‘নোনা জল’ গল্প লিখেছেন – রমাপদ চৌধুরী

শেয়ার করুনঃ

'নোনা জল' গল্প লিখেছেন - রমাপদ চৌধুরী

 

অচেনা পাড়ার এই নতুন ফ্ল্যাটে উঠে এসে অনীশের তখনো কেমন চোর-চোর ভাব। তার মতো মিশুকে মানুষটারও।

দুখানা খুদে সাইজের ঘর, আর তার সামনে দু ফুট ঝুলবারান্দা, বারান্দা থেকে থুতু ফেললে রাস্তার লোকের মাথায় পড়ে। ঋণা একদিন অভ্যাসবশে বারান্দায় দাঁড়িয়ে গামছা নিঙড়ে কি লজ্জায় যে পড়েছিলো! ছুটে পালিয়ে এসেছিলো ঘরের মধ্যে। রাস্তার লোকটা উপরের দিকে চোখ তুলে কি গালাগাল দিয়েছিলো কে জানে।

কিন্তু পাড়াপড়শীর সঙ্গে ঋণার দু-দিনেই বেশ আলাপ হয়ে গেছে। অনীশ এখনো মাথা নিচু করে রাস্তা হাঁটে, আপিস-ফেরতা কারও কারও সঙ্গে চোখাচোখি হলে চোখ নামিয়ে নেয়। পাড়ার দু-একজন যেচে আলাপ করতে এলেও অনীশ দুটো কথা বেশী বলার চেষ্টা করেনি।

দরকার হয়নি। টুয়া একাই এক শো। চার-পাঁচটা দাঁত বেরিয়ে গেছে। দু-একটা শক্ত শক্ত কথাও হঠাৎ হঠাৎ বলে ফেলে। আর অনীশ-ঋণা দুজনেই চমকানো খুশিতে হেসে ওঠে।

—ওমা, কি বললি রে টয়া ? বল, আবার বল।

অনীশ হাতঘড়িটায় দম দেওয়া হয়েছে কি না জিগ্যেস করবে বলে ডাকলো, ঋণা!

অমনি টুয়া টলমল টলমল পায়ে ছুটে গেল চৌকাঠের দিকে, তারপর দরজার ফাঁকে মুখ বাড়িয়ে বলে উঠলো, ইনা, ডাকছে!

‘ডাকছে’ কথাটাও তো স্পষ্ট বের হয় না, ‘ডাচ্ছে’ হয়ে সেটা বেরিয়ে এলো ওপর পাটির দুটো আর নীচের পাটির দুটো দাঁতের ফাঁক দিয়ে।

আরেক দিন ঋণা হাঁক দিলো বাচ্চা চাকরটাকে, আনন্দ, কাপটা দিয়ে যা তাড়াতাড়ি।

সঙ্গে সঙ্গে টুয়া বলে উঠলো, আন্দ, তাতাড়ি।

অনীশ আর ঋণা তো হেসে লুটোপুটি। টুয়াকে জড়িয়ে ধরে, বুকে চেপে, গালে গাল ঘষে আদরে আদরে ডুবিয়ে দিলো।

অনীশ আপিস থেকে ফিরলেই একটা-না-একটা খবর তার জন্যে অপেক্ষা করে। এই জানো আজ কি করেছে ? ঐ মোড়াটা নিয়ে দু হাতে তুলে এ-ঘর থেকে ও-ঘর অবধি গিয়েছে।

অনীশ হেসে বলেছে, গামা পালোয়ান। কিরকম হাঁটে দেখো না।

—আজ কি হয়েছে জানো, তৃপ্তিদি এসেছিলেন…

অনীশ আবার একটা নতুন চমকের অপেক্ষায় চোখ তুলেছিলো, হঠাৎ ভোল্টেজ বেড়ে গেলে বাল্বের যেমন হয়, চোখে ঔৎসক্য ফুটে উঠলো—তৃপ্তিদিটি আবার কে!

ঋণা হাসলো।—বাঃ রে, রঙিন ছাতা মাথায় দিয়ে ছেলেকে স্কুলে নিয়ে যান। বাঁ দিকের শেষ ফ্ল্যাটে থাকেন…

অনীশ নিরুৎসাহ গলায় বললো, এসেছিলেন বুঝি?

