ইয়াজদার্গিদের হিরে (কিশোর কর্নেল) – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ

শেয়ার করুনঃ

পাঁচ 

রাজেন অধিকারীর দানোটার কথা বলার জন্য উশখুশ করছিলাম। কিন্তু কর্নেলের হাবভাব আঁচ করেছি, পুলিশকে তিনি হাতের তাস দেখাতে চান না। অবশ্য বরাবর তার এই স্বভাব।

 

সুখরঞ্জনবাবু বললেন, কর্নেল! আপনার এই থিয়োরিটা কিন্তু মানতে পারছি না। যে তিরিশ ফুট লং জাম্প দিতে পারে, সে অলিম্পিকের মেডেল জেতা খেলোয়াড়। আপনি কি বলতে চাইছেন খুনি কোনও খেলোয়াড়?

 

কর্নেল বাইনোকুলারে দূরে বিচের মাথায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষজন দেখছিলেন। বাইনোকুলার নামিয়ে বললেন, চলুন ফেরা যাক। তারপরে হাঁটতে-হাঁটতে ফের বললেন, খেলোয়াড় বইকি। মি. দাস, আমরা এক সাংঘাতিক খেলোয়াড়ের প্রতিদ্বন্দ্বী।

 

সুখরঞ্জনবাবু গম্ভীর হয়ে গেলেন। একটু পরে ঘড়ি দেখে বললেন, আমাকে এখনই এক জায়গায় যেতে হবে। পরে যোগাযোগ করব’খন।

 

উনি চলে যাওয়ার পর আমরা বিচ ধরে হাঁটছিলাম। ডাইনে সমুদ্রে এখানে-ওখানে কালো-কালো ছোটোবড়ো পাথর দেখা যাচ্ছে। ঢেউয়ে নাকানি-চোবানি খাচ্ছে। মুহুর্মুহু ব্রেকারের গর্জনে কানে তালা ধরে যাচ্ছে। চাপ চাপ ফেনা ছড়িয়ে পড়ছে। বিচের মাথার পাথরে তৈরি ঘরবাড়ির ধ্বংসস্তূপ। প্রকাণ্ড সব পাথরের চাঙড় বিচে এসে পড়েছে। একটা ভাঙা ঘরে জানালায় কাউকে উঁকি মারতে দেখলাম। গোলগাল মুখ। মুখে কেমন একটা হাসি। হঠাৎ মুখটা চেনা মনে হল। তখনই মনে পড়ে গেল, রাজেনবাবু বাড়ির দোতলার জানালায় এই মুখটাই দেখছিলাম। দ্রুত বললাম, কর্নেল! কর্নেল! ওই দেখুন সেই বসন্তবাবু। রাজেনবাবুর দাদা।

 

কর্নেল বললেন, দেখেছি। ওঁর সঙ্গে আলাপ করতে চাও কি?

 

ওঁর কাছে জানা দরকার, উনি এখানে কেন এসেছেন।

 

চলে যাও তা হলে।

 

আপনিও চলুন!

 

কর্নেল হাসলেন। ডার্লিং! আমি পাগলকে বড্ড ভয় করি, সে তো তুমি জানো! তুমি ইচ্ছে করলে ওঁর সঙ্গে আলাপ করতে পারো। যাও, চলে যাও!

 

তীব্র কৌতূহলের চাপে পড়েই পাথরের চাঙড় বেয়ে উঠতে শুরু করলাম। ওপরে উঠে সেই ভাঙা পাথুরে ঘরটার দিকে হন্তদন্ত এগিয়ে গেলাম। কিন্তু জানলায় দেখা সেই মুখটা নেই।

 

ভেতরে উঁকি মেরে কাউকে দেখতে পেলাম না। ঘরগুলো বিপজ্জনক অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। একটা ফাঁকা জায়গা দিয়ে এগিয়ে চারদিকে তন্নতন্ন খুঁজে আর বসন্তবাবুর পাত্তা পেলাম না। সবখানে বালির স্তূপ। পোড়া পোড় ঘরগুলোর মেঝেও বালিতে ভর্তি। দেওয়ালের ফাঁক দিয়ে ওধারে পিচ-রাস্তা দেখা যাচ্ছিল। রাস্তায় গিয়ে একপলকের জন্য দেখলাম, বসন্তবাবু ওপাশের একটা পোড়ো জমির পাশে ঝোপঝাড়ের মধ্যে ঢুকে গেলেন। পাগলের পেছনে দৌড়োনোর মানে হয় না।

 

বিচে ফিরে গিয়ে কর্নেলকেও দেখতে পেলাম না। অদ্ভুত মানুষ তো!

