বিশুপাল বধ (ব্যোমকেশ বক্সী) – শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়

শেয়ার করুনঃ

সূচিপত্রঃ—

এক

কালীচরণ দাসকে পাড়ার লোকে আড়ালে শালীচরণ দাস বলে উল্লেখ করত। শুধু হাস্যরস সৃষ্টি করাই উদ্দেশ্য ছিল না, উদ্দেশ্য গভীরতর। নামের আদ্যাক্ষর বদল করে কোনো রসিক ব্যক্তি কালীচরণ দাসের প্রকৃতি উদ্‌ঘাটনের চেষ্টা করেছিলেন। আমরা এই কাহিনীতে তাকে শালীচরণ দাস বলেই উল্লেখ করব।

 

চৌদ্দ বছর আগে শালীচরণ কলকাতার দক্ষিণাংশে বাস করত এবং সামান্য কাজকর্ম করত। বাড়িটি ছোট হলেও দোতলা, শালীচরণ ওপরতলাটা একজনকে ভাড়া দিয়েছিল, নীচের তলায় নিজে সস্ত্রীক থাকত। তার স্ত্রী ছিল বন্ধ্যা। সংসারে আর কেউ ছিল না। তারপর হঠাৎ একদিন বৌ মরে গেল।

 

কিন্তু সংসার করতে হলে ঘরে একটি স্ত্রীলোক দরকার। শালীচরণের বয়স তখন ত্রিশ বছর, কিন্তু সে আর বিয়ে করল না; ভেবে-চিন্তে একটি বিধবা এবং অনাথা শালীকে এনে ঘরে বসাল। দূর সম্পর্কের শালী, নাম মালতী, বয়স কম, মাঝারি রকমের সুন্দরী, স্বভাব একটু চপল-চটুল; কিন্তু সংসারের কাজকর্মে নিপুণা।

 

মাসখানেক যেতে না যেতেই পাড়ায় কানাঘুষো আরম্ভ হয়ে গেল। শালীচরণের বৌ যতদিন বেঁচে ছিল নিজে গড়িয়াহাটে গিয়ে বাজার করত, পাড়াপড়শীর বাড়িতে যাতায়াত করত, কিন্তু শালী করে না কেন? শালীচরণ শালীকে ঘরের বাইরে যেতে দেয় না, নিজে বাজার করে কেন? বৌ-এর চেয়ে শালীর আদর কখন বেশি হয়?

 

তার ওপর শালীচরণের বাড়ির দোতলায় যে ভাড়াটে ছিল তাদের বাড়ির মেয়েরা একটা নতুন খবর বিতরণ করল। নীচের তলায় তাদের যাতায়াত ছিল। তারা বলল, শালী যখন প্রথম আসে তখন দুটো ঘরে দুটো আলাদা খাট বিছানা ছিল, এখন কেবল একটা ঘরে একটা বিছানা। ব্যাস্, আর যায় কোথায়! কালীচরণ দাস শালীচরণ দাসে পরিণত হল।

 

কিন্তু অপবাদ যে ভিত্তিহীন নয় তা চূড়ান্তভাবে প্রমাণ হল মাস ছয়েক পরে। শালীচরণের বাড়ির পাশের বাড়িতে একটা মেস ছিল, সেখানে বিশ্বনাথ পাল নামে এক যুবক থাকত। তার চেহারা যেমন বলবান তেমনি লাবণ্যময়, শালীচরণের মত বৈশিষ্ট্যহীন নয়। বিশ্বনাথ পাল ভাল অভিনয় করত, যাত্রা এবং সখের থিয়েটার দলে যোগ দিয়েছিল। তার সঙ্গে শালীচরণের শালীর নাম সংযুক্ত হয়ে নতুন করে কানাঘুষো আরম্ভ হল। দুপুরবেলা পুরুষেরা যখন কাজে বেরিয়ে যায় এবং মেয়েরা খাওয়া-দাওয়ার পর দিবানিদ্রায় নিমগ্ন হয় তখন নাকি বিশ্বনাথ পাল খিড়কির দোর দিয়ে শালীচরণের বাড়িতে যায়। এইভাবে কিছুদিন দিবাভিসার চলল। শালীচরণের বোধহয় সন্দেহ হয়েছিল, কিম্বা পাড়ার চ্যাংড়া ছোঁড়ারা হয়তো ব্যঙ্গ-বিদ্রুপপূর্ণ ইশারা করেছিল। সে একদিন দুপুরবেলা আচমকা খিড়কি দিয়ে বাড়ি ফিরে এল।

 

অতঃপর যে দৃশ্য উদ্‌ঘাটিত হল তা উহ্য রাখাই ভাল। মোট কথা আদিরস ও রুদ্ররস মিলে নাইট্রোগ্লিসারিনের মত বিস্ফোরক পরিস্থিতিতে পরিণত হল। শালীচরণ মেঘগর্জনের মত শব্দ করে অপরাধীদের আক্রমণ করল। কিন্তু বিশ্বনাথ পালের শরীরে অনেক বেশি শক্তি থাকা সত্ত্বেও তার মনে পাপ ছিল, সে পদাহত পথ-কুকুরের মত পালিয়ে গেল। বাকি রইল শুধু মালতী। শালীচরণ তখন বিকট চীৎকার করে মালতীর ঘাড়ে লাফিয়ে পড়ে তার গলা টিপে ধরল।

 

হুড়োহুড়ি চেঁচামেচিতে দোতলা থেকে লোক ছুটে এল, অল্পবয়স্ক বালক বালিকা ও স্ত্রীলোক। দৃশ্য দেখে তারা চীৎকার করে রাস্তার লোক ডাকল। রাস্তা থেকে দু’চার জন লোক এসে অতি কষ্টে শালীচরণের হাত থেকে মালতীর গলা ছাড়ালো। কিন্তু মালতী তখন দম বন্ধ হয়ে মরে গেছে।…

 

আদালতে শালীচরণের বিচার হল। সে অপরাধ অস্বীকার করল না। শালীর সঙ্গে অবৈধ সহবাসের অভিযোগও মেনে নিল। হাকিম বিজ্ঞ ব্যক্তি ছিলেন, মানুষের হৃদয়ের খবর রাখতেন। শালীচরণের ফাঁসি হল না, গুরুতর আকস্মিক প্ররোচনা বিধায় চৌদ্দ বছরের কারাদণ্ড হল।

 

শান্তভাবে শালীচরণ জেলে গেল। জেলে যাবার আগে ব্যবস্থা করে গেল: তার বাড়ির দোতলার ভাড়া সলিসিটার আদায় করে ব্যাঙ্কে রাখবেন; একতলা বন্ধ থাকবে। শালীচরণের বিষয়সম্পত্তি স্থাবর অস্থাবর আর কিছু ছিল না।

 

বিশ্বনাথ পাল সেই যে পালিয়েছিল, কিছুদিন গা-ঢাকা দিয়ে রইল। শালীচরণ জেলে চলে যাবার পর সে আবার আত্মপ্রকাশ করল। তার চেহারা ভাল, উপরন্তু যথেষ্ট অভিনয় নৈপুণ্য থাকায় সে অল্পকালের মধ্যেই চলচ্চিত্র ও রঙ্গমঞ্চের নামজাদা অভিনেতা হয়ে দাঁড়াল। চিত্রপটের চেয়ে রঙ্গালয়ের দিকেই তার ঝোঁক বেশি; সে দল গঠন করে একটি রঙ্গমঞ্চের অধিকারী হয়ে বসল।

 

ওদিকে শালীচরণ জেল খাটছিল, যথাকালে মেয়াদ পূর্ণ হলে মুক্তি পেয়ে বেরুল। জেলখানায় সুবোধ বালক হয়ে থাকলে কিছু রেয়াৎ পাওয়া যায়। শালীচরণ চৌদ্দ বছর পূর্ণ হবার আগেই বেরুল। এই কয় বছরে তার বয়স যেমন বেড়েছে তেমনি চেহারারও পরিবর্তন ঘটেছে; আগে সে ছিল রোগা-পট্‌কা, এখন বেশ চাকন-চিকন হয়েছে। সবচেয়ে পরিবর্তন হয়েছে তার মনে। মুক্তি পেয়েই সে সটান নবদ্বীপে চলে গেল, সেখান মাথা মুড়িয়ে কণ্ঠি ধারণা করে মালা জপ করতে করতে বাড়ি এল।

 

ইতিমধ্যে পাড়ার পুরোনো বাসিন্দারা অনেকে পাড়া ছেড়ে চলে গেছে, দোতলার ভাড়াটেও বদল হয়েছে, তাই শালীচরণ জেল থেকে ফেরার পর বিশেষ হৈ চৈ হল না। সেও কারুর সঙ্গে মেলামেশার চেষ্টা করল না। একলা থাকে, স্বপাক নিরামিষ খায় আর মালা জপ করে। মাঝে মাঝে সন্ধ্যের পর বেড়াতে বেরোয়। তার অর্থ উপার্জনের দরকার নেই। বারো বছর ধরে যে বাড়িভাড়া জমেছে তাই তার পক্ষে যথেষ্ট। উপরন্তু মাসে মাসে দোতলা থেকে ভাড়া আসে।

 

দুই

একটা শনিবার বিকেলে ব্যোমকেশ প্রতুলবাবুর বাড়িতে উপস্থিত হয়ে বলল, ‘সত্যবতী দাদার কাছে গিয়েছে, অজিত নিরুদ্দেশ, আমার হাতে কাজ নেই, তাই নিরুপায় হয়ে আপনাকে বিরক্ত করতে এলাম।’

 

প্রতুলবাবু বললেন, ‘শ্রীমতী সত্যবতীর দাদার কাছে যাওয়া বুঝলাম, মেয়েদের মাঝে মাঝে বাপের বাড়ি যাওয়ার বাসনা দুর্দমনীয় হয়ে ওঠে। কিন্তু অজিতবাবু নিরুদ্দেশ হলেন কেন?’

 

ব্যোমকেশ একটু বিমনাভাবে বলল, ‘কি জানি। কিছুদিন থেকে লক্ষ্য করছি ভোর হতে না হতে অজিত বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়, ফিরে আসে রাত ন’টার পর। প্রশ্ন করলে উত্তর দেয় না, মিটিমিটি হাসে।’

 

‘প্রেমে পড়েননি তো?’

 

‘অজিতের হৃদয়ে প্রেম নেই, আছে কেবল অর্থলিপ্সা। তাছাড়া প্রেমে পড়ার বয়স পেরিয়ে গেছে।’

 

‘তা বটে। চলুন, তাহলে থিয়েটার দেখে আসি।’

 

‘থিয়েটার?’

 

‘হ্যাঁ। কয়েক মাস থেকে একটা নতুন নাটক চলছে। বিশু পালের দল করছে। খুব ভাল রিপোর্ট পাচ্ছি। চলুন না, দেখে আসা যাক।’

 

‘মন্দ কথা নয়। বোধহয় ত্রিশ বছর থিয়েটার দেখিনি। নাটকের নাম কি?’

 

‘কীচক বধ।’

 

‘অ্যাঁ—পৌরাণিক নাটক!’

 

‘না না, আপনি যা ভাবছেন তা নয়। নামটা কীচক বধ বটে কিন্তু পরিস্থিতি আধুনিক; একজন নবীন নাট্যকার লিখেছেন। বর্তমান যুগেও যে কীচকের অভাব নেই, বরং এ যুগের কীচকেরা সে-যুগের কীচকের কান কেটে নিতে পারে এই হচ্ছে প্রতিভাবান নাট্যকারের প্রতিপাদ্য। স্বয়ং বিশু পাল কীচকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন।’

 

‘বিশু পাল কে?’

 

‘নটকেশরী বিশু পালের নাম জানেন না! দুর্ধর্ষ অ্যাক্‌টর। চলুন চলুন, দেখে আসবেন।’

 

‘নিতান্তই যদি আপনার রোখ চেপে থাকে—চলুন। নেই কাজ তো খই ভাজ।’

 

‘আচ্ছা, আমি তাহলে টেলিফোনে দুটো সিট রিজার্ভ করে আসি।’ প্রতুলবাবু পাশের ঘরে গেলেন।

 

ব্যোমকেশ কেয়াতলার বাড়িতে আসার পর প্রতুলবাবুর সঙ্গে আলাপ হয়েছে। দু’জনেই বুদ্ধিজীবী; উপরন্তু প্রতুলবাবু হৃদয়বান পুরুষ, সত্যবতীকে একটি মোটর কিনিয়ে দেবার জন্যে ব্যোমকেশের পিছনে লেগেছিলেন। সত্যবতীর বয়স বাড়ছে, এখন তার পক্ষে পায়ে হেঁটে বাজার করা কিম্বা সিনেমা দেখতে যাওয়া কষ্টকর, এই সব যুক্তি দেখিয়ে তিনি ব্যোমকেশের মন গলাবার চেষ্টা করেছিলেন। ফলে তিনি সত্যবতীর হৃদয় জয় করে নিয়েছিলেন কিন্তু ব্যোমকেশকে বিগলিত করতে পারেননি। ব্যোমকেশের আপত্তি, মোটর কেনার টাকা না হয় কষ্টেসৃষ্টে যোগাড় করা যায়, ছয় সাত হাজার টাকায় একটা সেকেন্ড-হ্যান্ড গাড়ি পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু তারপর? গাড়ি চালাবে কে? একটা ড্রাইভার রাখতে গেলে মাসে দেড়শো দু’শো টাকা খরচ। ঢাকের দায়ে মনসা বিকিয়ে যাবে। মধ্যবিত্ত গৃহস্থের পক্ষে বেশি বাড়াবাড়ি ভাল নয়। মাথায় চুল নেই লম্বা দাড়ি অত্যন্ত অশোভন।

 

‘সিট পাওয়া গেছে। চলুন, বেরিয়ে পড়া যাক।’ প্রতুলবাবু নিজের মোটরে ব্যোমকেশকে নিয়ে যাত্রা করলেন। অনেক দূর যেতে হবে, শহরের অন্য প্রান্তে। প্রতুলবাবু প্রচণ্ড পণ্ডিত হলে কি হয়, সেই সঙ্গে প্রগাঢ় থিয়েটার প্রেমিক।

 

এঁরা যখন রঙ্গালয়ের দিকে যাচ্ছিলেন সেই সময় কলেজ স্কোয়ারের এক কোণে গাছের তলায় একটি ভদ্ৰশ্রেণীর লোক দাঁড়িয়ে কারুর প্রতীক্ষা করছিল। তার হাতে একটি ছোট ব্যাগ, ব্যাগের মধ্যে এক সেট জামা-কাপড়। লোকটি অধীরভাবে ঘন ঘন কব্জির ঘড়ি দেখছিল। যদিও এ পাড়ায় তার চেনা লোকের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাতের সম্ভাবনা কম, তবু লোকটি রুমাল দিয়ে মুখের নিম্নর্ধ ঢাকা দিয়ে রেখেছিল। এই সময় এখানে ছাত্রদের ভীড় হয়, ছাত্ররা জলভ্রমির মত পুকুরের চারপাশে ঘুরপাক খাচ্ছে, তন্ময় হয়ে নিজেদের মধ্যে গল্প করছে। তবু বলা যায় না, পরিচিত কোনো ছাত্র তাকে দেখে চিনে ফেলতে পারে।

 

গলা খাঁকারির শব্দে চমকে উঠে লোকটি ঘাড় ফেরাল, দেখল অলক্ষিতে কখন একটা লোক তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। মুখে অজস্র দাড়ি গোঁফ, হাতে একটা মোটা লাঠি। লোকটি বলল, ‘এনেছি।’

 

প্রথম ব্যক্তি বলল, ‘কোথায়?’

 

দ্বিতীয় ব্যক্তি পাশের পকেট থেকে একটি রুমালের মত ন্যাকড়া বার করল। ন্যাকড়ার এক কোণে গিট বাঁধা, যেন সুপুরির মত একটা কিছু বাঁধা রয়েছে। প্রথম ব্যক্তি সেটি ভালভাবে দেখে বলল, ‘এতে কাজ হবে?’

 

দ্বিতীয় ব্যক্তি বলল, ‘হবে। খুব পাতলা কাচের অ্যাম্‌পুল। একটু ঠোকা পেলেই ফেটে যাবে।’

 

আর কোনো কথা হল না। প্রথম ব্যক্তি ব্যাগ থেকে কয়েকটা নোট বার করে দ্বিতীয় ব্যক্তিকে দিল, দ্বিতীয় ব্যক্তি টাকা পকেটে রেখে অ্যাম্‌পুলটি ভাল করে ন্যাকড়ায় জড়িয়ে প্রথম ব্যক্তিকে দিল। প্রথম ব্যক্তি সেটি সযত্নে জামা-কাপড়ের মধ্যে রেখে দিয়ে দ্বিতীয় ব্যক্তির পানে চাইল। দ্বিতীয় ব্যক্তির ঝাঁকড়া গোঁফের আড়াল থেকে এক ঝলক হাসি বেরিয়ে এল। সে বলল, ‘শুভমস্তু।’

 

তারপর দু’জনে ভিন্ন দিকে চলে গেল।

 

প্রতুলবাবু ব্যোমকেশকে পাশে নিয়ে প্রেক্ষাগৃহের প্রথম সারিতে বসেছিলেন। আশেপাশে কয়েকটি সিট খালি ছিল, কিন্তু পিছন দিক একেবারে ভরাট।

 

সাহেববেশী একটি লোক সামনের সারিতে এসে বসল। তার হাতে একটি ব্যাগ। বসবার পর সে দেখতে পেল পাশেই প্রতুলবাবু; অপ্রস্তুতভাবে একটু হেসে বলল, ‘কেমন আছেন?’

 

প্রতুলবাবু বললেন, ‘ভাল। আপনি কেমন?’

 

দু’ এক মিনিট শিষ্টতা বিনিময়ের পর লোকটি উঠে পড়ল, বলল, ‘যাই। এদিকে একটা কেসে এসেছিলাম, ভাবলাম দাদাকে দেখে যাই। —আচ্ছা।’

 

লোকটি ব্যাগ হাতে চলে যাবার পর প্রতুলবাবু বললেন, ‘বিশু পালের ছোট ভাই। ডাক্তারি করে।’

 

ব্যোমকেশ বলল, ‘কিন্তু পসার ভাল নয়।’

 

‘না, কষ্টেসৃষ্টে চালায়। কি করে বুঝলেন?’

 

‘ভাবভঙ্গী পোশাক পরিচ্ছদ দেখে বোঝা যায়।’

 

ঠিক সাড়ে ছ’টার সময় পর্দা উঠল, নাটক আরম্ভ হল। সাড়ে ন’টা পর্যন্ত চলবে। মাত্র তিনটি অঙ্ক।

 

গল্পটি মহাভারতের বিরাট পর্ব থেকে অপহৃত হলেও একেবারে মাছিমারা অনুকরণ নয়, যথেষ্ট মৌলিকতা আছে। বস্তুত নাটকের শেষ অঙ্কে ঠিক উল্টো ব্যাপার ঘটেছে, অর্থাৎ বর্তমান কালের কীচক বর্তমান কালের ভীমকে বধ করে দ্রৌপদীকে দখল করেছে। নাটকের চরিত্রগুলির অবশ্য আধুনিক নাম আছে, পাঠকের সুবিধার জন্যে পৌরাণিক নামই রাখা হল।

 

নাটকের অভিনয় হয়েছে উৎকৃষ্ট। ক্রূর নায়ক কীচকের ভূমিকায় বিশু পালের অভিনয় অতুলনীয়। দ্রৌপদীর চরিত্রে সুলোচনা নাম্নী যশস্বিনী অভিনেত্রী চমৎকার অভিনয় করেছে; তাছাড়া ভীম অর্জুন সুদেষ্ণা উত্তরা প্রভৃতির চরিত্রও ভাল অভিনীত হয়েছে। সব মিলিয়ে এই নাটকটিতে চিরন্তন মনুষ্য সমাজের বিচিত্র আলেখ্য যথাযথভাবে তুলে ধরা হয়েছে। ধর্মোপদেশ বা নীতিকথা শোনাবার চেষ্টা নেই।

 

প্রতুলবাবু পরমানন্দে থিয়েটার দেখছেন, ব্যোমকেশও আকৃষ্ট হয়ে পড়েছে। নাটক ক্রমশ তৃতীয় অঙ্কে এসে পৌছল। এবার চরম পরিণতি।

 

শেষ দৃশ্যটি হচ্ছে একটি শয়নকক্ষ। কক্ষে আসবাব কিছু নেই, কেবল একটি পালঙ্ক। এটি দ্রৌপদীর শয়নকক্ষ। ভীম পালঙ্কের ওপর চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে, কীচক আসবে।

 

ইতিপূর্বে ভীমের সঙ্গে দ্রৌপদীর পরামর্শ হয়েছে, দ্রৌপদী কীচককে তার ঘরে ডেকেছে। ভীম দ্রৌপদীর বদলে বিছানায় শুয়ে আছে, কীচক এলেই ক্যাঁক করে ধরবে।

 

নাটকের পরিসমাপ্তি এই রকম: ভীমের সঙ্গে কীচকের মল্লযুদ্ধ হবে; কীচক পরাজিত হয়ে মৃত্যুর ভান করে পালঙ্কের পায়ের কাছে পড়ে যাবে, ভীম তখন দ্রৌপদীকে ডাকতে যাবে। মিনিটখানেকের জন্যে মঞ্চ অন্ধকার হয়ে যাবে। তারপর অস্পষ্ট সবুজ আলো জ্বলবে। আস্তে আস্তে আলো উজ্জ্বল হবে। দ্রৌপদীকে নিয়ে ভীম ফিরে আসবে; কীচক ছুরি নিয়ে পিছন থেকে ভীমকে আক্রমণ করবে। ছুরিকাহত ভীম মরে যাবে। কীচক তখন পৈশাচিক হাস্য করতে করতে দ্রৌপদীকে পালঙ্কের দিকে টেনে নিয়ে যাবে। যবনিকা।

 

এবার দৃশ্যের আরম্ভের দিকে ফিরে যাওয়া যাক। ভীম পালঙ্কে চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে; ঘরের আলো খুব উজ্জ্বল নয়, তবে অন্ধকারও নয়। কীচক পা টিপে টিপে প্রবেশ করল, পা টিপে টিপে পালঙ্কের কাছে গেল। তারপর এক ঝটকায় চাদর সরিয়ে ফেলল। সঙ্গে সঙ্গে ঘরের আলো আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠল।

 

যিনি ভীম সেজেছেন তাঁর বপুটিও কম নয়, শালপ্রাংশু মহাভুজ। কীচক পরম কমনীয়া যুবতীর পরিবর্তে এই ষণ্ডামাকা পালোয়ানকে দেখে ক্ষণকালের জন্যে স্তম্ভিত হয়ে গেল, সেই ফাঁকে ভীম দাঁত কড়মড় করে তাকে আক্রমণ করল। কীচকের পকেটে ছুরি ছিল (পরস্ত্রী লোলুপ লম্পটেরা নিরস্ত্রভাবে অভিসারে যায় না) কিন্তু সে তা বের করবার অবকাশ পেল না। দু’জনে ঘোর মল্লযুদ্ধ বেধে গেল।

 

স্টেজের ওপর এই মরণান্তক কুস্তি সত্যিই প্রেক্ষণীয় দৃশ্য। মনে হয় না এটা অভিনয়। যেন দুটো ক্ষ্যাপা মোষ শিং-এ শিং আটকে যুদ্ধ করছে; একবার এ ওকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে, একবার ও একে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। লোমহর্ষণ লড়াই। শুধু এই লড়াই দেখবার জন্যেই অনেক দর্শক আসে।

 

শেষ পর্যন্ত কীচকের পরাজয় হল, ভীম তাকে পালঙ্কের পাশে মাটিতে ফেলে বুকে চেপে বসে তার গলা টিপতে শুরু করল। কীচকের হাঁত-পা এলিয়ে পড়ল, জিভ বেরিয়ে এল, তারপর সে মরে গেল।

 

ভীম তার বুক থেকে নেমে চোখ পাকিয়ে ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলল, ঘাড় চুলকে ভাবল, শেষে স্টেজ থেকে বেরিয়ে দ্রৌপদীকে খবর দিতে গেল।

 

ভীম নিষ্ক্রান্ত হবার সঙ্গে সঙ্গে স্টেজ ও প্রেক্ষাগৃহ অন্ধকার হয়ে গেল। এই নাটকে আলোর কৌশলে গল্পের নাটকীয়তা বাড়িয়ে দেবার নৈপুণ্য ভারি চমকপ্রদ। শেষ অঙ্কের চরম মুহূর্তে আলো সম্পূর্ণ নিভিয়ে দিয়ে পরিচালক বিশু পাল দর্শকের মনে উৎকণ্ঠা ও আগ্রহ বাড়িয়ে দিয়েছে।

 

মিনিটখানেক পরে দপ্ করে আবার সব আলো জ্বলে উঠল। দেখা গেল কীচক পূর্ববৎ খাটের খুরোর কাছে পড়ে আছে।

 

দ্রৌপদীকে নিয়ে ভীম প্রবেশ করল। ভীমের ভাবভঙ্গীতে উদ্ধত বিজয়োল্লাস, দ্রৌপদীর মুখে উদ্বেগ। তাদের মধ্যে হ্রস্বকণ্ঠে যে সংলাপ হল তা সংক্ষেপে এই রকম—

 

দ্রৌপদী: এখন মড়া নিয়ে কী করবে?

 

ভীম: কিছু ভেবো না, শেষ রাত্রে মড়া রাস্তায় ফেলে দিয়ে আসব।

 

নাটকের নির্দেশ, এই সময় কীচক মাটি থেকে চুপি চুপি উঠে ভীমের পিঠে ছুরি মারবে। কিন্তু কীচক যেমন পড়েছিল তেমনি পড়ে রইল, নড়ন চড়ন নেই। ছুরি মারার শুভলগ্ন অতিক্রম হয়ে যাবার পর ভীম উস্‌খুস্ করতে লাগল, দু’চারটে সংলাপ বানিয়ে বলল; কিন্তু কোনো ফল হল না। ভয়ানক সত্য আবিষ্কার করল প্রথমে দ্রৌপদী। শঙ্কিত মুখে কীচকের কাছে গিয়ে সে চীৎকার করে কেঁদে উঠল, ‘অ্যাঁ—একি! একি—!’

 

কীচক অথাৎ বিশু পাল সত্যি সত্যিই মরে গেছে।

 

তিন

নাটক শেষ হবার পাঁচ মিনিট আগে যবনিকা পড়ে গেল। যেসব দর্শকেরা আগে নাটক দেখেছিল তারা বিস্মিত হল, যারা দেখেনি তারা ভাবল এ আবার কি! কিন্তু কেউ কোনো গোলমাল না করে যে যার বাড়ি চলে গেল।

 

থিয়েটারের অন্দর মহলে তখন কয়েকজন মানুষ স্টেজের ওপর, কেউ বসে কেউ দাঁড়িয়ে ছিল। কেবল দ্রৌপদী অর্থাৎ সুলোচনা নাম্নী অভিনেত্রী মূৰ্ছিত হয়ে কীচকের পায়ের কাছে পড়ে ছিল। দারোয়ান প্রভুনারায়ণ সিং দরজা ছেড়ে স্টেজের উইংসে দাঁড়িয়ে অনিমেষ চোখে মৃত কীচকের পানে চেয়ে ছিল।

 

স্টেজের দরজা অরক্ষিত পেয়ে ব্যোমকেশ প্রতুলবাবুকে নিয়ে ঢুকে পড়েছিল। পরিস্থিতি স্বাভাবিক নয়, গুরুতর কিছু ঘটেছে সন্দেহ নেই; সুতরাং অনুসন্ধান দরকার।

 

স্টেজ থেকে তীব্র আলো আসছে। একটি লোক ব্যাগ হাতে বেরিয়ে দোরের দিকে যাচ্ছিল, প্রতুলবাবু তাকে থামিয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘কী হয়েছে, ডাক্তার পাল?’

 

অমল পাল, যে প্লে আরম্ভ হবার আগে তাদের পাশে গিয়ে বসেছিল, উদ্‌ভ্রান্তভাবে বলল, ‘দাদা নেই, দাদা মারা গেছেন।’

 

‘মারা গেছেন? কী হয়েছিল?’

 

‘জানি না, বুঝতে পারছি না। আমি পুলিসে খবর দিতে যাচ্ছি।’ অমল পাল দোরের দিকে পা বাড়াল।

 

এবার ব্যোমকেশ কথা কইল, ‘কিন্তু—আপনি বাইরে যাচ্ছেন কেন? যতদূর জানি এখানে টেলিফোন আছে।’

 

অমল পাল থমকে ব্যোমকেশের পানে চাইল, ধন্ধলাগাভাবে বলল, ‘টেলিফোন! হ্যাঁ হ্যাঁ, আছে বটে অফিস ঘরে—’

 

এই সময় দারোয়ান প্রভুনারায়ণ সিং এসে দাঁড়াল। লম্বা চওড়া মধ্যবয়স্ক লোক, থিয়েটারের পিছন দিকে কয়েকটা কুঠুরিতে সপরিবারে থাকে আর থিয়েটার বাড়ি পাহারা দেয়। সে অমল পালের পানে চেয়ে ভারী গলায় বলল, ‘সাব, মালিক তো গুজর গয়ে। আব্ ক্যা করনা হ্যায়?’