—রোজই বারান্দায় দাঁড়িয়ে কথা হয়। আজ ডাকলাম।

ঋণা আরো কি বলতে যাচ্ছিলো, টুয়া খেলা করতে করতে বলে উঠলো, মাসী কই।

ব্যস্, ঐ এক কথা, মাসী কই।

ঋণা হেসে বললো, খুব আদর করেছেন তো ওকে, বললাম, টুয়া, তোমার মাসী হয়, মাসী। সেই থেকে মাঝে মাঝেই ‘মাসী কই’।

বলে হেসে উঠলো ঋণা, অনীশও। টুয়াকে কাছে টেনে নিয়ে আদর করতে করতে খাটে গড়িয়ে পড়লো অনীশ, বকের ওপর টুয়াকে দাঁড় করালো।

টুয়া অমনি বলে উঠলো, পয়ে যাচ্ছে।

অর্থাৎ পড়ে যাচ্ছি।

সেদিনও এমনি আপিস থেকে ফিরে টুয়াকে কাঁধে বসিয়ে ড্রেসিং টেবিলের লম্বা আয়নার সামনে দাঁড়িয়েছে অনীশ, একটা ফুটফুটে বাচ্চা ছেলে পর্দা সরিয়ে ঘরে ঢুকলো।

—আরে বাবুল! বলেই তার দিকে ছুটে গেল ঋণা, বললো, একা এসেছো?

পর্দার ওপার থেকে প্রথমে চটির শব্দ, তারপর গলা। — ইস্, মাকে ছেড়ে আসার ছেলে কিনা !

পর্দা সরিয়ে তৃপ্তিদিকে দেখে একট, অপ্রতিভ হয়েই সারা মুখহাসিতে উছলে উঠলো  ঋণার। বললো, আসন, আসুন।

তৃপ্তির মুখ। অনীশ দেখলো, সঙ্কোচ কাটিয়ে হাসলো।

—নমস্কার। আপনার সঙ্গে তো আলাপই হয় না। তৃপ্তি হাসলো মিষ্টি করে।

তারপর ঋণার দিকে তাকিয়ে বললো, ভাবলাম বিনা নোটিসে এসে পড়ে একটা সিনেমা-টিনেমা দেখে ফেলবো…

ঋণা হেসে উঠলো।-সিনেমা-থিয়েটার আপনাদের, সেদিন রিকশায় যাচ্ছিলেন কর্তার সঙ্গে…

—তোমাদের তো সব সময় গ্রীনরুম, ওঁকে তো রাস্তায় দেখি পায়ের দিকে তাকিয়ে হাঁটেন। আরে বাবা, আমরাও এমন কিছু কুচ্ছিত না।

ঋণা আর অনীশ দুজনেই শব্দ করে হেসে উঠলো।

ঋণা বললো, ইস্, আপনি তো রীতিমতো সুন্দরী।

তৃপ্তি ঠোঁট ওল্টালো।— ছাই! এত দিন তবু একটা গর্ব ছিলো, কিন্তু এই যে যেচে আলাপ করতে এলাম, সুন্দরী হলে তো ওঁরই এতক্ষণ যেচে কথা বলার কথা।

ঋণা হেসে বললো, আমি রয়েছি যে।

তৃপ্তি ততক্ষণে টুয়াকে কোলে তুলে নিয়েছে, আর ঋণা যত হাত বাড়িয়ে বলছে, টুয়া এসো, ততই সে ঘাড় নাড়ছে জোরে জোরে।—নান্না, নান্না।

তৃপ্তি চলে যাওয়ার সময় সে কি কান্না টুয়ার !

রাত্রে খেতে বসে অনীশ বললো, ভদ্রমহিলা বেশ। খুব মিশুকে।

ঋণা হেসে উঠে বললো, বেশী মেলামেশা কোরো না বাপু! যা মুখফস্ কা কথাবার্তা ওঁর!

অনীশ বললো, ছেলেটাও বেশ শান্তশিষ্ট, কি নাম যেন?