 

খানিকটা হেঁটে জেলেদের ভেলানৌকোর কাছে পৌঁছোলাম। উঠে গিয়ে ওশান হাউস চোখে পড়ল। সেখানে গিয়ে দেখি নীচের বারান্দায় বসে স্মিথসায়েব হোমিয়োপ্যাথির ওষুধ বিলোচ্ছেন। একতঙ্গল গরিবগুরবো চেহারার রুগি দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখে স্মিথ-সায়েব সম্ভাষণ করলেন, গুড মর্নিং?

 

মর্নিং মি. স্মিথ! কর্নেলসায়েব কি ফিরেছেন?

 

ফিরলে দেখতে পেতাম।

 

মি. হালদার?

 

স্মিথ উদ্বিগ্নমুখে বললেন, না। আমি চিন্তিত মি. চৌধুরী। পুলিশকে খবর দিয়েছি।

 

আমার ঘরের চাবি কর্নেলের কাছে। ডুপ্লিকেট চাবি নিশ্চয় স্মিথসায়েবের কাছে আছে। কিন্তু ঘরে বসে থাকার মানে হয় না। আবার বিচে ফিরে গেলাম। সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে চমৎকার সময় কাটানো যায়। এদিকটা একেবারে খাঁ খাঁ জনহীন। জেলেবস্তির ছোট্ট ছেলেমেয়ের দঙ্গল খানিকটা দূরে সমুদ্রে নেমেছ। ওটাই ওদের খেলা। কেউ কেউ জলের ভেতর উঁচিয়ে থাকা পাথরেও উঠেছে। ওদের ভয় করছে না?

 

নিশ্চয় করছে না। সমুদ্র ওদের আপনজন। সমুদ্র ওদের লড়াই করে বেঁচে থাকতে শেখায়। ওরা যেন সমুদ্রের পাঠশালার পড়ুয়া।

 

কতক্ষণ পরে আনমনে ডানদিকে মুঘল আমলের ভাঙা কুঠিবাড়িগুলোর দিকে তাকাতেই চোখে পড়ল একটা মাথা উঁকি মেরে এগোচ্ছে। স্তূপের আড়াল দিয়ে কেউ গুঁড়ি মেরে কোথাও চলেছে। একটু পরে আর তাকে দেখা গেল না। মরিয়া হয়ে উঠে দাঁড়ালাম। বসন্তবাবু নন তো?

 

বালি ও ধ্বংসস্তূপ এবং ভাঙা ঘরের ফোকর গলিয়ে সাবধানে গুঁড়ি মেরে এগোচ্ছিলাম। হঠাৎ একটা ঘরের বালিতে পড়ে থাকা একটা কাগজের চিরকুট দেখতে পেলাম। চিরকুটটা পড়ে নেই আসলে। একটুকরো পাথর চাপা দেওয়া আছে এক কোনায়।

 

চিরকুটটা তুলে দেখি, আঁকাবাঁকা ইংরেজি হরফে যা লেখা আছে, তার মানে দাঁড়ায় :

 

আজ রাত দশটায় এখানে আসুন। দেখা হবে।

 

হালদারমশাইয়ের ভাষায় প্রচুর রহস্য। ঝটপট ভেবে নিয়ে চিঠিটা সেই অবস্থায় রেখে দিলাম। তারপর তেমনই গুঁড়ি মেরে এগিয়ে খানিকটা তফাতে একটা ভাঙা দেওয়ালের আড়ালে বসে রইলাম। এখান থেকে ওই ঘর এবং নীচের বিচ মোটামুটি চোখে পড়ে।

 

এমন ভঙ্গিতে বসেছিলাম, কেউ দেখলে ভাববে, নিছক সমুদ্রদর্শন করছি। প্রায় ঘণ্টাখানেক পরে বিচের দিক থেকে একটা লোককে উঠে আসতে দেখলাম। প্রথমে তাকে সায়েব ভেবেছিলাম। পরে দেখি খাঁটি সায়েব নয়। তবে কতকটা সায়েব-সায়েব গড়ন। লম্বা নাকটা দেখার মতো। পরনে জিনস-জ্যাকেট। মাথায় রোদ-বাঁচানো টুপি। বয়স আন্দাজ ত্রিশ-বত্রিশ মনে হল।

