ইয়াজদার্গিদের হিরে (কিশোর কর্নেল) – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ
চার
বাসে চেপে পুরী। পুরী থেকে ফের বাসে চিল্কা রেলস্টেশন। তারপর ট্রেনে গঞ্জাম জেলার বহরমপুর স্টেশন। সেখান থেকে প্রাইভেট কার ভাড়া করে গোপালপুর-অন-সি-তে যখন পৌঁছোলাম, তখন রাত প্রায় দশটা। সমুদ্রের ব্যাকওয়াটারের দিকে স্মিথসায়েবের ওয়াশ হাউস। স্মিথসায়েব আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। অত্যন্ত অমায়িক বৃদ্ধ ভদ্রলোক। একসময় কলকাতার বন্দর অফিসে চাকরি করতেন। কর্নেলের পুরোনো বন্ধু।
বাড়ির নীচের তলায় উনি থাকেন। ওপরতলায় দুটো স্যুট। একটাতে হালদারমশায় আছেন।
আছেন, মানে ভাড়া নিয়েছেন। কিন্তু এ মুহূর্তে নেই। দরজায় তালা আঁটা। স্মিথসায়েব তার গেস্টদের ব্যাপারে নাক গলান না। তবে স্মিথসায়েবের মতে, এই গেস্ট ভদ্রলোক ছিটগ্রস্ত। কারণ আজই বিকেলে তাঁক বিচের মাথায় মুঘল আমলের ভাঙাচোরা পাথুরে বাড়িগুলির ভেতর সন্দেহজনকভাবে ঘোরাঘুরি করতে দেখেছেন। সন্ধের দিকে একবার তাকে বিচে জগিং করতেও দেখেছেন। স্মিথসায়েব ওঁর প্রতি বেজায় অখুশি।
স্মিথসায়েব গেস্টদের জন্য খাওয়ার ব্যবস্থা করেন। ওঁর পরিচারিকা মারিয়াম্মা আমাদের খাবার দিয়ে গেল। দেখলাম কর্নেল তার সুপরিচিত।
কর্নেল তাকে ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করলেন, পাশের ভদ্রলোক কি খেয়ে বেরিয়েছেন?
মারিয়াম্মা বলল, উনি বাইরে খান। কখন আসেন কখন যান, জানি না।
সে এঁটো থালাবাটি গুছিয়ে চলে যাচ্ছে, কর্নেল ডাকলেন, একটা কথা, মারিয়াম্মা!
বলুন স্যার!
আসার পথে শুনলাম নীচে নাকি কে খুন হয়ে পড়ে ছিল আজ?
মারিয়াম্মা বুকে ক্রস এঁকে ভয় পাওয়া গলায় বলল, সে এক বীভৎস দৃশ্য স্যার! শয়তান ছাড়া এ কাজ কার হতে পারে? মাথাটা মুচড়ে পিঠের দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছে। সে এদিক-ওদিক দেখে নিয়ে গলার স্বর চাপা করল। জেলেবস্তিতে শুনেছি, গতকাল সন্ধ্যায় ওরা একটা অদ্ভুত পাখিকে সমুদ্রের দিক থেকে উড়ে আসতে দেখেছে। পাখিটার ডানা নাকি বিশাল। দক্ষিণে লাইটহাউসের ওধারে উঁচু বালির টিলা আছে। সেদিকেই পাখিটা এসে নেমেছিল। শয়তান ছাড়া আর কিছু নয়।
মারিয়াম্মা চলে গেলে বললাম, মারিয়াম্মার গল্পটা বিশ্বাস করলেন?
কর্নেল দাড়ি নেড়ে চুরুটের ধোঁয়ার ভিতর বললেন, হ্যাঁ!
আমি পাখিটার কথা বলছি!
আমিও তা-ই বলছি।
গুল! বলে কর্নেলের দিকে তাকিয়ে রইলাম। কর্নেল এসবে বিশ্বাস করেন ভাবা যায় না।
কর্নেল চোখ বুজে চুরুট টানতে টানতে বললেন, হালদারমশাই পাখিটার পাল্লায় পড়লেন কিনা ভাবছি। এখনও ফিরলেন না। যাইহোক, একটু জিরিয়ে নিয়ে বেরোব।
এত রাতে কোথায় বেরোবেন?
কর্নেল হাসলেন! গোপালপুর অন-সি-তে শীতের তত উপদ্রব নেই। সমুদ্রতীরের আবহাওয়া সবসময় নাতিশীতোষ্ণ।
বাইরে খোলা বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। এই দোতলা থেকে সামনে বালিয়াড়ির নীচে সমুদ্র দেখা যায়। কুয়াশার আড়ালে সমুদ্র ঢাকা পড়েছে। ছেঁড়া ঘুড়ির মতো চাঁদটাকে অসহায় দেখাচ্ছে। মুঘল আমলের ভাঙচুর বাড়িগুলো কুয়াশামাখানো আবছা জ্যোৎস্নায় বড় বেশি ভূতুড়ে। বিচে ক্রমাগত ঢেউয়ের পর ঢেউ আছড়ে পড়ার গর্জনে কানে তালা ধরে যাচ্ছে। বাতাসে শীতের তীক্ষ্ণতা নেই। কিন্তু বিরক্তিকর।
বাঁদিকে বালিয়াড়িতে কালো লম্বাটে জিনিসগুলো দেখেই বুঝলাম জেলেদের ভেলানৌকো। সেখানে আবছা একটা মূর্তি দেখতে পেলাম। এত রাতে সামুদ্রিক শীতের হাওয়া খেতে কে বেরোল কে জানে!
একটু পরে মূর্তিটা সটান এসে এই বাড়ির নীচের রাস্তায় দাঁড়াল। চেঁচিয়ে বললাম, হালদারমশাই নাকি?
তখনই ছায়ামূর্তিটা বাঁ দিকের রাস্তায় চলে গেল। তারপর একেবারে নিপাত্তা। ব্যাপারটা সন্দেহজনক। ঘরে ঢুকে দেখি, কর্নেল উঠে দাঁড়িয়েছেন। আমি কিছু বলার আগেই বললেন, চলো বেরোনো যাক।
দরজায় তালা এঁটে আমরা নেমে এলাম। রাস্তায় পৌঁছে সন্দেহজনক লোকটার কথা বললাম। কর্নেল কোনও মন্তব্য করলেন না। খুব ভয়ে ভয়ে হাঁটছিলাম। কখন কোথায় দানোটা এসে ঝাঁপিয়ে পড়বে, বলা যায় না। রাস্তা খাঁ খাঁ, জনহীন। ল্যাম্পপোস্টগুলো দূরে-দূরে। তাই কোথাও কোথাও জ্যোৎস্না-কুয়াশা-আঁধার মিলেমিশে আছে।
প্রায় মিনিট কুড়ি হাঁটার পর বললাম, আমরা যাচ্ছিটা কোথায়?
কর্নেল সামনে আঙুল তুলে বললেন, ওই যে আলো জুগজুগ করেছ, ওখানে।
যেখানে পৌঁছেছি, সেখানটা কাঁচা রাস্তা। বালিতে ভর্তি। দু-ধারে ঝোপঝাড়। কিছু উঁচু গাছ কালো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কর্নেলের হাতে টর্চ আছে। কখনও পায়ের সামনে আলো ফেলছে। হঠাৎ একটা ছোট্ট ঢিল এসে আমার গায়ে লাগল। ভীষণ চমকে উঠে বললাম, কর্নেল! কে ঢিল ছুঁড়ছে।
কর্নেল বললেন, ভূত! চলে এসো।
কী আশ্চর্য! সত্যি ঢিল ছুঁড়ল যে!
কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে আবার পর-পর কয়েকটা ছোট্ট ঢিল এসে পড়ল। কর্নেল টর্চের আলো ফেলামাত্র ঢিল ছোঁড়া বন্ধ হল। কেউ কোথাও নেই। অথচ কে ঢিল ছুঁড়ছে রাতদুপুরে? কর্নেল চারদিকে খুঁটিয়ে দেখে নিয়ে চাপা স্বরে বললেন, দৌড়োতে হবে। কুইক!
কর্নেল সত্যি দৌড়োতে শুরু করলেন। আমিও ভ্যাবাচাকা খেয়েও ওঁকে অনুসরণ করলাম। এই সময় পেছনে কোথাও খিখিখিখি… হিহিহিহি… হোহোহোহো…এই ধরনের বিকট হাসি শোনা গেল।
কিছুদূর দৌড়ে গিয়ে কর্নেল দাঁড়িয়ে গেলেন। বললাম, কী অদ্ভুত–
ভূত! কর্নেল হাঁসফাঁস করে বললেন, রোসো! মিনিট দু-তিন জিরিয়ে নিই। বাপস! বালিতে দৌড়োনো সহজ নয়।
কিছুক্ষণ পরে সেই আলোর কাছে পৌঁছে দেখি, গাছপালার আড়ালে একটা বাড়ি এবং গেটে সঙিনধারী পুলিশ। বুঝলাম থানায় এসেছি।
দুজন অফিসার একটা ঘরে বসেছিলেন। কর্নেলকে দেখেই এক গলায় সম্ভাষণ করলেন, হাই ওল্ড বস!
আলাপ-পরিচয় হওয়ার পর জানলাম একজন সি আই ডি ইনস্পেকটার সুখরঞ্জন দাস, অন্যজন অফিসার-ইন-চার্জ জগপতি রাউত। দুজনেই চমৎকার বাংলা বলেন। সুরঞ্জনবাবু বললেন, দেরি দেখে ভাবছিলাম ওশান হউসে গিয়ে খোঁজ নিই! কোনও অসুবিধে হয়নি তো?
কর্নেল বললেন, নাহ, চমৎকার এসেছি।
জগপতিবাবু বললেন, আমি বহরমপুর-গঞ্জাম স্টেশনে জিপ পাঠাতে চেয়েছিলাম। মি. দাস নিষেধ করলেন। আপনি নাকি পুলিশের জিপে চাপা পছন্দ করেন না!
জগপতিবাবু হেসে উঠলেন। কর্নেল বললেন, কখনও কখনও করি না। ওতে আমার কাজের অসুবিধে হয়। যাইহোক, মি. দাস, সেই চিঠিটা দেখতে চাই।
সুখরঞ্জনের ইশারায় জগপতিবাবু দেওয়ালে আঁটা আয়রনচেস্ট থেকে একটা ফাইল বের করলেন। ফাইলের ভেতর একটা কাগজে সাঁটা অজস্র কুচি এবং কুচিগুলোতে কিছু লেখা আছে। কর্নেল ঝুঁকে গেলেন। ইতিমধ্যে তাঁর হাতে আতশকাচ বেরিয়ে এসেছে।
সুরঞ্জনবাবু বললেন, কুচিগুলো ওবেরয় গ্র্যান্ড হোটেলের ওদিকে নীচু জমিতে পড়ে ছিল। শিশিরে অধিকাংশ চুপসে গেছে। আর পড়ার উপায় নেই। আমি যেভাবে জোড়াতালি দিয়েছি, তা ভুল হতেই পারে। তবে মোটামুটি এটুকু বোঝা যায়, কেউ ম্যাডানসায়েবকে এখানে আসতে বলেছিল। হাতের লেখা হিজিবিজি। তাছাড়া ইংরেজি বানানও ভুল।
জগপতি বললেন, ঠিক তাই। ভদ্রলোককে মার্ডার করার জন্যই ডেকেছিল। জুয়েল ফেরত দেওয়াটা ছল।
বুঝলাম, এঁরা সম্ভবত কেসটা জানেন। বললাম, কিন্তু ঘাড় মটকে খুন সম্পর্কে আপনাদের ধারণী কী?
জগপতি হাসলেন। ভূতের কীর্তি বলে রটেছে। তাছাড়া আগের রাতে নাকি প্রকাণ্ড একটা পাখি সমুদ্র থেকে উড়ে আসতে দেখেছে জেলেরা। তবে মর্গের রিপোর্টে বলছে, সত্যি কতকটা ঘাড় মটকে– মানে মুন্ডুটা মুচড়ে ঘুরিয়ে খুন করেছে। প্রকাণ্ড জোর আছে খুনির গায়ে।
বললাম, তা হলে–।
এবার বাধা দিলেন কর্নেল! রুষ্টভাবে বললেন, প্লিজ জয়ন্ত! এখন কোনও প্রশ্ন নয়।
চুপ করে গেলাম। একটু পরে কর্নেল ফাইলটা দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। মি. দাস। কাল সকালে, ধরুন আটটা নাগাদ আমি সি-বিচে অপেক্ষা করব। আপনি আমাকে দেখিয়ে দেবেন, কোথায় ম্যাডানসায়েবের বডি পড়ে ছিল।
সুখরঞ্জনবাবু বললেন, অবশ্যই। আর আপনি বলেছিলেন গ্র্যান্ডে গত তিনদিনের আবাসিকদের লিস্ট দিতে। এই নিন। এতে আপনার বলা নামের কেউ নেই। একুশ নম্বর ডাবলস্যুটে দুজন ভারতীয় আছেন। একজন অবাঙালি মুসলিম মইনুদ্দিন আমেদ এবং অন্যজন তার গোয়ানিজ বন্ধু পিটার নাজারেথ। দুজনেই চামড়াব্যবসায়ী। নাজারেথ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। শয্যাশায়ী অবস্থা।
আমেদের মুখে দাড়ি আছে কি?
আছে। ধর্মপ্রাণ মুসলিম। মাথায় টুপি। পরনে শেরোয়ানি-চুস্ত। সুখরঞ্জনবাবু আমাদের বিদায় দিতে এলেন। গেটের কাছে এসে বললেন, আপনার সন্দেহভাজন লোক দুটো এখানকার কোনও হোটেলে ওঠেনি। তন্নতন্ন খোঁজা হয়েছে। তবে কারও বাংলো বা বাড়িতে খুঁজতে সময় লাগবে! আবার এমনও হতে পারে, তারা ম্যাডানসায়েবকে খুন করেই চলে গেছে।
আমাদের হালদারমশাইয়ের খবর নিয়েছেন?
আজ দুপুরে থানায় এসেছিলেন। আপনি আসছেন কি না জানতেই এসেছিলেন। কিন্তু উনি তো ওশান হাউসেই আছেন?
আছেন। তবে দেখা হয়নি। ওঁর সম্পর্কে আমার দুর্ভাবনা আছে, মি. দাস! খুব অ্যাডভেঞ্চার প্রবণ মানুষ। কোনও বিপদে না পড়েন?
সুখরঞ্জনবাবু হাসতে হাসতে বললেন, কথাবার্তা হাবভাবেই সেটা বুঝেছি। আমাকে পরামর্শ দিয়ে গেছেন, রিটায়ার করেই যেন কলকাতা চলে যাই এবং ওঁর প্রাইভেট ডিটেকটিভ এজেন্সিতে ঢুকি।
সুখরঞ্জনবাবু চলে গেলেন। এবার কর্নেল অন্য রাস্তায় এগোলেন। এটা পিচমোড়া সুন্দর রাস্তা। দু-ধারে ল্যাম্পপোস্ট। কর্নেল বললেন, ওই রাস্তাটা শর্টকাট ছিল। এই রাস্তায় ওশান হাউস অনেকটা দূর। কিন্তু উপায় নেই ডার্লিং! এই শীতের রাতে ভূতের ঢিল খেতে আমার আপত্তি আছে।
বললাম, ভূত-টুত নয়। রাজেনবাবু সেই দানোকে লেলিয়ে দিয়েছিলেন! আমাদের ছাই করে দিতে পারেন।
আঁতকে উঠে বললাম, সর্বনাশ! তা হলে বড্ড বেশি ঝুঁকি নেওয়া হচ্ছে যে?
কর্নেল হাসলেন। তা হচ্ছে। চিন্তা করো, ম্যাডানসায়েবের বাড়ির মাটির তলার ঘরে লুকোনো ইস্পাতের ভল্ট গলিয়ে হিরে চুরি! তাছাড়া লেসারঅস্ত্র দূর থেকে প্রয়োগ করা যায়। দানোটা তোমাকে কানমলার সুযোগই দেবে না।
হেসে ফেললাম। ভ্যাট! হেঁয়ালি করা আর ভয় দেখানো আপনার স্বভাব।
হঠাৎ কর্নেল থমকে দাঁড়িয়ে চাপা স্বরে বললেন, স্বভাব কী বলছ জয়ন্ত! ওউ দ্যাখো, গাছের আড়ালে কে যেন দাঁড়িয়ে আছে। কুইক! আমরাও লুকিয়ে পড়ি।
রাস্তার দু-ধারে গাছ এবং ঝোপঝাড়। মাঝে-মাঝে একটা করে বাংলোবাড়ি। কর্নেল আমাকে টেনে একটা ঝোপের আড়ালে নিয়ে গেলেন। গুঁড়ি মেরে কিছুক্ষণ বসে রইলাম দুজনে। আমি কিন্তু কাউকে দেখতে পাইনি।
এক সময় কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। তেমনই চাপা স্বরে বললেন, চলো!