বাবুলের নামটা ঠিকই মনে ছিলো, তবু অকারণেই ও ভুলে যাওয়ার ভান করলো।

ঋণা ঠোঁট টিপে হেসে বললো, ভদ্রমহিলার নামটা ভুলে যাওনি তো!

প্রথম প্রথম বেশ ভালোই লাগতো। এমন সাদা মন, তার ওপর ফুর্তির তুবড়ি যেন। কিছুক্ষণ কাছে থাকলে ঋণার মনটা খুশী হয়ে ওঠে। টুয়াকে সত্যি সত্যি খুব ভালোবেসে ফেলেছেন তৃপ্তিদি। কিন্তু অনীশের সঙ্গে এত ঠাট্টা-ইয়ার্কি’র কি দরকার।

অবশ্য ঋণাই বা বলতে ছাড়বে কেন। অনীশকে ওর সন্দেহ হয়নি, তব, যে লোকটা ট্রাম-বাসের ভিড়ের দোহাই পেড়ে সাতটার আগে ফিরতো না, সে হঠাৎ সাড়ে পাঁচটায় এসে হাজির হ’লা যে। আর এলোই যদি তো সিনেমার টিকিট কেটে আনলেও বুঝতো।

অনীশ তখনো জুতোর ফিতে খুলছে, ঋণা হেসে বললো, কি ব্যাপার?

অনীশ বুঝলো, তবু হেসে বললো, মুশকিল হলো দেখছি, তাড়াতাড়ি ছুটি পেলেও এখন আর বাড়ি ফেরা যাবে না। শরীর খারাপ হলেও…

—তাই বলেছি! ঋণার মুখে উৎকণ্ঠার প্রলেপ পড়লো। — সত্যি, শরীর খারাপ?

—ও কিছু না। কথাটা গ্রাহ্য করলো না অনীশ। শধু ক্ষণিকের জন্যে মনে পড়লো বিয়ের পর কত দিন ঋণা ওর জুতোর ফিতে খুলে দিয়েছে জোর করে, শরীর খারাপ বললেই কপালে হাত ছুইয়েছে।

ও তাই ইচ্ছে করেই একটু শরীর খারাপের ভান করলো। কিন্তু মনে মনে বিরক্ত হয়ে উঠলো ঋণার ওপর। ওকে এত খারাপ ভাবছে কেন ঋণা! তৃপ্তি এলে সমস্ত ঘরখানা চঞ্চল খুশিতে ভরে ওঠে, মন রজনীগন্ধা হয়ে ওঠে—–—এইটুকুই। আর কিছু নয়।

তৃপ্তিদি, তৃপ্তিদি, তৃপ্তিদি! চেনে বাঁধা চাবির রিং ঘোরাতে ঘোরাতে রাস্তার মাঝেই থমকে থেমে পড়বে : আরে অশোক যে! আজকাল নাকি খুব এমব্রয়ডারি করা রমাল নিয়ে ঘুরছো? কিংবা পাড়ার বাচ্চা ছেলে তমালকে: মর্নিং সেকশন ছুটি হবার সময় হয়ে গেছে, তাড়াতাড়ি যাও, মেয়েরা বেরিয়ে পড়েছে।

সুন্দর শরীর জুড়ে উচ্ছলতা। এক-একসময় তৃপ্তিদির এই গায়ে-পড়া স্বভাব ভীষণ খারাপ লাগে ঋণার, এক-একসময় হিংসে হয়। ও নিজে কেন এমন উচ্ছল হতে পারে না?

এদিকে অনীশের তখন চোখ পড়েছে দেয়ালে ঠেসানো জিনিসটার দিকে। — ওটা আবার কি রেখেছো?

—আজ্ঞে আমি না। ঋণা জবাব দিলো। আপনার ফ্রেণ্ড রেখে গেছেন।

একটু থেমে অনীশের অপ্রতিভ মুখটার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললো।—ক্যারাম বোর্ড। তৃপ্তিদি রেখে গেছেন।

বলতে না-বলতে এসে হাজির। হাতে ফ্রেঞ্চ চকের টিন।

ক্যারাম খেলার আড্ডা বসলো। সন্ধ্যেবেলায় এসে হাজির হবে প্রতি দিন। বেচারা ঋণার কাজ হয় না, টুয়াকে খাওয়াতে দেরি হয়ে যায়, অনীশ উঠতে চায় না।

—ভদ্রলোক সেল্‌ সম্যানের চাকরি করেন, অর্ধেক দিন কলকাতার বাইরে। ঋণা একদিন বলেছিলো।

অনীশ তাই বলেছিলো, বেচারা তৃপ্তিদির দোষ নেই, সময়ই বা কাটাবে কি করে।

—সময় কাটাবার জন্যে কি তুমি ছাড়া লোক নেই?

