প্রেম – ছোটগল্প – প্রফুল্ল রায়
ক’দিন আগে দিল্লি দূরদর্শনের জন্য রবীন্দ্রনাথের একটি ছোটগল্পের চিত্রনাট্য লিখতে বসেছি। গল্পটির একটি দৃশ্য এইরকম। বাড়ির পুরুষেরা যে যার কাজে বেরিয়ে গেছে, মহিলারা ভরদুপুরে পরিপাটি দিবানিদ্রার আয়োজনে ব্যস্ত। এই সুযোগে সবার চোখ এড়িয়ে নায়িকা অত্যন্ত সতর্ক ভঙ্গিতে পা টিপে টিপে ছাদে উঠে আসছে। ছাদ থেকে রাস্তার উলটো দিকের একটি বাড়ির চিলেকোঠা দেখা যায়। সেখানে কলেজ় পালিয়ে এক যুবক তার জন্য প্রায় রোজই অপেক্ষা করে।
প্রায় তিরিশ ফিট দূরত্ব থেকে কথা বলার প্রশ্নই নেই। শুধু এক পলক দেখার জন্য মেয়েটিকে বিরাট ঝুঁকি নিতে হয়। ঝুঁকির কারণ, প্রতি মুহূর্তে ধরা পড়ার ভয়।
প্রায় আশি বছর আগের লেখা এই গল্পের প্রেমিক-প্রেমিকার মতোই সেকালের যুবক যুবতীরা ছিল ভীরু এবং লাজুক। তাদের ঘিরে সারাক্ষণ লোকলজ্জা, ভয় আর সংকোচ। সামাজিক পরিবেশটাই তখন এমন যে প্রেম করা বা দু’টি তরুণ-তরুণীর নিভৃত মিলন একটি অতি গর্হিত কাজ বা মারাত্মক ধরনের কুকর্ম। সে যুগে অসংখ্য যুবক-যুবতী দূর থেকেই পরস্পরকে দেখে হৃদয় সমর্পণ করে বসেছে, তার নীট ফল শুধুই হা-হুতাশ, আক্ষেপ, অশ্রুপাত এবং না ঘুমিয়ে রাত কাটানো। এইসব প্রেমের মৃত্যুহার খুবই বেশি।
ছাদের দৃশ্যটি যখন লেখা শেষ হয়ে এসেছে, হঠাৎ পাশের বসবার ঘরে তুমুল হইচই এবং হাসাহাসির শব্দে চমকে উঠি। টের পাই, আমার ছোট মেয়ে তার বন্ধুবান্ধব নিয়ে এইমাত্র কলেজ থেকে ফিরে এসেছে।
চিত্রনাট্যটি আজই শেষ করতে হবে। কাল হিন্দিতে সংলাপ অনুবাদ হবার পর পরশু থেকে শুটিং। হই-হুল্লোড়ে আমার মনোযোগ এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল বার বার। গলার স্বর একটু নিচু স্কেলে যাতে ওরা নামায় সেজন্য পাশের ঘরে যেতে হল। সেখানে দেখা গেল আমার ছোট মেয়ে, তার বন্ধু মালিনী এবং একটি অচেনা যুবক জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছে।
মালিনীকে অনেক দিন চিনি। প্রায়ই আমাদের বাড়ি আসে। দারুণ স্মার্ট এবং ঝকঝকে মেয়ে। পড়াশোনায় চৌকশ। আমার মেয়ের সঙ্গে আসছে বছর বি এ পার্ট-টু দেবে। শুনেছি, ওর বাবা স্টেট গভর্নমেন্টের মাঝারি মাপের একজন অফিসার। সচ্ছল মিডল ক্লাস বলতে যা বোঝায়, ওরা মোটামুটি তা-ই।
আমাকে দেখে হইহই থেমে যায়। সবাই উঠে দাঁড়ায়। মালিনী বলে, ‘সরি মেসোমশাই, আপনি বাড়ি আছেন জানতাম না। নিশ্চয়ই লিখছিলেন? ভীষণ ডিসটার্ব করে ফেললাম।’
আমি সামান্য হাসি। অচেনা যুবকটিকে দেখিয়ে জিগ্যেস করি, ‘একে তো চিনলাম না—’
মালিনী বলে, ‘ও সঞ্জয়, হিস্ট্রি নিয়ে রিসার্চ করছে। একটা খবর দিই মেসোমশাই। আমার পরীক্ষা হয়ে গেলে নেক্সট ইয়ারে আমরা বিয়ে করব। তার ভেতর ওর রিসার্চও শেষ হয়ে যাবে।’
এতটুকু আড়ষ্টতা নেই। এভাবে কোনো মেয়েকে তার বিয়ের কথা ঘোষণা করতে আগে আর শুনিনি। রবীন্দ্রনাথের গল্পের সেই পরিবেশ থেকে উনিশশো সাতাশিতে ফিরে আসতে আমার কিঞ্চিৎ সময় লাগে। একটু পরে শশব্যস্তে বলি, ‘খুব সুখবর, তোমার মাসিমাকে জানিয়ে যেয়ো।’
‘নিশ্চয়ই।’
“আচ্ছা তোমরা গল্প কর।’
নিজের ঘরে ফিরে আসি। লেখায় মন বসে না। রবীন্দ্রনাথের সেই গল্পের নায়িকাটির সঙ্গে কত তফাত মালিনীর। আশি বছরে বাঙালি প্রেমিক-প্রেমিকারা বহুদূর এগিয়েছে নিঃসংশয়ে। সময়ের মাপে আট দশক, কিন্তু মানসিকতা এবং অ্যাটিচুডের দিক থেকে যেন কয়েক শতাব্দী।
কতক্ষণ চুপচাপ বসে ছিলাম, মনে নেই। পাশের ঘর থেকে এখন সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না।
আমার স্ত্রী রান্নাঘরে ছিলেন। এক কাপ চা নিয়ে এলেন। জানতে চাইলাম, মালিনীরা চলে গেছে কিনা। স্ত্রী জানালেন মালিনী এবং সঞ্জয়কে সুযোগ করে দিয়ে আমাদের ছোট কন্যাটি পাশের বাড়ি গেছে।
ব্যাপারটা দুর্বোধ্য ঠেকছে। স্ত্ৰী বুঝিয়ে বললেন, মালিনী এবং সঞ্জয়ের বিয়ের ব্যাপারে কিছু সমস্যা আছে। আলোচনা করে তারা জট ছাড়িয়ে নিতে চায়। আমি যেন আপাতত ঘণ্টাখানেক বাইরের ঘরে না যাই।
বিমূঢ়ের মতো প্রশ্ন করি, ‘তা আমাদের এখানে??
স্ত্রী জানান, কোথাও বসে নির্বিঘ্নে কথা বলার মতো নাকি জায়গা পাচ্ছে না মালিনীরা।
মজার গলায় বলি, ‘আমাদের বাড়িটা প্রেমের স্যাংচুয়ারি হয়ে উঠল নাকি?’
মৃদু হেসে স্ত্রী চলে যান।
প্রেমের ব্যাপারে নানা সমস্যা চিরকালই রয়েছে। কিন্তু একটি তরুণ এবং একটি তরুণী কোথাও ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে যে দু-এক ঘণ্টা সময় কাটাবে তেমন জায়গার যে অভাব ঘটেছে, এ দিকটা আগে কখনও ভাবিনি। প্রেমিক-প্রেমিকাদের কাছে আজকাল ‘স্পেস’ও যে একটা প্রবলেম, কে জানত।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের কিছু আগে যদিও আমার জন্ম, তখনকার কথা প্রায় কিছুই মনে নেই। তবে যুদ্ধের পর পুরনো ধ্যানধারণা ঠুনকো বাসনের মতো ভেঙে যেতে লাগল, সময় প্রবল এক আইকোনোক্লাস্ট হয়ে চুরমার করে দিতে লাগল যত সব জীর্ণ সংস্কার, বদলে গেল দীর্ঘকালের প্রাচীন ভ্যালুজ।
স্ত্রী-শিক্ষার সূচনা অনেক আগে শুরু হলেও যুদ্ধের আগে রাস্তায় ক’টি আর মেয়ে দেখা যেত! কিন্তু পরে ঝাঁকে ঝাঁকে মেয়েরা বেরিয়ে এল অন্তঃপুর থেকে। ভরে যেতে লাগল স্কুল-কলেজ, ইউনিভার্সিটি, অফিস-আদালত। জীবনের প্রায় সব ক্ষেত্রেই সে পুরুষের প্রতিদ্বন্দী। রবীন্দ্রনাথ শরৎচন্দ্রের গল্পের ভীরু কুণ্ঠিত নায়িকাদের বদলে আমরা পেয়ে গেলাম সাহসী উজ্জ্বল তৎপর তরুণীদের। দেশভাগের পর তো কথাই নেই। যে পঁচিশ তিরিশ লাখ উদ্বাস্তু কলকাতা এবং শহরতলিতে এসে আশ্রয় নিল তাদের মধ্যে কম করেও এক-দেড় লাখ তরুণী। তাদেরও বেরিয়ে পড়তে হল রাস্তায়—চাই শিক্ষা, চাই চাকরিবাকরি। বাঁচতে তো হবে।
জীবনের সকল দিকেই মেয়েরা তখন পুরুষদের সঙ্গে সমানে পাল্লা দিতে শুরু করেছে। মেলামেশার ব্যাপারে আগের সেই কড়াকড়ি নেই। একসঙ্গে যেখানে কাজ করতে হচ্ছে, ট্রামে-বাসে চলতে হচ্ছে, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস করতে হচ্ছে সেখানে এটা তো খুবই স্বাভাবিক। এরই মধ্যে প্রেম তার কাজ করে চলেছে আরো ব্যাপকভাবে।
দেশভাগের পরও বেশ কয়ের বছর এই কলকাতা শহরে যথেষ্ট ফাঁকা জায়গা ছিল, ছিল অনেকগুলো সুন্দর পার্ক, চমৎকার ময়দান, লেক বা গঙ্গার ধার। জোড়ায় জোড়ায় প্রেমিক-প্রেমিকারা সেখানে গিয়ে বসতে পারত। তাদের একান্ত নিজস্ব ব্যাপারে কেউ নাক গলাত না, বিরক্ত করত না। শুধু সকৌতুকে কেউ কেউ তাদের দিকে তাকাতে তাকাতে চলে যেত।
কিন্তু তারপর এই বিশাল মেট্রোপলিসের চেহারা দ্রুত পালটে যেতে লাগল। তৃতীয় বিশ্বের যে কোনো শহরের তুলনায় এখানে পপুলেশন এক্সপ্লোসন বা জন-বিস্ফোরণ ঘটল ভয়াবহ আকারে। পূর্ব পাকিস্তানের উদ্বাস্তুরা তো ছিলই, দানাপুর প্যাসেঞ্জার, মাদ্রাজ মেল বা আপার ইন্ডিয়া এক্সপ্রেস বোঝাই হয়ে হাজার হাজার মানুষ আসতে লাগল রুজি-রোজগারের আশায়। কলকাতা তো কাউকে ফেরায় না, সবাইকেই মাথা গোঁজার ব্যবস্থা করে দেয়। মানুষের সঙ্গে টক্কর দিয়ে বাড়তে লাগল ট্রাম-বাস, ঠেলা-রিকশা-অটো-মিনিবাস আর হাজার হাজার প্রাইভেট কার। এই মুহূর্তে সমীক্ষা চালালে হয়তো দেখা যাবে এই শহরে মাথাপিছু কুড়ি ফিটের বেশি জায়গা আছে কিনা সন্দেহ।
চারিদিকে এখন থিকথিকে ভিড়। বেশির ভাগ পার্কেই হয় সি এম ডি এ’র কিংবা পাতাল রেলের গো-ডাউন। যে কটিতে গুদাম নেই, সেগুলো অ্যান্টিসোশাল আর সাট্টাবাজদের দখলে। গঙ্গার ধারে, লেকের পাড়ে এত মানুষ যে আলাদাভাবে বসার উপায় নেই। ছোটখাটো রেস্তোরাঁয় পর্দা-ঢাকা কেবিনে গিয়ে যে প্রেমিক-প্রেমিকা ঘণ্টাখানেক বসবে, সেই সময়টুকুও মেলে না। চা’টা খাওয়া হতে না-হতেই ‘বয়’ বিল নিয়ে আসে। কেননা বাইরে লম্বা ‘কিউ’ অপেক্ষা করছে। তারা উঠলে অন্য এক জোড়া শূন্যস্থান দখল করবে। ফুটপাথ দিয়ে পাশাপাশি যে হাঁটবে তারও কি উপায় আছে? সেগুলো পুরোপুরি হকারদের দখলে।
এই শহরের বাতাস থেকে অক্সিজেন দ্রুত কমে যাচ্ছে, চারিদিকে গ্যাসোলিনের পোড়া গন্ধ, রাস্তায় জীবাণুর মতো লক্ষ লক্ষ মানুষ, যেটুকু ফাঁকা জায়গা এখনও অবশিষ্ট আছে, সেখানে মুক্ত মূত্রাঙ্গন। মধ্যবিত্ত পরিবারের একটি যুবক যে তার প্রেমিকাটিকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যাবে তেমন জায়গা তো সেখানেও নেই। দুই কি আড়াই কামরার একটি ফ্ল্যাটে হয়তো সাত আটজন ফ্যামিলি মেম্বার।
তা হলে কি শুধু একটু জায়গার অভাবে মধ্যবিত্ত পরিবারের ‘প্রেমিক-প্রেমিকা’ ক্লাসটি বিলুপ্ত হয়ে যাবে? এই প্রশ্নটা মাঝে মাঝে আমাকে পেয়ে বসে। তখন খুবই বিষণ্ণ বোধ করি।
সেদিন পাতাল রেলের কালীঘাট স্টেশন থেকে জরুরি কাজে এসপ্ল্যানেডে যেতে হয়েছিল। দুপুরবেলা, তাই তেমন ভিড় ছিল না। ট্রেনে উঠতে উঠতে চোখে পড়ল, একটি তরুণ এবং একটি তরুণী পরিষ্কার ছিমছাম প্ল্যাটফর্মের একধারে দাঁড়িয়ে হেসে হেসে নিচু গলায় কথা বলছে। ঘণ্টা দুয়েক বাদে ফের কালীঘাটে ফিরে এসে দেখি সেই তরুণ-তরুণীটি একই জায়গায় নিজেদের মধ্যে বিভোর হয়ে আছে।
খুব ভালো লাগল। এত যে স্থানাভাব, তবু একালের প্রেমিক-প্রেমিকারা যেটুকু সুযোগ পাচ্ছে তা-ই কাজে লাগাচ্ছে। না, হতাশ হবার কিছু নেই।
প্রেমিক-প্রেমিকাদের ব্যাপারে আমার একটি প্রস্তাব আছে। অভয়ারণ্যের মতো তাদের জন্য শহরের নানা প্রান্তে কয়েকটি সংরক্ষিত এলাকার ব্যবস্থা করা যায় কি?