নষ্টনীড় গল্প – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রথম পরিচ্ছেদ
ভূপতির কাজ করিবার কোনো দরকার ছিল না। তাঁহার টাকা যথেষ্ট ছিল, এবং দেশটাও গরম। কিন্তু গ্রহবশত তিনি কাজের লোক হইয়া জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন। এইজন্য তাঁহাকে একটা ইংরেজি খবরের কাগজ বাহির করিতে হইল। ইহার পরে সময়ের দীর্ঘতার জন্য তাঁহাকে আর বিলাপ করিতে হয় নাই।ছেলেবেলা হইতে তাঁর ইংরেজি লিখিবার এবং বক্তৃতা দিবার শখ ছিল। কোনোপ্রকার প্রয়োজন না থাকিলেও ইংরেজি খবরের কাগজে তিনি চিঠি লিখিতেন, এবং বক্তব্য না থাকিলেও সভাস্থলে দু-কথা না বলিয়া ছাড়িতেন না।তাঁহার মতো ধনী লোককে দলে পাইবার জন্য রাষ্ট্রনৈতিক দলপতিরা অজস্র স্তুতিবাদ করাতে নিজের ইংরেজি রচনাশক্তি সম্বন্ধে তাঁহার ধারণা যথেষ্ট পরিপুষ্ট হইয়া উঠিয়াছিল।
অবশেষে তাঁহার উকিল শ্যালক উমাপতি ওকালতি ব্যবসায়ে হতোদ্যম হইয়া ভগিনীপতিকে কহিল, ‘ভূপতি, তুমি একটা ইংরেজি খবরের কাগজ বাহির করো। তোমার যে রকম অসাধারণ’ ইত্যাদি।
ভূপতি উৎসাহিত হইয়া উঠিল। পরের কাগজে পত্র প্রকাশ করিয়া গৌরব নাই, নিজের কাগজে স্বাধীন কলমটাকে পুরাদমে ছুটাইতে পারিবে। শ্যালককে সহকারী করিয়া নিতান্ত অল্প বয়সেই ভূপতি সম্পাদকের গদিতে আরোহণ করিল।
অল্প বয়সে সম্পাদকি নেশা এবং রাজনৈতিক নেশা অত্যন্ত জোর করিয়া ধরে। ভূপতিকে মাতাইয়া তুলিবার লোকও ছিল অনেক।
এইরূপে সে যতদিন কাগজ লইয়া ভোর হইয়া ছিল ততদিনে তাহার বালিকা বধূ চারুলতা ধীরে ধীরে যৌবনে পর্দাপণ করিল। খবরের কাগজের সম্পাদক এই মস্ত খবরটি ভালো করিয়া টের পাইল না। ভারত গবর্মেন্টের সীমান্তনীতি ক্রমশই স্ফীত হইয়া সংযমের বন্ধন বিদীর্ণ করিবার দিকে যাইতেছে, ইহাই তাহার প্রধান লক্ষের বিষয় ছিল।
ধনীগৃহে চারুলতার কোনো কর্ম ছিল না। ফলপরিণামহীন ফুলের মতো পরিপূর্ণ অনাবশ্যকতার মধ্যে পরিস্ফুট হইয়া উঠাই তাহার চেষ্টাশূন্য দীর্ঘ দিনরাত্রির একমাত্র কাজ ছিল। তাহার কোনো অভাব ছিল না।
এমন অবস্থার সুযোগ পাইলে বধূ স্বামীকে লইয়া অত্যন্ত বাড়াবাড়ি করিয়া থাকে, দাম্পত্যলীলার সীমান্তনীতি সংসারের সমস্ত সীমা লঙ্ঘন করিয়া সময় হইতে অসময়ে এবং বিহিত হইতে অবিহিতে গিয়া উত্তীর্ণ হয়। চারুলতার সে সুযোগ ছিল না। কাগজের আবরণ ভেদ করিয়া স্বামীকে অধিকার করা তাহার পক্ষে দুরূহ হইয়াছিল।
যুবতী স্ত্রীর প্রতি মনোযোগ আকর্ষণ করিয়া কোনো আত্মীয়া তাহাকে ভর্ৎসনা করিলে ভূপতি একবার সচেতন হইয়া কহিল, “তাই তো, চারুর একজন কেউ সঙ্গিনী থাকা উচিত, ও বেচারার কিছুই করিবার নাই।”
শ্যালক উমাপতিকে কহিল, “তোমার স্ত্রীকে আমাদের এখানে আনিয়া রাখো-না–– সমবয়সি স্ত্রীলোক কেহ কাছে নাই, চারুর নিশ্চয়ই ভারি ফাঁকা ঠেকে।”
স্ত্রীসঙ্গের অভাবই চারুর পক্ষে অত্যন্ত শোকাবহ, সম্পাদক এইরূপ বুঝিল এবং শ্যালকজায়া মন্দাকিনীকে বাড়িতে আনিয়া সে নিশ্চিন্ত হইল।
যে সময়ে স্বামী স্ত্রী প্রেমোন্মেষের প্রথম অরুণালোকে পরস্পরের কাছে অপরূপ মহিমায় চিরনূতন বলিয়া প্রতিভাত হয়, দাম্পত্যের সেই স্বর্ণপ্রভামণ্ডিত প্রত্যুষকাল অচেতন অবস্থায় কখন অতীত হইয়া গেল কেহ জানিতে পারিল না। নূতনত্বের স্বাদ না পাইয়াই উভয়ে উভয়ের কাছে পুরাতন পরিচিত অভ্যস্ত হইয়া গেল।
লেখাপড়ার দিকে চারুলতার একটা স্বাভাবিক ঝোঁক ছিল বলিয়া তাহার দিনগুলা অত্যন্ত বোঝা হইয়া উঠে নাই। সে নিজের চেষ্টায় নানা কৌশলে পড়িবার বন্দোবস্ত করিয়া লইয়াছিল। ভূপতির পিসতুতো ভাই অমল থার্ড-ইয়ারে পড়িতেছিল, চারুলতা তাহাকে ধরিয়া পড়া করিয়া লইত; এই কর্মটুকু আদায় করিয়া লইবার জন্য অমলের অনেক আবদার তাহাকে সহ্য করিতে হইত। তাহাকে প্রায়ই হোটেলে খাইবার খোরাকি এবং ইংরেজি সাহিত্যগ্রন্থ কিনিবার খরচা জোগাইতে হইত। অমল মাঝে মাঝে বন্ধুদের নিমন্ত্রণ করিয়া খাওয়াইত, সেই যজ্ঞ-সমাধার ভার গুরুদক্ষিণার স্বরূপ চারুলতা নিজে গ্রহণ করিত। ভূপতি চারুলতার প্রতি কোনো দাবি করিত না, কিন্তু সামান্য একটু পড়াইয়া পিসতুতো ভাই অমলের দাবির অন্ত ছিল না। তাহা লইয়া চারুলতা প্রায় মাঝে মাঝে কৃত্রিম কোপ এবং বিদ্রোহ প্রকাশ করিত; কিন্তু কোনো একটা লোকের কোনো কাজে আসা এবং স্নেহের উপদ্রব সহ্য করা তাহার পক্ষে অত্যাবশ্যক হইয়া উঠিয়াছিল।
অমল কহিল, “বোঠান, আমাদের কলেজের রাজবাড়ির জামাইবাবু রাজঅন্তঃপুরের খাস হাতের বুননি কার্পেটের জুতো পরে আসে, আমার তো সহ্য হয় না–– একজোড়া কার্পেটের জুতো চাই, নইলে কোনোমতেই পদমর্যাদা রক্ষা করতে পারছি নে।”
চারু। হাঁ, তাই বৈকি! আমি বসে বসে তোমার জুতো সেলাই করে মরি। দাম দিচ্ছি, বাজার থেকে কিনে আনো গে যাও।
অমল বলিল, “সেটি হচ্ছে না।”
চারু জুতা সেলাই করিতে জানে না, এবং অমলের কাছে সে কথা স্বীকার করিতেও চাহে না। কিন্তু তাহার কাছে কেহ কিছু চায় না, অমল চায়–– সংসারে সেই একমাত্র প্রার্থীর প্রার্থনা রক্ষা না করিয়া সে থাকিতে পারে না। অমল যে সময় কালেজে যাইত সেই সময়ে সে লুকাইয়া বহু যত্নে কার্পেটের সেলাই শিখিতে লাগিল। এবং অমল নিজে যখন তাহার জুতার দরবার সম্পূর্ণ ভুলিয়া বসিয়াছে এমন সময় একদিন সন্ধ্যাবেলায় চারু তাহাকে নিমন্ত্রণ করিল।
গ্রীষ্মের সময় ছাদের উপর আসন করিয়া অমলের আহারের জায়গা করা হইয়াছে। বালি উড়িয়া পড়িবার ভয়ে পিতলের ঢাকনায় থালা ঢাকা রহিয়াছে। অমল কালেজের বেশ পরিত্যাগ করিয়া মুখ ধুইয়া ফিট্ফাট্ হইয়া আসিয়া উপস্থিত হইল।
অমল আসনে বসিয়া ঢাকা খুলিল; দেখিল, থালায় একজোড়া নূতন-বাঁধানো পশমের জুতা সাজানো রহিয়াছে। চারুলতা উচ্চৈঃস্বরে হাসিয়া উঠিল।
জুতা পাইয়া অমলের আশা আরো বাড়িয়া উঠিল। এখন গলাবন্ধ চাই, রেশমের রুমালে ফুলকাটা পাড় সেলাই করিয়া দিতে হইবে, তাহার বাহিরের ঘরে বসিবার বড়ো কেদারায় তেলের দাগ নিবারণের জন্য একটা কাজ-করা আবরণ আবশ্যক।
প্রত্যেক বারেই চারুলতা আপত্তি প্রকাশ করিয়া কলহ করে এবং প্রত্যেক বারেই বহু যত্নে ও স্নেহে শৌখিন অমলের শখ মিটাইয়া দেয়। অমল মাঝে মাঝে জিজ্ঞাসা করে, “বউঠান, কতদূর হইল।”
চারুলতা মিথ্যা করিয়া বলে, “কিছুই হয় নি।” কখনো বলে, “সে আমার মনেই ছিল না।”
কিন্তু অমল ছাড়িবার পাত্র নয়। প্রতিদিন স্মরণ করাইয়া দেয় এবং আবদার করে। নাছোড়বান্দা অমলের সেই-সকল উপদ্রব উদ্রেক করাইয়া দিবার জন্যই চারু ঔদাসীন্য প্রকাশ করিয়া বিরোধের সৃষ্টি করে এবং হঠাৎ একদিন তাহার প্রার্থনা পূরণ করিয়া দিয়া কৌতুক দেখে।
ধনীর সংসারে চারুকে আর কাহারও জন্য কিছু করিতে হয় না, কেবল অমল তাহাকে কাজ না করাইয়া ছাড়ে না। এ-সকল ছোটোখাটো শখের খাটুনিতেই তাহার হৃদয়বৃত্তির চর্চা এবং চরিতার্থতা হইত।
ভূপতির অন্তঃপুরে যে একখণ্ড জমি পড়িয়া ছিল তাহাকে বাগান বলিলে অনেকটা অত্যুক্তি করা হয়। সেই বাগানের প্রধান বনস্পতি ছিল একটা বিলাতি আমড়া গাছ।
এই ভূখণ্ডের উন্নতিসাধনের জন্য চারু এবং অমলের মধ্যে কমিটি বসিয়াছে। উভয়ে মিলিয়া কিছুদিন হইতে ছবি আঁকিয়া, প্লান করিয়া, মহা উৎসাহে এই জমিটার উপরে একটা বাগানের কল্পনা ফলাও করিয়া তুলিয়াছে।
অমল বলিল, “বউঠান, আমাদের এই বাগানে সেকালের রাজকন্যার মতো তোমাকে নিজের হাতে গাছে জল দিতে হবে।”
চারু কহিল, “আর ঐ পশ্চিমের কোনটাতে একটা কুঁড়ে তৈরি করে নিতে হবে, হরিণের বাচ্ছা থাকবে।”
অমল কহিল, “আর-একটি ছোটোখাটো ঝিলের মতো করতে হবে, তাতে হাঁস চরবে।”
চারু সে প্রস্তাবে উৎসাহিত হইয়া কহিল, “আর তাতে নীলপদ্ম দেব, আমার অনেকদিন থেকে নীলপদ্ম দেখবার সাধ আছে।”
অমল কহিল, “সেই ঝিলের উপর একটি সাঁকো বেঁধে দেওয়া যাবে, আর ঘাটে একটি বেশ ছোটো ডিঙি থাকবে।”
চারু কহিল, “ঘাট অবশ্য সাদা মার্বেলের হবে।”
অমল পেনসিল কাগজ লইয়া রুল কাটিয়া কম্পাস ধরিয়া মহা আড়ম্বরে বাগানের একটা ম্যাপ আঁকিল।
উভয়ে মিলিয়া দিনে দিনে কল্পনার-সংশোধন পরিবর্তন করিতে করিতে বিশ-পঁচিশখানা নূতন ম্যাপ আঁকা হইল।
ম্যাপ খাড়া হইলে কত খরচ হইতে পারে তাহার একটা এস্টিমেট তৈরি হইতে লাগিল। প্রথমে সংকল্প ছিল–– চারু নিজের বরাদ্দ মাসহারা হইতে ক্রমে ক্রমে বাগান তৈরি করিয়া তুলিবে; ভূপতি তো বাড়িতে কোথায় কী হইতেছে তাহা চাহিয়া দেখে না; বাগান তৈরি হইলে তাহাকে সেখানে নিমন্ত্রণ করিয়া আশ্চর্য করিয়া দিবে; সে মনে করিবে, আলাদিনের প্রদীপের সাহায্যে জাপান দেশ হইতে একটা আস্ত বাগান তুলিয়া আনা হইয়াছে।
কিন্তু এস্টিমেট যথেষ্ট কম করিয়া ধরিলেও চারুর সংগতিতে কুলায় না। অমল তখন পুনরায় ম্যাপ পরিবর্তন করিতে বসিল। কহিল, “তা হলে বউঠান, ঐ ঝিলটা বাদ দেওয়া যাক।”
চারু কহিল, “না না, ঝিল বাদ দিলে কিছুতেই চলিবে না, ওতে আমার নীলপদ্ম থাকবে।”
অমল কহিল, “তোমার হরিণের ঘরে টালির ছাদ নাই দিলে। ওটা অমনি একটা সাদাসিধে খোড়ো চাল করলেই হবে।”
চারু অত্যন্ত রাগ করিয়া কহিল, “তা হলে আমার ও ঘরে দরকার নেই–– ও থাক্।”
মরিশস হইতে লবঙ্গ, কর্নাট হইতে চন্দন, এবং সিংহল হইতে দারচিনির চারা আনাইবার প্রস্তাব ছিল, অমল তাহার পরিবর্তে মানিকতলা হইতে সাধারণ দিশি ও বিলাতি গাছের নাম করিতেই চারু মুখ ভার করিয়া বসিল; কহিল, “তা হলে আমার বাগানে কাজ নেই।”
এস্টিমেট কমাইবার এরূপ প্রথা নয়। এস্টিমেটের সঙ্গে সঙ্গে কল্পনাকে খর্ব করা চারুর পক্ষে অসাধ্য এবং অমল মুখে যাহাই বলুক, মনে মনে তাহারও সেটা রুচিকর নয়।
অমল কহিল, “তবে বউঠান, তুমি দাদার কাছে বাগানের কথাটা পাড়ো; তিনি নিশ্চয় টাকা দেবেন।”
চারু কহিল, “না, তাঁকে বললে মজা কী হল। আমরা দুজনে বাগান তৈরি করে তুলব। তিনি তো সাহেববাড়িতে ফরমাশ দিয়ে ইডেন গার্ডেন বানিয়ে দিতে পারেন–– তা হলে আমাদের প্ল্যানের কী হবে।”
আমড়া গাছের ছায়ায় বসিয়া চারু এবং অমল অসাধ্য সংকল্পের কল্পনাসুখ বিস্তার করিতেছিল। চারুর ভাজ মন্দা দোতলা হইতে ডাকিয়া কহিল, “এত বেলায় বাগানে তোরা কী করছিস।”
চারু কহিল, “পাকা আমড়া খুঁজছি।”
লুব্ধা মন্দা কহিল, “পাস যদি আমার জন্যে আনিস।”
চারু হাসিল, অমল হাসিল। তাহাদের সংকল্পগুলির প্রধান সুখ এবং গৌরব এই ছিল যে, সেগুলি তাহাদের দুজনের মধ্যেই আবদ্ধ। মন্দার আর যা-কিছু গুণ থাক্, কল্পনা ছিল না; সে এ-সকল প্রস্তাবের রস গ্রহণ করিবে কী করিয়া। সে এই দুই সভ্যের সকলপ্রকার কমিটি হইতে একেবারে বর্জিত।
অসাধ্য বাগানের এস্টিমেটও কমিল না, কল্পনাও কোনো অংশে হার মানিতে চাহিল না। সুতরাং আমড়াতলার কমিটি এইভাবেই কিছুদিন চলিল। বাগানের যেখানে ঝিল হইবে, যেখানে হরিণের ঘর হইবে, যেখানে পাথরের বেদী হইবে, অমল সেখানে চিহ্ন কাটিয়া রাখিল।
তাহাদের সংকল্পিত বাগানে এই আমড়াতলার চার দিক কী ভাবে বাঁধাইতে হইবে, অমল একটি ছোটো কোদাল লইয়া তাহারই দাগ কাটিতেছিল–– এমন সময় চারু গাছের ছায়ায় বসিয়া বলিল, “অমল, তুমি যদি লিখতে পারতে তা হলে বেশ হত।”
অমল জিজ্ঞাসা করিল, “কেন বেশ হত।”
চারু। তা হলে আমাদের এই বাগানের বর্ণনা করে তোমাকে দিয়ে একটা গল্প লেখাতুম। এই ঝিল, এই হরিণের ঘর, এই আমড়াতলা, সমস্তই তাতে থাকত—আমরা দুজনে ছাড়া কেউ বুঝতে পারত না, বেশ মজা হত। অমল, তুমি একবার লেখবার চেষ্টা করে দেখো-না, নিশ্চয় তুমি পারবে।
অমল কহিল, “আচ্ছা, যদি লিখতে পারি তো আমাকে কী দেবে।”
চারু কহিল, “তুমি কী চাও।”
অমল কহিল, “আমার মশারির চালে আমি নিজে লতা এঁকে দেব, সেইটে তোমাকে আগাগোড়া রেশম দিয়ে কাজ করে দিতে হবে।”
চারু কহিল, “তোমার সমস্ত বাড়াবাড়ি। মশারির চালে আবার কাজ! ”
মশারি জিনিসটাকে একটা শ্রীহীন কারাগারের মতো করিয়া রাখার বিরুদ্ধে অমল অনেক কথা বলিল। সে কহিল, সংসারের পনেরো-আনা লোকের যে সৌন্দর্যবোধ নাই এবং কুশ্রীতা তাহাদের কাছে কিছুমাত্র পীড়াকর নহে ইহাই তাহার প্রমাণ।
চারু সে কথা তৎক্ষণাৎ মনে মনে মানিয়া লইল এবং ‘আমাদের এই দুটি লোকের নিভৃত কমিটি যে সেই পনেরো-আনার অস্তর্গত নহে’ ইহা মনে করিয়া সে খুশি হইল।
কহিল, “আচ্ছা বেশ, আমি মশারির চাল তৈরি করে দেব, তুমি লেখো।”
অমল রহস্যপূর্ণভাবে কহিল, “তুমি মনে কর, আমি লিখতে পারি নে? ”
চারু অত্যন্ত উত্তেজিত হইয়া কহিল, “তবে নিশ্চয় তুমি কিছু লিখেছ, আমাকে দেখাও।”
অমল। আজ থাক্, বউঠান।
চারু। না, আজই দেখাতে হবে–– মাথা খাও, তোমার লেখা নিয়ে এসো গে।
চারুকে তাহার লেখা শোনাইবার অতিব্যগ্রতাতেই অমলকে এতদিন বাধা দিতেছিল। পাছে চারু না বোঝে, পাছে তার ভালো না লাগে, এ সংকোচ সে তাড়াইতে পারিতেছিল না।
আজ খাতা আনিয়া একটুখানি লাল হইয়া, একটুখানি কাশিয়া, পড়িতে আরম্ভ করিল। চারু গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়া ঘাসের উপর পা ছড়াইয়া শুনিতে লাগিল।
প্রবন্ধের বিষয়টা ছিল ‘আমার খাতা’। অমল লিখিয়াছিল–– ‘হে আমার শু খাতা, আমার কল্পনা এখনো তোমাকে স্পর্শ করে নাই। সূতিকাগৃহে ভাগ্যপুরুষ প্রবেশ করিবার পূর্বে শিশুর ললাটপট্টের ন্যায় তুমি নির্মল, তুমি রহস্যময়। যেদিন তোমার শেষ পৃষ্ঠার শেষ ছত্রে উপসংহার লিখিয়া দিব, সেদিন আজ কোথায়! তোমার এই শুভ্র শিশুপত্রগুলি সেই চিরদিনের জন্য মসীচিহ্নিত সমাপ্তির কথা আজ স্বপ্নেও কল্পনা করিতেছে না।’–– ইত্যাদি অনেকখানি লিখিয়াছিল।
চারু তরুচ্ছায়ায় বসিয়া স্তব্ধ হইয়া শুনিতে লাগিল। পড়া শেষ হইলে ক্ষণকাল চুপ করিয়া থাকিয়া কহিল, “তুমি আবার লিখতে পার না! ”
সেদিন সেই গাছের তলায় অমল সাহিত্যের মাদকরস প্রথম পান করিল; সাকী ছিল নবীনা, রসনাও ছিল নবীন এবং অপরাহ্নের আলোক দীর্ঘ ছায়াপাতে রহস্যময় হইয়া আসিয়াছিল।
চারু বলিল, “অমল, গোটাকতক আমড়া পেড়ে নিয়ে যেতে হবে, নইলে মন্দাকে কী হিসেব দেব।”
মূঢ় মন্দাকে তাহাদের পড়াশুনা এবং আলোচনার কথা বলিতে প্রবৃত্তিই হয় না, সুতরাং আমড়া পাড়িয়া লইয়া যাইতে হইল।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
বাগানের সংকল্প তাহাদের অন্যান্য অনেক সংকল্পের ন্যায় সীমাহীন কল্পনাক্ষেত্রের মধ্যে কখন হারাইয়া গেল তাহা অমল এবং চারু লক্ষও করিতে পারিল না।
এখন অমলের লেখাই তাহাদের আলোচনা ও পরামর্শের প্রধান বিষয় হইয়া উঠিল। অমল আসিয়া বলে, “বোঠান, একটা বেশ চমৎকার ভাব মাথায় এসেছে।”
চারু উৎসাহিত হইয়া উঠে; বলে, “চলো, আমাদের দক্ষিণের বারান্দায়–– এখানে এখনই মন্দা পান সাজতে আসবে।”
চারু কাশ্মীরি বারান্দায় একটি জীর্ণ বেতের কেদারায় আসিয়া বসে এবং অমল রেলিঙের নিচেকার উচ্চ অংশের উপর বসিয়া পা ছড়াইয়া দেয়।
অমলের লিখিবার বিষয়গুলি প্রায়ই সুনির্দিষ্ট নহে; তাহা পরিষ্কার করিয়া বলা শক্ত। গোলমাল করিয়া সে যাহা বলিত তাহা স্পষ্ট বুঝা কাহারো সাধ্য নহে। অমল নিজেই বারবার বলিত, “বোঠান, তোমাকে ভালো বোঝাতে পারছি নে।”
চারু বলিত, “না, আমি অনেকটা বুঝতে পেরেছি; তুমি এইটে লিখে ফেলো, দেরি কোরো না।”
সে খানিকটা বুঝিয়া, খানিকটা না বুঝিয়া, অনেকটা কল্পনা করিয়া, অনেকটা অমলের ব্যক্ত করিবার আবেগের দ্বারা উত্তেজিত হইয়া, মনের মধ্যে কী একটা খাড়া করিয়া তুলিত, তাহাতেই সে সুখ পাইত এবং আগ্রহে অধীর হইয়া উঠিত।
চারু সেইদিন বিকালেই জিজ্ঞাসা করিত, “কতটা লিখলে।”
অমল বলিত, “এরই মধ্যে কি লেখা যায়।”
চারু পরদিন সকালে ঈষৎ কলহের স্বরে জিজ্ঞাসা করিত, “কই, তুমি সেটা লিখলে না? ”
অমল বলিত, “রোসো, আর-একটু ভাবি।”
চারু রাগ করিয়া বলিত, “তবে যাও।”
বিকালে সেই রাগ ঘনীভূত হইয়া চারু যখন কথা বন্ধ করিবার জো করিত তখন অমল লেখা কাগজের একটা অংশ রুমাল বাহির করিবার ছলে পকেট হইতে একটুখানি বাহির করিত।
মুহূর্তে চারুর মৌন ভাঙিয়া গিয়া সে বলিয়া উঠিত, “ঐ-যে তুমি লিখেছ! আমাকে ফাঁকি! দেখাও।”
অমল বলিত, “এখনো শেষ হয় নি, আর-একটু লিখে শোনাব।”
চারু। না, এখনই শোনাতে হবে।
অমল এখনই শোনাইবার জন্যই ব্যস্ত; কিন্তু চারুকে কিছুক্ষণ কাড়াকাড়ি না করাইয়া সে শোনাইত না। তার পরে অমল কাগজখানি হাতে করিয়া বসিয়া প্রথমটা একটুখানি পাতা ঠিক করিয়া লইত, পেনসিল লইয়া দুই-এক জায়গায় দুটো-একটা সংশোধন করিতে থাকিত, ততক্ষণ চারুর চিত্ত পুলকিত কৌতূহলে জলভারনত মেঘের মতো সেই কাগজ কয়খানির দিকে ঝুঁকিয়া রহিত।
অমল দুই-চারি প্যারাগ্রাফ যখন যাহা লেখে তাহা যতটুকুই হোক চারুকে সদ্য সদ্য শোনাইতে হয়। বাকি অলিখিত অংশটুকু আলোচনা এবং কল্পনায় উভয়ের মধ্যে মথিত হইতে থাকে।
এতদিন দুজনে আকাশকুসুমের চয়নে নিযুক্ত ছিল, এখন কাব্যকুসুমের চাষ আরম্ভ হইয়া উভয়ে আর-সমস্তই ভুলিয়া গেল।
একদিন অপরাহ্নে অমল কালেজ হইতে ফিরিলে তাহার পকেটটা কিছু অতিরিক্ত ভরা বলিয়া বোধ হইল। অমল যখন বাড়িতে প্রবেশ করিল তখনই চারু অন্তঃপুরের গবাক্ষ হইতে তাহার পকেটের পূর্ণতার প্রতি লক্ষ করিয়াছিল।
অমল অন্যদিন কালেজ হইতে ফিরিয়া বাড়ির ভিতরে আসিতে দেরি করিত না; আজ সে তাহার ভরা পকেট লইয়া বাহিরের ঘরে প্রবেশ করিল, শীঘ্র আসিবার নাম করিল না।
চারু অন্তঃপুরের সীমান্তদেশে আসিয়া অনেকবার তালি দিল, কেহ শুনিল না। চারু কিছু রাগ করিয়া তাহার বারান্দায় মন্মথ দত্তর এক বই হাতে করিয়া পড়িবার চেষ্টা করিতে লাগিল।
মন্মথ দত্ত নূতন গ্রন্থকার। তাহার লেখার ধরন অনেকটা অমলেরই মতো, এইজন্য অমল তাহাকে কখনো প্রশংসা করিত না; মাঝে মাঝে চারুর কাছে তাহার লেখা বিকৃত উচ্চারণে পড়িয়া বিদ্রূপ করিত–– চারু অমলের নিকট হইতে সে বই কাড়িয়া লইয়া অবজ্ঞাভরে দূরে ফেলিয়া দিত।
আজ যখন অমলের পদশব্দ শুনিতে পাইল তখন সেই মন্মথ দত্তর ‘কলকণ্ঠ’-নামক বই মুখের কাছে তুলিয়া ধরিয়া চারু অত্যন্ত একাগ্রভাবে পড়িতে আরম্ভ করিল।
অমল বারান্দায় প্রবেশ করিল, চারু লক্ষও করিল না। অমল কহিল, “কী বোঠান, কী পড়া হচ্ছে।”
চারুকে নিরুত্তর দেখিয়া অমল চৌকির পিছনে আসিয়া বইটা দেখিল। কহিল, “মন্মথ দত্তের গলগণ্ড।”
চারু কহিল, “আঃ, বিরক্ত কোরো না, আমাকে পড়তে দাও।” পিঠের কাছে দাঁড়াইয়া অমল ব্যঙ্গস্বরে পড়িতে লাগিল, “আমি তৃণ, ক্ষুদ্র তৃণ; ভাই রক্তাম্বর রাজবেশধারী অশোক, আমি তৃণমাত্র! আমার ফুল নাই, আমার ছায়া নাই, আমার
মস্তক আমি আকাশে তুলিতে পারি না, বসন্তের কোকিল আমাকে আশ্রয় করিয়া কুহুস্বরে জগৎ মাতায় না –– তবু ভাই অশোক, তোমার ঐ পুষ্পিত উচ্চ শাখা হইতে তুমি আমাকে উপেক্ষা করিয়ো না; তোমার পায়ে পড়িয়া আছি আমি তৃণ, তবু আমাকে তুচ্ছ করিয়ো না।”
অমল এইটুকু বই হইতে পড়িয়া তার পরে বিদ্রূপ করিয়া বানাইয়া বলিতে লাগিল, “আমি কলার কাঁদি, কাঁচকলার কাঁদি, ভাই কুষ্মাণ্ড, ভাই গৃহচালবিহারী কুষ্মাণ্ড, আমি নিতান্তই কাঁচকলার কাঁদি।”
চারু কৌতূহলের তাড়নায় রাগ রাখিতে পারিল না; হাসিয়া উঠিয়া বই ফেলিয়া দিয়া কহিল, “তুমি ভারি হিংসুটে, নিজের লেখা ছাড়া কিছু পছন্দ হয় না।”
অমল কহিল, “তোমার ভারি উদারতা, তৃণটি পেলেও গিলে খেতে চাও।”
চারু। আচ্ছা মশায়, ঠাট্টা করতে হবে না–– পকেটে কী আছে বের করে ফেলো।
অমল। কী আছে আন্দাজ করো।
অনেকক্ষণ চারুকে বিরক্ত করিয়া অমল পকেট হইতে ‘সরোরুহ’-নামক বিখ্যাত মাসিক পত্র বাহির করিল।
চারু দেখিল, কাগজে অমলের সেই ‘খাতা’-নামক প্রবন্ধটি বাহির হইয়াছে।
চারু দেখিয়া চুপ করিয়া রহিল। অমল মনে করিয়াছিল, তাহার বোঠান খুব খুশি হইবে। কিন্তু খুশির বিশেষ কোনো লক্ষণ না দেখিয়া বলিল, ‘সরোরুহ পত্রে যে-সে লেখা বের হয় না।’
অমল এটা কিছু বেশি বলিল। যে-কোনোপ্রকার চলনসই লেখা পাইলে সম্পাদক ছাড়েন না। কিন্তু অমল চারুকে বুঝাইয়া দিল, সম্পাদক বড়োই কড়া লোক, একশো প্রবন্ধের মধ্যে একটা বাছিয়া লন।
শুনিয়া চারু খুশি হইবার চেষ্টা করিতে লাগিল কিন্তু খুশি হইতে পারিল না। কিসে যে সে মনের মধ্যে আঘাত পাইল তাহা বুঝিয়া দেখিবার চেষ্টা করিল; কোনো সংগত কারণ বাহির হইল না।
অমলের লেখা অমল এবং চারু দুজনের সম্পত্তি। অমল লেখক এবং চারু পাঠক। তাহার গোপনতাই তাহার প্রধান রস। সেই লেখা সকলে পড়িবে এবং অনেকেই প্রশংসা করিবে, ইহাতে চারুকে যে কেন এতটা পীড়া দিতেছিল তাহা সে ভালো করিয়া বুঝিল না।
কিন্তু লেখকের আকাঙ্ক্ষা একটিমাত্র পাঠকে অধিকদিন মেটে না। অমল তাহার লেখা ছাপাইতে আরম্ভ করিল। প্রশংসাও পাইল।
মাঝে মাঝে ভক্তের চিঠিও আসিতে লাগিল। অমল সেগুলি তাহার বোঠানকে দেখাইত। চারু তাহাতে খুশিও হইল, কষ্টও পাইল। এখন অমলকে লেখায় প্রবৃত্ত করাইবার জন্য একমাত্র তাহারই উৎসাহ ও উত্তেজনার প্রয়োজন রহিল না। অমল মাঝে মাঝে কদাচিৎ নামস্বাক্ষরবিহীন রমণীর চিঠিও পাইতে লাগিল। তাহা লইয়া চারু তাহাকে ঠাট্টা করিত কিন্তু সুখ পাইত না। হঠাৎ তাহাদের কমিটির রুদ্ধ দ্বার খুলিয়া বাংলাদেশের পাঠকমণ্ডলী তাহাদের দুজনকার মাঝখানে আসিয়া দাঁড়াইল।
ভূপতি একদিন অবসরকালে কহিল, “তাই তো চারু, আমাদের অমল যে এমন ভালো লিখতে পারে তা তো আমি জানতুম না।”
ভূপতির প্রশংসায় চারু খুশি হইল। অমল ভূপতির আশ্রিত, কিন্তু অন্য আশ্রিতদের সহিত তাহার অনেক প্রভেদ আছে এ কথা তাহার স্বামী বুঝিতে পারিলে চারু যেন গর্ব অনুভব করে। তাহার ভাবটা এই যে ‘অমলকে কেন যে আমি এতটা স্নেহ আদর করি এতদিনে তোমরা তাহা বুঝিলে; আমি অনেকদিন আগেই অমলের মর্যাদা বুঝিয়াছিলাম, অমল কাহারো অবজ্ঞার পাত্র নহে।’
চারু জিজ্ঞাসা করিল, “তুমি তার লেখা পড়েছ? ”
ভূপতি কহিল, “হাঁ–– না ঠিক পড়ি নি। সময় পাই নি। কিন্তু আমাদের নিশিকান্ত প’ড়ে খুব প্রশংসা করছিল। সে বাংলা লেখা বেশ বোঝে।”
ভূপতির মনে অমলের প্রতি একটি সম্মানের ভাব জাগিয়া উঠে, ইহা চারুর একান্ত ইচ্ছা।
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
উমাপদ ভূপতিকে তাহার কাগজের সঙ্গে অন্য পাঁচরকম উপহার দিবার কথা বুঝাইতেছিল। উপহার যে কী করিয়া লোকসান কাটাইয়া লাভ হইতে পারে তাহা ভূপতি কিছুতেই বুঝিতে পারিতেছিল না।
চারু একবার ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিয়াই উমাপদকে দেখিয়া চলিয়া গেল। আবার কিছুক্ষণ ঘুরিয়া ফিরিয়া ঘরে আসিয়া দেখিল, দুইজনে হিসাব লইয়া তর্কে প্রবৃত্ত।
উমাপদ চারুর অধৈর্য দেখিয়া কোনো ছুতা করিয়া বাহির হইয়া গেল। ভূপতি হিসাব লইয়া মাথা ঘুরাইতে লাগিল।
চারু ঘরে ঢুকিয়া বলিল, “এখনো বুঝি তোমার কাজ শেষ হইল না। দিনরাত ঐ একখানা কাগজ নিয়ে যে তোমার কী করে কাটে, আমি তাই ভাবি।”
ভূপতি হিসাব সরাইয়া রাখিয়া একটুখানি হাসিল। মনে মনে ভাবিল, “বাস্তবিক চারুর প্রতি আমি মনোযোগ দিবার সময়ই পাই না, বড়ো অন্যায়। ও বেচারার পক্ষে সময় কাটাইবার কিছুই নাই।”
ভূপতি স্নেহপূর্ণস্বরে কহিল, “আজ যে তোমার পড়া নেই! মাস্টারটি বুঝি পালিয়েছেন? তোমার পাঠশালার সব উলটো নিয়ম–– ছাত্রীটি পুঁথিপত্র নিয়ে প্রস্তুত, মাস্টার পলাতক! আজকাল অমল তোমাকে আগেকার মতো নিয়মিত পড়ায় বলে তো বোধ হয় না।”
চারু কহিল, “আমাকে পড়িয়ে অমলের সময় নষ্ট করা কি উচিত। অমলকে তুমি বুঝি একজন সামান্য টিউটর পেয়েছ? ”
ভূপতি চারুর কটিদেশ ধরিয়া কাছে টানিয়া কহিল, “এটা কি সামান্য প্রাইভেট টিউটারি হল। তোমার মতো বউঠানকে যদি পড়াতে পেতুম তা হলে–– ”
চারু। ইস্ ইস্, তুমি আর বোলো না। স্বামী হয়েই রক্ষে নেই তো আরো কিছু!
ভূপতি ঈষৎ একটু আহত হইয়া কহিল, “আচ্ছা, কাল থেকে আমি নিশ্চয় তোমাকে পড়াব। তোমার বইগুলো আনো দেখি, কী তুমি পড় একবার দেখে নিই।”
চারু। ঢের হয়েছে, তোমার আর পড়াতে হবে না। এখনকার মতো তোমার খবরের কাগজের হিসাবটা একটু রাখবে! এখন আর-কোনো দিকে মন দিতে পারবে কি না বলো।
ভূপতি কহিল, “নিশ্চয় পারব। এখন তুমি আমার মনকে যে দিকে ফেরাতে চাও সেই দিকেই ফিরবে।”
চারু। আচ্ছা বেশ, তা হলে অমলের এই লেখাটা একবার পড়ে দেখো কেমন চমৎকার হয়েছে। সম্পাদক অমলকে লিখেছে, এই লেখা পড়ে নবগোপালবাবু তাকে বাংলার রাস্কিন নাম দিয়েছেন।
শুনিয়া ভূপতি কিছু সংকুচিতভাবে কাগজখানা হাতে করিয়া লইল। খুলিয়া দেখিল, লেখাটির নাম “আষাঢ়ের চাঁদ”। গত দুই সপ্তাহ ধরিয়া ভূপতি ভারত গবর্মেন্টের বাজেট-সমালোচনা লইয়া বড়ো বড়ো অঙ্কপাত করিতেছিল, সেই-সকল অঙ্ক বহুপদ কীটের মতো তাহার মস্তিষ্কের নানা বিবরের মধ্যে সঞ্চরণ করিয়া ফিরিতেছিল–– এমন সময় হঠাৎ বাংলা ভাষায় ‘আষাঢ়ের চাঁদ’ প্রবন্ধ আগাগোড়া পড়িবার জন্য তাহার মন প্রস্তুত ছিল না। প্রবন্ধটি নিতান্ত ছোটো নহে।
লেখাটা এইরূপে শুরু হইয়াছে–– ‘আজ কেন আষাঢ়ের চাঁদ সারা রাত মেঘের মধ্যে এমন করিয়া লুকাইয়া বেড়াইতেছে। যেন স্বর্গলোক হইতে সে কী চুরি করিয়া আনিয়াছে, যেন তাহার কলঙ্ক ঢাকিবার স্থান নাই। ফাল্গুন মাসে যখন আকাশের একটি কোণেও মুষ্টিপরিমাণ মেঘ ছিল না তখন তো জগতের চক্ষের সম্মুখে সে নির্লজ্জের মতো উন্মুক্ত আকাশে আপনাকে প্রকাশ করিয়াছিল–– আর আজ তাহার সেই ঢলঢল হাসিখানি–– শিশুর স্বপ্নের মতো, প্রিয়ার স্মৃতির মতো, সুরেশ্বরী শচীর অলকবিলম্বিত মুক্তার মালার মতো––’
ভূপতি মাথা চুলকাইয়া কহিল, “বেশ লিখেছে। কিন্তু আমাকে কেন। এ-সব কবিত্ব কি আমি বুঝি।”
চারু সংকুচিত হইয়া ভূপতির হাত হইতে কাগজখানা কাড়িয়া কহিল, “তুমি তবে কী বোঝে।”
ভূপতি কহিল, “আমি সংসারের লোক, আমি মানুষ বুঝি।”
চারু কহিল, “মানুষের কথা বুঝি সাহিত্যের মধ্যে লেখে না? ”
ভূপতি। ভুল লেখে। তা ছাড়া মানুষ যখন সশরীরে বর্তমান তখন বানানো কথার মধ্যে তাকে খুঁজে বেড়াবার দরকার?
বলিয়া চারুলতার চিবুক ধরিয়া কহিল, “এই যেমন আমি তোমাকে বুঝি, কিন্তু সেজন্য কি ‘মেঘনাদবধ’ ‘কবিকঙ্কণ চণ্ডী’ আগাগোড়া পড়ার দরকার আছে।”
ভূপতি কাব্য বোঝে না বলিয়া অহংকার করিত। তবু অমলের লেখা ভালো করিয়া না পড়িয়াও তাহার প্রতি মনে মনে ভূপতির একটা শ্রদ্ধা ছিল। ভূপতি ভাবিত, ‘বলিবার কথা কিছুই নাই অথচ এত কথা অনর্গল বানাইয়া বলা সে তো আমি মাথা কুটিয়া মরিলেও পারিতাম না। অমলের পেটে যে এত ক্ষমতা ছিল তাহা কে জানিত।’
ভূপতি নিজের রসজ্ঞতা অস্বীকার করিত কিন্তু সাহিত্যের প্রতি তাহার কৃপণতা ছিল না। দরিদ্র লেখক তাহাকে ধরিয়া পড়িলে বই ছাপিবার খরচ ভূপতি দিত, কেবল বিশেষ করিয়া বলিয়া দিত, “আমাকে যেন উৎসর্গ করা না হয়।” বাংলা ছোটো বড়ো সমস্ত সাপ্তাহিক এবং মাসিক পত্র, খ্যাত অখ্যাত পাঠ্য অপাঠ্য সমস্ত বই সে কিনিত। বলিত, “একে পড়ি না, তার পরে যদি না কিনি তবে পাপও করিব প্রায়শ্চিত্তও হইবে না।” পড়িত না বলিয়াই মন্দ বইয়ের প্রতি তাহার লেশমাত্র বিদ্বেষ ছিল না, সেইজন্য তাহার বাংলা লাইব্রেরি গ্রন্থে পরিপূর্ণ ছিল।
অমল ভূপতির ইংরেজি প্রুফ-সংশোধন-কার্যে সাহায্য করিত; কোনো-একটা কাপির দুর্বোধ্য হস্তাক্ষর দেখাইয়া লইবার জন্য সে একতাড়া কাগজপত্র লইয়া ঘরে ঢুকিল।
ভূপতি হাসিয়া কহিল, “অমল, তুমি আষাঢ়ের চাঁদ আর ভাদ্র মাসের পাকা তালের উপর যতখুশি লেখো, আমি তাতে কোনো আপত্তি করি নে–– আমি কারো স্বাধীনতায় হাত দিতে চাই নে–– কিন্তু আমার স্বাধীনতায় কেন হস্তক্ষেপ। সেগুলো আমাকে না পড়িয়ে ছাড়বেন না, তোমার বোঠানের এ কী অত্যাচার।”
অমল হাসিয়া কহিল, “তাই তো বোঠান–– আমার লেখাগুলো নিয়ে তুমি যে দাদাকে জুলুম করবার উপায় বের করবে, এমন জানলে আমি লিখতুম না।”
সাহিত্যরসে বিমুখ ভূপতির কাছে আনিয়া তাহার অত্যন্ত দরদের লেখাগুলিকে অপদস্থ করাতে অমল মনে মনে চারুর উপর রাগ করিল এবং চারু তৎক্ষণাৎ তাহা বুঝিতে পারিয়া বেদনা পাইল। কথাটাকে অন্য দিকে লইয়া যাইবার জন্য ভূপতিকে কহিল, “তোমার ভাইটির একটি বিয়ে দিয়ে দাও দেখি, তা হলে আর লেখার উপদ্রব সহ্য করতে হবে না।”
ভূপতি কহিল, “এখনকার ছেলেরা আমাদের মতো নির্বোধ নয়। তাদের যত কবিত্ব লেখায়, কাজের বেলায় সেয়ানা। কই, তোমার দেওরকে তো বিয়ে করতে রাজি করাতে পারলে না।”
চারু চলিয়া গেলে ভূপতি অমলকে কহিল, “অমল, আমাকে এই কাগজের হাঙ্গামে থাকতে হয়, চারু বেচারা বড়ো একলা পড়েছে। কোনো কাজকর্ম নেই, মাঝে মাঝে আমার এই লেখবার ঘরে উঁকি মেরে চলে যায়। কী করব বলো। তুমি, অমল, ওকে একটু পড়াশুনোয় নিযুক্ত রাখতে পারলে ভালো হয়। মাঝে মাঝে চারুকে যদি ইংরেজি কাব্য থেকে তর্জমা করে শোনাও তা হলে ওর উপকারও হয়, ভালোও লাগে। চারুর সাহিত্যে বেশ রুচি আছে।”
অমল কহিল, “তা আছে। বোঠান যদি আরো একটু পড়াশুনো করেন তা হলে আমার বিশ্বাস উনি নিজে বেশ ভালো লিখতে পারবেন।”
ভূপতি হাসিয়া কহিল, “ততটা আশা করি নে, কিন্তু চারু বাংলা লেখার ভালোমন্দ আমার চেয়ে ঢের বুঝতে পারে।”
অমল। ওঁর কল্পনাশক্তি বেশ আছে, স্ত্রীলোকের মধ্যে এমন দেখা যায় না।
ভূপতি। পুরুষের মধ্যেও কম দেখা যায়, তার সাক্ষী আমি। আচ্ছা, তুমি তোমার বউঠাকরুনকে যদি গড়ে তুলতে পার আমি তোমাকে পারিতোষিক দেব।
অমল। কী দেবে শুনি।
ভূপতি। তোমার বউঠাকরুনের জুড়ি একটি খুঁজে-পেতে এনে দেব।
অমল। আবার তাকে নিয়ে পড়তে হবে! চিরজীবন কি গড়ে তুলতেই কাটাব।
দুটি ভাই আজকালকার ছেলে, কোনো কথা তাহাদের মুখে বাধে না।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
পাঠকসমাজে প্রতিপত্তি লাভ করিয়া অমল এখন মাথা তুলিয়া উঠিয়াছে। আগে সে স্কুলের ছাত্রটির মতো থাকিত, এখন সে যেন সমাজের গণ্যমান্য মানুষের মতো হইয়া উঠিয়াছে। মাঝে মাঝে সভায় সাহিত্যপ্রবন্ধ পাঠ করে– সম্পাদক ও সম্পাদকের দূত তাহার ঘরে আসিয়া বসিয়া থাকে, তাহাকে নিমন্ত্রণ করিয়া খাওয়ায়, নানা সভার সভ্য ও সভাপতি হইবার জন্য তাহার নিকট অনুরোধ আসে, ভূপতির ঘরে দাসদাসী-আত্মীয়স্বজনের চক্ষে তাহার প্রতিষ্ঠাস্থান অনেকটা উপরে উঠিয়া গেছে।
মন্দাকিনী এতদিন তাহাকে বিশেষ একটা কেহ বলিয়া মনে করে নাই। অমল ও চারুর হাস্যালাপ-আলোচনাকে সে ছেলেমানুষি বলিয়া উপেক্ষা করিয়া পান সাজিত ও ঘরের কাজকর্ম করিত; নিজেকে সে উহাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ এবং সংসারের পক্ষে আবশ্যক বলিয়াই জানিত।
অমলের পান খাওয়া অপরিমিত ছিল। মন্দার উপর পান সাজিবার ভার থাকাতে সে পানের অযথা অপব্যয়ে বিরক্ত হইত। অমলে চারুতে ষড়যন্ত্র করিয়া মন্দার পানের ভাণ্ডার প্রায়ই লুঠ করিয়া আনা তাহাদের একটা আমোদের মধ্যে ছিল। কিন্তু এই শৌখিন চোর দুটির চৌর্যপরিহাস মন্দার কাছে আমোদজনক বোধ হইত না।
আসল কথা, একজন আশ্রিত অন্য আশ্রিতকে প্রসন্নচক্ষে দেখে না। অমলের জন্য মন্দাকে যেটুকু গৃহকর্ম অতিরিক্ত করিতে হইত সেটুকুতে সে যেন কিছু অপমান বোধ করিত। চারু অমলের পক্ষপাতী ছিল বলিয়া মুখ ফুটিয়া কিছু বলিতে পারিত না, কিন্তু অমলকে অবহেলা করিবার চেষ্টা তাহার সর্বদাই ছিল। সুযোগ পাইলেই দাসদাসীদের কাছেও গোপনে অমলের নামে খোঁচা দিতে সে ছাড়িত না। তাহারাও যোগ দিত।
কিন্তু অমলের যখন অভ্যুত্থান আরম্ভ হইল তখন মন্দার একটু চমক লাগিল। সে অমল এখন আর নাই। এখন তাহার সংকুচিত নম্রতা একেবারে ঘুচিয়া গেছে। অপরকে অবজ্ঞা করিবার অধিকার এখন যেন তাহারই হাতে। সাংসারে প্রতিষ্ঠা প্রাপ্ত হইয়া যে পুরুষ অসংশয়ে অকুণ্ঠিতভাবে নিজেকে প্রচার করিতে পারে, যে লোক একটা নিশ্চিত অধিকার লাভ করিয়াছে, সেই সমর্থ পুরুষ সহজেই নারীর দৃষ্টি আকর্ষণ করিতে পারে। মন্দা যখন দেখিল অমল চারি দিক হইতেই শ্রদ্ধা পাইতেছে তখন সেও অমলের উচ্চ মস্তকের দিকে মুখ তুলিয়া চাহিল। অমলের তরুণ মুখে নবগৌরবের গর্বোজ্জ্বল দীপ্তি
মন্দার চক্ষে মোহ আনিল; সে যেন অমলকে নূতন করিয়া দেখিল।
এখন আর পান চুরি করিবার প্রয়োজন রহিল না। অমলের খ্যাতিলাভে চারুর এই আর-একটা লোকসান; তাহাদের ষড়যন্ত্রের কৌতুকবন্ধনটুকু বিচ্ছিন্ন হইয়া গেল; পান এখন অমলের কাছে আপনি আসিয়া পড়ে, কোনো অভাব হয় না।
তাহা ছাড়া, তাহাদের দুইজনে, গঠিত দল হইতে মন্দাকিনীকে নানা কৌশলে দূরে রাখিয়া তাহারা যে আমোদ বোধ করিত, তাহাও নষ্ট হইবার উপক্রম হইয়াছে। মন্দাকে তফাতে রাখা কঠিন হইল। অমল যে মনে করিবে চারুই তাহার একমাত্র বন্ধু ও সমজদার, ইহা মন্দার ভালো লাগিত না। পূর্বকৃত অবহেলা সে সুদে আসলে শোধ দিতে উদ্যত। সুতরাং অমলে চারুতে মুখোমুখি হইলেই মন্দা কোনো ছলে মাঝখানে আসিয়া ছায়া ফেলিয়া গ্রহণ লাগাইয়া দিত। হঠাৎ মন্দার এই পরিবর্তন লইয়া চারু তাহার অসাক্ষাতে যে পরিহাস করিবে সে অবসরটুকু পাওয়া শক্ত হইল।
মন্দার এই অনাহূত প্রবেশ চারুর কাছে যত বিরক্তিকর বোধ হইত অমলের কাছে ততটা বোধ হয় নাই, এ কথা বলা বাহুল্য। বিমুখ রমণীর মন ক্রমশ তাহার দিকে যে ফিরিতেছে, ইহাতে ভিতরে ভিতরে সে একটা আগ্রহ অনুভব করিতেছিল।
কিন্তু চারু যখন দূর হইতে মন্দাকে দেখিয়া তীব্র মৃদুস্বরে বলিত “ঐ আসছেন” তখন অমলও বলিত, “তাই তো, জ্বালালে দেখছি।” পৃথিবীর অন্য-সকল সঙ্গের প্রতি অসহিষ্ণুতা প্রকাশ করা তাহাদের একটা দস্তুর ছিল; অমল সেটা হঠাৎ কী বলিয়া ছাড়ে। অবশেষে মন্দাকিনী নিকটবর্তিনী হইলে অমল যেন বলপূর্বক সৌজন্য করিয়া বলিত, “তার পরে, মন্দা-বউঠান, আজ তোমার পানের বাটায় বাটপাড়ির লক্ষণ কিছু দেখলে! ”
মন্দা। যখন চাইলেই পাও ভাই, তখন চুরি করবার দরকার!
অমল। চেয়ে পাওয়ার চেয়ে তাতে সুখ বেশি।
মন্দা। তোমরা কী পড়ছিলে পড়ো-না, ভাই। থামলে কেন। পড়া শুনতে আমার বেশ লাগে।
ইতিপূর্বে পাঠানুরাগের জন্য খ্যাতি অর্জন করিতে মন্দার কিছুমাত্র চেষ্টা দেখা যায় নাই, কিন্তু ‘কালোহি বলবত্তরঃ।’
চারুর ইচ্ছা নহে অরসিকা মন্দার কাছে অমল পড়ে, অমলের ইচ্ছা মন্দাও তাহার লেখা শোনে।
চারু। অমল কমলাকান্তের দপ্তরের সমালোচনা লিখে এনেছে, সে কি তোমার––
মন্দা। হলেমই বা মুখ্খু, তবু শুনলে কি একেবারেই বুঝতে পারি নে।
তখন আর-একদিনের কথা অমলের মনে পড়িল। চারুতে মন্দাতে বিন্তি খেলিতেছে, সে তাহার লেখা হাতে করিয়া খেলাসভায় প্রবেশ করিল। চারুকে শুনাইবার জন্য সে অধীর, খেলা ভাঙিতেছে না দেখিয়া সে বিরক্ত। অবশেষে বলিয়া উঠিল, “তোমরা তবে খেলো বউঠান, আমি অখিলবাবুকে লেখাটা শুনিয়ে আসি গে।”
চারু অমলের চাদর চাপিয়া কহিল, “আঃ, বোসো-না, যাও কোথায়।” বলিয়া তাড়াতাড়ি হারিয়া খেলা শেষ করিয়া দিল।
মন্দা বলিল, “তোমাদের পড়া আরম্ভ হবে বুঝি? তবে আমি উঠি।”
চারু ভদ্রতা করিয়া কহিল, “কেন, তুমিও শোনো-না ভাই।”
মন্দা। না ভাই, আমি তোমাদের ও-সব ছাইপাঁশ কিছুই বুঝি নে; আমার কেবল ঘুম পায়। বলিয়া সে অকালে খেলাভঙ্গে উভয়ের প্রতি অত্যন্ত বিরক্ত হইয়া চলিয়া গেল।
সেই মন্দা আজ কমলাকান্তের সমালোচনা শুনিবার জন্য উৎসুক। অমল কহিল, “তা বেশ তো মন্দা-বউঠান, তুমি শুনবে সে তো আমার সৌভাগ্য।” বলিয়া পাত উলটাইয়া আবার গোড়া হইতে পড়িবার উপক্রম করিল; লেখার আরম্ভে সে অনেকটা পরিমাণ রস ছড়াইয়াছিল, সেটুকু বাদ দিয়া পড়িতে তাহার প্রবৃত্তি হইল না।
চারু তাড়াতাড়ি বলিল, “ঠাকুরপো, তুমি যে বলেছিলে জাহ্নবী লাইব্রেরি থেকে পুরোনো মাসিক পত্র কতকগুলো এনে দেবে।”
অমল। সে তো আজ নয়।
চারু। আজই তো। বেশ। ভুলে গেছ বুঝি।
অমল। ভুলব কেন। তুমি যে বলেছিলে––
চারু। আচ্ছা বেশ, এনো না। তোমরা পড়ো। আমি যাই, পরেশকে লাইব্রেরিতে পাঠিয়ে দিই গে। বলিয়া চারু উঠিয়া পড়িল।
অমল বিপদ আশঙ্কা করিল। মন্দা মনে মনে বুঝিল এবং মুহূর্তের মধ্যেই চারুর প্রতি তাহার মন বিষাক্ত হইয়া উঠিল। চারু চলিয়া গেলে অমল যখন উঠিবে কি না ভাবিয়া ইতস্তত করিতেছিল মন্দা ঈষৎ হাসিয়া কহিল, “যাও ভাই, মান ভাঙাও গে; চারু রাগ করেছে। আমাকে লেখা শোনালে মুশকিলে পড়বে।”
ইহার পরে অমলের পক্ষে ওঠা অত্যন্ত কঠিন। অমল চারুর প্রতি কিছু রুষ্ট হইয়া কহিল, “কেন, মুশকিল কিসের।” বলিয়া লেখা বিস্তৃত করিয়া পড়িবার উপক্রম করিল।
মন্দা দুই হাতে তাহার লেখা আচ্ছাদন করিয়া বলিল, “কাজ নেই ভাই, পোড়ো না।” বলিয়া, যেন অশ্রু সংবরণ করিয়া, অন্যত্র চলিয়া গেল।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
চারু নিমন্ত্রণে গিয়াছিল। মন্দা ঘরে বসিয়া চুলের দড়ি বিনাইতেছিল। “বউঠান” বলিয়া অমল ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিল। মন্দা নিশ্চয় জানিত যে, চারুর নিমন্ত্রণে যাওয়ার সংবাদ অমলের অগোচর ছিল না; হাসিয়া কহিল, “আহা অমলবাবু, কাকে খুঁজতে এসে কার দেখা পেলে। এমনি তোমার অদৃষ্ট।” অমল কহিল, “বাঁ দিকের বিচালিও যেমন ডান দিকের বিচালিও ঠিক তেমনি, গর্দভের পক্ষে দুইই সমান আদরের।” বলিয়া সেইখানে বলিয়া গেল।
অমল। মন্দা-বোঠান, তোমাদের দেশের গল্প বলো, আমি শুনি।
লেখার বিষয় সংগ্রহ করিবার জন্য অমল সকলের সব কথা কৌতূহলের সহিত শুনিত। সেই কারণে মন্দাকে এখন সে আর পূর্বের ন্যায় সম্পূর্ণ উপেক্ষা করিত না। মন্দার মনস্তত্ত্ব, মন্দার ইতিহাস, এখন তাহার কাছে ঔৎসুক্যজনক। কোথায় তাহার জন্মভূমি, তাহাদের গ্রামটি কিরূপ, ছেলেবেলা কেমন করিয়া কাটিত, বিবাহ হইল কবে, ইত্যাদি সকল কথাই সে খুঁটিয়া খুঁটিয়া জিজ্ঞাসা করিতে লাগিল। মন্দার ক্ষুদ্র জীবনবৃত্তান্ত সম্বন্ধে এত কৌতূহল কেহ কখনো প্রকাশ করে নাই। মন্দা আনন্দে নিজের কথা বকিয়া যাইতে লাগিল; মাঝে মাঝে কহিল, “কী বকছি তার ঠিক নাই।”
অমল উৎসাহ দিয়া কহিল, “না, আমার বেশ লাগছে, বলে যাও।” মন্দার বাপের এক কানা গোমস্তা ছিল, সে তাহার দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়া করিয়া এক-একদিন অভিমানে অনশনব্রত গ্রহণ করিত, অবশেষে ক্ষুধার জ্বালায় মন্দাদের বাড়িতে কিরূপে গোপনে আহার করিতে আসিত এবং দৈবাৎ একদিন স্ত্রীর কাছে কিরূপে ধরা পড়িয়াছিল, সেই গল্প যখন হইতেছে এবং অমল মনোযোগের সহিত শুনিতে শুনিতে সকৌতুকে হাসিতেছে, এমন সময় চারু ঘরের মধ্যে আসিয়া প্রবেশ করিল।
গল্পের সূত্র ছিন্ন হইয়া গেল। তাহার আগমনে হঠাৎ একটা জমাট সভা ভাঙিয়া গেল, চারু তাহা স্পষ্টই বুঝিতে পারিল।
অমল জিজ্ঞাসা করিল, “বউঠান, এত সকাল-সকাল ফিরে এলে যে।”
চারু কহিল, “তাই তো দেখছি। বেশি সকাল-সকালই ফিরেছি।” বলিয়া চলিয়া যাইবার উপক্রম করিল।
অমল কহিল, “ভালোই করেছ, বাঁচিয়েছ আমাকে। আমি ভাবছিলুম, কখন না জানি ফিরবে। মন্মথ দত্তর ‘সন্ধ্যার পাখি’ বলে নূতন বইটা তোমাকে পড়ে শোনাব বলে এনেছি।”
চারু। এখন থাক্, আমার কাজ আছে।
অমল। কাজ থাকে তো আমাকে হুকুম করো, আমি করে দিচ্ছি।
চারু জানিত অমল আজ বই কিনিয়া আনিয়া তাহাকে শুনাইতে আসিবে; চারু ঈর্ষা জন্মাইবার জন্য মন্মথর লেখার প্রচুর প্রশংসা করিবে এবং অমল সেই বইটাকে বিকৃত করিয়া পড়িয়া বিদ্রূপ করিতে থাকিবে। এই-সকল কল্পনা করিয়াই অধৈর্যবশত সে অকালে নিমন্ত্রণগৃহের সমস্ত অনুনয়বিনয় লঙ্ঘন করিয়া অসুখের ছুতায় গৃহে চলিয়া আসিতেছে। এখন বারবার মনে করিতেছে, ‘সেখানে ছিলাম ভালো, চলিয়া আসা অন্যায় হইয়াছে।’
মন্দাও তো কম বেহায়া নয়। একলা অমলের সহিত একঘরে বসিয়া দাঁত বাহির করিয়া হাসিতেছে। লোকে দেখিলে কী বলিবে। কিন্তু মন্দাকে এ কথা লইয়া ভর্ৎসনা করা চারুর পক্ষে বড়ো কঠিন। কারণ, মন্দা যদি তাহারই দৃষ্টান্তের উল্লেখ করিয়া জবাব দেয়। কিন্তু সে হইল এক, আর এ হইল এক। সে অমলকে রচনায় উৎসাহ দেয়, অমলের সঙ্গে সাহিত্যালোচনা করে, কিন্তু মন্দার তো সে উদ্দেশ্য আদবেই নয়। মন্দা নিঃসন্দেহই সরল যুবককে মুগ্ধ করিবার জন্য জাল বিস্তার করিতেছে। এই ভয়ংকর বিপদ হইতে বেচারা অমলকে রক্ষা করা তাহারই কর্তব্য। অমলকে এই মায়াবিনীর মতলব কেমন করিয়া বুঝাইবে। বুঝাইলে তাহার প্রলোভনের নিবৃত্তি না হইয়া যদি উলটা হয়।
বেচারা দাদা! তিনি তাঁহার স্বামীর কাগজ লইয়া দিন রাত খাটিয়া মরিতেছেন, আর মন্দা কিনা কোণটিতে বসিয়া অমলকে ভুলাইবার জন্য আয়োজন করিতেছে। দাদা বেশ নিশ্চিন্ত আছেন। মন্দার উপরে তাঁর অগাধ বিশ্বাস। এ-সকল ব্যাপার চারু কী করিয়া স্বচক্ষে দেখিয়া স্থির থাকিবে। ভারি অন্যায়।
কিন্তু আগে অমল বেশ ছিল, যেদিন হইতে লিখিতে আরম্ভ করিয়া নাম করিয়াছে সেই দিন হইতেই যত অনর্থ দেখা যাইতেছে। চারুই তো তাহার লেখার গোড়া। কুক্ষণে সে অমলকে রচনায় উৎসাহ দিয়াছিল। এখন কি আর অমলের ’পরে তাহার পূর্বের মতো জোর খাটিবে। এখন অমল পাঁচজনের আদরের স্বাদ পাইয়াছে, অতএব একজনকে বাদ দিলে তাহার আসে যায় না।
চারু স্পষ্টই বুঝিল, তাহার হাত হইতে গিয়া পাঁচজনের হাতে পড়িয়া অমলের সমূহ বিপদ। চারুকে অমল এখন নিজের ঠিক সমকক্ষ বলিয়া জানে না; চারুকে সে ছাড়াইয়া গেছে। এখন সে লেখক, চারু পাঠক। ইহার প্রতিকার করিতেই হইবে।
আহা, সরল অমল, মায়াবিনী মন্দা, বেচারা দাদা।
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
সেদিন আষাঢ়ের নবীন মেঘে আকাশ আচ্ছন্ন। ঘরের মধ্যে অন্ধকার ঘনীভূত হইয়াছে বলিয়া চারু তাহার খোলা জানালার কাছে একান্ত ঝুঁকিয়া পড়িয়া কী একটা লিখিতেছে।
অমল কখন নিঃশব্দপদে পশ্চাতে আসিয়া দাঁড়াইল তাহা সে জানিতে পারিল না। বাদলার স্নিগ্ধ আলোকে চারু লিখিয়া গেল, অমল পড়িতে লাগিল। পাশে অমলেরই দুই-একটা ছাপানো লেখা খোলা পড়িয়া আছে; চারুর কাছে সেইগুলিই রচনার একমাত্র আদর্শ।
“তবে যে বল, তুমি লিখতে পার না! ” হঠাৎ অমলের কণ্ঠ শুনিয়া চারু অত্যন্ত চমকিয়া উঠিল;
তাড়াতাড়ি খাতা লুকাইয়া ফেলিল; কহিল, “তোমার ভারি অন্যায়।”
অমল। কী অন্যায় করেছি।
চারু। নুকিয়ে নুকিয়ে দেখছিলে কেন।
অমল। প্রকাশ্যে দেখতে পাই নে বলে।
চারু তাহার লেখা ছিঁড়িয়া ফেলিবার উপক্রম করিল। অমল ফস্ করিয়া তাহার হাত হইতে খাতা কাড়িয়া লইল। চারু কহিল, “তুমি যদি পড় তোমার সঙ্গে জন্মের মতো আড়ি।”
অমল। যদি পড়তে বারণ কর তা হলে তোমার সঙ্গে জন্মের মত আড়ি।
চারু। আমার মাথা খাও ঠাকুরপো, পোড়ো না।
অবশেষে চারুকেই হার মানিতে হইল। কারণ, অমলকে তাহার লেখা দেখাইবার জন্য মন ছট্ফট্ করিতেছিল, অথচ দেখাইবার বেলায় যে তাহার এত লজ্জা করিবে তাহা সে ভাবে নাই। অমল যখন অনেক অনুনয় করিয়া পড়িতে আরম্ভ করিল তখন লজ্জায় চারুর হাত-পা বরফের মতো হিম হইয়া গেল। কহিল, “আমি পান নিয়ে আসি গে।” বলিয়া তাড়াতাড়ি পাশের ঘরে পান সাজিবার উপলক্ষ করিয়া চলিয়া গেল।
অমল পড়া সাঙ্গ করিয়া চারুকে গিয়া কহিল, “চমৎকার হয়েছে।”
চারু পানে খয়ের দিতে ভুলিয়া কহিল, “যাও, আর ঠাট্টা করতে হবে না। দাও, আমার খাতা দাও।”
অমল কহিল, “খাতা এখন দেব না, লেখাটা কপি করে নিয়ে কাগজে পাঠাব।”
চারু। হাঁ, কাগজে পাঠাবে বৈকি! সে হবে না।
চারু ভারি গোলমাল করিতে লাগিল। অমলও কিছুতে ছাড়িল না। সে যখন বারবার শপথ করিয়া কহিল, “কাগজে দিবার উপযুক্ত হইয়াছে” তখন চারু যেন নিতান্ত হতাশ হইয়া কহিল, “তোমার সঙ্গে তো পেরে ওঠবার জো নেই! যেটা ধরবে সে আর কিছুতেই ছাড়বে না! ”
অমল কহিল, “দাদাকে একবার দেখাতে হবে।”
শুনিয়া চারু পান সাজা ফেলিয়া আসন হইতে বেগে উঠিয়া পড়িল; খাতা কাড়িবার চেষ্টা করিয়া কহিল, “না, তাঁকে শোনাতে পাবে না। তাঁকে যদি আমার লেখার কথা বল তা হলে আমি আর এক অক্ষর লিখব না।”
অমল। বউঠান, তুমি ভারি ভুল বুঝছ। দাদা মুখে যাই বলুন, তোমার লেখা দেখলে খুব খুশি হবেন।
চারু। তা হোক, আমার খুশিতে কাজ নেই।
চারু প্রতিজ্ঞা করিয়া বসিয়াছিল সে লিখিবে–– অমলকে আশ্চর্য করিয়া দিবে; মন্দার সহিত তাহার যে অনেক প্রভেদ এ কথা প্রমাণ না করিয়া সে ছাড়িবে না। এ কয়দিন বিস্তর লিখিয়া সে ছিঁড়িয়া ফেলিয়াছে। যাহা লিখিতে যায় তাহা নিতান্ত অমলের লেখার মতো হইয়া উঠে; মিলাইতে গিয়া দেখে এক-একটা অংশ অমলের রচনা হইতে প্রায় অবিকল উদ্ধৃত হইয়া আসিয়াছে। সেইগুলিই ভালো, বাকিগুলা কাঁচা। দেখিলে অমল নিশ্চয়ই মনে মনে হাসিবে ইহাই কল্পনা করিয়া চারু সে-সকল লেখা কুটি কুটি করিয়া ছিঁড়িয়া পুকুরের মধ্যে ফেলিয়া দিয়াছে, পাছে তাহার একটা খণ্ডও দৈবাৎ অমলের হাতে আসিয়া পড়ে।
প্রথমে সে লিখিয়াছিল ‘শ্রাবণের মেঘ’। মনে করিয়াছিল, ‘ভাবাশ্রুজলে অভিষিক্ত খুব একটা নূতন লেখা লিখিয়াছি।” হঠাৎ চেতনা পাইয়া দেখিল জিনিসটা অমলের ‘আষাঢ়ের চাঁদ’-এর এপিঠ-ওপিঠ মাত্র। অমল লিখিয়াছে, “ভাই চাঁদ, তুমি মেঘের মধ্যে চোরের মতো লুকাইয়া বেড়াইতেছ কেন।’ চারু লিখিয়াছিল, ‘সখী কাদম্বিনী, হঠাৎ কোথা হইতে আসিয়া তোমার নীলাঞ্চলের তলে চাঁদকে চুরি করিয়া পলায়ন করিতেছ’ ইত্যাদি।
কোনোমতেই অমলের গণ্ডি এড়াইতে না পারিয়া অবশেষে চারু রচনার বিষয় পরিবর্তন করিল। চাঁদ, মেঘ, শেফালি, বউ-কথা-কও, এ সমস্ত ছাড়িয়া সে ‘কালীতলা’ বলিয়া একটা লেখা লিখিল। তাহাদের গ্রামে ছায়ায়-অন্ধকার পুকুরটির ধারে কালীর মন্দির ছিল; সেই মন্দিরটি লইয়া তাহার বাল্যকালের কল্পনা ভয় ঔৎসুক্য, সেই সম্বন্ধে তাহার বিচিত্র স্মৃতি, সেই জাগ্রত ঠাকুরানীর মাহাত্ম্য সম্বন্ধে গ্রামে চিরপ্রচলিত প্রাচীন গল্প–– এই-সমস্ত লইয়া সে একটি লেখা লিখিল। তাহার আরম্ভ-ভাগ অমলের লেখার ছাঁদে কাব্যাড়ম্বরপূর্ণ হইয়াছিল, কিন্তু খানিকটা অগ্রসর হইতেই তাহার লেখা সহজেই সরল এবং পল্লীগ্রামের ভাষা-ভঙ্গি-আভাসে পরিপূর্ণ হইয়া উঠিয়াছিল।
এই লেখাটা অমল কাড়িয়া লইয়া পড়িল। তাহার মনে হইল, গোড়ার দিকটা বেশ সরস হইয়াছে, কিন্তু কবিত্ব শেষ পর্যন্ত রক্ষিত হয় নাই। যাহা হউক, প্রথম রচনার পক্ষে লেখিকার উদ্যম প্রশংসনীয়।
চারু কহিল, “ঠাকুরপো, এসো আমরা একটা মাসিক কাগজ বের করি। কী বল।”
অমল। অনেকগুলি রৌপ্যচক্র না হলে সে কাগজ চলবে কী করে।
চারু। আমাদের এ কাগজে কোনো খরচ নেই। ছাপা হবে না তো–– হাতের অক্ষরে লিখব। তাতে তোমার আমার ছাড়া আর কারো লেখা বেরবে না, কাউকে পড়তে দেওয়া হবে না। কেবল দু কপি করে বের হবে; একটি তোমার জন্যে, একটি আমার জন্যে।
কিছুদিন পূর্বে হইলে অমল এ প্রস্তাবে মাতিয়া উঠিত; এখন গোপনতার উৎসাহ তাহার চলিয়া গেছে। এখন দশজনকে উদ্দেশ না করিয়া কোনো রচনায় সে সুখ পায় না। তবু সাবেক কালের ঠাট বজায় রাখিবার জন্য উৎসাহ প্রকাশ করিল। কহিল, “সে বেশ মজা হবে।”
চারু কহিল, “কিন্তু প্রতিজ্ঞা করতে হবে, আমাদের কাগজ ছাড়া আর কোথাও তুমি লেখা বের করতে পারবে না।”
অমল। তা হলে সম্পাদকরা যে মেরেই ফেলবে।
চারু। আর আমার হাতে বুঝি মারের অস্ত্র নেই?
সেইরূপ কথা হইল। দুই সম্পাদক, দুই লেখক এবং দুই পাঠকে মিলিয়া কমিটি বসিল। অমল কহিল, “কাগজের নাম দেওয়া যাক চারুপাঠ।” চারু কহিল, “না, এর নাম অমলা।”
এই নূতন বন্দোবস্তে চারু মাঝের কয়দিনের দুঃখবিরক্তি ভুলিয়া গেল। তাহাদের মাসিক পত্রটিতে তো মন্দার প্রবেশ করিবার কোনো পথ নাই এবং বাহিরের লোকেরও প্রবেশের দ্বার রুদ্ধ।
সপ্তম পরিচ্ছেদ
ভূপতি একদিন আসিয়া কহিল, “চারু , তুমি যে লেখিকা হয়ে উঠবে, পূর্বে এমন তো কোনো কথা ছিল না।”
চারু চমকিয়া লাল হইয়া উঠিয়া কহিল, “আমি লেখিকা! কে বলল তোমাকে। কখ্খনো না।”
ভূপতি। বামালসুদ্ধ গ্রেফ্তার। প্রমাণ হাতে-হাতে। বলিয়া ভূপতি একখণ্ড সরোরুহ বাহির করিল। চারু দেখিল, যে-সকল লেখা সে তাহাদের গুপ্ত সম্পত্তি মনে করিয়া নিজেদের হস্তলিখিত মাসিক পত্রে সঞ্চয় করিয়া রাখিতেছিল তাহাই লেখক-লেখিকার নামসুদ্ধ সরোরুহে প্রকাশ হইয়াছে।
কে যেন তাহার খাঁচার বড়ো সাধের পোষা পাখিগুলিকে দ্বার খুলিয়া উড়াইয়া দিয়াছে, এমনি তাহার মনে হইল। ভূপতির নিকটে ধরা পড়িবার লজ্জা ভুলিয়া গিয়া বিশ্বাসঘাতী অমলের উপর তাহার মনে মনে অত্যন্ত রাগ হইতে লাগিল।
“আর এইটে দেখো দেখি।” বলিয়া বিশ্ববন্ধু খবরের কাগজ খুলিয়া ভূপতি চারুর সম্মুখে ধরিল। তাহাতে ‘হাল বাংলা লেখার ঢঙ’ বলিয়া একটা প্রবন্ধ বাহির হইয়াছে।
চারু হাত দিয়া ঠেলিয়া দিয়া কহিল, “এ পড়ে আমি কী করব।” তখন অমলের উপর অভিমানে আর কোনো দিকে সে মন দিতে পারিতেছিল না। ভূপতি জোর করিয়া কহিল, “একবার পড়ে দেখোই-না।”
চারু অগত্যা চোখ বুলাইয়া গেল। আধুনিক কোনো কোনো লেখকশ্রেণীর ভাবাড়ম্বরে পূর্ণ গদ্য লেখাকে গালি দিয়া লেখক খুব কড়া প্রবন্ধ লিখিয়াছে। তাহার মধ্যে অমল এবং মন্মথ দত্তর লেখার ধারাকে সমালোচক তীব্র উপহাস করিয়াছে, এবং তাহারই সঙ্গে তুলনা করিয়া নবীনা লেখিকা শ্রীমতী চারুবালার ভাষার অকৃত্রিম সরলতা, অনায়াস সরসতা এবং চিত্ররচনানৈপুণ্যের বহুল প্রশংসা করিয়াছে। লিখিয়াছে, এইরূপ রচনাপ্রণালীর অনুকরণ করিয়া সফলতা লাভ করিলে তবেই অমল-কোম্পানির নিস্তার, নচেৎ তাহারা সম্পূর্ণ ফেল করিবে ইহাতে কোনো সন্দেহ নাই।
ভূপতি হাসিয়া কহিল, “একেই বলে গুরুমারা বিদ্যে।”
চারু তাহার লেখার এই প্রথম প্রশংসায় এক-একবার খুশি হইতে গিয়া তৎক্ষণাৎ পীড়িত হইতে লাগিল। তাহার মন যেন কোনোমতেই খুশি হইতে চাহিল না। প্রশংসার লোভনীয় সুধাপাত্র মুখের কাছ পর্যন্ত আসিতেই ঠেলিয়া ফেলিয়া দিতে লাগিল।
সে বুঝিতে পারিল, তাহার লেখা কাগজে ছাপাইয়া অমল হঠাৎ তাহাকে বিস্মিত করিয়া দিবার সংকল্প করিয়াছিল। অবশেষে ছাপা হইলে পর স্থির করিয়াছিল কোনো-একটা কাগজে প্রশংসাপূর্ণ সমালোচনা বাহির হইলে দুইটা একসঙ্গে দেখাইয়া চারুর রোষশান্তি ও উৎসাহবিধান করিবে। যখন প্রশংসা বাহির হইল তখন অমল কেন আগ্রহের সহিত তাহাকে দেখাইতে আসিল না। এ সমালোচনায় অমল আঘাত পাইয়াছে এবং চারুকে দেখাইতে চাহে না বলিয়াই এ কাগজগুলি সে একেবারে গোপন করিয়া গেছে। চারু আরামের জন্য অতি নিভৃতে যে একটি ক্ষুদ্র সাহিত্যনীড় রচনা করিতেছিল হঠাৎ প্রশংসা-শিলাবৃষ্টির একটা বড়ো রকমের শিলা আসিয়া সেটাকে একেবারে স্খলিত করিবার জো করিল। চারুর ইহা একেবারেই ভালো লাগিল না।
ভূপতি চলিয়া গেলে চারু তাহার শোবার ঘরের খাটে চুপ করিয়া বসিয়া রহিল; সম্মুখে সরোরুহ এবং বিশ্ববন্ধু খোলা পড়িয়া আছে।
খাতা-হাতে অমল চারুকে সহসা চকিত করিয়া দিবার জন্য পশ্চাৎ হইতে নিঃশব্দপদে প্রবেশ করিল। কাছে আসিয়া দেখিল, বিশ্ববন্ধুর সমালোচনা খুলিয়া চারু নিমগ্নচিত্তে বসিয়া আছে।
পুনরায় নিঃশব্দপদে অমল বাহির হইয়া গেল। ‘আমাকে গালি দিয়া চারুর লেখাকে প্রশংসা করিয়াছে বলিয়া আনন্দে চারুর আর চৈতন্য নাই।’ মুহূর্তের মধ্যে তাহার চিত্ত যেন তিক্তস্বাদ হইয়া উঠিল। চারু যে মুর্খের সমালোচনা পড়িয়া নিজেকে আপন গুরুর চেয়ে মস্ত মনে করিয়াছে, ইহা নিশ্চয় স্থির করিয়া অমল চারুর উপর ভারি রাগ করিল। চারুর উচিত ছিল কাগজখানা টুকরা টুকরা করিয়া ছিঁড়িয়া আগুনে ছাই করিয়া পুড়াইয়া ফেলা।
চারুর উপর রাগ করিয়া অমল মন্দার ঘরের দ্বারে দাঁড়াইয়া সশব্দে ডাকিল, “মন্দা-বউঠান।”
মন্দা। এসো ভাই, এসো। না চাইতেই যে দেখা পেলুম। আজ আমার কী ভাগ্যি।
অমল। আমার নূতন লেখা দু-একটা শুনবে?
মন্দা। কতদিন থেকে ‘শোনাব শোনাব’ করে আশা দিয়ে রেখেছ কিন্তু শোনাও না তো। কাজ নেই ভাই–– আবার কে কোন্ দিক থেকে রাগ করে বসলে তুমিই বিপদে পড়বে–– আমার কী।
অমল কিছু তীব্রস্বরে কহিল, “রাগ করবেন কে। কেনই বা রাগ করবেন। আচ্ছা সে দেখা যাবে, তুমি এখন শোনোই তো।”
মন্দা যেন অত্যন্ত আগ্রহে তাড়াতাড়ি সংযত হইয়া বসিল। অমল সুর করিয়া সমারোহের সহিত পড়িতে আরম্ভ করিল।
অমলের লেখা মন্দার পক্ষে নিতান্তই বিদেশী, তাহার মধ্যে কোথাও সে কোনো কিনারা দেখিতে পায় না। সেইজন্যই সমস্ত মুখে আনন্দের হাসি আনিয়া অতিরিক্ত ব্যগ্রতার ভাবে সে শুনিতে লাগিল। উৎসাহে অমলের কণ্ঠ উত্তরোত্তর উচ্চ হইয়া উঠিল।
সে পড়িতেছিল–– ‘অভিমন্যু যেমন গর্ভবাসকালে কেবল ব্যূহ-প্রবেশ করিতে শিখিয়াছিল, ব্যূহ হইতে নির্গমন শেখে নাই–– নদীর স্রোত সেইরূপ গিরিদরীর পাষাণ-জঠরের মধ্যে থাকিয়া কেবল সম্মুখেই চলিতে শিখিয়াছিল, পশ্চাতে ফিরিতে শেখে নাই। হায় নদীর স্রোত, হায় যৌবন, হায় কাল, হায় সংসার, তোমরা কেবল সম্মুখেই চলিতে পার–– যে পথে স্মৃতির স্বর্ণমণ্ডিত উপলখণ্ড ছড়াইয়া আস সে পথে আর কোনোদিন ফিরিয়া যাও না। মানুষের মনই কেবল পশ্চাতের দিকে চায়, অনন্ত জগৎ-সংসার সে দিকে ফিরিয়াও তাকায় না।’
এমন সময় মন্দার দ্বারের কাছে একটি ছায়া পড়িল, সে ছায়া মন্দা দেখিতে পাইল। কিন্তু যেন দেখে নাই এরূপ ভান করিয়া অনিমেষদৃষ্টিতে অমলের মুখের দিকে চাহিয়া নিবিড় মনোযোগের সহিত পড়া শুনিতে লাগিল।
ছায়া তৎক্ষণাৎ সরিয়া গেল।
চারু অপেক্ষা করিয়া ছিল, অমল আসিলেই তাহার সম্মুখে বিশ্ববন্ধু কাগজটিকে যথোচিত লাঞ্ছিত করিবে, এবং প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করিয়া তাহাদের লেখা মাসিক পত্রে বাহির করিয়াছে বলিয়া অমলকেও ভর্ৎসনা করিবে।
অমলের আসিবার সময় উত্তীর্ণ হইয়া গেল তবু তাহার দেখা নাই। চারু একটা লেখা ঠিক করিয়া রাখিয়াছে; অমলকে শুনাইবার ইচ্ছা; তাহাও পড়িয়া আছে।
এমন সময় কোথা হইতে অমলের কন্ঠস্বর শুনা যায়। এ যেন মন্দার ঘরে। শরবিদ্ধের মতো সে উঠিয়া পড়িল। পায়ের শব্দ না করিয়া সে দ্বারের কাছে আসিয়া দাঁড়াইল। অমল যে লেখা মন্দাকে শুনাইতেছে এখনো চারু তাহা শোনে নাই। অমল পড়িতেছিল––‘মানুষের মনই কেবল পশ্চাতের দিকে চায়–– অনন্ত জগৎ-সংসার সে দিকে ফিরিয়াও তাকায় না।’
চারু যেমন নিঃশব্দে আসিয়াছিল তেমন নিঃশব্দে আর ফিরিয়া যাইতে পারিল না। আজ পরে পরে দুই-তিনটা আঘাত তাহাকে একেবারে ধৈর্যচ্যুত করিয়া দিল। মন্দা যে একবর্ণও বুঝিতেছে না এবং অমল যে নিতান্ত নির্বোধ মূঢ়ের মতো তাহাকে পড়িয়া শুনাইয়া তৃপ্তিলাভ করিতেছে, এ কথা তাহার চীৎকার করিয়া বলিয়া আসিতে ইচ্ছা করিল। কিন্তু না বলিয়া সক্রোধে পদশব্দে তাহা প্রচার করিয়া আসিল। শয়নগৃহে প্রবেশ করিয়া চারু দ্বার সশব্দে বন্ধ করিল।
অমল ক্ষণকালের জন্য পড়ায় ক্ষান্ত দিল। মন্দা হাসিয়া চারুর উদ্দেশে ইঙ্গিত করিল। অমল মনে মনে কহিল, ‘বউঠানের এ কী দৌরাত্ম্য। তিনি কি ঠিক করিয়া রাখিয়াছেন, আমি তাঁহারই ক্রীতদাস। তাঁহাকে ছাড়া আর কাহাকেও পড়া শুনাইতে পারিব না। এ যে ভয়ানক জুলুম।’ এই ভাবিয়া সে আরো উচ্চৈঃস্বরে মন্দাকে পড়িয়া শুনাইতে লাগিল।
পড়া হইয়া গেলে চারুর ঘরের সম্মুখ দিয়া সে বাহিরে চলিয়া গেল। একবার চাহিয়া দেখিল, ঘরের দ্বার রুদ্ধ।
চারু পদশব্দে বুঝিল, অমল তাহার ঘরের সম্মুখ দিয়া চলিয়া গেল–– একবারও থামিল না। রাগে ক্ষোভে তাহার কান্না আসিল না। নিজের নূতন-লেখা খাতাখানি বাহির করিয়া তাহার প্রত্যেক পাতা বসিয়া বসিয়া টুকরা টুকরা করিয়া ছিঁড়িয়া স্তূপাকার করিল। হায়, কী কুক্ষণেই এই-সমস্ত লেখালেখি আরম্ভ হইয়াছিল।
অষ্টম পরিচ্ছেদ
সন্ধ্যার সময় বারান্দায় টব হইতে জুঁইফুলের গন্ধ আসিতেছিল। ছিন্ন মেঘের ভিতর দিয়া স্নিগ্ধ আকাশে তারা দেখা যাইতেছিল। আজ চারু চুল বাঁধে নাই, কাপড় ছাড়ে নাই। জানলার কাছে অন্ধকারে বসিয়া আছে, মৃদুবাতাসে আস্তে আস্তে তাহার খোলা চুল উড়াইতেছে, এবং তাহার চোখ দিয়া এমন ঝর্ ঝর্ করিয়া কেন জল বহিয়া যাইতেছে তাহা সে নিজেই বুঝিতে পারিতেছে না।
এমন সময় ভূপতি ঘরে প্রবেশ করিল। তাহার মুখ অত্যন্ত ম্লান, হৃদয় ভারাক্রান্ত। ভূপতির আসিবার সময় এখন নহে। কাগজের জন্য লিখিয়া প্রুফ দেখিয়া অন্তঃপুরে আসিতে প্রায়ই তাহার বিলম্ব হয়। আজ সন্ধ্যার পরেই যেন কোন্ সান্ত্বনা-প্রত্যাশায় চারুর নিকট আসিয়া উপস্থিত হইল।
ঘরে প্রদীপ জ্বলিতেছিল না। খোলা জানালার ক্ষীণ আলোকে ভূপতি চারুকে বাতায়নের কাছে অস্পষ্ট দেখিতে পাইল; ধীরে ধীরে পশ্চাতে আসিয়া দাঁড়াইল। পদশব্দ শুনিতে পাইয়াও চারু মুখ ফিরাইল না–– মূর্তিটির মতো স্থির হইয়া কঠিন হইয়া বসিয়া রহিল।
ভূপতি কিছু আশ্চর্য হইয়া ডাকিল, “চারু।”
ভূপতির কণ্ঠস্বরে সচকিত হইয়া তাড়াতাড়ি উঠিয়া পড়িল। ভূপতি আসিয়াছে সে তাহা মনে করে নাই। ভূপতি চারুর মাথার চুলের মধ্যে আঙুল বুলাইতেবুলাইতে স্নেহার্দ্রকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিল, “অন্ধকারে তুমি যে একলাটি বসে আছ, চারু? মন্দা কোথায় গেল।”
চারু যেমনটি আশা করিয়াছিল আজ সমস্ত দিন তাহার কিছুই হইল না। সে নিশ্চয় স্থির করিয়াছিল অমল আসিয়া ক্ষমা চাহিবে–– সেজন্য প্রস্তুত হইয়া সে প্রতীক্ষা করিতেছিল, এমন সময় ভূপতির অপ্রত্যাশিত কণ্ঠস্বরে সে যেন আর আত্মসংবরণ করিতে পারিল না–– একেবারে কাঁদিয়া ফেলিল।
ভূপতি ব্যস্ত হইয়া ব্যথিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, “চারু, কী হয়েছে, চারু।”
কী হইয়াছে তাহা বলা শক্ত। এমনই কী হয়েছে। বিশেষ তো কিছুই হয় নাই। অমল নিজের নূতন লেখা প্রথমে তাহাকে না শুনাইয়া মন্দাকে শুনাইয়াছে এ কথা লইয়া ভূপতির কাছে কী নালিশ করিবে। শুনিলে কী ভূপতি হাসিবে না? এই তুচ্ছ ব্যাপারের মধ্যে গুরুতর নালিশের বিষয় যে কোন্খানে লুকাইয়া আছে তাহা খুঁজিয়া বাহির করা চারুর পক্ষে অসাধ্য। অকারণে সে যে কেন এত অধিক কষ্ট পাইতেছে, ইহাই সম্পূর্ণ বুঝিতে না পারিয়া তাহার কষ্টের বেদনা আরো বাড়িয়া উঠিয়াছে।
ভূপতি। বলো-না চারু, তোমার কী হয়েছে। আমি কী তোমার উপর কোনো অন্যায় করেছি। তুমি তো জানই, কাগজের ঝঞ্ঝাট নিয়ে আমি কিরকম ব্যতিব্যস্ত হয়ে আছি, যদি তোমার মনে কোনো আঘাত দিয়ে থাকি সে আমি ইচ্ছে করে দিই নি।
ভূপতি এমন বিষয়ে প্রশ্ন করিতেছে যাহার একটিও জবাব দিবার নাই, সেইজন্য চারু ভিতরে ভিতরে অধীর হইয়া উঠিল; মনে হইতে লাগিল, ভূপতি এখন তাহাকে নিষ্কৃতি দিয়া ছাড়িয়া গেলে সে বাঁচে।
ভূপতি দ্বিতীয়বার কোনো উত্তর না পাইয়া পুনর্বার স্নেহসিক্ত স্বরে কহিল, “আমি সর্বদা তোমার কাছে আসতে পারি নে চারু, সেজন্যে আমি অপরাধী, কিন্তু আর হবে না। এখন থেকে দিনরাত কাগজ নিয়ে থাকব না। আমাকে তুমি যতটা চাও ততটাই পাবে।”
চারু অধীর হইয়া বলিল, “সেজন্যে নয়।”
ভূপতি কহিল, “তবে কী জন্যে।” বলিয়া খাটের উপর বসিল।
চারু বিরক্তির স্বর গোপন করিতে না পারিয়া কহিল, “সে এখন থাক্, রাত্রে বলব।”
ভূপতি মুহূর্তকাল স্তব্ধ থাকিয়া কহিল, “আচ্ছা, এখন থাক্।” বলিয়া আস্তে আস্তে উঠিয়া বাহিরে চলিয়া গেল। তাহার নিজের একটা কী কথা বলিবার ছিল, সে আর বলা হইল না।
ভূপতি যে একটা ক্ষোভ পাইয়া গেল, চারুর কাছে তাহা অগোচর রহিল না। মনে হইল, ‘ফিরিয়া ডাকি।’ কিন্তু ডাকিয়া কী কথা বলিবে। অনুতাপে তাহাকে বিদ্ধ করিল, কিন্তু কোনো প্রতিকার সে খুঁজিয়া পাইল না।
রাত্রি হইল। চারু আজ সবিশেষ যত্ন করিয়া ভূপতির রাত্রের আহার সাজাইল এবং নিজে পাখা হাতে করিয়া বসিয়া রহিল।
এমন সময় শুনিতে পাইল মন্দা উচ্চৈঃস্বরে ডাকিতেছে, “ব্রজ, ব্রজ।” ব্রজ চাকর সাড়া দিলে জিজ্ঞাসা করিল, “অমলবাবুর খাওয়া হয়েছে কি।” ব্রজ উত্তর করিল, “হয়েছে।” মন্দা কহিল, “খাওয়া হয়ে গেছে অথচ পান নিয়ে গেলি নে যে।” মন্দা ব্রজকে অত্যন্ত তিরস্কার করিতে লাগিল।
এমন সময় ভূপতি অন্তঃপুরে আসিয়া আহারে বসিল, “চারু পাখা করিতে লাগিল।”
চারু আজ প্রতিজ্ঞা করিয়াছিল, ভূপতির সঙ্গে প্রফুল্ল স্নিগ্ধভাবে নানা কথা কহিবে। কথাবার্তা আগে হইতে ভাবিয়া প্রস্তুত হইয়া বসিয়া ছিল। কিন্তু মন্দার কণ্ঠস্বরে তাহার বিস্তৃত আয়োজন সমস্ত ভাঙিয়া দিল, আহারকালে ভূপতিকে সে একটি কথাও বলিতে পারিল না। ভূপতিও অত্যন্ত বিমর্ষ অন্যমনস্ক হইয়া ছিল। সে ভালো করিয়া খাইল না, চারু একবার কেবল জিজ্ঞাসা করিল, “কিচ্ছু খাচ্ছ না যে।”
ভূপতি প্রতিবাদ করিয়া কহিল, “কেন। কম খাই নি তো।”
শয়নঘরে উভয়ে একত্র হইলে ভূপতি কহিল, “আজ রাত্রে তুমি কী বলবে বলেছিলে।”
চারু কহিল, “দেখো, কিছুদিন থেকে মন্দার ব্যবহার আমার ভালো বোধ হচ্ছে না। ওকে এখানে রাখতে আমার আর সাহস হয় না।”
ভূপতি। কেন, কী করেছে।
চারু। অমলের সঙ্গে ও এমনি ভাবে চলে যে, সে দেখলে লজ্জা হয়।
ভূপতি হাসিয়া উঠিয়া কহিল, “হাঁ :, তুমি পাগল হয়েছে! অমল ছেলেমানুষ। সেদিনকার ছেলে––”
চারু। তুমি তো ঘরের খবর কিছুই রাখ না, কেবল বাইরের খবর কুড়িয়ে বেড়াও। যাই হোক, বেচারা দাদার জন্যে আমি ভাবি। তিনি কখন খেলেন না খেলেন মন্দা তার কোনো খোঁজও রাখে না, অথচ অমলের পান থেকে চুন খসে গেলেই চাকরবাকরদের সঙ্গে বকাবকি ক’রে অনর্থ করে।
ভূপতি। তোমরা মেয়েরা কিন্তু ভারি সন্দিগ্ধ তা বলতে হয়। চারু রাগিয়া বলিল, “আচ্ছা বেশ, আমরা সন্দিগ্ধ, কিন্তু বাড়িতে আমি এ-সমস্ত বেহায়াপনা হতে দেব না তা বলে রাখছি।”
চারুর এ-সমস্ত অমূলক আশঙ্কায় ভূপতি মনে মনে হাসিল, খুশিও হইল। গৃহ যাহাতে পবিত্র থাকে, দাম্পত্যধর্মে আনুমানিক কাল্পনিক কলঙ্কও লেশমাত্র স্পর্শ না করে, এজন্য সাধ্বী স্ত্রীদের যে অতিরিক্ত সতর্কতা, যে সন্দেহাকুল দৃষ্টিক্ষেপ, তাহার মধ্যে একটি মাধুর্য এবং মহত্ত্ব আছে।
ভূপতি শ্রদ্ধায় এবং স্নেহে চারুর ললাট চুম্বন করিয়া কহিল, “এ নিয়ে আর কোনো গোল করবার দরকার হবে না। উমাপদ ময়মনসিংহে প্র্যাক্টিস করতে যাচ্ছে, মন্দাকেও সঙ্গে নিয়ে যাবে।”
অবশেষে নিজের দুশ্চিন্তা এবং এই-সকল অপ্রীতিকর আলোচনা দূর করিয়া দিবার জন্য ভূপতি টেবিল হইতে একটা খাতা তুলিয়া লইয়া কহিল, “তোমার লেখা আমাকে শোনাও-না, চারু।”
চারু খাতা কাড়িয়া লইয়া কহিল, “এ তোমার ভালো লাগবে না, তুমি ঠাট্টা করবে।”
ভূপতি এই কথায় কিছু ব্যথা পাইল, কিন্তু তাহা গোপন করিয়া হাসিয়া কহিল, “আচ্ছা, আমি ঠাট্টা করব না, এমনি স্থির হয়ে শুনব যে তোমার ভ্রম হবে, আমি ঘুমিয়ে পড়েছি।”
কিন্তু ভূপতি আমল পাইল না–– দেখিতে দেখিতে খাতাপত্র নানা আবরণ-আচ্ছাদনের মধ্যে অন্তর্হিত হইয়া গেল।
নবম পরিচ্ছেদ
সকল কথা ভূপতি চারুকে বলিতে পারে নাই। উমাপদ ভূপতির কাগজখানির কর্মাধ্যক্ষ ছিল। চাঁদা আদায়, ছাপাখানা ও বাজারের দেনা শোধ, চাকরদের বেতন দেওয়া, এ-সমস্তই উমাপদর উপর ভার ছিল।
ইতিমধ্যে হঠাৎ একদিন কাগজওয়ালার নিকট হইতে উকিলের চিঠি পাইয়া ভূপতি আশ্চর্য হইয়া গেল। ভূপতির নিকট হইতে তাহাদের ২৭০০ টাকা পাওনা জানাইয়াছে। ভূপতি উমাপদকে ডাকিয়া কহিল, “এ কী ব্যাপার! এ টাকা তো আমি তোমাকে দিয়ে দিয়েছি। কাগজের দেনা চার-পাঁচশোর বেশি তো হবার কথা নয়।”
উমাপদ কহিল, “নিশ্চয় এরা ভুল করেছে।”
কিন্তু, আর চাপা রহিল না। কিছুকাল হইতে উমাপদ এইরূপ ফাঁকি দিয়া আসিতেছে। কেবল কাগজ সম্বন্ধে নহে, ভূপতির নামে উমাপদ বাজারে অনেক দেনা করিয়াছে। গ্রামে সে যে একটি পাকা বাড়ি নির্মাণ করিতেছে তাহার মালমসলার কতক ভূপতির নামে লিখাইয়াছে অধিকাংশই কাগজের টাকা হইতে শোধ করিয়াছে।
যখন নিতান্তই ধরা পড়িল তখন সে রুক্ষ স্বরে কহিল, “আমি তো আর নিরুদ্দেশ হচ্ছি নে। কাজ করে আমি ক্রমে ক্রমে শোধ দেব–– তোমার সিকি পয়সার দেনা যদি বাকি থাকে তবে আমার নাম উমাপদ নয়।”
তাহার নামের ব্যত্যয়ে ভূপতির কোনো সান্ত্বনা ছিল না। অর্থের ক্ষতিতে ভূপতি তত ক্ষুণ্ন হয় নাই, কিন্তু অকস্মাৎ এই বিশ্বাসঘাতকতায় সে যেন ঘর হইতে শূন্যের মধ্যে পা ফেলিল।
সেইদিন সে অকালে অন্তঃপুরে গিয়াছিল। পৃথিবীতে একটা যে নিশ্চয় বিশ্বাসের স্থান আছে, সেইটে ক্ষণকালের জন্য অনুভব করিয়া আসিতে তাহার হৃদয় ব্যাকুল হইয়াছিল। চারু তখন নিজের দুঃখে সন্ধ্যাদীপ নিবাইয়া জানলার কাছে অন্ধকারে বসিয়া ছিল।
উমাপদ পরদিনই ময়মনসিংহ যাইতে প্রস্তুত। বাজারের পাওনাদাররা খবর পাইবার পূর্বেই সে সরিয়া পড়তে চায়। ভূপতি ঘৃণাপূর্বক উমাপদর সহিত কথা কহিল না–– ভূপতির সেই মৌনাবস্থা উমাপদ সৌভাগ্য বলিয়া জ্ঞান করিল।
অমল আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “মন্দা-বোঠান, এ কী ব্যাপার। জিনিসপত্র গোছাবার ধুম যে? ”
মন্দা। আর ভাই, যেতে তো হবেই। চিরকাল কি থাকব।
অমল। যাচ্ছ কোথায়।
মন্দা। দেশে।
অমল। কেন। এখানে অসুবিধাটা কী হল।
মন্দা। অসুবিধে আমার কী বল। তোমাদের পাঁচজনের সঙ্গে ছিলুম, সুখেই ছিলুম। কিন্তু অন্যের অসুবিধে হতে লাগল যে। বলিয়া চারুর ঘরের দিকে কটাক্ষ করিল।
অমল গম্ভীর হইয়া চুপ করিয়া রহিল। মন্দা কহিল, “ছি ছি, কী লজ্জা। বাবু কী মনে করলেন।”
অমল এ কথা লইয়া আর অধিক আলোচনা করিল না। এটুকু স্থির করিল, চারু তাহাদের সম্বন্ধে দাদার কাছে এমন কথা বলিয়াছে যাহা বলিবার নহে।
অমল বাড়ি হইতে বাহির হইয়া রাস্তায় বেড়াইতে লাগিল। তাহার ইচ্ছা হইল এ বাড়িতে আর ফিরিয়া না আসে। দাদা যদি বোঠানের কথায় বিশ্বাস করিয়া তাহাকে অপরাধী মনে করিয়া থাকেন, তবে মন্দা যে পথে গিয়াছে তাহাকেও সেই পথে যাইতে হয়। মন্দাকে বিদায় এক হিসাবে অমলের প্রতিও নির্বাসনের আদেশ–– সেটা কেবল মুখ ফুটিয়া বলা হয় নাই মাত্র। ইহার পরে কর্তব্য খুব সুস্পষ্ট–– আর একদণ্ডও এখানে থাকা নয়। কিন্তু দাদা যে তাহার সম্বন্ধে কোনোপ্রকার অন্যায় ধারণা মনে মনে পোষণ করিয়া রাখিবেন সে হইতেই পারে না। এতদিন তিনি অক্ষুণ্ন বিশ্বাসে তাহাকে ঘরে স্থান দিয়া পালন করিয়া আসিতেছেন, সে বিশ্বাসে যে অমল কোনো অংশে আঘাত দেয় নাই সে কথা দাদাকে না বুঝাইয়া সে কেমন করিয়া যাইবে।
ভূপতি তখন আত্মীয়ের কৃতঘ্নতা, পাওনাদারের তাড়না, উচ্ছৃঙ্খল হিসাবপত্র এবং শূন্য তহবিল লইয়া মাথায় হাত দিয়া ভাবিতেছিল। তাহার এই শুষ্ক মনোদুঃখের কেহ দোসর ছিল না–– চিত্তবেদনা এবং ঋণের সঙ্গে একলা দাঁড়াইয়া যুদ্ধ করিবার জন্য ভূপতি প্রস্তুত হইতেছিল।
এমন সময় অমল ঝড়ের মতো ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিল। ভূপতি নিজের অগাধ চিন্তার মধ্যে হইতে হঠাৎ চমকিয়া উঠিয়া চাহিল। কহিল, “খবর কী অমল।” অকস্মাৎ মনে হইল, অমল বুঝি আর-একটা কী গুরুতর দুঃসংবাদ লইয়া আসিল।
অমল কহিল, “দাদা, আমার উপরে তোমার কি কোনোরকম সন্দেহের কারণ হয়েছে।”
ভূপতি আশ্চর্য হইয়া কহিল, “তোমার উপরে সন্দেহ!” মনে মনে ভাবিল, “সংসার যেরূপ দেখিতেছি তাহাতে কোনোদিন অমলকেও সন্দেহ করিব আশ্চর্য নাই।”
অমল। বোঠান কি আমার চরিত্রসম্বন্ধে তোমার কাছে কোনোরকম দোষারোপ করেছেন।
ভূপতি ভাবিল, ওঃ,এই ব্যাপার। বাঁচা গেল। স্নেহের অভিমান। সে মনে করিয়াছিল, সর্বনাশের উপর বুঝি আর-একটা কিছু সর্বনাশ ঘটিয়াছে, কিন্তু গুরুতর সংকটের সময়েও এই-সকল তুচ্ছ বিষয়ে কর্ণপাত করিতে হয়। সংসার এ দিকে সাঁকোও নাড়াইবে অথচ সেই সাঁকোর উপর দিয়া তাহার শাকের আঁটিগুলো পার করিবার জন্য তাগিদ করিতেও ছাড়িবে না।
অন্য সময় হইলে ভূপতি অমলকে পরিহাস করিত, কিন্ত আজ তাহার সে প্রফুল্লতা ছিল না। সে বলিল, “পাগল হয়েছ নাকি।”
অমল আবার জিজ্ঞাসা করিল, “বোঠান কিছু বলেন নি? ”
ভূপতি। তোমাকে ভালোবাসেন বলে যদি কিছু বলে থাকেন তাতে রাগ করাবার কোনো কারণ নেই।
অমল। কাজকর্মের চেষ্টায় এখন আমার অন্যত্র যাওয়া উচিত।
ভূপতি ধমক দিয়া কহিল, “অমল, তুমি কী ছেলেমানুষি করছ তার ঠিক নেই। এখন পড়াশুনো করো, কাজকর্ম পরে হবে।”
অমল বিমর্ষমুখে চলিয়া আসিল, ভূপতি তাহার কাগজের গ্রাহকদের মূল্যপ্রাপ্তির তালিকার সহিত তিন বৎসরের জমাখরচের হিসাব মিলাইতে বসিয়া গেল।
দশম পরিচ্ছেদ
অমল স্থির করিল, বউঠানের সঙ্গে মোকাবিলা করিতে হইবে, এ কথাটার শেষ না করিয়া ছাড়া হইবে না। বোঠানকে যে-সকল শক্ত শক্ত কথা শুনাইবে মনে মনে তাহা আবৃত্তি করিতে লাগিল।
মন্দা চলিয়া গেলে চারু সংকল্প করিল, অমলকে সে নিজে হইতে ডাকিয়া পাঠাইয়া তাহার রোষশান্তি করিবে। কিন্তু একটা লেখার উপলক্ষ করিয়া ডাকিতে হইবে। অমলেরই একটা লেখার অনুকরণ করিয়া ‘অমাবস্যার আলো’ নামে সে একটা প্রবন্ধ ফাঁদিয়াছে। চারু এটুকু বুঝিয়াছে যে তাহার স্বাধীন ছাঁদের লেখা অমল পছন্দ করে না।
পূর্ণিমা তাহার সমস্ত আলোক প্রকাশ করিয়া ফেলে বলিয়া চারু তাহার নূতন রচনায় পূর্ণিমাকে অত্যন্ত ভর্ৎসনা করিয়া লজ্জা দিতেছে। লিখিতেছে–– অমাবস্যার অতলম্পর্শ অন্ধকারের মধ্যে ষোলোকলা চাঁদের সমস্ত আলোক স্তরে স্তরে আবদ্ধ হইয়া আছে, তাহার এক রশ্মিও হারাইয়া যায় নাই–– তাই পূর্ণিমার উজ্জ্বলতা অপেক্ষা অমাবস্যার কালিমা পরিপূর্ণতর–– ইত্যাদি। অমল নিজের সকল লেখাই সকলের কাছে প্রকাশ করে এবং চারু তাহা করে না–– পূর্ণিমা-অমাবস্যার তুলনার মধ্যে কি সেই কথাটার আভাস আছে।
এ দিকে এই পরিবারের তৃতীয় ব্যক্তি ভূপতি কোনো আসন্ন ঋণের তাগিদ হইতে মুক্তিলাভের জন্য তাহার পরম বন্ধু মতিলালের কাছে গিয়াছিল।
মতিলালকে সংকটের সময় ভূপতি কয়েক হাজার টাকা ধার দিয়াছিল–– সেদিন অত্যন্ত বিব্রত হইয়া সেই টাকাটা চাহিতে গিয়াছিল। মতিলাল স্নানের পর গা খুলিয়া পাখার হওয়া লাগাইতেছিল এবং একটা কাঠের বাক্সর উপর কাগজ মেলিয়া অতি ছোটো অক্ষরে সহস্র দুর্গানাম লিখিতেছিল। ভূপতিকে দেখিয়া অত্যন্ত হৃদ্যতার স্বরে কহিল, “এসো এসো–– আজকাল তো তোমার দেখাই পাবার জো নেই।”
মতিলাল টাকার কথা শুনিয়া আকাশপাতাল চিন্তা করিয়া কহিল, “কোন্ টাকার কথা বলছ। এর মধ্যে তোমার কাছ থেকে কিছু নিয়েছি নাকি।”
ভূপতি সাল-তারিখ স্মরণ করাইয়া দিলে মতিলাল কহিল, “ওঃ, সেটা তো অনেকদিন হল তামাদি হয়ে গেছে।”
ভূপতির চক্ষে তাহার চতুর্দিকের চেহারা সমস্ত বদল হইয়া গেল। সংসারের যে অংশ হইতে মুখোশ খসিয়া পড়িল সে দিকটা দেখিয়া আতঙ্কে ভূপতির শরীর কন্টকিত হইয়া উঠিল। হঠাৎ বন্যা আসিয়া পড়িলে ভীত ব্যক্তি যেখানে সকলের চেয়ে উচ্চ চূড়া দেখে সেইখানে যেমন ছুটিয়া যায়, সংশয়াক্রান্ত বহিঃসংসার হইতে ভূপতি তেমনি বেগে অন্তঃপুরে প্রবেশ করিল, মনে মনে কহিল, “আর যাই হোক, চারু তো আমাকে বঞ্চনা করিবে না।”
চারু তখন খাটে বসিয়া কোলের উপর বালিশ এবং বালিশের উপর খাতা রাখিয়া ঝুঁকিয়া পড়িয়া একমনে লিখিতেছিল। ভূপতি যখন নিতান্ত তাহার পাশে আসিয়া দাঁড়াইল তখনই তাহার চেতনা হইল, তাড়াতাড়ি তাহার খাতাটা পায়ের নীচে চাপিয়া বসিল।
মনে যখন বেদনা থাকে তখন অল্প আঘাতেই গুরুতর ব্যথা বোধ হয়। চারু এমন অনাবশ্যক সত্বরতার সহিত তাহার লেখা গোপন করিল দেখিয়া ভূপতির মনে বাজিল।
ভূপতি ধীরে ধীরে খাটের উপর চারুর পাশে বসিল। চারু তাহার রচনাস্রোতে অনপেক্ষিত বাধা পাইয়া এবং ভূপতির কাছে হঠাৎ খাতা লুকাইবার ব্যস্ততায় অপ্রতিভ হইয়া কোনো কথাই জোগাইয়া উঠিতে পারিল না।
সেদিন ভূপতির নিজের কিছু দিবার বা কহিবার ছিল না। সে রিক্তহস্তে চারুর নিকটে প্রার্থী হইয়া আসিয়াছিল। চারুর কাছ হইতে আশঙ্কাধর্মী ভালোবাসার একটা-কোনো প্রশ্ন, একটা-কিছু আদর পাইলেই তাহার ক্ষত-যন্ত্রণায় ঔষধ পড়িত। কিন্তু ‘হ্যাদে লক্ষ্মী হৈল লক্ষ্মীছাড়া’, এক মুহূর্তের প্রয়োজনে প্রীতিভাণ্ডারের চাবি চারু যেন কোনোখানে খুঁজিয়া পাইল না। উভয়ের সুকঠিন মৌনে ঘরের নীরবতা অত্যন্ত নিবিড় হইয়া আসিল।
খানিকক্ষণ নিতান্ত চুপচাপ থাকিয়া ভূপতি নিশ্বাস ফেলিয়া খাট ছাড়িয়া উঠিল এবং ধীরে ধীরে বাহিরে চলিয়া আসিল।
সেই সময় অমল বিস্তর শক্ত শক্ত কথা মনের মধ্যে বোঝাই করিয়া লইয়া চারুর ঘরে দ্রুতপদে আসিতেছিল, পথের মধ্যে অমল ভূপতির অত্যন্ত শুষ্ক বিবর্ণ মুখ দেখিয়া উদ্বিগ্ন হইয়া থামিল, জিজ্ঞাসা করিল, “দাদা, তোমার অসুখ করেছে? ”
অমলের স্নিগ্ধস্বর শুনিবামাত্র হঠাৎ ভূপতির সমস্ত হৃদয় তাহার অশ্রুরাশি লইয়া বুকের মধ্যে যেন ফুলিয়া উঠিল। কিছুক্ষণ কোনো কথা বাহির হইল না। সবলে আত্মসংবরণ করিয়া ভূপতি আর্দ্রস্বরে কহিল, “কিছু হয় নি, অমল। এবারে কাগজে তোমার কোনো লেখা বেরচ্ছে কি।”
অমল শক্ত শক্ত কথা যাহা সঞ্চয় করিয়াছিল তাহা কোথায় গেল। তাড়াতাড়ি চারুর ঘরে আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “বউঠান, দাদার কী হয়েছে বলো দেখি।”
চারু কহিল, “কই, তা তো কিছু বুঝতে পারলুম না। অন্য কাগজে বোধ হয় ওঁর কাগজকে গাল দিয়ে থাকবে।”
অমল মাথা নাড়িল।
না ডাকিতেই অমল আসিল এবং সহজভাবে কথাবার্তা আরম্ভ করিয়া দিল দেখিয়া চারু অত্যন্ত আরাম পাইল। একেবারেই লেখার কথা পাড়িল–– কহিল, “আজ আমি ‘অমাবস্যার আলো’ বলে একটা লেখা লিখছিলুম; আর একটু হলেই তিনি সেটা দেখে ফেলেছিলেন।”
চারু নিশ্চয় স্থির করিয়াছিল, তাহার নূতন লেখাটা দেখিবার জন্য অমল পীড়াপীড়ি করিবে। সেই অভিপ্রায়ে খাতাখানা একটু নাড়াচাড়াও করিল। কিন্তু, অমল একবার তীব্রদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ চারুর মুখের দিকে চাহিল–– কী বুঝিল, কী ভাবিল জানি না। চকিত হইয়া উঠিয়া পড়িল। পর্বতপথে চলিতে চলিতে হঠাৎ এক সময়ে মেঘের কুয়াশা কাটিবামাত্র পথিক যেন চমকিয়া দেখিল, সে সহস্র হস্ত গভীর গহ্বরের মধ্যে পা বাড়াইতে যাইতেছিল। অমল কোনো কথা না বলিয়া একেবারে ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল।
চারু অমলের এই অভূতপূর্ব ব্যবহারের কোনো তাৎপর্য বুঝিতে পারিল না।
একাদশ পরিচ্ছেদ
পরদিন ভূপতি আবার অসময়ে শয়নঘরে আসিয়া চারুকে ডাকাইয়া আনাইল। কহিল, “চারু, অমলের বেশ একটি ভালো বিবাহের প্রস্তাব এসেছে।”
চারু অন্যমনস্ক ছিল। কহিল, “ভালো কী এসেছে।”
ভূপতি। বিয়ের সম্বন্ধ।
চারু। কেন, আমাকে কি পছন্দ হল না।
ভূপতি উচ্চৈঃস্বরে হাসিয়া উঠিল। কহিল, “তোমাকে পছন্দ হল কি না সে কথা এখনো অমলকে জিজ্ঞাসা করা হয় নি। যদি বা হয়ে থাকে আমার তো একটা ছোটো খাটো দাবি আছে, সে আমি ফস্ করে ছাড়ছি নে।”
চারু। আঃ, কী বকছ তার ঠিক নেই। তুমি যে বললে, তোমার বিয়ের সম্বন্ধ এসেছে। চারুর মুখ লাল হইয়া উঠিল।
ভূপতি। তা হলে কি ছুটে তোমাকে খবর দিতে আসতুম? বকশিশ পাবার তো আশা ছিল না।
চারু। অমলের সম্বন্ধ এসেছে? বেশ তো। তা হলে আর দেরি কেন।
ভূপতি। বর্ধমানের উকিল রঘুনাথবাবু তাঁর মেয়ের সঙ্গে বিবাহ দিয়ে অমলকে বিলেত পাঠাতে চান।
চারু বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, “বিলেত? ”
ভূপতি। হাঁ,বিলেত।
চারু। অমল বিলেত যাবে? বেশ মজা তো। বেশ হয়েছে, ভালোই হয়েছে তা তুমি তাকে একবার বলে দেখো।
ভূপতি। আমি বলবার আগে তুমি তাকে একবার ডেকে বুঝিয়ে বললে ভালো হয় না?
চারু। আমি তো তিন হাজার বার বলেছি। সে আমার কথা রাখে না। আমি তাকে বলতে পারব না।
ভূপতি। তোমার কি মনে হয়, সে করবে না?
চারু। আরো তো অনেকবার চেষ্টা দেখা গেছে, কোনোমতে তো রাজি হয় নি।
ভূপতি। কিন্তু এবারকার এ প্রস্তাবটা তার পক্ষে ছাড়া উচিত হবে না। আমার অনেক দেনা হয়ে গেছে, অমলকে আমি তো আর সেরকম করে আশ্রয় দিতে পারব না।
ভূপতি অমলকে ডাকিয়া পাঠাইল। অমল আসিলে তাহাকে বলিল, “বর্ধমানের উকিল রঘুনাথবাবুর মেয়ের সঙ্গে তোমার বিয়ের প্রস্তাব এসেছে। তাঁর ইচ্ছে বিবাহ দিয়ে তোমাকে বিলেত পাঠিয়ে দেবেন। তোমার কী মত।”
অমল কহিল, “তোমার যদি অনুমতি থাকে, আমার এতে কোনো অমত নেই।”
অমলের কথা শুনিয়া উভয়ে আশ্চর্য হইয়া গেল। সে যে বলিবামাত্রই রাজি হইবে, এ কেহ মনে করে নাই।
চারু তীব্রস্বরে ঠাট্টা করিয়া কহিল, “দাদার অনুমতি থাকলেই উনি মত দেবেন। কী আমার কথার বাধ্য ছোটো ভাই। দাদার ’পরে ভক্তি এতদিন কোথায় ছিল, ঠাকুরপো? ”
অমল উত্তর না দিয়া একটুখানি হাসিবার চেষ্টা করিল।
অমলের নিরুত্তরে চারু যেন তাহাকে চেতাইয়া তুলিবার জন্য দ্বিগুণতর ঝাঁজের সঙ্গে বলিল, “তার চেয়ে বলো-না কেন, নিজের ইচ্ছে গেছে। এতদিন ভান করে থাকবার কী দরকার ছিল যে বিয়ে করতে চাও না? পেটে খিদে মুখে লাজ! ”
ভূপতি উপহাস করিয়া কহিল, “অমল তোমার খাতিরেই এতদিন খিদে চেপে রেখেছিল, পাছে ভাজের কথা শুনে তোমার হিংসা হয়।”
চারু এই কথায় লাল হইয়া উঠিয়া কোলাহল করিয়া বলিতে লাগিল, “হিংসে! তা বৈকি! কখখ্নো আমার হিংসে হয় না। ওরকম করে বলা তোমার ভারি অন্যায়।”
ভূপতি। ঐ দেখো। নিজের স্ত্রীকে ঠাট্টাও করতে পারব না।
চারু। না, ওরকম ঠাট্টা আমার ভালো লাগে না।
ভূপতি। আচ্ছা, গুরুতর অপরাধ করেছি। মাপ করো। যা হোক, বিয়ের প্রস্তাবটা তা হলে স্থির?
অমল কহিল, “হাঁ।”
চারু। মেয়েটি ভালো কি মন্দ তাও বুঝি একবার দেখতে যাবারও তর সইল না। তোমার যে এমন দশা হয়ে এসেছে তা তো একটু আভাসেও প্রকাশ কর নি।
ভূপতি। অমল, মেয়ে দেখতে চাও তো তার বন্দোবস্ত করি। খবর নিয়েছি মেয়েটি সুন্দরী।
অমল। না, দেখবার দরকার দেখি নে।
চারু। ওর কথা শোন কেন। সে কি হয়। কনে না দেখে বিয়ে হবে? ও না দেখতে চায় আমরা তো দেখে নেব।
অমল। না দাদা, ঐ নিয়ে মিথ্যে দেরি করবার দরকার দেখি নে।
চারু। কাজ নেই বাপু–– দেরি হলে বুক ফেটে যাবে। তুমি টোপর মাথায় দিয়ে এখনই বেরিয়ে পড়ো। কী জানি, তোমার সাত রাজার ধন মানিকটিকে যদি আর কেউ কেড়ে নিয়ে যায়।
অমলকে চারু কোনো ঠাট্টাতেই কিছুমাত্র বিচলিত করিতে পারিল না।
চারু। বিলেত পালাবার জন্যে তোমার মনটা বুঝি দৌড়চ্ছে? কেন, এখানে আমরা তোমাকে মারছিলুম না ধরছিলুম। হ্যাট কোট পরে সাহেব না সাজলে এখানকার ছেলেদের মন ওঠে না। ঠাকুরপো, বিলেত থেকে ফিরে এসে আমাদের মতো কালা আদমিদের চিনতে পারবে তো?
অমল কহিল, “তা হলে আর বিলেত যাওয়া কী করতে।”
ভূপতি হাসিয়া কহিল, “কালো রূপ ভোলবার জন্যেই তো সাত সমুদ্র পেরোনো। তা, ভয় কী চারু, আমরা রইলুম, কালোর ভক্তের অভাব হবে না।”
ভূপতি খুশি হইয়া তখনই বর্ধমানে চিঠি লিখিয়া পাঠাইল। বিবাহের দিন স্থির হইয়া গেল।
দ্বাদশ পরিচ্ছেদ
ইতিমধ্যে কাগজখানা তুলিয়া দিতে হইল। ভূপতি খরচ আর জোগাইয়া উঠিতে পারিল না। লোকসাধারণ-নামক একটা বিপুল নির্মম পদার্থের যে সাধনায় ভূপতি দীর্ঘকাল দিনরাত্রি একান্ত মনে নিযুক্ত ছিল সেটা এক মুহূর্তে বিসর্জন দিতে হইল। ভূপতির জীবনে সমস্ত চেষ্টা যে অভ্যস্ত পথে গত বারো বৎসর অবিচ্ছেদে চলিয়া আসিতেছে সেটা হঠাৎ এক জায়গায় যেন জলের মাঝখানে আসিয়া পড়িল। ইহার জন্য ভূপতি কিছুমাত্র প্রস্তুত ছিল না। অকস্মাৎ-বাধাপ্রাপ্ত তাহার এতদিনকার সমস্ত উদ্যমকে সে কোথায় ফিরাইয়া লইয়া যাইবে। তাহারা যেন উপবাসী অনাথ শিশু-সন্তানদের মতো ভূপতির মুখের দিকে চাহিল, ভূপতি তাহাদিগকে আপন অন্তঃপুরে করুণাময়ী শুশ্রূষাপরায়ণা নারীর কাছে আনিয়া দাঁড় করাইল।
নারী তখন কী ভাবিতেছিল। সে মনে মনে বলিতেছিল, ‘এ কী আশ্চর্য, অমলের বিবাহ হইবে সে তো খুব ভালোই। কিন্তু এতকাল পরে আমাদের ছাড়িয়া পরের ঘরে বিবাহ করিয়া বিলাত চলিয়া যাইবে, ইহাতে তাহার মনে একবারও একটুখানির জন্য দ্বিধাও জন্মিল না? এতদিন ধরিয়া তাহাকে যে আমরা এত যত্ন করিয়া রাখিলাম, আর যেমনি বিদায় লইবার একটুখানি ফাঁক পাইল অমনি কোমর বাঁধিয়া প্রস্তুত হইল, যেন এতদিন সুযোগের অপেক্ষা করিতেছিল। অথচ মুখে কতই মিষ্ট, কতই ভালোবাসা। মানুষকে চিনিবার জো নাই। কে জানিত, যে লোক এত লিখিতে পারে তাহার হৃদয় কিছুমাত্র নাই।’
নিজের হৃদয়প্রাচুর্যের সহিত তুলনা করিয়া চারু অমলের শূন্য হৃদয়কে অত্যন্ত অবজ্ঞা করিতে অনেক চেষ্টা করিল কিন্তু পারিল না। ভিতরে ভিতরে নিয়ত একটা বেদনার উদ্বেগ তপ্ত শূলের মতো তাহার অভিমানকে ঠেলিয়া ঠেলিয়া তুলিতে লাগিল–– ‘অমল আজ বাদে কাল চলিয়া যাইবে, তবু এ কয়দিন তাহার দেখা নাই। আমাদের মধ্যে যে পরস্পর একটা মনান্তর হইয়াছে সেটা মিটাইয়া লইবার আর অবসরও হইল না।’ চারু প্রতিক্ষণে মনে করে অমল আপনি আসিবে–– তাহাদের এতদিনকার খেলাধুলা এমন করিয়া ভাঙিবে না, কিন্তু অমল আর আসেই না। অবশেষে যখন যাত্রার দিন অত্যন্ত নিকটবর্তী হইয়া আসিল তখন চারু নিজেই অমলকে ডাকিয়া পাঠাইল।
অমল বলিল, “আর একটু পরে যাচ্ছি।” চারু তাহাদের সেই বারান্দার চৌকিটাতে গিয়া বসিল। সকালবেলা হইতে ঘন মেঘ করিয়া গুমট হইয়া আছে–– চারু তাহার খোলা চুল এলো করিয়া মাথায় জড়াইয়া একটা হাতপাখা লইয়া ক্লান্ত দেহে অল্প অল্প বাতাস করিতে লাগিল।
অত্যন্ত দেরি হইল। ক্রমে তাহার হাতপাখা আর চলিল না। রাগ দুঃখ অধৈর্য তাহার বুকের ভিতরে ফুটিয়া উঠিল। মনে মনে বলিল–– নাই আসিল অমল, তাতেই বা কী। কিন্তু তবু পদশব্দ মাত্রেই তাহার মন দ্বারের দিকে ছুটিয়া যাইতে লাগিল।
দূর গির্জায় এগারোটা বাজিয়া গেল। স্নানান্তে এখনই ভূপতি খাইতে আসিবে। এখনো আধঘন্টা সময় আছে, এখনো অমল যদি আসে। যেমন করিয়া হোক, তাহাদের কয়দিনকার নীরব ঝগড়া আজ মিটাইয়া ফেলিতেই হইবে–– অমলকে এমনভাবে বিদায় দেওয়া যাইতে পারে না। এই সমবয়সি দেওর-ভাজের মধ্যে যে চিরন্তন মধুর সম্বন্ধটুকু আছে–– অনেক ভাব, আড়ি, অনেক স্নেহের দৌরাত্ম্য, অনেক বিশ্রব্ধ সুখালোচনায় বিজড়িত একটি চিরচ্ছায়াময় লতাবিতান–– অমল সে কি আজ ধুলায় লুটাইয়া দিয়া বহুদিনের জন্য বহুদূরে চলিয়া যাইবে। একটু পরিতাপ হইবে না? তাহার তলে কী শেষ জলও সিঞ্চন করিয়া যাইবে না–– তাহাদের অনেকদিনের দেওর-ভাজ সম্বন্ধের শেষ অশ্রুজল!
আধঘন্টা প্রায় অতীত হয়। এলো খোঁপা খুলিয়া খানিকটা চুলের গুচ্ছ চারু দ্রুতবেগে আঙুলে জড়াইতে এবং খুলিতে লাগিল। অশ্রুসংবরণ করা আর যায় না। চাকর আসিয়া কহিল, “মাঠাকরুন, বাবুর জন্যে ডাব বের করে দিতে হবে।”
চারু আঁচল হইতে ভাঁড়ারের চাবি খুলিয়া ঝন্ করিয়া চাকরের পায়ের কাছে ফেলিয়া দিল–– সে আশ্চর্য হইয়া চাবি লইয়া চলিয়া গেল।
চারুর বুকের কাছ হইতে কী একটা ঠেলিয়া কণ্ঠের কাছে উঠিয়া আসিতে লাগিল।
যথাসময়ে ভূপতি সহাস্যমুখে খাইতে আসিল। চারু পাখা হাতে আহারস্থানে উপস্থিত হইয়া দেখিল, অমল ভূপতির সঙ্গে আসিয়াছে। চারু তাহার মুখের দিকে চাহিল না।
অমল জিজ্ঞাসা করিল, “বোঠান, আমাকে ডাকছ? ”
চারু কহিল, “না, এখন আর দরকার নেই।”
অমল। তা হলে আমি যাই, আমার আবার অনেক গোছাবার আছে।
চারু তখন দীপ্তচক্ষে একবার অমলের মুখের দিকে চাহিল; কহিল, “যাও।”
অমল চারুর মুখের দিকে একবার চাহিয়া চলিয়া গেল।
আহারান্তে ভূপতি কিছুক্ষণ চারুর কাছে বসিয়া থাকে। আজ দেনাপাওনা-হিসাবপত্রের হাঙ্গামে ভূপতি অত্যন্ত ব্যস্ত–– তাই আজ অন্তঃপুরে বেশিক্ষণ থাকিতে পারিবে না বলিয়া কিছু ক্ষুণ্ন হইয়া কহিল, “আজ আর বেশিক্ষণ বসতে পারছি নে–– আজ অনেক ঝঞ্ঝাট।”
চারু বলিল, “তা যাও-না।”
ভূপতি ভাবিল, চারু অভিমান করিল। বলিল, “তাই বলে যে এখনই যেতে হবে তা নয়; একটু জিরিয়ে যেতে হবে।” বলিয়া বসিল। দেখিল চারু বিমর্ষ হইয়া আছে। ভূপতি অনুতপ্ত চিত্তে অনেকক্ষণ বসিয়া রহিল, কিন্তু কোনোমতেই কথা জমাইতে পারিল না। অনেকক্ষণ কথোপকথনের বৃথা চেষ্টা করিয়া ভূপতি কহিল, “অমল তো কাল চলে যাচ্ছে, কিছুদিন তোমার বোধ হয় খুব একলা বোধ হবে।”
চারু তাহার কোনো উত্তর না দিয়া যেন কী একটা আনিতে চট্ করিয়া অন্য ঘরে চলিয়া গেল। ভূপতি কিয়ৎক্ষণ অপেক্ষা করিয়া বাহিরে প্রস্থান করিল।
চারু আজ অমলের মুখের দিকে চাহিয়া লক্ষ করিয়াছিল অমল এই কয়দিনেই অত্যন্ত রোগা হইয়া গেছে–– তাহার মুখের তরুণতার সেই স্ফূর্তি একেবারে নাই। ইহাতে চারু সুখও পাইল বেদনাও বোধ করিল। আসন্ন বিচ্ছেদই যে অমলকে ক্লিষ্ট করিতেছে, চারুর তাহাতে সন্দেহ রহিল না–– কিন্তু তবু অমলের এমন ব্যবহার কেন। কেন সে দূরে দূরে পালাইয়া বেড়াইতেছে। বিদায়কালে কেন সে ইচ্ছাপূর্বক এমন বিরোধতিক্ত করিয়া তুলিতেছে।
বিছানায় শুইয়া ভাবিতে ভাবিতে সে হঠাৎ চমকিয়া উঠিয়া বসিল। হঠাৎ মন্দার কথা মনে পড়িল। যদি এমন হয়, অমল মন্দাকে ভালোবাসে। মন্দা চলিয়া গেছে বলিয়াই যদি অমল এমন করিয়া–– ছি! অমলের মন কি এমন হইবে। এত ক্ষুদ্র? এমন কলুষিত? বিবাহিত রমণীর প্রতি তাহার মন যাইবে? অসম্ভব। সন্দেহকে একান্ত চেষ্টায় দূর করিয়া দিতে চাহিল কিন্তু সন্দেহ তাহাকে সবলে দংশন করিয়া রহিল।
এমনি করিয়া বিদায়কাল আসিল। মেঘ পরিষ্কার হইল না। অমল আসিয়া কম্পিতকণ্ঠে কহিল, “বোঠান, আমার যাবার সময় হয়েছে। তুমি এখন থেকে দাদাকে দেখো। তাঁর বড়ো সংকটের অবস্থা–– তুমি ছাড়া তাঁর আর সান্ত্বনার কোনো পথ নেই।”
অমল ভূপতির বিষণ্ন ম্লান ভাব দেখিয়া সন্ধান দ্বারা তাহার দুর্গতির কথা জানিতে পারিয়াছিল। ভূপতি যে কিরূপ নিঃশব্দে আপন দুঃখদুর্দশার সহিত একলা লড়াই করিতেছে, কাহারও কাছে সাহায্য বা সান্ত্বনা পায় নাই, অথচ আপন আশ্রিত পালিত আত্মীয়স্বজনদিগকে এই প্রলয়সংকটে বিচলিত হইতে দেয় নাই, ইহা সে চিন্তা করিয়া চুপ করিয়া রহিল। তার পরে সে চারুর কথা ভাবিল, নিজের কথা ভাবিল, কর্ণমূল লোহিত হইয়া উঠিল, সবেগে বলিল, “চুলোয় যাক আষাঢ়ের চাঁদ আর অমাবস্যার আলো। আমি ব্যারিস্টার হয়ে এসে দাদাকে যদি সাহায্য করতে পারি তবেই পুরুষমানুষ।”
গত রাত্রি সমস্ত রাত জাগিয়া চারু ভাবিয়া রাখিয়াছিল অমলকে বিদায়কালে কী কথা বলিবে–– সহাস্য অভিমান এবং প্রফুল্ল ঔদাসীন্যের দ্বারা মাজিয়া মাজিয়া সেই কথাগুলিকে সে মনে মনে উজ্জ্বল ও শানিত করিয়া তুলিয়াছিল। কিন্তু বিদায় দেবার সময় চারুর মুখে কোনো কথাই বাহির হইল না। সে কেবল বলিল, “চিঠি লিখবে তো, অমল? ”
অমল ভূমিতে মাথা রাখিয়া প্রণাম করিল, চারু ছুটিয়া শয়নঘরে গিয়া দ্বার বন্ধ করিয়া দিল।
ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ
ভূপতি বর্ধমানে গিয়া অমলের বিবাহ-অন্তে তাহাকে বিলাতে রওনা করিয়া ঘরে ফিরিয়া আসিল।
নানা দিক হইতে ঘা খাইয়া বিশ্বাসপরায়ণ ভূপতির মনে বহিঃসংসারের প্রতি একটা বৈরাগ্যের ভাব আসিয়াছিল। সভাসমিতি মেলামেশা কিছুই তাহার ভালো লাগিত না। মনে হইল, ‘এই-সব লইয়া আমি এতদিন কেবল নিজেকেই ফাঁকি দিলাম–– জীবনের সুখের দিন বৃথা বহিয়া গেল এবং সারভাগ আবর্জনাকুণ্ডে ফেলিলাম।’
ভূপতি মনে মনে কহিল, ‘যাক, কাগজটা গেল, ভালোই হইল। মুক্তিলাভ করিলাম।’ সন্ধ্যার সময় আঁধারের সূত্রপাত দেখিলেই পাখি যেমন করিয়া নীড়ে ফিরিয়া আসে, ভূপতি সেইরূপ তাহার দীর্ঘদিনের সঞ্চরণক্ষেত্র পরিত্যাগ করিয়া অন্তঃপুরে চারুর কাছে চলিয়া আসিল। মনে মনে স্থির করিল, ‘বাস্, এখন আর-কোথাও নয়; এইখানেই আমার স্থিতি! যে কাগজের জাহাজটা লইয়া সমস্তদিন খেলা করিতাম সেটা ডুবিল, এখন ঘরে চলি।’
বোধ করি ভূপতির একটা সাধারণ সংস্কার ছিল, স্ত্রীর উপর অধিকার কাহাকেও অর্জন করিতে হয় না, স্ত্রী ধ্রুবতারার মতো নিজের আলো নিজেই জ্বালাইয়া রাখে–– হাওয়ায় নেবে না, তেলের অপেক্ষা রাখে না। বাহিরে যখন ভাঙচুর আরম্ভ হইল তখন অন্তঃপুরে কোনো খিলানে ফাটল ধরিয়াছে কি না তাহা একবার পরখ করিয়া দেখার কথাও ভূপতির মনে স্থান পায় নাই।
ভূপতি সন্ধ্যার সময় বর্ধমান হইতে বাড়ি ফিরিয়া আসিল। তাড়াতাড়ি মুখহাত ধুইয়া সকাল সকাল খাইল। অমলের বিবাহ ও বিলাতযাত্রার আদ্যোপান্ত বিবরণ শুনিবার জন্য স্বভাবতই চারু একান্ত উৎসুক হইয়া আছে স্থির করিয়া ভূপতি আজ কিছুমাত্র বিলম্ব করিল না। ভূপতি শোবার ঘরে বিছানায় গিয়া শুইয়া গুড়গুড়ির সুদীর্ঘ নল টানিতে লাগিল। চারু এখনো অনুপস্থিত, বোধ করি গৃহকার্য করিতেছে। তামাক পুড়িয়া শ্রান্ত ভূপতির ঘুম আসিতে লাগিল। ক্ষণে ক্ষণে ঘুমের ঘোর ভাঙিয়া চমকিয়া জাগিয়া উঠিয়া সে ভাবিতে লাগিল, এখনো চারু আসিতেছে না কেন। অবশেষে ভূপতি থাকিতে না পারিয়া চারুকে ডাকিয়া পাঠাইল। ভূপতি জিজ্ঞাসা করিল, “চারু, আজ যে এত দেরি করলে? ”
চারু তাহার জবাবদিহি না করিয়া কহিল, “হাঁ, আজ দেরি হইয়া গেল।”
চারুর আগ্রহপূর্ণ প্রশ্নের জন্য ভূপতি অপেক্ষা করিয়া রহিল; চারু কোনো প্রশ্ন করিল না। ইহাতে ভূপতি কিছু ক্ষুণ্ন হইল। তবে কি চারু অমলকে ভালোবাসে না। অমল যতদিন উপস্থিত ছিল ততদিন চারু তাহাকে লইয়া আমোদ-আহ্লাদ করিল, আর যেই চলিয়া গেল অমনি তাহার সম্বন্ধে উদাসীন! এইরূপ বিসদৃশ ব্যবহারে ভূপতির মনে খটকা লাগিল, সে ভাবিতে লাগিল–– তবে কি চারুর হৃদয়ের গভীরতা নাই। কেবল সে আমোদ করিতেই জানে, ভালোবাসিতে পারে না? মেয়েমানুষের পক্ষে এরূপ নিরাসক্ত ভাব তো ভালো নয়।
চারু ও অমলের সখিত্বে ভূপতি আনন্দ বোধ করিত। এই দুইজনের ছেলেমানুষি আড়ি ও ভাব, খেলা ও মন্ত্রণা তাহার কাছে সুমিষ্ট কৌতুকাবহ ছিল; অমলকে চারু সর্বদা যে যত্ন আদর করিত তাহাতে চারুর সুকোমল হৃদয়ালুতার পরিচয় পাইয়া ভূপতি মনে মনে খুশি হইত। আজ আশ্চর্য হইয়া ভাবিতে লাগিল, সে সমস্তই কি ভাসা-ভাসা, হৃদয়ের মধ্যে তাহার কোনো ভিত্তি ছিল না? ভূপতি ভাবিল, চারুর হৃদয় যদি না থাকে তবে কোথায় ভূপতি আশ্রয় পাইবে।
অল্পে অল্পে পরীক্ষা করিবার জন্য ভূপতি কথা পাড়িল, “চারু, তুমি ভালো ছিলে তো? তোমার শরীর খারাপ নেই? ”
চারু সংক্ষেপে উত্তর করিল, “ভালোই আছি।”
ভূপতি। অমলের তো বিয়ে চুকে গেল।
এই বলিয়া ভূপতি চুপ করিল; চারু তৎকালোচিত একটা কোনো সংগত কথা বলিতে চেষ্টা করিল, কোনো কথাই বাহির হইল না; সে আড়ষ্ট হইয়া রহিল।
ভূপতি স্বভাবতই কখনো কিছু লক্ষ্য করিয়া দেখে না–– কিন্তু অমলের বিদায়শোক তাহার নিজের মনে লাগিয়া আছে বলিয়াই চারুর ঔদাসীন্য তাহাকে আঘাত করিল। তাহার ইচ্ছা ছিল, সমবেদনায় ব্যথিত চারুর সঙ্গে অমলের কথা আলোচনা করিয়া সে হৃদয়ভার লাঘব করিবে।
ভূপতি। মেয়েটিকে দেখতে বেশ।–– চারু, ঘুমোচ্ছ?
চারু কহিল, “না।”
ভূপতি। বেচারা অমল একলা চলে গেল। যখন তাকে গাড়িতে উঠিয়ে দিলুম, সে ছেলেমানুষের মতো কাঁদতে লাগল–– দেখে এই বুড়োবয়সে আমি আর চোখের জল রাখতে পারলুম না। গাড়িতে দুজন সাহেব ছিল, পুরুষমানুষের কান্না দেখে তাদের ভারি আমোদ বোধ হল।
নির্বাণদীপ শয়নঘরে বিছানার অন্ধকারের মধ্যে চারু প্রথমে পাশ ফিরিয়া শুইল,তাহার পর হঠাৎ তাড়াতাড়ি বিছানা ছাড়িয়া চলিয়া গেল। ভূপতি চকিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, “চারু, অসুখ করেছে?”
কোনো উত্তর না পাইয়া সেও উঠিল। পাশে বারান্দা হইতে চাপা কান্নার শব্দ শুনিতে পাইয়া ত্রস্তপদে গিয়া দেখিল, চারু মাটিতে পড়িয়া উপুড় হইয়া কান্না রোধ করিবার চেষ্টা করিতেছে।
এরূপ দুরন্ত শোকোচ্ছ্বাস দেখিয়া ভূপতি আশ্চর্য হইয়া গেল। ভাবিল, চারুকে কী ভুল বুঝিয়াছিলাম। চারুর স্বভাব এতই চাপা যে, আমার কাছেও হৃদয়ের কোনো বেদনা প্রকাশ করিতে চাহে না। যাহাদের প্রকৃতি এইরূপ তাহাদের ভালোবাসা সুগভীর এবং তাহাদের বেদনাও অত্যন্ত বেশি। চারুর প্রেম সাধারণ স্ত্রীলোকদের ন্যায় বাহির হইতে তেমন পরিদৃশ্যমান নহে, ভূপতি তাহা মনে মনে ঠাহর করিয়া দেখিল। ভূপতি চারুর ভালোবাসার উচ্ছ্বাস কখনো দেখে নাই; আজ বিশেষ করিয়া বুঝিল, তাহার কারণ অন্তরের দিকেই চারুর ভালোবাসার গোপন প্রসার। ভূপতি নিজেও বাহিরে প্রকাশ করতে অপটু; চারুর প্রকৃতিতেও হৃদয়াবেগের সুগভীর অন্তঃশীলতার পরিচয় পাইয়া সে একটা তৃপ্তি অনুভব করিল।
ভূপতি তখন চারুর পাশে বসিয়া কোনো কথা না বলিয়া ধীরে ধীরে তাহার গায়ে হাত বুলাইয়া দিতে লাগিল। কী করিয়া সান্ত্বনা করিতে হয় ভূপতির তাহা জানা ছিল না–– ইহা সে বুঝিল না, শোককে যখন কেহ অন্ধকারে কণ্ঠ চাপিয়া হত্যা করিতে চাহে তখন সাক্ষী বসিয়া থাকিলে ভালো লাগে না।
চতুর্দশ পরিচ্ছেদ
ভূপতি যখন তাহার খবরের কাগজ হইতে অবসর লইল তখন নিজের ভবিষ্যতের একটা ছবি নিজের মনের মধ্যে আঁকিয়া লইয়াছিল। প্রতিজ্ঞা করিয়াছিল, কোনো প্রকার দুরাশা-দুশ্চেষ্টায় যাইবে না, চারুকে লইয়া পড়াশুনা ভালোবাসা এবং প্রতিদিনের ছোটোখাটো গার্হস্থ্য কর্তব্য পালন করিয়া চলিবে। মনে করিয়াছিল, যে-সকল ঘোরো সুখ সব চেয়ে সুলভ অথচ সুন্দর, সর্বদাই নাড়াচাড়ার যোগ্য অথচ পবিত্র নির্মল, সেই সহজলভ্য সুখগুলির দ্বারা তাহার জীবনের গৃহকোণটিতে সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বালাইয়া নিভৃত শান্তির অবতারণা করিবে। হাসি গল্প পরিহাস, পরস্পরের মনোরঞ্জনের জন্য প্রত্যহ ছোটোখাটো আয়োজন, ইহাতে অধিক চেষ্টা আবশ্যক হয় না অথচ সুখ অপর্যাপ্ত হইয়া উঠে।
কার্যকালে দেখিল, সহজ সুখ সহজ নহে। যাহা মূল্য দিয়া কিনিতে হয় না তাহা যদি আপনি হাতের কাছে না পাওয়া যায় তবে আর কোনোমতেই কোথাও খুঁজিয়া পাইবার উপায় থাকে না।
ভূপতি কোনোমতেই চারুর সঙ্গে বেশ করিয়া জমাইয়া লইতে পারিল না। ইহাতে সে নিজেকেই দোষ দিল। ভাবিল, ‘বারো বৎসর কেবল খবরের কাগজ লিখিয়া, স্ত্রীর সঙ্গে কী করিয়া গল্প করিতে হয় সে বিদ্যা একেবারে খোয়াইয়াছি।’ সন্ধ্যাদীপ জ্বালিতেই ভূপতি আগ্রহের সহিত ঘরে যায়–– সে দুই-একটা কথা বলে, চারু দুই-একটা কথা বলে, তার পরে কী বলিবে ভূপতি কোনোমতেই ভাবিয়া পায় না। নিজের এই অক্ষমতায় স্ত্রীর কাছে সে লজ্জা বোধ করিতে থাকে। স্ত্রীকে লইয়া গল্প করা সে এতই সহজ মনে করিয়াছিল অথচ মূঢ়ের নিকট ইহা এতই শক্ত! সভাস্থলে বক্তৃতা করা ইহার চেয়ে সহজ।
যে সন্ধ্যাবেলাকে ভূপতি হাস্যে কৌতুকে প্রণয়ে আদরে রমণীয় করিয়া তুলিবে কল্পনা করিয়াছিল, সেই সন্ধ্যাবেলা কাটানো তাহাদের পক্ষে সমস্যার স্বরূপ হইয়া উঠিল। কিছুক্ষণ চেষ্টাপূর্ণ মৌনের পর ভূপতি মনে করে ‘উঠিয়া যাই’— কিন্তু উঠিয়া গেলে চারু কী মনে করিবে এই ভাবিয়া উঠিতেও পারে না। বলে, “চারু, তাস খেলবে? ” চারু অন্য কোনো গতি না দেখিয়া বলে, আচ্ছা। বলিয়া অনিচ্ছাক্রমে তাস পাড়িয়া আনে, নিতান্ত ভুল করিয়া অনায়াসেই হারিয়া যায়–– সে খেলায় কোনো সুখ থাকে না।
ভূপতি অনেক ভাবিয়া একদিন চারুকে জিজ্ঞাসা করিল, “চারু, মন্দাকে আনিয়া নিলে হয় না? তুমি নিতান্ত একলা পড়েছ।”
চারু মন্দার নাম শুনিয়াই জ্বলিয়া উঠিল। বলিল, “না, মন্দাকে আমার দরকার নেই।”
ভূপতি হাসিল। মনে মনে খুশি হইল। সাধ্বীরা যেখানে সতীধর্মের কিছুমাত্র ব্যতিক্রম দেখে সেখানে ধৈর্য রাখিতে পারে না।
বিদ্বেষের প্রথম ধাক্কা সামলাইয়া চারু ভাবিল, মন্দা থাকিলে সে হয়তো ভূপতিকে অনেকটা আমোদে রাখিতে পারিবে। ভূপতি তাহার নিকট হইতে যে মনের সুখ চায় সে তাহা কোনোমতে দিতে পারিতেছে না, ইহা চারু অনুভব করিয়া পীড়া বোধ করিতেছিল। ভূপতি জগৎসংসারের আর-সমস্ত ছাড়িয়া একমাত্র চারুর নিকট হইতেই তাহার জীবনের সমস্ত আনন্দ আকর্ষণ করিয়া লইতে চেষ্টা করিতেছে, এই একাগ্র চেষ্টা দেখিয়া ও নিজের অন্তরের দৈন্য উপলব্ধি করিয়া চারু ভীত হইয়া পড়িয়াছিল। এমন করিয়া কতদিন কিরূপে চলিবে। ভূপতি আর কিছু অবলম্বন করে না কেন। আর-একটা খবরের কাগজ চালায় না কেন। ভূপতির চিত্তরঞ্জন করিবার অভ্যাস এ পর্যন্ত চারুকে কখনো করিতে হয় নাই, ভূপতি তাহার কাছে কোনো সেবা দাবি করে নাই, কোনো সুখ প্রার্থনা করে নাই, চারুকে সে সর্বতোভাবে নিজের প্রয়োজনীয় করিয়া তোলে নাই; আজ হঠাৎ তাহার জীবনের সমস্ত প্রয়োজন চারুর নিকট চাহিয়া বসাতে সে কোথাও কিছু যেন খুঁজিয়া পাইতেছে না। ভূপতির কী চাই, কী হইলে সে তৃপ্ত হয়, তাহা চারু ঠিকমত জানে না এবং জানিলেও তাহা চারুর পক্ষে সহজে আয়ত্তগম্য নহে।
ভূপতি যদি অল্পে অল্পে অগ্রসর হইত তবে চারুর পক্ষে হয়তো এত কঠিন হইত না। কিন্তু হঠাৎ এক রাত্রে দেউলিয়া হইয়া রিক্ত ভিক্ষাপাত্র পাতিয়া বসাতে সে যেন বিব্রত হইয়াছে।
চারু কহিল, “আচ্ছা, মন্দাকে আনিয়ে নাও, সে থাকলে তোমার দেখাশুনোর অনেক সুবিধে হতে পারবে।”
ভূপতি হাসিয়া কহিল, “আমার দেখাশুনো! কিছু দরকার নেই।”
ভূপতি ক্ষুণ্ণ হইয়া ভাবিল, ‘আমি বড়ো নীরস লোক, চারুকে কিছুতেই আমি সুখী করিতে পারিতেছি না।’
এই ভাবিয়া সে সাহিত্য লইয়া পড়িল। বন্ধুরা কখনো বাড়ি আসিলে বিস্মিত হইয়া দেখিত, ভূপতি টেনিসন, বাইরন, বঙ্কিমের গল্প এই সমস্ত লইয়া আছে। ভূপতির এই অকাল-কাব্যানুরাগ দেখিয়া বন্ধুবান্ধবেরা অত্যন্ত ঠাট্টাবিদ্রূপ করিতে লাগিল। ভূপতি হাসিয়া কহিল, “ভাই, বাঁশের ফুলও ধরে, কিন্তু কখন ধরে তার ঠিক নেই।”
একদিন সন্ধ্যাবেলায় শোবার ঘরে বড়ো বাতি জ্বালাইয়া ভূপতি প্রথমে লজ্জায় একটু ইতস্তত করিল; পরে কহিল, “একটা কিছু পড়ে শোনাব? ”
চারু কহিল, “শোনাও-না।”
ভূপতি। কী শোনাব।
চারু। তোমার যা ইচ্ছে।
ভূপতি চারুর অধিক আগ্রহ না দেখিয়া একটু দমিল। তবু সাহস করিয়া কহিল, “টেনিসন থেকে একটা কিছু তর্জমা করে তোমাকে শোনাই।”
চারু কহিল, “শোনাও।”
সমস্তই মাটি হইল। সংকোচ ও নিরুৎসাহে ভূপতির পড়া বাধিয়া যাইতে লাগিল, ঠিকমত বাংলা প্রতিশব্দ জোগাইল না। চারুর শূন্যদৃষ্টি দেখিয়া বোঝা গেল, সে মন দিতেছে না। সেই দীপালোকিত ছোটো ঘরটি, সেই সন্ধ্যাবেলাকার নিভৃত অবকাশটুকু তেমন করিয়া ভরিয়া উঠিল না।
ভূপতি আরো দুই-একবার এই ভ্রম করিয়া অবশেষে স্ত্রীর সহিত সাহিত্য-চর্চার চেষ্টা পরিত্যাগ করিল।
পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ
যেমন গুরুতর আঘাতে স্নায়ু অবশ হইয়া যায় এবং প্রথমটা বেদনা টের পাওয়া যায় না, সেইরূপ বিচ্ছেদের আরম্ভকালে অমলের অভাব চারু ভালো করিয়া যেন উপলব্ধি করিতে পারে নাই।
অবশেষে যতই দিন যাইতে লাগিল ততই অমলের অভাবে সাংসারিক শূন্যতার পরিমাণ ক্রমাগতই যেন বাড়িতে লাগিল। এই ভীষণ আবিষ্কারে চারু হতবুদ্ধি হইয়া গেছে। নিকুঞ্জবন হইতে বাহির হইয়া সে হঠাৎ এ কোন্ মরুভূমির মধ্যে আসিয়া পড়িয়াছে–– দিনের পর দিন যাইতেছে, মরুপ্রান্তর ক্রমাগতই বাড়িয়া চলিয়াছে। এ মরুভূমির কথা সে কিছুই জানিত না।
ঘুম থেকে উঠিয়াই হঠাৎ বুকের মধ্যে ধক্ করিয়া উঠে–– মনে পড়ে, অমল নাই। সকালে যখন সে বারান্দায় পান সাজিতে বসে, ক্ষণে ক্ষণে কেবলই মনে হয়, অমল পশ্চাৎ হইতে আসিবে না। এক-একসময় অন্যমনস্ক হইয়া বেশি পান সাজিয়া ফেলে, সহসা মনে পড়ে, বেশি পান খাইবার লোক নাই। যখনই ভাঁড়ারঘরে পদার্পণ করে মনে উদয় হয়, অমলের জন্য জলখাবার দিতে হইবে না। মনের অধৈর্য অন্তঃপুরের সীমান্তে আসিয়া তাহাকে স্মরণ করাইয়া দেয়, অমল কলেজ হইতে আসিবে না। কোনো একটা নূতন বই, নূতন লেখা, নূতন খবর, নূতন কৌতুক প্রত্যাশা করিবার নাই; কাহারও জন্য কোনো সেলাই করিবার, কোনো লেখা লিখিবার, কোনো শৌখিন জিনিস কিনিয়া রাখিবার নাই।
নিজের অসহ্য কষ্ট ও চাঞ্চল্যে চারু নিজে বিস্মিত। মনোবেদনার অবিশ্রাম পীড়নে তাহার ভয় হইল। নিজে কেবলই প্রশ্ন করিতে লাগিল, ‘কেন। এত কষ্ট কেন হইতেছে। অমল আমার এতই কী যে, তাহার জন্য এত দুঃখ ভোগ করিব। আমার কী হইল, এতদিন পরে আমার এ কী হইল। দাসী চাকর রাস্তার মুটেমজুরগুলাও নিশ্চন্ত হইয়া ফিরিতেছে, আমার এমন হইল কেন। ভগবান হরি, আমাকে এমন বিপদে কেন ফেলিলে।’
কেবলই প্রশ্ন করে এবং আশ্চর্য হয়, কিন্তু দুঃখের কোনো উপশম হয় না। অমলের সমৃতিতে তাহার অন্তর-বাহির এমনি পরিব্যাপ্ত যে, কোথাও সে পালাইবার স্থান পায় না।
ভূপতি কোথায় অমলের স্মৃতির আক্রমণ হইতে তাহাকে রক্ষা করিবে, তাহা না করিয়া সেই বিচ্ছেদব্যথিত স্নেহশীল মূঢ়
কেবলই অমলের কথাই মনে করাইয়া দেয়।
অবশেষে চারু একেবারে হাল ছাড়িয়া দিল–– নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করায় ক্ষান্ত হইল; হার মানিয়া নিজের অবস্থাকে অবিরোধে গ্রহণ করিল। অমলের স্মৃতিকে যত্নপূর্বক হৃদয়ের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করিয়া লইল।
ক্রমে এমনি হইয়া উঠিল, একাগ্রচিত্তে অমলের ধ্যান তাহার গোপন গর্বের বিষয় হইল–– সেই স্মৃতিই যেন তাহার জীবনের শ্রেষ্ঠ গৌরব।
গৃহকার্যের অবকাশে একটা সময় সে নির্দিষ্ট করিয়া লইল। সেই সময় নির্জনে গৃহদ্বার রুদ্ধ করিয়া তন্ন তন্ন করিয়া অমলের সহিত তাহার নিজ জীবনের প্রত্যেক ঘটনা চিন্তা করিত। উপুড় হইয়া বালিশের উপর মুখ রাখিয়া বার বার করিয়া বলিত, “অমল, অমল, অমল!” সমুদ্র পার হইয়া যেন শব্দ আসিত, “বোঠান, কী বোঠান।” চারু সিক্ত চক্ষু মুদ্রিত করিয়া বলিত, “অমল, তুমি রাগ করিয়া চলিয়া গেলে কেন। আমি তো কোনো দোষ করি নাই। তুমি যদি ভালোমুখে বিদায় লইয়া যাইতে, তাহা হইলে বোধ হয় আমি এত দুঃখ পাইতাম না।” অমল সম্মুখে থাকিলে যেমন কথা হইত চারু ঠিক তেমনি করিয়া কথাগুলি উচ্চারণ করিয়া বলিত, “অমল, তোমাকে আমি একদিনও ভুলি নাই। একদিনও না, একদণ্ডও না। আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ পদার্থ সমস্ত তুমিই ফুটাইয়াছ, আমার জীবনের সারভাগ দিয়া প্রতিদিন তোমার পূজা করিব।”
এইরূপে চারু তাহার সমস্ত ঘরকন্না তাহার সমস্ত কর্তব্যের অন্তঃস্তরের তলদেশে সুড়ঙ্গ খনন করিয়া সেই নিরালোক নিস্তব্ধ অন্ধকারের মধ্যে অশ্রুমালাসজ্জিত একটি গোপন শোকের মন্দির নির্মাণ করিয়া রাখিল। সেখানে তাহার স্বামী বা পৃথিবীর আর-কাহারও কোনো অধিকার রহিল না। সেই স্থানটুকু যেমন গোপনতম, তেমনি গভীরতম, তেমনি প্রিয়তম। তাহারই দ্বারে সে সংসারের সমস্ত ছদ্মবেশ পরিত্যাগ করিয়া নিজের অনাবৃত আত্মস্বরূপে প্রবেশ করে এবং সেখান হইতে বাহির হইয়া মুখোশখানা আবার মুখে দিয়া পৃথিবীর হাস্যালাপ ও ক্রিয়াকর্মের রঙ্গভূমির মধ্যে আসিয়া উপস্থিত হয়।
ষোড়শ পরিচ্ছেদ
এইরূপে মনের সহিত দ্বন্দ্ববিবাদ ত্যাগ করিযা চারু তাহার বৃহৎ বিষাদের মধ্যে একপ্রকার শান্তিলাভ করিল এবং একনিষ্ট হইয়া স্বামীকে ভক্তি ও যত্ন করিতে লাগিল। ভূপতি যখন নিদ্রিত থাকিত চারু তখন ধীরে ধীরে তাহার পায়ের কাছে মাথা রাখিয়া পায়ের ধূলা সীমন্তে তুলিয়া লইত। সেবাশুশ্রূষায় গৃহকর্মে স্বামীর লেশমাত্র ইচ্ছা সে অসম্পূর্ণ রাখিত না। আশ্রিত প্রতিপালিত ব্যক্তিদের প্রতি কোনোপ্রকার অযত্নে ভূপতি দুঃখিত হইত জানিয়া, চারু তাহাদের প্রতি আতিথ্যে তিলমাত্র ত্রুটি ঘটিতে দিত না। এইরূপে সমস্ত কাজকর্ম সারিয়া ভূপতির উচ্ছিষ্ট প্রসাদ খাইয়া চারুর দিন শেষ হইয়া যাইত।
এই সেবা ও যত্নেও ভগ্নশ্রী ভূপতি যেন নবযৌবন ফিরিয়া পাইল। স্ত্রীর সহিত পূর্বে যেন তাহার নববিবাহ হয় নাই, এতদিন পরে যেন হইল। সাজসজ্জায় হাস্যে পরিহাসে বিকশিত হইয়া সংসারের সমস্ত দুর্ভাবনাকে ভূপতি মনের একপাশে ঠেলিয়া রাখিয়া দিল। রোগ-আরামের পর যেমন ক্ষুধা বাড়িয়া উঠে, শরীরে ভোগশক্তির বিকাশকে সচেতনভাবে অনুভব করা যায়, ভূপতির মনে এতকাল পরে সেইরূপ একটা অপূর্ব এবং প্রবল ভাবাবেশের সঞ্চার হইল। বন্ধুদিগকে, এমন-কি, চারুকে লুকাইয়া ভূপতি কেবল কবিতা পড়িতে লাগিল। মনে মনে কহিল, ‘কাগজখানা গিয়া এবং অনেক দুঃখ পাইয়া এতদিন পরে আমি আমার স্ত্রীকে আবিষ্কার করিতে পারিয়াছি।’
ভূপতি চারুকে বলিল, “চারু, তুমি আজকাল লেখা একেবারেই ছেড়ে দিয়েছ কেন।”
চারু বলিল, “ভারি তো আমার লেখা।”
ভূপতি। সত্যি কথা বলছি, তোমার মতো অমন বাংলা এখনকার লেখকদের মধ্যে আমি তো আর কারও দেখি নি। ‘বিশ্ববন্ধু’তে যা লিখেছিল আমারও ঠিক তাই মত।
চারু। আঃ, থামো।
ভূপতি “এই দেখো-না” বলিয়া একখণ্ড ‘সরোরুহ’ বাহির করিয়া চারু ও অমলের ভাষার তুলনা করিতে আরম্ভ করিল। চারু আরক্তমুখে ভূপতির হাত হইতে কাগজ কাড়িয়া লইয়া অঞ্চলের মধ্যে আচ্ছাদন করিয়া রাখিল।
ভূপতি মনে মনে ভাবিল, ‘লেখার সঙ্গী একজন না থাকিলে লেখা বাহির হয় না; রোসো, আমাকে লেখাটা অভ্যাস করিতে হইবে, তাহা হইলে ক্রমে চারুরও লেখার উৎসাহ সঞ্চার করিতে পারিব।’
ভূপতি অত্যন্ত গোপনে খাতা লইয়া লেখা অভ্যাস করিতে আরম্ভ করিল। অভিধান দেখিয়া পুনঃপুনঃ কাটিয়া, বারবার কাপি করিয়া ভূপতির বেকার অবস্থার দিনগুলি কাটিতে লাগিল। এত কষ্টে এত চেষ্টায় তাহাকে লিখিতে হইতেছে যে, সেই বহু দুঃখের রচনাগুলির প্রতি ক্রমে তাহার বিশ্বাস ও মমতা জন্মিল।
অবশেষে একদিন তাহার লেখা আর-একজনকে দিয়া নকল করাইয়া ভূপতি স্ত্রীকে লইয়া দিল। কহিল, “আমার এক বন্ধু নতুন লিখতে আরম্ভ করেছে। আমি তো কিছু বুঝি নে, তুমি একবার পড়ে দেখো দেখি তোমার কেমন লাগে।”
খাতাখানা চারুর হাতে দিয়া সাধ্বসে ভূপতি বাহিরে চলিয়া জেল। সরল ভূপতির এই ছলনাটুকু চারুর বুঝিতে বাকি রইল না।
পড়িল; লেখার ছাঁদ এবং বিষয় দেখিয়া একটুখানি হাসিল। হায়! চারু তাহার স্বামীকে ভক্তি করিবার জন্য এত আয়োজন করিতেছে, সে কেন এমন ছেলেমানুষি করিয়া পূজার অর্ঘ্য ছড়াইয়া ফেলিতেছে। চারুর কাছে বাহবা আদায় করিবার জন্য তাহার এত চেষ্টা কেন। সে যদি কিছুই না করিত, চারুর মনোযোগ আকর্ষণের জন্য সর্বদাই তাহার যদি প্রয়াস না থাকিত, তবে স্বামীর পূজা চারুর পক্ষে সহজসাধ্য হইত। চারুর একান্ত ইচ্ছা, ভূপতি কোনো অংশেই নিজেকে চারুর অপেক্ষা ছোটো না করিয়া ফেলে।
চারু খাতাখানা মুড়িয়া বালিশে হেলান দিয়া দূরের দিকে চাহিয়া অনেকক্ষণ ধরিয়া ভাবিতে লাগিল। অমলও তাহাকে নূতন লেখা পড়িবার জন্য আনিয়া দিত।
সন্ধ্যাবেলায় উৎসুক ভূপতি শয়নগৃহের সম্মুখবর্তী বারান্দায় ফুলের টব-পর্যবেক্ষণে নিযুক্ত হইল, কোনো কথা জিজ্ঞাসা করিতে সাহস করিল না।
চারু আপনি বলিল, “এ কি তোমার বন্ধুর প্রথম লেখা।”
ভূপতি কহিল, “হাঁ”
চারু। এত চমৎকার হয়েছে–– প্রথম লেখা বলে মনেই হয় না।
ভূপতি অত্যন্ত খুশি হইয়া ভাবিতে লাগিল, বেনামি লেখাটায় নিজের নামজারি করা যায় কী উপায়ে।
ভূপতির খাতা ভয়ংকর দ্রুতগতিতে পূর্ণ হইয়া উঠিতে লাগিল। নাম প্রকাশ হইতে বিলম্ব হইল না।
সপ্তদশ পরিচ্ছেদ
বিলাত হইতে চিঠি আসিবার দিন কবে, এ খবর চারু সর্বদাই রাখিত। প্রথমে এডেন হইতে ভূপতির নামে একখানা চিঠি আসিল, তাহাতে অমল বউঠানকে প্রণাম নিবেদন করিয়াছে; সুয়েজ হইতেও ভূপতির চিঠি আসিল, বউঠান তাহার মধ্যেও প্রণাম পাইল। মাল্টা হইতে চিঠি পাওয়া গেল, তাহাতেও পুনশ্চ-নিবেদনে বউঠানের প্রণাম আসিল।
চারু অমলের একখানা চিঠিও পাইল না। ভূপতির চিঠিগুলি চাহিয়া লইয়া উলটিয়া পালটিয়া বারবার করিয়া পড়িয়া দেখিল–– প্রণামজ্ঞাপন ছাড়া আর কোথাও তাহার সম্বন্ধে আভাসমাত্রও নাই।
চারু এই কয়দিন যে একটি শান্ত বিষাদের চন্দ্রাতপচ্ছায়ার আশ্রয় লইয়াছিল অমলের এই উপেক্ষায় তাহা ছিন্ন হইয়া গেল। অন্তরের মধ্যে তাহার হৃৎপিণ্ডটা লইয়া আবার যেন ছেঁড়াছেঁড়ি আরম্ভ হইল। তাহার সংসারের কর্তব্যস্থিতির মধ্যে আবার ভূমিকম্পের আন্দোলন জাগিয়া উঠিল।
এখন ভূপতি এক-একদিন অর্ধরাত্রে উঠিয়া দেখে, চারু বিছানায় নাই। খুঁজিয়া খুঁজিয়া দেখে, চারু দক্ষিণের ঘরের জানালায় বসিয়া আছে। তাহাকে দেখিয়া চারু তাড়াতাড়ি উঠিয়া বলে, “ঘরে আজ যে গরম, তাই একটু বাতাসে এসেছি।”
ভূপতি উদ্বিগ্ন হইয়া বিছানায় পাখা টানার বন্দোবস্ত করিয়া দিল, এবং চারুর স্বাস্থ্যভঙ্গ আশঙ্কা করিয়া সর্বদাই তাহার প্রতি দৃষ্টি রাখিল। চারু হাসিয়া বলিত, “আমি বেশ আছি, তুমি কেন মিছামিছি ব্যস্ত হও।” এই হাসিটুকু ফুটাইয়া তুলিতে তাহার বক্ষের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করিতে হইত।
অমল বিলাতে পৌঁছিল। চারু স্থির করিয়াছিল, পথে তাহাকে স্বতন্ত্র চিঠি লিখিবার যথেষ্ট সুযোগ হয়তো ছিল না, বিলাতে পৌঁছিয়া অমল লম্বা চিঠি লিখিবে। কিন্তু সে লম্বা চিঠি আসিল না।
প্রত্যেক মেল আসিবার দিনে চারু তাহার সমস্ত কাজকর্ম কথাবার্তার মধ্যে ভিতরে ভিতরে ছট্ফট্ করিতে থাকিত। পাছে ভূপতি বলে, ‘তোমার নামে চিঠি নাই’ এইজন্য সাহস করিয়া ভূপতিকে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিতে পারিত না।
এমন অবস্থায় একদিন চিঠি আসিবার দিনে ভূপতি মন্দগমনে আসিয়া মৃদুহাস্যে কহিল, “একটা জিনিস আছে, দেখবে? ”
চারু ব্যস্তসমস্ত চমকিত হইয়া কহিল, “কই দেখাও।”
ভূপতি পরিহাসপূর্বক দেখাইতে চাহিল না।
চারু অধীর হইয়া ভূপতির চাদরের মধ্য হইতে বাঞ্ছিত পদার্থ কাড়িয়া লইবার চেষ্টা করিল। সে মনে মনে ভাবিল, ‘সকাল হইতেই আমার মন বলিতেছে, আজ আমার চিঠি আসিবেই–– এ কখনো ব্যর্থ হইতে পারে না।’
ভূপতির পরিহাসস্পৃহা ক্রমেই বাড়িয়া উঠিল; সে চারুকে এড়াইয়া খাটের চারি দিকে ফিরিতে লাগিল।
তখন চারু একান্ত বিরক্তির সহিত খাটের উপর চোখ ছল্ছল্ করিয়া তুলিল।
চারুর একান্ত আগ্রহে ভুপতি খুশি হইয়া চাদরের ভিতর হইতে নিজের রচনার খাতাখানা বাহির করিয়া তাড়াতাড়ি চারুর কোলে দিয়া কহিল, “রাগ কোরো না। এই নাও।”
অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ
অমল যদিও ভূপতিকে জানাইয়াছিল যে, পড়াশুনার তাড়ায় সে দীর্ঘকাল পত্র লিখিতে সময় পাইবে না, তবু দুই-এক মেল তাহার পত্র না আসাতে সমস্ত সংসার চারুর পক্ষে কণ্টকশয্যা হইয়া উঠিল।
সন্ধ্যাবেলায় পাঁচ কথার মধ্যে চারু অত্যন্ত উদাসীনভাবে শান্তস্বরে তাহার স্বামীকে কহিল, “আচ্ছা দেখো, বিলেতে একটা টেলিগ্রাফ করে জানলে হয় না, অমল কেমন আছে? ”
ভূপতি কহিল, “দুই হপ্তা আগে তার চিঠি পাওয়া গেছে, সে এখন পড়ায় ব্যস্ত।”
চারু। ওঃ, তবে কাজ নেই। আমি ভাবছিলুম, বিদেশে আছে, যদি ব্যামোস্যামো হয় –– বলা তো যায় না।
ভূপতি। নাঃ, তেমন কোনো ব্যামো হলে খবর পাওয়া যেত। টেলিগ্রাফ করাও তো কম খরচা নয়।
চারু। তাই নাকি। আমি ভেবেছিলুম, বড়ো জোর এক টাকা কি দু টাকা লাগবে।
ভূপতি। বল কী, প্রায় একশো টাকার ধাক্কা।
চারু। তা হলে তো কথাই নেই!
দিন দুয়েক পরে চারু ভূপতিকে বলিল, “আমার বোন এখন চুঁচড়োয় আছে, আজ একবার তার খবর নিয়ে আসতে পার? ”
ভূপতি। কেন। কোনো অসুখ করেছে নাকি?
চারু। না, অসুখ না, জানই তো তুমি গেলে তারা কত খুশি হয়।
ভূপতি চারুর অনুরোধে গাড়ি চড়িয়া হাবড়া-স্টেশন-অভিমুখে ছুটিল। পথে একসার গোরুর গাড়ি আসিয়া তাহার গাড়ি আটক করিল।
এমন সময় পরিচিত টেলিগ্রাফের হরকরা ভূপতিকে দেখিয়া তাহার হাতে একখানা টেলিগ্রাফ লইয়া দিল। বিলাতের টেলিগ্রাম দেখিয়া ভূপতি ভারি ভয় পাইল। ভাবিল, অমলের হয়তো অসুখ করিয়াছে। ভয়ে ভয়ে খুলিয়া দেখিল টেলিগ্রামে লেখা আছে, ‘আমি ভালো আছি।’
ইহার অর্থ কী। পরীক্ষা করিয়া দেখিল, ইহা প্রী-পেড টেলিগ্রামের উত্তর।
হাওড়া যাওয়া হইল না। গাড়ি ফিরাইয়া ভূপতি বাড়ি আসিয়া স্ত্রীর হাতে টেলিগ্রাম দিল।ভূপতির হাতে টেলিগ্রাম দেখিয়া চারুর মুখ পাংশুবর্ণ হইয়া গেল।
ভূপতি কহিল, “আমি এর মানে কিছুই বুঝিতে পারছি নে।” অনুসন্ধানে ভূপতি মানে বুঝিল। চারু নিজের গহনা বন্ধক রাখিয়া টাকা ধার করিয়া টেলিগ্রাফ পাঠাইয়াছিল
ভূপতি ভাবিল, এত করিবার দরকার ছিল না। আমাকে একটু অনুরোধ করিয়া ধরিলেই তো আমি টেলিগ্রাফ করিয়া দিতাম, চাকরকে দিয়া গোপনে বাজারে গহনা বন্ধক দিতে পাঠানো–– এ তো ভালো হয় নাই।
থাকিয়া থাকিয়া ভূপতির মনে কেবলই এই প্রশ্ন হইতে লাগিল, চারু কেন এত বাড়াবাড়ি করিল। একটা অস্পষ্ট সন্দেহ অলক্ষ্যভাবে তাহাকে বিদ্ধ করিতে লাগিল। সে সন্দেহটাকে ভূপতি প্রত্যক্ষভাবে দেখিতে চাহিল না, ভুলিয়া থাকিতে চেষ্টা করিল, কিন্তু বেদনা কোনোমতে ছাড়িল না।
ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ
অমলের শরীর ভালো আছে, তবু সে চিঠি লেখে না! একেবারে এমন নিদারুণ ছাড়াছাড়ি হইল কী করিয়া। একবার মুখোমুখি এই প্রশ্নটার জবাব লইয়া আসিতে ইচ্ছা হয়, কিন্তু মধ্যে সমুদ্র–– পার হইবার কোনো পথ নাই। নিষ্ঠুর বিচ্ছেদ, নিরুপায় বিচ্ছেদ, সকল প্রশ্ন সকল প্রতিকারের অতীত বিচ্ছেদ।
চারু আপনাকে আর খাড়া রাখিতে পারে না। কাজকর্ম পড়িয়া থাকে, সকল বিষয়েই ভুল হয়, চাকরবাকর চুরি করে; লোকে তাহার দীনভাব লক্ষ্য করিয়া নানাপ্রকার কানাকানি করিতে থাকে, কিছুতেই তার চেতনামাত্র নাই।
এমনি হইল, হঠাৎ চারু চমকিয়া উঠিত, কথা কহিতে কহিতে তাহাকে কাঁদিবার জন্য উঠিয়া যাইতে হইত, অমলের নাম শুনিবামাত্র তাহার মুখ বিবর্ণ হইয়া যাইত।
অবশেষে ভূপতিও সমস্ত দেখিল, এবং যাহা মুহূর্তের জন্য ভাবে নাই তাহাও ভাবিল–– সংসার একেবারে তাহার কাছে বৃদ্ধ শুষ্ক জীর্ণ হইয়া গেল।
মাঝে যে-কয়দিন আনন্দের উন্মেষে ভূপতি অন্ধ হইয়াছিল সেই কয়দিনের স্মৃতি ইহাকে লজ্জা দিতে লাগিল। যে অনভিজ্ঞ বানর জহর চেনে না তাহাকে ঝুঁটা পাথর দিয়া কি এমনি করিয়াই ঠকাইতে হয়।
চারুর যে-সকল কথায় আদরে ব্যবহারে ভূপতি ভুলিয়াছিল সেগুলো মনে আসিয়া তাহাকে ‘মূঢ়, মূঢ়, মূঢ়’ বলিয়া বেত মারিতে লাগিল।
অবশেষে তাহার বহু কষ্টের বহু যত্নের রচনাগুলির কথা যখন মনে উদয় হইল তখন ভূপতি ধরণীকে দ্বিধা হইতে বলিল। অঙ্কুশতাড়িতের মতো চারুর কাছে দ্রুতপদে গিয়া ভূপতি কহিল, “আমার সেই লেখাগুলো কোথায়।”
চারু কহিল, “আমার কাছেই আছে।”
ভূপতি কহিল, “সেগুলো দাও।”
চারু তখন ভূপতির জন্য ডিমের কচুরি ভাজিতেছিল, কহিল, “তোমার কি এখনই চাই।”
ভূপতি কহিল, “হাঁ এখনই চাই।”
চারু কড়া নামাইয়া রাখিয়া আলমারি হইতে খাতা ও কাগজগুলি বাহির করিয়া আনিল।
ভূপতি অধীরভাবে তাহার হাত হইতে সমস্ত টানিয়া লইয়া খাতাপত্র একেবারে উনানের মধ্যে ফেলিয়া দিল।
চারু ব্যস্ত হইয়া সেগুলো বাহির করিবার চেষ্টা করিয়া কহিল, “এ কী করলে।”
ভূপতি তাহার হাত চাপিয়া ধরিয়া গর্জন করিয়া বলিল, “থাক্।”
চারু বিস্মিত হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। সমস্ত লেখা নিঃশেষে পুড়িয়া ভস্ম হইয়া গেল।
চারু বুঝিল। দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল। কচুরিভাজা অসমাপ্ত রাখিয়া ধীরে ধীরে অন্যত্র চলিয়া গেল।
চারুর সম্মুখে খাতা নষ্ট করিবার সংকল্প ভূপতির ছিল না। কিন্তু ঠিক সামনেই আগুনটা জ্বলিতেছিল, দেখিয়া কেমন যেন তাহার খুন চাপিয়া উঠিল। ভূপতি আত্মসংবরণ করিতে না পারিয়া প্রবঞ্চিত নির্বোধের সমস্ত চেষ্টা বঞ্চনাকারিণীর সম্মুখেই আগুনে ফেলিয়া দিল।
সমস্ত ছাই হইয়া গেলে, ভূপতির আকস্মিক উদ্দামতা যখন শান্ত হইয়া আসিল তখন চারু আপন অপরাধের বোঝা বহন করিয়া যেরূপ গভীর বিষাদে নীরব নতমুখে চলিয়া গেল তাহা ভূপতির মনে জাগিয়া উঠিল–– সম্মুখে চাহিয়া দেখিল, ভূপতি বিশেষ করিয়া ভালোবাসে বলিয়াই চারু স্বহস্তে যত্ন করিয়া খাবার তৈরি করিতেছিল।
ভূপতি বারান্দার রেলিঙের উপর ভর দিয়া দাঁড়াইল। মনে মনে ভাবিতে লাগিল–– তাহার জন্য চারুর এই যে-সকল অশ্রান্ত চেষ্টা, এই যে-সমস্ত প্রাণপণ বঞ্চনা ইহা অপেক্ষা সকরুণ ব্যাপার জগৎসংসারে আর কি আছে। এই-সমস্ত বঞ্চনা এ তো ছলনাকারিণীর হেয় ছলনামাত্র নহে; এই ছলনাগুলির জন্য ক্ষতহৃদয়ের ক্ষতযন্ত্রণা চতুর্গুণ বাড়াইয়া অভাগিনীকে প্রতি দিন প্রতি মুহূর্তে হৃৎপিণ্ড হইতে রক্ত নিষ্পেষণ করিয়া বাহির করিতে হইয়াছে। ভূপতি মনে মনে কহিল, ‘হায় অবলা,হায় দুঃখিনী। দরকার ছিল না, আমার এ-সব কিছুই দরকার ছিল না। এতকাল আমি তো ভালোবাসা না পাইয়াও ‘পাই নাই’ বলিয়া জানিতেও পারি নাই–– আমার তো কেবল প্রুফ দেখিয়া, কাগজ লিখিয়াই চলিয়া গিয়াছিল; আমার জন্য এত করিবার কোনো দরকার ছিল না।’
তখন আপনার জীবনকে চারুর জীবন হইতে দূরে সরাইয়া লইয়া–– ডাক্তার যেমন সাংঘাতিক ব্যাধিগ্রস্ত রোগীকে দেখে, ভূপতি তেমনি করিয়া নিঃসম্পর্ক লোকের মতো চারুকে দূর হইতে দেখিল! ঐ একটি ক্ষীণশক্তি নারীর হৃদয় কী প্রবল সংসারের দ্বারা চারি দিকে আক্রান্ত হইয়াছে। এমন লোক নাই যাহার কাছে সকল কথা ব্যক্ত করিতে পারে, এমন কথা নহে যাহা ব্যক্ত করা যায়, এমন স্থান নাই যেখানে সমস্ত হৃদয় উদ্ঘাটিত করিয়া দিয়া সে হাহাকার করিয়া উঠিতে পারে–– অথচ এই অপ্রকাশ্য অপরিহার্য অপ্রতিবিধেয় প্রত্যহপুঞ্জীভূত দুঃখভার বহন করিয়া নিতান্ত সহজ লোকের মতো, তাহার সুস্থচিত্ত প্রতিবেশিনীদের মতো, তাহাকে প্রতিদিনের গৃহকর্ম সম্পন্ন করিতে হইতেছে।
ভূপতি তাহার শয়নগৃহে গিয়া দেখিল–– জানালার গরাদে ধরিয়া অশ্রুহীন অনিমেষদৃষ্টিতে চারু বাহিরের দিকে চাহিয়া আছে। ভূপতি আস্তে আস্তে তাহার কাছে আসিয়া দাঁড়াইল–– কিছু বলিল না, তাহার মাথার উপরে হাত রাখিল।
বিংশ পরিচ্ছেদ
বন্ধুরা ভূপতিকে জিজ্ঞাসা করিল, “ব্যাপারখানা কী। এত ব্যস্ত কেন।”
ভূপতি কহিল, “খররের কাগজ––”
বন্ধু। আবার খররের কাগজ? ভিটেমাটি খররের কাগজে মুড়ে গঙ্গার জলে ফেলতে হবে নাকি।
ভূপতি। না, আর নিজে কাগজ করছি নে।
বন্ধু। তবে?
ভূপতি। মৈশুরে একটা কাগজ বের হবে, আমাকে তার সম্পাদক করেছে।
বন্ধু। বাড়িঘর ছেড়ে একেবারে মৈশুরে যাবে? চারুকে সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছ?
ভূপতি। না, মামারা এখানে এসে থাকবেন।
বন্ধু। সম্পাদকি নেশা তোমার আর কিছুতেই ছুটল না
ভূপতি। মানুষের যা হোক একটা কিছু নেশা চাই।
বিদায়কালে চারু জিজ্ঞাসা করিল, “কবে আসবে? ”
ভূপতি কহিল, “তোমার যদি একলা বোধ হয়, আমাকে লিখো, আমি চলে আসব।”
বলিয়া বিদায় লইয়া ভূপতি যখন দ্বারের কাছ পর্যন্ত আসিয়া পৌঁছিল তখন হঠাৎ চারু ছুটিয়া আসিয়া তাহার হাত চাপিয়া ধরিল, কহিল, “আমাকে সঙ্গে নিয়ে যাও। আমাকে এখানে ফেলে রেখে যেয়ো না।”
ভূপতি থমকিয়া দাঁড়াইয়া চারুর মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। মুষ্টি শিথিল হইয়া ভূপতির হাত হইতে চারুর হাত খুলিয়া আসিল। ভূপতি চারুর নিকট হইতে সরিয়া বারান্দায় আসিল দাঁড়াইল।
ভূপতি বুঝিল, অমলের বিচ্ছেদস্মৃতি যে বাড়িকে বেষ্টন করিয়া জ্বলিতেছে চারু দাবানলগ্রস্ত হরিণীর মতো সে বাড়ি পরিত্যাগ করিয়া পালাইতে চায়।–– ‘কিন্তু, আমার কথা সে একবার ভাবিয়া দেখিল না? আমি কোথায় পলাইব। যে স্ত্রী হৃদয়ের মধ্যে নিয়ত অন্যকে ধ্যান করিতেছে, বিদেশে গিয়াও তাহাকে ভুলিতে সময় পাইব না? নির্জন বন্ধুহীন প্রবাসে প্রত্যহ তাহাকে সঙ্গদান করিতে হইবে? সমস্ত দিন পরিশ্রম করিয়া সন্ধ্যায় যখন ঘরে ফিরিব তখন নিস্তব্ধ শোকপরায়ণা নারীকে লইয়া সেই সন্ধ্যা কী ভয়ানক হইয়া উঠিবে। যাহার অন্তরের মধ্যে মৃতভার তাহাকে বক্ষের কাছে ধরিয়া রাখা, সে আমি কতদিন পারিব। আরো কত বৎসর প্রত্যহ আমাকে এমনি করিয়া বাঁচিতে হইবে! যে আশ্রয় চূর্ণ হইয়া ভাঙিয়া গেছে তাহার ভাঙা ইঁটকাঠগুলা ফেলিয়া যাইতে পারিব না, কাঁধে করিয়া বহিয়া বেড়াইতে হইবে?’
ভূপতি চারুকে আসিয়া কহিল, “না, সে আমি পারিব না।”
মুহূর্তের মধ্যে সমস্ত রক্ত নামিয়া গিয়া চারুর মুখ কাগজের মতো শুষ্ক সাদা হইয়া গেল, চারু মুঠা করিয়া খাট চাপিয়া ধরিল।
তৎক্ষণাৎ ভূপতি কহিল, “চলো চারু, আমার সঙ্গেই চলো।”
চারু বলিল, “না থাক্।”