অলক্ষ্মীর গয়না (কিশোর কর্নেল) – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ

শেয়ার করুনঃ

এক

সম্প্রতি কোনও রহস্যময় কারণে কর্নেল নীলাদ্রি সরকার ভারত মহাসাগরের টোরা আইল্যান্ডে পাড়ি জমিয়েছিলেন। সেখানে নাকি রাত-বিরেতে এক আজব প্রাণী চরে বেড়ায়। তার মুখটা ঘোড়ার, ধড়টা মানুষের–এক কথায় ঘোড়ামানুষ বলা যায়। সেই দারুণ রোমাঞ্চকর গল্প খুব মন দিয়ে শুনছিলুম আর ভাবছিলুম, আমাদের পৌরাণিক বৃত্তান্তে যে হয়গ্রীব অবতারের বৃত্তান্ত আছে, টোরা দ্বীপের ঘোড়ামানুষরা তারই বংশধর নয় তো! এমন সময় ষষ্ঠীচরণ এসে কর্নেলের হাতে একটা কার্ড দিয়ে বলল, -একজন ভদ্রলোক এয়েছেন বাবামশাই!

 

খুদে কার্ডটার অবস্থা জরাজীর্ণ। কর্নেল উলটে-পালটে দেখে বললেন, -ঢ্যাঙা, রোগা চেহারা, মাথার মধ্যিখানে টেরি?

 

আমাকে অবাক করে ষষ্ঠীচরণ বলল, আজ্ঞে।

 

–কালো কোট, ঢোলা পাতলুন, কাঁধে ঝোলা?

 

আজ্ঞে বাবামশাই!-ষষ্ঠীচরণের সরু দাঁতগুলো বেরিয়ে পড়ল।

 

নিয়ে এসো। -বলে কর্নেল তেল-চিটচিটে ছেঁড়াফাটা কার্ডটা আমাকে এগিয়ে দিলেন, লাস্ট কার্ড, ডার্লিং। সাবধানে হ্যাঁন্ডেল করো। নইলে তোমায় নিজের পয়সায় বেচারার নেমকার্ড ছেপে দিতে হবে।

 

কার্ডে আগন্তুকের নাম ছাপানো রয়েছে। প্রফেসর তানাচা, দা গ্রেট ম্যাজিশিয়ান। ঠিকানার ওপর ময়লা জমেছে। তাই অস্পষ্ট। বললুম, –চিনা কিংবা জাপানি নাকি?

 

উঁহু। খাঁটি বাঙালি।

 

–অদ্ভুত নাম। কিন্তু আজকাল কি দেয়ালের ওপারেও আপনার দৃষ্টি চলে!

 

-একটু আগে জানালার কাকটাকে তাড়াতে গিয়ে দেখেছি, প্রফেসর তানাচা ফুটপাথে দাঁড়িয়ে আমার এই ফ্ল্যাটের দিকে করুণ মুখে তাকিয়ে আছেন। নিশ্চয়ই দ্বিধায় ভুগছিলেন- একটা তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে আমার কাছে আসাটা ঠিক হবে কি না। …এই যে। আসুন, আসুন প্রফেসর তানাচা। বসুন।

 

যিনি ঢুকলেন, তিনি ধুতি-পাঞ্জাবি পরে থাকলে হলফ করে বলতে পারতুম, ইনি অষ্টপ্রহর সংকীর্তনের খোলবাজিয়ে। মধ্যিখানে সিঁথি-করা চুল, ঢুলুঢুলু চাউনি, ভাবুক ভাব এবং ঠোঁটে মাখনের মতো কোমল হাসি। তবে কোট-প্যান্টের অবস্থা ওঁর কার্ডের মতোই করুণ। নোংরা ঝোলাটা কফি-টেবিলে রেখে কাচুমাচু হেসে বললেন, -ভয়ে বলি, কি নির্ভয়ে বলি?

 

কর্নেল বললেন, –নির্ভয়ে বলুন প্রফেসর তানাচা। আর ইয়ে-কফি চলবে কি?

 

খুব চলবে। তবে দু-ভাগ দুধ, এক ভাগ কফি। -প্রফেসর তানাচা গলার ভেতর বেহালা বাজানোর মতো টেনে-টেনে হেঁ-হেঁ করে কেমন একটা হাসতে লাগলেন।

 

ওঁর কফি না খেয়ে তাহলে তো বরং দুধ খাওয়াই উচিত। কফি খাওয়ার অভ্যাস নেই তো না খেলেই হয়। আমি প্রফেসর তানাচার দিকে তাকিয়ে রইলুম। ভদ্রলোককে দেখে কেন কে জানে রহস্যের গন্ধ পাওয়া যায়। ম্যাজিকের খেলা দেখান বা নাই দেখান, লোকটির টুলটুলু চাউনিতে কিন্তু ম্যাজিক আছে।

 

ষষ্ঠীচরণকে ডেকে কফির কথা বলে কর্নেল বললেন, –আলাপ করিয়ে দিই। আমার তরুণ বন্ধু জয়ন্ত চৌধুরি। দৈনিক সত্যসেবকের স্পেশাল রিপোর্টার।

 

প্রফেসর তানাচা খুশি হয়ে বললেন, –কী সৌভাগ্য। সত্যি বলতে কী, সত্যসেবকে আপনার লেখা রাতের ট্যাক্সিতে ভূতুড়ে যাত্রী পড়েই ওঁর কাছে আসা। অনেক কষ্টে ঠিকানা জোগাড় করেছি আপনাদের অফিস থেকে। প্রথমে আপনার খোঁজই করেছিলুম। শুনলুম, আপনি সাঁওতালডি গেছেন। ফিরতে দেরি হবে। তা নোডশেডিংয়ের কিছু সুরাহা হবে বুঝলেন?

 

কর্নেল একটু হেসে বললেন, -সুরাহা হলেও কি আপনার বাড়িতে ভূতের দৌরাত্ম থামবে ভাবছেন প্রফেসর তানাচা? সবই ভূতের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করছে।

 

প্রফেসর তানাচার মুখে বিস্ময় ফুটে উঠল। –আপনার অলৌকিক ক্ষমতার কথা কাগজে পড়েই তো আসা। স্বীকার করছি কর্নেলসায়েব, একসময় দেশেবিদেশে আমি নিজেও অনেক ভূতুড়ে ম্যাজিক দেখিয়েছি কিন্তু আপনার কোনও তুলনা হয় না। বহুদিন ম্যাজিক ছেড়ে দিয়েছি। ম্যাজিকের ওপর ঘেন্না ধরে গিয়েছিল বলতে পারেন। তাছাড়া, অনিদ্রার ব্যাধি, নানারকম মানসিক অশান্তি, অর্থাভাব। তো…

 

ওঁর কথা কেড়ে কর্নেল বললেন, -ট্যাক্সির ভূতটার মতো আপনার ভূতটাও আশা করি টাকাকড়ির ব্যাপারে খুব উদার?

 

প্রফেসার তানাচার চোখের চুলটুলু ভাবটা চলে গেল। বললেন, –কী আশ্চর্য, কী আশ্চর্য। আপনি দেখছি থটরিডিং জানেন!

 

-কত টাকা পেয়েছেন?

 

প্রফেসর তানাচা চাপাগলায় বললেন, –পাঁচদিনে মোট পঞ্চাশ টাকা। ডেলি একটা করে দশ টাকার নোট খামের ভেতর। ওপরে লেখা, উইশ ইউ গুড লাক। এ কী কাণ্ড বলুন তো স্যার? লোকে টাকার জন্য মাথার ঘাম পায়ে ফেলছে। খুনখারাপি পর্যন্ত করছে। আর এমনি-এমনি রোজ সক্কালবেলা মেঝের ওপর দশ টাকার নোটভরা খাম!

 

-আজ বুঝি আর কোনও খাম পাননি?

 

প্রফেসর তানাচা মুখটা করুণ করে মাথা দোলালেন। আমি দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে আছি হাবাকান্তের মতো। তারপর দেখি, কর্নেল হেলান দিয়ে বসে চোখদুটো বন্ধ করে টাকে হাত বুলোচ্ছেন। কয়েক সেকেন্ড পরে হঠাৎ চোখ খুলে বললেন, আপনার ঘর থেকে কিছু চুরি যায়নি তো?

 

চুরি?–প্রফেসর তানাচা একটু হাসলেন, আছেটা কী যে নেবে? মির্জাপুরের একটা মেসবাড়ির ছাদে ছোটো চিলেকোঠার মতো ঘরে থাকি। একটা ভাঙাচোরা তক্তপোশ–তার ওপর যেমন-তেমন একটা বিছানা পাতা। তলায় একটা সুটকেস। তার মধ্যে ছোটোখাটো ম্যাজিকের কিছু আসবাব আছে। আর আছে একটা কুঁজো আর জল খাওয়ার জন্য কাচের গেলাস। ব্যস, এই মোটে সম্বল। চোর নেবেটা কী?

 

–আপনি তো আফিংয়ের নেশা করেন?

 

প্রফেসর তানাচা হকচকিয়ে গেলেন প্রথমটা। পরে অপ্রস্তুত হেসে লাজুক ভঙ্গিতে বললেন, –অনিদ্রার রুগি। কী করি বলুন।

 

-দরজা খোলা রেখে ঘুমোন তো?

 

অনেকদিন বৃষ্টি নেই। যা গরম পড়েছে।

 

কিছু চুরি যায়নি বলছেন?

 

নাঃ। –প্রফেসর তানাচা জোরে মাথা নাড়লেন।

 

কর্নেল ওঁর মুখের দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, -ধরুন, কোনও তুচ্ছ জিনিস, অথবা আপনি এখনও খেয়াল করে দেখেননি এমন কিছু?

 

ষষ্ঠীচরণ এতক্ষণে কফি আনল। কর্নেল ফের বললেন, -কফি খেতে-খেতে ভাবুন। ভেবে বলুন প্রফেসর তানাচা!

 

তিনজনে একসঙ্গে কফিতে চুমুক দিলুম। ঘরের আবহাওয়া কেন যেন থমথমে মনে হচ্ছিল আমার। একটু পরে কর্নেল কফির পেয়ালায় শেষ চুমুক দিয়ে চুরুট ধরিয়েছেন, প্রফেসর তানাচা হঠাৎ নড়ে উঠলেন। তারপর দুধে-সাদা কফিটুকু কোঁত করে গিলে কফির পেয়ালা ঠকাস করে রেখে উঠে দাঁড়ালেন।

 

তারপর–সর্বনাশ! ঠাকুরদার কবচটা…বলেই সটান পরদা তুলে অদৃশ্য হলেন। পরদাটা যেন ঝড়ের ধাক্কায় বেজায় দুলতে থাকল।

 

কর্নেল চুরুটের নীল রঙের প্যাচালো ধোঁয়া উড়িয়ে মিটিমিটি হেসে বললেন, –কী বুঝলে জয়ন্ত?

 

–অনেক কিছু। আপনি দেখছি ম্যাজিশিয়ানদের রাজা। এতসব জানলেন কীভাবে? ভদ্রলোককে নিশ্চয়ই চেনেন।

 

–ওঁকে এই প্রথম দেখলুম, ডার্লিং!

 

কর্নেল সোফা থেকে উঠে জানালার ধারে গেলেন। তবে সেখানে তাড়ানোর মতো কোনও কাক নেই। উঁকি মেরে নিচের রাস্তা দেখতে-দেখতে বললেন, প্রফেসর তানাচা বাস পেয়ে গেলেন। যাই হোক, তুমি একটু অবাক হয়েছ টের পাচ্ছি। দ্যাখো জয়ন্ত, আসল কথাটা হচ্ছে অবজার্ভেশন-পর্যবেক্ষণ। তাছাড়া, তুমি তো জানো, ম্যানওয়াচিং আমার একটা হবি। এ কিছু কঠিন নয়-চেষ্টা করলে তুমিও এগুলো পারও। যেমন ধরো-উনি যে আফিংখোর, সেটা ওঁর চোখ দেখলেই ধরা যায়। তাছাড়া কফির সঙ্গে বেশি দুধ চাইলেন। আফিংখোররা দুধের প্রতি বেশিমাত্রায় আসক্ত। ট্যাক্সির ভূতুড়ে যাত্রীর খবর তুমিই লিখেছ। যাত্রীটি রাত দুটোয় ট্যাক্সিওয়ালা নির্দিষ্ট জায়গায় যাতে আবার আসে, তাই ইচ্ছে করে অনেক টাকা ভাড়া দিত। প্রফেসর তানাচা এটা উল্লেখ করামাত্র বুঝলুম তেমন কিছু ঘটে থাকবে।

 

–আজ খাম পাননি, কীভাবে জানলেন?

 

কর্নেল হাসলেন। –আজ টাকা পেলে আসতেন না। এভাবে টাকা পাওয়ার কথা কে আর পাঁচকান করতে চায় বল? সে অবশ্যই ভাবত, টাকাটা যদি অদৃশ্য দাতামহাশয় রেগেমেগে বন্ধ করে দেন? বন্ধ হয়েছে বলেই আমার কাছে আসা।

 

-কিন্তু চুরি?

 

–ওঁর মত আফিংখোরকে টাকা দেওয়ার এই একটিই উদ্দেশ্য থাকতে পারে। অভাবী মানুষ। হাতে টাকা পেলে আফিংয়ের মাত্রা চড়িয়ে ফেলবেন এবং মড়ার মতো পড়ে থাকবেন। সেই সুযোগে চোর ইচ্ছেমতো চুরির বস্তুটি হাতড়ানোর অঢেল সময় পাবে। তবে গরমের জন্য দরজা খুলে রাখার কথাটা বিশ্বাসযোগ্য মনে হল না। সম্ভবত নেশার মাত্রা বেশি হওয়ায় দরজা লাগানো হতো না। আফিংখোরদের এই সমস্যা ডার্লিং। মৌতাত কিছুতেই নষ্ট হতে দেবে না-সে যদি ঘরে আগুন লাগে, তবুও।

 

কর্নেল হঠাৎ ভুরু কুঁচকে সটান এগিয়ে এলেন। আরে! ভদ্রলোক ব্যাগটা ফেলে চলে গেলেন যে!

 

টেবিলে ব্যাগটা এতক্ষণে আমার নজরে পড়ল। বললুম, –আফিংখোরদের ব্যাগের ভেতর কী থাকতে পারে?

 

কর্নেল ব্যাগের মুখটা ফাঁক করে দেখে বললেন, –টাকা না পেয়ে ক্ষুণ্ণমনে প্রফেসর তানাচা গঙ্গাস্নানে গিয়েছিলেন। ফেরার পথে আমার এখানে এসেছিলেন। লুঙ্গি আর গামছা ভেজা রয়েছে। আর… আর… এটা…। একটা নোটবই দেখছি। পরের জিনিসে হাত দিতে নেই। কিন্তু এটা একটা স্পেশাল কেস। ভদ্রলোককে আরও একটু চেনা দরকার।

 

চটিমতো কালো মলাটের জীর্ণ নোটবই। ওঁর কার্ডটার মতোই অবস্থা। প্রথম পাতায় চোখ বুলিয়ে দেখি, শীতারানাথ চাটুজ্জে–বড়ো হরফে লেখা রয়েছে। বললুম, –তানাচার রহস্য ফাঁস হল, কর্নেল! পাতা ওলটান।

 

পরের পাতায় লাল কালিতে সম্ভবত তন্ত্রমন্ত্র লেখা। ওঁ হ্রীং ক্রীং ফট ফট… মাড়য় মাড়য় তাড়য়। তাড়য়… এইসব বিদঘুটে লাইন। বশীকরণ মন্ত্র। মারণমন্ত্র। তাড়নমন্ত্র। কোন গাছের শেকড়ের কী অলৌকিক ক্ষমতা আছে, তার বৃত্তান্ত। তারপর একটা পাতা খুলে কর্নেল বললেন, -এও কি মন্ত্র! নাকি ছড়া?

 

কবে যাবি রে সেই সমাজে

ছাড় কুইচ্ছে পোড়া পাম রে…

 

এই আজব ছড়া কিংবা মন্ত্র আমি আওড়াতে শুরু করলুম। কয়েকবার আওড়ে দিব্যি মুখস্থ হয়ে গেল। কর্নেল নোটবইটা ভেতরে ঢুকিয়ে রেখে বললেন, -বেশ ছন্দ আছে লাইনদুটোতে। সহজে মুখস্থ হয়ে যায়। জয়ন্ত, যে প্রফেসর তানাচার ঠাকুরদার কবচ ওভাবে চুরি যায়, তার নোটবইয়ে এই উদ্ভুটে ছড়া বা মন্ত্রের নিশ্চিয়ই কোনও তাৎপর্য আছে। বরং দুপুরবেলা এ নিয়ে বসব। এখন আমার ছাদে যাওয়ার সময় হল। মেক্সিকান ক্যাকটাসটার গায়ে ভোরবেলা ইলেকট্রোনোমিটার লাগিয়ে রেখে এসেছি। দুষ্টু গাছটা গ্রাফিক চার্টে সাড়া দিয়েছে নাকি দেখা দরকার।

 

কর্নেল উঠলেন। বুঝলুম, এখন আর আড্ডার আশা নেই। বুড়ো এবার উদ্ভিদ আর পোকামাকড়ের রাজ্যে ঢুকে পড়বেন। তখন আফিংখখার প্রফেসর তানাচার মতোই ওঁর দশা হবে। প্রকৃতিবিদ্যার মৌতাত মাথা ভাঙলেও ঘুচবে না। অতএব আমিও উঠে পড়লুম। বললুম, –চলি কর্নেল! প্রফেসর তানাচা-রহস্যের কী কতটা দাঁড়াল ফোনে জানিয়ে দেবেন। দৈনিক সত্যসেবকের জন্য দারুণ একটা স্টোরি হবে।

 

কর্নেল মুচকি হেসে বললেন, প্রফেসর তানাচা হয়তো পিশাচসিদ্ধ হতে চেয়েছিলেন একসময়। ওটা পিশাচ-জাগানো মন্ত্র হলেও হতে পারে। জপ করে দ্যাখো, ডার্লিং। …

 

.

 

এর পর কয়েকটা দিন আবার আমাকে অফিসের কাজে বাইরে ছোটাছুটি করে বেড়াতে হল। তার মধ্যে যখনই সময় পেয়েছি, কর্নেলকে ফোন করেছি। প্রফেসর তানাচার আর পাত্তা নেই। ব্যাগটাও ফেরত নিতে আসেননি। সপ্তাহটাক পরে কর্নেল ফোন করলেন আমাকে মির্জাপুরের সেই মেসে প্রফেসর তানাচার খোঁজে গিয়েছিলেন। দরজায় তালা আটকানো রয়েছে। মেসের ম্যানেজার বলেছেন, পাগলা লোক। কখন থাকেন, কখন না–কিছু ঠিক নেই।

 

ফোনে কর্নেলকে বললুম, -ঠাকুরদার কবচ উদ্ধার করতে প্রফেসর তানাচা সম্ভবত আপনার সেই হয়গ্রীব অবতারের মুলুকে পাড়ি দিয়েছেন। ওঁর খোঁজে বেরিয়ে পড়ছেন না কেন?

 

কর্নেল বললেন, -সময় নেই ডার্লিং। অক্টোবর শেষ হয়ে এল। মেক্সিকান ক্যাকটাসটার ওপর শিশির ও কুয়াশার কী প্রতিক্রিয়া ঘটে, দেখার জন্য ব্যস্ত রয়েছি। তাছাড়া ভৈশারার জঙ্গল থেকে সে প্রজাপতিটা ধরে এনেছিলুম, তার ডানার রং হঠাৎ বদলাতে শুরু করেছে। প্রকৃতিরহস্যের গোলকধাঁধায় আটকে গেছি। …কর্নেল ঝাড়া পাঁচ মিনিট এইসব বুকনি ঝেড়ে ফোন ছাড়লেন।

 

সেদিনই বিকেলের ডাকে ভারি অদ্ভুত একটা চিঠি পেলুম।

 

ওহে সাংবাদিক,

তুমি তো সব সময় রোমাঞ্চকর খবর খুঁজে বেড়াও। দোসরা নভেম্বর রাত দশটায় লোহাগড়া রাজবাড়ির পেছনে নদীর ধারে অলক্ষ্মীর থানে চলে এসো। রোমাঞ্চকর খবর পেয়ে যাবে হাতে নাতে।

ইতি,

ইস্কাপনের টেক্কা।

 

চিঠিটা পড়ে প্রথমে একচোট হাসলুম। খবরের কাগজের লোকদের ঠাট্টা-তামাশা করে অনেকে চিঠি লেখে। কেউ কেউ প্রাণের ভয় দেখিয়ে শাসায়। এ আমার গা-সওয়া। বহুবার দারুণ রকমের খবরের টিপস পেয়ে হন্তদন্ত গিয়ে দেখেছি, পুরোটাই হৌক্স-স্রেফ গুল।

 

কিন্তু এই ছোটো চিঠিটার বৈশিষ্ট্য হল, খবরের কাগজ কেটে-কেটে এক বা একগুচ্ছ শব্দ আঠা দিয়ে কাগজে সেঁটে চিঠিটা তৈরি করা হয়েছে। ইস্কাপনের টেক্কা কোত্থেকে কেটে বসানো হয়েছে বুঝতে দেরি হল না। দৈনিক সত্যসেবকেরই দুইয়ের পাতায় নিচে একটা কমিক সিরিজ ছাপা হয়। ওটা সেখান থেকেই নেওয়া। লোহাগড়া রাজবাড়ির এবং অলক্ষ্মীর থানে কোত্থেকে কেটেছে, কাগজের ফাইল হাতড়ে উদ্ধার করতে পারলুম না।

 

একত্রিশে অক্টোবর রাত সাড়ে নটায় যখন অফিস থেকে বেরুলুম, তখনও ব্যাপারটা হৌক্স বলেই ভেবেছি। কিন্তু বাড়ি ফেরার পর ক্রমশ একটা চাপা অস্বস্তি জেগে উঠতে থাকল মনের ভেতর। আবার চিঠিটা নিয়ে বসলুম। খামের ওপর আমার নাম-ঠিকানাও ছাপা অক্ষরে সাঁটা। সেটা খুব সহজ কাজ। দৈনিক সত্যসেবকে প্রকাশিত আমার লেখা ফিচার থেকে নামটা কেটে নেওয়া যায়। আর সত্যসেবকের ঠিকানাও শেষ পাতার তলায় মুদ্রিত থাকে। ডাকটিকিটের ওপর ডাকঘরের নাম কিছুতেই পড়া গেল না।

 

ব্যাপারটা কর্নেলকে জানাবার ভরসা পাচ্ছিলুম না। বুড়োর মতিগতি যা টের পেয়েছি, তাতে ওঁর এখন প্রকৃতিরহস্যের মৌতাত জমে উঠেছে। এখন আর কানের কাছে ক্র্যাকার ফাটালেও প্রজাপতির ডানা কিংবা ক্যাকটাসের গায়ে আটকানো যন্ত্রটি থেকে ওঁর দৃষ্টি একচুল সরানো যাবে না।

 

কিন্তু অনিদ্রা এবং দুঃস্বপ্নে লম্বা-চওড়া একটা রাত কাটিয়ে পয়লা নভেম্বর সকালে মরিয়া হয়েই বুড়োকে ফোন করলুম। কিন্তু সাড়া দিল ওঁর ভৃত্য শ্রীযুক্ত ষষ্ঠীচরণ। বলল, -কাগুঁজে দাদাবাবু নাকি? বাবামশাই তো নেই। কাল বিকেলে কোথায় যেন গেলেন-হ্যাঁ, গড়গড়া বললেন, নাকি সোনাগড়া… দুচ্ছাই! পেটে আসছে মুখে আসছে না।

 

লোহাগড়া নয় তো?

 

আজ্ঞে! আজ্ঞে! তাই বটে কাগুজে দাদাবাবু। ষষ্ঠীচরণ খিকখিক করে হাসতে লাগল।

 

-কিছু বলে যাননি?

 

–কবেই বা বলেকয়ে যান? উঠল বাইতো মক্কা যাই–বরাবর তো তাই। তবে কথা কী কাগুজে দাদাবাবু…।

 

-আহা, ঝটপট বলো!

 

লোহাগড়ার রাজবাড়ি থেকে গাড়ি পাঠেছিল, বুঝলেন?–ষষ্ঠীচরণ আবার হাসতে লাগল।

 

–হাসির কী হল?

 

–গাড়িখানা দেখলে আপনিও হাসতেন কাগুঁজে দাদাবাবু!

 

–বুঝেছি, ভিনটেজ কার। রাজা-জমিদারদের অবস্থা এখন শোচনীয়। আচ্ছা, ছাড়ি ষষ্ঠীচরণ? শুনুন, শুনুন!–ষষ্ঠীচরণ ব্যস্তভাবে বলল, এইমাত্র মনে পড়ল। বাবামশাই আপনার কথা কী যেন বলে গেলেন–দুচ্ছাই! পেটে আসছে, মুখে আসছে না। …হ্যাঁ, আপনাকে যেতে বলেছেন। আপনি যেন অবশ্য করে যাবেন।

 

এতক্ষণ বলতে কী হয়েছিল? রাগ করে ফোন রেখে দিলুম। আরও কয়েকটা মিনিট রাগটা থাকল। মনিব ও চাকর দুজনেই সমান পাগল। কর্নেল কি আমাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে পারতেন না? কিংবা যাওয়ার সময় একবার রিং করলেও কি মহাভারত অশুদ্ধ হতো!

 

কিন্তু রহস্যটা তাহলে যে সত্যি-সত্যি ঘনীভূত হয়ে উঠল। ইস্কাপনের টেক্কা আমাকে দোসরা নভেম্বর রাত দশটায় লোহাগড়া রাজবাড়ির পেছনে নদীর ধারে অলক্ষ্মীর মন্দিরে হাজির হতে বলেছে। আর এদিকে গোয়েন্দাপ্রবর কর্নেল নীলাদ্রি সরকারকে সেই লোহাগড়া রাজবাড়িরই লোক গাড়ি চাপিয়ে নিয়ে গেল! ব্যাপারটা মোটেও আকস্মিক যোগাযোগ বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। হৌক্স বলেও মনে হয় না।

 

যতবার কথাটা ভাবলুম, ততবার রহস্যের একটা কালো পরদা ভেসে উঠল মনে। সেই কালো পরদার ফাঁকে সাদা রঙের একটা তাস ইস্কাপনের টেক্কা ঝিলিক দিতে থাকল। আর মুহুর্মুহু গা ছমছম করতে থাকল।

 

তবে ইস্কাপনের টেক্কা যেই হোক, আপাতত লোহাগড়া জায়গাটা কোথায় সেটা খুঁজে বের করা দরকার। কর্নেল-বুড়োর মুন্ডুপাত করলুম অসংখ্যবার। ঠিকানা তো ঠিকমতো বাতলে যাবেন ষষ্ঠীচরণের কাছে? এখন লোহাগড়ার খোঁজে বেরুনো মানে খড়ের গাদায় সূচ খুঁজতে যাওয়া!

 

হঠাৎ খেয়াল হল, রাজবাড়ি যখন আছে, তখন জায়গাটা নেহাত অখাদ্য নয়। তাছাড়া অলক্ষ্মীর মন্দির যেখানে আছে, সেখানকার খ্যাতি বা অখ্যাতি নিশ্চয়ই অসামান্য। অতএব চেষ্টা করে দেখা যাক।

 

আমার বরাত ভালোই বলতে হয়। …অফিসের লাইব্রেরিতে গিয়ে স্থান-নামের গাইডবুক হাতড়ে লোহাগড়া পেয়ে গেলুম। বিহার সীমান্তে পূর্বরেলের একটা ছোটো স্টেশন। তবে ঐতিহাসিক জায়গা। বিশেষ করে লোহা নদীর ধারে অলক্ষ্মীর মন্দির নাকি দেখার মতো জিনিস। সতেরো শতকে বর্তমান রাজবংশের এক পূর্বপুরুষ শিবেন্দ্রনারায়ণ ছিলেন দুর্ধর্ষ মানুষ। প্রজাদের ওপর ভীষণ অত্যাচার করতেন। প্রতিদিন মানুষের রক্ত না দেখে জলগ্রহণ করতেন না। তিনিই অলক্ষ্মীকে হটিয়ে লক্ষ্মীমূর্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু অদ্ভুত-অদ্ভুত কী-সব ঘটনা ঘটতে থাকে। শেষপর্যন্ত মন্দিরটা ভেঙে দিলেও অলক্ষ্মীকে কেউ উচ্ছেদ করতে পারেননি। মন্দিরের উঁচু চৌকোণা মেঝের ওপর এখনও সিংহাসনে বসে অলক্ষ্মীর কালো পাথরে গড়া মূর্তি ক্রুর চোখে তাকিয়ে রয়েছে। অলক্ষ্মীর পুজো করবে এমন বেআক্কেলে ভক্ত কেই-বা আছে?…

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *