ব্যর্থ প্রেমিক – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
আহত বাঘ যেমন নিজের ক্ষতস্থানটা বার বার চাটে, সেই রকমই মণিময় তার দুঃখগুলোকে ভালোবাসে। কখনও একলা হয়ে পড়লেই সে তার নিজের দুঃখগুলোকে আদর করে।
সন্ধে সাড়ে ছ-টা, অফিস থেকে বেরিয়ে এসে মণিময় দাঁড়িয়ে আছে মনুমেন্টের কাছে। এরপর সে কোথায় যাবে জানে না। এই জায়গাটা থেকে অনেক রকম বাস ছাড়ে, মিনিবাস দাঁড়ায়, শেয়ারের ট্যাক্সিও পাওয়া যায়, অর্থাৎ এখান থেকে কলকাতার যে-কোনো জায়গায় যাওয়া যেতে পারে। কিন্তু মণিময় মনস্থির করতে পারে না। পরপর দুটি সিগারেট সে শেষ করল। প্রায় প্রত্যেকদিনই অফিস থেকে বেরিয়ে মণিময়ের এরকম হয়।
কোথায় সে এখন যাবে?
মণিময়ের একটা বাড়ি আছে, সেখানে মা-বাবা, দুই ভাই, তিন বোন নিয়ে বেশ বড়ো সংসার। মণিময়ের আছে নিজস্ব একটা ঘর। তাদের বাড়িতেও বিশেষ অশান্তি নেই, সব সময় বেশ একটা হইচই ভাব। মণিময় তো অন্য আর সবার মতন বাড়িও ফিরে যেতে পারে, স্নান করে জলখাবার খাবে, তারপর একটা বই নিয়ে বসবে, কিংবা রেডিয়ো শুনবে, কিংবা গল্পে মেতে যাবে। যা সবাই করে। আবার সে তো একটা সিনেমাও দেখতে পারে। একা যেতে না পারে, সঙ্গীরও অভাব নেই। তার বোনেরা প্রায়ই তাকে সিনেমা দেখাবার জন্য আবদার করে। তাদের পাড়াতেই থাকে বাসবী, তার মেজ বোনের বান্ধবী। বাসবী প্রায়ই আসে তাদের বাড়িতে এবং মণিময়ের দিকে এমনভাবে তাকায় যে বোঝা যায় মণিময়ের প্রতি তার একটা মুগ্ধতার ভাব আছে। বাসবীকে তো দেখতে সবাই ভালোই বলে, মেয়েটি পড়াশোনাতেও ভালো, এ বছর থেকে রিসার্চ করছে কেমিস্ট্রিতে। এই বাসবীর সঙ্গে মণিময় কি প্রেম করে সন্ধেগুলো কাটাতে পারে না? একদিন তো মণিময় তাদের বাড়ির ছাদের আলসের কাছে দাঁড়িয়ে বাসবীকে বলেছিল, তোমার হাতের আঙুলগুলো খুব সুন্দর। এরপর আরও তো অনেক কিছু বলার থাকে।
মণিময় একেবারে নির্বান্ধবও নয়। তার বেশ কয়েকজন কলেজজীবনের বন্ধু ছড়িয়ে আছে কলকাতার নানা প্রান্তে, তাদের অনেকের বাড়িতেই এ সময় গেলে আড্ডা দেওয়া যায়।
মণিময় সে রকম কোনো জায়গাতেই গেল না। সে একটা মিনিবাস ধরে চলে এল নিউ আলিপুরে। পেট্রোল-পাম্পের কাছে নেমে হাঁটতে লাগল মন্থরভাবে। যেন এখনও সে জানে না কোথায় যাবে। মিনিট সাতেক হাঁটার পর সে একটা চারতলা ফ্ল্যাট-বাড়ির সামনে থমকে দাঁড়াল। সন্ধে এখন গাঢ় হয়ে এসেছে, কিন্তু আকাশে একটাও তারা নেই। ওপরে তাকালে দেখা যায় গর্ভিনী মেঘ।
ফ্ল্যাট-বাড়িটার সব ঘরেই আলো জ্বলছে। বেশ পরিচ্ছন্ন, ঝকঝকে চেহারা বাড়িটার। মণিময় একটুক্ষণ দ্বিধা করে তারপর বাড়িটার ভেতরে ঢুকল। সিঁড়ি দিয়ে উঠে এল চারতলায়। বেশ খাড়া খাড়া সিঁড়ি, চারতলায় উঠতেই হাঁপিয়ে যেতে হয়। মণিময় একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে দম নিল।
দু-পাশে দুটি ফ্ল্যাট। একই রকম দরজা, একই রকম কলিং বেল। তবে দুটি আলাদা নাম লেখা। মণিময় ডান দিকের দরজার সামনে এসে বেল টিপল। সামান্য একটুক্ষণ অপেক্ষা করতে হল, দরজা খুলে দিল একটি বাচ্চা চাকর।
দরজা থেকেই বসবার ঘরটা দেখা যায়। সুন্দর সোফা-সেট দিয়ে সাজানো। একটি সোফার ওপর পা মুড়ে বসে আছে অনীতা, হাতে একটি পাতলা বই, সে কৌতূহলে তাকিয়ে আছে দরজার দিকেই।
মণিময় সরু করিডরটা পেরিয়ে বসবার ঘরে চলে এল। অনীতা উঠে দাঁড়াল না, কোনো কথা বলল না, শুধু চেয়ে আছে তার দিকে।
মণিময় জিজ্ঞেস করল, ভালো আছ?
অনীতা ঘাড় হেলিয়ে জানাল, হ্যাঁ।
মণিময় জানে, অনীতা নিজে থেকে তাকে বসতে বলবে না। সে শুধু শান্তভাবে চেয়েই থাকবে একদৃষ্টে।
মণিময় নিজেই বসল। ফ্ল্যাটটা ফাঁকা এবং নিঃশব্দ, সেই নৈঃশব্দ অনুভব করে মণিময় আবার জিজ্ঞেস করল, অরূপ বাড়ি নেই?
অনীতা বলল, না।
অনীতার ভুরু সামান্য কুঁচকে এসেছে। মণিময় খুব ভালো করেই জানে, অরূপ এ সময় বাড়ি থাকে না। অরূপ একটি বিদেশি বিমান কোম্পানিতে কাজ করে, তাকে সপ্তাহে তিনদিন এই সময় এয়ারপোর্টে থাকতে হয়। বাড়ি ফিরতে রাত দশটা তো বাজবেই।
হাতের বইটা নামিয়ে রাখল অনীতা। পাতলা চটিবই, আকাশি রঙের মলাট। মণিময় লক্ষ করে দেখল, ওটা একটা কবিতার বই। একলা সন্ধেবেলা অনীতা একটা কবিতার বই পড়ছিল। অনীতাকে এসব মানায়। অন্য মেয়েরা এসময় সিনেমা পত্রিকার পাতা ওলটায় কিংবা পাশের ফ্ল্যাটের মেয়েদের সঙ্গে গল্প করতে যায়। কিন্তু অনীতার রুচি অত্যন্ত সূক্ষ্ম, কবিতা কিংবা গানে সে মগ্ন হয়ে থাকতে পারে।
মণিময় বলল, অরূপ একদিন আসতে বলেছিল, তাই এলাম!
কথাটা একদম মিথ্যে নয়। অথচ সত্যি তা নয়, সে সম্পর্কে কোনো সন্দেহই নেই। অরূপ একদিন মণিময়কে আসতে বলেছিল ঠিকই। অরূপ আর অনীতার সঙ্গে মণিময়ের একদিন নিউ মার্কেটের কাছে দেখা। অরূপের সঙ্গে মণিময়ের মোটামুটি পরিচয় আছে, দ্বারভাঙ্গা বিল্ডিংয়ের ছাদের হলে তাদের একই সঙ্গে পরীক্ষার সিট পড়েছিল। অনীতার কিছু ব্যস্ততা ছিল বলে সেদিন নিউ মার্কেটের সামনে অরূপ বেশিক্ষণ কথা বলতে পারেনি মণিময়ের সঙ্গে। সে বলেছিল, একদিন এসো না আমাদের বাড়িতে, গল্প করা যাবে।
এটা নিতান্ত কথার কথা। এরকম নেমন্তন্নে হঠাৎ কেউ কারুর বাড়িতে এসে উপস্থিত হয় না। তাও বেছে বেছে মণিময় ঠিক এমন সময়েই এসেছে, যখন অরূপ বাড়িতে থাকে না।
অনীতা এবার উঠে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি চা খাবে?