 

লোকটা সেই ঘরের কাছে এসে চাপা গলায় কাকে ডাকল, হ্যালো।

 

বারকতক ডাকার পর এদিক-ওদিক তাকিয়ে সে ঘরের ভেতর উঁকি দিল। তারপর ফোকর দিয়ে ঢুকে পড়ল।

 

আমি আর চুপ করে বসে থাকতে পারলাম না। হন্তদন্ত ছুটে গিয়ে সেই ঘরের ফোকরের সামনে দাঁড়ালাম। লোকটা চমকে উঠেছিল। সামলে নিয়ে ইংরেজিতে বলল, এই পাথরের বাড়িগুলো ভারি অদ্ভুত। কে তৈরি করেছিল জানেন কি?

 

চার্জ করার ভঙ্গিতে বললাম, কে আপনি?

 

ট্যুরিস্ট, আশা করি আপনিও ট্যুরিস্ট?

 

তার কথায় কান না করে বললাম, ওখানে একটা চিঠি ছিল, চিঠিটা নিতেই কি আপনি এসেছেন?

 

চিঠি! কী বলছেন আপনি?

 

ঠিক বলছি। চিঠিটা আমি দেখেছি। আপনি সেটা নিয়েছেন। এবার বলুন কে আপনি?

 

পেছন থেকে কর্নেলের কথা ভেসে এল। সাবধান ডার্লিং! সেই দানোর কথা ভুলো যেয়ো না।

 

শোনামাত্র ভ্যাবাচাকা খেয়ে একলাফে লোকটার কান ধরতে গেলাম। লোকটাও একলাফে সরে গেল। কর্নেল এসে অট্টহাসি হেসে বললেন, সেমসাইড হয়ে যাচ্ছে জয়ন্ত! আলাপ করিয়ে দিই, ইনি ম্যাডানসায়েবের জামাই মি. কুসরো। আর মি. কুসরো! আমার স্নেহভাজন বন্ধু সাংবাদিক জয়ন্ত চৌধুরী মাঝে-মাঝে অতুৎসাহী হয়ে পড়ে। আসলে এটা ওর ভয় পাওয়ারই প্রতিক্রিয়া!

 

কুসরো হেসে ফেললেন। সত্যি বলতে কি, আমি ভয় পেয়েছিলাম। যাই হোক, সেই ভদ্রলোক আমার জন্য একটি চিঠি রেখে গেছেন। এই দেখুন।

 

কর্নেল চিঠিটা নিয়ে চোখ বুলিয়ে বললেন, এটা আমার কাছে থাক। রাত নটা নাগাদ ওশান হাউসে আমার সঙ্গে দেখা করবেন। তারপর সব ব্যবস্থা হবে। আপনি বরং নীচের দিকে না গিয়ে সদর রাস্তা ধরে বাংলোয় যান। সাবধানে যাবেন।

 

কুসরো তখনই ধ্বংসস্তূপের ভেতর দিয়ে চলে গেলেন। বললাম, শ্বশুর চিঠির ফাঁদে পড়ে প্রাণ হারিয়েছেন। এবার জামাইকেও চিঠির ফাঁদে ফেলা হচ্ছে। ব্যাপারটা এই তো?

 

কর্নেল সে কথার জবাব না দিয়ে বললেন, তখন বসন্তবাবুকে কোথায় হারিয়ে ফেললে?

 

রাস্তার ওধারে। তো মি. কুসরো কি শ্বশুরের ডেডবডি নিতে এসেছেন?

 

হ্যাঁ। ওঁর বাবার বন্ধু এক প্রাক্তন মন্ত্রীমশাই। তার সাহায্যে আর্মির হেলিকপ্টারে ম্যাডানসায়েবের বডি সকালেই কলকাতা পাঠনো হয়েছে। কুসরো যাননি। মানে, কলকাতায় উনি যখন আমাকে ফোন করেন, তখন আমি ওঁকে একটা দিন থেকে যেতে বলেছিলাম। তবে জানতাম না, কুসরো মন্ত্রীমশাইয়ের বাংলোয় উঠেছেন। উঠে অবশ্য ভালোই করেছেন। কারণ আমাদের প্রিয় বিজ্ঞানী চন্দ্রকান্ত চৌধুরীর সান্নিধ্যে থাকলে উনি নিরাপদ।

 

অবাক হয়ে বললাম, ওই বাংলোতে চন্দ্রকান্তবাবুও উঠেছেন নাকি?

