কঙ্কগড়ের কঙ্কাল (কিশোর কর্নেল) – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ
পাঁচ
হলঘরে ফিরে কর্নেল বললেন, এই জিনিসটার খোঁজে ম্যাজিকবাবুর ডেরায় হানা দিয়েছিলাম। তার ম্যাজিকের বাকসো-পাটরা তন্নতন্ন খুঁজে যখন পেলাম না, তখন বুঝলাম এটা হয়তো সিন্দুকের ভেতর থেকে গেছে। কাপালিকবেশী লোকটি যে-ই হোক, তাকে ম্যাজিকবাবু এটা দিলে প্রাণে মারা পড়ত না। ম্যাজিকবাবু ভজুয়ার সাহায্যে সিন্দুক থেকে তান্ত্রিক আদিনাথের বন্ধ লাশের হাড়গোড় নিয়ে গিয়েছিল…
দীপক চমকে উঠে বলল, ভজুয়ার সাহায্যে? অসম্ভব।
সম্ভব ডার্লিং! কর্নেল সোফায় বসে চুরুট ধরালেন। যখের ধনের লোভ সবচেয়ে সাংঘাতিক লোভ। চিন্তা করে দ্যাখো। ওই পাতালঘর থেকে ভজুয়ার সাহায্য ছাড়া কারও পক্ষে কাজটা সম্ভব ছিল না। তোমার ঠাকুরদার বইয়ে লেখা আছে, কবন্ধ লাশ দুমড়ো-মুচড়ে কাপড়ে বেঁধে সিন্দুকে ঢোকানো হয়েছিল। এতকাল পরে কাপড় আস্ত থাকার কথা নয়। কাজেই হাড়গোড়গুলো আবার একটা কাপড়ে বা চটের থলেয় ভরে নিয়ে গিয়েছিল দুজনে। এদিকে মাংস গলে পচে কাপড় গুড়ো হয়ে এই জিনিসটা সিন্দুকের তলায় খসে পড়েছে এবং সেঁটে গেছে।
জিনিসটা কর্নেল দেখলেন বাংলোয় দেখা আধখানা চাঁদের গড়ন সেই সিলের বাকি টুকরো বলে মনে হল। বললাম, একটা গোটা সিল দু-টুকরো করার কারণ কী?
কর্নেল দাড়িতে হাত বুলিয়ে বললেন, বইয়ে তান্ত্রিক আদিনাথের ছবি আছে। শিবের জটায় চন্দ্রকলার ছবি দেখেছ তো? ওঁর জটাতেও তেমনই আধখানা খুদে চাঁদের মতো জিনিস আছে। প্রথমে গ্রাহ্য করিনি। পরে দেখলাম ওঁর ডান বাহুতে তাগার মতো অবিকল একই জিনিস বাঁধা আছে। আতশ কাচে দুটোই পরীক্ষা করে বুঝলাম একটা খুদে সিলের দুটো টুকরো। কী সব খোদাই করা আছে ওতে! তখনই বুঝলাম তান্ত্রিক আদিনাথ যত বুদ্ধিমান ছিলেন, তাঁর ভাইপো হরনাথ মানে, দিপুর ঠাকুরদাও তত বুদ্ধিমান ছিলেন। হরনাথ লিখেছিলেন, দেবী চণ্ডিকার ধনে লোভ করা উচিত নয়। বইয়ে ধ হরফ এবং লো হরফ পোকায় কেটেছে। তাই দিপুর বাবা ব্যাপারটা প্রথমে বুঝতে পারেননি। দু-দুটো নরবলির পর ওঁর সন্দেহ হয়। তাই আমার কাছে ছুটে গিয়েছিলেন?
দিপু বলল, বাপস! মাথা ভোঁ ভোঁ করছে। সেকালের লোকেরা কী অদ্ভুত ছিল!
