আমি একটি সাধারণ মেয়ে – গল্প – রমাপদ চৌধুরী
আমি একটি সাধারণ মেয়ে। সাধারণ মেয়েদের মতোই সারা জীবন আমার কেটেছে শধু, স্বপ্ন দেখে। সাধারণ ঘরে আমার জন্ম। স্বাস্থ্য অটুট ছিলো না কোনো কালেই দেখতে সুন্দরী ছিলাম না, ‘পাত্রপাত্রী’ কলমের ভাষার মধ্যমশিক্ষিতা। তবু আমি স্বপ্ন দেখতাম সুখের স্বাচ্ছন্দ্যের।
ছোটবেলায় যখন ইস্কুলে পড়তাম, কি ফুর্তিতেই না কেটে যেতো দিনগুলো। মা কাছে ডেকে বসাতো, যত্ন করে বিনুনি বেধে দিতো। ইস্কুলের বাস এসে পড়লে ভালো করে খাওয়া হবে না বলে নিজেই বারবার ঘড়ি দেখতো, সময় থাকতে সামনে বসিয়ে খাওয়াতো, বলতো, ‘আর দুটি ভাত নিবি না?’
সত্যি, তখন মাকে কি ভালো যে লাগতো। আবার ভালো লাগতোও না। মনে হতো, আমার যেন এতটুকু স্বাধীনতা নেই। একটু ময়লা জামা পরলে কি এমন মহাভারত অশুদ্ধ হবে? সময়ে ভাত না খেলেই কি নয়? চুলে তেল না দিলে, কিংবা চুল ভিজে থাকলে এমন কি অপরাধ?
তারপর একটু একটু করে বড় হলাম। আর আশ্চর্য, দেখলাম মায়ের ব্যবহারে কি অদ্ভুত পরিবর্তন। আগে মনে হতো মা-র এত যত্ন যেন অসহ্য, এখন মনে হলো, মা কি একটুও ভালোবাসতে পারে না আমাকে ! যত্ন পেতাম আগে, এখন পেলাম শব্দ শাসন। কথায় কথায় মা শোনাতো, আমি তার গলায় লেগে আছি। অর্থাৎ মা তখন আমাকে পার করার কথা ভাবছে দিনরাত। পার করার পথটা খুঁজে পাচ্ছিলো না বলেই সব দোষ এসে পড়তো আমার ঘাড়ে। আমি নাকি সভ্যতা জানি না, দেখতে ভালো নই, কপাল নিয়ে আসিনি।
এই সময়ে ভাগ্যিস দাদার বিয়ে হলো। বউদি এলো ঘরে, রাঙা টকটকে চেহারা, এক-গা গয়না, শরীর স্বাস্থ্য চমৎকার। সবচেয়ে বড় কথা, বউদির মিষ্টি ব্যবহার। দু দিনেই আমাকে আপন করে নিলো। শুধু তাই নয়, একে একে আমার কাজগুলো কেড়ে নিতে লাগলো বউদি। প্রথম প্রথম আপত্তি করতাম। কিন্তু প্রথমেই বলেছি, স্বাস্থ্য আমার তেমন ভালো ছিলো না, তাই ঘর-সংসারের কাজ করতে রীতিমতো কষ্ট হতো। তবু না করলে কে করবে, তাই করতে হতো সব কিছু। রান্না থেকে পরিবেশন, ঘর ঝাঁট দেওয়া থেকে মশারি খাটানোর কাজগুলো বউদি নিয়ে নিলো, আর ক্রমে বউদি যত পুরোনো হয়ে যেতে লাগলো, দেখলাম, কাজ না করায় অনেক সুখ অনেক আরাম। দু-একটা কাজ করতে হলেই মুখে বেজার করতাম।
এদিকে তখন দু-একজন করে মেয়ে দেখতে আসছে। মা-র এবং বউদির নির্দেশমতো আমি সেজেগজে তাদের সামনে গিয়ে বসছি, পরীক্ষা দিচ্ছি, পণাপণের পরীক্ষায় বাবা বার- বার ফেল করছে আর সব দোষ এসে পড়ছে আমার ওপর।
কাজ আমি এমনিতেই করতাম না, যদি বা দু-একটা করতে যেতাম, মা বাধা দিতো। ঊনুনের তাতে দিনের পর দিন রান্না করে, ঘর-সংসারের খাটুনি খেটে বউদির চেহারা দিনকের দিন কালি হয়ে যাচ্ছিলো, চোখের সামনে দেখতে পেতাম। তাই কোনো কোনোদিন রান্নাঘরে গিয়ে দাঁড়াতাম, কাপ-ডিশ ধুতে যেতাম, আর মা বকুনি দিতো বউদিকে।
যেন বউদিই জোর করে খাটাচ্ছে আমাকে। এমনিতেই মেয়ে পছন্দ হচ্ছে না কারও, এব পর আগুনের তাতে গেলে যা চেহারা হবে, বুঝি বা মেয়ের আর বিয়েই দিতে পারবে না। আমি কিছু বলতে পারতাম না, কারণ ধমকটা যদিও বউদির উদ্দেশে, তবু তার মধ্যে আমার বিরুদ্ধেও একটা হুল উচিয়ে থাকতো কথাটায়।
আমি দেখতে সুন্দরী নই, আমার কপাল মন্দ, ভব্যতা শিখিনি—এসব অভিযোগ একদিন কিন্তু মিথ্যে হয়ে গেল। সব দঃখ-কষ্ট, সব জ্বালাযন্ত্রণা সহ্য করেও সাধারণ মেয়েদের মতোই যে সাধারণ স্বপ্নটা আমি দেখতাম তা একদিন সত্যি হলো। আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেল।
সঙ্গে সঙ্গে মা-র ব্যবহারে আবার পরিবর্তন দেখলাম। সেই ছোটবেলাকার মতো আদর যত্ন করে মা সামনে বসিয়ে চুল বে’ধে দেয়, শোবার সময় নিজে হাতে করে দুধের বাটি নিয়ে আসে, খাওয়ার সময় মাছের টুকরো একটার জায়গায় দুটো হয়। এত ভালোবাসা পেয়ে এক-একদিন আমার চোখে জল আসতো। ভাবতাম, কি বোকা আমি, এত ভালোবাসে মা, আর মাকে আমি এতদিন দু চোখে দেখতেই পারতাম না।
বাবার হাতে যেদিন চাল আর টাকা দিয়ে ঋণ শোধ করার কথা বলতে হলো সেদিন আরো বেশী করে টের পেলাম—বাবা-মা ছাড়া আমার আর কেউ নেই। যার স্বপ্ন দেখে এসেছি এতদিন, সেও আমার কেউ নয়। কি বোকা আমরা সাধারণ মেয়েরা। শ্বশরবাড়ি এসে প্রথম প্রথম মন খারাপ হতো বটে, কিন্তু কিছু দিনের মধ্যে সবই প্রায় ভুলতে বসলাম। ভালো লেগে গেল নতুন ঘর-সংসার, ভালোবেসে ফেললাম শ্বশুর-শাশুড়ী, ননদ-জা, ভাশুর-দেওর সকলকে। মনে হলো, আমার মতো সুখী ত্রিভুবনে কেউ নেই।
হঠাৎ একটা ধাক্কা খেলাম যেদিন, তন্ময়তাটা কেটে গেল। বড় জা বললে, আমার নাকি লাজলজ্জা নেই। ননদ বললে, আমি নাকি কাজ করতে চাই না। ঠিক এত স্পষ্ট করে কেউই বললো না, হাবেভাবে টীকাটিপ্পনী, ব্যঙ্গবিদ্রূপে এ কথাটাই তারা বলতে চাইলে হঠাৎ সন্দেহ হলো, ঠিক এমনি কথা যেন আমিও বলেছি বউদিকে— হাবেভাবেই বলেছি।
আমি তাই উঠেপড়ে লাগলাম ওদের খুশী করার জন্যে। একে একে সব কাজ আমি কেড়ে নেবার চেষ্টা করলাম। প্রথম প্রথম ওরা ছাড়তে রাজী হতো না, অথচ কথা শোনাতো। কিন্তু টানাপোড়েন চলতে চলতে একদিন আবিষ্কার করলাম উননের সামনে আগুন-তাতে বসে রান্না করা থেকে রাত্রে মশারি টাঙানো পর্যন্ত সব কিছুই আমার ঘাড়ে এসে চেপেছে। অথচ আমার খাওয়া-দাওয়ার দিকে নজর নেই কারও। এক পো দুধ কেউ হাত তুলে দেয় না।
ছোট ননদের তখন বিয়ের কথা চলছে। তাই শাশুড়ী তাকে কোনো কাজে হাত দিতে দিতেন না। বড় জা গেলেন বাপের বাড়ি তাঁর ছোট ছেলের জন্যে একটি ভাই কিংবা বোন আনতে। বড় ননদ ফিরে এলেন শ্বশুরবাড়ি থেকে। বাপের বাড়িতে দু-দশ দিন জিরিয়ে নেবার জন্যে। শাশুড়ী তাদের জন্যে দুধের বরাদ্দ করলেন, নিজে বসে খাওয়া-দাওয়া তদারক করতেন।
আমি একা মানষ, এত বড় সংসারটা সামলাতে গিয়ে হিমসিম খেয়েই ক্ষান্ত নই, কথায় কথায় খোঁটাও খাই, বাপের বাড়ির শীতের তত্ত্ব কেন ভালো হয়নি; মাছ-ঝালটায় নুন কেন বেশী হলো, দুধ কেন ঢাকা দিয়ে রাখিনি।
শরীর খারাপ হচ্ছিলো, মন আরো খারাপ হতে শুরু হলো। ফলে আয়নায় একদিন দেখলাম, বিশ্রী রোগা হয়ে গেছি, চোখ বসে গেছে, রঙও আমার এতটা কালো ছিলো না তো। কিন্তু কি বোকা আমি, পাছে এই চেহারা স্বামী দেখতে পায়, তাই পাউডার মেখে, সেজেগজে এমন একটা ভাব করতাম যেন আমি যা ছিলাম তাই আছি। দু-একজন বেড়াতে এসে বলতো, এ কি, তোমার চেহারা এত খারাপ হয়ে গেছে কেন? আমি হাসতাম, কিন্তু মনের ভিতরটা গুমরে উঠতো। ভাবতাম, কথাটা আমাকে না বলে শাশুড়ীকে বলে না কেন। তা হলে হয়তো…।
দাদা একবার দেখা করতে এসে ওই কথাই বললো, তারপর বাবাও এলো একদিন। এসে শাশুড়ীকে বললো, আপনাদের অমত না থাকে তো ওকে একবার নিয়ে যাই, অনেক দিন যায়নি !
শাশুড়ী অমত করলেন না। সিথিতে সিদুর দিয়ে চিবুকে হাত ঠেকালেন।
বাপের বাড়িতে ফিরে এসে স্বস্তি পেলাম। হাত-পা ছড়িয়ে এবার একটু জিরিয়ে নিতে হবে। রুগ্ন শরীরকে এবার একটু সুস্থ করে তুলতে হবে।
প্রথম কয়েকদিন বউদিরও খুব ফুর্তি। এতদিন পরে আবার দুজনে গল্প-গুজব করতে পেয়েছি। আমি একদিন বউদিকে সিনেমা দেখালাম, বউদি একদিন আমাকে দেখালো। বেশ হইচই করে কেটে গেল কয়েকটা দিন।
তারপর ক্রমে ক্রমে বউদির মুখের ভাব বদলাতে শুরু করলো। বেচারীর দোষ কি। অমন সন্দর রূপ একেবারে কালি হয়ে গেছে। খাটছে তো খাটছেই সারা দিন।
একট, একটু সাহায্য করার ইচ্ছে যে আর না হতো তা নয়। কিন্তু তা হলে আমার শরীর সারবে কি করে। শখ করে তো বাপের বাড়িতে আসিনি। একটু বিশ্রাম না নিলে শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে আবার কাঁধে জোয়াল তুলে নেবো কি করে? বউদি কিন্তু এটটুকু কিছুতেই বুঝতে চাইতো না। ওর গোমড়া মুখ দেখে আমি বেশ বুঝতে পারতাম। মা আমার পাতে দুটো মাছ দিতো কি সাধ করে! না দুধের বাটিটা এগিয়ে দিতো মিছেমিছি! আমি তো দু-দিনের জন্যে এসেছি, দুধ মাছ যত খুশি বউদি তো এর পর খেতে পাবে। আমাকে এসব কে দেবে শ্বশুরবাড়িতে? কে দেবে বিশ্রাম?
সত্যি, বউদি এত ভালো ছিলো, এখন কি যেন হয়ে গেছে। বউদির বিরক্তিটা স্পষ্টই। যেন দেখতে পেতাম। তাই একদিন অতিষ্ঠ হয়ে চিঠি লিখলাম স্বামীকে।
দিন কয়েক পরেই শ্বশুরবাড়িতে চলে এলাম আমি। আবার ঘর-সংসারের ভার কাঁধে তুলে নিলাম।
ভাবনা-চিন্তার সময় কই? আমি হলাম একটি সাধারণ মেয়ে। সাধারণ ঘরে আমার জন্ম, সাধারণ স্বপ্ন, হতাশাও সাধারণ। এত সময় নেই যে ভেবে দেখবো—বাপের বাড়িতে যা করে এসেছি, শ্বশুরবাড়িতে তাই ফিরে পাচ্ছি। কিন্তু যদি ভেবে দেখতাম ! ভেবে দেখবো কি করে, তখন যে আমি সাধারণ মেয়েদের মতোই আর একটি সাধারণ স্বপ্ন দেখছি! যা সবাই দেখে।