 

হ্যাঁ। চলো, চন্দ্রকান্তবাবুকে ওশান হাউসে বসিয়ে রেখে এসেছি।

 

বুঝলাম, আমি যখন বসন্তবাবুর পেছনে ছুটছিলাম, তখন কর্নেল আমাকে ফেলে সেই বাংলোয় চলে গিয়েছিলেন। তাই ওঁকে আর দেখতে পাইনি। কিন্তু হঠাৎ ওভাবে চলে না গিয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করতে পারতেন। কেন করেন নি? এমনকী ঘটেছিল যে, প্রাক্তন মন্ত্রীমশাইয়ের বাংলোর দিকে ছুটে গিয়েছিলেন?

 

যেতে-যেতে কথাটা তুললাম। কর্নেল বললেন, বাইনোকুলারে দেখেছিলাম, বিজ্ঞানী ভদ্রলোক ওঁর ডিটেক্টর যন্ত্র নিয়ে ব্যাকওয়াটারের ওদিকে ঘুরঘুর করছেন। কাজেই ওঁর কাছে না গিয়ে পারলাম না। হ্যাঁ, গত রাতে দানোটা বাংলোয় ঢুকতে পারেনি। বিজ্ঞানীর কারবার! মারাত্মক কী অদৃশ্য রশ্মি দিয়ে নাকি বাংলোটা ঘিরে রেখেছিলেন।

 

কিন্তু হালদারমশাইয়ের কী হল?

 

কর্নেল গম্ভীর মুখে বললেন, জানি না।

 

ওশান হাউসের দোতলায় আমাদের স্যুটে ঢুকে দেখি, বিজ্ঞানীপ্রবর ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে ঘুমোচ্ছেন। কারণ ওঁর নাক ডাকছে। আমি যেই চন্দ্রকান্তবাবু বলে ডেকেছি, আমনিই তড়াক করে সোজা হলেন এবং বললেন, হিরে আছে! শিয়োর!

 

হাসতে-হাসতে বললাম, স্বপ্ন দেখছিলেন বুঝি?

 

চন্দ্রকান্ত চোখ কচলে বললেন, সরি! সারারাত ঘুমোইনি। ঘুমোনো দরকার। বলে আমার দিকে তাকালেন। হ্যালো জয়ন্তবাবু! আসুন, আসুন। আপনার কথা ভাবতে-ভাবতেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম

 

কেন বলুন তো?

 

হিরেটা উদ্ধার হয়ে গেলে আপনাকে একটা রোমহর্ষক স্টোরি দেব। দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকায় বেরোলে হইচই পড়ে যাবে। আমার মাথা তো গুলিয়ে গেছে মশাই। ভাবা যায়? হিরেতে এক ধরনের রশ্মি আছে, যা প্রাণীর দেহকোষের পরিবর্তন ঘটাতে পারে। হিরে ঠিক যেভাবে কাচ কাটতে পারে, সেইভাবে হিরের সেই বিস্ময়কর রশ্মিপ্রবাহ ডি এন এ অণুতে কেটেকুটে– চন্দ্রকান্ত হঠাৎ কথা থামিয়ে ফিক করে হাসলেন।

 

কর্নেল আতশকাচ দিয়ে চিঠিটা দেখতে ব্যস্ত। আমাদের কথা দিকে ওঁর কান নেই।

 

বললাম, চন্দ্রকান্তবাবু! আপনি বললেন, হিরে আছে। কোথায় আছে?

 

চন্দ্রকান্ত গম্ভীর হয়ে বললেন, এখানেই।

 

এখানেই মানে? গোপালপুর-অন-সি-তে?

 

শিয়োর। ওই ব্যাকওয়াটারের কাছাকাছি কোথাও লুকোনো আছে। ডিটেক্টরে সাড়া পেয়েছি কিন্তু ঠিক জায়গাটা খুঁজে বের করতে পারছি না, এটাই সমস্যা।

 

আমি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলাম। একটু পরে বললাম, হিরেটা এখানে এল কী করে? আনল কে? কেনই বা আনল?