হ্যাঁ। এখন তা-ই মনে হচ্ছে। কিন্তু হরনাথ ধর্মপ্রাণ মানুষ। দেবী চণ্ডিকার ধনের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব বংশধরদের হাতে দিতে চেয়েছিলেন। ওই ছড়াটা উনি তাই নিজেই রচনা করে লিখে গেছেন। এর মধ্যে একটা সূত্র লুকানো আছে। সিলের আধখানা তো সিন্দুকে নিরাপদে রইল। বাকি আধখানা খুঁজে বের করার জন্য ওই ছড়া! কিন্তু ছড়াটা কাজে লাগেনি। জগাই জানত, মুন্ডু কোথায় পোঁতা আছে।
বললাম, কিন্তু তান্ত্রিক আদিনাথকে বলি দিল কে? কর্নেল হাসলেন। ওটা গপ্পো। আমার থিয়োরি হল, আসলে জ্যাঠামশাইয়ের মৃত্যুর পর দেবী চণ্ডিকার লুকিয়ে রাখা ধন যাতে সহজে কেউ খুঁজে না পায় তাই হরনাথ একটা সাংঘাতিক কাজ করেছিলেন। মৃতদেহের মুণ্ডু কেটে কোথাও পুঁতে রাখার জন্য…
বাধা দিয়ে বললাম, বোগাস। আপনার থিয়োরর মাথামুণ্ডু নেই। সিলের টুকরো দুটো লুকিয়ে রেখে গেলেই পারতেন! কোনও বদ্ধ পাগল ছাড়া মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা দিতে পারে না।
কর্নেল হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, সাড়ে বারোটা বাজে। চলি দিপু! ওবেলা এসে তোমার বাবার সঙ্গে দেখা করব।
দীপক হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
বাইরে গিয়ে বললাম, জগাই কী করে জানল কোথায় মুণ্ডু পোঁতা আছে?
কর্নেল গম্ভীর মুখে বললেন, তুমি তো কথাটা শেষ করতেই দিলে না। আমি কি বলেছি হরনাথ নিজের হাতে তান্ত্রিক জ্যাঠার লাশের মুণ্ডু কেটে ছিলেন? মড়া কাটার জন্য ওঁর একজন লোকের দরকার ছিল। জগাইরা পুরুষানুক্রমে এই কাজ করে। হরনাথের বইয়ে একজনের উল্লেখ আছে। তার নাম গদাই। নিশ্চয় জগাইয়ের ঠাকুরদা বা তার বাবা। নামে নামে মিল। এদিকে তো পূর্বপুরুষের কোনও গোপন কথা বংশানুক্রমে পরিবারে চালু থাকে। এই পরিবারেও ছিল। আমার থিয়োরি নিখুঁত, ডার্লিং!
কী করে অত নিশ্চিত হচ্ছেন?
জগাই একইভাবে খুন হয়ছে বলে। কর্নেল গেট পেরিয়ে একটা সাইকেল রিকশা ডাকলেন। তারপর বললেন, বাংলোয় ফিরে বুঝিয়ে দেব।
বাংলোয় পৌঁছে দেখি, হালদারমশাই আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন। উত্তেজিতভাবে এগিয়ে এসে চাপা স্বরে বললেন, কাপালিকের ডেরা ডিসকভার করেছি কর্নেল! গড়খাইয়ের ওপারে একটা গুহার মতো গম্বুজঘরে সে থাকে। কম্বলের তলায় ভাজকরা এই চিঠি ছিল।
কর্নেল ওঁর হাত থেকে ইনল্যান্ড লেটার নিয়ে বললেন, দিপু আপনার জন্য ভেবে সারা। শিগগির গিয়ে ওকে দেখা দিন। আর শুনুন! একটা দায়িত্ব দিচ্ছি। রামুর গাধার পিঠে একটা বোঁচকা বাঁধা আছে। গাধাটা নয়, বোঁচকাটা খুব দরকার।
হালদারমশাই লাফিয়ে উঠলেন। কই? কই সে?