 

অমল পাল একটা ঢোক গিলে প্রবল বাষ্পেচ্ছ্বাস দমন করল, কোনো উত্তর না দিয়ে টেলিফোনের উদ্দেশ্যে অফিস ঘরের দিকে চলে গেল। প্রভু সিং ব্যোমকেশের পানে চাইল, ব্যোমকেশ বলল, ‘তুমি দারোয়ান? বেশ, দোরে পাহারা দাও। পুলিস যতক্ষণ না আসে কাউকে ঢুকতে বা বেরুতে দিও না।’

 

প্রভু সিং চলে গেল। সে সচ্চরিত্র প্রভুভক্ত লোক; তার সংসারে স্ত্রী আর একটি বিধবা বোন ছাড়া আর কেউ নেই। বস্তুত থিয়েটারই তার সংসার। বিশেষত অভিনেত্রী জাতীয় স্ত্রীলোকদের সে একটু বেশি স্নেহ করে। এই তার চরিত্রের একটি দুর্বলতা; কিন্তু নিঃস্বার্থ দুর্বলতা।

 

ব্যোমকেশ ও প্রতুলবাবু যখন মঞ্চে গিয়ে দাঁড়ালেন তখন তিনজন পুরুষ দ্রৌপদীকে অথাৎ অভিনেত্রী সুলোচনাকে ধরাধরি করে তুলে নিয়ে গ্রীনরুমে যাচ্ছে। তারা চলে গেলে স্টেজে রয়ে গেল দু’টি লোক: একটি ছেলেমানুষ গোছের মেয়ে, সে উত্তরার ভূমিকায় অভিনয় করেছিল; সে পালঙ্কের পায়ের দিকে দাঁড়িয়ে বিভীষিকা-ভরা চোখে মৃত বিশু পালের মুখের পানে চেয়ে ছিল। সে এখনো উত্তরার সাজ-পোশাক পরে আছে, তার মোহাচ্ছন্ন অবস্থা দেখে মনে হয় সে আগে কখনো অপঘাত মৃত্যু দেখেনি। তার নাম মালবিকা।

 

দ্বিতীয় ব্যক্তিটি যুবাপুরুষ, সে পালঙ্কের শিয়রের দিকে দাঁড়িয়ে ছিল এবং ক্রমান্বয়ে একবার মৃতের মুখের দিকে একবার মেয়েটির মুখের পানে চোখ ফেরাচ্ছিল। তার খেলোয়াড়ের মত দৃঢ় সাবলীল শরীর এবং সংযত নিরুদ্বেগ ভাব দেখে মনে হয় না যে সে এই থিয়েটারের আলোকশিল্পী। তার নাম মণীশ, বয়স আন্দাজ ত্রিশ।

 

ব্যোমকেশ ও প্রতুলবাবু স্টেজে প্রবেশ করে পালঙ্কের কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। মৃতের মুখে তীব্র আলো পড়েছে। মুখে মৃত্যুযন্ত্রণার ভান সত্যিকার মৃত্যুযন্ত্রণায় পরিণত হয়েছে। কিম্বা—

 

‘মুখের কাছে ওটা কী? প্রতুলবাবু মৃতের মুখের দিকে আঙুল দেখিয়ে খাটো গলায় প্রশ্ন করলেন।

 

ব্যোমকেশ সামনের দিকে ঝুঁকে দেখল, রুমালের মত এক টুক্‌রো কাপড় বিশু পালের চোয়ালের কাছে পড়ে আছে। সে বলল, ‘ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। রুমাল নয়। যখন লড়াই হচ্ছিল তখন ওটা চোখে পড়েনি।’

 

‘আমারও না।’

 

ব্যোমকেশ সোজা হয়ে বলল, ‘কোনো গন্ধ পাচ্ছেন?’

 

‘গন্ধ?’ প্রতুলবাবু দু’বার আঘ্রাণ নিয়ে বললেন, ‘সেন্ট-পাউডার, ম্যাক্‌সফ্যাক্‌টর, সিগারেটের ধোঁয়ার গন্ধ। আর তো কিছু পাচ্ছি না।’

 

‘পাচ্ছেন না? এইদিকে ঝুঁকে একটু ওঁকে দেখুন তো।’ ব্যোমকেশ মৃতদেহের দিকে আঙুল দেখাল।

 

প্রতুলবাবু সামনে ঝুঁকে কয়েকবার নিশ্বাস নিলেন, তারপর খাড়া হয়ে ব্যোমকেশের সঙ্গে মুখোমুখি হলেন, ঘাড় নেড়ে বললেন, ‘আপনি ঠিক ধরেছেন। বাদাম তেলের ক্ষীণ গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। তার মানে—’

 

যারা সুলোচনাকে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল তারা ফিরে এল। তাদের মধ্যে একজন হচ্ছে ব্রজদুলাল, অর্থাৎ ভীম; দ্বিতীয় ব্যক্তিটি থিয়েটারের প্রমপ্‌টার, নাম কালীকিঙ্কর; তৃতীয় ব্যক্তির নাম দাশরথি, সে কমিক অভিনেতা, নাটকে বিরাটরাজার পার্ট করেছে।

 

তিনজনে অস্বস্তিপূর্ণভাবে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল; মাঝে মাঝে মৃতদেহের পানে তাকাচ্ছে। এ অবস্থায় কি করা উচিত বুঝতে পারছে না। ভীমের হাতে তার ব্যাগ ছিল (পরে দেখা গেল অভিনেতা অভিনেত্রীরা সকলেই বাড়তি কাপড়-চোপড় এবং প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে অভিনয় করতে আসে)। ভীম ব্যাগটি স্টেজের ওপর রেখে নিজে সেখানে বসল; ব্যাগ খুলে আস্ত একটা হুইস্কির বোতল ও গেলাস বার করল, একবার সকলের দিকে চোখ তুলে গভীর স্বরে বলল, ‘কেউ খাবে?’

 

কেউ সাড়া দিল না। ভীম তখন গেলাসে খানিকটা মদ ঢেলে মালবিকার পানে চাইল। মালবিকার মুখ পাংশু, মনে হয় যেন তার শরীর অল্প অল্প টল্‌ছে। স্নায়ুর অবসাদ এসেছে, এখনি হয়তো মূৰ্ছিত হয়ে পড়বে। ভীম মণীশকে বলল, ‘মণীশ, মালবিকার অবস্থা ভাল নয়, এই নাও, একটু জল মিশিয়ে খাইয়ে দাও। নইলে ও যদি আবার অজ্ঞান হয়ে পড়ে, নতুন ঝামেলা শুরু হবে—’

 

মণীশ তার হাত থেকে গেলাস নিয়ে বলল, ‘সুলোচনাদিদির জ্ঞান হয়েছে?’

 

ভীম বলল, ‘এখনো হয়নি। নন্দিতাকে বসিয়ে এসেছি। মণীশ, তুমি মালবিকাকে ওঘরে নিয়ে যাও। ওষুধটা জল মিশিয়ে খাইয়ে দিও, তারপর খানিকক্ষণ শুইয়ে রেখো। দশ মিনিট শুয়ে থাকলেই ঠিক হয়ে যাবে।’

 

মণীশ এক হাতে মালবিকার পিঠ জড়িয়ে অন্য হাতে হুইস্কির গেলাস নিয়ে গ্রীনরুমের দিকে চলে গেল। ভীম তখন নিজের পুরুষ্টু গোঁফজোড়া ছিঁড়ে ফেলে দিয়ে হুইস্কির বোতলের গলায় ঠোঁট জুড়ে চুমুক মারল।

 

আমাদের দেশের যাত্রা থিয়েটারে ভীমের ইয়া গোঁফ ও গালপাট্টা দেখা যায়; যদিও মহাভারতে বেদব্যাস ভীমকে তূবর বলেছেন। অর্থাৎ ভীম মাকুন্দ ছিল। অবশ্য বর্তমান নাটকে ভীম মাকুন্দ না হলেও ক্ষতি নেই; এ-ভীম সে-ভীম নয়, তার অর্বাচীন বিকৃত ছায়ামাত্র।

 

লম্বা এক চুমুকে প্রায় আধাআধি বোতল শেষ করে ভীম বোতল নামিয়ে রাখল, প্যাঁচার মত মুখ করে কিছুক্ষণ বোতলের পানে চেয়ে রইল। তার গোঁফ-বর্জিত মুখখানা অন্য রকম দেখাচ্ছে, ন্যাড়া হাড়গিলের মত। সে কতকটা নিজের মনেই বলল, ‘ভীম-কীচকের লড়াই-এর পর আমার রোজই এক গেলাস দরকার হয়, নইলে গায়ের ব্যথা মরে না। আজ এক বোতলেও শানাবে না।’

 

ব্যোমকেশ এতক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে সব দেখছিল, শুনছিল। এখন শান্ত স্বরে প্রশ্ন করল, ‘বিশু পাল মদ খেতেন?’

 

ভীম তার পানে আরক্ত চোখ তুলে চাইল, তারপর মৃতদেহের দিকে একবার চোখ ফিরিয়ে বলল, ‘না। ওর দরকার হত না। লোহার শরীর ছিল। কিসে যে মারা গেল—। ডাক্তার অমলকে দেখেছিলাম, সে কোথায় গেল?’

 

ব্যোমকেশ বলল, ‘তিনি পুলিসকে টেলিফোন করতে অফিসে গেছেন। পুলিস এখনি এসে পড়বে। তার আগে আমি আপনাদের দু’ একটা প্রশ্ন করতে পারি?’

 

ভীম বোতলে আর এক চুমুক দিয়ে বলল, ‘করুন প্রশ্ন। আপনি কে জানি না, কিন্তু প্রশ্ন করার হক সকলেরই আছে।’

 

প্রতুলবাবু পরিচয় করিয়ে দিলেন, ‘ইনি সত্যান্বেষী ব্যোমকেশ বক্সী। থিয়েটার দেখতে এসেছিলাম একসঙ্গে, তারপর এই দুর্ঘটনা।’

 

ভীমের চোখের দৃষ্টি একটু সতর্ক হল, অন্য দু’জন ঘাড় ফিরিয়ে চাইল। ব্যোমকেশ বলল, ‘আজ আপনারা এখানে ক’জন উপস্থিত আছেন?’

 

ভীম বলল, ‘শেষ দৃশ্য অভিনয় হচ্ছিল। সাধাণরত শেষ দৃশ্যে যাদের কাজ নেই তারা বাড়ি চলে যায়। আজ বিশু সুলোচনা আর আমি ছিলাম। আর কারা ছিল না ছিল খবর রাখি না।’

 

কমিক অভিনেতা দাশরথি বলল, ‘আমি আর আমার স্ত্রী নন্দিতা ছিলাম।’

 

ব্যোমকেশ সপ্রশ্ন নেত্রে চাইল। দাশরথির এখন কমিক ভাব নেই, চোখে উদ্বিগ্ন দৃষ্টি। সে ইতস্তত করে বলল, ‘বিশুবাবুর সঙ্গে আমার কিছু কথা ছিল, তাই নাটক শেষ হবার অপেক্ষায় ছিলাম। তৃতীয় অঙ্কে আমার প্রবেশ নেই।’

 

‘আর কেউ ছিল?’

 

‘আর মালবিকা ছিল। টেক্‌নিশিয়ানদের মধ্যে মণীশ আর তার সহকারী কাঞ্চনজঙ্ঘা ছিল—’

 

‘কাঞ্চনজঙ্ঘা!’

 

‘তার নাম কাঞ্চন সিংহ, সবাই কাঞ্চনজঙ্ঘা বলে।’

 

‘ও, তিনি কোথায়?’

 

দাশরথি এদিক ওদিক চেয়ে বলল, ‘দেখছি না। কোথাও পড়ে ঘুম দিচ্ছে বোধহয়।’

 

‘আর কেউ?’

 

এতক্ষণে তৃতীয় ব্যক্তি কথা বলল, ‘আর আমি ছিলাম। আমি প্রমপ্‌টার, শেষ পর্যন্ত নিজের জায়গায় ছিলাম।’

 

‘আপনার জায়গা কোথায়?’

 

প্রমপ্‌টার কালীকিঙ্কর দাস আঙুল দেখিয়ে বলল, ‘ওই যে উইংসের খাঁজের মধ্যে টুল পাতা রয়েছে, ঐখানে।’

 

স্টেজের ওপর যে ঘরের সেট তৈরি হয়েছিল তার প্রবেশদ্বার মাত্র দু’টি: একটি পিছনের দেয়ালে, অন্যটি বাঁ পাশে; কিন্তু প্রসিনিয়ামের দু’পাশে থেকে এবং আরো কয়েকটি উইংসের প্রচ্ছন্ন পথে যাতায়াত করা যায়। প্রমপ্‌টার যেখানে দাঁড়ায় সেখানে যাওয়া আসার সঙ্কীর্ণ পথ আছে; বিপরীত দিকে আলোর কলকব্জা ও সুইচ বোর্ড যেখানে দেয়ালের সারা গায়ে বিছিয়ে আছে সেদিক থেকে স্টেজে প্রবেশের সোজা রাস্তা। আলোকশিল্পীকে সর্বদা স্টেজের ওপর চোখ রাখতে হয়, মাঝখানে আড়াল থাকলে চলে না।

 

এই সময় পিছনের দরজা দিয়ে মণীশ মালবিকার বাহু ধরে স্টেজে প্রবেশ করল। মালবিকার ফ্যাকাসে মুখে একটু সজীবতা ফিরে এসেছে। ওরা মৃতদেহের দিকে চোখ ফেরাল না। মণীশ বলল, ‘ব্রজদুলালদা, এই নিন আপনার গেলাস। মালবিকা এখন অনেকটা সামলেছে, ওকে এবার বাড়ি নিয়ে যাই?’

 

ভীম বলল, ‘এখনি যাবে কোথায়! এখনো পুলিস আসেনি।’

 

মণীশ সপ্রশ্ন চোখে ব্যোমকেশ ও প্রতুলবাবুর পানে চাইল। ব্যোমকেশ মাথা নাড়ল, ‘আমরা পুলিস নই। কিন্তু আপনাকে তো অভিনয় করতে দেখিনি—’

 

ভীম বলল, ‘ও অভিনয় করে না। ও আমাদের আলোকশিল্পী। মণীশ ভদ্র’র নাম শুনেছেন নিশ্চয়—বিখ্যাত সাঁতারু।’

 

মণীশ বলল, ‘আপনিও কম বিখ্যাত নন, ব্রজদুলালদা। এক সময় ভারতবর্ষের চ্যাম্পিয়ন মিড্ল-ওয়েট মুষ্টিযোদ্ধা ছিলেন।’

 

ভীম গেলাসে মদ ঢালতে ঢালতে বলল, ‘সেসব দিন গেছে ভায়া। বোসো বোসো, আজ রাত দুপুরের আগে কেউ ছাড়া পাচ্ছে না।’

 

মণীশ বলল, ‘কিন্তু কেন? পুলিস আসবে কেন? বিশুবাবুর মৃত্যু কি স্বাভাবিক মৃত্যু নয়? আমার তো মনে হয় ওঁর হার্ট ভেতরে ভেতরে দুর্বল হয়েছিল, লড়াই-এর ধকল সহ্য করতে পারেননি, হার্ট ফেল করে গেছে।’

 

ভীম বলল, ‘যদি তাই হয় তবু পুলিস তদন্ত করবে।’

 

মণীশ আর মালবিকা পাশাপাশি স্টেজের ওপর বসল। কিছুক্ষণ কোনো কথা হল না। কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে ঠিক নেই; কমিক অভিনেতা দাশরথি ওরফে বিরাটরাজ পকেট থেকে সিগারেট বার করে মৃতদেহের পানে কটাক্ষপাত করে সিগারেট আবার পকেটে পুরল।

 

ব্যোমকেশ বলল, ‘আচ্ছা, একটা কথা। মণীশবাবু এবং শ্রীমতী মালবিকা হলেন স্বামী-স্ত্রী—কেমন? ওঁরা একসঙ্গে এই থিয়েটারে কাজ করেন। এই রকম স্বামী-স্ত্রী এ থিয়েটারে আরো আছেন নাকি?’

 

ভীম গেলাসে এক চুমুক দিয়ে বলল, ‘দেখুন, আমাদের এই থিয়েটার হচ্ছে একটি ঘরোয়া কারবার। যারা এখানে কাজ করে, মেয়ে-মদ্দ কাজ করে। যেমন মণীশ আর মালবিকা, বিশু আর সুলোচনা, দাশরথি আর নন্দিতা। আমি অ্যাকটিং করি, আমার স্ত্রী শান্তি মিউজিক মাস্টার—গানে সুর বসায়। শান্তির কাজ শেষ হয়েছে, সে রোজ আসে না। আজ আসেনি। এমনি ব্যবস্থা। ছুট্ লোক বড় কেউ নেই।’

 

ব্যোমকেশ বলল, ‘বুঝলাম। এখন বলুন দেখি, বিশুবাবু মানুষটি কেমন ছিলেন?’

 

ভীম মদের গেলাস মুখে তুলল। দাশরথি উত্তেজিত হয়ে বলল, ‘সাধু ব্যক্তি ছিলেন। উদার প্রকৃতির মানুষ ছিলেন, মুক্তহস্ত পুরুষ ছিলেন। তিনি যেমন অগাধ টাকা রোজগার করতেন তেমনি দু’হাতে টাকা খরচ করতেন। মণীশকে নতুন মোটর কিনে দিয়েছিলেন, আমাদের সকলের নামে লাইফ্-ইনসিওর করেছিলেন। নিজে প্রিমিয়াম দিতেন। এ রকম মানুষ পৃথিবীতে। ক’টা পাওয়া যায়?’

 

ব্যোমকেশ গম্ভীর মুখে বলল, ‘তাহলে বিশুবাবুর মৃত্যুতে আপনাদের সকলেরই লাভ হয়েছে।’ একথার উত্তরে হঠাৎ কেউ কিছু বলতে পারল না, মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগল। শেষে ভীম বলল, ‘তা বটে। বিশু নিজের নামে জীবনবীমা করেছিল, কিন্তু উত্তরাধিকারী করেছিল আমাদের। তার মৃত্যুতে বীমার টাকা আমরাই পাব। কিন্তু সামান্য ক’টা টাকার জন্যে বিশুকে খুন করবে এমন পাষণ্ড এখানে কেউ নেই।’

 

‘তাহলে বিশুবাবুর শত্রু কেউ ছিল না?’

 

কেউ উত্তর দেবার আগেই বাঁ দিকের দোর দিয়ে ডাক্তার অমল পাল প্রবেশ করল। তার পিছনে একটি হিপি-জাতীয় ছোকরা। মাথার চুলে কপাল ঢাকা, দাড়ি গোঁফে মুখের বাকি অংশ সমাচ্ছন্ন; আসলে মুখখানা কেমন বাইরে থেকে আন্দাজ করা যায় না। সে মৃতদেহের দিকে একটি বঙ্কিম কটাক্ষ নিক্ষেপ করে চুপিচুপি মণীশদের পাশে গিয়ে বসল।

 

দাশরথি বলল, ‘এই যে কাঞ্চনজঙ্ঘা! কোথায় ছিলে হে তুমি?’

 

কাঞ্চনজঙ্ঘা যেন শুনতে পায়নি এমনিভাবে মণীশকে খাটো গলায় বলল, ‘ভীষণ মাথা ধরেছিল, মণীশদা। থার্ড অ্যাক্‌টে আমার বিশেষ কাজ নেই, তাই সিন্ ওঠার পর আমি কলঘরে গিয়ে মাথায় খুব খানিকটা জল ঢাললাম। তারপর অফিস ঘরে গিয়ে পাখাটা জোরে চালিয়ে দিয়ে টেবিলে মাথা রেখে একটু চোখ বুজেছিলাম। অফিসে কেউ ছিল না, তাই বোধহয় একটু ঝিম্‌কিনি এসে গিয়েছিল—’

 

মণীশ বিরক্ত চোখে তার পানে চাইল। দাশরথি বলল, ‘এত কাণ্ড হয়ে গেল কিছুই জানতে পারলে না।’

 

এবারও কাঞ্চনজঙ্ঘা কোনো কথায় কর্ণপাত না করে মণীশের কাছে আরো খাটো গলায় বোধকরি নিজের কার্যকলাপের কৈফিয়ৎ দিতে লাগল।

 

ব্যোমকেশ হঠাৎ গলা চড়িয়ে তাকে প্রশ্ন করল, ‘আপনার জন্যে বিশুবাবু কত টাকার বীমা করে গেছেন?’

 

কাঞ্চনজঙ্ঘা চকিতভাবে মুখ তুলল, ‘আমাকে বলছেন? বীমা! কই, আমার জন্যে তো বিশুবাবু জীবনবীমা করেননি!’

 

ব্যোমকেশ বলল, ‘করেননি? তবে যে শুনলাম—’

 

ভীম বলল, ‘ওর চাকরির এক বছর পূর্ণ হয়নি, প্রোবেশনে কাজ করছে, কাঁচা চাকরি—তাই—’

 

কাছেই প্রতুলবাবু ও অমল পাল দাঁড়িয়ে নিম্নস্বরে কথা বলছিলেন, ব্যোমকেশ কাঞ্চনজঙ্ঘাকে আর কোনো প্রশ্ন না করে সেইদিকে ফিরল। অমল পাল অস্বস্তিভরা গলায় বলছিল, ‘দাদার সঙ্গে সুলোচনার ঠিক—মানে—ওরা অনেকদিন স্বামী-স্ত্রীর মতই ছিল—’

 

ব্যোমকেশ প্রশ্ন করল, ‘বিশুবাবু বিয়ে করেননি?’

 

‘করেছিলেন বিয়ে। কিন্তু অল্পকাল পরেই বৌদি মারা যান। সে আজ দশ বারো বছরের কথা। ছেলেপুলে নেই।’

 

স্টেজের দোরের বাইরে মোটর হর্ন শোনা গেল। একটা পুলিস ভ্যান ও অ্যাম্বুলেন্স এসে দাঁড়িয়েছে। আট দশজন পোষাকী পুলিস ভ্যান থেকে নেমে প্রভু সিং-এর সঙ্গে কথা বলল। তারপর পিল্‌পিল্ করে স্টেজে ঢুকল। একজন অফিসার ব্যোমকেশদের দিকে এগিয়ে এসে বললেন, ‘আমি ইন্সপেক্টর মাধব মিত্র, থানা থেকে আসছি। কে টেলিফোন করেছিলেন?’

 

‘আমি—ডক্টর অমল পাল। আমার দাদা—’

 

‘কি ব্যাপার সংক্ষেপে বলুন।’

 

অমল পাল স্খলিত স্বরে আজকের ঘটনা বলতে আরম্ভ করলেন, ইন্সপেক্টর মাধব মিত্র ঘাড় একটু কাত করে শুনতে শুনতে স্টেজের চারিদিকে চোখ ফেরাতে লাগলেন; মৃতদেহ থেকে প্রত্যেক মানুষটি তাঁর দৃষ্টি প্রসাদে অভিষিক্ত হল। বিশেষত তাঁর অনুসন্ধিৎসু চক্ষু প্রতুলবাবু ও ব্যোমকেশের পাশে বারবার ফিরে আসতে লাগল। মাধব মিত্রের চেহারা ভাল, মুণ্ডিত মুখে চাতুর্য ও সতর্কতার আভাস পাওয়া যায়; তিনি কেবলমাত্র তাঁর উপস্থিতির দ্বারা যেন সমস্ত দায়িত্বের ভার নিজের স্কন্ধে তুলে নিয়েছেন।

 

ডাক্তার পালের বিবৃতি শেষ হলে ইন্সপেক্টর বললেন, ‘মৃতদেহ সরানো হয়নি?’

 

ব্যোমকেশ বলল, ‘না। কাউকে কিছুতে হাত দিতে দেওয়া হয়নি। যাঁরা ঘটনাকালে মঞ্চে ছিলেন তাঁরাও সকলেই উপস্থিত আছেন।’

 

ইন্সপেক্টর ব্যোমকেশের পানে চেয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘আপনারা—?’ তিনি বোধহয় অনুভব করেছিলেন যে এঁরা দু’জন থিয়েটার সম্পর্কিত লোক নন।

 

প্রতুলবাবু ব্যোমকেশের পরিচয় দিলেন, সহজাত বিনয়বশত নিজের পরিচয় উহ্য রাখলেন। মাধব মিত্রের মুখ এতক্ষণ হাস্যহীন ছিল, এখন ধীরে ধীরে তাঁর অধর-প্রান্তে একটু মোলায়েম হাসি দেখা দিল। তিনি বললেন, ‘আপনি সত্যান্বেষী ব্যোমকেশ বক্সী! আপনার যে থিয়েটার দেখার শখ আছে তা জানতাম না।’

 

ব্যোমকেশ বলল, ‘আর বলেন কেন, পণ্ডিত ব্যক্তির পাল্লায় পড়ে এই বিপত্তি। ইনি হলেন—’

 

ব্যোমকেশ প্রতুলবাবুর পরিচয় দিল। তারপর বলল, ‘মাধববাবু, আমরা মৃতদেহের কাছে একটা গন্ধ পেয়েছি। এই বেলা আপনি সেটা শুঁকে নিলে ভাল হয়। গন্ধটা বোধহয় স্থায়ী গন্ধ নয়।’

 

মাধববাবু ত্বরিতে ফিরে মৃতদেহের কাছে গেলেন, একবার তার আপাদমস্তক দেখে নিয়ে পাশে নতজানু হয়ে সামনের দিকে ঝুঁকে মৃতের মুখের কাছে মুখ নিয়ে গেলেন।

 

‘বিশ্বাস, শীগ্‌গির ডাক্তার ডেকে নিয়ে এস।’—মাধব মিত্র উঠে দাঁড়িয়ে ব্যোমকেশের দিকে ফিরলেন। তরুণ সাব-ইন্সপেক্টর বিশ্বাস প্রায় দৌড়তে দৌড়তে বাইরে চলে গেল। পুলিসের ডাক্তার পুলিস ভ্যানে অপেক্ষা করছিলেন।

 

‘আপনারা ঠিক ধরেছেন, গন্ধটা সন্দেহজনক।—এই যে ডাক্তার, একবার এদিকে আসুন তো—’

 

ব্যাগ হাতে প্রৌঢ় ডাক্তার মৃতের কাছে গেলেন, মাধববাবু ক্ষিপ্রস্বরে তাঁকে ব্যাপার বুঝিয়ে দিলেন।

 

পাঁচ মিনিট পরে শব পরীক্ষা শেষ করে ডাক্তার উঠে দাঁড়ালেন।

 

‘খুব ক্ষীণ গন্ধ, কিন্তু সায়ানাইড সন্দেহ নেই। এখনি মর্গে নিয়ে গিয়ে অটপ্সি করতে হবে, নইলে সায়ানাইডের সব লক্ষণই লুপ্ত হয়ে যাবে।’

 

‘সায়ানাইড কি করে প্রয়োগ করা হল, ডাক্তার?’

 

ডাক্তার মৃতের কাছ থেকে ন্যাক্‌ড়ার ফালিটা তুলে ধরে বললেন, ‘এই কাপড়ের এক কোণে গিট বাঁধা রয়েছে দেখছেন? ওর মধ্যে কাচের একটা অ্যাম্‌পুল ছিল, তার মধ্যে তরল সায়ানাইড ছিল। যখন স্টেজ অন্ধকার হয়ে যায় সেই সময় আততায়ী স্টেজে ঢুকে ন্যাক্‌ড়ার খুঁট ধরে মাটিতে আছাড় মারে, অ্যাম্‌পুল ভেঙ্গে যায়। তারপর—বুঝেছেন? হায়ড্রোসায়নিক অ্যাসিড খুব ভোলাটাইল—মানে—’

 

‘বুঝেছি’—মাধব মিত্র হাত নেড়ে পরিচরদের হুকুম দিলেন। তারা কীচকের মরদেহ ধরাধরি করে বাইরে নিয়ে গেল। ডাক্তার ন্যাক্‌ড়ার ফালি ব্যাগে পুরে কীচকের অনুগামী হলেন।

 

অমল পালের গলার মধ্যে একটা চাপা শব্দ হল, যেন সে প্রবল কান্নার বেগ রোধ করবার চেষ্টা করছে।

 

মাধব মিত্র একবার চারিদিকে তাকালেন, ভীম প্রমুখ কয়েকটি লোক স্টেজের মধ্যে প্রস্তর পুত্তলিকার মত বসে আছে। ভীমের বোতল ব্যাগের মধ্যে অন্তর্হিত হয়েছে। মালবিকার চোখে মোহাচ্ছন্ন দৃষ্টি। মাধব মিত্র ব্যোমকেশের দিকে এগিয়ে গিয়ে বললেন, ‘আজ বোধহয় এজাহার নিতে রাত কাবার হয়ে যাবে। আপনাদের অতক্ষণ আটকে রাখব না। কী দেখেছেন বলুন।’

 

ব্যোমকেশ বলল, ‘দেখলাম আর কই। যা কিছু ঘটেছে অন্ধকারে ঘটেছে।’

 

প্রতুলবাবু বললেন, ‘যেমন তেমন অন্ধকার নয়, সূচীভেদ্য অন্ধকার। আমরা চোখ থাকতেও অন্ধ ছিলাম।’

 

মাধববাবু নিশ্বাস ফেলে বললেন, ‘তাহলে আপনাদের আট্‌কে রেখে লাভ নেই। আজ আসুন তবে। যদি কোনো দরকারী কথা মনে পড়ে দয়া করে আমাকে স্মরণ করবেন। আচ্ছা, নমস্কার।’

 

ব্যোমকেশের ইচ্ছে ছিল আরো কিছুক্ষণ থেকে পরিস্থিতির গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে, কিন্তু এ রকম বিদায় সম্ভাষণের পর আর থাকা যায় না। দু’জনে দ্বারের অভিমুখে অগ্রসর হলেন। ব্যোমকেশ যেতে যেতে একবার ঘাড় ফিরিয়ে দেখল ইন্সপেক্টর অমল পালের সঙ্গে কথা কইছেন।

 

দোরের কাছে প্রভু সিং দাঁড়িয়েছিল। ব্যোমকেশ লক্ষ্য করল, দোরের বাইরে থেকে একটি মেয়ে ব্যগ্র চক্ষে স্টেজের দিকে উঁকি মারছে। যুবতী মেয়ে, মুখশ্রী ভাল, শাড়ি পরার ভঙ্গী ঠিক বাঙালী মেয়ের মত নয়। ব্যোমকেশদের আসতে দেখে সে সুট্ করে অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেল।

 

ব্যোমকেশ প্রভু সিং-এর কাছে গিয়ে দাঁড়াল, বলল, ‘ও মেয়েটি কে?’

 

প্রভু সিং একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল, ‘জি—ও আমার ছোট বোন সোমরিয়া। আমার কাছেই থাকে, থিয়েটারের কাজকর্ম করে, ঝটপাট ঝাড়পোঁছ—এই সব। মালিক ওকে খুব স্নেহ করতেন—’

 

‘হুঁ, সধবা মেয়ে মনে হল। তোমার কাছে থাকে কেন?’

 

প্রভু সিং বিব্রত হয়ে বলল, ‘জি, ওর মরদের সঙ্গে বনিবনাও নেই, তাই আমি নিজের কাছে এনে রেখেছি।’

 

‘তোমার সংসারে আর কেউ আছে?’

 

‘জি, ঔরৎ আছে, বাচ্চা মেয়ে আছে। থিয়েটারের হাতার মধ্যেই আমরা থাকি।’

 

প্রতুলবাবুর মোটর রাস্তার ধারে পার্ক করা ছিল। সেইদিকে যেতে যেতে ব্যোমকেশ দেখল থিয়েটারের হাতার মধ্যে পুলিসের ভ্যান ছাড়াও আরো দু’টি মোটর দাঁড়িয়ে আছে। একটি সম্ভবত বিশু পালের গাড়ি, আকারে বেশ বড় বিলিতি গাড়ি, খুব নতুন নয়; অন্য গাড়িটি কার অনুমান করা শক্ত। ভীমের হতে পারে, যদি ভীমের গাড়ি থাকে; অমল পাল ডাক্তার, তার গাড়ি হতে পারে; কিম্বা মণীশ ভদ্র’র হতে পারে। বিশু পাল মণীশকে গাড়ি কিনে দিয়েছিল—

 

এই সব চিন্তার মধ্যে ব্যোমকেশ অনুভব করল সে প্রতুলবাবুর গাড়িতে চড়ে বাড়ির দিকে ফিরে চলেছে। সে অন্যমনস্কভাবে একটা সিগারেট ধরিয়েছে, পাশের অন্ধকার থেকে প্রতুলবাবু বললেন, ‘আমি অন্ধকারের মধ্যে স্টেজের ওপর কিছু দেখিনি সত্য, কিন্তু মনে হয় কিছু শুনেছি।’

 

‘কি শুনেছেন?’ ব্যোমকেশ তাঁর দিকে ঘাড় ফেরাল।

 

‘একটা মিহি শব্দ।’

 

‘কি রকম মিহি শব্দ?’

