‘পরী’ রুপকথার গল্পটি লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
কুসমি বললে, তুমি বড় বানিয়ে কথা বল। একটা সত্যিকার গল্প শােনাও না। আমি বললুম, জগতে দুরকম পদার্থ আছে। এক হচ্ছে সত্য, আর হচ্ছে আরও সত্য। আমার কারবার আরও সত্যকে নিয়ে।
দাদামশায়, সবাই বলে, তুমি কী যে বলাে কিছু বােঝাই যায় না! আমি বললুম, কথাটা সত্যি, কিন্তু যারা বােঝে না সেটা তাদেরই দোষ।
আরও সত্যি কাকে বলছ একটু বুঝিয়ে বলাে না। আমি বললুম, এই যেমন তােমাকে সবাই কুসমি বলে জানে। এই কথাটা খুবই সত্য; তার হাজার প্রমাণ আছে। আমি কিন্তু সন্ধান পেয়েছি যে, তুমি পরীস্থানের পরী। এটা হল আরও সত্য।
খুশি হল কুসমি। বলল, আচ্ছা, সন্ধান পেলে কী করে? আমি বললুম, তােমার ছিল এঞ্জামিন, বিছানার উপরে বসে বসে ভূগােল বৃত্তান্ত মুখস্থ করছিলে, কখন তােমার মাথা ঠেকল বালিশে, পড়লে ঘুমিয়ে। সেদিন ছিল পূর্ণিমার রাত্রি। জানলার ভিতর দিয়ে জ্যোৎয়া এসে পড়ল তােমার মুখের উপরে, তােমার আসমানি রঙের শাড়ির উপরে। আমি সেদিন স্পষ্ট দেখতে পেলুম, পরীস্থানের রাজা চর পাঠিয়েছে তাদের পলাতকা পরীর খবর নিতে। সে এসেছিল আমার জানলার কাছে, তার সাদা চারদটা উড়ে পড়েছিল ঘরের মধ্যে। চর দেখল তােমাকে আগাগােড়া, ভেবে পেল না তুমি তাদের সেই পালিয়ে আসা পরী কি না। তুমি এই পৃথিবীর পরী বলে তার সন্দেহ হল। তােমাকে মাটির কোল থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া তাদের পক্ষে সহজ হবে না। এত ভার সইবে না। ক্রমে চাঁদ উপরে উঠে গেল, ঘরের মধ্যে ছায়া পড়ল, চর শিশুগাছের ছায়ায় মাথা নেড়ে চলে গেল। সেদিন আমি খবর পেলুম, তুমি পরীস্থানের পরী, পৃথিবীর মাটির ভারে বাঁধা পড়ে গেছ।
কুসমি বললে, আচ্ছা দাদামশায়, আমি পরীস্থানে থেকে এলুম কী করে? আমি বললুম, সেখানে একদিন তুমি পারিজাতের বনে প্রজাপতির পিঠে চড়ে উড়ে বেড়াচ্ছিলে, হঠাৎ তােমার চোখে পড়ল দিগন্তের ঘাটে এসে ঠেকেছে একটা খেয়ানৌকা। সেটা সাদা মেঘ দিয়ে গড়া, হাওয়া লেগে দুলছে। তােমার কী মনে হল, তুমি উঠে পড়লে সেই নৌকায়। নৌকা চলল ভেসে, ঠেকল এসে পৃথিবীর ঘাটে, তােমার মা নিলেন কুড়িয়ে।
কুসমি ভারি খুশি হয়ে বললে হাততালি দিয়ে, দাদামশায়, আচ্ছা, এ কি সত্যি! আমি বললুম, ঐ দেখাে, কে বললে সত্যি। আমি কি সত্যিকে মানি। এ হল আরও সত্যি।
কুসমি বললে, আচ্ছা, আমি কি পরীস্থানে ফিরে যেতে পারব না? আমি বললুম, পারতেও পার, যদি তােমার স্বপ্নের পালে পরীস্থানের হাওয়া এসে লাগে।
আচ্ছা, যদি হাওয়া লাগে তবে কোন রাস্তায় কোথা দিয়ে কোথায় যাব! সেকি অনেক দূরে? আমি বললুম, সে খুব কাছে।
কত কাছে?
যত কাছে তুমি আছ আর আমি আছি। ঐ বিছানার বাইরে যেতে হবে না। আর একদিন জানলা দিয়ে পড়ুক এসে জ্যোত্না; এবার যখন তুমি তাকিয়ে দেখবে বাইরে, তােমার আর সন্দেহ হবে না। তুমি দেখবে জ্যোৎস্নার স্রোত বেয়ে মেঘের খেয়ানৌকা এসে পৌচচ্ছে। কিন্তু তুমি যে এখন পৃথিবীর পরী হয়েছ, ও নৌকায় তােমার কুলােবে না। এখন তুমি তােমার দেহ ছেড়ে বেরিয়ে যাবে, কেবল তােমার মন থাকবে তােমার সাথি। তােমার সত্য থাকবে এই পৃথিবীতে পড়ে আর তােমার আরও সত্য যাবে কোথায় ভেসে, আমরা কেউ তার নাগাল পাব না।
কুসমি বললে, আচ্ছা, এবারে পূর্ণিমারাত এলে আমি ঐ আকাশের পানে তাকিয়ে থাকব। দাদামশায়, তুমি কি আমার হাত ধরে যাবে? আমি বললুম, আমি এইখানে বসে বসে পথ দেখিয়ে দিতে পারব। আমার সেই ক্ষমতা আছে–কেননা, আমি সেই আরও সত্যের কারবারি।
যেটা তােমায় লুকিয়ে-জানা সেটাই আমার পেয়ার, বাপ-মা তােমায় যে নাম দিল থােড়াই করি কেয়ার। সত্য দেখায় যেটা দেখি তারেই বলি পরী, আমি ছাড়া ক’জন জানে তুমি যে অপ্সরী। কেটে দেব বাধা নামের বন্দির শৃঙ্খল, সেই কাজেতেই লেগে গেছি আমরা কবির দল কোনাে নামেই কোনাে কালে কুলােয় নাকো যারে তাহার নামের ঈশারা দেই ছন্দের ঝংকারে।