খেয়েদেয়ে খুঁজতে বোরোবেন। ঝিলের জঙ্গলেই দেখা পেতে পারেন। কিছুক্ষণ আগে ওকে তাড়া করে ওদিকেই পাঠিয়ে দিয়েছি।
প্রাইভেট ডিটেকটিভ সবেগে উধাও হয়ে গেলেন।
খাওয়াদাওয়ার পর কর্নেল ইনল্যান্ড লেটার পড়ে আমাকে দিলেন। চিঠিতে লেখা আছে :
শঙ্করদা,
পত্রপাঠ চলে আসুন জগাই রাজি হয়েছে। ভজুয়াও রাজি। গতবারের মতো সেজে আসবেন। শ্মশানতলায় থাকবেন। মা চণ্ডীর কৃপায় এবার আর ব্ল্যর্থ হব না। প্রণাম রইল। ইতি
নাম ঠিকানা ইংরেজিতে লেখা! শ্রী এস. এন. ভট্টাচার্য। কেয়ার অব জয়চণ্ডি অপেরা। ৩৩/১, ঠাকুরপাড়া লেন, কলকাতা-৫।
বললাম, যাত্রাদলের লোক?
কর্নেল হাসলেন। তাই তো মনে হচ্ছে। তার পক্ষে কাপালিক সাজা সহজ। এবার এই চিরকুটটা দ্যাখো। ম্যাজিকবাবু শচীন হাজরার বাকসে পেয়েছি।
চিরকুটটা দেখেই বললাম, আমাকে যে চিরকুটটা ছুঁড়ে কাল বিকেলে ভয় দেখিয়েছিল, তারই লেখা। ম্যাজিকবাবুকে শ্মশানতলায় ডেকেছিল দেখছি। তলায় ইংরেজিতে এস লেখা, সেই শঙ্করদা!
হ্যাঁ। জগাইকে দিয়ে খবর পাঠিয়েছিল, এসে গেছি। যাই হোক, এবার ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিই। বলে কর্নেল তার কিটব্যাগ থেকে প্যাড বের করে আঁকজোক শুরু করলেন। তারপর বললেন, এটা একটা ওলটানো ত্রিভুজ।
…এ বিন্দু ভজুয়া, বি বিন্দু জগাই এবং সি বিন্দু ম্যাজিকবাবু শচীন হাজরা, মাঝখানে ডি বিন্দু হল শঙ্কর নামে একটা লোক। যে কোনো কারণেই হোক শঙ্কর প্রকাশ্যে কঙ্কগড়ে আসতে পারে না। অথচ সে দেবী চণ্ডিকার গুপ্তধন-রহস্য জানে। সে তিনজনের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিল।
এতদিন পরে সে ম্যাজিকবাবুর সাহায্যে প্রথমে তান্ত্রিক আদিনাথের ধড় হাতাল। কিন্তু সিলের অর্ধাংশ পেল না। তখন ম্যাজিকবাবু ওটা হাতিয়েছে সন্দেহ করে তাকে খতম করল। তারপর জগাই মুন্ডু উদ্ধার করে দিলে। কিন্তু মুণ্ডুতেও সিলের বাকি আধখানা নেই। থাকবে কী করে? মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। সন্দেহক্রমে খাপ্পা হয়ে সে জগাইকে খতম করল। কারণ সে ধরেই নিয়েছিল গুপ্তধনের লোভে তাকে ওরা ফাঁকি দিচ্ছে। বাকি রইল ভজুয়া। আমার ধারণা, ভজুয়ার সঙ্গে বোঝাপড়া চালিয়ে যাচ্ছিল শঙ্কর। নিশ্চয় ওকে লোভ দেখিয়ে বাগে এনেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকেও সন্দেহক্রমে খতম করেছে। গুপ্তধনের লোভ পেয়ে বসলে মানুষ হিংস্র হয়ে ওঠে। তিন-তিনজনকে সে অবশ করে দেবী চণ্ডিকার থানে এনে বলি দিয়েছে। দিগবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করেছে। কিন্তু সে আশা ছাড়েনি। দিপুর বাবা গোয়েন্দা এনেছেন কলকাতা থেকে, সে জেনে গিয়েছে। তাই ভেবেছে, গোয়েন্দার ওপর বাটপাড়ি করবে। আসলে আমাদের হালদারমশাই অতি-উৎসাহে- ঠিক তোমার মতোই…।
বাধা দিয়ে বললাম, জ্যান্ত কঙ্কাল চোখের সামনে নাচতে দেখলে মাথার ঠিক থাকে না।
কর্নেল সেই কালো আধখানা সিলটা লোশন দিয়ে পরিষ্কার করতে থাকলেন। বললেন, আজ পুর্ণিমা। আজ রাতে আবার কঙ্কালের নাচ দেখাব তোমাকে। শিয়োর!
দুপুরে আমার ভাতঘুমের অভ্যাস আছে। কিছুক্ষণ পরে কর্নেলের ডাকে ঘুমটা ভেঙে গেল। কর্নেল সিলের টুকরো দুটো জোড়া দিয়েছেন। বললেন, একপিঠে দেবী চণ্ডিকার রণমূর্তি। অন্যপিঠে শুধু স্বস্তিকাচিহ্ন। ব্যাপারটা বোঝা যাচ্ছে না। গুপ্তধনের সূত্র কোথায়? দেবী চন্ডিকা আর স্বস্তিকা। কর্নেল টাকে হাত বোলাতে থাকলেন। চোখ বুজে গেল।
একটু পরে চোখ খুলে সোজা হয়ে বসলেন। বললাম, গুপ্তধনটা গুলতাপ্পি নয় তো?
কিছু বলা যায় না। যাকগে চলো। বেরোনো যাক।
গুপ্তধনের খোঁজে?
নাহ। থানায়।
থানায় যেতে আমার ভালো লাগে না। আপনি যান।
কর্নেল উঠে দরজার কাছে গিয়ে বললেন, ঠিক আছে। বরং তুমি রামুর গাধাটা ধরতে হালদারমশাইকে সাহায্য করতে পারো। ওই দ্যাখো, ঝিলের দক্ষিণের ঘাটে হালদারমশাই ওত পেতে বসে আছেন।
বারান্দায় গিয়ে দেখি, সত্যি তাই। হালদারমশাই ঘাটের পাশে একটা ঝোপের ধারে বসে আছেন! গাধাটা দেখতে পেলাম না। কর্নেল চলে যাওয়ার পর রঘুলালকে ঘরের দিকে লক্ষ্য রাখতে বলে বেরিয়ে পড়লাম। নীচের রাস্তায় নেমেছি, হালদারমশাইয়ের চিৎকার শোনা গেল।
জয়ন্তবাবু! জয়ন্তবাবু! গাধা! গাধা!
পিঠে বোঁচকাবাঁধা গাধাটা জঙ্গল ফুঁড়ে ছুটে আসছিল। আমি দু-হাত তুলে এগিয়ে যেতেই ঝিলের ঢালে নেমে গেল। তারপর দিব্যি জলজঘাসের দিকে মুখ বাড়াল। আমি রঘুলালকে ডাকলাম। সে দৌড়ে এল। বললাম, গাধাটা ধরতে হবে। বকশিশ পাবে রঘুলাল।
হালদারমশাই থমকে দাঁড়িয়ে বললেন, গাধা কয় আর কারে!
রঘুলাল একটা মজার কাজ পেয়ে গেল যেন। সে বলল, চ্যাঁচামেচি না করে তিনজনে তিনদিক থেকে ঘিরে ধরতে হবে স্যার। রামুর গাধাটা খুব বদমাশ! লাথি ছুঁড়তে পারে।
হালদারমশাই বললেন, দড়ি লও রঘুলাল! আমার কাছে দড়ি আছে।
রঘুলাল দড়ি নিয়ে পা টিপেটিপে এগোলো। বললাম, দড়ি নিয়ে বেরিয়েছিলেন নাকি?
হালদারমশাই হাসলেন। নাহ। কাইল রাত্রে কাপালিক আমারে এই দড়ি দিয়া বাঁন্ধছিল না?
রঘুলাল চাপা গলায় বলল, আপনারা দু-দিকে রেডি থাকুন সার?
সে কাছাকাছি যেতেই গাধাটা ঘুরল। অমনই রঘুলাল তার গলায় দড়ির ফাঁস আটকে দিল। হালদারমশাই এবং আমি গিয়ে দড়ি ধরে ফেললাম। টাগ অব ওয়ারে শেষ পর্যন্ত গাধাটা পরাস্ত হয়ে ঘাসে পড়ে গেল। হালদারমশাই তার পিঠ থেকে বোঁচকাটা খুলে নিয়ে বললেন, খুব জব্দ এবার। রঘুলাল! ওকে ছেড়ে দাও! কিন্তু ইস্! বোঁচকাটায় কী বিটকেল গন্ধ!
গাধা বেচারা গলায় দড়ির ফাঁস নিয়ে নড়বড় করে দৌড়ে রাস্তায় উঠল। বুঝলাম, বুদ্ধিমান গাধা। জঙ্গলে ঢুকলে দড়িটা কোথাও আটকে গিয়ে বিপদে পড়ত।
হালদারমশাই বাংলোয় এলেন আমার সঙ্গে। কর্নেল নেই শুনে নিরাশ হলেন। বোঁচকা থেকে সত্যি বিকট দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছিল। সেটা এনে ফেলে রেখে বারান্দায় বসলাম আমরা। রঘুলাল কফি করতে গেল। হালদারমশাই সন্দিগ্ধভাবে বললেন, বোঁচকায় কী আছে যে, এমন দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। গাধার পিঠে এটা বাঁধলই বা কে?
হাসতে-হাসতে বললাম, খুলে দেখুন না! গুপ্তধন থাকতেও পারে।
হালদারমশাইয়ের ধৈর্য রইল না আর। উঠে গিয়ে নোংরা কাপড়ের বোঁচকাটা খুলে ফেললেন। তারপর লাফিয়ে উঠে বললেন, সর্বনাশ! মড়ার খুলি আর হাড়গোড়ে ভর্তি।
চমকে উঠেছিলাম। বুক ধড়াস করে উঠেছিল। বললাম, এই সেই তান্ত্রিক আদিনাথের কঙ্কাল।
বোঁচকাটা ঝটপট বেঁধে হালদারমশাই বললেন, আপনি কাইল রাত্তিরে দেখছিলেন, একটা কঙ্কাল আমারে বলি দিতে চাইছিল? হেই ব্যাটাই! কিন্তু খড়্গ গেল কই?
বললাম, কাপালিকের কাছে।
হঃ। ঠিক কইছেন। বলে হালদারমশাই বারান্দায় এলেন। ধপাস করে বসে জোরে শ্বাস ছাড়লেন। বোঝা গেল, এতক্ষণে উনি বেজায় উত্তেজিত।
একটু করে কফি খেতে খেতে আমরা গুপ্তধন রহস্য নিয়ে আলোচনা করছি, রঘুলাল ব্যাপারটা বোঝবার চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিয়েছে এবং লনে দাঁড়িয়ে উদাস চোখে ঝিলের দিকে তাকিয়ে আছে, হঠাৎ বলল, কর্নেলসাব আসছেন। ওই দেখুন।
ঝিলের ধারে জঙ্গলের ভেতর কর্নেলকে হন্তদন্ত আসতে দেখলাম। হালদারমশাই হন্তদন্ত গেটের দিকে এগিয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পরে গেটের নীচে কর্নেলের টুপি দেখা গেল। হালদারমশাই জয়ের উল্লাসে বলে উঠলেন, বোঁচকার ভেতর স্কেলিটন অ্যান্ড স্কাল!