 

‘ঠিক বর্ণনা করে বোঝানো শক্ত। এই ধরুন মেয়েরা হাত ঝাড়লে যেমন চুড়ির আওয়াজ হয়, সেই রকম।’

 

‘কাচের চুড়ি, না সোনার চুড়ি?’

 

‘তা বলতে পারি না। আপনি কিছু শুনতে পাননি?’

 

‘আমার কান ওদিকে ছিল না।’

 

পথে আর কোনো কথা হল না।

 

চার

পরদিন সকাল আন্দাজ সাড়ে সাতটার সময় ব্যোমকেশ বসবার ঘরে খবরের কাগজটা মুখের সামনে উঁচু করে ধরে গত রাত্রের থিয়েটারের খুনের বিবরণ পড়ছিল। সত্যবতী সকালে বাড়ি ফিরেছে, ব্যোমকেশকে এক পেয়ালা চা খাইয়ে গড়িয়াহাটে বাজার করতে গেছে, ফিরে এসে ব্যোমকেশকে আর এক পেয়ালা চা ও প্রাতরাশ দেবে। বাড়িতে কেবল অজিত আছে।

 

অন্দরের দিকের দরজা থেকে অজিত উঁকি মারল, দেখল ব্যোমকেশ মুখের সামনে কাগজের পর্দা তুলে দিয়ে খবর পড়ছে। অজিত নিঃশব্দে ঘরে ঢুকে গুটি গুটি সদর দোরের দিকে অগ্রসর হল। সে প্রায় দোর পর্যন্ত পৌঁচেছে পিছন থেকে শব্দ হল, ‘সাত সকালে চলেছ কোথায়?’

 

ধরা পড়ে গিয়ে অজিত দাঁড়াল, ভারিক্কিভাবে বলল, ‘দরকারী কাজে বেরুচ্ছি, টুকে দিলে তো?’

 

ব্যোমকেশ কাগজ নামিয়ে বলল, ‘বই-এর দোকানের কাজ?’

 

গাম্ভীর্য বর্জন করে অজিত মুখ টিপে হাসল।

 

ব্যোমকেশ বলল, ‘তোমার কার্য-কলাপ গতিবিধি ক্রমেই সন্দেহজনক হয়ে উঠছে। বিকাশকে ডেকে তোমার পিছনে টিকটিকি লাগাতে হবে দেখছি।’

 

‘সাত দিন ধৈর্য ধরে থাকো, তারপর আমি নিজেই সব বলব।’ অজিত বেরিয়ে গেল।

 

ব্যোমকেশ আবার কাগজ তুলে নিল। থিয়েটারে পুলিস প্রায় দেড়টা পর্যন্ত ছিল, থিয়েটারের আগাপাস্তলা তন্ন তন্ন করেছে; থিয়েটার সংশ্লিষ্ট যাবতীয় স্ত্রী পুরুষের জবানবন্দী নেওয়া হয়েছে। কেবল খ্যাতনামা অভিনেত্রী সুলোচনা শোকাভিভূত থাকার জন্য এজাহার দিতে পারেননি। লাশ রাত্রেই ব্যবচ্ছেদ করা হয়েছিল, লাশ-পরীক্ষক ডাক্তার বলেন, মৃতের শ্বাসনালী ও ফুস্‌ফুসের মধ্যে সাইনোজেন গ্যাসের অস্তিত্ব পাওয়া গিয়েছে, ওই ভয়ঙ্কর বিষই মৃত্যুর কারণ। মামলার পুলিস ইন-চার্জ ইন্সপেক্টর মাধব মিত্র মনে করেন, বিশু পালের মৃত্যু স্বাভাবিক মৃত্যু নয়, কেউ তাকে খুন করেছে। কিন্তু চিন্তার কারণ নেই, পুলিস তৎপর আছে, শীঘ্রই আসামী ধরা পড়বে। ওকুস্থলে অর্থাৎ প্রেক্ষাগৃহে ব্যোমকেশ ও প্রতুলবাবু উপস্থিত ছিলেন কাগজে সে কথারও উল্লেখ আছে।

 

বাইরে সত্যবতীর কণ্ঠস্বর শোনা গেল, সে বাজার করে ফিরেছে। তার পিছনে প্রতুলবাবু দু’হাতে দু’টি পরিপুষ্ট থলে নিয়ে আসছেন, মুখে একটু অপ্রতিভ হাসি। সত্যবতী ঘরে ঢুকে বলল, ‘ওগো, দ্যাখো কে এসেছেন। উনিও গড়িয়াহাটে বাজার করতে গিয়েছিলেন—ধরে নিয়ে এলুম।’

 

ব্যোমকেশ হেসে উঠে দাঁড়াল, বলল, ‘বাঃ, বেশ।—সত্যবতী ঝাঁকামুটের কাজটা আপনাকে দিয়েই করিয়ে নিয়েছে দেখছি।’

 

‘যাঃ, তা কেন? উনি নিজেই আমার হাত থেকে থলি কেড়ে নিলেন। —আপনারা বসে গল্প করুন, আমি চা তৈরি করে আনছি।’ নিজের থলি প্রতুলবাবুর হাত থেকে নিয়ে সত্যবতী ভেতরে চলে গেল।

 

প্রতুলবাবু নিজের থলিটি নামিয়ে রেখে ব্যোমকেশের সামনের চেয়ারে বসলেন, বললেন, ‘কাগজে কালকের কীচক বধের খবর পড়ছেন দেখছি। আমিও পড়েছি। —আচ্ছা, কাল থিয়েটার থেকে ফিরতে ফিরতে আপনাকে একটা কথা বলেছিলাম মনে আছে?’

 

‘কি কথা, চুড়ির ঝনাৎকার?’

 

‘হ্যাঁ, কাল থেকে চিন্তাটা মনের পিছনে লেগে আছে, পুলিসকে একথা জানানো উচিত কিনা।’

 

ব্যোমকেশ একটু নীরব থেকে প্রশ্ন করল, ‘ঝনাৎকার শব্দ স্টেজ থেকে এসেছিল এ বিষয়ে আপনি যোল আনা নিঃসংশয়?’

 

প্রতুলবাবু বললেন, ‘দেখুন, অন্ধকারে বসে থাকলে কোন্ দিক থেকে আওয়াজ আসছে সব সময় ধরা যায় না। তবু, স্টেজ থেকে যে আওয়াজটা এসেছিল এ বিষয়ে আমি বারো আনা নিঃসংশয়।’

 

‘তাহলে পুলিসকে বলা উচিত। ওরা যদি তা থেকে কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হয়—’

 

এই সময় সদর দোরের কাছ থেকে আওয়াজ এল, ‘আসতে পারি?’

 

ব্যোমকেশ মুখ তুলে বলল, ‘এস এস, রাখাল। তোমাদের কথাই হচ্ছিল।’

 

ইন্সপেক্টর রাখাল সরকার প্রবেশ করলেন, হেসে বললেন, ‘দু’জন আসামীই উপস্থিত আছেন দেখছি।’

 

ব্যোমকেশ বলল, ‘বসো। তোমার কি কাজকর্ম নেই, সকালবেলাই থানা ছেড়ে বেরিয়েছ যে!’

 

রাখালবাবু বললেন, ‘কাজকর্ম ঢিমে। কাগজে আপনাদের দু’জনের নাম দেখলাম। আপনারা আমার এলাকার লোক, তাই ভাবলাম তদারক করে আসি।’

 

সত্যবতী ট্রে’র ওপর দু’ পেয়ালা চা ও রাশীকৃত চিঁড়ে ভাজা নিয়ে এল। রাখালবাবু বললেন, ‘বৌদি, আমিও আছি। আর এক পেয়ালা চাই।’

 

আর এক পেয়ালা চা এল। তিনজনে চায়ের অনুপান সহযোগে চিঁড়ে ভাজা খেতে খেতে গত রাত্রির থিয়েটারী হত্যাকাণ্ডের আলোচনা করতে লাগলেন।

 

চিঁড়ে ভাজা নিঃশেষ হলে রাখালবাবু চায়ের পেয়ালায় অন্তিম চুমুক দিয়ে রুমালে মুখ মুছতে মুছতে বললেন, ‘ব্যোমকেশদা, এ পাড়ায় শালীচরণ দাস নামে কাউকে চেনেন?’

 

ব্যোমকেশ বলল, ‘শালীচরণ দাস! নামের একটা মহিমা আছে বটে কিন্তু আমি চিনি না। কে তিনি?’

 

রাখালবাবু বললেন, ‘বছর বারো আগে আমি এই থানাতেই সাব-ইন্সপেক্টর ছিলাম। তখন শালীচরণকে নিয়ে বেশ কিছুদিন হৈ চৈ চলেছিল।’

 

‘হৈ চৈ কিসের? কী করেছিলেন তিনি?’

 

‘শালীকে খুন করেছিল।’

 

‘শালীচরণ শালীকে খুন করেছিল!’

 

‘এবং বিশু পালের সঙ্গে এই ঘটনার কিছু যোগাযোগ আছে।’

 

‘তাই নাকি! বল বল, শুনি। —প্রতুলবাবু, আপনার গল্প শুনতে আপত্তি নেই তো?’

 

প্রতুলবাবু বললেন, ‘গল্প শুনতে কার আপত্তি হতে পারে? আমি এ পাড়ার পুরনো বাসিন্দা, শালীচরণ নামটা যেন চেনা-চেনা মনে হচ্ছে। আজ রবিবার, ভেবেছিলাম সকালবেলা একটু লেখাপড়া করব। তা গল্পই শোনা যাক।’

 

অতঃপর রাখালবাবু শালীচরণের অতীত কাহিনী বললেন। গল্প শুনে ব্যোমকেশ বলল, ‘শালীচরণ এখন কোথায়? জেল থেকে বেরিয়েছে?’

 

রাখালবাবু বললেন, ‘মাসখানেক হল। জেলখাটা কয়েদীদের খবরাখবর আমাদের রাখতে হয়—’

 

‘কোথায় আছে?’

 

‘নিজের বাড়ির একতলায় উঠেছিল। আজ কোথায় আছে জানি না। খোঁজ নিতে পারি।’

 

ব্যোমকেশ প্রতুলবাবুর দিকে কটাক্ষ নিক্ষেপ করে বলল, ‘আজ ছুটির দিন, একটু সত্যান্বেষণে বেরুলে কেমন হয়? শালীচরণ আমার মনোহরণ করেছে। যাবেন তার বাড়িতে তত্ত্ব-তল্লাশ নিতে?’

 

প্রতুলবাবু বললেন, ‘বেশ তো, চলুন না। আমি কখনো খুনী আসামী দেখিনি, একটা নতুন অভিজ্ঞতা হবে। উঠুন তাহলে। আমার গাড়ি রয়েছে, তাতেই যাওয়া যাক।’

 

তিনজনে গিয়ে গাড়িতে উঠলেন। রাখালবাবু ড্রাইভারকে পথ নির্দেশ করার জন্যে সামনের সিটে বসলেন।

 

যেতে যেতে ব্যোমকেশ প্রশ্ন করল, ‘আচ্ছা, রাখাল, মাধব মিত্তিরকে তুমি চেন?’

 

রাখালবাবু ঘাড় ফিরিয়ে বললেন, ‘চিনি। ওঁর সঙ্গে কিছুদিন একসঙ্গে কাজ করেছি।’

 

‘লোকটি কেমন বল তো?’

 

রাখালবাবু একটু চুপ করে থেকে বললেন, ‘খুব হুঁশিয়ার কাজের লোক, আর ভারি মুখমিষ্টি। কিন্তু নিজের এলাকায় কাউকে নাক গলাতে দেন না।’

 

‘হুঁ।’ ব্যোমকেশ প্রতুলবাবুর পানে চেয়ে একটু হাসল।

 

পাঁচ মিনিট পরে রাখালবাবুর নির্দেশ অনুসরণ করে মোটর একটি বাড়ির সামনে থামল। অপেক্ষাকৃত সরু রাস্তার ওপর ছোট দোতলা বাড়ি; বাড়ির গায়ে জীর্ণতার ছাপ পড়েছে। তিনজনে মোটর থেকে অবতীর্ণ হয়ে বাড়ির সদরে এসে দেখলেন দরজায় তালা ঝুলছে।

 

তিনজনে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলেন। বাড়িতে তালা লাগিয়ে শালীচরণ কোথায় গেল? বাজারে?

 

সদর দোরের মাথায় দোতলায় একটি অর্ধচন্দ্রাকৃতি ব্যালকনি ছিল, এক ভদ্রলোক সেখান থেকে নীচে উঁকি মারলেন, ‘কাকে চান?’

 

নীচে তিনজন ঊর্ধ্বমুখ হলেন। রাখালবাবু বললেন, ‘শালী—মানে কালীচরণ দাস আছেন?’

 

ত্রিশঙ্কুর মত ভদ্রলোক বললেন, ‘না, তিনি বাইরে গেছেন।’

 

‘কোথায় গেছেন?’

 

‘দাঁড়ান, আমি আসছি।’ ত্রিশঙ্কু ব্যালকনি থেকে অদৃশ্য হলেন।

 

অল্পক্ষণ পরে বাড়ির পাশের দিক থেকে ভদ্রলোক এসে দাঁড়ালেন। মধ্যবয়স্ক লোক, কিন্তু ভাবভঙ্গীতে চটুলতার আভাস বয়সের অনুকূল নয়। বললেন, ‘আমি কালীচরণবাবুর ভাড়াটে। ওপরতলায় থাকি। আপনারা কি তাঁর বন্ধু?’

 

ব্যোমকেশ হেসে বলল, ‘অন্তত শত্রু নয়; দর্শনার্থী বলতে পারেন। তিনি কোথায়?’

 

ভদ্রলোক হাসি-হাসি মুখে বললেন, ‘তিনি বোষ্টুমীকে নিয়ে বৃন্দাবন গেছেন।’

 

ব্যোমকেশ ভ্রূ তুলে বলল, ‘বৃন্দাবন! বোষ্টমী!’

 

ভদ্রলোকের মুখের হাসি আর একটু প্রকট হল, ‘আজ্ঞে। আমার বাসায় একটি কমবয়সী ঝি কাজ করত, দেখতে শুনতে ভাল, বোধহয় বিধবা। কাজকর্ম ভালই করছিল, তারপর কালীচরণবাবু জেল থেকে ফিরে এলেন। একলা মানুষ হলেও তাঁর একজন ঝি দরকার, চপলা—মানে আমার ঝি তাঁর কাজও করতে লাগল। কিছুদিন যেতে না যেতেই চপলা আমার কাজ ছেড়ে দিল, কেবল কালীচরণবাবুর কাজ করে। তারপর দেখলাম চপলা গলায় কণ্ঠি পরে বৈষ্ণবী হয়েছে। ক্রমে সন্ধ্যার পর নীচের তলা থেকে খঞ্জনির আওয়াজ আসে; যুগল-কণ্ঠে গান শোনা যায়—হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে—

 

‘দিন দশেক আগে একদিন সন্ধ্যেবেলা কালীচরণবাবু এক থালা মালপো আর পরমান্ন নিয়ে দোতলায় এলেন, সলজ্জভাবে জানালেন চপলা বোষ্টুমীকে তিনি কণ্ঠি-বদল করে বিয়ে করেছেন।’

 

নিঃশব্দ হাসিতে ভদ্রলোকের মুখ ভরে গেল।

 

ব্যোমকেশ চুলের মধ্যে দিয়ে আঙুল চালিয়ে বলল, ‘তাই তো। কবে বাইরে গেলেন?’

 

‘কাল সকালে।’

 

‘সকালে?’

 

‘আজ্ঞে। ভোরবেলা ওপরতলায় এসে আমাকে নীচের তলার চাবি দিয়ে বললেন, আমরা বৃন্দাবন যাচ্ছি বেলা দশটার ট্রেনে, হপ্তা দুই পরে ফিরব। এই বলে বোষ্টুমীকে ট্যাক্সিতে তুলে চলে গেলেন। বৃন্দাবনে নাকি কোন্ আখড়ায় মোচ্ছব আছে।’

 

ব্যোমকেশ রাখালবাবুর সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় করল, প্রতুলবাবু বললেন, ‘এটা বোধহয় বৈষ্ণবীয় হনিমুন।’

 

তারপর রসিক ভদ্রলোকটিকে ধন্যবাদ ও নমস্কার জানিয়ে তিনজনে গাড়িতে এসে উঠলেন। প্রতুলবাবু দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘খুনী আসামী দেখা আমার ভাগ্যে নেই।’

 

পাঁচ-ছয় দিন বিশুপাল বধ সম্বন্ধে আর কোনো নতুন খবর পাওয়া গেল না; সংবাদপত্রে খবরটি প্রথম পৃষ্ঠা ছেড়ে অন্দরমহলে গা-ঢাকা দিয়েছে। মাধব মিত্রের সাড়াশব্দ নেই। ভাবগতিক দেখে মনে হয় তিনি মামলার কোনো কিনারা করতে পারেননি, আসামী এখনো অজ্ঞাত।

 

ব্যোমকেশের হাতে অন্য কোনো কাজ ছিল না, তাই তার মনটা থিয়েটারী হত্যার দিকে পড়ে থাকত। শনিবার বিকেলবেলা সে প্রতুলবাবুকে ফোন করবে মনস্থ করেছে এমন সময় ফোন বেজে উঠল। স্বয়ং প্রতুলবাবু ফোন করছেন। তিনি বললেন, ‘এইমাত্র ইন্সপেক্টর মাধব মিত্রের পরোয়ানা এসেছে। তিনি আমার বাসায় আসছেন। আপনাকেও হাজির থাকতে হবে। বোধহয় হালে পানি পাচ্ছেন না।’

 

ব্যোমকেশ বলল, ‘হুঁ। আপনি তাকে কঙ্কণ ঝনাৎকারের কথা বলেছেন নাকি?’

 

‘না। তিনি এলে বলব।’

 

‘আর শালীচরণ দাসের রোমান্স?’

 

‘না, দরকার বোধ করেন আপনি বলবেন।’

 

‘আচ্ছা, আমি এখনি বেরুচ্ছি।’

 

‘গাড়ি পাঠাব?’

 

‘না না, দরকার নেই। দশ মিনিটের তো রাস্তা।’

 

‘গাড়ি থাকলে দু’ মিনিটে আসা যেত।’

 

ব্যোমকেশ হেসে বলল, ‘হুঁ। বুঝেছি আপনার ইঙ্গিত।’

 

পনেরো মিনিট পরে ব্যোমকেশ প্রতুলবাবুর বাড়িতে দোতলার বারান্দায় গিয়ে বসতে না বসতেই মাধব মিত্র উপস্থিত হলেন। তাঁর হাতে চামড়ার মোটা ফাইল। টেবিলের ওপর ফাইল রেখে তিনি বিনীত হাস্য করলেন, ‘বিরক্ত করতে এলাম। ভেবেছিলাম আপনাদের কষ্ট দেব না, কিন্তু গরজ বড় বালাই। আপনারা সে রাত্রে ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন; যদিও চোখে কিছু দেখেননি, তবু আপনাদের উপস্থিতিই আমার কাছে মূল্যবান। আপনারা জ্ঞানী গুণী ব্যক্তি, পরম পণ্ডিত। আপনাদের মানসিক সহযোগিতা পেলেই আমরা কৃতার্থ হয়ে যাব।’

 

লোকটির মিষ্টি কথা বলবার ক্ষমতা আছে বটে। কিন্তু ব্যোমকেশও হার মানবার পাত্র নয়। সে বলল, ‘সে কি কথা! পুলিসকে সাহায্য করা তো প্রত্যেক নাগরিকের কর্তব্য। তাছাড়া আপনি যে রকম মিষ্টভাষী সজ্জন ব্যক্তি আপনাকে সাহায্য করা তো গৌরবের কথা। আমরা কি করতে পারি বলুন। সে-রাত্রে থিয়েটার থেকে চলে আসার পর কী ঘটেছিল আমরা কিছুই জানি না; খবরের কাগজে যা পড়েছি তা ধর্তব্য নয়। এইটুকু শুধু জানি যে অজ্ঞাত আসামী এখনো সনাক্ত হয়নি।’

 

প্রতুলবাবু ইতিমধ্যে চা ফরমাস করেছিলেন, সঙ্গে এক প্লেট প্যাস্ট্রি। মাধববাবু এক চুমুক চা খেয়ে প্যাস্ট্রিতে কামড় দিলেন, চিবোতে চিবোতে বললেন, ‘না, সনাক্ত হয়নি। তবে জাল খানিকটা গুটিয়ে এনেছি। ঘটনাকালে যে দশজন মঞ্চে উপস্থিত ছিল তাদের মধ্যে ছাঁটাই করে গুটি তিনেক লোককে দাঁড় করানো গেছে। মুশকিল কি হয়েছে জানেন, ওদের সকলেরই একটা একটা মোটিভ আছে। তাহলে গোড়া থেকে বলি শুনুন—

 

‘আপনারা চলে আসবার পর থিয়েটারের মঞ্চ গ্রীনরুম অডিটোরিয়াম, তারপর হাতার মধ্যে প্রভুনারায়ণের কোয়ার্টার—সব খানাতল্লাশ করলাম; স্টেজের দোরের কাছে দুটো মোটর ছিল—একটা বিশু পালের, দ্বিতীয়টা মণীশ ভদ্র’র—সে দুটোও খুঁজে দেখলাম, কিন্তু সন্দেহজনক কিছু পাওয়া গেল না। আর্টিস্টরা সবাই ব্যাগ হাতে করে অভিনয় করতে আসে, তাদের ব্যাগের মধ্যেও সাধারণ কাপড়-চোপড় পাউডার লিপস্টিক ছাড়া বিশেষ কিছু নেই। কেবল মালবিকার ব্যাগে একটা নরুনের মত ধারালো ছুরি আর ব্রজদুলালের ব্যাগে এক বোতল হুইস্কি পাওয়া গেল। তারপর নিষ্ফল বডি সার্চ।’

 

মাধব মিত্র চায়ের পেয়ালা শেষ করে রুমালে মুখ মুছলেন, বললেন, ‘অতঃপর সাক্ষীদের জবানবন্দী নিতে শুরু করলাম। প্রথমে বিশু পালের ভাই অমল পাল—’

 

ব্যোমকেশ হাত তুলে বলল, ‘জবানবন্দী মুখে বলতে গেলে অনেক কথা বাদ পড়ে যাবে। তার চেয়ে যদি জবানবন্দীর নথি আপনার কাছে থাকে—’

 

মাধববাবু ফাইলের ওপর হাত রেখে একটু দ্বিধাভরে বললেন, ‘আছে। একটা কপি সর্বদাই সঙ্গে থাকে। কিন্তু—মুশকিল কি জানেন, ফাইল হাতছাড়া করার নিয়ম নেই। যাহোক, এক কাজ করা যেতে পারে, আমি বসছি, আপনি ফাইলে চোখ বুলিয়ে নিন। আপনার পড়াও হবে, নিয়ম রক্ষেও হবে। কি বলেন?’

 

ব্যোমকেশ নিস্পৃহ স্বরে বলল, ‘দেখুন, আমার কোনো আগ্রহ নেই। আপনার যদি আগ্রহ থাকে তবেই জবানবন্দী পড়ব।’

 

মাধববাবু ব্যস্ত হয়ে বললেন, ‘না না, সে কি কথা! আমার আগ্রহ আছে বলেই না আপনার কাছে এসেছি।’ তিনি ফাইল থেকে টাইপ করা ফুলস্ক্যাপ কাগজের একটা নথি বার করে ব্যোমকেশের দিকে এগিয়ে দিলেন, ‘এই নিন। আপনি পড়ুন, আমি না হয় ততক্ষণ প্রতুলবাবুর সঙ্গে পাশের ঘরে বসে গল্প করি।’

 

ব্যোমকেশ নথি টেনে নিয়ে বলল, ‘মন্দ কথা নয়। প্রতুলবাবু আপনাকে কিছু নতুন খবর দিতে পারবেন। আমিও একটা খবর দেব। আগে জবানবন্দী পড়ি। ডাক্তারের ময়না তদন্তের রিপোর্ট নথিতে আছে নাকি?’

 

‘আছে। তিনি ডাক্তারি পরিভাষার কচ্‌কচি রিপোর্টে যথাসম্ভব সরল করে দিয়েছেন।’

 

ব্যোমকেশ সিগারেট ধরিয়ে জবানবন্দীর নথির পাতা খুলে পড়তে আরম্ভ করল।

 

থিয়েটারের অফিস ঘরে বসে মাধব মিত্র একের পর এক সাক্ষী ডেকে তাদের এজাহার নিয়েছিলেন। একজনের এজাহার নেবার সময় অন্য কোনো সাক্ষী উপস্থিত ছিল না।

 

অমল পাল। বয়স—৩৯। জীবিকা—ডাক্তারি। ঠিকানা—* * গোলাম মহম্মদ রোড, দক্ষিণ কলিকাতা।

 

মৃত বিশ্বনাথ পাল আমার দাদা ছিলেন। আমরা দুই ভাই; আমি কনিষ্ঠ। দাদা আমার পড়ার খরচ দিয়ে ডাক্তারি পড়িয়েছিলেন। আমি দক্ষিণ কলকাতায় প্র্যাক্‌টিস করি, দাদা থিয়েটারের কাছে থাকার জন্যে শ্যামবাজারে থাকতেন। তিনি বিপত্নীক ও নিঃসন্তান ছিলেন। শ্যামবাজারের বাসায় অভিনেত্রী সুলোচনা তাঁর সঙ্গে থাকত। আমার সুযোগ হলে আমি থিয়েটারে এসে কিম্বা শ্যামবাজারের বাসায় গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করতাম। তাঁর সঙ্গে আমার পরিপূর্ণ সদ্ভাব ছিল, তিলমাত্র মনোমালিন্য কোনো দিন হয়নি।

 

দাদা উদার চরিত্রের মানুষ ছিলেন, পরোপকারী ছিলেন। তিনি পনেরো হাজার টাকার লাইফ ইন্‌সিওর করে আমাকে তার ওয়ারিশ করেছিলেন। শুনেছি থিয়েটারের আরো অনেক লোককে লাইফ ইন্‌সিওরের ওয়ারিশ করেছিলেন। কাউকে দশ হাজার, কাউকে পাঁচ হাজার। তিনি অজস্র টাকা রোজগার করতেন, কোনো বদ্‌খেয়াল ছিল না; যাদের ভালবাসতেন তাদের দু’হাত ভরে দিতেন।

 

নৈতিক চরিত্র? তিনি আমার গুরুজন ছিলেন, তাঁর নৈতিক চরিত্র সম্বন্ধে কোনো কথা বলবার অধিকার আমার নেই। সুলোচনার সঙ্গে ওঁর বিবাহিত সম্বন্ধ না থাকলেও ওঁরা স্বামী-স্ত্রীর মতই থাকতেন।

 

দাদার শত্ৰু? শত্ৰু কেউ ছিল বলে তো মনে হয় না। সকলেই তাঁর অনুগৃহীত, শত্রুতা কে করবে?

 

আমি আজ এ পাড়ায় একটা ‘কল’এ এসেছিলাম, ভাবলাম দাদার সঙ্গে দুটো কথা বলে যাই; তাই থিয়েটারে এসেছিলাম। আমার ডাক্তারি প্র্যাক্‌টিস মোটের ওপর মন্দ নয়। আমি বিবাহিত; তিনটি মেয়ে দু’টি ছেলে।

 

আজ নাটক শেষ হবার ঠিক আগে যখন এক মিনিটের জন্যে আলো নিভিয়ে দেওয়া হল তখন আমি স্টেজের পিছন দিকে একটা টুলের ওপর বসে সিগারেট টানছিলাম। তখন কে কোথায় ছিল, নিজের জায়গা থেকে নড়েছিল কিনা আমি লক্ষ্য করিনি। আলো জ্বলার পরে আবার অভিনয় আরম্ভ হল, কিছুক্ষণ পরে চীৎকার কান্না হৈ হৈ, ড্রপসিন পড়ে গেল। তখন আমি স্টেজে এসে দেখলাম—

 

আমি ডাক্তার, কিন্তু দাদার মৃত্যুর কারণ আমি বুঝতে পারিনি। এত অল্প সময়ের মধ্যে মৃত্যু—হার্ট ফেলিওর হতে পারে। কিন্তু দাদার হার্ট দুর্বল ছিল না, কয়েক দিন আগে আমি পরীক্ষা করেছি। মৃত্যুর প্রকৃত কারণ পোস্ট-মর্টেমে জানা যাবে। এ যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত, এখনো ঠিক ধারণা করতে পারছি না।

 

দাদা যদি উইল করে গিয়ে থাকেন তাহলে কে তাঁর উত্তরাধিকারী আমি জানি না, সলিসিটার সিংহ-রায়ের অফিসে খোঁজ নিয়ে জানা যাবে। যদি উইল না থাকে তাহলে সম্ভবত আমিই তাঁর উত্তরাধিকারী। তাঁর স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি কী আছে আমি জানি না।

 

ব্রজদুলাল ঘোষ। বয়স—৪২। জীবিকা—নাট্যাভিনয়। ঠিকানা—* * শ্যামপুকুর লেন।

 

ইন্সপেক্টরবাবু, আপনি সুলোচনাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু সে এখনো সম্পূর্ণ প্রকৃতিস্থ হয়নি। আপনি আগে আমাকে প্রশ্ন করুন। আমার এজাহার শেষ হলে সুলোচনা আসবে।

 

প্রশ্ন: আপনি এই নাটকে ভীমের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন?

 

উত্তর: হ্যাঁ। বিশু যতগুলি নাটক মঞ্চস্থ করেছিল সব নাটকেই আমি অভিনয় করেছি।

 

প্রশ্ন: কতদিন তাঁর সঙ্গে আছেন?

 

উত্তর: তা প্রায় দশ বছর। বিশু যখন নিজের দল তৈরি করে আসরে নামল তখন থেকে আমি ওর সঙ্গে আছি।

 

প্রশ্ন: আপনার মত আর কেউ গোড়া থেকে আছে?

 

উত্তর: গোড়া থেকে—। আছে। কমিক অভিনেতা দাশরথি চক্কোত্তি আর তার বৌ নন্দিতা। অন্য যারা ছিল তারা এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়েছে।

 

প্রশ্ন: আপনাদের কারুর সঙ্গে বিশু পালের অসদ্ভাব ছিল?

 

উত্তর: দেখুন, কুমীরের সঙ্গে বিবাদ করে জলে বাস করা যায় না। কার মনে কি আছে জানি না, কিন্তু বাইরে কোনো অসদ্ভাব ছিল না। বিশু ছিল দিলদরিয়া মেজাজের লোক, দলের লোককে সে ঘরের লোক বলে মনে করত। এমন অমায়িক চরিত্র দেখা যায় না।

 

প্রশ্ন: বিশু পালের চরিত্রে কোনো দোষ ছিল না?

 

উত্তর: একটু আধটু দোষ কার না থাকে? ঠক্ বাছতে গাঁ উজোড়। বিশু মরে গেছে, কিন্তু আমি গলা ছেড়ে বলতে পারি সে উঁচু মেজাজের সজ্জন ব্যক্তি ছিল। যারা তার দলে কাজ করেছে তারা সপরিবারে কাজ করেছে। সমস্ত থিয়েটারটাই একটা পারিবারিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে, যেন আমাদের সকলের এজমালি থিয়েটার। এখন সে মরে গেছে, এরপর কী হবে জানি না।

 

প্রশ্ন: আচ্ছা, এবার আপনার ঘরের কথা কিছু জিজ্ঞেস করি। আপনার পরিবারে কে কে আছে?

 

উত্তর: বুড়ি পিসি আছেন। আমার স্ত্রী শান্তি আছে আর একটি মেয়ে আছে। মেয়ে স্কুলে পড়ে। শান্তি আমাদের থিয়েটারে গান-বাজনা শেখায়।

 

প্রশ্ন: তিনি আজ আসেননি?

 

উত্তর: না। নতুন নাটকের যখন মহড়া আরম্ভ হয় তখন সে আসে, নাচ-গান শেখায়; নাটক একবার চালু হলে তার কাজ থাকে না, তখন আর বড় একটা আসে না। বাড়িতে একটা নাচ-গানের কোচিং ক্লাস খুলেছে, তাইতে শেখায়।

 

প্রশ্ন: আপনি থিয়েটারে যোগ দেবার আগে কোনো কাজ করতেন কি?

 

উত্তর: হ্যাঁ, আমি মুষ্টিযোদ্ধা ছিলাম। একবার ভারতের মিড্ল-ওয়েট চ্যাম্পিয়ান হয়েছিলাম। একটি জিম্‌নেসিয়ামে বক্সিং শেখাতাম। কিন্তু থিয়েটারের শখ বরাবরই ছিল, একটা সুযোগ পেয়ে চলে এলাম।

 

প্রশ্ন: আজ স্টেজের ওপর বিশু পালের সঙ্গে আপনার মল্লযুদ্ধ হয়েছিল; তখন আপনি বিশু পালের শরীরে কোনো দুর্বলতা লক্ষ্য করেছিলেন?

 

উত্তর: না। ঠিক অন্য দিনের মত।

 

প্রশ্ন: কখন জানতে পারলেন বিশু পালের মৃত্যু হয়েছে?

 

উত্তর: আমি জানতে পারিনি। লাইট অফ্ হয়ে যাবার পর আমি আর সুলোচনা পিছন দিকের দোরের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলাম, আলো জ্বললে স্টেজে এসে অ্যাক্‌টিং আরম্ভ করলাম। এই সময় বিশুর মাটি থেকে উঠে আমার পিঠে ছুরি মারবার কথা; কিন্তু বিশু উঠল না। তারপরই সুলোচনা চীৎকার করে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। তখন আমি বুঝতে পারলাম।

 

প্রশ্ন: এর বেশি আপনি কিছু জানেন না? আচ্ছা, আজ আপনি বাড়ি যান। যদি নতুন কিছু মনে পড়ে জানাবেন।

 

সুলোচনা। বয়স—৩৫। জীবিকা—নাট্যাভিনয়। ঠিকানা—* * শ্যামবাজার, উত্তর কলিকাতা।

 

সুলোচনা মুখের রঙ অনেকটা পরিষ্কার করেছে, তবু কানে ও গলায় কিছু পেন্ট লেগে আছে। তার গায়ের রঙ ফরসা, শরীরের গড়ন ভাল; কিন্তু আকস্মিক বিপর্যয়ে একেবারে যেন ভেঙে পড়েছে। অফিস ঘরে এসে মাধব মিত্রের সামনের চেয়ারে সে বসে পড়ল, আর্তস্বরে নিজেই প্রথমে প্রশ্ন করল, ‘কে একাজ করল, দারোগাবাবু?’

 

উত্তরে দারোগা প্রশ্ন করলেন, ‘কোন্ কাজ?’

 

সুলোচনার চোখ দারোগার মুখের ওপর স্থির হল, গলার স্বরে তীক্ষ্ণতা এল। সে বলল, ‘আপনি জানেন না কোন্ কাজ? ওঁর শরীরে কোনো রোগ ছিল না, ওঁর মৃত্যু স্বাভাবিক নয়। কেউ ওঁকে খুন করেছে।’

 

প্রশ্ন: এ বিষয়ে এখনো ডাক্তারের রিপোর্ট পাওয়া যায়নি, তবে আপনার অনুমান সত্যিও হতে পারে। যদি সত্যি হয়, কে খুন করেছে আপনি বলতে পারেন?

 

উত্তর: তা কি করে বলব। কিন্তু ওঁর কোনো শত্রু ছিল না।

 

প্রশ্ন: শত্রু না থাকলেও বিশু পালের মৃত্যুতে অনেকের লাভ ছিল। যাদের উদ্দেশ্যে উনি লাইফ ইন্‌সিওর করেছিলেন তাঁর মৃত্যুতে তাদের সকলেরই লাভ। নয় কি?

 

উত্তর: তা সত্যি কিন্তু এমন কে আছে কয়েকটা টাকার জন্যে চিরজীবনের উপকারী বন্ধুকে খুন করবে!

 

প্রশ্ন: আপনি কাউকে সন্দেহ করেন না?

 

উত্তর: না।

 

প্রশ্ন: বাইরের কেউ হতে পারে না?

 

উত্তর: বাইরের লোক! তা জানি না। তিনি থিয়েটারের বাইরের অনেক লোককে চিনতেন, কার মনে কী আছে কেমন করে জানব?

 

প্রশ্ন: আচ্ছা যাক। আপনার সঙ্গে বিশুবাবুর কতদিনের পরিচয়?

 

উত্তর: প্রায় পাঁচ বছর।

 

প্রশ্ন: কোথায় পরিচয় হয়েছিল? কে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল?

 

উত্তর: এই থিয়েটারে পরিচয় হয়েছিল। ব্রজদুলালবাবু আগে থাকতে আমাকে চিনতেন, তিনিই পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন।

 

প্রশ্ন: আগেও থিয়েটার করতেন নাকি?

 

উত্তর: নিয়মিত নয়, মাঝে মাঝে করতাম।

 

প্রশ্ন: আপনার পারিবারিক পরিস্থিতি কিছু জানতে চাই।

 

উত্তর: মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। কম বয়সে বিধবা হয়েছিলুম। থিয়েটারের দিকে ঝোঁক ছিল। সুযোগ পেয়ে চলে এলুম।

 

প্রশ্ন: এ থিয়েটারে আসার পর থেকে বিশুবাবুর সঙ্গে আছেন?

 

উত্তর: হ্যাঁ। বিয়ে হয়নি, কিন্তু উনিই আমার স্বামী।

 

প্রশ্ন: বাপের বাড়ির সঙ্গে আর আপনার কোনো সম্বন্ধ নেই?

 

উত্তর: না। আমার মা বাবা নেই, দাদা খবর রাখেন না।

 

প্রশ্ন: ডাক্তার অমল পালের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কেমন?

 

উত্তর: ভাল। সে তার দাদাকে শ্রদ্ধা করত। বাড়িতে বড় একটা আসত না, দরকার হলে এখানে এসে দাদার সঙ্গে দেখা করত।

 

প্রশ্ন: কিসের দরকার—টাকার?

 

উত্তর: হ্যাঁ। বেশির ভাগই টাকা। ওর ডাক্তারি ভাল চলে না। অনেকগুলি ছেলেমেয়ে—

 

প্রশ্ন: বিশু পালের স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি এখন কে পাবে আপনি জানেন?

 

উত্তর: যতদূর জানি উনি উইল করে যাননি। স্থাবর সম্পত্তির কথাও কখনো শুনিনি। ব্যাঙ্কে কিছু টাকা আছে, আর মোটর গাড়িটা আছে। ব্যাঙ্কের টাকা কে পাবে তা জানি না, তবে গাড়িটা আমার নামে আছে, সম্ভবত আমার নামেই থাকবে।

 

প্রশ্ন: এবার শেষ প্রশ্ন। আজ অভিনয়ের সময় কিছু দেখেছেন কিম্বা শুনেছেন কি যা আমাদের কাজে লাগতে পারে?

 

সুলোচনা একটু চিন্তা করে বলল, ‘সন্দেহজনক কিছু নয়, তবে সোমরিয়াকে উইংসের বাইরে এক কোণে লুকিয়ে বসে থাকতে দেখেছি। সে মাঝে মাঝে ভিতরে এসে থিয়েটার দেখে।’

 

প্রশ্ন: সোমরিয়া কে?

 

উত্তর: দারোয়ান প্রভু সিং-এর বোন।

 

ইন্সপেক্টর: আচ্ছা, আজ এই পর্যন্ত।

 

মণীশ ভদ্র। বয়স—২৯। জীবিকা—থিয়েটারের আলোকযন্ত্র পরিচালনা। ঠিকানা * * আমহার্স্ট স্ট্রীট।

 

মণীশ ঘরে ঢুকে একবার কজির ঘড়ির দিকে তাকালো। রেডিয়াম লাগানো ঘড়ি, অন্ধকারেও সময় দেখা যায়। সে চেয়ারে বসে বলল, ‘পৌনে এগারটা। দারোগাবাবু, বড্ড রাত হয়ে গেছে, একটু তাড়াতাড়ি ছেড়ে দেবেন? হোটেল সব বন্ধ হয়ে গেছে, আজ আর বোধহয় কিছু জুটবে না—’

 

মাধববাবু বললেন, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, আপনার এজাহার পাঁচ মিনিটের বেশি লাগবে না।’

 

মণীশ বলল, ‘আমি একলা নয়, বৌও আছে। —দু’জনের এজাহার একসঙ্গে নিলে হয় না?’

 

মাধববাবু বললেন, ‘না, তা হয় না। আপনারা দু’জন দু’ জায়াগায় ছিলেন। —আচ্ছা, বলুন দেখি, আলো নেভাবার পর আপনি কী করলেন?’

 

উত্তর: সুইচের ওপর হাত রেখে ঘড়ির পানে তাকিয়ে রইলাম, পঁয়তাল্লিশ সেকেন্ড পরে সুইচ টিপে আলো জ্বাললাম।

 

প্রশ্ন: আপনার বোর্ডে অনেকগুলি সুইচ, কোনটা কোথাকার সুইচ সব আপনার নখদর্পণে?

 

উত্তর: হ্যাঁ, তবু সাবধান থাকা ভাল, তাই এই দৃশ্যে সুইচে হাত রাখি।

 

প্রশ্ন: ঠিক পঁয়তাল্লিশ সেকেন্ড কেন?

 

উত্তর: বিশুবাবু সময় ধার্য করে দিয়েছিলেন, পঁয়তাল্লিশ সেকেন্ড হাউস অন্ধকার থাকবে।

 

প্রশ্ন: আপনার একজন সহকারী আছে না?

 

উত্তর: আছে। কাঞ্চন সিংহ। সে আমার সঙ্গে সুইচ বোর্ডে ছিল না। তার মাথা ধরেছিল—

 

প্রশ্ন: তার প্রায়ই মাথা ধরে?

 

মণীশ চুপ করে রইল।

 

প্রশ্ন: সে কোথায় ছিল আপনি জানেন?

 

উত্তর: পরে শুনেছি সে অফিস ঘরে ঘুমোচ্ছিল।

 

প্রশ্ন: কার মুখে শুনলেন?

 

উত্তর: তার নিজের মুখে।

 

প্রশ্ন: ও। বিশুবাবুর সঙ্গে আপনি কতদিন কাজ করছেন?

 

উত্তর: প্রায় চার বছর।

 

প্রশ্ন: আপনার স্ত্রীও?

 

উত্তর: না, তখন আমার বিয়ে হয়নি। মালবিকা থিয়েটারে যোগ দিয়েছে বছরখানেক, এই নাটক ধরবার পর থেকে। বিশুবাবু উত্তরার পার্ট করার জন্যে কমবয়সী মেয়ে খুঁজছিলেন: শেষ পর্যন্ত মালবিকাকে রাখেন।

 

প্রশ্ন: আপনার নামে বিশুবাবু জীবনবীমা করেননি?

 

উত্তর: না। আমি বলেছিলাম জীবনবীমা চাই না, মাইনে বাড়িয়ে দিন। তা তিনি জীবনবীমাও করলেন না, মাইনেও বাড়ালেন না। সাতশো টাকা ছিল, সাতশো টাকাই রইল।

 

প্রশ্ন: তার বদলে বিশ হাজার টাকা দিয়ে একটা স্ট্যাণ্ডার্ড হেরাল্ড গাড়ি কিনে দিলেন?

 

উত্তর: গাড়ির একটা ইতিহাস আছে। বিশুবাবু যখন মাইনে বাড়িয়ে দিলেন না তখন আমি বাইরে কাজ খুঁজতে লাগলাম। এই নাটক আরম্ভ হবার কয়েকদিন আগে আমি মাদ্রাজ থেকে একটা ভাল অফার পেলাম। একটা বিখ্যাত সিনেমা কোম্পানি আলোকশিল্পী চায়; মাইনে দেড় হাজার, তাছাড়া বাড়িভাড়া ইত্যাদি। বিশুবাবুকে গিয়ে চিঠি দেখালাম। তিনি বে-কায়দায় পড়ে গেলেন, কিন্তু তবু নিজের জিদ ছাড়লেন না। আমাকে গাড়ি কিনে দিলেন। আর মালবিকাকে যে একশো টাকা হাতখরচ হিসেবে দিতেন তা বাড়িয়ে দু’শো টাকা করে দিলেন। তখন আমি মাদ্রাজের অফারটা ছেড়ে দিলাম। দেশ ছেড়ে কে বিদেশে যেতে চায়?

 

দারোগাবাবু বললেন, ‘তা বটে। তাহলে আপনি বিশু পালের মৃত্য সম্বন্ধে কোনো হদিস দিতে পারেন না? আচ্ছা, এবার তাহলে আপনার স্ত্রীকে পাঠিয়ে দিন।’

 

মালবিকা ভদ্র। বয়স—২০। জীবিকা—নাট্যাভিনয়। ঠিকানা * * আমহার্স্ট স্ট্রীট।

 

নোট: বিশু পালের আকস্মিক মৃত্যুতে সাক্ষী প্রথমটা খুব শক্ খেয়েছিল, এখন সুস্থ হয়েছে। বয়স কম, দেখতেও সুন্দরী; কিন্তু চোখের ঋজু দৃষ্টি ও চিবুকের মজবুত গড়ন থেকে চরিত্রের দৃঢ়তা অনুমান করা যায়।

 

প্রশ্ন: নাটকে আপনি উত্তরার ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। নাটকের শেষ দৃশ্য পর্যন্ত আপনার অভিনয় আছে?

 

উত্তরা: না। দ্বিতীয় অঙ্কের শেষে আমার অভিনয় শেষ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমার স্বামীকে থাকতে হয়, তাই আমিও থাকি।

 

প্রশ্ন: আজ যখন শেষ অঙ্কে আলো নিভিয়ে দেওয়া হয় তখন আপনি কোথায় ছিলেন?

 

উত্তর: সাধারণ অভিনেত্রী মেয়েদের জন্যে একটা আলাদা সাজঘর আছে। আমি সেই সাজঘরে গায়ের মুখের রঙ সবেমাত্র তুলতে আরম্ভ করেছিলুম।

 

প্রশ্ন: সেখানে আর কেউ ছিল?

 

উত্তর: লক্ষ্য করিনি। একবার বোধহয় নন্দিতাদিদি ঘরে এসেছিল।

 

প্রশ্ন: আপনি কবে থেকে অভিনয় করছেন?

 

উত্তর: এই নাটকের আরম্ভ থেকে। প্রায় বছর ঘুরতে চলল।

 

প্রশ্ন: অভিনয়ের দিকে আপনার ঝোঁক আছে।

 

উত্তর: খুব বেশি নয়। আমার স্বামী চেয়েছিলেন, কিছু টাকাও আসছিল, তাই থিয়েটারে যোগ দিয়েছিলুম।

 

প্রশ্ন: আপনি বোম্বাই কিম্বা মাদ্রাজে গিয়ে সিনেমায় অভিনয় করলে অনেক টাকা উপার্জন করতে পারতেন। করেননি কেন?

 

উত্তর: বাংলা দেশের বাইরে যেতে ইচ্ছে করে না। তাছাড়া আমি গেরস্থ ঘরের মেয়ে, ঘরকন্না করতেই ভালবাসি। আমার মা সহমৃতা হয়েছিলেন।

 

প্রশ্ন: সহমৃতা! আজকালকার দিনে—!

 

উত্তর: বাবা মারা যাবার এক ঘন্টা পরে মা হার্টফেল করে মারা যান।

 

প্রশ্ন: ও—বুঝেছি। আচ্ছা, বিশু পাল কেমন লোক ছিলেন?

 

উত্তর: খুব মিশুকে লোক ছিলেন। দরাজ হাত ছিল। সকলের সঙ্গে সমান ব্যবহার করতেন।

 

প্রশ্ন: মেয়েদের সঙ্গেও?

 

উত্তর: হ্যাঁ। কিন্তু কখনো কোনো রকম বেচাল দেখিনি।

 

ইন্সপেক্টর: আচ্ছা, এবার আপনি বাড়ি যান।

 

কাঞ্চন সিংহ। বয়স—২৬। জীবিকা—থিয়েটারের আলোকশিল্পীর সহকারী। ঠিকানা—মানিকতলা স্ট্রীটের একটি মেস।

 

নোট: লোকটির ভাবভঙ্গী একটু খ্যাপাটে গোছের; মাঝে মাঝে আবোল তাবোল এলোমেলো কথা বলে। কতখানি খাঁটি কতখানি অভিনয় বলা যায় না।

 

প্রশ্ন: আপনি হিপি, না বিট্‌লে, না অবধূত?

 

উত্তর: আজ্ঞে, আমি বাঙালী।

 

প্রশ্ন: আপনার সাজপোশাক বাঙালীর মত নয়। দাড়ি গোঁফও প্রচুর। কোনো কারণ আছে কি?

 

উত্তর: আমার ভাল লাগে। তাছাড়া থিয়েটার করার সময় পরচুলো পরতে হয় না।

 

প্রশ্ন: আপনি এখানে আসার আগে কী কাজ করতেন?

 

উত্তর: বাউণ্ডুলে ছিলাম। বাপ কিছু টাকা রেখে গিয়েছিল, মেসে থাকতাম আর শখের থিয়েটার করতাম।

 

প্রশ্ন: তাহলে চাকরিতে ঢুকলেন কেন?

 

উত্তর: বাপের পয়সায় শাক-চচ্চড়ি খাওয়া চলে, রসগোল্লা খাওয়া চলে না।

 

প্রশ্ন: তাহলে রসগোল্লা খাওয়ার জন্যেই চাকরিতে ঢুকেছিলেন?

 

উত্তর:. শুধু রসগোল্লা নয়, অন্য মতলবও ছিল। জানেন, আমি খুব ভাল অ্যাক্‌ট করতে পারি। শিবাজির পার্ট, ঔরঙ্গজেবের পার্ট প্লে করেছি। বিশুবাবু আমার চেহারা দেখে চাকরিতে নিলেন, কিন্তু কাজ দিলেন আলো জ্বালা আর আলো নেভানোর। যদি অভিনয় করতে দিতেন, আগুন ছুটিয়ে দিতাম।

 

প্রশ্ন: তা বটে। এখন বলুন দেখি, আলো নেভানোর সময় আপনি সুইচের কাছে ছিলেন না কেন?

 

উত্তর: আলো নেভানোর সময় সুইচবোর্ডে একজন লোকেরই দরকার হয়। মণীশদা ছিলেন, তাই আমি—

 

প্রশ্ন: কোথায় ছিলেন?

 

উত্তর: মাথা ধরেছিল, তাই আমি অফিস ঘরে গিয়ে টেবিলে মাথা রেখে একটু বসে ছিলাম।

 

প্রশ্ন: স্টেজের ওপর খুন হল। অসময়ে প্লে বন্ধ হয়ে গেল, এসব কিছুই জানতে পারেননি?

 

উত্তর: এঁ—একটু ঝিমকিনি এসে গিয়েছিল।

 

প্রশ্ন: আপনি নেশাভাঙ করেন?

 

উত্তর: নেশাভাঙ! নাঃ, পয়সা কোথায় পাব!

 

প্রশ্ন: কোন্ নেশা করেন?

 

উত্তর: এঁ—নেশা করি না—মাঝে মাঝে ভাঙ খাই। মানে—

 

প্রশ্ন: মানে মারিওয়ানা সিগারেট খান। কে যোগান দেয়? পান কোথায়?

 

উত্তর: যেখানে সেখানে পাওয়া যায়। ঠেলাগাড়িতে পানের দোকানে। আপনার চাই?

 

ইন্সপেক্টর: আপনি এখন যেতে পারেন। মেস ছেড়ে কোথাও যাবেন না। কলকাতাতেই থাকবেন।

 

দাশরথি চক্রবর্তী। বয়স—৪৫। জীবিকা—নাট্যাভিনয়। ঠিকানা—বেহালা।

 

ভাল মানুষের মত ভাবভঙ্গী, কিন্তু কথা বলার ধরন সোজা নয়। সরলভাবে চোখ মিট্‌মিট্ করে তাকায়, কিন্তু চোখের গভীরে প্রচ্ছন্ন দুষ্টতার ইঙ্গিত। লোকটি কমিক অ্যাক্‌টর, খোঁচা দিয়ে কথা বলতে পারে। কিন্তু খোঁচা বুঝতে একটু সময় লাগে।

 

প্রশ্ন: আপনি গোড়া থেকে বিশুবাবুর সঙ্গে ছিলেন?

 

উত্তর: ছিলাম। বিশুর সঙ্গে যথেষ্ট সম্ভাবও ছিল। তাই বুঝতে পারছি না যাবার সময় সে আমাকে এমনভাবে দয়ে মজিয়ে গেল কেন?

 

প্রশ্ন: সেটা কি রকম?

 

উত্তর: ট্রাম-বাস বন্ধ হয়ে গেছে। এত রাত্রে যদি ট্যাক্সি না পাই, পেটে কিল মেরে এখানেই শুয়ে থাকতে হবে।

 

ইন্সপেক্টর: আপনি বেহালায় থাকেন তো? কিছু ভাববেন না, আমি পুলিস ভ্যানে আপনাকে আর আপনার স্ত্রীকে বাড়ি পাঠিয়ে দেব।

 

দাশরথি: ধন্যবাদ। এবার যত ইচ্ছে হয় প্রশ্ন করুন।

 

প্রশ্ন: বিশু পালের সঙ্গে আপনার সদ্ভাব ছিল?

 

উত্তর: কারুর সঙ্গে আমার অসদ্ভাব নেই। জলে বাস করে কুমীরের সঙ্গে বিবাদ করা যায় না।

 

প্রশ্ন: বিশু পালের কোনো শত্রু ছিল?

 

উত্তর: শত্রুর কথা শুনিনি। তবে কি জানেন, যেখানে মেয়েমানুষ সেখানেই গণ্ডগোল।

 

প্রশ্ন: তার মানে? সুলোচনার কথা বলছেন?

 

উত্তর: (ক্ষণেক নীরব থাকার পর) সুলোচনা খুব ভাল অভিনয় করে, কিন্তু সে খানদানি অ্যাক্‌ট্রেস নয়, গেরস্তঘরের মেয়ে। ব্রজদুলাল প্রথম ওকে—মানে—থিয়েটারে নিয়ে আসে। তারপর বিশুর সঙ্গে সুলোচনার জোটপাট হয়ে গেল—

 

প্রশ্ন: ও—বুঝেছি। তা নিয়ে বিশুবাবুর সঙ্গে ব্রজদুলালবাবুর কোনো মনোমালিন্য হয়নি?

 

উত্তর: অমন হেরফের হামেশাই হয়ে থাকে, কেউ গায়ে মাখে না। কে যাবে কেউটে সাপের লেজ মাড়াতে।

 

প্রশ্ন: হুঁ। অন্য কোনো স্ত্রীলোকের সঙ্গে বিশু পালের ঘনিষ্ঠতা ছিল?

 

উত্তর: তা কি করে জানব। কেউ তো ঢাক পিটিয়ে এসব কাজ করে না। অবশ্য থিয়েটারে নানা রকম মেয়ের যাতায়াত আছে, কোন্ অ্যাক্‌টরের কখন কোন্ মেয়ের ওপর নজর পড়বে কে বলতে পারে। এই যে দারোয়ান প্রভুনারায়ণের একটা বোন আছে—সোমরিয়া, উচক্কা বয়স, রূপও আছে। সে থিয়েটারে চাকরানীর কাজ করে; কারুর নজর এড়িয়ে চলা তার স্বভাব নয়। বিশুও সকাল বিকেল নিয়ম করে থিয়েটার তদারক করতে আসত—

 

প্রশ্ন: অর্থাৎ, সোমরিয়ার সঙ্গে বিশু পালের—?

 

উত্তর: ভগবান জানেন। তবে সুযোগ সুবিধে সবই ছিল।

 

প্রশ্ন: আচ্ছা, ওকথা যাক। —বিশু পালের সঙ্গে বাইরের কোনো লোকের শত্রুতা ছিল?

 

উত্তর: এক থিয়েটারের অধিকারীর সঙ্গে অন্য থিয়েটারের অধিকারীর রেষারেষি থাকে। বিশুর থিয়েটার খুব ভাল চলছিল, অনেকের চোখ টাটিয়েছিল। একে যদি শত্রুতা বলেন, বলতে পারেন।

 

প্রশ্ন: এবার নিজের কথা বলুন।

 

উত্তর: নিজের কথা আর কি বলব? ছেলেবেলা থেকে থিয়েটারে ঢুকেছি, অনেক ঘাটের জল খেয়েছি। স্ত্রীকে নিয়ে বেহালায় থাকি, ছেলেপুলে নেই। বেশি উচ্চাশাও নেই। যেমনভাবে দিন কাটছিল তেমনিভাবে কেটে গেলেই খুশি থাকতাম। কিন্তু বিশু মরে গেল, ওর দল টিকবে কিনা কে জানে। হয়তো ভেঙে যাবে, তখন আবার অন্য দলে গিয়ে ভিড়তে হবে।

 

প্রশ্ন: আজ দ্বিতীয় অঙ্কে আপনার আর আপনার স্ত্রীর অভিনয় শেষ হয়ে গিয়েছিল, বাড়ি যাননি কেন?

 

উত্তর: দ্বিতীয় অঙ্কের পর বাড়ি যাব বলে বেরুচ্ছি, বিশু বলল, ‘একটু থেকে যাও, তোমার সঙ্গে কথা আছে। নাটক শেষ হলে বলব।’

 

প্রশ্ন: কি কথা?

 

উত্তর: তা জানি না, বিশু বলেনি।

 

প্রশ্ন: সেখানে অন্য কেউ উপস্থিত ছিল?

 

উত্তর: না, আমরা একলা ছিলাম। বিশুর ড্রেসিংরুমে কথা হয়েছিল।

 

ইন্সপেক্টর: হুঁ। আজ এই পর্যন্ত। আপনার স্ত্রীকে পাঠিয়ে দিন।

 

নন্দিতা চক্রবর্তী। বয়স—৪৪। জীবিকা—নাট্যাভিনয়। ঠিকানা—বেহালা।

 

নোট: মহিষমর্দিনী চেহারা, দাশরথির চেয়ে মুঠিখানেক মাথায় উঁচু। লালচে চোখ, বড় বড় দাঁত, কিন্তু গলার স্বর মিষ্টি। আচরণ শিষ্ট ও শালীন।

 

প্রশ্ন: আপনার স্বামী নামকরা কমিক অ্যাক্‌টর, আপনিও কি কমিক অ্যাক্‌টিং করেন?

 

উত্তর: ও মা, অ্যাক্‌টিং-এর আমি কি জানি। আগে আমি থিয়েটারের পোশাক আশাকের ইন-চার্জ ছিলুম। একদিন বিশুবাবু আমাকে একটা ছোট পার্টে নামিয়ে দিলেন। সেই থেকে (হেসে) আমার চেহারার মানানসই পার্ট থাকলে আমি করি।

 

প্রশ্ন: বিশুবাবু কেমন লোক ছিলেন?

 

উত্তর: দিল্‌দরিয়া লোক ছিলেন। টাকা তাঁর হাতের ময়লা ছিল, যেমন রোজগার করতেন তেমনি খরচ করতেন। কিন্তু মদ খেতেন না, বদ্‌খেয়ালি ছিল না।

 

প্রশ্ন: প্রভুনারায়ণের বোনের সঙ্গে কিছু ছিল?

 

উত্তর: ওসব বাজে গুজব, আমি বিশ্বাস করি না।

 

প্রশ্ন: সুলোচনা কেমন মানুষ?

 

উত্তর: (একটু থেমে) সুলোচনা ভাল অভিনয় করে, মেয়েও ভাল, কিন্তু মনের কথা কাউকে বলে না। ভারি চাপা প্রকৃতির মেয়ে।

 

প্রশ্ন: আর মালবিকা?

 

উত্তর: মালবিকা ছেলেমানুষ, কিন্তু মনে ছুঁই-ছুঁৎ আছে। ভালভাবে কারুর সঙ্গে মেশে না, একটু দূরত্ব রেখে চলে। তবে মেয়ে ভাল।

 

প্রশ্ন: আর ওর স্বামী?

 

উত্তর: মণীশ? একটু গম্ভীর প্রকৃতি, কিন্তু ভাল ছেলে। আর ওর কাজের তুলনা নেই, আলো ফেলে নাটকের চেহারা বদলে দিতে পারে। আগে সাঁতারু ছিল, কিন্তু সাঁতারে তো পয়সা নেই, তাই থিয়েটারে ঢুকেছে।

 

প্রশ্ন: আর ব্রজদুলালবাবু?

 

উত্তর: মদ-টদ খান বটে কিন্তু ভারি বিজ্ঞ লোক। এক সময় মুষ্টিযোদ্ধা ছিলেন, এখনো গায়ে অসুরের শক্তি। ওঁর স্ত্রী শান্তিও ভারি গুণের মেয়ে; নাচতে জানে, গাইতে জানে, গানে সুর দিতে জানে। এখানকার মিউজিক্‌ মাস্টার।

 

প্রশ্ন: স্বামী-স্ত্রীতে সদ্ভাব আছে?

 

উত্তর: তা আছে বই কি। তবে যে-যার নিজের কাজে থাকে, কেউ কারুর বড় একটা খবর রাখে না।

 

প্রশ্ন: আজ যখন আলো নেভানো হয় আপনি কোথায় ছিলেন?

 

উত্তর: আমার স্বামী আর আমি স্টেজের পিছন দিকে একটা বেঞ্চিতে বসেছিলুম।

 

ইন্সপেক্টর একজন জমাদারকে ডেকে বললেন, ‘ইনি বেহালায় থাকেন। এঁকে আর এঁর স্বামীকে পুলিসের গাড়িতে বাড়ি পৌঁছে দাও।’

 

কালীকিঙ্কর দাস। বয়স—৪০। জীবিকা—থিয়েটারের প্রমপ্‌টার। ঠিকানা * * কৈলাস বোস লেন।

 

অসমাপ্ত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *


সূচিপত্রঃ—

সূচিপত্র