শুনে কখনো রাগে চুপ করে থাকে অনীশ, কখনো হেসে ওঠে।

কিন্তু ঋণার কাছে ক্রমশই যেন অসহ্য হয়ে ওঠে ব্যাপারটা। সিনেমা দেখতে যাওয়ার কথা হচ্ছিলো ক’দিন ধরে, হঠাৎ তৃপ্তিদির সামনে অনীশ ফস করে বলে বসলো, আপনিও চলুন না।

—বেশ তো, নিয়ে গেলে আর যাবো না কেন।

সমস্ত শরীর চিড়বিড় করে উঠলো ঋণার, ক্রুদ্ধ চোখে একবার তাকালো অনীশের মুখের দিকে, তারপর বলে উঠলো, বাঃ রে, উনি গেলে কি করে হবে!

চমৎকার অভিনয়ে হেসে উঠলো ঋণা। টুয়াকে তো ওঁর কাছেই রেখে যাবো ভেবেছিলাম। উনি তো বলেছিলেন…

তৃপ্তিও ততক্ষণে হেসে উঠেছে। — ওমা, আমিও তো বাবুলের কথা একদম ভাবিনি।

কিন্তু কতটুকুই বা বাধা দেবে ঋণা, কতবার? মাঝে মাঝে একটা বাটি হাতে এসে হাজির হতো তৃপ্তি, বলতো, আজ কচুর শাক রান্না করেছি ঋণা, নিয়ে এলাম তোমার জন্যে।

ইস্ ‘তোমার জন্যে’! মুখে হাসি মাখিয়ে সমস্ত শরীর তার ভিতরে ভিতরে বিষের তীর হয়ে উঠতো।

কিন্তু যেদিন অনীশের খাবার সময়ে এক বাটি মাংস নিয়ে এলো তৃপ্তি, অনীশের সামনে বাটিটা রেখে বসে রইলো, খান মশাই, খান, আপনার জন্যে স্পেশাল রান্না, সেদিন ঋণা দম আটকে ভাবলো, এখান থেকে পালাতে পারলে বাঁচে। তৃপ্তিদির কাছ থেকে।

—কোথায় কাপড় শুকোতে দিই বলো তো? বারান্দা নামেই, বর্ষাকালে এ বাড়িতে থাকা যায় না। ঋণা মাঝে মাঝে অনুযোগ করে।

শুধু কি বারান্দায় রোদ আসে না? অনীশ বুঝতে পারে এ পাড়ার এ বাড়ির কিছুই যেন পছন্দ নয় ঋণার। হয়তো অনীশকেও।

অনীশ বেশ বুঝতে পারে ঋণা অসুখী হয়ে উঠছে। সন্দেহ ঢুকেছে ওর মনের মধ্যে, তাই দিনে দিনে শরীর শুকিয়ে যাচ্ছে।

—শীতকালে এ বাড়িতে থাকতে হলে দেখো, আমি ঠিক মরে যাবো টি. বি. হবে আমার। ঋণা বলে।

অনীশ কপাল কু’চকে বলে, কি আজেবাজে বলছো! বেশ, পছন্দ না হয়, বাড়ি খু’জে দেখি।

—তুমি যাবে এ বাড়ি ছেড়ে? ম্লান হাসি দিয়ে অনীশকে বিদ্ধ করতে চাইলো ঋণা।

ঋণাকে সত্যিই মাঝে মাঝে বড় বিষণ্ন দেখায়। মনে হয়, ওর মাথার মধ্যে কি যেন ঘুরছে, কি যেন ঘুরছে। অসহ্য একটা যন্ত্রণা। বিষাক্ত একটা ভিমরুল।

সেদিন আপিস থেকে ফিরে চুপচাপ বসে রইলো অনীশ। কান সজাগ হয়ে রইলো, কখন বাবুলের আধো-আধো কথা শোনা যাবে, কিংবা তৃপ্তিদির চটির আওয়াজ। একবার ইচ্ছে হলো ক্যারাম বোর্ডটা পেতে ঋণাকেই ডাকে, তা হলে ঋণা অন্তত বুঝবে নেশাটা খেলার। কিন্তু একটুও ইচ্ছে হলো না।

কিন্তু কই, আটটা তো বেজে গেল, তৃপ্তি তো এলো না। তবে কি সেল্‌ সম্যান স্বামী তার ফিরে এসেছে?

—আজ তৃপ্তিদিকে খুব শুনিয়ে দিয়েছি। খাবার টেবিলে বসে কথাটা না বলে পারলো না ঋণা।

অনীশ চমকে চোখ তুললো।

ঋণা চোখ না তুলেই থালার ওপর মাছের কাঁটা বাছতে বাছতে বললো, পাড়ায় যা বদনাম তৃপ্তিদির, শেষকালে আমারও হয়তো…

অনীশের মাথা ঝিমঝিম করে উঠলো। চোখ বুজে রাগ চাপার চেষ্টা করলো। তারপর চিবিয়ে চিবিয়ে ছুরির ফলার মতো ধারালো কণ্ঠম্বরে বললো, না বললেও পারতে।

ঋণা চুপ করে রইলো।

অনীশ হঠাৎ বললো, দুর্গাপুরে ট্রান্সফার নিচ্ছি, প্রায় ঠিক হয়ে গেছে, তোমাকে বলিনি।

মুহূর্তে ঋণার সমস্ত মুখে খুশিতে ভরে উঠলো, দু চোখ ঝিকমিক করে উঠলো। সত্যি? দুর্গাপপুর? উঃ, চমৎকার, মামীমা আছেন সেখানে, ব্যারেজের ধারে রোজ বেড়াতে যাবো !

অনীশ হাসি-হাসি মুখে তাকালো ঋণার দিকে।

তারপর বললো, বাড়িটা সত্যি — এখানে আলো নেই, হাওয়া নেই। মুখার্জি সাহেবকে বললাম, তোমার শরীর খুব খারাপ হচ্ছে ।

—সত্যি? আমার, আমার জন্যে? ঋণার দু চোখের ঝকঝকে হাসি দু ফোঁটা জল হয়ে গেল ।

কিন্তু এ কি হলো? এমন তো চায়নি ঋণা !

গর্বে ওর বুক ভরে গিয়েছিলো সেদিন। নিজের ওপর নিজেরই রাগ হয়েছিলো। অনীশ অবশ্য এমনিই একটু চাপা স্বভাবের। তাই মুখে কিছু বলেনি, অথচ ঋণার কথা বিশ্বাস করে ট্রান্সফারের চেষ্টা করেছে। ট্রান্সফার নিয়েছে।

দুর্গাপুরে এসে সেই মানুষটাই কি করে এমন বদলে গেল, ঋণা বাঝতে পারে না।

—তোমার কি হয়েছে বলো তো? আপিসে কিছু? নির্বোধের মতো একদিন প্রশ্ন করেছিলো।

—কি আবার হবে! এমন তাচ্ছিল্যের সঙ্গে উত্তর দিয়েছিলো অনীশ, এমন মুখভঙ্গি করেছিলো যে, সেদিন আর কোনো কথাই বলেনি ঋণা। অপমানে চোখ ঠেলে জল এসেছিলো।

তবু মনকে স্তোক দিয়েছিলো ঋণা, ভেবেছিলো, হয়তো আপিসের কাজের চাপেই এমন বিরক্ত হয়ে থাকে অনীশ। কিন্তু দিনের পর দিন লোকটা এত দূরে সরে যাচ্ছে কেন! টুয়াকে বুকের ওপর দাঁড় করিয়ে আর তো কই আদর করে না। ঋণাকেও কেমন এড়িয়ে এড়িয়ে চলে। যেচে দু-একটা কথা বলতে গিয়েছে ও আর অনীশ ‘হু’ ‘হ্যাঁ’ করে দু-এক কথায় উত্তর দিয়েছে। আপিসের পর আপিসের বন্ধুদের নিয়ে সেই যে বেরিয়ে যায়, রাত দশটা অবধি একবারও যেন ঋণার কথা মনে পড়ে না।

টুয়ার জন্যে একটা নতুন সোয়েটার বুনতে বুনতে নিজের মনে মনেই ঋণা বললে অনীশকে শুনিয়ে শুনিয়ে, তখন ভেবেছিলাম রোজ ব্যারেজের দিকে বেড়াতে যাবো!

—গেলেই পারো।

যেন একটা অচেনা অজানা মানুষের প্রশ্নের জবাব দিলো অনীশ।

অভিমানে অপমানে মুখ সাদা হয়ে গেল ঋণার। ও কি একা বেড়াতে যাওয়ার কথা বলেছে ? ও কি শুধু, নিজের কথাই ভাবে? অনীশের মুখে হাসি ফুটিয়ে তোলার জন্যে কি এক মাস কম চেষ্টা করেছে ও! তবু বোঝে না কেন অনীশ।

দমবন্ধ-হওয়া কষ্ট লুকিয়ে ঋণা বললো, কান্না কান্না গলায় বললো, কি হয়েছে তোমার বলবে তো? কেন তুমি আজকাল এত খিটখিটে হয়ে উঠছো?

উত্তেজিত হয়ে উঠলো ঋণা।—কত দিন তোমাকে হাসতে দেখিনি বলো তো?

অনীশ গম্ভীর আক্রোশের গলায় চিবিয়ে চিবিয়ে বললো, সে কি! আমায় হাসতে দেখলেই তো তুমি হিংসেয় জ্বলে যাও।

বলেই উঠে চলে গেল অনীশ। আর সঙ্গে সঙ্গে ঋণার চোখের সামনে থেকে একটা পর্দা সরে গেল। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে অনীশের চলে যাওয়ার দিকে, সংসারকে লাথি মারা ভঙ্গিতে ফেলা তার পায়ের দিকে তাকিয়ে রইলো ঋণা।

কি আশ্চর্য! এত দিন এই সত্যটুকু ওর চোখে ধরা পড়েনি?

সমস্ত রাত বিছানায় ছটফট করলো ঋণা। অসহ্য এক কষ্টে। ভুল, ভুল। ভুল করেছে ও। নোংরা ঈর্ষায় জ্বলেছে ও তখন অথচ বুঝতে পারেনি তৃপ্তিদি ওদের সংসারে এক ঝলক আনন্দ এনে দিয়েছিলেন। আর অকারণ সন্দেহে নিজেকে কষ্ট দিয়েছে ঋণা, অনীশকে কষ্ট দিয়েছে।

তৃপ্তিদি কি অনীশকে ভালোবেসে ফেলেছিলো? কই চলে আসার দিনে তো মুখ দেখে মনে হয়নি। অনীশও বিচ্ছেদ-ব্যথা পেয়েছে বলে মনে হয়নি। আর তাই যদি সত্যি হতো তা হলে কি অনীশ নিজেই চেষ্টা করে ট্রান্সফার নিতো!

তৃপ্তিদির মধ্যে কি এক জাদু আছে, এক-একজনের মধ্যে থাকে, তাই তার সংস্পর্শে এসে ঋণা নিজেও তো প্রথম প্রথম সুখী হয়ে উঠেছিলো। অথচ অনীশ খুশী হয়ে উঠলে কেন সন্দেহে জ্বলেছে ও?

‘আমায় হাসতে দেখলেই তো তুমি হিংসেয় জলে যাও।’ কথাটা ক’দিন ধরেই ঋণার মাথার মধ্যে ভিমরুল হয়ে ঘুরলো। সত্যি। অনীশের ওপর সত্যি অবিচার করেছে ও। কিন্তু কি লাভ হয়েছে ঋণার? তৃপ্তিদি ছিলো, তবু সুখ ছিলো, আনন্দ ছিলো ওদের দুজনের জীবনেই। সেখান থেকে সরিয়ে এনে যেটুকু সম্বল ছিলো তা-ও হারিয়ে ফেলেছে।

তার চেয়ে আগের জীবনে ফিরে যেতে পেলে বে’চে যাবে ঋণা। সেই একটু সন্দেহ, একটু ভয়, কিন্তু অসীম আনন্দ। খাটে শুয়ে রবিবার দুপরে হয়তো অনীশ আবার আগের মতোই ওর চুল এলোমেলো করে দেবে। টুয়া কখন কি নতুন কথা বললো তা নিয়ে দুজনে মিলে চমকে উঠতে পারবে, হাসতে পারবে প্রাণ খুলে। অনীশ আবার টুয়ার জন্যে তাড়াতাড়ি আপিস থেকে ফিরবে।

আঃ, কি যন্ত্রণা! কি করে সে কথা মুখ ফুটে বলবে ও! কি করে ফেলে-আসা জীবনে, ছেড়ে-আসা ফ্ল্যাটে ফিরে যেতে পারবে।

—শুনছো! হাত বাড়িয়ে অনীশের তন্দ্রাঘোরের শরীরটা ছুলো ঋণা।

অনীশ বুঝতে পারলো. তবু উত্তর দিলো না।

—এই. এই. শোনো না। বলেই কে’দে ফেললো ঋণা, অনীশের বুকের ওপর মাথা রাখলো।

অনীশ ঘুম-ভাঙা হাতখানা তুলে ঋণার মাথায় রাখতে গেল বুকের ওপর ভিজে-ভিজে ঠেকতেই। কিন্তু হাতটা নামিয়ে নিলো, সান্ত্বনা দিতে ইচ্ছে হলো না।

ঋণা তবু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বললো, আমি — আমি এখানে থাকলে মরে যাবো, শুনছো, তুমি আমাকে কলকাতায় ফিরিয়ে নিয়ে চলো।

—কলকাতায় ? অনীশ বিস্ময়ের দুটি চোখে অন্ধকার ঠেলে সিলিঙের দিকে তাকালো।

ঋণা ওর বুকের ওপর মুখে ঘষতে ঘষতে বললো, আমাদের সেই ফ্ল্যাটে।

সেই ফ্ল্যাটে নয়। চিঠি লিখে দু মাস অপেক্ষা করে সেই পাড়াতেই আরেকটা ফ্ল্যাট যোগাড় হলো। ট্রান্সফার নিলো অনীশ অনেক চেষ্টা করে।

আর ঋণা মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো, আর হিংসেয় জ্বলবে না ও, সন্দেহের আগুনে নিজেকে পোড়াবে না।

–কি মশাই, কি অত ভাবছেন?

ঋণা ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় দাঁড়িয়ে চুল বাঁধছিলো। অনীশ একদৃষ্টে তাকিয়ে দেখছিলো তাকে? নাকি অন্য কিছু ভাবছিলো?

চুলের কালো ফিতেটা দাঁতে চেপে, ঋণার ফর্সা গালে সেটা চেপে বসেছে, ঋণা চুল বাঁধছিলো। তৃপ্তিদির গলা শুনে ফিরে তাকালো।

দেখো কাণ্ড! কপাল কু’চকে উঠলো ঋণার।

তৃপ্তিদি পিছন থেকে এসে অনীশের চুল এলোমেলো করে দিলেন।—কি, সেই ফিরে আসতে হলো তো আমার টানে! জানি আসতে হবে।

বলেই খিলখিল করে হেসে উঠলেন দু কাঁধ ঝাঁকিয়ে।

ঋণা তাকালো অনীশের দিকে, দেখলো অনীশের সারা মুখে হাসিতে উচ্ছল হয়ে উঠছে। অসহ্য কষ্টে দাঁতে ঠোঁট কামড়ে রইলো ঋণা।

কপাল আরো কু’চকে উঠলো।

ঋণা মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলো, আর বাধা দেবে না, হিংসেয় জলবে না সন্দেহে পুড়বে না। তা হলেই ওর নিজের জীবন সুখে সহজ হয়ে যাবে।

কিন্তু পারলো না। ধীরে ধীরে তীক্ষ্ণ কর্কশ গলায় বিষাক্ত তীরের মতো কথাটা ছু’ড়ে দিলো।—না। আপনার ভয়েই পালিয়েছিলো ও, আপনার ভয়ে!

 

Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments