ইয়াজদার্গিদের হিরে (কিশোর কর্নেল) – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ
তিন
কোনও গুরুতর চিন্তাভাবনার সময় আমার বৃদ্ধ বন্ধুটির চোখ বুজে যায়। ডাকলেও সাড়াশব্দ পাওয়া যায় না। হালদারমশাইয়ের ব্যাপারটা তখনকার মতো জানা গেল না। শুধু ভাবছিলাম, জারে চুবোনো সেই কাটা হাতটার কথা এবং শিউরে উঠছিলাম। হালদারমশাই জোর বাঁচা বেঁচেছেন তা হলে। আমরা পৌঁছোতে দেরি করলে গোয়েন্দা ভদ্রলোককে নিশ্চয় কুচিকুচি করে কেটে জেনোমবিজ্ঞানী রাজেন অধিকারী জারে চুবিয়ে রাখতেন।
কর্নেলের বাড়ির লনে গাড়ি ঢুকিয়ে দেখি, উনি তখনও ধ্যানস্থ। বললাম, এসে গেছি বস।
কর্নেল চোখ খুলে বললেন, কখনও কানমলা খেয়েছ, ডার্লিং?
হঠাৎ এই অদ্ভুত প্রশ্নে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললাম, কানমলা? তার মানে?
নিশ্চয় খেয়েছ। বিশেষ করে তোমার ছেলেবেলা পাড়াগাঁয়ে কেটেছে যখন। কর্নেল আস্তে-সুস্থে গড়ি থেকে বেরোলেন। একটু হেসে বললেন, কানমলা খাওয়া খুব অপমানজনক ব্যাপার। কাউকে চূড়ান্ত অপমান করতে হলে কানমলে দেওয়াই যথেষ্ট। কারও কান ধরলেই সে জব্দ হয়। শুধু মানুষ নয় জয়ন্ত! জন্তুজানোয়ারও কান ধরলে জব্দ।
ব্যাপারটা কী?
তুমি কি গাড়িতেই বসে থাকবে, না কি বেরোবে?
ঘড়ি দেখে বললাম, বারোটা বাজে। প্রেস ক্লাবে লাঞ্চের নেমতন্ন আছে। এক মন্ত্রী ভাষণ দিতে আসবেন।
ঠিক আছে। তা হলে তুমি এসো। বলে কর্নেল চলে গেলেন।
একটু অভিমান নিশ্চয় হল। হালদারমশাইয়ের বন্দি হওয়া এবং কানমলা ব্যাপারটা জানার খুব ইচ্ছে ছিল। কিন্তু এই খেয়ালি বৃদ্ধের রকমসকম বরাবর দেখে আসছি। যথাসময়ে নিজে থেকেই জানাতে ব্যস্ত হয়ে উঠবেন। কাজেই গাড়ি ঘুরিয়েই তখন স্থানত্যাগ করলাম।
সন্ধের দিকে একবার ভেবেছিলাম কর্নেলের বাড়ি যাব! কিন্তু উনি যখনতখন হুট করে বেরিয়ে নিপাত্তা হয়ে যান। তাই টেলিফোন করলাম। ষষ্ঠীচরণ ফোন ধরেছিল। এককথায় জানিয়ে দিল, বাবামশাই বেইরেছেন।
হালদারমশাইয়ের ফ্ল্যাটে রিং করলাম। কোনও সাড়া পাওয়া গেল না।
বিজ্ঞানী চন্ত্রকান্তকে রিং করলাম। ফোনে তখনই সাড়া এল, জয়ন্তবাবু নাকি?
অবাক হয়ে বললাম, গলা শুনেই লোক চেনার যন্ত্র তৈরি করেছেন বোঝা যাচ্ছে।
ঠিক তা-ই। বিজ্ঞানীর হাসি ভেসে এল। আমার সোনিম থিয়োরি–
ঝটপট বললাম, জেনোম থিয়োরির পর সোনিম থিয়োরি এলে আমার বারোটা বেজে যাবে চন্দ্রকান্তবাবু! প্লিজ! থিয়োরি থাক।
সহজ ব্যাপার জয়ন্তবাবু! ইংরেজিতে এস ও এন আই এম সোনিম। শব্দ! ধ্বনি! বুঝলেন তো?
চন্দ্রকান্তবাবু–
ল্যাবে বসে আছি, জয়ন্তবাবু! আমার ঘরে যাঁরা আসেন, তাঁদের গলার স্বর, শব্দ উচ্চারণের বিশেষ বিশেষ ভঙ্গি ইত্যাদি সব রেকর্ড করে রাখি। কম্পিউটারে সেই ডেটা অ্যানালিসিস করে নিই। তারপর টেলিফোনের সঙ্গে কম্পিউটারের কানেকশন! ব্যস! সো ইজি।
প্লিজ! আমি জানতে চাইছি আপনার সেই মাল্টিপারপাস ডিটেক্টর যন্ত্রে রাজেনবাবুর বাড়ি সম্পর্কে কী তথ্য পেলেন?
ডেটা অ্যানালিসিস চলছে। এখনও কিছু বুঝতে পারছি না। আরও দু-একটা দিন লেগে যাবে হয়তো।
কৃত্রিম মানুষের কোনও হদিস পেলেন কি?
নাহ। তবে একটা অদ্ভুত ধ্বনিতরঙ্গ ধরা পড়েছে। কোনও পার্থিব বস্তু বা প্রাণী এই ধ্বনিতরঙ্গের কারণ নয়, এটুকু বলতে পারি।
চন্দ্রকান্তবাবু, আপনি তো হালদারমশাইকে ভালোই চেনেন।
খুউব চিনি।
রাজেনবাবুর বাড়ি ঢুকে উনি বিপদে পড়েছিলেন। আমরা যখন ওঁর ল্যাবে ছিলাম, তখন কর্নেল ওঁকে দেখতে পান। বন্দি অবস্থায় ছিলেন। কর্নেল ওঁকে উদ্ধার করেন।
হাঃ হাঃ হাঃ! কর্নেল আমার পাশে বসে আছেন। কথা বলুন।
কর্নেলের কণ্ঠস্বর ভেসে এল। ডার্লিং! তখন যে কথাটা তোমাকে বোঝাতে চেয়েছিলাম, আবার বুঝতে চেষ্টা করো। কানমলা! প্রতিপক্ষকে জব্দ করতে হলে তার কান ধরে ফেলবে। কেমন? যখনই কেউ তোমার ওপর হামলা করবে, তোমার লক্ষ্য হবে তার কান। ভুলো না কিন্তু।
চটে গিয়ে বললাম, এই নাক-কান মলে প্রতিজ্ঞা করছি–।
নাক নয়, কান। তুমি কান মলে প্রতিজ্ঞা করার ব্যাপারটা লক্ষ্য করো, জয়ন্ত। তা হলেই বুঝতে পারবে, কান একটা ভাইটাল প্রত্যঙ্গ। মানুষ শুধু নাকমলে প্রতিজ্ঞা করে না, কানও মলতে হয়। তবে নাহ। নিজের কান নিজে মলে নিজেকে জব্দ করার অর্থ হয় না।
ছাড়ছি।
কান ধরে আছ নাকি?
নাহ। ফোন।
ফোনের সঙ্গে কানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ডার্লিং! ফোন মানে ধ্বনি। ধ্বনি আমরা কান দিয়েই শুনি।
খাপ্পা হয়ে টেলিফোন রেখে দিলাম। ঠিক করলাম, এসব উদ্ভুটে ব্যাপারে কিছুতেই নাক গলাব না। এমনকী, ওই বৃদ্ধ ঘুঘুর মুখদর্শনও আর করব না।
পরদিন বিকেলে পত্রিকা-অফিসে রাজেন অধিকারীর টেলিফোন পেলাম। রাজেনবাবু বললেন, মি. জয়ন্ত চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলতে চাই।
জয়ন্ত চৌধুরী বলছি।
মি. চৌধুরী! খবরটা তো বেরোল না আপনাদের কাগজে? খুব আশা করে ছিলাম।
বেরোবে। আসলে আমাদের কাগজে বিজ্ঞাপনের চাপ খুব বেশি তো! সবসময় সব খবরকে জায়গা দেওয়া যায় না।
শুনুন! ব্যাপারটা সায়েন্টিফিক কিনা! কাজেই জটিল। আপনার লেখার সুবিধে হবে বলে আমি একটা আর্টিকল-আকারে লিখে লোক দিয়ে পাঠাব কি?
পাঠাতে পারেন। কিন্তু এখনই আমাকে রাইটার্স বিল্ডিংয়ে যেতে হবে। ফিরতে দেরি হতে পারে। নীচের রিসেপশনে দিয়ে যেতে বলবেন আপনার লোককে।
— না জয়ন্তবাবু! ওটা আপনার হাতে সরাসরি পৌঁছোনো দরকার। কারণ এর আগে আমি সব কাগজে রাইট-আপ পাঠিয়েছি। ছাপা হয়নি। প্রেস কনফারেন্স ডেকেছি। কেউ আসেনি। আমাকে আসলে কেউ পাত্তা দিতে চায় না। হ্যাঁ, ছোটোখাটো কাগজ ছেপেছে। কিন্তু তাতে কাজ হয়নি। হয় না। বড়ো কাগজে বেরোলে লক্ষ লক্ষ লোকের নজরে পড়ে।
বুঝেছি। আপনি এক কাজ করুন। খামে আমার নাম লিখে পাঠান। তা হলেই আমি পেয়ে যাব।
ঠিক আছে। আসলে আমি আজই কদিনের জন্য বাইরে যাচ্ছি। তাই এত তাড়া।
এক মিনিট মি. অধিকারী! কাল সকালে কি আপনার বাড়িতে চোর ঢুকেছিল? হ্যালো! হ্যালো! হ্যালো!
একটু পরে সাড়া এল। ঢুকেছিল। কিন্তু আপনি কী করে জানলেন?
রিপোর্টারদের খবরের সোর্স বলা বারণ। হ্যালো! হ্যালো! হ্যালো!
লাইন কেটে গেল। বুঝলাম, বোকামি করে ফেলেছি। কিছুক্ষণ পরে হালদারমশাইকে ফোন করলাম। রিং হতে থাকল। কিন্তু কেউ ফোন ধরল না। টেলিফোনের গন্ডগোল অথবা হালদারমশাই কোথাও পাড়ি জমিয়েছেন। ভদ্রলোক রহস্য-অন্ত-প্রাণ যাকে বলে। হয়তো ইয়াজদার্গিদের হিরের খোঁজেই হন্যে হয়ে বেড়াচ্ছেন।
রাত দশটায় অফিস থেকে বাড়ি ফিরছিলাম প্রতিদিনের মতো। রাজেন অধিকারীর কোনও রাইট-আপ বা আর্টিকল কেউ রিসেপশনে জমা দিয়ে যায়নি। সত্যি, মুখ ফসকে কথাটা বলা বোকামি হয়েছে। লোকটা সতর্ক হয়ে গেছে।
সল্টলেকে নতুন কেনা ফ্ল্যাটে মাসখানেক হল উঠেছি। রাস্তা খাঁ খাঁ জনহীন। শীতের রাতে কুয়াশা জমে আছে গাছপালায়। হঠাৎ দেখি প্রায় তিরিশ মিটার দূরে একটা লোক রাস্তার মাঝখান দিয়ে আসছে। হর্ন দিয়েও তাকে সরানো গেল না। পাগল-টাগল হবে। তাকে পাশ কাটানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু সে আবার সামনে এসে দাঁড়াল। দুটো ল্যাম্পপোস্টের মধ্যবর্তী জায়গা। দু-ধারে গাছ এবং ঝোপঝাড়। ব্রেক কষেই দেখি তার গায়ে নেভিব্লু সোয়েটার।
তারপর তার চেহারার দিকে চোখ গেল। ও কি মানুষ? ও কী মানুষ?
হালদারমশাইয়ের বর্ণনার সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। বুকটা ধড়াস করে উঠল। সে আমার গাড়ির সামনে এসে ঝুঁকে দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বুঝলাম, গাড়িটা সে দুহাতে উলটে ফেলে দেওয়ার মতলব করছে।
এক লাফে গাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লাম। অমনই সে আমার দিকে এগিয়ে এল। অদ্ভুত জ্বলজ্বল নীলচে চোখে হিংস্রতার ছাপ।
মুহূর্তে কর্নেলের কথাটা মনে পড়ে গেল। আমাকে ধরার আগেই মরিয়া হয়ে আমি তার ওপর ঝাঁপ দিয়ে তার কান দুটো ধরে মোচড় দিলাম। অমনই সে ধড়াস করে নেতিয়ে পড়ল। একেবারে চিৎপাত।
এরপর আর নার্ভ ঠিক রইল না আমার। সটান গাড়িতে ঢুকে স্টার্ট দিয়ে বেরিয়ে গেলাম।
ফ্ল্যাটে ফিরে প্রতিজ্ঞা ভুলে কর্নেলকে রিং করলাম। আমার হাত তখন কাঁপছিল। কর্নেলের সাড়া পেয়েই বললাম, এইমাত্র দানোটার পাল্লায় পড়েছিলাম। আপনার কথামতো–।
কানমলে জব্দ করেছ তো?
হ্যাঁ। সাংঘাতিক ব্যাপার। ভাগ্যিস আপনার পরামর্শটা মনে পড়েছিল। নইলে জামসিজ নওরোজির মতো হাড়গোড়-ভাঙা দলাপাকানো মাংসপিণ্ড হয়ে পড়ে থাকতাম। শীতের রাতে সল্টলেকের ব্যাপার তো জানেন। চেঁচিয়ে মাথা ভাঙলেও কেউ বেরিয়ে আসত না।
কর্নেলের হাসি শোনা গেল। বললেন, ডার্লিং! তোমার ওপর তো রাজেনবাবুর রাগ হওয়ার কথা নয়। উনি কাগজে প্রচার চান।
আমারই বোকামি। উনি বিকেলে ফোন করেছিলেন। বলে ঘটনাটা সবিস্তার জানিয়ে দিলাম।
কর্নেল বললেন, হালদারমশাই গোয়েন্দাগিরি করতে গিয়ে বরাবরই বন্দি হন, সে তো জানো! এবারও মুখে টেপ-সাঁটা অবস্থায় বাথরুমে বন্দি ছিলেন। হাত-পা শক্ত করে বাঁধা ছিল। দরজায় পাহারা দিচ্ছিল তোমার দেখা দানো আমার ভাষায় কৃত্রিম মানুষ। বিজ্ঞানী চন্দ্ৰকান্তের সিন্থেটিক কফির মতো সিন্থেটিক ম্যানও বলতে পারো। তো তার পাল্লায় পড়ে আমারও বাঁচার কথা ছিল না। দৃশ্যটা কল্পনা করো জয়ন্ত! বাথরুম খোলা। হালদারমশাই পড়ে আছেন। দানোটা দরজার সামনে আমাকে দেখেই দু-হাত বাড়াল। জায়গাটা করিডরমতো। কয়েক হাত দূরে দোতলার সিঁড়ি। হঠাৎ দেখি সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসছেন এক ভদ্রলোক। মুখে শিশুর হাসি। দেখামাত্র বুঝলাম রাজেনবাবুর দাদা সেই পাগল ভদ্রলোক। মিটিমিটি হেসে চোখ নাচিয়ে চাপা গলায় বললেন, কান মলে দিন ব্যাটাচ্ছেলের! জব্দ হবে। ব্যস! দানোটা হাত বাড়াতেই আমি তার কান দুটো ধরে জোরে মলে দিলাম। কাজেই তোমাকে কান মলে দেওয়ার কথা বলে আসলে সতর্ক করেই দিয়েছিলাম।
থ্যাংকস বস! কিন্তু কালই পুলিশকে জানিয়ে দেননি কেন?
হালদারমশাই জানিয়েছিলেন। পুলিশ গিয়ে কোনও হদিস পায়নি। মাঝখান থেকে হালদারমশাই পুলিশের জেরায় জেরবার হয়েছেন।
উনি কোথায় আছেন? ফোনে পাচ্ছি না কাল থেকে।
দমদমে ওঁর সেই আত্মীয়ের বাড়িতে আছেন। আসলে রাজেনবাবুর বাড়ির দিকে সারাক্ষণ নজর রাখার জন্য ওখানে ডেরা পেতেছেন।
আমার নার্ভ বিগড়ে গেছে, বস! রাখছি।
সকালে চলে এসো। চন্দ্রকান্তবাবুর আসার কথা আছে।
যাব।
ফোন রেখে দিয়ে কিছুক্ষণ আচ্ছন্ন অবস্থায় বসে রইলাম। কলকাতা মহানগরে এমন একটা সাংঘাতিক বিপজ্জনক দানো ঘুরে বেড়াচ্ছে, কেউ কি বিশ্বাস করতে চাইবে?
সারাটা রাত প্রায় জেগেই কাটিয়েছিলাম। একটু শব্দ হলেই চমকে উঠি। ওই ভয়ংকর দানোকে কোনও অস্ত্রেই জব্দ করা যাবে না। শুধু কান মললেই ব্যাটাচ্ছেলে কাত। কাজেই যদি সে রাতবিরেতে হানা দেয়, তার কান মলে দেওয়ার জন্যই জেগে থাকা দরকার।
শেষ রাতে কখন একটুখানি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, সেটা জেগে ওঠার পর বুঝলাম। নিজের ওপর চটে গেলাম। ভাগ্যিস দানোটা ওত পাততে আসেনি।
যখন কর্নেলের তেতলার অ্যাপার্টমেন্টে পোঁছোলাম, তখন প্রায় সাড়ে নটা বাজে। ড্রয়িংরুমে ঢুকে দেখি, বিজ্ঞানী চন্দ্রকান্ত ভাষণ দিচ্ছেন এবং কর্নেল মনোযোগ দিয়ে শুনছেন। ইশারায় আমাকে বসতে বললেন কর্নেল। ষষ্ঠীচরণ কফি দিয়ে গেল।
চন্দ্রকান্ত বলছিলেন, ক্লোনিং আর জেনোম এক জিনিস নয়। ক্লোনিং বলতে সাদা বাংলায় কলম করা। হাজার বছর আগেও মানুষ জেনেটিকস না জেনেও ক্লোনিং করেছে। এক জাতের উদ্ভিদের সঙ্গে আর এক জাতের উদ্ভিদ কিংবা এক জাতের প্রাণীর সঙ্গে আর এক জাতের প্রাণীর ক্লোনিং করেছে। কিন্তু আধুনিক জেনেটিকসের থিয়োরির অপব্যাখ্যা করে কেউ কেউ বলছেন, দেহকোষের ডি এন এ অণুতে কারচুপি করে মানুষকে গাধা করা যায়। কিংবা ধরুন, একই মানুষের অসংখ্য আদল গড়া যায়। হুবহু তারা এক। এভাবে অসংখ্য কর্নেল কিংবা এই চন্দ্রকান্ত চৌধুরী বাজারে ছাড়া যায়। কিন্তু আমি বলব, এটা বাড়াবাড়ি। এটা স্রেফ গুল। বিজ্ঞানের নামে অপবিজ্ঞান। মশাই, মানুষ ইজ মানুষ! জেনোম থিয়োরি কখনও দাবি করছে না, মানুষকে গাধা কিংবা দানো বানানো যায়।
কর্নেল বললেন, সিন্থেটিক ম্যানের ব্যাপারটা বলুন চন্দ্রকান্তবাবু!
চন্দ্রকান্ত হাসলেন। রাজেন অধিকারীর বাড়িতে অদ্ভুত ধ্বনিতরঙ্গ অ্যানালিলিস করে বুঝেছি, আমার তৈরি শ্রীমান ধুন্ধুর মতোই কোনও রোবোট আছে। কিন্তু সে রোবোট ধুন্ধুর চেয়ে বহুগুণে উন্নত। তার দেহ ধাতু দিয়ে তৈরি নয়।
কৃত্রিম হাড়-মাংস-চামড়া দিয়ে তৈরি!
ঠিক, ঠিক। চন্দ্রকান্ত নড়ে বসলেন। কিন্তু ওইসব জিনিসকে একেবারে কৃত্রিম বলতে দ্বিধা হচ্ছে। সম্ভবত মৃত মানুষের দেহকোষের ডি এন এ অণুতে কোনও প্রক্রিয়ায় কারচুপি করে হাড়-মাংস-রক্ত-চামড়া ইত্যাদি তৈরি করেছেন রাজেন অধিকারী। তারপর জোড়া দিয়ে একটা মানুষ গড়েছেন।
জেনোম প্রজেক্ট তা হলে সফল করতে পেরেছেন রাজেনবাবু?
বিজ্ঞানী চিবুকের দাড়ি চুলকে বললেন, সম্ভবত।
আমি চুপ করে থাকতে পারলাম না। বললাম, কাল রাতে দানোটা আমাকে
হাত তুলে চন্দ্রকান্ত বললেন, শুনেছি। কিন্তু কান ধরলে কেন ও জব্দ হয় জানেন কি? আমার কাছে শুনুন। আপনাকে আমার সোনিম থিয়োরির কথা বলেছি। রাজেনবাবুর এই রোবটটিও ধ্বনিতরঙ্গের সাহায্যে চালিত হয়। কানই ধ্বনিতরঙ্গের একমাত্র গমনপথ। কাজেই ওর কান চেপে ধরলে রাজেনবাবুর রিমোট কনট্রোল থেকে পাঠানো ধ্বনিতরঙ্গ ওর ব্রেনে ঢুকতে বাধা পায়। তখন স্বভাবত ও নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়।
কর্নেল বললেন আমার ধারণা, ওর কানের সঙ্গে কোনো সূক্ষ্ম রিসিভিং যন্ত্র ফিট করা আছে। কানে চাপ পড়লে কিছুক্ষণের জন্য সেটা অকেজো হয়ে যায়।
বললাম, রাজেনবাবুর দাদা বসন্তবাবু সেটা জানেন?
যেভাবে হোক, জানতে পেরেছেন। বলে কর্নেল চুরুট ধরিয়ে চোখ বুজলেন।
কিন্তু সম্রাট ইয়াজদার্গিদের হিরের কোনও খোঁজ পেলেন না চন্দ্রকান্তবাবু? আপনার ডিটেক্টরে কোনও খোঁজ মেলেনি?
চন্দ্রকান্ত মাথা নেড়ে বললেন, নাহ। রাজেনবাবুর বাড়িতে কোনও হিরেটিরে নেই মশাই!
কর্নেল চোখ খুলে বললেন, চন্দ্রকান্তবাবু! আপনার ওই যন্ত্রটি কতটা দূরত্বের পরিধি খুঁজতে পারে?
চারদিকে একশো মিটার পরিধির দূরত্ব খুঁজতে পারে।
ওপরের দিকে?
ভার্টিক্যালি? চন্দ্রকান্ত একটু হাসলেন। আমি হাত তুললে যতটা উঁচু হয়, ততদূর পর্যন্ত।
তার মানে দোতলার কিছু ডিটেক্ট করা যায় না আপনার যন্ত্রে?
নাহ। হাতে ওটা দেখলে ওঁর সন্দেহ হত কি না বলুন?
এই সময় টেলিফোন বাজল। কর্নেল রিসিভার তুলে বললেন, হ্যাঁ। কে? হালদারমশাই নাকি? কোথা থেকে বলছেন? … কী আশ্চর্য! ওখানে কেন গেলেন? … বলেন কী! কাকে দেখেছেন? বসন্তবাবুকে? …হ্যাঁ, প্রচুর রহস্য।… হ্যাঁ, হ্যাঁ। ঠিক আছে। ওয়েট অ্যান্ড সি।…উইশ ইউ গুড লাক। রাখছি।
কর্নেল ফোন রেখে প্রথমে একচোট হাসলেন। তারপরে বললেন, হালদারমশাই গোপালপুর-অন-সি থেকে ট্রাংককল করে জানালেন, গত রাতে রাজেনবাবু এবং তার দানোটিকে ফলো করে হাওড়া স্টেশনে যান। তখন রাত প্রায় এগারোটা। মাদ্রাজ মেল ছাড়ার কথা রাত আটটা ৪৫ মিনিটে। আড়াই ঘণ্টা দেরিতে ছাড়ে। ওঁর ধারণা, রাজেনবাবু সে খবর জেনেই দেরি করে স্টেশনে যান। যাইহোক, গোয়েন্দামশাই ওঁদের ফলো করে গোপালপুর অন-সি-তে পৌঁছেছেন। উঠেছেন আমার বন্ধু স্মিথসায়েবের ওশান হাউসে। দোতলার বারান্দা থেকে এক পলকের জন্য নাকি সামনে বালিয়াড়িতে একটা ভাঙা ঘরের ভেতর বসন্তবাবুকে দেখেছেন। নেমে গিয়ে তার আর পাত্তা পাননি। এদিকে রাজেনবাবু উঠেছেন লাইটহাউসের ওদিকে ওবেরয় গ্র্যান্ডে। কাজেই–।
ওঁর কথার ওপর বললাম, প্রচুর রহস্য।
বিজ্ঞানী চন্দ্রকান্ত চোখ নাচিয়ে বললেন, চলুন কর্নেল! গোপালপুর অন-সি নিরিবিলি জায়গা। রাজেনবাবুর রোবটটিকে জব্দ করে জেনেটিক্সের মিস্ট্রি সলভ করা যাবে। এই চান্স ছাড়া উচিত নয়।
কর্নেল চোখবুজে দাড়িতে হাত বললেন, গেলে আপনাকে খবর দেব।
আমি উৎসাহ দেখিয়ে বললাম, নওরোজি জানতে পেরেছিলেন, কে হিরে চুরি করেছে। তাই তাকে মরতে হল। এবার হালদারমশাইয়ের বরাতে সাংঘাতিক বিপদ ঘটে না যায়। আমাদের যাওয়া উচিত, কর্নেল!
হালদারমশাইকে কানমলার পরামর্শ দিয়েছি ডার্লিং! ভেবো না।
বিজ্ঞানী চন্দ্রকান্ত উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আমি কিন্তু যাচ্ছি। বিজ্ঞানের এমন রহস্যময় আবিষ্কার হাতে-নাতে যাচাইয়ের চান্স ছাড়তে রাজি নই কর্নেল! গোপালপুর উপকূলের মতো সুনসান নির্জন জায়গা ভারতের কোনও সমুদ্র তীরে নেই। আমি রাজেনবাবুর অজ্ঞাতসারে রোবটটির ওপর পরীক্ষা চালাব।
উনি খুব জোরে বেরিয়ে গেলেন। কর্নেল ধ্যানস্থ। বললাম, চলি বস। আপনি ধ্যান করুন।
তবু কর্নেলের সাড়া নেই। অগত্যা মনে-মনে চটে গিয়ে উঠে দাঁড়ালাম এবং বেরিয়ে গেলাম।
পরদিন সকালে ব্রেকফাস্ট করে একটা কাজে বেরোতে যাচ্ছি, কর্নেলের ফোন এল। জয়ন্ত! তৈরি হয়ে থাকো। আমি আধঘণ্টর মধ্যে যাচ্ছি।
কী ব্যাপার?
আমরা গোপালপুর-অন-সি রওনা হব।
অ্যাঁ?
হ্যাঁ। এইমাত্র ম্যাডানসায়েবের জামাই কুসরো এসেছিলেন। আজ ভোরবেলায় গোপালপুরে–অন-সি বিচে তার শ্বশুর ম্যাডানসায়েবকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে। পুলিশ ট্রাংককলে লালবাজারের থ্রু দিয়ে খবর দিয়েছে।
মার্ডার নাকি?
তা আর বলতে? তবে ঘাড় মটকে মারা হয়েছে।
সেই শয়তান রোবটটা! সেই দানো ব্যাটাচ্ছেলে!
তৈরি থেকো ডার্লিং! যাচ্ছি।
ফোন নামিয়ে রেখে দেখি, এই শীতে ঘাম দিচ্ছে। শরীর কাঁপছে। আবার সেই বিভীষিকার মুখোমুখি হওয়া কি ঠিক হবে? জীববিজ্ঞানী রাজেন অধিকারী যদি তাঁদের দানোর কানের বদলে এবার অন্য কোনও প্রত্যঙ্গে গোপনে রিসিভারযন্ত্র ফিট করে রাখেন?