সাড়ম্বরে ঘটনার বিবরণ দিতে দিতে হালদারমশাই কর্নেলের সঙ্গে বাংলোর বারান্দায় ফিরে এলেন। রঘুলাল আবার কফি করতে গেল। বললাম, গেলেন তো থানায়। ফিরলেন জঙ্গল থেকে। নিশ্চয় অর্কিড খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন না জঙ্গলে?
কর্নেল হাসলেন। মুখে ক্লান্তির ছাপ। বললেন, ফাঁদ পাততে গিয়েছিলাম।
কিসের ফাঁদ?
কাপালিক ধরার। হালদারমশাই ওর ডেরার খোঁজ দিয়েছেন। সেই ডেরায় ঢুকে গুপ্তধনের সূত্র অর্থাৎ সিলটা রেখে এলাম। সঙ্গে একটা চিঠি। সন্ধ্যা সাতটায় ঝিলের পুবের ঘাটে বুড়ো শিবের মন্দিরের সামনে দেখা করতে লিখেছি। শর্ত দিয়েছি, গুপ্তধনের আধাআধি বখরা চাই। দেখা যাক টোপ গেলে কি না। গুপ্তধনের লোভ অবশ্য সাংঘাতিক।
অবাক হয়ে বললাম, সিলটা রেখে এসেছেন! করেছেন কী!
কর্নেল চাপা স্বরে সকৌতুকে বললেন, বলেছি ডার্লিং, আজ রাতে কঙ্কালের নাচ দেখব। আর হালদারমশাই স্বচক্ষে দেখবেন তাকে কে বলি দেবে বলে শাসাচ্ছিল।
হালদারমশাই বললেন, সে-ব্যাটা তো ওই বোঁচকার ভেতর বাঁধা আছে।
হালদারমশাই! প্রেতাত্মা তার কঙ্কালসুদ্ধ বোঁচকা থেকে বেরিয়ে পড়বে। যাইহোক, রঘুলালকে দিয়ে ওটা আপাতত বাথরুমে রাখতে হবে। এখন সাড়ে পাঁচটা বাজে। পৌনে সাতটায় আমরা বুড়ো শিবমন্দিরের ওখানে পৌঁছোব।
একটা চুড়ান্ত মুহূর্তের দিকে পৌঁছোতে গেলে যা হয়। সময় যেন কাটতে চায় না। সাড়ে ছটায় আমরা বেরিয়ে পড়লাম। নীচের রাস্তা দিয়ে ঘুরে ঝিলের উত্তর পাড় ধরে কর্নেল এগোলেন। স্তূপ, খানাখন্দ, ঝোপঝাড় পেরিয়ে মোটামুটি ফাঁকা জায়গা দেখা গেল। সবে চাঁদ পুবের গাছপালার মাথা আলো করে উঁকি দিচ্ছে। হালদারমশাই ফিশফিশ করে বললেন, আরে! এখানেই তো কাপালিক মাটি খুঁড়ছিল।
কর্নেল বললেন, হ্যাঁ। খুলি পোঁতা ছিল এখানেই। ওই দেখুন, বুড়ো শিবের মন্দির। চুড়োয় একটা ত্রিশূল পোঁতা আছে।
এই সময় কাছাকাছি কেউ বলে উঠল, এসে গেছি কর্নেল!
চলে এসো দিপু!
দীপক একটা স্তূপের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল। হাতে সেই বল্লম আর টর্চ। কর্নেল আমাদের নিয়ে ফাঁকা জমিটায় গেলেন। তারপর বললেন সবাই মন্দিরের আড়ালে যাও। কুইক! দিপু, এদের নিয়ে যাও। সাবধান! টুঁ শব্দটি করবে না।
কতকালের পুরোনো মন্দির। তার একপাশে ঘন ছায়ায় আমরা তিনজনে বসে রইলাম। কর্নেল ফাঁকা জমিটায় পায়চারি করছিলেন। আশ্চর্য ব্যাপার, একটু পরে ওঁকে সেই ছড়াটা আওড়াতে শুনলাম। ছড়াটা বার-দুই আউড়েছেন, কেউ খ্যানখ্যানে গলায় বলে উঠল, ওঁ, হ্রীং ক্লীং ফট! তারপর দপ করে একটা মশাল জ্বলে উঠল। পেছনে ঘন ঝোপ। ঝোপের মাথায় মশালটা আটকানো মনে হল।
হঠাৎ ঝোপ ডিঙিয়ে একটা আস্ত নরকঙ্কাল লাফ দিয়ে এসে দাঁড়াল। তার দু-হাতে ধরা একটা চকচকে খাঁড়া নেড়ে তেমনই ভুতুড়ে গলায় বলল, এসেছিস? আয়, আয়! কাছে আয়!
কর্নেল কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে বললেন, দেবী চণ্ডিকার গুপ্তধন কি উদ্ধার হয়নি?
কাছে আয়। কথা হবে।
আর কিসের কথা মশাই? সিল তো পেয়ে গেছেন।
কঙ্কাল খাঁড়া নামিয়ে বলল, চালাকি? আমি কে জানিস? আমি তান্ত্রিক আদিনাথ। আমার দেবীর ধন। আমার সঙ্গে ফক্কুড়ি? তবে রে ব্যাটা বুড়ো টিকটিকি!
এবার যেন কর্নেলেরই আমার মতো মাথা খারাপ হয়ে গেল। টিকটিকি বলার জন্যই কি খেপে গেলেন? রিভলভার বের করে দৌড়ে গেলেন। কঙ্কালটা তড়াক করে ঝোপ ডিঙিয়ে পালাতে যাচ্ছিল। ঝোপে আটকে গেল। তারপর হঠাৎ ঝোপের ওপাশে অনেক টর্চের আলো জ্বলে উঠল। ধুপধাপ, দুদ্দাড়, ছুটোছুটি শব্দ। আমরা দৌড়ে কর্নেলের কাছে গেলাম। কর্নেল সেই কঙ্কালটা ঝোপের ডগা থেকে নামিয়ে এনে বললেন, ম্যাজিকবাবুর ম্যাজিক কঙ্কাল! ম্যাজিকের স্টেজে পুতুলনাচের কৌশল পেছন থেকে প্লাস্টিকে তৈরি কঙ্কালটাকে দড়ির সাহায্যে কনট্রোল করা হত। হুঁ, খাঁড়াটা দেখছি পিসবোর্ডে মোড়া রাংতার। বলে হাঁক ছাড়লেন, কই মি. ধাড়া! আপনার আসামি কোথায়?
ঝোপের পেছন থেকে সাড়া এল, বড্ড বেয়াড়া আসামি! এক মিনিট কর্নেল!
তারপর সদলবলে বেরিয়ে এলেন সত্যিকার খাড়া হাতে এক দারোগাবাবু। তার পেছনে কনস্টেবলরা লাল কাপড়পরা এক কাপালিককে বেঁধে নিয়ে এল। দারোগাবাবু বললেন, খাড়াটা দেখেছেন? হাতে এটা ছিল বলেই অ্যারেস্ট করতে একটু দেরি হল।
কর্নেল কাপালিকের জটাজুট এবং গোঁফদাড়ি হ্যাঁচকা টানে খুলে দিয়ে টর্চ জ্বেলে বললেন, দ্যাখো তো দিপু, লোকটাকে চিনতে পারো কি না?
দীপু অবাক হয়ে বলল, এ কী! শঙ্করকাকা না?
