঁটছে, তাদের মুশকিল হচ্ছে কি অশ্বারোহী আর ডাণ্ডিবাহীদের জন্য প্রায়ই তাদের পাশ দিতে হচ্ছে। এখানে নিয়মটা হচ্ছে কি সবসময়ই পাহাড়ের গা ঘেঁষে পাশ দেওয়া। খাদের দিকটায় গিয়ে পাশ দিতে গেলে পদস্খলনের সমূহ সম্ভাবনা।
যোগব্যায়াম করি বলে বোধহয় আমাদের দুজনের খুব একটা কষ্ট হচ্ছিল না। লালমোহনবাবুর পক্ষে ব্যাপারটা খুব শ্রমসাপেক্ষ হলেও উনি প্রাণপণ চেষ্টা করছিলেন সেটা যেন বাইরে প্রকাশ না পায়। চড়াই ওঠার সময় ত কথা বলা যায় না; এরপর খানিকটা সমতল রাস্তায় আমাদের কাছাকাছি পেয়ে বললেন, ‘তেনজিং নোরকের মাহাত্ম্যটা কোথায় সেটা এখন বুঝতে পারছি।’
মিনিট কুড়ি চলার পর একটা ঘটনা ঘটল যেটা আমাদের কেদার পৌঁছানটা আরো আধ ঘণ্টা পিছিয়ে দিল।
একটা বেশ বড় পাথরের খণ্ড পাহাড়ের গা দিয়ে হঠাৎ গড়িয়ে এল সোজা ফেলুদার দিকে। ব্যাপারটা সম্বন্ধে সচেতন হতে যে কয়েকটা মুহূর্ত গেল তাতেই কিছুটা ড্যামেজ হয়ে গেল। পাথরের ঘষা খেয়ে ফেলুদার হাতের এইচ এম টি ঘড়িটা চুরমার হয়ে গেল, আর আমাদের পাশের এক প্রৌঢ় যাত্রীর লাঠিটা হস্তচ্যুত হয়ে পাশের খাদ দিয়ে পাথরের সঙ্গে ঝড়ের বেগে গড়িয়ে নেমে গেল মন্দাকিনী লক্ষ্য করে।
ফেলুদা একটু হকচকিয়ে গেলেও সেটা মুহুর্তের জন্য। ওর শরীর যে কত মজবুত আর স্ট্যামিনা যে কী সাংঘাতিক সেটা বুঝলাম এই এতখানি খাড়াই পথ হাঁটার পর সে সোজা পাহাড়ের গা বেয়ে উপরে উঠে গেল। আমিও ওর পিছন পিছন গিয়েছিলাম, কিন্তু যতক্ষণে ওর কাছে পৌছলাম তার মধ্যেই ও একটা লোকের কলার চেপে তাকে একটা গাছে ঠেসে ধরেছে। লোকটার বয়স বছর পঁচিশের বেশি না। তার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে এবং সে স্বীকার করেছে যে পাথর ফেলার ব্যাপারে সে আরেকজনের আদেশ পালন করছিল। পকেট থেকে দশটা কড়কড়ে দশ টাকার নোট বার করে সে দেখিয়ে দিল কেন তাকে এমন একটা কাজ করতে রাজি হতে হয়েছে।
কে তাকে এই টাকা দিয়েছে জিজ্ঞেস করাতে সে বলল তারই এক অচেনা জাতভাই। বোঝাই গেল আসল লোক সে নয়, সে শুধু দালালের কাজ করেছে।
আপাতত ফেলুদা লোকটার গা থেকে একটা পশমের চাদর খুলে সেটা দিয়ে তাকে দু হাত সমেত পিছমোড়া করে গাছের সঙ্গে বেঁধে দিল। বলল যাত্রীদের ফাঁকে ফাঁকে কনস্টেবল থাকে, তাদের একজনকে পেলে তার কাছে পাঠিয়ে দেবে।
লালমোহনবাবুর ভাষায় পাথর ফেলার অন্তর্নিহিত মানেটা সত্যি করে ভাবিয়ে তোলে। ভদ্রলোক বললেন, ‘বোঝাই যাচ্ছে কেউ বা কাহারা কেদারে আপনার উপস্থিতিটা প্রিভেন্ট করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে।’
গৌরীকুণ্ড আর কেদারের মাঝামাঝি একটা জায়গা আছে যেটার নাম রামওয়াড়া। সকলেই এখানে থামে বিশ্রামের জন্য। চটি আছে, ধরমশালা আছে, চায়ের দোকান আছে। লালমোহনবাবুকে আমরা এখানে আধ ঘণ্টা বিশ্রাম দেওয়া স্থির করলাম। এখানকার এলিভেশন আড়াই হাজার মিটার, অর্থাৎ প্রায় আট হাজার ফুট। চারিদিকের দৃশ্য ক্রমেই ফ্যানট্যাস্টিক হয়ে আসছে। লালমোহনবাবু একেবারে মহাভারতের মুডে চলে গেছেন; এমন কি এও বলছেন যে যাত্রাপথে তাঁর যদি পতনও হয় তাহলেও কোনো আক্ষেপ নেই, কারণ এমন গ্লোরিয়াস ডেথ নাকি হয় না।
ফেলুদা বলল, ‘আপনি কিন্তু পাবলিকের উপর যে পরিমাণে গাঁজাখুরি মাল চাপিয়েছেন, আপনার নরকভোগ না হয়ে যায় না।’
‘হেঃ’, বললেন লালমোহনবাবু, ‘যুধিষ্ঠিরও পার পাননি মশাই নরকভোগের হাত থেকে, আর লালমোহন গাঙ্গুলী!’
বাকি সাড়ে তিন মাইলের মধ্যে একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটল। একটা জায়গা থেকে হঠাৎ কেদারের মন্দিরের চুড়ো দেখতে পেয়ে সব যাত্রীরা ‘জয় কেদার!’ বলে কেউ মাথা নত করে, কেউ হাত জোড় করে, কেউ বা সাষ্টাঙ্গ হয়ে তাদের ভক্তি জানালেন। কিন্তু আবার হাঁটা শুরু করার সঙ্গে সঙ্গেই মন্দিরের চুড়ো লুকিয়ে গেল পাহাড়ের পিছনে, আর বেরোল একেবারে কেদার পৌঁছানর পর। পরে জানলাম যে এই বিশেষ জায়গা থেকে এই বিশেষ দর্শনটাকে এরা বলে ‘দেও-দেখ্নী’।
পাহাড়ের চূড়োগুলোয় রোদ ঝলমল
কেদার পৌঁছাতে পৌঁছাতে আমাদের হয়ে গেল বিকেল সাড়ে পাঁচটা। তখনও যথেষ্ট আলো রয়েছে, চারদিকের পাহাড়ের চুড়োগুলোয় রোদ ঝলমল করছে।
এতক্ষণ চড়াই-এর পর হঠাৎ সামনে সমতল জমি দেখতে পেলে যে কেমন লাগে তা লিখে বোঝাতে পারব না। এটুকু বলতে পারি যে অবিশ্বাস, আশ্বাস, আনন্দ সব যেন এক সঙ্গে মনের মধ্যে জেগে ওঠে, আর তার সঙ্গে কৃতজ্ঞতা মেশানো একটা অদ্ভুত শান্ত ভাব। সেটাই বোধহয় যাত্রীদের মনে আরো বেশি ভক্তি জাগিয়ে তোলে।
চারিদিকে সব পাথর বাঁধানো জমিতে শুয়ে বসে দাঁড়িয়ে ‘জয় কেদার’ ‘জয় কেদার’ করছে, মন্দিরটা দাঁড়িয়ে রয়েছে তিন দিকে ঘেরা বরফের পাহাড়ের মধ্যে, আমরা তিনজন তারই মধ্যে এগিয়ে গেলাম একটা বাসস্থানের ব্যবস্থা করতে।
এখানে হোটেল আছে—হোটেল হিমলোক—কিন্তু তাতে জায়গা নেই, বিড়লা রেস্ট হাউসেও জায়গা নেই। এক রাত্রের ব্যাপার যখন, মোটামুটি একটা ব্যবস্থা হলেই হল। তাই শেষ পর্যন্ত কালীকমলীওয়ালির ধরমশালায় উঠলাম আমরা। সামান্য ভাড়ায় গরম লেপ তোষক কম্বল সবই পাওয়া যায়।
কেদারনাথের মন্দির এই কিছুক্ষণ আগে সন্ধ্যা ছ’টায় বন্ধ হয়ে গেছে, আবার খুলবে সেই কাল সকাল আটটায়। তাই লালমোহনবাবুর পুজো দেবার কাজটা আজ স্থগিত থাকবে। আপাতত ঠিক এই মুহূর্তে যেটা দরকার সেটা হল গরম চা। আমাদের থাকার ঘর থেকে নিচে নেমেই চায়ের দোকান পেয়ে গেলাম। এটা হল কাশীর বিশ্বনাথের গলির মতোই কেদারনাথের গলি। দোকানগুলো সবই অস্থায়ী, কারণ নভেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত বরফের জন্য কেদারনাথে জনপ্রাণী থাকবে না।
আমি ভেবেছিলাম এই ধকলের পর লালমোহনবাবু হয়ত একটু বিশ্রাম নিতে চাইবেন, কিন্তু তিনি বললেন যে তাঁর দেহের রন্ধ্রে রন্ধ্রে নাকি নতুন এনার্জি পাচ্ছেন।—‘তপেশ, এই হল কেদারের মহিমা!’
বিশ্বনাথের মতোই এখানেও কেদারের গলির দোকানগুলোতে বেশিরভাগই পুজোর সামগ্রী বিক্রী হয়। এমন কি বেনারসের সেই অতি চেনা গন্ধটাও যেন এখানে পাওয়া যায়।
আমরা তিনজনে এলাচ দেওয়া গরম চা খাচ্ছি, এমন সময় হঠাৎ চেনা গলায় প্রশ্ন এল—‘উপাধ্যায়ের সন্ধান পেলেন?’
ছোটকুমার পবনদেও সিং। এখনও তার হাতে ক্যামেরা আর বেল্টের সঙ্গে লাগানো সাউণ্ড রেকর্ডিং যন্ত্র।
‘আমরা ত এই মিনিট কুড়ি হল এলাম,’ বলল ফেলুদা।
‘আমি এসেছি আড়াইটে,’ বলল পবনদেও। যেটুকু জেনেছি তিনি এখন পুরোপুরি সাধুই হয়ে গেছেন। চেহারাও সাধুরই মতো। বুঝে দেখুন, এখানে এত সাধুর মধ্যে তাকে খুঁজে বার করা কত কঠিন। একটা ব্যাপার সম্বন্ধে আমি শিওর। তিনি নাম বদলেছেন। উপাধ্যায় বলে এখানে কেউ কাউকে চেনে না।’
দেখুন চেষ্টা করে,’ বলল ফেলুদা, ‘আমরাও খুঁজছি।’
পবনদেও চলে গেলেন। লোকটা আমার কাছে এখনো রহস্য রয়ে গেল।
আমরা চা শেষ করে উঠে কয়েক পা এগিয়েছি, এমন সময় আরেকটা চেনা কণ্ঠে বাংলায় একটা প্রশ্ন এল।
‘এই যে—এসে পড়েছেন? কেমন, আসা সার্থক কিনা বলুন।’
আমাদের ট্রেনের আলাপী মাখনলাল মজুমদার।
‘ষোল আনা সার্থক,’ বলল ফেলুদা, ‘আমাদের ঘোর এখনো কাটেনি।’
‘হরিদ্বারের কাজ হল?’
‘হয়নি বলেই ত এখানে এলাম। একজনের সন্ধান করে বেড়াচ্ছি। আগে ছিলেন হরিদ্বারে। সেখানে গিয়ে শুনি তিনি চলে গেছেন রুদ্রপ্রয়াগ। আবার রুদ্রপ্রয়াগে গিয়ে শুনি কেদারনাথ।’
‘কার কথা বলছেন বলুন ত?’
‘ভবানী উপাধ্যায় বলে এক ভদ্রলোক।’
মাখনবাবুর চোখ কপালে উঠে গেল।
‘ভবানী? ভবানীর খোঁজ করছেন আপনারা? আর সে কথা অ্যাদ্দিন আমাকে বলেননি?’
‘আপনি তাঁকে চেনেন নাকি?’
‘চিনি মানে? সাত বচ্ছর থেকে চিনি। আমার পেটের আলসার সারিয়ে দিয়েছিল এক বড়িতে। তারপর হরিদ্বার ছাড়ার কিছুদিন আগেও আমার সঙ্গে দেখা করেছে। একটা বৈরাগ্য লক্ষ্য করেছিলাম ওর মধ্যে। বললে রুদ্রপ্রয়াগ যাবে। আমি বললাম বাসরুট হয়ে রুদ্রপ্রয়াগ আর এখন সে জিনিস নেই। তুমি জপতপ করতে চাও ত সোজা কেদার চলে যাও। বোধহয় একটা দোটানার মধ্যে পড়েছিল, তাই কিছুদিন রুদ্রপ্রয়াগ থেকে যায়। কিন্তু এখন সে এখানেই।’
‘সে ত বুঝলাম, কিন্তু কোথায়?’
‘শহরের মধ্যে তাকে পাবেন না ভাই। সে এখন গুহাবাসী। চোরাবালিতাল নাম শুনেছেন? যাকে এখন গান্ধী সরোবর বলা হয়?’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, শুনেছি বটে।’
‘ওই চোরাবালিতাল থেকে মন্দাকিনী নদীর উৎপত্তি। কেদারনাথের পিছন দিয়ে পাথর আর বরফের উপর দিয়ে মাইল তিনেক যেতে হবে। হ্রদের ধারে একটা গুহায় বাস করে ভবানী। উপাধ্যায় অংশটা তার নাম থেকে উবে গেছে; এখন সে ভবানীবাবা। একা থাকে, কাছেপিঠে আর কেউ থাকে না। কাল সকালে আপনারা চেষ্টা করে দেখতে পারেন।’
‘আপনার সঙ্গে এবার দেখা হয়েছে?’
‘না, তবে স্থানীয় লোকের কাছে খবর পেয়েছি। ফলমূলের জন্য তাকে বাজারে আসতে হয় মাঝে মাঝে।’
‘আপনি আমাদের অশেষ উপকার করলেন, মিঃ মজুমদার। কিন্তু তাঁর অতীতের ইতিহাস কি এখানে কেউ জানে?’
‘তা তো জানতেই পারে,’ বললেন মাখনবাবু, ‘কারণ সে তো চিকিৎসা এখনো সম্পূর্ণ ছাড়েনি। এই কেদারনাথের মোহান্তই ত বলছিলেন যে ভবানী সম্প্রতি নাকি একটি ছেলের পোলিও সারিয়ে দিয়েছে। তবে আমার ধারণা সে কিছুদিনের মধ্যে আর চিকিৎসা করবে না—পুরোপুরি সন্ন্যাসী বনে যাবে।’
‘একটা শেষ প্রশ্ন,’ বলল ফেলুদা, ‘ভদ্রলোক কোন্ দেশী তা আপনি জানেন?’
‘এ বিষয় ত তাকে কোনোদিন জিগ্যেস করিনি। তবে সে আমার সঙ্গে সব সময় হিন্দিতেই কথা বলেছে। ভালো হিন্দি। তাতে অন্য কোনো প্রদেশের ছাপ পাইনি কখনো।’
মাখনলালবাবু চলে গেলেন।
লালমোহনবাবু ইতিমধ্যে আমাদের দল থেকে একটু দূরে সরে গিয়ে কার সঙ্গে যেন কথা বলছিলেন। এবার এগিয়ে এসে বললেন, ‘বিড়লা গেস্ট হাউস থেকে আমাদের তলব পড়েছে।’
‘কে ডাকছে?’ প্রশ্ন করল ফেলুদা।
একটি বেঁটে ভদ্রলোক এগিয়ে এসে বললেন, ‘মিঃ সিংঘানিয়া।’
ফেলুদার ভুরুটা কুঁচকে গেল। আমাদের দিকে ফিরে চাপা গলায় বলল, ‘মনে হচ্ছে এই সিংঘানিয়াই এক ভদ্রলোককে সঙ্গে নিয়ে হরিদ্বার গিয়েছিলেন উপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করতে। আমার মনে হয় একে খানিকটা সময় দেওয়া যেতে পারে।—চলিয়ে।’
যদিও চারিদিকে অনেকগুলো বরফের পাহাড়ের চূড়োতে এখনও রোদ রয়েছে—তার কোনোটা সোনালী, কোনোটা লাল, কোনোটা গোলাপী—কেদার শহরের উপর অন্ধকার নেমে এসেছে।
বিড়লা গেস্ট হাউস কেদারনাথের মন্দিরের পাশেই, কাজেই আমরা তিন মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম। দেখে মনে হল এখানে হয়ত এটাই থাকবার সবচেয়ে ভালো জায়গা। অন্তত পরিচ্ছন্নতার দিক দিয়ে ত বটেই; খাবারের কথা জানি না। খাবারের ব্যাপারে এমনিতেও শুনছি এখানে আলু ছাড়া আর বিশেষ কিছুই পাওয়া যায় না।
বেঁটে লোকটা আমাদের আগে আগে পথ দেখিয়ে বিড়লা গেস্ট হাউসের দোতলার একটা ঘরে নিয়ে গিয়ে হাজির করল। বেশ বড় ঘর, চারিদিকে চারটে গদি পাতা। মাথার উপর একটা ঝুলন্ত লোহার ডাণ্ডা থেকে বেরোন তিনটে ডালে টিম টিম করে তিনটে বালব্ জ্বলছে। কেদারনাথে ইলেকট্রিসিটি আছে বটে, কিন্তু আলোর কোনো তেজ নেই।
আমরা মিনিট খানেক অপেক্ষা করতেই যিনি আমাদের আহ্বান করেছিলেন তাঁর আবির্ভাব হল।
মাই নেম ইজ সিংঘানিয়া
যা ভাবা যায় সেটা যখন না হয়, তখন মনের অবস্থাটা আবার স্বাভাবিক হতে বেশ কিছুটা সময় লাগে। সিংঘানিয়ার নামটার সঙ্গে সিংহের মিল আছে বলে বোধহয় ব্যক্তিত্বসম্পন্ন কাউকে আশা করেছিলাম। যিনি এলেন তাঁর মাঝারি গড়ন, মেজাজে মাঝারি গাম্ভীর্য, গলার স্বর সরুও নয়। মোটাও নয়। শুধু একটা মোটা পাকানো গোঁফে বলা যায় কিছুটা ভারিক্কি ভাব এসেছে।
‘মাই নেম ইজ সিংঘানিয়া’ বললেন ভদ্রলোক। ‘প্লীজ সিট ডাউন।’
আমরা তিনজনে দুটো গদীতে ভাগাভাগি করে বসলাম, সিংঘানিয়া বসলেন তৃতীয় গদীতে সোজা আমাদের দিকে মুখ করে। কথা হল ইংরিজি হিন্দি মিশিয়ে।
সিংঘানিয়া বললেন, ‘আপনার খ্যাতির সঙ্গে আমি পরিচিত, মিঃ মিটার, কিন্তু আলাপ হবার সৌভাগ্য হয়নি।’
ফেলুদা বলল, ‘বিপদে না পড়লে ত আর আমার ডাক পড়ে না, তাই আলাপ হবার সুযোগও হয় না।’
‘আমি অবিশ্যি আপনাকে বিপদে পড়ে ডাকিনি।’
‘তা জানি,’ বলল ফেলুদা। ‘আপনার নামও কিন্তু আমি শুনেছি। অবিশ্যি সিংঘানিয়া ত অনেক আছে, কাজেই যাঁর নাম শুনেছি তিনিই আপনি কিনা বলতে পারব না।’
‘আই অ্যাম ভেরি ইন্টারেস্টেড টু নো আপনি কী ভাবে আমার নাম শুনলেন।’
‘আপনি হরিদ্বার গিয়েছিলেন কখনো?’
‘সার্টেনলি।’
‘সেখানে ভবানী উপাধ্যায় বলে একজনের সঙ্গে দেখা করেছিলেন?’
‘করেছিলাম বৈ কি; কিন্তু আপনি সেটা কী করে জানলেন?’
‘উপাধ্যায়ের বাড়িওয়ালা আমাকে বলেছিলেন যে মিঃ সিংঘানিয়া এবং আরেকটি ভদ্রলোক উপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন।’
‘আর কিছু বলেন নি?’
‘বলেছিলেন যে উপাধ্যায়কে নাকি আপনি লোভে ফেলে দিয়েছিলেন, কিন্তু উপাধ্যায় সেটা কাটিয়ে ওঠে।’
‘হোয়াট এ স্ট্রেঞ্জ ম্যান, দিস উপাধ্যায়! আমি এমন লোক আর দ্বিতীয় দেখিনি। ভেবে দেখুন মিঃ মিটার—লোকটার রোজগার মাসে পাঁচশো টাকার বেশি নয়, কারণ গরীবদের সে বিনা পয়সায় চিকিৎসা করে। সেই লোককে আমি পাঁচ লাখ টাকা অফার করলাম। আপনি জানেন বোধহয় যে ওঁর কাছে একটা অত্যন্ত ভ্যালুএব্ল লকেট আছে—খুব সম্ভবত এককালে সেটা ট্র্যাভাঙ্কোরের মহারাজার ছিল।’
‘সে তো জানি, কিন্তু আমার জানার কৌতূহল হচ্ছে আপনি এই লকেটের খবরটা জানলেন কি করে। ওটা ত রাজার পাঁচ-ছ জন খুব কাছের লোক ছাড়া আর কারোর কাছে প্রচার হয়নি।’
‘আমি খবরটা জেনেছিলাম সেই কাছের লোকের একজনের কাছ থেকেই। আমার জুয়েলারির ব্যবসা আছে দিল্লীতে। আমার কাছে এই লকেটের খবর আনে রূপনারায়ণগড়ের ম্যানেজার মিঃ পুরীর ছেলে দেবীশঙ্কর পুরী। সে আমাকে লকেটটা কিনতে বলে। ন্যাচারেলি হি এক্সপেক্টেড এ পারসেনটেজ। আমরা গেলাম হরিদ্বার। উপাধ্যায় রিফিউজ করলেন। পুরীর উৎসাহ চলে গেল। কিন্তু আমি ওটা কেনার লোভ ছাড়তে পারছি না। আমার মনে হয় এখন চেষ্টা করলে হয়ত পাওয়া যাবে। তখন তিনি ডাক্তারি করছিলেন, লোকের সেবা করছিলেন, এখন হি ইজ এ সন্ন্যাসী। একজন গৃহত্যাগী সন্ন্যাসীর ওই রকম একটা পার্থিব সম্পদের উপর কোনো আসক্তি থাকবে এটা ভাবতে একটু অদ্ভুত লাগছে না? আমি চাই ওঁকে আরেকবার অ্যাপ্রোচ করতে।’
‘বেশ ত, করুন না।’
‘দ্যাট ইজ ইমপসিব্ল, মিঃ মিটার।’
‘কেন?’
‘উনি এমন জায়গায় থাকেন সেখানে আমার পক্ষে যাওয়া অসম্ভব। আমি আপনাকে একটা কথা জিগ্যেস করতে পারি?’
‘করুন।’
‘হোয়াই আর ইউ হিয়ার?’
‘প্রধানত ভ্রমণের উদ্দেশ্যে। তবে আমার উপাধ্যায় লোকটার উপর একটা শ্রদ্ধা রয়েছে। তার যদি কোনো অনিষ্ট হচ্ছে দেখি তাহলে কিন্তু আমি বাধা দেব।’
‘ইউ আর অ্যাকটিং অ্যাজ এ ফ্রী এজেন্ট? আপনাকে কেউ এমপ্লয় করেনি?’
‘না।’
‘আপনি আমার হয়ে কাজ করবেন?’
‘কী কাজ?’
‘আপনি উপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করে তাকে বুঝিয়ে বলে লকেটটা এনে দিন। আমি আপনাকে পাঁচ লাখের টেন পার্সেন্ট দেব। উনি যদি নিজে টাকা না নেন, তাহলে ওঁর যদি কোনো উত্তরাধিকারী থাকে তাকে আমি টাকাটা দেব।’
‘কিন্তু এই লকেট সম্বন্ধে ইন্টারেস্টেড কয়েকজন এখানে রয়েছে আপনি জানেন সেটা?’
‘রূপনারায়ণগড়ের ছোটকুমার ত?’
‘আপনি জানেন?’
‘জানতাম না। আজ বিকেলেই ভার্গব বলে এক সাংবাদিক এসেছিল। কেদারে এসেও যে সাংবাদিকদের উৎপাত সহ্য করতে হবে সেটা ভাবিনি। যাই হোক্, সে-ই খবরটা দিল। কিন্তু ছোটকুমার ত ফিল্ম তুলতে এসেছে।’
‘জানি;কিন্তু তাতে উপাধ্যায় আর লকেটের একটা বড় ভূমিকা আছে।’
সিংঘানিয়ার চেহারাটা এবার একটা ইঁদুরের মতো হয়ে গেল। সে হাতজোড় করে বলল—
‘দোহাই মিঃ মিটার—প্লীজ হেল্প মি!’
‘আপনি ভার্গবকে এসব নিয়ে কিছু বলেননি ত?’
‘পাগল! আমি বলেছি তীর্থ করতে এসেছি। কেদারে আসার আর কোনো কারণ থাকার দরকার আছে কি?’
‘ভার্গব লোকটাও উপাধ্যায় সম্বন্ধে ইন্টারেস্টেড। তবে খবরের কাগজের খোরাক হিসেবে।’
‘আপনি কিন্তু এখনো আমার কথার উত্তর দেন নি।’
‘মিঃ সিংঘানিয়া—আমি এইটুকু বলতে পারি যে আপনার প্রস্তাব আমি উপাধ্যায়কে জানাব। তবে আমার ধারণা যে তিনি যদি লকেটটা নিজে না রাখেন, তবে সেটা হয়ত অন্য কাউকে দিয়ে যেতে চাইবেন। কাজেই এখন কোনো পাকাপাকি কথা বলার দরকার নেই; তখন অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা হবে, কেমন?’
‘ভেরি গুড।’
*
বাইরে রাত। কেদার শহর ঝিমিয়ে পড়েছে। বাড়ির বাতি, রাস্তার বাতি, দোকানের বাতি—সবই যেন ধুঁকছে। তারই মধ্যে এক জায়গায় বেশ একটা উজ্জ্বল আলো দেখে অবাক হয়ে এগিয়ে গিয়ে দেখি ছোটকুমার পবনদেও একটা ব্যাটারি-আলো জ্বালিয়ে কেদারের গলির ফিল্ম তুলছে। আমাদের দেখে শুটিং থামিয়ে ফেলুদাকে উদ্দেশ করে প্রশ্ন করল, ‘উপাধ্যায়ের কোনো খবর পেলেন?’
ফেলুদা উত্তর না দিয়ে একটা পাল্টা প্রশ্ন করল।
‘আপনি উঠেছেন কোথায়?’
এখানে পাণ্ডারা ঘর ভাড়া দেয় জানেন ত? তারই একটাতে রয়েছি—এই বাঁয়ের রাস্তা দিয়ে দুটো বাড়ি পরে ডান দিকের বাড়ি।’
‘ঠিক আছে—আমি আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করছি’, বলল ফেলুদা। আমরা এগিয়ে গেলাম আমাদের ধরমশালার দিকে।’
লালমোহনবাবু হঠাৎ মন্তব্য করলেন, ছোটকুমার কেমন লোক জানি না মশাই, কিন্তু সিংঘানিয়া লোকটা ধড়িবাজ আছে।’
‘কী করে জানলেন?’ ফেলুদা প্রশ্ন করল।
‘আপনি যেখানে বসেছিলেন সেখান থেকে বোধহয় দেখতে পাননি, কিন্তু আমি দেখলাম লোকটার কোটের বাঁ পকেটে একটা ক্যাসেট রেকর্ডার। কথা শুরু হবার আগে সেটা টুক করে চালু করে দিল।’
‘ধড়িবাজের উপর আবার ধড়িবাজতর হয় জানেন ত?’
ফেলুদাও তারও পকেট থেকে মাইক্রোক্যাসেট রেকর্ডারটা বার করে দেখিয়ে দিল।
‘আপনি কি ভাবছেন যে এটা আমি—’
ফেলুদার কথা শেষ হল না, কারণ কাঁধে একটা ঘা খেয়ে সে মাটিতে পড়ে গেছে। গলির এই অংশটা নিরিবিলি, সেই সুযোগে পাশের একটা গলি থেকে একটা লোক আচমকা বেরিয়ে এসে ওই কাণ্ডটি করেছে।
মুহূর্তের মধ্যে একটা তুলকালাম কাণ্ড হয়ে গেল।
লোকটা মেরেই পালাচ্ছিল; আমি তার উপর ঝাঁপ দিয়ে পড়ে তার কোমরটা দুহাতে জাপটে ধরে তাকে দেয়ালে চেপে ধরলাম। সেও পালটা চাপ দিয়ে আমাকে ঠেলে সরিয়ে পালাতে যাচ্ছিল, এমন সময় লালমোহনবাবু তার হাতের অস্ত্রটা দিয়ে তাকে এক ঘায়ে ধরাশায়ী করে দিলেন।
অস্ত্রটা আর কিছুই না, গৌরীকুণ্ডে দু-টাকা দিয়ে কেনা সেই লোহা লাগানো লাঠি। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি লোকটার মাথা ফেটে গলগল করে রক্ত বেরোচ্ছে, কিন্তু সেই অবস্থাতেই সে আবার উঠে এক দৌড়ে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।
এদিকে ফেলুদা উঠে বসেছে। বোঝাই যাচ্ছে সে বেশ কাবু। আমরা দুজন দুদিক থেকে তাকে ধরে তুললাম। আমাদের ধরমশালা প্রায় পৌঁছে গেছি। শেষ পথটুকু ফেলুদা শুধু একটা কথাই বলল, ‘কেদারেও তাহলে গুণ্ডা এসে পৌঁছে গেছে!’
কপাল জোরে আমাদের পাশের ঘরেই একজন বাঙালী ডাক্তার পাওয়া গেল, নাম অধীর সেন। অধীরবাবু আবার ফেলুদাকে চিনে ফেললেন, কাজেই যত না জখম, তার তুলনায় শুশ্রুষাটা একটু বেশিই হল। ডান কাঁধে একটা জায়গায় কেটে গিয়েছিল, সেখানে ওষুধ দিয়ে ব্যাণ্ড-এড দিয়ে দিলেন। বললেন, ‘ফ্র্যাকচার হয়েছে কি না সেটা ত এক্স-রে না করলে বোঝা যাবে না।’
ফেলুদা বলল, ‘ফ্র্যাকচারই হোক আর যাই হোক, আমাকে বিছানায় শুইয়ে রাখতে পারবেন না এটা আগে থেকেই বলে দিলাম।’
ফী-এর কথা জিগ্যেস করাতে ভদ্রলোক জিভ-টিভ কেটে একাক্কার।—‘তবে ব্যাপারটা কী জানেন, মিঃ মিত্তির। এই নিয়ে আমার তিনবার হল কেদার। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যেমন ছিল তেমনই আছে, কিন্তু ক্রমে অ্যান্টি-সোশ্যাল এলিমেন্টস ঢুকে পড়ছে শহরে। এর জন্য দায়ী কী জানেন ত? আমাদের যানবাহনের সুব্যবস্থা। একদিকে ভালো করেন ত অন্যদিক দিয়ে খারাপ ঢুকে পড়ে—এই ত দেখে আসছি জগতের নিয়ম।’
কালীকমলীর ম্যানেজার নিজের বুদ্ধি খাটিয়েই এখানকার পুলিশকে খবর দিয়ে আনিয়ে নিয়েছিলেন। ফেলুদা তার সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ ধরে কথা বলল। বুঝতে পারলাম যে নানারকম নির্দেশ দেওয়া হল, এবং সবই দারোগা সাহেব অতি মনোযোগের সঙ্গে শুনে নিলেন।
পুলিশ চলে যাবার পর সাংবাদিক মিঃ ভার্গব এসে হাজির।—‘শুনলাম আপনার লাইফের উপর একটা অ্যাটেম্পট হয়ে গেছে?’
‘গোয়েন্দার জীবনে এতো দৈনন্দিন ঘটনা, মিঃ ভার্গব। এখানকারই কোনো গুণ্ডা হয়ত পকেট মারতে চেয়েছিল, কিন্তু বিশেষ সুবিধা করতে পারেনি।’
‘আপনি বলতে চান আপনার কোনো তদন্তের সঙ্গে এর কোনো কানেকশন নেই?’
‘তদন্ত আবার কোথায়? আমি ত এখানে এসেছি উপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করতে।’
‘ভালো কথা, তিনি কোথায় থাকেন সে খবর পেয়েছেন?
‘আপনি পেয়েছেন?’
‘উপাধ্যায় বলে এখানে কেউ কাউকে চেনে না।’
‘তাহলে ভদ্রলোক হয়ত নাম বদলেছেন।’
‘তাই হবে।’
ফেলুদা আসল ব্যাপারটা বেমালুম চেপে গেল। ভার্গব কিছুটা নিরাশ হয়েই যেন চলে গেলেন।
কাল সকাল সকাল উঠতে হবে বলে আমরা সাড়ে আটটার মধ্যে পুরী তরকারি খেয়ে নিয়ে শুয়ে পড়ার আয়োজন করতে লাগলাম। এই সময় ফেলুদা যে ব্যাপারটা করল সেটা কিন্তু আমি আর লালমোহনবাবু মোটেই অ্যাপ্রুভ করতে পারলাম না। ও বলল, ‘তোরা দুজন শুয়ে পড়, আমি একটু ঘুরে আসছি।’
‘ঘুরে আসছ মানে?’ আমি অবাক এবং কিছুটা বিরক্ত হয়ে প্রশ্ন করলাম। আমি জানি ওর কাঁধে এখনো বেশ ব্যথা। ‘কোত্থেকে ঘুরে আসছ?’
‘একবার ছোটকুমারের সঙ্গে দেখা করা দরকার।’
‘সে কি, তুমি সোজা এনিমি ক্যাম্পে চলে যাবে?’
‘আমার এরকম অনেকবার হয়েছে রে তোপ্সে। একটা চোট খেয়ে বুদ্ধিটা খুলে গেছে। এবারও তাই। পবনদেও আমাদের শত্রু না।’
‘তবে?’
‘আসল শত্রু কে সেটা জানতে পারবি। খুব শিগ্গিরই।’
‘কিন্তু তুমি বেরোবে, আর শত্রু যদি এখন ওৎ পেতে থাকে?’
‘আমার সঙ্গে অস্ত্র আছে। তোরা শুয়ে পড়। আমি যখনই ফিরি না কেন, কালকের প্রোগ্রামে কোনো চেঞ্জ নেই। গান্ধী সরোবর। ভোর সাড়ে চারটায় রওনা হচ্ছি।’
সঙ্গে রিভলভার আর একটা বড় টর্চ নিয়ে ফেলুদা চলে গেল।
‘তোমার দাদার সাহসের জবাব নেই,’ বললেন জটায়ু।
ফেলুদা কাল রাত্তিরে কখন ফিরেছে
ফেলুদা কাল রাত্তিরে কখন ফিরেছে জানি না। সেটা ওকে আর জিগ্যেস করলাম না, কারণ ও দেখলাম সাড়ে চারটার মধ্যে রেডি হয়ে আছে।
আমরা দুজনও দশ মিনিটের মধ্যে তৈরি হয়ে তিনজনে এক সঙ্গে বেরিয়ে পড়লাম। বাইরে এখন ফিকে ভোরের আলো, রাস্তার বাতিগুলো এখনও টিমটিম করে জ্বলছে।
কেদারনাথের মন্দির ছাড়িয়ে খোলা জায়গায় পড়ে ফেলুদা হঠাৎ জিগ্যেস করল, ‘তুই যে জিভ আর দাঁতের ফাঁক দিয়ে খুব জোরে শিস দিতিস, সেটা এখনো পারিস?’
আমি একটু অবাক হয়েই বললাম, ‘হ্যাঁ, তা পারি বৈকি।’
ফেলুদা বলল, ‘আমি যখন বলব তখন দিবি।’
আমরা তিনজনেই সঙ্গে লোহার পাইক দেওয়া লাঠি এনেছিলাম, তা না হলে মাঝে মাঝে বরফে ঢাকা এই পাথুরে পথ দিয়ে হাঁটা অসম্ভব হত। গোড়াতেই মন্দাকিনীর উপর দিয়ে একটা তক্তা-ফেলা সেতু পার হতে হয়েছে আমাদের। নদী এখানে সরু নালার মতো। তিনদিকে ঘিরে সব তুষার শৃঙ্গ রয়েছে, তার কোনোটার নাম এখনো জানা হয়নি। তাদের মধ্যে যেগুলো সবচেয়ে উঁচু, তার চুড়োয় গোলাপী আভা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। শীত প্রচণ্ড, তারই মধ্যে কাঁপা গলায় লালমোহনবাবু হঠাৎ প্রশ্ন করলেন, ‘তো-হো-হোপ্সে ত শি-হিস দেবে; আমার ভূ-হূ-হূমিকাটা —?’
ফেলুদা বলল, ‘আপনি আপনার ওই হাতের লাঠিটা প্রয়োজনে পাগ্লা জগাই-এর মতো মাথার ওপর ঘোরাবেন, তাতে আপনার বীরত্ব আর ব্যারাম দুটোই একসঙ্গে প্রমাণ হবে।’
‘বু-হু-ঝেছি।’
আরো আধঘণ্টা চলার পরে দেখতে পেলাম দূরে একটা ছেয়ে রঙের মসৃণ সমতল প্রান্তর রয়েছে। চারিদিকের পাথরের মধ্যে সেটাই যে চোরাবালিতাল বা গান্ধী সরোবর সেটা বুঝতে অসুবিধা হল না। তবু আমি ফেলুদার দিকে ঘাড় ফিরিয়ে জিগ্যেস করলাম, ‘ওটাই কি—?’ ফেলুদা ঘাড় নাড়িয়ে বুঝিয়ে দিল হ্যাঁ।
হ্রদের পশ্চিম ধারে একটা পাথরের ঢিবি রয়েছে, সেটার মধ্যে অনায়াসে একটা গুহা থাকতে পারে। পুরো ব্যাপারটা এখনো আমাদের থেকে অন্তত আড়াই শো গজ দূরে।
আমরা যেখান দিয়ে যাচ্ছি সেখানে জমিতে আলগা পাথর ছাড়াও বেশ বড় বড় শিলাখণ্ড রয়েছে। তাছাড়া বরফ জমে রয়েছে চতুর্দিকে।
কিছুক্ষণ থেকেই লক্ষ্য করছি যে ফেলুদার দৃষ্টিটা এদিক ওদিক ঘুরছে। ও যেন কিছু একটা খুঁজছে। এবারে দৃষ্টিটা এক জায়গায় স্থির হল।
তার দৃষ্টি অনুসরণ করে দেখলাম আমাদের ডান দিকে একটা পাথরের আড়াল থেকে বেরিয়ে আছে ক্যামেরার তেপায়ার একটা ঠ্যাং।
ফেলুদা প্রায় নিঃশব্দে সেই দিকে এগিয়ে গেল, আমরা তার পিছনে।
পাথরটা পেরোতেই দেখা গেল ছোটকুমার পবনদেও ক্যামেরায় চোখ লাগিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। লেনসটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে সেটা টেলিফোটো, অর্থাৎ টেলিস্কোপের কাজ করবে।
ছোটকুমারের পাশে পৌঁছতেই তিনি বললেন, ‘স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। গুহাটা, কিন্তু এখনো উনি বেরোননি।’
এবার পর পর ফেলুদা আর আমি দুজনেই চোখ লাগালাম।
লেকের জলটা স্থির, তাতে আকাশের আবছা গোলাপী রঙ প্রতিফলিত হয়েছে। তারপর বাঁ দিকে ক্যামেরা ঘুরিয়ে দেখা গেল গুহাটা। পাথরের ফাঁকে গোঁজা একটা গৈরিক পতাকা রয়েছে গুহাটার ঠিক পাশে।
আমাদের চারপাশের যে শৃঙ্গগুলো সবচেয়ে উঁচু তাতে এখনই গোলাপী রোদ লেগেছে। পূবে একটা উঁচু শৃঙ্গ, তার পিছনে আকাশে লাল রঙ দেখে মনে হচ্ছে সূর্যটা ওখান দিয়েই উঠবে।
মিনিটখানেকের মধ্যেই পূবের পাহাড়ের চূড়োর পিছন দিয়ে চোখ ঝলসানো সূর্যটা উঁকি দিতেই গান্ধী সরোবরটা রোদে ধুয়ে গেল।
সেই সঙ্গে লক্ষ্য করলাম গুহার গায়ে রোদ পড়েছে, আর এক আশ্চর্য প্রাকৃতিক পরিবেশে এক আশ্চর্য নাটক হচ্ছে এই ভাবে সন্ন্যাসী বেরিয়ে এলেন গুহা থেকে। তাঁর দৃষ্টি সোজা পূব দিকে। যেন নতুন ওঠা। সূর্যকে স্বাগত জানাচ্ছেন।
‘তোপ্সে, এগিয়ে চল!’ ফিস্ফিসিয়ে আদেশ এল ফেলুদার কাছ থেকে।
‘আমি ক্যামেরায় আছি’, বললেন ছোটকুমার।
আমরা তিনজন দ্রুত এগিয়ে গেলাম গুহার দিকে এ-পাথর ও-পাথরের আড়াল দিয়ে।
আলো পড়ছে, কিন্তু কোনো শব্দ নেই। প্রকৃতি যেন রুদ্ধশ্বাসে কোনো একটা বিশেষ ঘটনার জন্য অপেক্ষা করছে।
এবার গুহা, সন্ন্যাসী, পতাকা সবই স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। আমরা উত্তর মুখে এগিয়ে চলেছি। সন্ন্যাসী আমাদের দিকে পাশ করে পূব দিকে চেয়ে আছেন, তাঁর গেরুয়া বসনের উপর একটা খয়েরি রঙের পট্টুর চাদর।
এবার একটা আশ্চর্য জিনিস লক্ষ্য করলাম। গুহার পূব দিকের পাথরের ঢিবির গায়ে একটা আলো নড়া চড়া করছে। সেটা যে কোনো ধাতব জিনিস থেকে প্রতিফলিত তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
এবার গুহার ঢিবির পিছন দিয়ে একটা লোক বেরিয়ে এল। তার ওভারকোটের কলার তোলা, তাই মুখটা বোঝা যাচ্ছে না। লোকটার মাথায় একটা পশমের টুপি, আর হাতে যে জিনিসটা রোদ পড়ে চক্চক্ করছে সেটা রিভলভার ছাড়া আর কিছুই না।
সন্ন্যাসী সেই একই ভাবে সামনের দিকে চেয়ে আছে, সূর্যের আলো পড়ছে তার মুখে।
ফেলুদা এবার চাপা গলায় বলল, ‘আমি এগোচ্ছি। তোরা এই পাথরের আড়াল থেকে দ্যাখ। রিভলভারের আওয়াজ শুনলেই তোর সেই শিসটা দিবি।’
ফেলুদা নিঃশব্দে এগিয়ে গেল গুহাটার দিকে। খানিক দূর গিয়ে সে একটা পাথরের পাশে এমনভাবে দাঁড়াল যেন সমস্ত ঘটনাটা দেখতে পায়। আমরা আছি তার বিশ গজ পিছনে, কিন্তু আমরাও দেখতে পাচ্ছি নাটকের সব চরিত্রকে।
ফেলুদার পকেট থেকেও এবার রিভলভার বেরিয়ে এল।
এবার সন্ন্যাসী তাঁর দৃষ্টি ঘুরিয়েছেন বাঁ দিকে, অর্থাৎ ওভারকোটে মুখ ঢাকা লোকটার দিকে।
পরমুহূর্তেই এই অপার্থিব নৈঃশব্দ্য চুরমার করে একটা রিভলভারের শব্দের সঙ্গে সঙ্গে ওভারকোট পরা লোকটা বাঁ হাত দিয়ে ডান হাতের কবজি টিপে বরফের উপর বসে পড়ল, আর তার হাতের রিভলভারটাও ছিট্কে গিয়ে পড়ল বরফের উপর।
সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে পড়ল ফেলুদার নির্দেশ।
শিসের শব্দ হওয়া মাত্র এ-পাথর সে-পাথরের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল পুলিশ।
‘তোপ্সে, তোরা আয়!’
আমরা দুজনে দৌড়ে এগিয়ে গেলাম ঘটনাস্থলের দিকে।
এক মিনিটের মধ্যে পৌঁছে গেলাম সাধুর গুহার সামনে।
সৌম্যমূর্তি গেরুয়াধারী সন্ন্যাসী এখনও যেন পুরো ব্যাপারটা অনুধাবন করতে পারেননি। আমাদের সকলের দিকেই ঘুরে ঘুরে অবাক হয়ে দেখছেন।
আর যিনি মাটিতে বসে আছেন তাঁর কবজি টিপে? এবারে ত তার মুখ দেখা যাচ্ছে।
সে কি, ইনি যে সাংবাদিক মিঃ ভার্গব!
একজন কনস্টেবল যেন ফেলুদারই কাছ থেকে নির্দেশ পাবার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছেন। ফেলুদা বলল, ‘আগে ওঁর দাড়িটা টেনে খুলুন ত!’
ভার্গবের দাড়িটা টেনে খুলতে যে মুখটা বেরোল, সেই মুখটাই ম্যাজিকের মতো আশ্চর্য রকম চেনা চেনা হয়ে গেল যখন ফেলুদা নিজেই গিয়ে এক টানে মাথার টুপিটা খুলে ফেলল।
‘আশ্চর্য জিনিস রে হেরেডিটি’, বলল ফেলুদা—‘শুধু যে এর কানের লতি এর বাপের মতো তা নয়, ইনি সিঁথিও করেন ডান দিকে—আর তাই একে দেখে আমার এত অসোয়াস্তি হত।’
তার মানে কী দাঁড়াল?
ইনি উমাশঙ্কর পুরীর ছেলে দেবীশঙ্কর পুরী।
দৃষ্টি গেল সন্ন্যাসীর দিকে
এবার আমাদের সকলের দৃষ্টি গেল সন্ন্যাসীর দিকে। তাঁর এখনও কেমন যেন মুহ্যমান ভাব। হিন্দিতে বললেন, ‘পিস্তলের শব্দ শুনে মনটা কেমন যেন হয়ে গিয়েছিল—কিছু মনে করবেন না।’
ফেলুদাও হিন্দিতে বলল, ‘যদি কিছু মনে না করেন, আপনার কাছে যে থলিটি আছে সেটি একবার বার করা দরকার। আমরা আপনার বন্ধু সেটা বোধহয় বুঝতেই পারছেন। ওটা আপনার গুহার মধ্যেই আছে ত?’
‘আর কোথায় থাকবে? ওই ত আমার একমাত্র সম্পত্তি!’
একজন কনস্টেবল গিয়ে গুহার ভিতর থেকে একটা লাল খলি বার করে নিয়ে এল। সেটা খুলতে প্রথম বেরোল একটা পাকানো কাগজ। এটা রাজা চন্দ্রদেও সিং-এর শীলমোহর সমেত ভবানী উপাধ্যায়কে লকেট দানের স্বীকৃতি।
তারপর বেরোল আরেকটা ছোট থলি থেকে সেই বিখ্যাত সোনার লকেট—বালগোপাল, যার অপরূপ সৌন্দর্য এই পরিবেশে এই সকালের রোদে আরো শতগুণ বেড়ে গেছে।
এইবার ফেলুদা মুখ খুলল। তার বেস্ট হিন্দিতে সে বলল, ‘এবার আপনার আসল পরিচয়টা দিলে কিন্তু আমাদের সকলের খুব সুবিধে হত।’
‘আমার আসল পরিচয়?’
‘আপনার নিজের নামটা বাংলাতেই বলুন না। অ্যাদ্দিন পরে বাংলা বলতে আপনার নিশ্চয়ই ভালো লাগবে।’
উপাধ্যায় ফেলুদার দিকে অবাক হয়ে গিয়ে বাংলায় বললেন, ‘আপনি বুঝে ফেলেছেন আমি বাঙালী?’
‘কেন বুঝব না?’ বলল ফেলুদা, ‘আপনি দেবনাগরী অক্ষরে হিন্দিতে চিঠি লিখেছেন, কিন্তু আপনার “ল” আর বর্গীয় “জ” বাংলার মতো। তাছাড়া আপনার হরিদ্বারের ঘরের তাকে একটা বইয়ের পাতার টুকরো পেয়েছি সেটাও বাংলা।’
‘আপনার বুদ্ধি ত আশ্চর্য তীক্ষ্ণ!’
‘এবার আরেকটা প্রশ্নের জবাব দেবেন কি?’
‘কী?’
‘উপাধ্যায় কি সত্যিই আপনার পদবী, আর ভবানী কি সত্যিই আপনার নাম?’
‘আপনি কী বলছেন আমি—’
‘উপাধ্যায় কি গঙ্গোপাধ্যায়ের অংশ নয়, আর ভবানী কি দুর্গার আরেকটা নাম নয়? আমি যদি বলি আপনার আসল নাম দুর্গামোহন গঙ্গোপাধ্যায় তাহলে কি খুব মিথ্যে বলা হবে?’
‘ছো—ছো—ছো—ছো—’
‘আপনি কাকে ধিক্কার দিচ্ছেন লালমোহনবাবু?’ ফেলুদা বলে উঠল।
‘ছো-ছোটকাকা!’
দুর্গামোহন গঙ্গোপাধ্যায় অবাক হয়ে চাইলেন লালমোহনবাবুর দিকে।
‘আমি যে লালু!’ বললেন জটায়ু।
লালমোহনবাবু গিয়ে দুর্গামোহনকে ঢিপ করে প্রণাম করায় সাধুবাবা তাঁর ভাইপোকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘তাহলে ত আমার সমস্যার সামধান হয়েই গেল। ওই লকেট ত তোরই প্রাপ্য! ও জিনিস আমার কাছে রাখা এক বিরাট বিড়ম্বনা।’
‘তাত বটেই। তা, আমাকে দিলে আমি একটা ব্যাঙ্কের ভল্টে রেখে দিতে পারি। আপনি ত জানেন না ছোটকাকা, আজকাল আমি ছোটদের উপন্যাস লিখে বেশ টু পাইস করছি; তবে রুচির ত কিছু বলা যায় না, একদিন দেখব ঝপ্ করে সেল পড়ে গেছে! তখন লকেটটা থাকলে তবু একটা…’
*
নিজের ছেলে লকেটটা হাত করার তাল করছে জেনে উমাশঙ্করকে বাধ্য হয়ে ফেলুদাকে টেলিগ্রাম ও চিঠি পাঠাতে হয়েছিল। বাপকে হাতের মুঠোর মধ্যে রাখার ক্ষমতা দেবীশঙ্করের নিশ্চয়ই আছে। দুর্গামোহন খুন হলে লকেট বেহাত হয়ে যেত এটাও ঠিক, কিন্তু বাঁচিয়ে দিয়েছিল ওই ধস্। দেবীশঙ্কর আটকা পড়ে গিয়েছিল রুদ্রপ্রয়াগে। সিংঘানিয়া যে এসেছিল কেদারে, সে একেবারে নিজের গরজে, লকেটটাকে কেনার জন্য।
দেবীশঙ্করই লোক লাগিয়ে ফেলুদার দিকে পাথর গড়িয়ে দিয়েছিল, সে-ই আবার কেদারে রাত্তিরবেলা গুণ্ডা লাগিয়ে ফেলুদাকে জখম করার চেষ্টা করেছিল।
ছোটকুমার পবনদেও সিং অবিশ্যি তার ক্যামেরা দিয়ে পুরো ঘটনাটাই টেলিফোটো লেনস-এর জোরে বেশ কাছ থেকেই তুলে রেখেছিল। দেবীশঙ্কর যে রিভলভার বার করে দুর্গামোহনের দিকে তাগ করেছিল সেটা স্পষ্ট বোঝা যাবার কথা। আপাতত ছোটকুমারের আর ফিল্ম নেই, কিন্তু দিল্লী থেকে স্টক এলে পরে সে দুর্গামোহনের একটা সাক্ষাৎকার নেবার ইচ্ছা প্রকাশ করল। দুর্গামোহন আপত্তি করলেন না; বরং বললেন, ‘একজন রাজার আশ্চর্য দরাজ মনের কথাটা বিশ্বের লোকের কাছে গোপন থাকে কেন? আমি টেলিভিশন ক্যামেরায় নিশ্চয়ই বলব আমার সোনার বালগোপাল পাবার কথা।’
পবনদেও বললেন, ‘কিন্তু বালগোপাল ত আর আপনার কাছে থাকছে না।’
‘না’, বললেন দুর্গামোহন। ‘সেটার ছবি যদি তুলতে চাও ত আমার ভাইপোকে বল।’
পবনদেও লালমোহনবাবুর দিকে ফিরে বললেন, ‘আপনার বাড়ি গিয়ে আমি লকেটটার ছবি তুলে আনতে পারি কি?’
জটায়ু তাঁর সবচেয়ে বেশি সাহেবী উচ্চারণে বললেন, ‘ইউ আর মোউস্ট ওয়েলখাম!’