মণিময় বলল, খেতে পারি!
বাড়িতে নিশ্চয়ই রান্নার লোক আছে। অনীতা তো সেখান থেকেই জোরে চায়ের কথা বলে দিতে পারত। তা বলল না। নিজেই চলে গেল, তারপর অনেকক্ষণ আর এল না। খানিকবাদে বাচ্চা চাকর এসে চা দিয়ে গেল, তবু অনীতার দেখা নেই।
মণিময় একটু হাসল। অনীতা বুঝিয়ে দিতে চায় যে, মণিময় এখানে অবাঞ্ছিত। অতিথিকে একলা বসিয়ে রেখে নিজে অন্য জায়গায় থাকার মতন অভদ্র তো অনীতা নয়। সে ইচ্ছে করেই মণিময়কে এরকম অপমান করলে!
আর কোথাও, কেউ মণিময়কে এরকম অবহেলা বা অপমান করে না। তার স্বাস্থ্য ভালো, চেহারা সুন্দর, এক কালে খুব নামকরা ছাত্র ছিল, এখনও সে অরূপের চেয়ে কিছু খারাপ চাকরি করে না, সে কথাবার্তাও ভালো বলতে পারে, কোথাও অযথা বকবক করে অন্যদের বিরক্তি সৃষ্টি করে না। অন্য অনেক জায়গাতেই সন্ধেবেলা মণিময় খাতির পেতে পারত, কিন্তু তবু সে এখানে ইচ্ছে করে অপমান সহ্য করতে এসেছে।
একটু পরে অনীতা এসে জিজ্ঞেস করল, তোমায় চা দিয়েছে?
তুমি ভালো আছ, অনীতা?
অনীতা এবার স্পষ্টত বিরক্ত হয়ে উঠল। ঝংকার দিয়ে বলল, তুমি বার বার এ কথাটা জিজ্ঞেস করো কেন বলো তো? হ্যাঁ আমি ভালো আছি, নিশ্চয়ই ভালো আছি, খারাপ থাকব কেন? তুমি কি চাও, আমি খারাপ থাকি?
মণিময় শুকনো গলায় বলল, না, আমি তা চাই না। সত্যি চাই না।
মণিদা, আমাকে এখন একটু বেরোতে হবে।
কোথায় যাবে? চলো আমি তোমাকে পৌঁছে দিচ্ছি।
না, আমি যাব নীচের ফ্ল্যাটে। টেলিভিশনে আটটার সময় একটা ভালো প্রোগ্রাম আছে। সেটা দেখব।
টেলিভিশনের প্রোগ্রাম? সেটা না দেখলে হয় না আজ?
আমি ওদের বলে রেখেছি, আমি না গেলে ওরা ডাকতে আসবে।
মণিময় বুঝতে পারে, এটা একটা অতি সামান্য ছুতো। অনীতা তাকে চলে যেতে বলছে, এর থেকে ভদ্রভাষা আর কী হতে পারে? অনীতা কি তার সামনে বসতে ভয় পায়, না বিরক্ত হয়?
কিন্তু মণিময়ও এর চেয়ে বেশি অভদ্র হতে পারে না। এ কথা বলার পর মণিময়ই বা আর কী করে বসে থাকবে? এক্ষুনি তার চলে যাওয়া উচিত।
সে উঠে দাঁড়াল। তার মুখে কোনো ব্যথার চিহ্ন নেই, বরং একটা পাতলা চাপা হাসি। সে তো এরকম পাওয়ার আশা করেই এসেছিল। সে জানত, অনীতা ঠিক এরকম ব্যবহার করবে।
মণিময় বলল, অরূপের সঙ্গে দেখা হল না!
অনীতা মণিময়কে উঠে দাঁড়াতে দেখে খুশি হয়েছে। সে বলল, ওর সঙ্গে দেখা করতে হলে রবিবার আর বৃহস্পতিবার—ওই দুদিন ও বাড়িতেই থাকে।
অরূপকে বলো, আমি এসেছিলাম।
অনীতা দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এল না। মণিময় একাই বেরিয়ে এসে বাইরে থেকে দরজাটা টেনে দিল। অনীতা তখনও বসবার ঘরে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে।
অন্য অনেক মেয়েই এই অবস্থায় ঝগড়া করত কিংবা খারাপ কথা বলত। অন্য কেউ অনায়াসেই বলতে পারত, মণিদা, আমি চাই না তুমি এরকমভাবে আমার বাড়িতে আসো। আমি চাই না, তুমি আমার স্বামীর সঙ্গে গায়ে পড়ে বেশি ভাব করতে যাও! কেন তুমি আমাদের জীবনে অশান্তি এনে দিতে চাইছ? তুমি ফের এরকমভাবে এলে আমি চ্যাঁচামেচি করে লোক জড়ো করব!
কিন্তু অনীতা এরকম কথা কোনোদিন মুখ দিয়ে উচ্চারণ করতে পারবে না। তার রুচি অত্যন্ত সূক্ষ্ম, ব্যবহার খুব মার্জিত। সে আকারে ইঙ্গিতে মণিময়কে এইসব কথা বোঝাতে চায়, কিন্তু মুখে কোনো কটু কথা বলবে না। এক সময় সে মণিময়কে ভালোবাসত, এখন ভালো না বাসুক, ভদ্রতাটুকু মুছে ফেলতে পারবে না কিছুতেই। মণিময় সেই ভরসাতেই তো এখানে এসেছে।
অন্য কোনো লোক হলে মণিময় যে কথাটা জানবার জন্য বার বার অনীতার সঙ্গে দেখা করতে চায়, সেটা সোজাসুজি জিজ্ঞেস করত। কিন্তু মণিময় তা পারে না। সে আশা করে থাকে, অনীতা নিজেই তা বলবে।
মণিময় যখন বাড়ি ফিরল, তখন তাদের বাইরের ঘরে তুমুল আড্ডা জমিয়েছে ভাই-বোনেরা! বাসবীও আছে সেখানে। সে ঢুকতেই তার ছোটো বোন বলল, সেজদা তুমি এইখানে, এই জায়গাটায় এসে একটু পাশ ফিরে দাঁড়াও তো!
কেন, কেন?
দাঁড়াও না, একবার।
তার বোন নিজেই মণিময়ের হাত ধরে দাঁড় করিয়ে মুখটা একপাশে ঘুরিয়ে দিল। তারপর বলল, এই দ্যাখো, বলছিলাম না সেজদার মুখের সঙ্গে অমিতাভ বচ্চনের অনেকটা মিল আছে! দ্যাখো, এপাশ থেকে দ্যাখো!
বাসবী বলল, সত্যিই তো!
মণিময় ওদের সঙ্গে আড্ডায় যোগ দিয়ে সেখানেই বসে পড়ল। একটা সিগারেট ধরিয়ে শুনতে লাগল ওদের কথা। এখানে বেশ আনন্দময় পরিবেশ। এরা কেউ কল্পনাও করতে পারবে না, একটু আগেই মণিময় কতখানি অপমান সয়ে এসেছে। এরা কেউ বিশ্বাসই করবে না যে, মণিময়কে কেউ অপমান করতে পারে।
শুধু অনীতা পারে। সেই কথাই খানিকটা বাদে, নিজের ঘরে এসে একা একা শুয়ে থেকে মণিময় ভাবছিল। এ জীবনে এ পর্যন্ত আর কেউ মণিময়কে এরকম আঘাত দেয়নি। অনীতা নিজেও হয়তো জানে না, সে মণিময়ের কতখানি ক্ষতি করেছে। মণিময় আর কিছুতেই সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারছে না।
সেই কলেজজীবন থেকেই বন্ধুবান্ধবরা সবাই জানত, মণিময় অনীতাকে বিয়ে করবে। প্রতিটি বিকেল দুজনে একসঙ্গে ঘুরে বেড়াত। বোটানিক্যাল গার্ডেন, বালিগঞ্জ লেক, দক্ষিণেশ্বর—এইসব জায়গায় ওদের পাশাপাশি বসে থাকার ছবি, মণিময়ের মধ্যে এখনও একটুও ম্লান হয়নি।
অনীতার সঙ্গে মণিময়ের আলাপ হয়েছিল খুব সামান্য ঘটনা থেকে। তার বন্ধু শুভেন্দুর বাড়িতে মণিময় প্রথম অনীতাকে দেখে। শুভেন্দুর বোনের তিন-চারজন বান্ধবী এসেছিল সেদিন, তার মধ্যে অনীতা একজন। এমনিই ভদ্রতার আলাপ হয়েছিল। প্রথম দর্শনেই প্রেম হয়নি। কিন্তু এর ঠিক পরের দিনই অনীতার সঙ্গে আবার দেখা হয়ে যায় আকস্মিকভাবে। প্রবল বৃষ্টির দিন ছিল সেটা, রাস্তাঘাট ভেসে যাচ্ছে, তার মধ্যে মণিময় অতিকষ্টে একটা ট্যাক্সি জোগাড় করে বাড়ি ফিরছিল, পার্ক স্ট্রিটের কাছে দেখল অনীতা দাঁড়িয়ে আছে, সর্বাঙ্গ ভেজা। ঠিক আগের দিনই মেয়েটির সঙ্গে পরিচয় হলেও তাকে চিনতে একটু দেরি হয়েছিল মণিময়ের। শুধু মনে হয়েছিল চেনা-চেনা, কোথায় যেন দেখেছে। অনীতার সঙ্গে চোখাচোখি হতে অনীতা নিজেই চেনা-ভাবে হাসল, তখন মনে পড়ে গেল মণিময়ের। এইরকম অবস্থায় একটি মেয়েকে দেখলে তাকে লিফট দেওয়াই ভদ্রতা। তবু মণিময় নিজে থেকে সে-কথা বলতে একটু লজ্জা পেল, ট্যাক্সিটা অনীতাকে ছাড়িয়ে চলে গেল। তারপর মণিময়ের মনে হল আজ ট্রাম-বাসে চড়া খুবই কঠিন ব্যাপার, ট্যাক্সিও পাওয়া খুব শক্ত, এইরকম সময় সে পরিচিত একটি মেয়েকে বৃষ্টির মধ্যে ভিজতে দেখেও চলে যাচ্ছে! ট্যাক্সি থামিয়ে সে নিজেই নেমে দৌড়ে এসে অনীতাকে জিজ্ঞেস করেছিল, আপনি কোন দিকে যাবেন?
সেদিন যদি মণিময় এভাবে ট্যাক্সি থামিয়ে ফিরে না আসত, তাহলে অনীতার সঙ্গে তার গভীর পরিচয় হতই না কোনোদিন, তার জীবনটা এরকম বদলে যেত না। এক একটা মুহূর্তে মানুষের জীবনের মোড় ঘুরে যায়।
সেদিন ট্যাক্সিতে অনীতাকে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়া যায়নি। ভবানীপুরের কাছে রাস্তায় প্রায় এক কোমর জল, সেখানে ট্যাক্সি আটকে গেল। দুজনকেই নেমে পড়তে হল সেখানে। তারপর জলের মধ্যেই প্যান্ট আর শাড়ি ভিজিয়ে হাঁটতে লাগল দুজনে, তাতেই ওরা খুব কাছাকাছি এসে গেল। অনীতা দেখতে যে দারুণ একটা সুন্দরী তাও নয়, সাধারণভাবে সুশ্রী বলা যায়। কিন্তু মণিময় দেখেছিল, অনীতার রুচি বা কথাবার্তার ধরনের সঙ্গে তার একটা মিল আছে। দুজনেই একই ধরনের বই পড়তে ভালোবাসে।
প্রায় চার বছর ওরা দুজন দুজনকে তীব্রভাবে ভালোবেসেছে। অনীতা নিজেই দু-তিন দিন মণিময়ের সঙ্গে দেখা না হলেই ছটফট করত। মণিময়ের বুকে মাথা রেখে বলত, তুমি কোনোদিন আমাকে ভুলে যাবে না, বলো!
নিজের বাড়িতেও অনীতার কথা গোপন করেনি মণিময়! শেষের দিকে একদিন অনীতাকে বাড়িতে নিয়েও এসেছিল। তাদের বাড়ির লোকজন অনীতার সঙ্গে খুব ভালো ব্যবহার করেছে। মণিময় নিজের পছন্দ মতন কারুকে বিয়ে করলে তাদের বাড়ি থেকে কোনোরকম আপত্তি ওঠবার কথা নয়। তাদের বাড়ির আবহাওয়াই সেই রকম। মণিময়ের মা পরে অনীতা সম্পর্কে বলেছিলেন, মেয়েটি বেশ! খুব নম্র, চমৎকার ব্যবহার।
অনীতাও মণিময়দের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে বলেছিল, তোমাদের বাড়ির সবাই কী চমৎকার! তোমার মা, কী সুন্দর শান্ত চেহারা, ঠিক একটা মা-মা ভাব আছে, আর তোমার ভাই-বোনেরা এত ভালো, একটু আলাপেই কত আন্তরিক ব্যবহার করল। তোমার ভাই-বেনেরা তোমাকে খুব ভালোবাসে, তাই না?
মণিময় বলেছিল, হ্যাঁ, ভাই-বোনেরাও আমার বন্ধুর মতন।
এর পরদিন থেকে অনীতা মণিময়ের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ বন্ধ করে দিল। চিঠি লিখলেও কোনো উত্তর দেয়নি। শুধু বিস্মিত নয়, মণিময় একেবারে বিমূঢ় হয়ে গিয়েছিল বলা যায়। গণ্ডগোলটা কোথায় হল? তার বাড়ির লোকেরা অনীতাকে পছন্দ করেছে, অনীতার ভালো লেগেছে সবাইকে। তবু কেন অনীতা ঠিক এর পর থেকেই দূরে সরিয়ে দিল মণিময়কে? কেন সব ভালোবাসা মিথ্যে হয়ে গেল? মণিময় আগে কোনোদিন অনীতাদের বাড়িতে যায়নি। অনীতা নিয়ে যেতেও চায়নি। সে বলেছিল, তার বাবা একটু কড়া ধরনের, তিনি পছন্দ করবেন না। তবু প্রায় সাত আটখানা চিঠি লিখেও অনীতার উত্তর না পেয়ে মণিময় একদিন গিয়েছিল অনীতাদের বাড়ি। অনীতার দেখা পায়নি, একটি চাকর এসে বলেছিল, অনীতা বাড়ি নেই, কিন্তু মণিময়ের সন্দেহ হয়েছিল, সেটা মিথ্যে কথা, অনীতা নিজেই দেখা করতে চায় না। অনীতা কেন এমন অপমান করতে চাইল তাকে, তার দোষটা কোথায়? অনীতা কি তার বাবাকে এতখানি ভয় পায়? এত ভয়ের কী আছে? মণিময়েরও কোনো অযোগ্যতা নেই, এমনকি জাতের পর্যন্ত মিল আছে!
এর আট মাস পরে সে পেয়েছিল অনীতার বিয়ের চিঠি এবং অরূপের সঙ্গে অনীতাদের জাতেরও মিল নেই। তাহলে, মণিময়ের বদলে কেন অরূপকে বিয়ে করতে গেল অনীতা? চার বছরের মধ্যে তো সে একদিনও অরূপের কথা শোনেনি? অনীতা অরূপের কথা গোপন করে গিয়েছিল? না, তা হতেই পারে না। অনীতা মিথ্যে কথা বলে না, কোনওরকম লুকোচুরি সে পছন্দ করে না। অনীতার ভালোবাসার মধ্যে কোনো গলদ ছিল না, তবু সে এরকম অদ্ভুত ব্যবহার করল কেন?
ব্যর্থ প্রেমে মণিময় পাগল হয়ে যায়নি। সে জানে, একটি মেয়েকে বিয়ে করতে না পারলে কারুর জীবন ব্যর্থ হয়ে যায় না। সময় সব কিছু ভুলিয়ে দেয়। সে আবার অন্য কারুকে ভালোবেসে নতুন করে জীবন শুরু করতে পারে। কিন্তু তার আগে তার শুধু জানা দরকার। অনীতা তাকে অপমান করতে চায়, করুক, দেখা যাক, অপমানে কোন চরম সীমানায় সে যেতে পারে। এবং কেন?
আবার মণিময় গেল অনীতার ফ্ল্যাটে। দরজা খুলে অনীতা ভুরু কোঁচকাল, মণিময়কে ভেতরে এসে বসতে পর্যন্ত বলল না।
ঠোঁটে পাতলা হাসি টেনে মণিময় বলল, আমি আবার এসেছি। অরূপ নেই?
অনীতা বলল, তোমাকে তো আমি বলেইছি, এরকম সন্ধের সময় অরূপ বাড়ি থাকে না।
কিন্তু আজ বেস্পতিবার। তুমি বলেছিলে রবি আর বেস্পতিবার সে থাকে!
তা অবশ্য ঠিক! বেস্পতিবার অরূপ বাড়ি ফেরে , কিন্তু আজ একটা জরুরি কাজে তাকে এয়ারপোর্ট যেতে হয়েছে, অরূপ অফিস থেকে খবর পাঠিয়েছে।
মণিময় এক পা দরজার ভেতরে রাখল। সে দেখতে চায় অনীতা তার মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দেবে কিনা। অনীতা কি এতদূর যাবে?
অনীতা অবশ্য তা পারল না। দরজার কাছ থেকে সরে এল। মণিময় জিজ্ঞেস করল, আমি একটু বসব? অরূপ যদি একটুক্ষণের মধ্যে ফেরে!
অনীতা বলল, অরূপের সঙ্গে তোমার হঠাৎ কোনো দরকার আছে?
সোফার ওপর বসে পড়ে মণিময় বলল, না। আমি অরূপের সঙ্গে দেখা করতে আসি না! আমি তোমাকেই দেখতে আসি।
অনীতা কিছু বলতে যাচ্ছিল, মণিময় তাকে বাধা দিয়ে বলল, তুমি কি ভেবেছিলে আমি কোনো খারাপ লোকের মতন, তোমার ওপর প্রতিশোধ নেবার জন্য অরূপকে আমাদের পুরোনো সব কথা বলে দেব? অরূপকে জানিয়ে দেবো যে, গঙ্গায় নৌকোর ওপর তুমি চুমু খেয়েছিলে। তুমি আমাকে এরকম খারাপ লোক ভাব।
না, তা অবশ্য ভাবি না।
আমি তোমাদের বাড়ির সামনের রাস্তায় আজ একঘন্টা দাঁড়িয়েছিলাম। অরূপকে ফিরতে দেখিনি বলেই তোমার কাছে এসেছি।
তুমি চা খাবে?
না। আজ তোমার কোনো টেলিভিশন প্রোগ্রাম দেখতে যাবার কথা নেই? অরূপ নিজেই টেলিভিশন সেট কেনে না কেন?
আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি। কিন্তু তুমি নিশ্চয়ই বুঝবে। এখন এভাবে দেখাশোনা করা আমাদের উচিত নয়।
অর্থাৎ, তুমি ভয় পাচ্ছ! এখন যদি অরূপ হঠাৎ এসে পড়ে, সে ভাববে, তুমি লুকিয়ে লুকিয়ে আমার সঙ্গে প্রেম করছ!
মণিদা!
তুমি আগে আমাকে শুধু মণিময় বলে ডাকতে, এখন দাদা বলো।
আমি অনুরোধ করছি, তুমি পুরোনো সব কথা ভুলে যাও!
তোমার ভয় নেই, আমি তোমার সঙ্গে লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেম কিংবা ব্যভিচার করতে চাই না। ওসব আমার চরিত্রে নেই। এখন পুরোনো কথা ভুলে যেতে বলছ। অথচ, একদিন তুমিই বলেছিলে তোমাকে যেন আমি ভুলে না যাই!
আমি ক্ষমা চাইছি।
মণিময় এমনভাবে উঠে দাঁড়াল, যেন তক্ষুনি সে অনীতার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল অনীতার ওপর। সে সহ্যের শেষ সীমায় এসে গেছে। চাপা গলায় প্রায় গর্জন করে সে বললে, আগে বলো, কেন? কেন তুমি আমাকে অপমান করলে?
অনীতা মুখ নীচু করে বলল, অপমান করতে চাইনি। আমি তোমার অযোগ্য বলে সরে এসেছি।
কীসে তুমি অযোগ্য? চার বছর আমরা একসঙ্গে ছিলাম!
তখন আমি বুঝতে পারিনি। আমি স্বপ্ন দেখেছিলাম, তোমাকে পাব, সেই স্বপ্নে আর সবকিছু ভুলে গিয়েছিলাম। তারপর হঠাৎ একদিন ঘোর ভাঙল, আমি বুঝতে পারলাম। তোমার সঙ্গে আমার বিয়ে হতে পারে না! আমি তোমার সম্পূর্ণ অযোগ্য!
কেন? সেটাই তো জানতে চাইছি।
তুমি শুনবেই?
না শুনে আজ আর আমি যাব না এখান থেকে।
তবে শোন। আমার যখন চার বছর বয়েস, তখন আমার মা আমার বাবার এক বন্ধুর সঙ্গে পালিয়ে যান। আমার বাবা একটি নার্সকে রক্ষিতা রেখেছে। সেই আমাদের বাড়ির কর্ত্রী। আমার পরিচয় এরকম কালি মাখা তোমাকে কখনও বলতে পারিনি।
মণিময়ের মুখখানা বিবর্ণ হয়ে গেল। তার মনে হল, আজ এই কথা বলে অনীতা তাকে যা অপমান করল, সে রকম বেশি অপমান আগে ও করেনি।
সে আস্তে আস্তে জিজ্ঞেস করল, অরূপ এসব জানে?
হ্যাঁ।
অনীতা, তুমি ভাবলে যে অরূপ এসব জেনেও তোমাকে বিয়ে করতে পারে, আর আমি পারতাম না? আমার মধ্যে সেটুকু উদারতা নেই? আমি তোমার সামাজিক পরিচয়টা এত বড়ো করে দেখতাম। এতদিন আমার সঙ্গে মিশে আমাকে তুমি এই চিনেছ?
আমি জানতাম, তোমার সে উদারতা আছে। কিন্তু সেই উদারতার সুযোগ নিলে সেটা হত আমার পক্ষে দারুণ স্বার্থপরতা। সেটা আমি কবে বুঝেছিলাম জানো?
কবে?
যেদিন তোমাদের বাড়িতে গিয়েছিলাম। তোমাদের বাড়ির সব লোক এত ভালো, এমন একটা আনন্দময় পরিবেশ—সে বাড়িতে বউ হয়ে গিয়ে আমি নিজেকে কিছুতেই মানাতে পারতাম না। আমি মিথ্যে কথা বলি না, আমার বাড়ির সব কথা আমাকে বলতেই হত, না বললেও ওঁরা জানতেন ঠিকই—ওঁরা মনে করতেন, আমি একটা নোংরা কুৎসিত বাড়ির মেয়ে।
কিন্তু অনীতা, আমি তো তোমাকেই চেয়েছিলাম! তোমার বাড়ির যাই ব্যাপার থাক না কেন?
তা হয় না। তুমি হয়তো আমার জন্য তোমার বাড়ি ছেড়ে আলাদা এরকম কোনো ফ্ল্যাট ভাড়া নিতে। কিন্তু তোমাদের বাড়ির আনন্দময় পরিবেশ আমি ভেঙে দিতে চাইনি! সেটা হত পাপ! তোমাকে তোমার মা কিংবা ভাইবোনদের কাছ থেকে ছিনিয়ে এনে—
ওরাও হয়তো মেনে নিতেন অনীতা, আমি বুঝিয়ে বললে…
অনীতা ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। মণিময়ের পায়ের কাছে বসে পড়ে বলল, তোমাকে আমি কত ভালোবাসতাম, তুমি জানো না? তুমি ছিলে আমার কাছে দেবতার মতন। তবু, আমি বুঝেছিলাম, আমি তোমাকে পাব না। আমার বাবা-মায়ের অপরাধ তোমার বাবা-মা মেনে নিতে পারতেন না কিছুতেই। আমি জানি! আমার জন্য তুমি ওদের ছেড়ে এলে শান্তি পেতে না—আমি কত কেঁদেছি, একলা একলা, মণিদা, এখনও কাঁদি।
মণিময় স্তব্ধ হয়ে রইল। তার শরীরটা কাঁপছে। সে হঠাৎ বুঝতে পেরেছে। অনীতা তার চেয়েও অনেক বড়ো। অনীতা যা বলছে, তা অস্বীকার করা যায় না। এক কুলটা নারীর মেয়েকে তার মা কি পুত্রবধূ হিসেবে মেনে নিতে পারতেন? অথচ, অনীতার তো কোনো দোষ নেই।
অনীতাকে সান্ত্বনা দেবার জন্য সে তার কাঁধে হাতটা রাখল। আবার তুলে নিল হাতটা। অনীতাকে সে কী সান্ত্বনা দেবে? অনীতার কান্না থামাবার মতন কোনো ভাষা সে জানে না! সে একজন বঞ্চিত মানুষের মতন চুপ করে বসে রইল। তারা হেরে গেছে। সে আর অনীতা দুজনেই হেরে গেছে তাদের বাবা-মায়েদের কাছে।