হ্যাঁ। তোমার বাবার জ্ঞাতিভাই শঙ্করনাথ ভট্টাচার্য। তোমাদের বাড়ি থেকে পাঁচ হাজার টাকা চুরি করে পালিয়েছিল। তুমি তখন আসানসোলে কলেজ-স্টুডেন্ট। তোমার বাবার কাছে জেনে নিয়ো কী সাংঘাতিক আর জঘন্য চরিত্রের লোক এই শঙ্করনাথ। মি. ধাড়া! আসামি নিয়ে থানায় চলুন। আমি পরে দেখা করব।
দারোগাবাবু এবং কনস্টেবলরা আসামি নিয়ে চলে গেলেন। হালদারমশাই কঙ্কালটা পরীক্ষা করছিলেন। খি-খি করে হেসে বললেন, কী কাণ্ড! আমি ভাবছিলাম বোঁচকা থেকে বেরিয়ে– খি-খি-খি!
বললাম, কিন্তু ওই অদ্ভুত ছড়াটার মানে কী?
কর্নেল, বললেন, ওই দ্যাখো, বার-পনেরো-চাঁদা উঠেছে। বুড়ো শিবের ত্রিশুলের ছায়া কোথায় পড়েছে লক্ষ্য করো! ওখানে খুলিটা পোতা ছিল। হুঁ, গোড়া থেকে বুঝিয়ে দিই। আঁটঘাট বাঁধা নয়, কথাটা হল আটঘাট বাঁধা। এই ঝিলের চারদিকে বাঁধানো ঘাট আছে। বুড়ো শিবের মন্দির তো দেখতেই পাচ্ছ। বার পনেরো চাঁদ মানে বারো নম্বর মাস অর্থাৎ চৈত্র মাস। পনেরো হচ্ছে চাঁদে পঞ্চদশী তিথি। তার মানে চৈত্র মাসে পূর্ণিমার চাঁদ যখন বুড়ো শিবের ত্রিশূলের মাথায় দেখা যাবে, ত্রিশূলের ছায়া যেখানে পড়বে, সেখানেই খুলি পোঁতা আছে। তাই ছড়ায় আছে : বুড়ো শিবের শূলে। আমার মাথায় ছুঁলে। কিন্তু চূড়ার জট ছাড়ানোর আগেই জগাই খুলির খোঁজ দিয়েছিল শঙ্করনাথকে।
গুপ্তধনের কী হল?
তুমি ভুলে গেছ জয়ন্ত, পাতালঘরের দেওয়ালে আমরা সিদুরে আঁকা স্বস্তিকাচিহ্ন দেখেছি। সিলের একপিঠে স্বস্তিকা আছে। অন্যপিঠে দেবী চণ্ডিকার মূর্তি। ওই মূর্তিটাই গুপ্তধন। প্রায় এক কেজি ওজনের সোনার দেবীমূর্তি। থানায় খবর দিয়ে দিপুদের বাড়ি গিয়ে গুপ্তধন উদ্ধার করেছি। স্বস্তিকা আঁকা ছিল যেখানে, সেখানে খুঁড়তেই সোনার মূর্তি পাওয়া গেল। কাজেই সিলটা শঙ্করনাথের ডেরায় রেখে এসেছিলাম। ওটাই ফাঁদ। বুঝলে তো?
হালদারমশাই উদাস চোখে চাঁদ দেখছিলেন। বললেন, চলেন কর্নেলস্যার। বাংলোয় গিয়া বোঁচকাটা দেখা দরকার।
কর্নেল কঙ্কালটা দিব্যি ভাঁজ করে গুটিয়ে বললেন, বোঁচকা আছে। শঙ্করনাথ-তান্ত্রিক আদিনাথের কঙ্কাল আর খুলিতে সিল না পেয়ে খাপ্পা হয়ে ওটা রামুর গাধার পিঠে বেঁধে দিয়েছিল। কিন্তু গাধাটাকে এই কাজে লাগাতে হলে রামুকে ভয় দেখিয়ে ঘাট থেকে তাড়ানো দরকার ছিল। তাই ম্যাজিকবাবুর কঙ্কাল দেখিয়ে বেচারাকে ভাগিয়ে দেয়। আস্ত কঙ্কালের নাচ দেখে রামুর পাগল হওয়া স্বাভাবিক। তবে এবার ওকে সুস্থ করা যাবে।
আমরা বাংলোয় ফিরে চললাম।