 

চন্দ্রকান্ত চিবুকের দাড়ি খুঁটতে-খুঁটতে বললেন, তা জানি না মশাই! কর্নেল ওসব রহস্য জানেন বলেই আমার ধারণা।

 

কর্নেল চিঠিটা পকেটস্থ করে বললেন, চন্দ্রকান্তবাবু! মি. কুসরো বাংলোয় ফিরে গেছেন। লাঞ্চের সময় হয়ে এল। উনি আপনার জন্য অপেক্ষা করবেন।

 

বিজ্ঞানী তখনই উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, হ্যাঁ চলি! আমার একটা লম্বা ঘুমও দরকার।

 

উনি চলে গেলে বললাম, প্রাক্তন মন্ত্রী ভদ্রলোক কি চন্দ্রকান্তবাবুর পরিচিত?

 

পরিচিত না হলে চন্দ্রকান্তবাবু ওখানে উঠবেন কেন? বাংলোটা বেশ বড়ো। অনেক ঘর। কাজেই প্রাক্তন মন্ত্রীমশাইয়ের পক্ষে তার একাধিক প্রিয়জনকে ঠাঁই দেওয়ার অসুবিধে নেই। কেয়ারটেকার গোমস তার প্রিয়জনদের সেবার জন্য বহাল রয়েছে। বলে কর্নেল উঠলেন। তুমি কি স্নান করবে? আমি বলি, বরং সমুদ্রে স্নান করে এসো। স্বাস্থ্যের পক্ষে ভালো।

 

আঁতকে উঠে বললাম, মাথাখারাপ? এখানকার সমুদ্র মানুষখেকো। সবসময় হাউমাউখাঁউ করে চ্যাঁচাচ্ছে। জলের ভেতর পাথরগুলো যেন সমুদ্রের দাঁত। বুঝলেন তো? পেলেই পাথরের দাঁতে চিবিয়ে গিলে ফেলবে।

 

তা হলে সুইচ টিপে মারিয়াম্মাকে ডাকো। গরম জল করে দেবে। আমি তো সপ্তাহে একদিন স্নান করি। আজ আমার স্নানের দিন নয়।

 

দুপুরের খাওয়ার পর একটু ঘুমিয়ে নেওয়া আমার অভ্যাস। পুরোনো বাংলায় একে বলে ভাতঘুম। কিন্তু কর্নেল বাদ সাধলেন। বললেন, এখনই মিলিটারির জিপ আসবে। তৈরি থাকো।

 

মনে পড়ে গেল, এখানে সেনাবাহিনীর একটা ঘাঁটি আছে। ঢেঁকি নাকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে। সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল নীলাদ্রি সরকার এখানে এসেছেন একটা রহস্যের সমাধনে। কিন্তু এসেই কখন সেনাবাহিনীর কোনও স্নেহভাজন কর্তাব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করে ফেলেছেন দেখা যাচ্ছে।

 

কিছুক্ষণ পরে মিলিটারি জিপে আমরা যেখানে পৌঁছোলাম, সেটা উঁচুতলার অফিসারদের কোয়ার্টার এলাকা। বাংলোবাড়ি এবং সুদৃশ্য লন, ফুলবাগিচা। একটা বাংলোর লনে ঘাসের ওপর চেয়ারটেবিল পেতে একজন শিক সামরিক অফিসার পাইপ টানছিলেন। কর্নেলকে দেখে এগিয়ে এসে সম্ভাষণ করলেন। কর্নেল পরিচয় করিয়ে দিলেন। ইনিও এক কর্নেল। কর্নেল পরমজিৎ সিং।

 

পরমজিৎ বললেন, পুরোনো ক্যানটিং-রেকর্ডে আপনার দেওয়া নামটা পাওয়া গেছে। হ্যাঁ, ভদ্রলোক সোলজার্স ক্যানটিনে ফুড সাপ্লায়ার ছিলেন।

 

কর্নেল বললেন, ওশান হাউসের মি. মিথের কাছে কথায়-কথায় জানতে পারি, এই নামের ভদ্রলোক একসময় এখানে ছিলেন। ফুড কনট্রাক্টরি করতেন। ধন্যবাদ কর্নেল সিং। অসংখ্য ধন্যবাদ!

 

বেয়ারা কফি রেখে গেল। কফি খেতে-খেতে পরমজিৎ একটু হেসে বললেন, কিন্তু এবার যে রহস্যটা জানতে ইচ্ছা করছে কর্নেল সরকার? বুঝতে পেরেছি আপনার এবারকার গোপালপুর–অন-সি-তে আসার উদ্দেশ্য সেই বিরল প্রজাতির জগন্নাথ প্রজাপতি ধরা নয়, আমাদের একজন প্রাক্তন ফুড সাপ্লায়ারকে ধরা। কিন্তু রেকর্ডে ওঁর বিরুদ্ধে তো কিছুই নেই। অসুস্থতার জন্য কারবার গুটিয়ে কলকাতা ফিরে যান। উনি কি সেই জুয়েলার ম্যাডানসায়েবের মার্ডার কেসে জড়িয়ে পড়েছেন?

 

কর্নেল জোরে মাথা নাড়লেন।না, না! উনি অত্যন্ত সদাশয় পরোপকারী মানুষ।

 

তা হলে ব্যাপারটা একটু খুলে বলুন, শুনি।

 

যথাসময়ে জানাব।

 

এরপর দু জনে সামরিক বিষয়ে কথা বলতে শুরু করলেন। আলাপ এবং কফি খাওয়া শেষ হলে কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, চলি কর্নেল সিং! পরে দেখা হবে। একটু তাড়া আছে।

 

কর্নেলের নির্দেশে এবার মিলিটারি জিপ আমাদের লাইট হাউসের কাছাকাছি পৌঁছে দিয়ে চলে গেল। আমরা বস্তি এলাকার ভেতর দিয়ে একটা নীচু জায়গায় নেমে গেলাম। বললাম, কোথায় যাচ্ছি?

 

কর্নেল বাইনোকুলারে চোখ রেখে বালির টিলাগুলো দেখে নিয়ে বললেন, চলো তো!

 

যেতে-যেতে বললাম, সেই ফুট সাপ্লায়ার ভদ্রলোক কে?

 

বসন্ত অধিকারী।

 

চমকে উঠে বললাম, অ্যাঁ?

 

হ্যাঁ। কর্নেল হাসলেন। বসন্তবাবুকে ঠিক বদ্ধ পাগল বলা চলে না। তবে মাথায় একটু গন্ডগোল ঘটেছে, সেটা ঠিকই। এই গোপালপুর-অন-সির প্রত্যেকটি ইঞ্চি ওঁর নখদর্পণে। ডার্লিং! কাল রাত্তিরে উনিই ভূত হয়ে আমাদের ঢিল ছুঁড়ছিলেন। আমুদে চরিত্রের মানুষ। মজা করার সুযোগ পেলে ছাড়তে চান না।

 

বালির টিলার কাছে পৌঁছে বললাম, কিন্তু আমরা যাচ্ছিটা কোন চুলোয়?

 

ধৈর্য ধরো জয়ন্ত! বলে কর্নেল টিলায় উঠতে থাকলেন। ক্রমশ সমুদ্রের গর্জন স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। কিছুক্ষণ পরে সমুদ্র চোখে পড়ল। চুড়োয় ওঠার পর বাইনোকুলারের বাঁ দিকে কিছু দেখে কর্নেল বললেন, ওই যে দেখছ একটা হোটেল। তুমি এখানে বসে লক্ষ রাখো। যদি দ্যাখো, শেরোয়ানিচুস্ত-টুপিপরা কোনও মুসলিম ভদ্রলোক এবং তার সঙ্গী বিচে নামছেন, তুমি গিয়ে ওঁদের সঙ্গে ভাব জমাবে। যেভাবে হোক, কথায়-কথায় ওঁদের আটকে রাখবে। আমি সেই সুযোগে হোটেলে ঢুকে স্যুটে হানা দেব।

 

কর্নেল হনহন করে সোজা এগিয়ে গেলেন। তারপর অদৃশ্য হলেন। হতবুদ্ধি হয়ে বসে রইলাম। শীতের বেলা পড়ে আসছিল। বসে আছি তো আছি। কতক্ষণ পরে দেখি, সেই মুসলিম ভদ্রলোক এবং তার সঙ্গী কখন আমার ঠিক নীচে বিচের ওপর চলে এসেছেন। দু জনে বিচ ধরে দক্ষিণে এগোচ্ছেন। তবে হাঁটার গতি বেশ দ্রুত।

 

গতরাতে থানায় ওঁদের কথা শুনেছি। নাম দুটি মনে পড়ল। মইনুদ্দিন আমেদ এবং পিটার ন্যাজারেথ। দু জনেই নাকি চামড়া ব্যবসায়ী। কিন্তু কর্নেলের দৃষ্টি ওঁদের ওপর পড়ল কেন?

 

একটু ইতস্তত করে বিচে নেমে গেলাম। ওঁরা ততক্ষণে অনেকটা এগিয়ে গেছেন। ওদিকটা একেবারে নির্জন খাঁ খাঁ। বাঁ দিকে সমুদ্র সামনে গজরাচ্ছে। হন্তদন্ত এগিয়ে হালো বলে সম্ভাষণ করলাম। কিন্তু সমুদ্রের গর্জনে কথাটা হারিয়ে গেল। দুটো বালির টিলার মধ্যিখানে খাড়ির মতো একটা সঙ্কীর্ণ জায়গা দেখা যাচ্ছিল। সমুদ্রের জল সেখানে গিয়ে আছড়ে পড়ছে। জলটা পিছিয়ে সমুদ্রে সরে গেলে ওঁরা দুজনে খাড়িটা পেরিয়ে ডাইনে অদৃশ্য হলেন। ব্যাপারটা সন্দেহজনক।

 

আবার সমুদ্রের জল এসে খাড়িতে ঢুকল। তারপর জলটা পিছিয়ে যেতেই খাড়ি পেরিয়ে গেলাম। ডাইনে ঘুরে দেখি, বালিয়াড়িতে একটা পাথরের ঘর অর্ধেকটা ডুবে আছে। ফাটলধরা পোড়ো ঘর। ছাদ ধসে পড়েছে। এ-ও নিশ্চয় মুঘল আমলের কোনও বাড়ি। মইনুদ্দিন এবং ন্যাজারেথ সেখানে ঢুকে গেলেন।

 

সাবধানে এগিয়ে সেই ঘরের কাছে গেলাম। গুঁড়ি মেরে বসলাম। হঠাৎ একটা আর্তনাদ ভেসে এল। তারপর কেউ চিৎকার করে উঠল খ্যানখেনে গলায়, শাট আপ।

 

গুঁড়ি মেরে পাথরের চাঙড়ের আড়ালে গিয়ে উঁকি দিলাম। যা দেখলাম তা সাংঘাতিক ব্যাপার। দিনশেষের আবছা আলোয় ঘরের মেঝেতে বালিতে কোমর পর্যন্ত পুঁতে রাখা হয়েছে একটা লোককে। তার হাত দুটো পিঠের দিকে বাঁধা। এবং লোকটা আর কেউ নয়, আমাদের হালদারমশাই!

 

ন্যাজারেথ তার পিঠের কাছে দাঁড়িয়ে চুল খামচে ধরে আছে। মইনুদ্দিন সামনে দাঁড়িয়ে আঙুল তুলে শাসাচ্ছে, স্পিক দ্য ট্রুথ!

 

আর সহ্য করতে পারলাম না। একলাফে ঘরের ভেতর ঢুকে পড়লাম। তারপর ঝাঁপ দিলাম মইনুদ্দিনের ওপর। তার টুপি খসে পড়ল। সে হুংকার দিয়ে কিছু বলল। ন্যাজারেথ অমনই বালিতে গর্ত খুঁড়তে শুরু করল। ততক্ষণে মইনুদ্দিনের সঙ্গে আমার ধস্তাধস্তি বেধে গেছে। তার দাড়ি খামচে ধরেছিলাম। উপড়ে এল। তখনই চিনতে পারলাম তাকে। কী আশ্চর্য, এ তো সেই রাজেন অধিকারী।

 

চেনামাত্র তাকে ছেড়ে ন্যাজারেথের কান ধরতে লাফ দিলাম। ন্যাজারেথ যে সেই দানো অর্থাৎ কৃত্রিম মানুষ, এ-ও মুহূর্তে বুঝে গেছি। কিন্তু তার কান মলে দেওয়ার সুযোগ পেলাম না। সে আমাকে ঠেলে বালির ওপর ফেলে দিল। রাজেন অধিকারীও আমার বুকের ওপর এসে বসল। মুখে নিষ্ঠুর হাসি।

 

আমি তার দিকে হাত ওঠানোর সুযোগ পেলাম না। আমার দুই বাহুতে সে দুই পা চাপিয়ে দিল। তারপর পকেট থেকে কী একটা খুদে কালোবোতামের মতো জিনিস আমার কপালে সেঁটে দিল। মনে হল, অতল শূন্যে তলিয়ে যাচ্ছি।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *