ইয়াজদার্গিদের হিরে (কিশোর কর্নেল) – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ
এক
প্রাইভেট ডিটেকটিভ কে কে হালদার অর্থাৎ আমাদের প্রিয় হালদারমশাই সবেগে ঘরে ঢুকে সশব্দে সোফায় বসে ফ্যাঁসফেঁসে গলায় বলেন, অসম্ভব! অবিশ্বাস্য! অদ্ভু-উ-ত!
তার চোখ দুটো গুলি-গুলি এবং গোঁফের ডগা তির তির করে কাঁপছিল। এ-পকেট ও-পকেট খোঁজাখুঁজি করে ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে বললেন, ফ্যালাইয়া আইছি।
বুঝলাম জিনিসটা নস্যির কৌটো। উত্তেজনার সময় ওঁর মুখে মাতৃভাষা বেরিয়ে আসে। তাছাড়া খানিক নাটুকে স্বভাবের মানুষও বটে। সামান্য ব্যাপারে তিলকে তাল করে ফেলেন। পেশাদার গোয়েন্দা হওয়ার দরুন সবসময় সবকিছুতে সন্দিগ্ধ হয়ে রহস্য খোঁজেন।
বিশালদেহী কর্নেল নীলাদ্রি সরকার চোখ বুজে সম্ভবত কোনও দুর্লভ প্রজাতির প্রজাপতি দেখছিলেন এবং সাদা দাড়িতে হাত বুলিয়ে সেটির জৈব গোত্র বিচার করছিলেন। জানালা দিয়ে ছিটকে পড়া রোদ্দুরে ওঁর চওড়া টাক ঝকমক করছিল। বললেন, অদ্ভুতের সঙ্গে ভূতের সম্পর্ক আছে হালদারমশাই!
হঃ! ঠিক কইছেন, হালদারমশাই সোজা হয়ে বসলেন। ভূত। ভূত!
হাসি চেপে বললাম, কোথায় দেখলেন হালদারমশাই?
হালদারমশাইয়ের মুখে ভয়ের ছাপ ফুটে উঠল। চাপা গলায় বললেন, চৌতিরিশ বৎসর পুলিশে সার্ভিস করছি। রিটায়ার্ড লাইফে প্রাইভেট ডিটেকটিভ অ্যাজেন্সি খুলছি। ড্যাঞ্জারাস-ড্যাঞ্জারাস ক্যাস হাতে লইছি। কখনও ভূত দেখি নাই। কাইলই রাত্রে স্বচক্ষে দ্যাখলাম।
ভূত দেখলেন?
হঃ! ভূত ছাড়া কী? নিজের একখান চক্ষু খুইলা বেসিনে রাখল। জলে ধুইয়া ফের পইরা লইল।
হাসতে-হাসতে বললাম, নকল চোখ বা নকল দাঁত অনেকেই পরেন।
হালদারমশাই চটে গিয়ে বললেন, জয়ন্তবাবু! আমি পোলাপান না। বেসিনের জলে রক্ত দেখছি।
ভূতের শরীরে রক্ত থাকে নাকি?
হালদারমশাই আরও খাপ্পা হয়ে কী বলতে যাচ্ছিলেন, ষষ্ঠীচরণ কফি দিয়ে গেল। ওঁর জন্য স্পেশাল কফি অর্থাৎ তিনভাগ দুধ একভাগ লিকার। উনি কফির দিকে প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়লেন।
আমার বৃদ্ধ প্রকৃতিবিদ বন্ধু এতক্ষণে চোখ খুলে কফির পেয়ালা তুলে নিলেন। অভ্যাসমতো আওড়ালেনও ‘কফি নার্ভকে চাঙ্গা করে’। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ডারউইনসায়েবের বিবর্তনবাদ ভূতের ক্ষেত্রেও খাটে ডার্লিং! নিয়ানডারথ্যাল মানুষ থেকে ক্রোম্যাগনন মানুষ। তা থেকে হোমো-সাপিয়েন্স, আমরা যে-মানুষ। সেইরকম আদিম ভূত থেকে বর্তমান ভূত। এ-ভূতের রক্তও থাকতে পারে। হলিউডে তৈরি সায়েবভূতের ছবি দেখেছে। ড্রাকুলার ভূত রক্তচোষা ভূত ছিল। দিশি ভূত ঘাড় মটকাত। কিন্তু রক্ত খেত না। বিলিতি ভূতের চরিত্রই অন্যরকম। তারা যেমন রক্ত খায়, তেমনই তাদের শরীরে রক্তও থাকে। আধুনিক সায়েবভূত কীরকম, চিন্তা করো!
হালদারমশাই গুলি-গুলি চোখে তাকিয়ে কফি খাচ্ছিলেন। বললেন, কর্নেলস্যার! ঠিক ধরেছেন। লোকটার চেহারা সাহেবগো মতো।
এবার একটু আগ্রহ দেখিয়ে বললাম, ব্যাপারটা খুলে বলুন তো হালদারমশাই!
কফি শেষ করে হালদারমশাই যা বললেন তা মোটামুটি এই :
গতকাল সন্ধ্যায় তিনি দমদম এলাকায় এক অসুস্থ আত্মীয়কে দেখতে গিয়েছিলেন। ফিরতে রাত প্রায় দশটা হয়ে যায়। যশোর রোডের মোড়ে ট্যাক্সি বা বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়েছিলেন। শীতের রাত। ঘন কুয়াশা। রাস্তাঘাট সুনসান নিঝুম। হঠাৎ দেখলেন, তার পাশ দিয়ে একটা লোক রাস্তা পেরিয়ে যাচ্ছে। রাস্তার মধ্যিখানের আইল্যান্ডে বাগান করেছে পুরসভা। ঝোপঝাড়ে কালো হয়ে আছে। লোকটা সেখানে যেতেই কেউ সেই ঝোপ থেকে বেরিয়ে গুলি ছুঁড়ল। অমনই লোকটা তাকে দু-হাতে ধরে ওপরে তুলে আছাড় মারল। তারপর হনহন করে এগিয়ে ওপারের একটা বাড়ির গেটে ঢুকে গেল। কয়েক সেকেন্ডের ঘটনা।
পর-পর কয়েকটা গাড়ি চলে যাওয়ার পর হালদারমশাই দৌড়ে গেলেন। আবছা আলোয় দেখলেন, দলপাকানো রক্তাক্ত একটা দেহ ফুটপাত ঘেঁষে পড়ে আছে। এক্ষেত্রে অন্য কেউ হলে চ্যাঁচামেচি করে লোক ডাকত। কিন্তু হালদারমশাই স্বভাব-গোয়েন্দা। তাই সেই শক্তিমান লোকটার খোঁজেই ছুটে গেলেন।
গেটটা জরাজীর্ণ এবং ভেতরে প্রায় একটা জঙ্গল। তার ভেতর হানাবাড়ির মতো একটা দোতলা বাড়ি। ছায়ার আড়ালে গুঁড়ি মেরে এগিয়ে হালদারমশাই পাঁচিল ডিঙোলেন। আগাছার জঙ্গলে ঢুকে বাড়িটার দিকে তাকিয়ে আছেন, হঠাৎ নীচের একটা ঘরে আলো জ্বলে উঠল।
সাহস করে এগিয়ে একটা খোলা জানালায় উঁকি দিয়ে দেখলেন, সেই লোকটা বাথরুমে বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে আয়নায় নিজের মুখ দেখছে। একটা চোখ রক্তাক্ত। হালদারমশাই বুঝলেন, আততায়ীর গুলি তার চোখেই লেগেছে। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার, সে সেই চোখটা উপড়ে নিয়ে বেসিনে ট্যাপ খুলে ধুল। চোখের গর্ত থেকে সম্ভবত খুদে গুলিটাও টেনে বের করে ফেলল। তারপর চোখটা আবার পরে নিল।
দৃশ্যটা শুধু ভয়ংকর নয়, বীভৎসও। এই পর্যন্ত দেখে হালদারমশাইয়ের নার্ভের অবস্থা শোচনীয়। তিনি আতঙ্কে ঠকঠক করে কাঁপতে-কাঁপতে পালিয়ে এলেন। ততক্ষণে রাস্তায় কিছু লোক জড়ো হয়েছে। গাড়ি চাপা পড়ে দুর্ঘটনা ধরে নিয়েই তারা উত্তেজিত। কিন্তু গোয়েন্দার স্বভাব। হালদারমশাই গুলির শব্দ শুনেছেন। তাই আগ্নেয়াস্ত্রটি খুঁজছিলেন। একটু পরে তা দেখতেও পেলেন। পয়েন্ট ২২ ক্যালিবারের কালচে রঙের রিভলভারটা পড়ে আছে হাত তিরিশেক দূরে ফুটপাতের ওপর। লোকের চোখ এড়িয়ে সেটি কুড়িয়ে নিলেন। তারপর গ্যারাজগামী একটি বাস দৈবাৎ পেয়ে গেলেন।
সারারাত ঘুমোতে পারেননি হালদারমশাই। পুলিশকে জানাতে ভরসা পাননি। কারণ তাকে নিয়ে পুলিশ মহলে প্রচুর ঠাট্টাবিদ্রূপ চালু আছে। তাছাড়া নিজেই এই রহস্যের সমাধান করার লোভ রয়েছে। তাই ভেবেচিন্তে কর্নেলস্যারের লগে কনসাল্ট করতে এসেছেন।….
কর্নেল চোখ বুজে শুনছিলেন। দাঁতের ফাঁকে জ্বলন্ত চুরুট। বললেন, সাহেবের মতো চেহারা?
হালদারমশাই বললেন, কতকটা মানে, মড়ার মতো দেখতে। মাথায় ঝাঁকড়া চুলগুলি কেমন লালচে। গড়নে আমার মতো লম্বা। তবে রোগাও না, মোটাও না।
বয়স অনুমান করতে পারেন?
হালদারমশাই আমাকে দেখিয়ে বললেন, জয়ন্তবাবুর কাছাকাছি হইব।
তা হলে যুবক বলা চলে।
হঃ! জয়ন্তবাবুর মতোই গোঁফদাড়ি কিছু নাই।
পোশাক?
প্যান্ট সোয়েটার। সোয়েটারের রং ব্লু– সরি! নেভি-ব্লু। বলে হালদারমশাই জ্যাকেটের ভেতর পকেট থেকে খুদে একটি আগ্নেয়াস্ত্র বের করে কর্নেলকে দিলেন।
কর্নেল রিভলভারটি কিছুক্ষণ পরীক্ষা করে দেখার পর বললেন, সিক্স রাউন্ডার চিনে অস্ত্র। কাজেই চোরা বেআইনি জিনিস। এটা আমার কাছে রাখতে আপত্তি আছে হালদারমশাই?
হালদারমশাই জোরে মাথা নেড়ে বললেন, নাহ। তবে কর্নেলস্যার, এখনই সেই বাড়িটা চেক করনের দরকার। চলেন, যাই গিয়া।
উৎসাহের সঙ্গে তিনি উঠে দাঁড়িয়েছেন, সেই সময় ডোরবেল বাজল। ষষ্ঠী একটু পরে একটা নেমকার্ড এনে বলল, এক সায়েব বাবামশাই! বেরৎ নাক।
কর্নেল চোখ কটমটিয়ে বললেন, নিয়ে আয়। তারপর অস্ত্রটি টেবিলের ড্রয়ারে ঢোকালেন।
হালদারমশাই ধপাস করে বসে পড়েছিলেন। আমিও একটু চমকে উঠেছিলাম। সায়েবভূতের কথা শোনার পর বেরৎ অর্থাৎ কিনা বৃহৎ নাকওয়ালা সায়েবের আবির্ভাবে বুক ধড়াস করে ওঠারই কথা। হালদারমশাই গুলি-গুলি নিষ্পলক চোখে বাইরের দরজার দিকে তাকিয়ে আছেন। কর্নেল কার্ডটা টেবিলে রেখে বললেন, পার্ক স্ট্রিটের বিখ্যাত ম্যাডান জুয়েলার্সের মালিক এফ এস ম্যাডান।
হালদারমশাই আশ্বস্ত হয়ে শ্বাস ছাড়লেন। আমিও।
সুটপরা ঢ্যাঙা রোগাটে গড়নের এক ভদ্রলোক ঘরে ঢুকে করজোড়ে নমস্কার করে ইংরেজিতে বললেন, আমি কর্নেলসায়েবের সঙ্গে গোপনে কিছু কথা বলতে চাই।
হিরেচুরি সম্পর্কেই কি?
ম্যাডান একটু হেসে বললেন, তা হলে আমি ঠিক লোকের কাছেই এসেছি।
আপনি বসুন। তবে কী অর্থে আমাকে ঠিক লোক বললেন, জানি না। আপনার বাড়ির গোপন বেসমেন্টে রাখা ইস্পাতের ভল্ট থেকে ১৮২ ক্যারেটের একটা হিরে চুরির খবর গত মাসে কাগজে সবিস্তার বেরিয়েছিল। আপনার দাবি, হিরেটি নাকি ঐতিহাসিক।
ম্যাডান আমাদের দেখে নিয়ে বললেন, আমার কিছু গোপন কথা আছে।
কর্নেল আমাদের দুজনের পরিচয় দিয়ে সিরিয়াস ভঙ্গিতে বললেন, আপনার গোপন কথা এঁদের কাছে আমি গোপন রাখতে পারব না, মি. মাদান। কাজেই–
ম্যাডান ওঁর কথার ওপর বললেন, কী বললেন? মাদান? আপনি তা হলে পারসি ভাষা জানেন?
সামান্যই। ম্যাডান স্ট্রিট যাঁর নামে, তিনিও আপনাদের জোরাস্তারি ধর্মের লোক ছিলেন। বাঙালি বসু যেমন ইংরেজিতে বোস হয়েছেন, মাদানও তেমনি ম্যাডান। যাইহোক, বলুন আপনার গোপন কথা।
ম্যাডান একটু ইতস্তত করে বললেন, একমাস হয়ে গেল, পুলিশ কিছু করতে পারল না। ফরেন্সিক রিপোর্টে বলা হয়েছে, লেসার রশ্মি দিয়ে ইস্পাতে ভল্টের একটা অংশ গলিয়েছে চোর। বেসমেন্টে ঢোকার গোপন দরজার লকও গলিয়েছে। এই পর্যন্তই।
আপনি বলেছেন, হিরেটা ঐতিহাসিক। একটু বুঝিয়ে বলুন।
পারসিক সাসানীয় বংশের শেষ সম্রাট ইয়াজদাগির্দের মকুটে এই হিরে বসানো ছিল। তিনিও আমাদের জোরাস্তারি ধর্মাবলম্বী ছিলেন। বর্তমান বাগদাদের কিছু দূরে হিরার যুদ্ধে খ্রিস্টিয় সপ্তম শতকে তিনি আরবদের হাতে পরাজিত হন। তার মুকুট থেকে পবিত্র হিরেটি খুলে নিয়ে পালায় তার এক অনুচর। সে এক দীর্ঘ ইতিহাস। প্রায় সাড়ে তেরশো বছর এ-হাত ও-হাত ঘুরে হিরেটি যায় এক ব্রিটিশ সামরিক অফিসারের হাতে। তার বংশধর গত জুন মাসে নিউইয়র্কের নিলামঘরে সেটি বেচতে দেন। ১২ লক্ষ ডলারে আমার এজেন্ট কিনে নেন। বিশ্বের সব বড়ো নিলামকেন্দ্রে আমার এজেন্ট আছেন। ম্যাডান একটু দম নিয়ে বললেন, দুঃখের কথা কী জানেন কর্নেল সরকার? এই অধম ফিরুজ শাহ মাদানেরই পূর্বপুরুষ সম্রাট ইয়াজদার্গিদের সেই অনুচর। প্রামাণিক ঐতিহাসিক তথ্যও আপনাকে দেখাতে পারি।
কর্নেল একটু চুপ করে থেকে বললেন, পবিত্র হিরে আপনি উদ্ধার করে দিন। এর জন্য যত টাকা লাগে আমি দিতে রাজি। আমি বেশ বুঝতে পেরেছি, পুলিশের পক্ষে এ কাজ দুঃসাধ্য।
নিউ ইয়র্কের নিলামঘরে আপনার এজেন্টের নাম কী?
টেডি পিগার্ড। খুব বিশ্বস্ত লোক। জমিজমা-সম্পত্তির কারবারি। আবার অন্যের হয়ে নিলামঘরে হরেকরকম জিনিস নিলামেও ডাকেন। বলা দরকার কর্নেলসায়েব, আমার মতো ওঁর অনেক মক্কেল আছেন। কিন্তু এ ব্যাপারে মক্কেলের সঙ্গে ওঁর বোঝাপড়া আছে। কোন্ জিনিস কোন্ মক্কেলের হয়ে নিলামে কিনতে চাইছেন বা কেনেন, তা পিগার্ড এবং সেই মক্কেল ছাড়া ঘুণাক্ষরে আর কেউ জানতে পারবে না। পিগার্ড তা জানাবেন না। আপনি তো জানেন, ব্যবসাবাণিজ্যে কিছু নীতি কঠোরভাবে মেনে চলা হয়।
হালদারমশাই কান খাড়া করে শুনছিলেন। বলে উঠলেন, হঃ! ট্রেড সিক্রেট।
ট্রেড সিক্রেট। সায় দিলেন ম্যাডান। এভাবে বহু রত্ন আমি পিগার্ডের মারফত কিনেছি। প্রায় কুড়ি বছরের যোগাযোগ তার সঙ্গে। এই পবিত্র হিরে যে নিলামে বিক্রি হবে, তা পিগার্ডই আমাকে জানিয়েছিলেন। তার কারণ বুঝতেই পারছেন। জোরাস্তারি সম্রাটের মুকুটের হিরে এবং আমিও একজন জোরাস্তারি। তো শুনেই আমি আকাশের চাঁদ হাতে পেলাম। আমাদের পরিবারে বংশপরম্পরা এই হারানো হিরের কাহিনি চালু আছে। আমার ঠাকুরদার হাতে লেখা বৃত্তান্তে এর উল্লেখ আছে। খবর পেয়েই চলে গেলাম নিউইয়র্ক। পিগার্ডকে বললাম, এই হিরে আমার চাই। চিন্তা করুন কর্নেলসায়েব, এ-যাবৎকাল সর্বোচ্চ দরে ওই নিলামঘরে একটুকরো হিরে বিক্রি হল। রেকর্ড দর!
কর্নেল বললেন, পিগার্ডকে আপনি বলেছিলেন হিরেটার সঙ্গে আপনাদের পরিবারের সম্পর্ক আছে?
নাহ। ম্যাডানসায়েব চাপা গলায় বললেন, বলিনি। তার কারণ পিগার্ড তা হলে বেশি কমিশন দাবি করতেন।
আপনার বাড়িতে আর কে আছেন?
আমার মেয়ে খুরশিদ আর জামাই কুসরো। আমার স্ত্রী পাঁচ বছর আগে মারা গেছেন।
আর কেউ আছেন?
আয়া, খানসামা, বাবুর্চি, আমার ড্রাইভার, দারোয়ান- এরা আছে। কিন্তু পবিত্র হিরের ব্যাপারটা তাদের জানার কথা নয়।
আপনার মেয়ে-জামাইয়ের?
তারা জানত।
আপনার জামাই কী করেন?
আমার দোকানের দায়িত্ব তারই হাতে।
কলকাতায় আপনার আত্মীয়স্বজন নিশ্চয় আছেন?
অবশ্যই আছেন।
হালদারমশাই ক্রমশ উত্তেজিত হয়ে উঠছিলেন। নিজস্ব ইংরেজিতে বললেন, ইয়োর ডটার বাই সিলিপ অব টাং-।
ম্যাডান রুষ্টভাবে বলেন, নো!
হালদারমশাই দমে গিয়ে আবার ফেলে আসা নস্যির কৌটো খুঁজতে থাকলেন। কর্নেল বললেন, যাইহোক। সম্রাট ইয়াজদার্গিদের হিরে যে আপনার বাড়িতে আছে এবং কোথায় লুকোনো আছে, সে কথা কেউ জানতে পেরেছিল। সে যদি সত্যি লেসার রশ্মি ব্যবহার করে থাকে, তাহলে বুঝতে হবে, সে একজন বিজ্ঞানী। কারণ এখনও বিজ্ঞানী ছাড়া লেসার রশ্মি ব্যবহার কেউ করতে জানে না। করার ঝুঁকি সাংঘাতিক।
পুলিশও তাই বলছে।
বলে ম্যাডানসায়েব কৌটোর ভেতর পকেট থেকে একটা ব্যাংকের চেকবই বের করলেন। ফি–বাবদ আপনাকে অগ্রিম কিছু টাকা দিতে চাই কর্নেল সরকার। আমি আজ বিকেলের প্লেনে ক’দিনের জন্য বাইরে যাব। দরকার হলে আমার বাড়ি বা দোকানে টেলিফোনে কুসরোর সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। তাকেও বলে যাব আপনার কথা।
ম্যাডান চেকবই খুললে কর্নেল বললেম, দুঃখিত মি. ম্যাডান। আমি ফি নিই না।
সে কি! এই কেসে আপনাকে–।
মি. ম্যাডান, আমি ডিটেকটিভ নই। বলে কর্নেল হালদারমশাইকে দেখিয়ে দিলেন। উনি ডিটেকটিভ। কী হালদারমশাই, কেস নেবেন নাকি?
হালদারমশাই হাসতে গিয়ে গম্ভীর হলেন। ম্যাডান বললেন, কর্নেলসায়েব! আমি কিন্তু আপনার কাছে এসেছি। দয়া করে আপনি কেসটা নিন। আমার বিশ্বাস, আপনিই পবিত্র হিরে উদ্ধার করে দিতে পারবেন।
কর্নেল চোখ বুজে দাড়িতে হাত বুলোতে থাকলেন। কোনও কথা বললেন না।
ম্যাডানসায়েব দ্বিধার সঙ্গে বললেন, দয়া করে যদি আমার সঙ্গে আসেন, আমার বাড়ির গোপন বেসমেন্ট এবং ভল্ট দেখাতে পারি। আমার মনে হচ্ছে, আপনার দেখা দরকার।
কর্নেল বললেন, আপাতত দরকার দেখছি না।
তা হলে আপনি কেস নিচ্ছেন না?
আপনি কবে ফিরছেন বাইরে থেকে?
আগামী রবিবার।
ফিরে এসে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করবেন।
ম্যাডানসায়েব গম্ভীর মুখে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর নমস্কার করে বেরিয়ে গেলেন।
হালদারমশাই লাফিয়ে উঠলেন। ক্যাসটা লইলেন না কর্নেলসার? প্রচুর রহস্য! প্রচুর।
তার চেয়ে সাংঘাতিক রহস্যের খবর আপনি এনেছেন। বলে কর্নেল টেলিফোন তুলে ডায়াল করতে লাগলেন। একটু পরে কাকে বললেন, সোমা নাকি? আমি কর্নেল না! না! শোনো! গত রাত্রে যশোর রোডে একটা অ্যাকসিডেন্ট– হ্যাঁ, হ্যাঁ। আমি ইনটারেস্টেড। পরিচয় পাওয়া গেছে? এক সেকেন্ড। লিখে নিচ্ছি। কর্নেল টেবিলে রাখা প্যাড টেনে কী সব লিখে নিলেন। চাপা দুর্বোধ্য কিছু কথাবার্তাও বললেন।
হালদারমশাই বললেন, ক্কী? ক্কী?
কর্নেল একটু হেসে বললেন, ম্যাডানসায়েবের হঠাৎ এতদিন পরে আমার কাছে আসার কারণ খুঁজছিলাম, হালদারমশাই! আমার যখনই সন্দেহ হয়, কেউ কোনও তথ্য গোপন করে আমার সাহায্য চাইছে, তখন তার কেস নেওয়া আমি পছন্দ করি না। গত রাত্রে আপনার দেখা ভূতটা যাকে আছাড়ে মেরেছে, তার নাম জামসিদ নওরোজি।
চমকে উঠে বললাম, পারসি নাম!
হ্যাঁ। তার চেয়ে বড়ো কথা, ভদ্রলোকের একটা কিউরিয়ো শপ আছে। প্রত্নদ্রব্যের দোকান। বলে কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। আবার তার দোকানটাও ম্যাডান জুয়েলার্সের ওপরতলায়। কাজেই চলুন হালদারমশাই, সেই ভূতের আখড়াটি দেখে আসা যাক। জয়ন্ত! তুমিও চলো তোমাদের দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার জন্য কয়েক কিস্তি লোভনীয় খাদ্য পেয়ে যাবে।