রাস্তায় গিয়ে বললাম, কোথায় লোক দেখলেন?
কর্নেল বললেন, ওই দ্যাখো, চলে যাচ্ছে!
আন্দাজ তিরিশ মিটার দূরে রাস্তার বাঁকে একটা আবছা মূর্তি সদ্য মিলিয়ে যাচ্ছে। হন্তদন্ত হেঁটে বাঁকে পৌঁছে দেখি, আবছা মৃর্তিটা যেন হাঁটছে না। রাস্তার ওপর ভেসে যাচ্ছে।
সে কুয়াশার মধ্যে মিলিয়ে গেলে কর্নেল বললেন, কপালে দুর্ভোগ আছে ডার্লিং! আবার বালি আর জঙ্গল ভাঙতে হবে। একটা বালির টিলা ডিঙোতেও হবে। এসো।
পা বাড়িয়ে বললাম, ও কে?
সেই দানোটা বলেই মনে হল। হুঁ, তুমি ঠিকই বলেছিলে। বড্ড বেশি ঝুঁকি নিয়েছিলাম। তবে ঝুঁকি নেওয়ার উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। ম্যাডানসায়েবকে মেরে রাজেন অধিকারী গোপালপুর-অন-সি ছেড়ে চলে যায়নি এটা জানা গেল। কিন্তু কেন যায়নি, সেটাই রহস্য। এটা জানা গেলেই রহস্যের সমাধান হবে। এমনকী, ইয়াজদার্গিদের হিরেও সম্ভবত উদ্ধার করতে পারব।
বালিয়াড়ি, জঙ্গল এবং একটা আস্ত বালির পাহাড় ডিঙিয়ে সমুদ্রের বিচে পৌঁছোতে ঘণ্টাখানেক লেগে গেল। তারপর ওশান হাউসে যখন পৌঁছোলাম, তখন আমার অবস্থা শোচনীয়। পা নাড়তেই যন্ত্রণা কটকট করে উঠছে।
হালদারমশাইয়ের স্যুটে তেমনই তালা আঁটা। ফেরেননি। কোনওরকমে জুতো খুলে বিছানায় গড়িয়ে পড়লাম।
ঘুম ভাঙল কর্নেলের ডাকে। অভ্যাসমতো প্রাতভ্রমণে বেরিয়েছিলেন। মুচকি হেসে বললেন, যেভাবে ঘুমোচ্ছিলে, দানোটা এসে তোমার ঘাড় মটকাবার চমৎকার সুযোগ পেত।
বললাম, আপনি যেভাবে মর্নিংওয়াকে বেরিয়েছিলেন, আপনারও ঘাড় মটকানোর সুযোগ ছিল।
দেখা যাচ্ছে, সে এসব সুযোগের সদ্ব্যবহার করছে না।
কিন্তু গত রাতে সে গাছের আড়ালে ওত পেতে দাঁড়িয়েছিল!
কর্নেল প্রজাপতি ধরা জাল ঝেড়েমুছে গুটিয়ে রাখছিলেন। বললেন, আমাদের জন্য ওত পাততে যায়নি। জায়গাটা দেখে এলাম। ওড়িশার এক প্রাক্তন মন্ত্রীর বাংলোবাড়ির কাছে সে দাঁড়িয়েছিল। ওই বাড়িতে এমনই কেউ আছে, যার ঘাড় মটকাতে গিয়ে থাকবে। কোনও কারণে সে সুযোগ পায়নি। তাই তাকে রাজেন অধিকারী সরিয়ে নিয়েছে, কিংবা সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছে। হ্যাঁ- রিমোট কনট্রোলের সাহায্যেই।
সায় দিয়ে বললাম, ঠিক বলেছেন। দানোটা গুলতির বেগে যেন ভেসে যাচ্ছিল।
বাথরুম সেরে এসে দেখি, মারিয়াম্মা ব্রেকফাস্ট এনেছে। খেতে বসে কর্নেল বললেন, বাংলোবাড়িটার দরজায় তালা। পরে খোঁজ নেব, কে আছে ওখানে। প্রাক্তন মন্ত্রী ভদ্রলোক কদাচিৎ আসেন শুনলাম। এলে ওঁর লোকজনও সঙ্গে থাকে। কেউ নেই। সম্ভবত ওঁর কোনও পরিচিত লোক এসে থাকবে। তবে সে যে-ই হোক, তাকে সাবধান করে দেওয়া উচিত।
হালদারমশাইয়ের কথা মনে পড়ে গেল এতক্ষণে। বললাম, হালদারমশাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়েছে আপনার?
কর্নেল গম্ভীর হয়ে মাথা নাড়লেন। তখনই উঠে গিয়ে দেখে এলাম, ওঁর স্যুটের দরজায় তেমনই তালা আঁটা। অজ্ঞাত ত্রাসে বুকটা ধড়াস করে উঠল।
কিছুক্ষণ পরে সি আই ডি ইনস্পেকটার সুরঞ্জনবাবু এসে গেলেন। আমরা সামনের বালিয়াড়ি পেরিয়ে গেলাম। বিচে তত কিছু ভিড় নেই। বিচ ধবে প্রায় আধ কিমিটাক হাঁটার পর লাইটহাউসে ছাড়িয়ে গিয়ে বালির একটা টিলার কাছে পৌঁছোলাম। সুরঞ্জনবাবু দেখিয়ে দিলেন, কোথায় ম্যাডানসায়েবের মৃতদেহ পড়ে ছিল।
কর্নেল বাইনোকুলারে বালির বিশাল টিলাগুলো দেখছিলেন। হঠাৎ হন্তদন্ত এগিয়ে গেলেন। তারপর টিলা বেয়ে উঠতে শুরু করলেন। আমরা ওঁকে অনুসরণ করলাম। টিলার মাথায় উঠে কর্নেল বললেন, ম্যাডানসায়েবের জুতোর ছাপ কিনা জানি না। তবে ছাপগুলো লক্ষ্য করুন মি. দাস! পশ্চিমদিকের ঢাল থেকেই ছাপগুলো উঠে এসেছে। ওই দেখুন। স্বাভাবিক চড়াইয়ে ওঠার ছাপ। ওদিকে বালিটা জমাট। এই টিলার মাথায় আসার পর বিচের দিকে নেমে যাওয়া ছাপগুলো দেখুন। বিচের দিকটা ঢালু। বালি নরম। ক্রমশ স্টেপিংয়ের দূরত্ব বেড়েছে। ছাপও গম্ভীর হয়েছে। বাঁ দিকে কোনাকুনি নেমে গেছে ছাপগুলো। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, ভদ্রলোক দৌড়ে নেমেছিলেন। কিন্তু বাঁ দিকে কোনাকুনি কেন? চুড়োয় এসে নীচে বাঁদিকে কি কাউকে দেখতে পেয়ে পালিয়ে যাচ্ছিলেন?
কর্নেল বাইনোকুলারে ডান দিকটা দেখে এগিয়ে গেলেন। বললেন, এই যে! এখানে কেউ, দাঁড়িয়েছিল। মাই গুডনেস! সে একলাফে প্রায় তিরিশ ফুট নীচে পড়েছে। ওই দেখুন গভীর দুটো ছাপ কর্নেল নেমে গেলেন হন্তদন্ত। আবার খুঁটিয়ে দেখে বললেন, ডেডবডির দূরত্ব এখান থেকে আরও তিরিশ ফুট। জোয়ারের জল ওখান পর্যন্ত আসে না। তার মানে, সে দ্বিতীয় লাফে ম্যাডানসায়েবকে ধরে ফেলেছে। অস্বাভাবিক লং জাম্প!
সুখরঞ্জনবাবু ফ্যাঁসফেঁসে গলায় বলে উঠলেন, অসম্ভব! একেবারে অসম্ভব।
